পাঁচ
নিউ ইয়র্কের সাথে রানার চিরপ্রেম। অনেকেই বলে বটে এখানকার পরিবেশ শুধু নোংরা নয়, বিপজ্জনকও হয়ে উঠেছে; কালোদের অত্যাচারে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। কিন্তু রানার কাছে নিউ ইয়র্ক আজও স্বপ্নের শহর, অত্যন্ত প্রিয়। এত জাতি গোত্র আর বর্ণের মানুষ পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। নিউ ইয়র্ক রোমাঞ্চের খনি। নিউ ইয়র্ক বোহেমিয়ান, কবি আর ভবঘুরেদের শহরও বটে। তবে হ্যাঁ, নিউ ইয়র্ক আগের চেয়ে অনেক বদলেছে। নতুন নতুন বিল্ডিং উঠেছে, এবং অন্য সব শহরের মত এখানেও কিছু কিছু জায়গায় সন্ধ্যার পর যাওয়া উচিত নয়। কালোরা সত্যিই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের প্রতি ওর কোন রকম সহানুভূতি আছে তাও নয়, কিন্তু বোঝে তাদের এই বেপরোয়া ভাবটা যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষণের প্রতিক্রিয়া মাত্র। সব পেয়েছির দেশে কালোরা আজও সম-অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত, এ তো সবাই জানে।
এবার অবশ্য মাসুদ রানা হিসেবে নিউ ইয়র্কে আসেনি ও। ওর পাসপোর্টে নাম রয়েছে প্রফেসর গ্রেগ লুগানিস। আর্ট ডিলারদের তালিকায় উজ্জ্বল একটা নাম। রিটা হ্যামিলটনও তার নাম বদলেছে, সে এখন মিসেস গ্রেগ লুগানিস। দম্পতিটি সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কৃতিত্বটা অবশ্যই মি. কলিন ফর্নসের।
রানার লন্ডন ফ্ল্যাট থেকে সরাসরি ওদেরকে কেনসিংটন মিউজ-এর একটা সেফ-হাউসে নিয়ে আসেন মি. কলিন ফর্বস। ওদের দেখাশোনার ভার চাপে একদল নার্সমেইডের ওপর। একটু পরই বাড়িটায় হাজির হন হাওয়ার্ড ম্যাকলিন, সি.আই.এ-র লন্ডন শাখার প্রধান। ওদের কাভার সম্পর্কে ব্রিফিং করেন তিনি।
রিটা হ্যামিলটন এ-জগতে নতুন, কাজেই তার কোন ছদ্মবেশ দরকার নেই। দরকার শুধু রানার চেহারায় কিছু পরিবর্তন ঘটানো। হাওয়ার্ড ম্যাকলিন কিছু আইডিয়া দিলেন। কাজটা রানা নিজেই সারল।
ছদ্মবেশ, রানা জানে, খুব ভাল আর নিখুঁত হতে পারে যদি পরিবর্তনের মাত্রা যতটা সম্ভব কম রাখা যায়-চুল একটু অন্য রকম করে আঁচড়াও, হাঁটার ভঙ্গি বদলাও, কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করো, রাবার প্যাড দিয়ে গাল ফোলাতে পারো (খাওয়াদাওয়া করতে অসুবিধে হয় বলে খুব কমই ব্যবহার করা হয়), চশমা পরো, কিংবা পোশাকের ধরন বদলাও। এ-ধরনের পরিবর্তন আনা সহজ, সময়- সাপেক্ষ নয়; খরচাও কম। সেফ হাউসে এসে প্রথম রাতেই রানা জানতে পারল, কাঁচা-পাকা গোঁফ ব্যবহার করতে হবে ওকে, মোটা ফ্রেমের চশমা থাকবে চোখে-ক্লিয়ার লেন্স, চক্ষুপীড়ার কারণ হয়ে উঠবে না-আর মাথায় চুল থাকবে একেবারে কম, তাও বেশিরভাগ পাকা। পরামর্শ দেয়া হলো জ্ঞানতাপসসুলভ সামনের দিকে ঝুঁকে ধীরে হাঁটা শিখতে হবে ওকে, কথা বলতে হবে থেমে থেমে।
