আট
চিৎকারের ভঙ্গিতে হাঁ করে আছে রিটা, কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না, মুখ নয় যেন আতঙ্কের মুখোশ। হালকা অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে তাকে দেখতে পেল রানা, চিৎকারের আওয়াজ পতন আর সংঘর্ষের বিকট শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে কিনা বুঝতে পারল না। এলিভেটর দুলছে, ধাক্কা খাচ্ছে শ্যাফটের দেয়ালে, সংঘর্ষের শব্দগুলো বিস্ফোরণের মত বাজছে কানে।
প্রথম কয়েক সেকেন্ড অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো রানার। মনের অর্ধেকটা যেন সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হয়ে থাকল। রিটার চিৎকার কানে ঢুকছে কিনা বুঝতে পারল না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছে কল্পনা করতেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। জানে নিচের দিকে সবেগে খসে পড়ছে এলিভেটর, কিন্তু মনে হলো এখনও শ্যাফটের মাথায় রয়েছে সে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরই নির্লিপ্ত ভাবটা কাটিয়ে উঠল রানা। ‘হোল্ড অন!’ গর্জে উঠল ও, তবে গর্জনটা আর সব শব্দে চাপা পড়ে গেল, তীব্র বাতাসের মত শোঁ শোঁ একটা আওয়াজ কানের ভেতর চাপ সৃষ্টি করছে। কারটা খসে পড়তে শুরু করার সময় রানার এক হাতের তালু আলগাভাবে হ্যান্ড রেইলের ওপর ছিল। কারের তিন দিকে একটা করে হ্যান্ড রেইল রয়েছে। প্রথম ঝাঁকির সময়,
দীর্ঘ পতন শুরু হবার আগেই, রেইলটাকে ভেতরে নিয়ে শক্ত মুঠো হয়ে যায় হাত-নিখাদ রিফ্লেক্স।
নিমেষের জন্যে এলিভেটরের একটা ছবি আলোর মত রানার সামনে জ্বলে উঠল-শ্যাফটের নিচে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে, চেনার কোন উপায় নেই।
বিশতলা থেকে, প্রতি মুহূর্তে পতনের গতি বাড়ছে, এক এক করে ছাড়িয়ে এল ওরা পনেরোতলা…চোদ্দ…তেরো…বারো…এগারো… শ্যাফটের কোথায় রয়েছে সে-সম্পর্কে অজ্ঞ, শুধু জানে অস্তিত্ব বিলীন হতে আর বেশি দেরি নেই। চূড়ান্ত, শেষ, সমাপ্তিসূচক সংঘর্ষ যে-কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে।
তারপর, ঘন ঘন কয়েকটা তীব্র ঝাঁকির সাথে, পাশগুলো মেটাল রানার-এর সাথে ঘষা খাওয়ায় কানের পর্দা ছেঁড়া ঘর্ঘর আওয়াজের সাথে; ব্যাপারটা ঘটল।
ওদিকে মেইন্টেন্যান্স কমপ্লেক্সে ইঁদুর দুটো কাজ সেরে লেজ তুলে পালাতে শুরু করেছে। বিল্ডিং থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া তাদের জন্যে কোন সমস্যা হবে না। এখন থেকে যে-কোন মুহূর্তে শ্যাফটের তলায় খসে পড়ে বিচ্ছিন্ন, চুরমার হয়ে যাবে এলিভেটর কার, আতঙ্কিত মানুষ কি ঘটেছে বুঝতে না পেরে আত্মরক্ষার জন্যে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি শুরু করবে। কিন্তু হেনরি ডুপ্রের জানার কোন উপায় নেই যে মোটেলের এলিভেটরগুলোয় পুরানো আমলের একটা অতিরিক্ত সেফটি ডিভাইস আছে, যেটা জটিল ইলেকট্রনিক্সের ওপর নির্ভরশীল নয়।
