নয়
সারারাত কোথাও না থেমে একটানা ছুটে চলল স্যাব, ভোরের দিকে পাশ কাটাল পিটসবার্গকে, তারপর আবার পশ্চিমমুখো হলো। দীর্ঘ প্রথম দিনে ওরা শুধু পেট পুজো আর গ্যাসোলিনের জন্যে থামল। আমেরিকায় পাঠাবার আগে পরীক্ষা করা হয়েছে গাড়িটাকে-এঞ্জিন, চাকা, ব্রেক, সব নিখুঁত-চার প্রস্থ পথ নিয়ে তৈরি চওড়া হাইওয়ে ধরে গাড়িটা যেন নিয়ন্ত্রণহীন জেট প্লেনের মত উড়ে চলেছে।
সন্ধে নামার আগেই স্প্রিঙফিল্ড, মিশৌরীর কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওরা। হাইওয়ে থেকে সরে এল রানা, গাড়ি নিয়ে ছোট একটা মোটেলে ঢুকল। আলাদা কেবিন ভাড়া নিল ওরা, রিটা মিসেস গ্রেগ লুগানিস হিসেবে, রানা নিজের আসল পরিচয়ে।
ইতিমধ্যে, এলিভেটরে বিপদ দেখা দেয়ার আগেই, ওদের কৌশল কি হবে রিটাকে জানিয়েছে রানা। ‘ঝান যদি আমার আসল পরিচয় না-ও জানে, রানা হিসেবেই ওখানে যেতে হবে আমাকে। ‘
পথে বিষয়টা নিয়ে আবার আলোচনা করেছে ওরা। উদ্বেগ প্রকাশ করে রিটা বলেছে, ‘ব্যাপারটা জুয়া খেলার মত হয়ে যায় না, রানা? তুমিই না বললে তোমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে হার্মিসের? আমার তো মনে হয় লুগানিসের ভূমিকায় যতদিন পারা যায়…’
মাথা নেড়ে রানা বলল, ‘ওদেরকে বোকা বানানো যাবে না। আমি যে লুগানিস নই তা যদি ওরা ইতিমধ্যে না-ও জেনে থাকে, জানতে খুব বেশি সময় নেবে না। তবে তুমি সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা চরিত্র। মিসেস লুগানিস সম্ভবত উতরে যেতে পারে। মাসুদ রানা মিসেস লুগানিসের নিরাপত্তার দিকটা দেখছে, এটা বিশ্বাস করানো অনেক সহজ হবে, তাতে আমরা কিছু সুবিধেও পেতে পারি।
মোটেলে পৌছুবার ঠিক আগে প্রসঙ্গটা আবার তুলল রিটা। ‘তুমি কিন্তু, রানা নিজেকে টার্গেট হিসেবে তুলে ধরছ। তোমার ভয় করছে না?’
‘করছে না মানে! তবে এ-ধরনের ঝুঁকি আগেও আমাকে নিতে হয়েছে।’ হঠাৎ হাসল রানা। তুমি কি সত্যি বিশ্বাস করো, রিটা, আমার আসল পরিচয় না জেনেই মলিয়ের ঝান খুন করার অমন ব্যাপক আয়োজন করেছিল? আমি লুগানিস নই জানে বলেই তো খুন করার চেষ্টা করল সে।
রানার দিকে তাকিয়ে থাকল রিটা, মুখে কথা নেই।
‘চিন্তা করে দেখো না,’ আবার বলল রানা। ‘প্রথমে ভয়ালদর্শন একদল লোক পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানাল, আর কেউ দেখার আগে হোগার্থ প্রিন্টগুলো মলিয়ের ঝান দেখতে চায়। তারপর কি হলো? আমরা পালালাম। লক্ষ করো, ওরা পুলিসের কাছে গেল না, ওয়াশিংটনের কাছাকাছি ওরা নিজেরাই খুঁজে বের করল আমাদের-হার্মিসের কাজের ধরনই এরকম। খুঁজে বের করল, কিন্তু সরাসরি গুলি করে মারার চেষ্টা করল না। মারার চেষ্টা করল এলিভেটর ফেলে দিয়ে। আরও লক্ষ করো, হোগার্থ প্রিন্ট সম্পর্কে আর কোন আগ্রহ দেখাল না।’
মাথা ঝাঁকাল রিটা। ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু তবু ব্যাপারটা পাগলামি…হঠাৎ করে ঝানের কুখ্যাত র্যাঞ্চে গিয়ে পড়া…
‘ছাগলও বাঘকে ধরতে পারে…আমি রশি বাঁধা ছাগলের কথা বলছি।
‘তা হয়তো পারে,’ বলল রিটা। ‘কিন্তু ভুলো না ছাগলকে বলিও দেয়া হয়-জবাই করে।’
‘আমরা ছাগলরা দুর্ভাগা।’ রানার ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। ‘তবে, রিটা, আমরা যাচ্ছি সাথে ছুরি নিয়ে। আসল ব্যাপার হলো আমার কোন বিকল্প নেই। আমাদের কাজটা হলো, মলিয়ের ঝান গোটা ব্যাপারটা পরিচালনা করছে কিনা জানা। হার্মিসকে সত্যি যদি নতুন করে গড়ে তোলা হয়ে থাকে তাহলে ওরা কি করতে চাইছে সেটা জানা খুব জরুরী। আমরা নাক গলাচ্ছি, অন্যান্যদের মত। তারা খুন হয়েছে।’কেন?’