পরবর্তী ক’টা দিন সেফ হাউসে একই ঘরে রিটা হ্যামিলটনের সাথে থাকল রানা। শ্রদ্ধাভাজন জর্জ হ্যামিলটনের মেয়ে, তার কাছ থেকে আরেকটু ভাল ব্যবহার আশা করেছিল ও। লক্ষ করল, গর্ব আর অহঙ্কারে মাটিতে যেন পা পড়ে না মেয়েটার। একসাথে কাজ করতে হলে, কাভারের স্বার্থেই, সম্পর্কটা সহজ হওয়া দরকার। সে-কথা ভেবেই উপযাচক হয়ে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু ফল হলো অপ্রত্যাশিত। এক সন্ধ্যায় রিটার হাত ধরে প্রস্তাব করল ও, ‘চলো, কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসা যাক। কোন ভাল রেস্তোরাঁয় ডিনার খাব, তারপর একটা নাইটক্লাবে যাওয়া যাবে, সবশেষে…’
‘সবশেষে মদ খাওয়াবে আমাকে, তারপর ঘরে এনে বিছানায় তুলবে, তাই না?’ ঝাঁঝের সাথে কথাগুলো বলে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে গেল রিটা হ্যামিলটন। ‘কি ভেবেছ আমাকে, সস্তা? ইচ্ছে হলেই চাটতে পারবে?’
প্রায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিল রানা। ওর সম্পর্কে মেয়েটার এত খারাপ ধারণা? এমন বিচ্ছিরি ভাষা ব্যবহার করল! এ নিয়ে অবশ্য কথা বাড়ায়নি ও। অপমানবোধ করলেও, হাবভাব আর আচরণে সেটা বুঝতে দেয়নি। তবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রোজ সকালে রিটাকে নিয়ে কাজ শুরু করে ও। মি. কলিন ফর্বস রোগা- পাতলা এক ভদ্রলোককে দিয়ে গেছেন, প্রিন্টস সম্পর্কে এক্সপার্ট, বিশেষ করে দুর্লভ ইংলিশ প্রিন্টস সম্পর্কে। ভুলেও কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করেনি। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর ক্লাস করল ওরা দু’জন, তাতে অন্তত মানুষকে ধোঁকা দেয়ার মত জ্ঞান অর্জিত হলো। হপ্তা শেষ হবার আগেই ওরা শিখল, প্রথম দিকে অর্থাৎ ক্যাক্সটন-এর সাধারণ কিছু কাঠ খোদাইয়ের কাজের পর সতেরো শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংলিশ প্রিন্টমেকারদের কোন রকম অস্তিত্বই ছিল না। সত্যিকার মেধার উন্মেষ ঘটে কন্টিনেন্টে, উঠে আসেন ডুরর, লুকাস ভ্যান লেইডেন এবং আরও অনেকে। হলবীন দি ইয়ংগার সম্পর্কে জানল ওরা। জন শ্যুট-এর তৈরি প্রথম ইংলিশ কপার প্লেট সম্পর্কে শিখল। হলার, হোগার্থ এবং তাঁদের সমসাময়িক প্রিন্টমেকারদের কাজ সম্পর্কে লেকচার শুনল। তথাকথিত রোমান্টিক ট্র্যাডিশন থেকে শুরু করে উনিশ শতকের উঁচুদরের এচিং এবং প্রিন্টমেকিং-এর ইতিহাসও মুখস্থ করতে হলো।
তৃতীয় দিন কেনসিংটনে আবার এলেন মি. কলিন ফর্বস, ইনস্ট্রাকটরকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন ওদেরকে হোগার্থ সম্পর্কে বেশি করে জ্ঞান দান করেন। কারণটা সেদিন রাতেই জানা গেল, মি. কলিন ফর্বস আবার যখন উদয় হলেন। ‘মি. রানা,’ বললেন তিনি, ‘আপনার কথামত বেলাডোনা সম্পর্কে জেনেছি আমরা। মেয়েটা এতিম, বোর্ডিং স্কুলে থেকে পড়াশোনা করেছে। ফ্রান্সে তার এক আত্মীয় ছিল, বুড়ো মারা যাওয়ার সময় বিপুল সম্পত্তি তার নামে উইল করে দিয়ে যায়, বেলাডোনা তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্রী। সহজ সরল, বুদ্ধিমতী মেয়ে, কোথাও তার নামে কোন অভিযোগ নেই। উইল সূত্রে পাওয়া ফ্রান্সের সম্পত্তিগুলো এখনও তার নামে আছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তিগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। মেয়েটা যে ‘ক্লিন’ তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে মলিয়ের ঝান, ব্যাপারটাকে কিডন্যাপিংই বলা যেতে পারে।