শ্যাফটের পুরোটা দৈর্ঘ্য জুড়ে দুটো মেটাল কেব্ল রয়েছে, পাওয়ার সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেও ওগুলোর কাজ করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকে। স্টীলের তার দিয়ে বানানো মোটা রশিগুলো এলিভেটর কারের তলায় ফিট করা ক্ল সেফটি ব্রেকগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়েছে, ঝুলে আছে আলগাভাবে। কার গতিসীমা লঙ্ঘন করায় ধাতব রশিতে টান পড়ল, চাপ সৃষ্টি করল ভেতর দিকে, ফলস্বরূপ এক জোড়া ক্ল সক্রিয় হয়ে উঠল, এলিভেটর কারের সামনের দুই প্রান্তে একটা করে।
খসে পড়তে শুরু করার প্রথম কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এই ‘শেষ সুযোগ’ অটোমেটিক ডিভাইসের একটা, কারের ডানদিকেরটা, ইস্পাতের সাথে সংঘর্ষে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেল। তবে বাম দিকের কে টিকে থাকল, ধীরে ধীরে ভেতর দিকে চাপ বাড়িয়ে চলেছে। অবশেষে, ওরা যখন এগারোতলা পেরিয়ে এল. সেফটি ব্রেক ক্লিক করে উঠল, সেই সাথে আপনাআপনি বাইরের দিকে ছুটল ক্লটা। যেন মানুষেরই একটা হাত ঁ গালের মধ্যে যা হোক একটা কিছু আঁকড়ে ধরার জন্যে ব্যাকুল, মেটাল ব্রেক গাইড রেইলের দাঁতাল চাকায় সজোরে বাড়ি খেলো, বেরিয়ে গেল চাকা ভেঙে, আঘাত করল দ্বিতীয়টায়, তারপর তৃতীয় একটার।
কারের ভেতর ঘন ঘন ঝাঁকি খেলো ওরা। গোটা প্ল্যাটফর্ম কাত হয়ে পড়ল ডান দিকে তবে ঝাঁকির সাথে মনে হলো অধো-গতি কমে আসছে। তারপর, কানের পর্দা ফাটানো শব্দের সাথে, ডান দিকে ঝুলে পড়ল কার। হ্যান্ড রেইল ধরে ওরা দু’জনেই রানা আর রিটা, দাঁড়িয়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। টের পেল, ছাদের একটা অংশ উড়ে গেল। গতি কমছিল, হঠাৎ হাড়-কাঁপানো প্রচণ্ড এক ঝাঁকির সাথে থেমে গেল কার, একই সঙ্গে কারের সামনের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে খসে পড়ল নিচের দিকে।
হ্যান্ড রেইল থেকে হাত ছুটে গেল রিটার।
এবার রানা তার চিৎকার শুনতে পেল। ছেঁড়া-ফাড়া ছাদ থেকে ম্লান আলো আসছে রিটাকে সামনের দিকে পিছলে যেতে দেখল ও, তার পা দুটো মেঝেতে সদ্য তৈরি ফাঁকের ভেতর গলে গেল। এখনও কঠিন মুঠোর ভেতর রেইলিং ধরে আছে রানা, ফাঁকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপর হাতের মুঠোয় চেপে ধরল ও রিটার কব্জি।
‘ঝুলে থাকো, রিটা! যা হোক কিছু একটা ধরো!’
মনে করল শান্তভাবেই কথা বলছে, কিন্তু ভুলটা ভাঙল বিকৃত প্রতিধ্বনি কানে ফিরে আসতে। যত দূর সম্ভব সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল রানা, পলকের জন্যে ঢিল করল মুঠো, তারপর আবার রিটার কব্জি ধরল, এবার আগের চেয়ে শক্ত আর ভালভাবে।
ওদের পায়ের নিচে গোটা কার ক্যাঁচ ক্যাঁচ করছে, মেঝেটা নিচের দিকে দেবে গেল, ফলে তলার দিকে পুরোটা শ্যাফট দৃষ্টিসীমার ভেতর চলে এল। রিটাকে সাহস দিচ্ছে রানা, অপর হাতটা তুলে ওর বাহু ধরতে বলছে, সেই সাথে ধীরে ধীরে তাকে টেনে কারের ওপর ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে।
রিটা মোটা নয়, তবু মনে হলো তার ওজন এক টনের কম হবে না। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে তুলছে রানা। অবশেষে হ্যান্ড রেইল নাগালের মধ্যে পেল রিটা। রানা তাকে তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করল, কারণ কারের মেঝে শুধু যে দেবে যাচ্ছে তাই নয়, ভেঙেও যাচ্ছে, যে-কোন মুহূর্তে পুরোটা নিচের দিকে খসে পড়তে পারে, হ্যান্ড রেইল সহ।