মোটেলের কামরায় ঢুকে পার্সেলগুলো খুলল ওরা, প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসই রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কেনা হয়েছে, একজোড়া সুটকেস সহ। কাজের ফাঁকে কয়েকটা সঙ্কেত শেখাল রানা রিটাকে, রাতে বিপদ দেখা দিলে ব্যবহার করা হবে।
রিটার কামরা থেকে বেরিয়ে এসে মোটেলটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল রানা, আশপাশের এলাকাও বাদ দিল না, বিশেষ করে চোখ বুলাল পার্ক করা গাড়িগুলোর ওপর। সন্তুষ্ট হয়ে নিজের কেবিনে ফিরে এল ও। সুটকেস থেকে বের করল নতুন একজোড়া জিনসের প্যান্ট, কটনশার্ট, বুট, আর একটা উইন্ডব্রেকার। এরপর শাওয়ার সারল-প্রথমে চামড়া ছেলা গরম, তারপর হিমশীতল ঠাণ্ডা পানিতে। ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর। ভি-পি-সেভেনটি চেক করল, সেটা ঢুকে গেল বালিশের তলায়। দরজার গায়ে ঠেকিয়ে দাঁড় করাল একটা চেয়ার, তারপর জানালা বন্ধ করে উঠল কোমল বিছানায়।
প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল রানা। বিশ্রাম নেয়া শিখতে হয়, এটা একটা আর্ট-মন থেকে ‘কিভাবে সমস্ত উদ্বেগ আর উত্তেজনা মুছে ফেলতে হয় জানা আছে ওর, এবং সেই সাথে ঘুমের মধ্যে কিভাবে নিজেকে একটা সীমা পর্যন্ত সজাগ রাখতে হয়, বিশেষ করে কোন অ্যাসাইনমেন্টে থাকার সময়, তা-ও জানা আছে। ঘুমটা গভীরই হলো, কিন্তু ওর অবচেতন মন জেগে থাকল, প্রয়োজনের মুহূর্তে ধাক্কা দিয়ে ওকে সচেতন করে তোলার জন্যে তৈরি।
রাতে কিছু ঘটল না, পরদিন দুপুরে ওকলাহোমা সিটিকে পাশ কাটাল ওরা। ইন্টিরিয়র এয়ার কন্ডিশনিঙে স্যাবের ভেতরটা ঠাণ্ডা, বাইরে প্রেইরী আর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তার, সেই একেবারে টেক্সাসের গ্রেট প্লেইনস-এর কিনারা পর্যন্ত চলে গেছে।
পথে আর মাত্র একবার যতটা কম সময়ের জন্যে পারা যায় থামল ওরা, তারপর বিকেলের দিকে অ্যামারিলোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল-পুরো শহরটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করে পশ্চিম দিকে চলে এল, ঢুকতে হলে এদিক থেকেই, কারণ রানার সন্দেহ নজর রাখার জন্যে পুবদিকের রাস্তাগুলোতেই লোক থাকবে।
আবারও ছোট একটা মোটেল বেছে নিল ওরা। গাড়ি থেকে নামতেই আগুনের আঁচ লাগল চোখে-মুখে। ইতিমধ্যে সন্ধে নামতে শুরু করেছে, একটা দুটো করে আলো জ্বলছে, চারদিকের শুকনো ঘাসের ভেতর থেকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে একটানা। আশপাশে মানুষজন কম নয়, নারী-পুরুষ সবাই জিনস পরে রয়েছে, পায়ে বুট, মাথায় চওড়া কার্নিস সহ ফেল্ট হ্যাট। খানিকটা বিপন্ন অনুভূতির সাথে রানা উপলব্ধি করল, সত্যি তারা পশ্চিমে পৌঁচেছে।
ম্যানেজার ওদেরকে পথ দেখিয়ে একজোড়া কামরায় নিয়ে এল, দুটোর মাঝখানে দরজা আছে। বলা হলো, রাস্তার ওপারে সেলুন আর ডাইনার আছে-যদি ওরা মোটেলের কফি শপ ব্যবহার করতে না চায়। যতক্ষণ ওদের সাথে থাকল লোকটা, একবারও দাঁতের ফাঁক থেকে চুরুটটা নামাল না।
‘কি, রিটা,’ জিজ্ঞেস করল রানা, ‘তোমার খিদে পায়নি?’
‘ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি চিবি…,’ কথাটার আরেকটা অর্থ আছে বুঝতে পেরে থেমে গেল রিটা, তাড়াতাড়ি বলল, ‘ভীষণ।
মুখহাত ধুয়ে দরজা বন্ধ করে খেতে বেরুল ওরা। মোটেলের কফি শপে প্রধান খাদ্য শূকুরের মাংস, জিভে জল যদি এসেও থাকে সেটা গোপন রাখতে পারল রিটা, রানার দেখাদেখি গোমাংসের অর্ডার দিল সে। খেতে খেতে কেউ তেমন কথা বলল না, তবে রিটাকে তার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার সময় রানা জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু হয়েছে? চিন্তিত কেন?
ক্ষীণ একটু হেসে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাল রিটা। ‘না, কই!’
দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করল রানা। ‘শুধু মনে রেখো, ট্রেনিঙের সময় তোমাকে খুব কম শেখানো হয়নি। তাছাড়া, শুরু থেকে বেশ ভালই উতরে এসেছি আমরা, তাই না? কি প্ল্যান করেছি মনে আছে তো? সিংহের খাঁচায় ঢুকছি দু’জন একসাথে, কিন্তু যদি সোনার সন্ধান পাই দু’জনের মধ্যে শুধু একজনের বেরিয়ে এলেই হবে। শুধু একটা খবর পৌঁছে দেয়া হয় তোমার কন্ট্যাক্টের কাছে, নয়তো আমার, কিংবা দু’জনের। এই অ্যাসাইনমেন্টে আমরা সমান পার্টনার, রিটা। আমাদের কাজ ওদেরকে কাবু করা, প্রমাণ সংগ্রহ করা, আর ওরা যদি কোন অশুভ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে থাকে সেটাকে বানচাল করা। মনে আছে তো, সকাল ঠিক ছ’টায়…?’
রিটা ঠোঁট কামড়াল।
‘কিছু বলবে?’
মাঝখানের খোলা দরজার কাছ থেকে সরে এসে রানার সামনে দাঁড়াল রিটা। ‘না, কি আর বলব!’ পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো সে, আলতো করে ঠোঁট বুলাল রানার চিবুক, তারপর নাকের পাশে। ‘একটু বেয়াড়া মেয়ে আমি, শুরুতেই কিছুটা দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি-আমার আর কি বলার থাকতে পারে। শুধু একটা কথা না বলে পারছি না-তুমি একটা সেকেলে গাধা!
হেসে ফেলল রানা। ‘তুমি কি আমাকে কিছু দান করতে চাইছ, রিটা? ভাবছ সাত রাজার ধন পেয়েও হারাচ্ছি?’