‘এবার অন্য প্রসঙ্গ,’ বলে চলেছেন সি.আই.এ. চীফ। ‘আপনার সাথে, প্রফেসর লুগানিস, শিল্প জগতের কিছু লোকের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত। কাল সকালে দেখতে পাবেন প্রেস আপনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে তারা গরু খোঁজা করছে আপনাকে।’
‘আমি কি করেছি বলে তাদের ধারণা?’ সকৌতুকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘আপনার অপরাধ,’ মুখভাব গম্ভীর করে তুলে ভারী গলায় বললেন মি. কলিন ফর্বস, ‘এ-যাবৎ কাল অজ্ঞাত এক সেট হোগার্থ প্রিন্ট পেয়ে গেছেন আপনি, সই করা। ‘দি রেক’স প্রোগ্রেস’ বা ‘দি হারলট’স প্রোগ্রেস’-এর সমতুল্য নয়, তবে হোগার্থ তো বটে! সব মিলিয়ে মোট ছয়টা। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি অপূর্ব শিল্পকর্ম, আলাদা আলাদা নামকরণও করা আছে। ‘দি লেডি’স প্রোগ্রেস’ বোদ্ধা মহলে ভীষণ আলোড়ন তুলবে, দেখবেন এই আমি বলে রাখলাম। ওগুলো যে আসল, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। আপনি ব্যাপারটা গোপন রাখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিড়াল। গল্পের শেষ অংশটা এইরকম-আপনি এমনকি ইংল্যান্ডে ওগুলো বিক্রির জন্যে কোন চেষ্টাই করবেন না, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমেরিকায়। ব্যাপারটা নিয়ে যে ‘হাউজে’ হৈ-চৈ হবে তাতে আর সন্দেহ কি!’
সিগারেট ধরাল রানা। আর প্রিন্টগুলো?’
‘বিউটিফুল ফরজারি,’ চোখ মটকে বললেন সি.আই.এ. চীফ। ‘অন্য কিছু প্রমাণ করা ভারী কঠিন। ওগুলোর পিছনে কয়েক বস্তা টাকা খরচ হয়েছে এজেন্সির। কাল সকালে ওগুলো আনা হবে। আগামী হপ্তায় আপনারা নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন, তার ঠিক আগে যাতে প্রেস খবরটা পেয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখা হবে।’
এক সেকেন্ড ইতস্তত করে রানা বলল, ‘আপনার সাথে একা একটু কথা বলতে চাই, মি. ফবস।
রানাকে নিয়ে পাশের কামরায় চলে এলেন সি.আই.এ. চীফ। রানা কিছু বলার আগেই তিনি জানালেন, ‘না, মি. রানা- আপনাকে সাহায্য করার জন্যে কোন ব্যাক-আপ টীম থাকবে না। এর আগে বহুবার আপনি ব্যাক-আপ টীম ছাড়াও কাজ করেছেন।’
‘তা আমি চাইছিও না,’ বলল রানা। ‘আমি জানতে চাই আমার পার্সোনাল আর্মামেন্ট সম্পর্কে কি করেছেন আপনারা।’
হাসলেন মি. কলিন ফর্বস। রানাকে জানালেন, ভি-পি-সেভেনটি, অ্যামুনিশন, আর রানার প্রিয় ছুরিগুলো একটা ব্রীফকেসে ভরে ডেলিভারি দেয়া হবে, ওদের নিউ ইয়র্ক হোটেলে-ব্রীফকেসের ভেতর নকল হোগার্থ প্রিন্টগুলোও থাকবে। ‘আমাদের ‘কিউ’ ব্রাঞ্চ কিছু টেকনিকাল ইনফরমেশন জানাতে চাইবে আপনাকে, যাবার আগে টেকনোলজি সেশনে বসতে হবে।’
‘আরেকটা কথা,’ বলল রানা। ‘আপনি তো সিলভার বীস্ট সম্পর্কে জানেন, তাই না?’