শ্যাফটের গায়ে অদ্ভুতভঙ্গিতে আটকে আছে কার, বলাই বাহুল্য নিরাপদ নয়, কখন যে খসে পড়বে কেউ বলতে পারে না। রানা শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, ওদের খানিকটা ভার কমাতে না পারলে বেঁচে থাকার আশা প্রতি মুহূর্তে কমতে থাকবে।
‘কিভাবে আমরা সাহায্য…,’ ক্ষীণকণ্ঠে শুরু করল রিটা।
‘কেউ সাহায্য করতে পারবে কিনা জানি না।
নিচের দিকে তাকাল রানা। ব্রীফকেসটা, অদ্ভুত ব্যাপার, এখনও ওদের সঙ্গ ত্যাগ করেনি—ওর দু’পায়ের মাঝখানে আটকে রয়েছে। অত্যন্ত সাবধানে নড়ে উঠল ও, ভঙ্গি’ বদলের প্রতিটি পর্যায়ে থামল, হাত বাড়াল ব্রীফকেসটার দিকে 1
সামান্য এই নড়াচড়াতেও প্রমাণ হয়ে গেল ঠিক একেবারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। এক চুল নড়লেই গুঙিয়ে উঠছে কার, দুলছে, ক্যাচক্যাচ করছে।
শান্তভাবে ব্যাখ্যা করল রানা এরপর কি করতে চায়। হ্যান্ড রেইলের ওপর ব্রীফকেসটা রেখে তালা খুলল ও। গোপন কমপার্টমেন্ট থেকে বেরুল নাইলন রোপ, গ্লাভ, পিকলক, অন্যান্য টুল আর ছোট একজোড়া গ্র্যাপলিং হুক।
অনেক ওজন ধরে রাখতে পারে হুক জোড়া। বন্ধ অবস্থায় প্রতিটি সাত ইঞ্চি লম্বা. বেস থেকে হুকের পয়েন্ট পর্যন্ত কমবেশি তিন ইঞ্চি, আর চওড়ায় প্রায় এক ইঞ্চি। একটাকে খুলতে হলে তিনটে পার্টের তালা খোলার দরকার হয়, খোলার সাথে সাথে আটটা ক্ল সহ একটা বৃত্তের আকৃতি পায় ওটা, বেস ঘিরে থাকা ইস্পাতের সাথে প্রতিটি আটকানো।
গ্লাভ পরেছে রানা। কোমরের বেল্টের সাথে একটা ফিতে ঝুলছে, টুল আর পিকলক ঝুলছে ফিতের গায়ে। এক হাতের বাহুতে পেঁচানো রয়েছে নাইলন রশি। ব্রীফকেস বন্ধ করল ও, ধরিয়ে দিল রিটার হাতে, বলল যে-কোন অবস্থায় ওটা নিজের সাথে রাখতে হবে।
গ্র্যাপলিং হুক জোড়া রশির সাথে আটকাল ও। সামনের দিকে ঝুঁকল, এক হাত দিয়ে ধরে আছে হ্যান্ড রেইল, ভাঙা মেঝের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকাল। শ্যাফটের পাশগুলো পরিষ্কার দেখতে পেল ও, গায়ে মেটাল গার্ডার গিজগিজ করছে।
বাঁ হাতে কুণ্ডলী পাকানো রশি নিল রানা, মেঝের সামনের ফাঁক দিয়ে গ্র্যাপলিং হুক নামিয়ে দিল নিচে। দু’তিনবার চেষ্টা করার পর কার থেকে প্রায় পাঁচ ফুট নিচে একটা গার্ডারের চারপাশে আটকাল ক্লগুলো। আস্তে-ধীরে রশি ছাড়তে শুরু করল রানা, একটা হিসাব পাবার চেষ্টা করছে কতটা রশি ছাড়লে কার আর গ্র্যাপলিং হুক ছাড়িয়ে নেমে যেতে পারবে সে।
গায়ে নাইলন পেঁচাল রানা- সাধারণ অ্যাবসেইল পদ্ধতিতে। ডান বগলের নিচে দিয়ে নেমে গেল রশি, পিঠ বেয়ে দু’পায়ের মাঝখানে ঢুকল, আবার উঠে এল বাঁ হাতে, বাম বগলের নিচে দিয়ে। ডাবল রোপ টেকনিক যদিও আরও নিরাপদ, হাতে সময় নেই।