পিছিয়ে গেল রিটা, চোখে আগুন নিয়ে তাকিয়ে থাকল, তারপর ‘হুঁহ্,’ বলে সবেগে ঘুরল, পায়ের দুপ দাপ আওয়াজ তুলে চলে গেল নিজের কামরায়। কিন্তু দরজাটা বন্ধ করল না-ভুলে নাকি ইচ্ছে করে সে-ই জানে।
বিছানায় লম্বা হলো রানা, পুরোদস্তুর কাপড় পরে; হাতের কাছে অটোমেটিক নিয়ে চোখ বুজল, তারপর ঘুমিয়েও পড়ল। চমকে উঠে জাগল ও, ঠিক সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্মের শব্দে।
শাওয়ার সেরে দাড়ি কামাল রানা, কাপড় পরা শেষ করেছে এই সময় দরজায় এসে দাঁড়াল রিটা। তার এক হাতে কফি ভরা ফ্লাস্ক, অপর হাতে নাস্তার ট্রে। কফি শপ চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে, ব্যাখ্যা করল সে। ঠিক ছ’টায়, বিছানার ওপর পদ্মাসনে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে, ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল রানা-হেনরি ডুপ্রের দেয়া কার্ডের ওপর চোখ রেখে।
প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড রিঙ হলো। তারপর একজন সাড়া দিল, এতই চিকন আর তীক্ষ্ণ যে পুরুষকণ্ঠ কিনা বোঝা যায় না সহজে। ‘র্যাঞ্চ মলিয়ের ঝান।’
‘মলিয়ের ঝানকে দিন,’ বলল রানা, প্লীজ বা সম্মানসূচক আর কিছু বলল না। ‘আমার মনে হয় এখনও তিনি ঘুমাচ্ছেন। সাড়ে ছ’টার আগে তিনি জাগেন না।’
‘ঘুম ভাঙান। খুব গুরুত্বপূর্ণ কল।’
দীর্ঘ নীরবতার পর, ‘কে তার সাথে কথা বলতে চান?’
‘শুধু জানান আমি প্রফেসর লুগানিসের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমার সাথে মিসেস লুগানিস রয়েছেন। মলিয়ের ঝানের সাথে খুব জরুরী একটা আলাপ করতে চাই।’
অপরপ্রান্তে আবার নীরবতা, তারপর, ‘নামটা যেন কি বললেন…?’
‘বলিনি। আমি শুধু প্রফেসরের হয়ে কাজ করছি, কিন্তু ঝানকে যদি বলতেই চান, বলতে পারেন আমার নাম মাসুদ রানা।’
ঠিক বোঝা গেল না, তবে রানার মনে হলো হঠাৎ নিঃশ্বাস আটকানোর আওয়াজ পেল ও।
এরপর অবশ্য কোন বিরতি নয়; বুলেটের মত দ্রুত ছুটে এল জবাব, ‘মি. রানা, আমি এখুনি তাঁর ঘুম ভাঙাচ্ছি। একটু ধরুন, প্লীজ। আপনি যদি প্রফেসর লুগানিসের হয়ে কথা বলতে চান, তিনি অবশ্যই শুনতে চাইবেন।’
প্রায় এক মিনিট পর দ্বিতীয় একটা কণ্ঠস্বর পেল রানা। নরম গলা, ভদ্র সুর, হাসিখুশি। ‘মলিয়ের ঝান।’
রিটার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘আমার নাম রানা, মি. ঝান। মিসেস লুগানিস আমার সাথে রয়েছেন। প্রফেসর লুগানিসের পক্ষ থেকে পাওয়ার অভ অ্যাটর্নি দেয়া হয়েছে আমাকে…যতটুকু জানা আছে, তাঁর সাথে আপনি দেখা করতে চেয়েছিলেন।’
‘দেখা করতে চেয়েছিলাম.. হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, মি….কি…রানা বললেন, তাই না? হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমার প্রাইভেট জেটে চড়ে প্রফেসর আর মিসেস লুগানিসকে এখানে বেড়িয়ে যেতে বলেছিলাম। ধারণা করি, ওরা বোধহয় সুযোগ বা সময় করে উঠতে পারেননি। হোগার্থ প্রিন্টগুলো আপনার কাছে আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে পারি তো?’
‘মিসেস লুগানিস আর প্রিন্ট, দুটোই আছে।’
‘আহ্! খুশির খবর! আর পাওয়ার অভ অ্যাটর্নি? ওটার মানে কি আমরা কোন চুক্তিতে আসতে পারব?’
‘যদি সত্যিই আপনি তা চান, মি. ঝান।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মলিয়ের ঝান বলল, ‘প্রিন্টগুলো সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ওই একটা কাজই করতে চাই আমি। আপনি কোত্থেকে বলছেন?’