জানেন কিনা বোঝা গেল না, বললেন, ‘সিলভার বীস্ট? মানে?’
সিলভার বীস্ট হলো ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-টেরোরিজম অর্গানাইজেশন থেকে দান হিসেবে পাওয়া একটা গাড়ি-স্যাব নাইন হানড্রেড টার্বো। এই একই গাড়ি আরও বহু লোকের আছে, কিন্তু রানারটার সাথে সেগুলোর তফাৎ অনেক। নিজের খরচে টেকনিকাল অনেক পরিবর্তন এনেছে ও, সাহায্য নিয়েছে নাম করা এক্সপার্টদের। রানা এজেন্সির অনেকেই বহুবার গাড়িটার বিভিন্ন রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, রানাও গোপনীয়তা ফাঁস করেনি। গোপন কমপার্টমেন্ট, টিয়ার গ্যাস ডাক্ট, স্পীড লিমিট, ফটোগ্রাফিক ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু জানার তা একমাত্র রানাই জানে। সিলভার বীস্ট নামটা ওর বন্ধুদের দেয়া।
‘আমার গাড়ি, লন্ডনেই আছে,’ বলল রানা।
‘বেশ।’ রানা কি বলবে শোনার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন সি.আই.এ. চীফ।
‘ওটা আমি নিউ ইয়র্কে নিয়ে যেতে চাই। পাবলিক ট্র্যান্সপোর্টের দয়ার ওপর…’
‘আপনি বললে আপনার জন্যে ভাড়া করা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি-লেফট-হ্যান্ড ড্রাইভ…’
‘দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, মি. ফর্বস। আমি আমার গাড়িটা ব্যবহার করতে চাইছি।’
মুচকি হেসে সি.আই.এ. চীফ বললেন, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন কী না কি ওটার ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন আপনি! কি জানেন…’
‘আমার দরকার, সেটা আপনাকে জানালাম,’ বলল রানা। ‘গাড়িটা, কাগজ- পত্র সহ। আপনারা ব্যবস্থা করতে না পারলে বলে দিন, আমি নিজেই দেখব…
‘লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে একটা গাড়ি পৌঁছে দেয়া কোন সমস্যা নয়,’ মি. কলিন ফর্বস ভুরু কুচকে বললেন। সমস্যা হলো আপনার গাড়িটা সাধারণ নাগরিকদের জন্যে বিপজ্জনক কিনা-কাস্টমসের চোখে।’
মৃদু হেসে রানা বলল, ‘গাড়িটায় যদি কিছু লুকানো থাকে, মি. ফৰ্বস, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ওরা কিছু টের পাবে না।’
‘ঠিক আছে, কাল জানাব,’ বলে বিদায় নিলেন সি.আই.এ. চীফ।
পরদিন সন্ধের সময় আবার এলেন মি. কলিন ফর্বস। রানাকে জানালেন, হ্যাঁ, নিউ ইয়র্কে পৌছেই গাড়িটা পেয়ে যাবে ও, এয়ারপোর্টেই। পরের হপ্তায় রওনা হয়ে গেল ওরা।
.