নড়ে উঠতেই ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠল কার, নিজেকে সামনের দিকে পিছলে দিল রানা। বুকটা ধুকপুক করছে, ছাদটা না খসে পড়ে। কিন্তু ইতস্তত করার কোন মানে হয় না, বাঁচতে হলে এখুনি চেষ্টা করতে হবে। ফাঁকের কাছে যখন পৌঁছুল, গোটা কার কাপতে শুরু করল থর থর করে। পরমুহূর্তে কর্কশ আওয়াজ হলো, যেন ধাতব অবলম্বন, যেটায় আটকে আছে কার-সেটা জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ফাঁক গলে বেরিয়ে এল রানা, পতন শুরু হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ পাবার চেষ্টা করল ও, শ্যাফটের যথাসম্ভব নিরাপদ কিনারায় থাকতে চাইছে, শরীরটাকে লম্বা আর সোজা রাখল। মনে হলো কর্কশ ধাতব শব্দ গ্রাস করে ফেলবে ওকে। তারপর রশির আকস্মিক ঝাঁকিতে পিঠ, বগল আর পা ছড়ে গেল।
ঠিক যা ভয় করেছিল তাই ঘটল। পতনের গতিবেগ টান টান করল রশিটাকে; তারপর ঢিল পড়ল। বাচ্চাদের ইয়ো-ইয়োর মত ওপর দিকে উঠতে শুরু করল শরীরটা। রানা ভাবল, ওপর দিকে রশিটা যদি খুব বেশি লাফ দেয়, হুক থেকে ঝট করে বেরিয়ে আসবে এ্যাপল।
দ্বিতীয়বার পতন শুরু হলো, ভয়ে চোখ বুজল রানা। বিশ্বাস করতে পারছে না, তবে নিঃসন্দেহে ঝুলছে ও। কংক্রিট আর গার্ডারবহুল দেয়ালের বাড়ি খেতে খেতে দুলছে। অনুভব করল তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে পেশীগুলো। শরীরের ওজন তো আছেই, দুলতে থাকায় কব্জি আর হাতে রশির কামড় গভীর হতে থাকল।
ছোট, চারদিক আটকানো জগৎটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। বিবর্ণ, শ্যাওলা ধরা সিমেন্ট, গার্ডার, কোথাও কোথাও মরচে ধরেছে, তেল। নিচের দিকে তাকাল রানা, মনে হলো নরক ছাড়িয়ে আরও নিচে নেমে গেছে তলাটা।
রানার পা দেয়ালে শক্ত ঠাঁই খুঁজে-নিয়েছে, ওপর দিকে তাকাতে পারল ও। শ্যাফটের গায়ে কাত হয়ে আটকে গেছে এলিভেটর কার, কতক্ষণের জন্যে বলা অসম্ভব। এরই মধ্য কাঠ দিয়ে তৈরি ওপরের অংশে লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছে। গোটা অংশটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কাজটা যে হার্মিসের, এ-ব্যাপারে রানা নিশ্চিত। শুধু ওরাই মানুষকে দুনিয়া থেকে এমন জঘন্য উপায়ে বিদায় করে দিতে অভ্যস্ত। বড় একটা শ্বাস টেনে রিটাকে ডাকল ও। বলল, ‘তোমার কাছাকাছি আসছি আমি।
দেয়াল থেকে পা সরিয়ে নিয়ে, রশি ধরা হাত দুটোকে পিছলে যেতে দিল রানা, পা যাতে সবচেয়ে কাছের গার্ডারের নাগাল পায়। জুতোর তলায় গার্ডারের অস্তিত্ব অনুভব করল, রশি ধরে শরীরটাকে তুলল ও, প্রতিবার একটু একটু করে।
গ্র্যাপলিং হুকের কাছে পৌছল ও। দম নেয়ার জন্যে থামল এখানে। শ্যাফট টানেল থেকে ছুটে আসা বাতাসে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজের সাথে একটু একটু দুলছে কার। আওয়াজটাকে ছাপিয়ে উঠল আরও একটা শব্দ-নাকি শুনতে ভুল করছে-কারা যেন চিৎকার করছে, ভারী কিছু দিয়ে কি যেন ঠুকছে।
কারের ঝুলে থাকা মেঝে ওর মাথা থেকে পাঁচ ফুট ওপরে। হুক খুলে নিয়ে আরও ওপরে উঠল ও, গার্ডারগুলোর মাঝখানে ভাল একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে আবার একটায় হুক আটকাল, এবার কার থেকে এক ফুট নিচে।
শরীরটা ঘুরিয়ে দেয়ালে হেলান দিল ও, আবার ডাকল রিটাকে। ‘রশিটা ওপরে ছুঁড়ে দিচ্ছি। ব্রীফকেস বাঁধো, তারপর ধীরে ধীরে নামিয়ে দাও। কিন্তু রশি ছাড়বে না, আমি না বলা পর্যন্ত ধরে রাখো। পারবে?’