‘অ্যামারিলো,’ জবাব দিল রানা।
‘কোন হোটেলে? দাঁড়ান, এখুনি পিয়েরে ল্যাচাসিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি-সে আমার পার্টনার-আপনাদেরকে তুলে আনবে এখানে…’
বাধা দিল রানা। ‘আপনি শুধু বলুন কিভাবে পৌঁছুনো যায়। আমার সাথে গাড়ি আছে, ম্যাপও আছে।’
‘ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, মি. রানা…,’ ভরাট গলায় পথ-নির্দেশ দিল মলিয়ের ঝান-অ্যামারিলো ছেড়ে বেরুনো সহজ, তারপর হাইওয়ের নির্দিষ্ট একটা পয়েন্ট থেকে সেকেন্ডারি রোড ধরতে হবে, অনেকগুলো বাঁক আছে, একটু জটিল অবশেষে পাওয়া যাবে মনো-রেল স্টেশন।
‘যদি পারেন দশটার সময় থাকবেন ওখানে, আমি দেখব ট্রেনটা যেন আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করে। গাড়ির জন্যে ট্রেনে জায়গা আছে। আপনারটা র্যাঞ্চ পর্যন্ত আনা যাবে।’ মৃদু শব্দ করে হাসল মলিয়ের ঝান। ‘র্যাঞ্চটা ঘুরেফিরে দেখার জন্যে ওটা আপনার লাগবে।’
‘দশটায় পৌছুব আমরা।’ রিসিভার নামিয়ে রেখে রিটার দিকে ফিরল রানা। ‘বুঝলে, মিসেস লুগানিস, ঝানকে রীতিমত উৎফুল্ল মনে হলো। দশটায় মনো- রেলে চড়ব বলে আশা করছি। কথা শুনে তো মনে হলো নিপাট ভদ্রলোক।’ জানের পার্টনার পিয়েরে ল্যাচাসি সম্পর্কেও বলল ও, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কে লোকটা? কিছু জানো?‘
রিটা বলল তার সম্পর্কে একটা ফাইল আছে। পিয়েরে ল্যাচাসিকে ঝানের নিরীহ মোসাহেব বলা যেতে পারে, বহুকালের সঙ্গী। খুব ছোটবেলায় ঝান তাকে আইসক্রীম কারখানায় কাজ দেয়, সেই থেকে রয়ে গেছে। না, লোকটা সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। বর্তমানে সে ঝানের প্রভাবশালী সেক্রেটারি হতে পারে, যদিও ঝান তাকে সব সময় পার্টনার বলে পরিচয় দেয়।
সোয়া ন’টায় আবার ওরা রাস্তায় নামল। ঝানের সাথে কথা বলার সময় কাগজে কিছু নির্দেশ লিখেছে রানা, সেগুলো অনুসরণ করল রিটা। দু’জনেই লক্ষ করল, পিছনে ফেউ লেগেছে।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে চারদিকে সোনালি একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে, সেই আভায় পরিষ্কার দেখা গেল কালো একটা বি.এম.ডব্লিউ. ফাইভ-টু-এইট/আই ওদের পিছু পিছু আসছে, সামনের সীটে দু’জন লোক।
‘গার্ড অভ অনার?’ যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল রানা, মনে মনে ভাবল, গার্ড অভ অনার নাকি একটা হিট টীম? শান্তভাবে রিটার দিকে ঝুঁকে পড়ল ও, ড্যাশবোর্ডের কালো আর চৌকো বোতামে চাপ দিল। একটা কমপার্টমেন্ট খুলে যাবার পর দেখা গেল ভেতরে বড় একটা রুগার সুপার ব্ল্যাকহক পয়েন্ট ফরটি- ফোর ম্যাগনাম রয়েছে। গাড়িতে এটা সব সময় থাকে।
ফরটি-ফোর ম্যাগনাম শুধু যে মানুষকে থামাতে পারে তাই নয়, রানা এটাকে গাড়ি থামাবার উপযোগী বলেও মনে করে। ঠিক মত লক্ষ্যস্থির করা গেলে এই রিভলভার দিয়ে যে-কোন এঞ্জিনকে অকেজো করে দেয়া যায়।
‘কি সর্বনাশ…এ যে মস্ত বড়!’ বিস্ময় প্রকাশ করল রিটা।
‘যেমন রোগ তেমনি দাওয়াই,’ হাসতে হাসতে বলল রানা। ‘বলতে পারো এক্সট্রা প্রোটেকশন, যদি প্রয়োজন হয়।’
সময় বয়ে চলল, সেই সাথে জানা গেল ব্ল্যাকহক ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন নেই। কালো গাড়িটা পিছনে থাকল বটে, কিন্তু কাছে আসার চেষ্টা করল না। দশ মাইল দূরে থাকতেই মনো-রেল স্টেশন দেখতে পেল ওরা-নিচু একটা বিল্ডিং, কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে।
কাছাকাছি এসে ওরা দেখল, বেড়াটা প্রায় বিশ ফুট উঁচু। বেড়ার গায়ে ধুলোমাখা একটা নোটিশ বোর্ড ঝুলছে, তবে লাল হরফে লেখা সতর্কবাণী পরিষ্কার বোঝা গেল :
বিপদ
কাঁটাতারের বেড়া আর বেড়ার ও-পাশটা বিপজ্জনক।
বেড়া স্পর্শ করা বা খোঁচাখুঁচি করা অথবা ওপাশে যাওয়া
বিপজ্জনক, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটতে পারে।
নোটিশের নিচে লাল একটা খুলি আঁকা রয়েছে, তার নিচে দুটো হাড়; সেই সাথে বিদ্যুৎ-এর আন্তর্জাতিক চিহ্ন-জোড়া বিদ্যুৎচমকের ছবি। বেড়ার ওপারে যাবার একটাই পথ, বড়সড় ভারী লোহার গেট। গেটের ভেতর দিকে, খানিকটা দূরে, ছোট একটা ব্লকহাউস, সামনে প্রশস্ত কংক্রিট চাতাল, চাতালের শেষ মাথায় একতলা স্টেশন বিল্ডিং।
ব্লকহাউস থেকে দু’জন লোক বেরিয়ে এল। ইউনিফর্ম পরে আছে-হালকা বাদামী স্ন্যাকস, নীল শার্ট, শার্টের বুক পকেটের কাছে ব্যাজ, তাতে লেখা মলিয়ের সিকিউরিটি। কোমরে হোলস্টার, হোলস্টারে হ্যান্ডগান। কাঁধের সাথে একটা করে পাম্প-অ্যাকশন শটগান ঝুলছে।
ইলেকট্রিক উইন্ডো নামাল রানা। ‘আমাদের আসার কথা। মিসেস লুগানিস আর মি. রানা।’
‘মনো-রেল পৌছুবে দশটায়,’ উত্তর হলো। লোক দু’জনের বয়স আর চেহারা আলাদা করার উপায় নেই, সম্ভবত যমজ। দু’জনেই সাত ফুটের মত লম্বা হবে, শরীরের তুলনায় মাথা একটু যেন ছোট, চোখের চারপাশে নীল একটা ভাব।
ড্রাইভিং মিররে চোখ রেখে রানা দেখল, কালো বি.এম. ডব্লিউ এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ খানিকটা পিছনে। গাড়িটার আলো দু’বার জ্বলে উঠে নিভে গেল।
সঙ্কেত পেয়ে গেটের একজন লোক এক দলা থুথু ফেলল চাতালে। বোধহয় ঠিক আছে,’ টেক্সাসের আঞ্চলিক সুরে বলল সে, তাকাল সঙ্গীর দিকে, ইঙ্গিতে ব্লকহাউসটা দেখাল, ‘যাও, ইলেকট্রিসিটি অফ করো।’
‘কথাটা সত্যি?’ জিজ্ঞেস করল রানা, হাত বের করে নোটিশটা দেখাল।
‘বাজি ধরতে চাও?’