প্রফেসর এবং মিসেস গ্রেগ লুগানিস বোয়িঙে চড়ে নিউ ইয়র্কের জে.এফ. কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছল। এয়ারপোর্ট ভবনের সামনে শুধু স্যাব নয়, সাংবাদিকরাও অপেক্ষা করছিল। চেহারায় রগচটা ভাব নিয়ে খনখনে নাকি সুরে প্রশ্নের উত্তর দিল রানা। সংবাদ মাধ্যমগুলোর ধারণা নতুন আবিষ্কৃত হোগার্থগুলো তিনি নাকি আমেরিকায় বিক্রি করতে চান। উঁহুঁ-উঁহু, এখুনি তিনি কিছু বলতে রাজি নন। না, বিশেষ বা নির্দিষ্ট কোন ক্রেতার কথা তিনি ভাবছেন না। সবার বোঝা উচিত, আমেরিকায় এটা তাঁর ব্যক্তিগত সফর। আরে না, প্রিন্টগুলো তাঁর সাথে নেই-তবে হ্যাঁ, এটুকু জানাতে আপত্তি নেই যে ইতিমধ্যে সেগুলো নিউ ইয়র্কে পৌচেছে।
ব্যাপারটা রানা দারুণ উপভোগ করল, বিশেষ করে নিজের নতুন গলা শুনে। সে বহু বছর আগের কথা, রানা তখন ক্লাস টু কি থ্রীতে পড়ে, বিশালবপু এক গৃহশিক্ষক ছিলেন ওর। ডানপিটে রানা পড়ায় অমনোযোগী হলেই কাঠপেন্সিল দিয়ে ওর পেটে খোঁচা দিতেন তিনি। খোঁচা খাবার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত রানা। আজ এতদিন পরও ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর মনে আছে, এবং ব্যঙ্গ করার সুযোগটা ছাড়ছে না। একই সাথে লক্ষ রাখল, সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রফেসর লুগানিস যেন বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। সব কাগজে খবরগুলো যেন বড় বড় হেড়িঙে ছাপা হয়, যাতে কারও চোখ এড়িয়ে না যায়। মহা বিরক্ত হয়ে সে বলল, সাংবাদিকরা আর্ট বোঝেও না, এ-ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহও নেই। সাংবাদিকরা পারে শুধু হৈ- চৈ বাধাতে। ভিড় ঠেলে স্যাবের দিকে এগোল রানা, মুখে খই ফুটছে, ‘আপনারা শুধু ডলার চেনেন। একটা শিল্প কর্ম কত দামে বিক্রি হলো শুধু সেটাই জানতে চান। দাম বোঝেন, কিন্তু আর্ট বোঝেন না।’
সাংবাদিকদের একজন হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, ‘তারমানে কি আপনি এখানে এসেছেন ওগুলো বিক্রি করার জন্যে, প্রফেসর?
‘সেটা আমার ব্যাপার।‘
ফিফটি-সিক্স এভিনিউয়ের এমব্যাসী হোটেলে আগেই পৌঁছে গেছে ওদের ব্রীফকেসটা, সাবধানে সেটা খুলল রানা, প্রিন্টস আর অস্ত্রশস্ত্র আলাদা করল। প্রিন্টগুলো চলে যাবে হোটেলের সেফে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে ভি-পি-সেভেনটি থাকবে নিজের কাছে, ছুরি জোড়া নিজের ব্রীফকেসের গোপন কমপার্টমেন্টে। জিনিসগুলো আলাদা করার কাজে এতই মগ্ন ছিল ও যে লক্ষই করেনি কামরার ভেতর ঠাণ্ডা হিম একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে রিটা হ্যামিলটনকে ঘিরে।
কেনসিংটনের সেফ হাউসে একই ঘরে থেকেছে ওরা, তবে বিছানা ছিল দুটো। এমব্যাসী হোটেলে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে উঠেছে ওরা, বেডরূম আর বিছানা একটাই। ইতিমধ্যে যদিও আগের চেয়ে খানিকটা সহজ হতে পেরেছে রিটা হ্যামিলটন, এখন রানাকে সে নাম ধরেই ডাকে, কথাবার্তায় আন্তরিকতারও খুব একটা অভাব নেই, কিন্তু দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে এখনও সে আগের মতই সচেতন।
প্রিন্টগুলো নিরাপদ জায়গায় রেখে ফিরে এল রানা, দেখল বেডরূমের মাঝখানে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে রিটা, হাতজোড়া বুকের ওপর ভাঁজ করা। মনোলোভা ভঙ্গি, ইচ্ছাকৃত হোক বা না হোক।
‘কি ব্যাপার?’ কৌতূহল প্রকাশ করল রানা।