‘চেষ্টা…পারব।’
‘আরে, এ তো দেখছি লক্ষ্মী মেয়ে!’
কিন্তু হাসল না রিটা। ইতিমধ্যে হাতে কুণ্ডলী পাকানো সবটুকু রশি ছেড়ে দিয়েছে রানা, শ্যাফট ধরে প্রায় দৃষ্টিসীমার আড়ালে নেমে গেছে সেটা। গার্ডার ধরে এক হাতে ঝুলে থাকল ও, অপর হাতে কয়েক ফুট রশি আলগাভাবে পেঁচাল। তারপর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, ‘রেডি?’ রিটা জবাব দেয়ার সাথে সাথে কুণ্ডলী পাকানো হাতের রশি মেঝের ফাঁক লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল।
ছুটে গেল গোল পাকানো রশি। ফাঁক থেকে বেরিয়ে থাকা রশি পিছলে হড়হড় করে নেমে এল, মাত্র এক কি দু’সেকেন্ডের জন্যে। তারপর স্থির হলো সেটা, সেই সাথে ভেসে এল রিটার গলা।
‘ধরেছি!’
রশির মাথায় ব্রীফকেস বেঁধে নিচে নামিয়ে দিল সে। রশি ছাড়ছিল, ব্রীফকেসটা নাগালের মধ্যে চলে আসায় নিষেধ করল রানা। সাবধানে ব্রীফকেসটা গার্ডারের সাথে চেপে ধরল ও, গিট খুলে মুক্ত করল রশিটা। এরপর ওর বেল্টের বড় একটা ক্লিপের সাথে আটকে দিল ব্রীফকেসের হাতল। রশি টেনে নিতে বলল রিটাকে। ‘কোমরের চারপাশে আর কাঁধে জড়াও, তারপর ফাঁক গলে নেমে এসো-আস্তে-ধীরে-ভয় পাবার কিছু নেই।’
কতটা নামতে হবে?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল রিটা।
‘সামান্য,’ অভয় দিল রানা। ‘পরের ফ্লোর পনেরো ফুট নিচে হবে, ওখানে দরজাও আছে। পৌছুতে পারলে খানিক কার্নিস অন্তত পাব আমরা। চেষ্টা করা যাবে দরজা খোলার। এবার, নামতে শুরু করো।’
তাড়াতাড়ি নেমে এল রিটা। একটু বেশি তাড়াতাড়ি। তার পা দুটো বেরিয়ে আসতে দেখল রানা, রশিটা ওকে ছাড়িয়ে নেমে গেল। তারপর একটা ধাক্কা খেলো, রিটার কাঁধ বাড়ি মেরেছে ওকে।
রানা টের পেল এ্যাপলিঙে টান বাড়ছে, আর ঠিক ওর মাথার ওপর জায়গা বদল করছে কার। পরমুহূর্তে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ও, সাগরে পড়া মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে সে-ও তেমনি ঝুলে থাকা চঞ্চল রশিটাকে মুঠোর ভেতর পেতে চেষ্টা করছে।
রশিটা ধরে ফেলল রানা, দু’জনেই ওরা মৃদুমন্দ দুলছে, একজনের ওপর আরেকজন, প্রতিটি দোলার শেষ পর্যায়ে ধাক্কা খাচ্ছে শ্যাফটের দেয়ালের সাথে।
‘যেভাবে আছ সেভাবেই থাকো। তারমানে, তোমাকে আগে নামতে হবে, ‘ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা, দম ফুরিয়ে গেছে ওর। ‘নিচের দরজার কার্নিস পর্যন্ত। রশিটা বোধহয় ওই পর্যন্তই গেছে…’
নিচ থেকে রিটার গলা পাওয়া গেল, উত্তেজিত, ছিঁড়ে না গেলেই হয়…’
‘তোমার মত আরও পাঁচজন ঝুলে থাকলেও ছিঁড়বে না,’ ধমকের সুরে বলল রানা। ‘শুধু মনে রেখো, ছাড়া চলবে না।’