‘কেউ মারা গেছে কখনও?
বহু। র্যাঞ্চ কিনা, অনুমতি পাওয়া গেছে। কেউ যদি ইচ্ছে করে মরে, আইন আমাদের কি করবে! রাতে চারদিকে আমরা আলো জ্বেলে রাখি। পাওয়ার অফ করা হয় শুধু কেউ বেরুলে বা ঢুকলে। তুমি যদি প্রাইভেসী চাও, ডিয়ার ফ্রেন্ড, এখানে তার কোন অভাব নেই-যদি পেমেন্ট করার মুরোদ থাকে।
অপর লোকটা ব্লকহাউস থেকে বেরিয়ে এল। গেটের ভারী বোল্ট খুলল সে, তারপর দু’জন মিলে গেটের পাল্লা মেলে ধরল। ‘যত তাড়াতাড়ি পারো ঢুকে পড়ো,’ চিৎকার করে বলল একজন, এতক্ষণ সে-ই কথা বলছিল রানার সাথে। ‘বেশিক্ষণ ইলেকট্রিসিটি বন্ধ রাখলে মালিক রেগে যাবেন।’
সাবধানে গাড়ি চালিয়ে গেটের ভেতর, চাতালে চলে এল রানা, ঘাড় ফিরিয়ে গার্ডদের গেট বন্ধ করা দেখছে। একজন ব্লকহাউসে ঢুকে গেল। আয়নায় তাকিয়ে দেখল, বি.এম. ডব্লিউ অদৃশ্য হয়েছে। স্রেফ প্রহরী, ভাবল ও, অতিথি ঝান রাজ্যে নিরাপদে পৌঁছল কিনা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। হার্মিসের বৈশিষ্ট্যই এই, সব কাজের খুঁটিনাটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয়। ড্যাশবোর্ডের বোতামে আবার চাপ দিল রানা। হিস্ শব্দের সাথে ব্ল্যাকহক সহ কমপার্টমেন্টটা অদৃশ্য হয়ে গেল, পরমুহূর্তে রানার জানালায় উঁকি দিল প্রথম গার্ড।
‘তুমি জানো, তোমার স্টিয়ারিং উল্টো দিকে, ডিয়ার ফ্রেন্ড?’
মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে রানা বলল, ‘ইংলিশ কার…না, কার নয়, স্টিয়ারিং।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, শুনেছি বটে ওদিকের ওরা রঙ সাইডে গাড়ি চালায়।’ দশাসই টেক্সান এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। ‘দরজা দেখতে পাচ্ছ? গাড়ির নাক ওদিকে তাক করো, আর চুপচাপ বসে থাকো, কেমন? খবরদার, বেরুবে না-বেরুলেই মারা পড়বে। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো রানা।
চৌকো স্টেশন বিল্ডিঙের একদিকের দেয়াল দেখতে পাচ্ছে ওরা, বড় আকারের ধাতব দরজা রয়েছে।
‘এটা একটা পরিত্যক্ত স্টেশন,’ বলল রিটা। ‘পরে বোধহয় র্যাঞ্চ করার সময় কিনে নিয়েছে ঝান। তারমানে স্টেশনটাও তার নিজের সম্পত্তি, তা না হলে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারত না।’
‘হ্যাঁ, স্টেশনটাও র্যাঞ্চের একটা অংশ।
খানিক পর রিটা বলল, ‘সিকিউরিটি খুব কড়া।’
রিটা আগেই ব্রিফিং করেছিল, তাছাড়া হার্মিসের সিকিউরিটি কি ধরনের হতে পারে সে-সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল রানার, তবু আয়োজন আর কড়াকড়ির বহর দেখে প্রভাবিত হলো ও। ইলেকট্রিফায়েড কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত মনো- রেল ছাড়া র্যাঞ্চ মলিয়ের ঝানে প্রবেশ করার আর কোন পথ নেই। একমাত্র পথটা পাহারা দিচ্ছে শুধু ইলেকট্রিসিটি নয়, সশস্ত্র গার্ডরা। বি.এম. ডব্লিউ. গাড়িটা সম্পর্কে ভাবল রানা, ওদেরকে কি ওয়াশিংটন থেকে ফলো করা হয়েছে?
মাথায় এ-সব চিন্তা নিয়ে ওর গানমেটাল সিগারেট কেসটা বের করল রানা, অফার করল রিটাকে, রিটা প্রত্যাখ্যান করায় নিজে একটা ধরাল। উদ্বেগের অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি বিরক্ত করছে ওকে। ইংল্যান্ড থেকে রওনা হওয়ার সময় অনুভূতিটা ছিল না। রওনা হওয়ার পর অনেক ঘটনাই তো ঘটছে-নিউ ইয়র্কে ওদেরকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা হয়, ওয়াশিংটনে ফেলে দেয়া হয় এলিভেটর, তারপর টেক্সাসের পথে দীর্ঘ যাত্রা। এখন, ঝানের র্যাঞ্চে ঢোকার মুহূর্তে, উদ্বিগ্ন হওয়াটা শুভ লক্ষণ নয়। মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের একটা উপদেশ মনে পড়ে গেল রানার-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা ভাল, রানা; গোটা বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগো না।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দশটা এক মিনিটে রানা অনুভব করল, গাড়িটা সামান্য কাঁপছে। জানালার কাচ নামাবার পর টারবাইনের ভারী গুঞ্জন কানে এল। জিনিসটা যখন মলিয়ের ঝানের, অবশ্যই সিস্টেমটা শূন্যে ঝুলন্ত, দর্শনীয় কোন ব্যাপার হবে-বিশাল রেইলের ওপর ঝুলে আছে ট্রেন।
টারবাইনের গুঞ্জন বাড়তে থাকল।
ট্রেনটাকে ওরা আসতে দেখল না, তবে একজন গার্ড এগিয়ে গিয়ে ওদের দিকে মুখ করা দরজার পাশে দাঁড়াল, দেয়ালে আটকানো একটা বাক্সের ঢাকনি খুলে বোতাম টিপল সে। নিঃশব্দে খুলে গেল বিশাল লোহার দরজা।
লম্বা একটা র্যাম্প ক্রমশ উঁচু হতে হতে দরজার ভেতর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। গার্ড ইঙ্গিত দিল, স্টার্ট নিল স্যাব। ‘বিসমিল্লাহ বলো!’