‘ছেড়ে দেব? পাগল নাকি!’ চেঁচিয়ে জবাব দিল রিটা, রশি ছাড়তে ছাড়তে নামতে শুরু করেছে এরইমধ্যে, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে।
রিটার সাথে, রশির নড়াচড়ার সাথে ছন্দ রেখে, ‘রানাও নামতে শুরু করল। এক সময় দেখল, ওর নিচে রিটা সরু একটা কার্নিসে দাঁড়িয়ে পড়েছে, রশিটা দু’হাতের ভেতর, পা দুটো ফাঁক করা, শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।
কাকে যেন কি বলছে রিটা।
কয়েক মুহূর্ত পর রানা পৌঁছতে বলল, ‘দরজার ওদিকে কারা যেন আছে। ওদের বললাম, আমরা এখানে আটকা পড়েছি।’
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার নামতে শুরু করল রানা, তারপর ওরও পা কার্নিসের নাগাল পেল। পরমুহূর্তে হিস্ আওয়াজের সাথে আউটার ডোর খুলে গেল। একজন ফায়ার চীফ, সাথে আরও তিনজন ইউনিফর্ম আর হেলমেট পরা লোক, একপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল ওদের, সবাই হাঁ করে আছে। চৌকাঠে পা রাখতে গিয়ে হোঁচট খেলো রানা, ওর একটা হাত আঁকড়ে ধরল রিটা। দু’জন ওরা একসাথে পা রাখল করিডরে।
‘ওহ্, থ্যাঙ্ক ইউ,’ এমন সুরে বলল রানা যেন কোন রাজা এই মাত্র দরজা খুলে দিল ওদেরকে, রিটার হাত সরিয়ে দিয়ে পা বাড়াতে গিয়ে আবার হোঁচট খাবার উপক্রম করল। সারা শরীরে ব্যথা, পেশী থেকে যেন সব শক্তি নিঙড়ে বের করে নেয়া হয়েছে। আবার তাকে ধরে ফেলল রিটা। বড় একটা শ্বাস টানল রানা।
ফায়ারম্যান আর মোটেল স্টাফরা ভিড় করল ওদের চারপাশে। হাত নেড়ে একজন ডাক্তারকে দূরে থাকতে বলল রানা, জানাল দেরি না করে আগে ওরা নিচতলায় নামতে চায়। ‘প্লেন ধরব, দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে,’ ব্যাখ্যা দিল ও।
নিচে নামার সময় রিটার কানে কার্নে পরামর্শ দিল রানা, ‘বিল মেটাবার সময় যা পারো জেনে নেবে। তারপর চুপিসারে পালিয়ে এসে স্যাবে উঠবে। আমরা চাই না খুব বেশি প্রশ্ন করা হোক-আর সাবধান, কেউ যেন ফটো তুলতে না পারে।’
চারপাশে ভিড় নিয়ে রিটা যখন নিচের লবিতে নেমে এল, ওদের সাথে কোথাও দেখা গেল না রানাকে। এমনকি রিটাও ওকে কেটে পড়তে দেখেনি। অদৃশ্য হবার নিজস্ব কৌশল ওটা আমার,’ পরে তাকে বলেছে রানা। ‘জানা থাকলে পানির মত সহজ একটা পদ্ধতি।
সহজ কিনা সেটা আসলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে, ভিড়ের মধ্যে মানুষ যখন হতভম্ব এবং অনিশ্চিত, নিজের ওপর তোমাকে শুধু আস্থাবান থাকতে হবে-দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব নিয়ে এগোও, নির্দিষ্ট একটা দিকে, চেহারায় ফুটিয়ে তোলো এমন একটা ভাব যেন তুমি ভালভাবেই জানো কোথায় আর কেন যাচ্ছ। প্রতি দশ বারে নয় বারই তাতে কাজ হয়।
আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে নেমে এসে স্যাবের দিকে সরাসরি গেল না রানা। এক জায়গায় দাঁড়াল ও, খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল, আড়াল থেকে ভাল করে দেখল গাড়িটাকে, তারপর অন্যান্য গাড়ির আড়ালে থেকে আস্তে-ধীরে এগোল। প্রায় আধ ঘণ্টা পর এল রিটা, সার্ভিস এলিভেটর থেকে নেমে ছুটে এল ওর দিকে।
তাকে একা দেখে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা।
‘বাথরূমে যাচ্ছি বলে পালিয়ে এসেছি,’ রানাকে বলল রিটা, একটু হাঁপাচ্ছে সে। ‘তোমাকেও ওরা খুঁজছে। বাপরে বাপ, কত রকম প্রশ্ন যে থাকতে পারে মানুষের মনে… বীমা করা আছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করা হয়েছে আমাকে। চলো, কেটে পড়ি, তা না হলে…’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্যাবে উঠে বসল ওরা, এক মিনিটের মাথায় বেরিয়ে এল মোটেল থেকে। অ্যানকোস্টিয়া ফ্রিওয়ে ধরে সগর্জনে ছুটল স্যার। ‘তুমি নেভিগেটর,’ রিটাকে বলল রানা। ‘আমরা অ্যামারিলো, টেক্সাসে যেতে চাই।’
পথ-নির্দেশ দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে সদ্য সংগ্রহ করা তথ্যগুলোও রানাকে জানিয়ে দিল রিটা! ‘অবশ্যই ওরা আমাদের নিউ ইয়র্কের বন্ধুরা। রিসেপশন ক্লার্কদের কাছ থেকে ওদের চেহারার বর্ণনা পেয়েছি।’ সব ব্যাখ্যা করল রিটা-পুলিস বিভাগের ডিটেকটিভ সেজে এসেছিল ওরা, জেনে নেয় কোন্ পথে মেইন্টেন্যান্স কমপ্লেক্সে নামতে হয়, ডিউটিরত এঞ্জিনিয়ারকে অজ্ঞান অবস্থায় কোথায় পাওয়া গেছে। ‘সবগুলো এলিভেটরের ফিউজ বক্স খোলা পাওয়া গেছে,’ সবশেষে বলল সে। তারমানে আমরা অন্য কোনটায় চড়লেও ওরা খসিয়ে দিতে পারত।’
তিক্ত হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে। ‘তোমাকে বলেছি না, আরামের মৃত্যু তুমি হার্মিসের কাছ থেকে আশা করতে পারো না। যাই হোক, আমাদের যা জানার ছিল জানা হয়েছে। প্রথমে মলিয়ের ঝান আমাদেরকে তার ঘাঁটিতে অতিথি হিসেবে চাইল, তারপর খুন করার চেষ্টা করল। আমি ভাবছি প্রথমটাতেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’
মেয়েলি ক্ষোভ প্রকাশ করে রিটা বলল, ‘লাগেজগুলো আনা হলো না।’
‘পথে কোথাও থেমে আবার সব কিনে নেয়া যাবে,’ বলল রানা। ‘লাগেজ গেলেও, দরকারী জিনিসগুলো আমাদের সাথেই আছে।’ আছে প্রিন্টগুলোও, স্যাবের অনেকগুলো গোপন কমপার্টমেন্টের একটায়।
‘আমরা তাহলে সত্যি রওনা হয়ে গেছি…যাচ্ছি ওখানে?’ জানে, তবু যেন বিশ্বাস করতে পারছে না রিটা। আচ্ছা, বেশ; গেলাম-পৌছুলাম সিংহের খাঁচায়, তারপর কি হবে, মাসুদ রানা?’
‘মাই ডিয়ার রিটা, নিঃশব্দে হাসল রানা, ঢিল পড়ল ওর পেশীতে, মুখের রেখায় নির্দয় একটা ভাব ফুটে উঠল, তারপরেই তো শুরু হবে আসল মজা!’