‘বিসমিল্লাহ…,’ বলেই ঝট্ করে রানার দিকে তাকাল রিটা। ‘মানে?’
‘উনি তো একজনই,’ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল রানা, হাসছে। ‘কেউ বলতে পারবে না তিনি মুসলমান, ইহুদি বা খ্রিস্টান বা আর কিছু-যে-কোন এক নামে ডাকলেই হলো!’
‘ও, তুমি ঈশ্বরের কথা বলছ!’ বুঝতে পারায় রিটার পেশীতে ঢিল পড়ল। ‘বিসমিল্লাহ!’
র্যাম্প ধরে প্রায় বিশ ফুট উঠে এল স্যাব, এরপর সামনেটা সমতল। ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে একটা টানেলে ঢুকল গাড়ি, টানেল থেকে সরাসরি ট্রেনে।
আশপাশে কয়েকজন লোক দেখা গেল, গার্ডদের মত একই ইউনিফর্ম পরে আছে, তবে নীল শার্টের সাথে সোনালি ব্যাজে লেখা রয়েছে মলিয়ের সিকিউরিটির বদলে ‘মলিয়ের সার্ভিস’। তারাই রানাকে গাইড করল গাড়িটাকে ঠিক পজিশনে রাখার কাজে। তারপর তাদের একজন এগিয়ে এসে স্যাবের দরজা খুলল, সবিনয় ভদ্র সুরে বলল, ‘মিসেস লুগানিস, মি. রানা, ওয়েলকাম অ্যাবোর্ড। প্লীজ লিভ ইওর কার হিয়ার, উইথ দ্য হ্যান্ডব্রেক অন। ‘
ঝানের আরেকজন লোক রিটার জন্যে উল্টো দিকের দরজা খুলল। আবার যখন ওটা বন্ধ হলো, নিজের সীটে বসে থেকেই বোতাম টিপে সেটায় তালা লাগিয়ে দিল রানা। ইতিমধ্যে অটোমেটিক ডিভাইস-এরও বোতামে চাপ দিয়েছে রানা, ফলে ওর অনুপস্থিতিতে এঞ্জিনে কেউ হাত দিতে পারবে না। গাড়ি থেকে নামল ও, হাতে ব্রীফকেস, তারপর নিজের দিকের দরজায় তালা লাগাল।
লোকটা অনড় দাঁড়িয়ে থাকল, যেন পথ ছাড়বে না। ‘চাবিটা আমার কাছে নিরাপদ থাকবে, স্যার।’
‘আমার কাছে আরও বেশি নিরাপদ থাকবে!’ রানা হাসল না। ‘গাড়িটা যদি সরাবার দরকার হয়, আমার সাথে দেখা কোরো।’
এবার নড়ল লোকটা, তবে চেহারা আগের মতই ঠাণ্ডা আর নির্লিপ্ত। ‘আপনার জন্যে মি.. ল্যাচাসি অপেক্ষা করছেন, স্যার।’
ভেহিকেল কমপার্টমেন্টের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে মানুষ নয়, ওটা একটা কঙ্কাল। লম্বা তাল গাছ, গলার ওপর খুলি আর মুখে যেন স্বচ্ছ আলগা চামড়া টান টান করে সেঁটে দেয়া হয়েছে। এমনকি চোখ দুটো পর্যন্ত খোপের গভীরে সেঁধিয়ে আছে। জিন্দা লাশ বোধহয় একেই বলে।
‘মিসেস লুগানিস। মি. রানা। স্বাগতম।’
এ সেই চিকন, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, আজ সকালে টেলিফোনে শুনেছে রানা। সচল কঙ্কাল রানার দিকে একটা হাড্ডিসার হাত বাড়িয়ে দিল। রানা দেখল, হ্যান্ডশেক করার সময় নিজের অজান্তেই চোখ-মুখ কুঁচকে শিউরে উঠল রিটা। এক সেকেন্ড পর কারণটা রানাও বুঝতে পারল-আসলেও মনে হলো একটা লাশের হাত ধরল ও-ঠাণ্ডা, অসাড়, ভেজা ভেজা। একটু বেশি চাপ দিলে, রানার মনে হলো, গুঁড়ো হাড়ে ভর্তি হয়ে যাবে মুঠো।
ওদেরকে সুন্দর ডিজাইন করা একটা কোচে নিয়ে এল ল্যাচাসি। লেদারের তৈরি অনেকগুলো সুইভেল চেয়ার রয়েছে, টেবিলগুলো মেঝের সাথে আটকানো, সুন্দরী একজন হোস্টেস ওদেরকে পানীয় সার্ভ করার জন্যে এক পায়ে খাড়া।
ওরা বসতে না বসতে চলতে শুরু করল মনো-রেল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে স্পীড বাড়াল ড্রাইভার। রেল তো বটেই, কোচটা আরও উঁচুতে, এত ওপর থেকেও লাইনের দু’দিকে ইলেকট্রিফায়েড কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পেল রানা। ওদের চারদিকে মরুভূমি আর সমতল প্রান্তর দিগন্ত ছুঁয়েছে।
সামনে এগিয়ে এসে হোস্টেস জানতে চাইল কে কি চায় ওরা। ভোদকা মার্টিনি চাইল রানা। রিটা শেরি, ল্যাচাসিও তাই।
‘আপনার পছন্দের প্রশংসা করি,’ মন্তব্য করল ল্যাচাসি। ‘আ ভেরি সিভিলাইজড্ ড্রিঙ্ক, শেরি।’ হাসল বটে সে, কিন্তু তার যা মুখ তাতে হাসি ফোটেও না, মানায়ও না, কিংবা একেই বোধহয় ভৌতিক হাসি বলে। রানার মনে হলো, মৃত্যু যেন ভেঙচি কাটল।
যেন ওদের অস্বস্তি দূর করার জন্যেই আবার কথা বলল ল্যাচাসি, ‘আজ ঝান শুধু ভেহিকেল ট্র্যান্সপোর্টার আর ক্লাব কোচ রেখেছে ট্রেনে। আপনারা যখন বিদায় নেবেন, ও হয়তো বাছাইয়ের একটা সুযোগ দেবে।’
‘কিসের বাছাই?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘মনো-রেল কার,’ সাদা হাত দুটো দু’পাশে মেলে দিয়ে বলল ল্যাচাসি। ‘আপনারা বোধহয় জানেন না, ঝানের মধ্যে কিছু পাগলামি ভাব আছে। বিখ্যাত জিনিসের নকল রাখতে ভালবাসে ও। ওর এই রেল সিস্টেমে বিখ্যাত অনেক কোচ আছে, সব নকল-এই ধরুন রানী ভিক্টোরিয়ার বিশেষ রেলরোড কার, হ্যাঁ, সেটাও তৈরি করিয়েছে। তারপর ধরুন প্রেসিডেনশিয়াল কার, জার নিকোলাস যে কারটা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন, যে কোচে বসে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়রের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করা হয়-বিখ্যাত যে-কোন কারের নাম বলুন, ওর আছে। যেটায় যুদ্ধবিরতি সই করানো হয় সেটার অর্থাৎ আসলটার এখন আর কোন অস্তিত্বই নেই। ফ্রেঞ্চদেরকে ওটায় বসিয়ে শান্তিচুক্তি সই করায় হিটলার। পরে কোচটা নষ্ট হয়ে যায়।
‘জানি,’ হঠাৎ করে বলল রানা। মুখটা তো নরকের প্রতিচ্ছবি বটেই, কান ঝালাপালা করা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর স্নায়ুর ওপর যেন হাতুড়ির বাড়ি মারছে। ‘কিন্তু নকল কেন?’ সংক্ষেপে জানতে চাইল ও।
‘হ্যাঁ, খুব ভাল একটা প্রশ্ন করেছেন,’ পিয়েরে ল্যাচাসি বলল। ‘ঝান ইজ আ গ্রেট কালেক্টর। অমূল্য জিনিস সংগ্রহ করা ওর একটা বাতিক। তারমানে এ-কথা ভাববেন না যে আসল জিনিসের ওপর লোভ নেই ওর। রানী ভিক্টোরিয়ার রেনরোড কারটা কিনতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন ওরা ওটা বিক্রি করতে চায়নি বাকিগুলোও কেনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে ওগুলো বিক্রির জন্যে নয়।’
‘হুঁ।’ আর কিছু বলার মত খুঁজে পেল না রানা।
‘বাজারে যদি ভাল কোন জিনিস আসে, ঝান সেটা সবচেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে চায়, ফলে বেশিরভাগ জিনিস তার কপালেই জোটে। আপনারা এখানে কেন? ঝান হোগার্থ প্রিন্টগুলো চেয়েছে বলেই তো, নাকি?’
‘আরেকটু হলে এখানে আমাদের আসা হত না,’ মন্তব্য করল রানা, কিন্তু হয় ল্যাচাসি শুনতে না পাওয়ার ভান করল, নয় গুরুত্ব দিল না।
হাতে ট্রে নিয়ে ফিরে এল হোস্টেস মেয়েটা। নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে খুশি হলো রানা, নিজের হাতে তৈরি করা মার্টিনির কথা বাদ দিলে, এত ভাল জিনিসের স্বাদ আর কোথাও পায়নি ও।
রিটার সাথে কথা বলে চলেছে ল্যাচাসি, বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রানা। মনো-রেল নিশ্চয়ই ঘণ্টায় দেড়শো মাইল গতিতে ছুটছে অথচ কোচে বসে মনে হচ্ছে প্রান্তরের ওপর দিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে উড়ে চলেছে ওরা।
রেন্স ভ্রমণ শেষ হতে পনেরো মিনিটের সামান্য কিছু বেশি লাগল। ধীরে ধীরে কমে এল ট্রেনের গতি। কাছে আর দূরে কয়েক প্রস্থ কাঁটাতারের বেড়া দেখা গেল, তারপর উঁচু আর চওড়া একটা পাঁচিল, পাঁচিলের মাথায় কাঁটাতার, প্রায় বিশ ফুট পর্যন্ত উঠে গেছে।
পাঁচিলকে পাশ কাটিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মনো-রেল কার। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার, আকস্মিক নাটকীয়তার সাথে চারপাশের দৃশ্য বদলে গেল—চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ, প্রচুর গাছপালা, কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখার সুযোগ হলো, কারণ তারপরই ধনুকের মত বাঁকা স্টেশনের কয়েকটা সাদা দেয়াল ঘিরে ফেলল ওদেরকে।
‘আমার জন্যে আপনাদের গাড়িতে জায়গা হবে কি?’ রানার দিকে তাকাল ল্যাচাসি। রানাও তার দিকে তাকিয়ে আছে, রীতিমত একটা ধাক্কার সাথে উপলব্ধি করল কোটরে বসা চোখ দুটোয় প্রাণের কোন লক্ষণ নেই।
‘প্রচুর জায়গা,’ জবাব দিল ও।
‘গুড। স্টেশন থেকে পথ দেখাব আমি। মলিয়ের ঝান র্যাঞ্চ বেশ বড়, যদিও বড় বাড়িটা দেখতে না পাবার কোন কারণ নেই। স্টেশনের কাছেই।’
র্যাম্প থেকে নামার পর রানার মনে হলো সময় যেন পিছিয়ে গেছে, ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে গত শতাব্দীর ছোট একটা আমেরিকান রেলরোড স্টেশনের বাইরে। সন্দেহ নেই, ঝানের দুর্লভ সংগ্রহের মধ্যে এটাও একটা—ওয়েস্টার্ন কাহিনী থেকে তুলে আনা।
চারদিকে তাকাল রানা। কয়েক মিনিট আগে খয়েরি, রোদে পোড়া, মরু ঘাস দেখছিল ও। এখন, বিশাল পাঁচিল ডান আর বাম দিকে দ্রুত পিছিয়ে যাবার সময়, তাজা সবুজ ঘাস, গাছপালা, কৃত্রিম ঝর্না ইত্যাদি দেখতে পাচ্ছে। স্টেশন থেকে একটাই রাস্তা র্যাঞ্চের ভেতর দিকে চলে গেছে, রাস্তার দু’পাশে মাথা উঁচু করে রয়েছে সার সার গাছ, ছোট একটা নালার ওপর সুদৃশ্য ব্রিজ। এরপর মেইন রোডের আরও শাখা বেরিয়েছে।
‘ডান দিকে চলুন,’ বলল ল্যাচাসি। ‘তারপর মেইন ড্রাইভ ধরে সোজা ঢুকে পড়ন।’
ভয়ে নয়, বিস্ময়ে আঁতকে উঠল রিটা, আওয়াজটা শুনতে পেল রানা। ওদের সামনে, গাঢ় সবুজ মখমল বিছানো লনের মাঝখানে, প্রকাণ্ড একটা সাদা বাড়ি। চওড়া ধাপগুলো উঠে গেছে পোর্টিকোতে, পোর্টিকো থেকে চৌকো মোটা থামগুলো অনেক ওপরে সমতল ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। এই ছাদটাই পিছিয়ে গিয়ে গোটা বাড়িটাকে ঢেকে ফেলেছে। লাল টালির ছাদ। ধবধবে সাদা বাড়িটার মাথায় যেন আগুন জ্বলছে। বাড়ির সামনে ডগউড গাছ, গাড়ি-পথের দু’দিকে-রানার মনে হলো, কোথায় যেন ঠিক এই দৃশ্য আগেও দেখেছে ও।
‘টারা,’ ফিসফিস করে বলল রিটা। ‘এ টারা।
‘টারা?’ বুঝল না রানা।
‘গন উইথ দ্য উইন্ড। মার্গারেট মিচেল-এর বই—সিনেমা হয়েছে। সিনেমাতে আছে এই বাড়িটা। তুমি দেখোনি, রানা? ভিভিয়ান লিচ, ক্লার্ক গ্যাবল…
‘ওহ্-হো!’ মনে পড়ল রানার।
‘বাহ, ধরে ফেলেছেন দেখছি!’ ল্যাচাসির সরু গলা যেন কানের পর্দায় আঁচড় কাটল। ‘বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে আরও সময় নেয়। সিনেমায় বাড়িটা দেখার পর ঝান প্রেমে পড়ে যায়, বুঝলেন। এম.জি.এম-এর কাছ থেকে ডিজাইনটা কিনে নেয় ও। আহ্, ওই যে ওখানে-আমাদের ঝান!’
চওড়া ধাপগুলোর পাশে স্যাব দাঁড় করাল রানা, শেষ ধাপে বিশালদেহী মানুষটা নিঃশব্দ হাসির ঝর্না বিশেষ। কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক মাদকতা-যেমন উষ্ণ, তেমনি উদাত্ত।
‘মিসেস লুগানিস! আপনার স্বামীও কেন আসতে পারলেন না? আরে, ইনি নিশ্চয়ই মি. রানা! আসুন-আসুন, বারান্দায় বসে গলা ভেজানো যাক। লাঞ্চের আগে আমাদের হাতে প্রচুর সময়।’
মলিয়ের ঝানের মুখের রঙ লাল, চেহারায় আশ্চর্য সরলতা, বয়স্ক শিশু যেন। নাকি, ভাবল রানা, পরিণত শয়তান? স্যাব থেকে ধীরে ধীরে নামল ও। ঝানের বয়স আন্দাজ করা কঠিন, পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে হবে। মাথায় কালো চুল, পরচুলা কিনা কে জানে। তবে হাঁটা-চলায় প্রাণশক্তির প্রাচুর্য অনায়াসে ধরা পড়ে। শিশুসুলভ উৎসাহে সারাক্ষণ হাসছে। সব কিছু মিলিয়ে বানোয়াট একটা ব্যাপার-চেহারা, আচরণ দুটোই। এই লোকই কি নতুন সও মং? হার্মিসের নব নির্বাচিত নেতা?
‘আসুন, মিসেস লুগানিস,’ ঝানকে বলতে শুনল রানা, ‘… আসুন, মি. রানা। জানি আমরা টেক্সাসে রয়েছি, কিন্তু দুনিয়ার সেরা জুলিপ তৈরি করতে পারি আমি। কেমন লাগছে শুনতে? মিন্ট জুলিপ, টেক্সান স্টাইল!’ এবার সশব্দে, সংক্রামক হাসি উদ্গিরণ করল সে। টুকরো বরফ দিয়ে আপনি শুধু গ্লাস ভরবেন, তারপর জিন ঢালবেন, সাথে পুদিনার কয়েকটা পাতা।’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে, তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা আসছে কিনা।
হ্যাঁ, ধনকুবেরের চোখে চোখ রেখে ভাবল রানা, এ লোক নতুন সও মং হতে পারে। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এ-ধরনের একজন লোককেই সও মং নির্বাচিত করার কথা।
এরপর রানার চোখ পড়ল কঙ্কালসার পিয়েরে ল্যাচাসির দিকে, পোর্টিকোর রোদ আর ছায়ার মধ্যে উঁচু টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। নাকি ল্যাচাসি? মলিয়ের ঝানকে সামনে ঠেলে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে নতুন সও মং-পিয়েরে ল্যাচাসি? হার্মিস তার নেতার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার জন্যে এ- ধরনের কাভারের ব্যবস্থা করলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। সমস্ত সম্পত্তি আর ক্ষমতা হয়তো ল্যাচাসির হাতে রয়েছে, কিন্তু ভাব দেখানো হচ্ছে মলিয়ের ঝানই সর্বেসর্বা। হতে পারে না?
সিংহের গর্তে ঢোকার পর এখন সেটাই জানতে হবে রানাকে।