‘তুমিই বলো কি ব্যাপার?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রিটা।
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। অনেক দিনের অভ্যেস, সুটকেস থেকে জিনিস-পত্র বের করার সময় তোয়ালে আর স্লিপিং গাউনটা ডাবল বেড়ের ওপর রেখেছে ও। আমি তো কোন ব্লু খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘ওটা একটা ব্লু,’ বলে স্লিপিং গাউনটা দেখাল রিটা। ‘এখনও আমরা ঠিক করিনি কে বিছানায় কে কাউচে শোবে। আমি যতটুকু বুঝি, মি. মাসুদ রানা, আমরা যখন একা থাকব তখন বৈবাহিক সম্পর্কটার কোন অস্তিত্ব থাকবে না।’
‘ও, হ্যাঁ, তাইতো কাউচটা অবশ্যই আমি ব্যবহার করব।’ তারপর, বাথরূমের দিকে পা বাড়িয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে বলল রানা, চিন্তার কিছু নেই, রিটা, একজন নান-এর মত নিরাপদ থাকবে তুমি আমার কাছে। নরম বিছানা তোমার জন্যে, কষ্ট করা অভ্যেস আছে আমার।
বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে রানা দেখল, বিছানার পাশে অপ্রতিভ ভঙ্গিতে তখনও দাঁড়িয়ে আছে রিটা, চেহারায় একটু যেন অপরাধী অপরাধী ভাব। বলল, সত্যি আমি দুঃখিত, রানা-তোমার সম্পর্কে বাজে কথা ভেবেছি। আসলে আমার বাবা না…মানে তার মুখে তোমার কথা শুনে শুনে…
‘অ্যাডমিরাল আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেছেন?’ রানা বিস্মিত।
‘না-না, ঠিক উল্টোটা…মানে, বাবা তোমার সম্পর্কে এত প্রশংসা করেন যে মনে মনে তোমাকে আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নিয়েছি…মানে, নিয়েছিলাম। এখন দেখছি তুমি সত্যি ভদ্রলোক, ইন দ্য রিয়েল সেন্স অভ দ্য ওয়ার্ড।’
রানা ঠিক লালচে হয়ে উঠল না, যদিও মেয়েরা ওকে ঠিক এভাবে প্রকাশ্যে ভদ্রলোক বলে অভিহিত করে না কখনও।
‘বলছিলাম কি,’ ইতস্তত করতে করতে বলল রিটা। ‘চলো না, কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলে আমি কিন্তু দুঃখ পাব, ভাবব…
তাড়াতাড়ি রানা বলল, ‘বেশ তো, চলো-আমাদের কাভারের জন্যে সেটা বোধহয় দরকারও।
‘কাছাকাছি একটা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ আছে, আমি চিনি, খুব ভাল…’
হাঁটতে হাঁটতে ঈস্ট ফিফটি-টু-তে চলে এল ওরা, রেস্তোরাঁটা এখানেই। নির্জন এক কোণে বসল ওরা। সাধারণ ফ্রেঞ্চ ডিশের অর্ডার দিল রানা। প্রধান খাবার অ্যাসপ্যারাগাস আর ফিলিট। অ্যাসপ্যারাগাসের সাথে যোগ হয়েছে ক্রীম, লেমন আর অরেঞ্জের তৈরি সস। ফিলিটের সাথে দেয়া হয়েছে নাশপাতি, মুখে ফেলার সাথে সাথে মিলিয়ে যায়। সবশেষে কফি! কথাবার্তা খুব সামান্যই হলো, তবে অকৃত্রিম হাসি থাকল দু’জনের মুখেই। প্রফেসরের ভূমিকায় প্রতি মুহূর্ত নিখুঁত অভিনয় করে গেল রানা, যদিও রিটার মনে হলো ছদ্মবেশের আড়ালে আসল মানুষটাকে আগের চেয়ে যেন আরও ভাল ভাবে বুঝতে পারছে সে। বাবা এই যুবক সম্পর্কে যাই বলে থাকুন, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে একটা কথাও বোধহয় বাড়িয়ে বলা হয়নি। অপরাধবোধটা আবার তাকে অপ্রতিভ করে তুলল, রানাকে অপমান করা তার উচিত হয়নি। নীরবে ব্যাপারটা হজম করেছে রানা, হয়তো সেজন্যেই ওর প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করছে সে। এই আকর্ষণ, একে শুধু বোধহয় চুম্বকের সাথেই তুলনা করা চলে। সারাক্ষণ টানছে তাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল রিটা হ্যামিলটন-কে জানে এর আগে কত মেয়ে তার মত এই একই টান অনুভব করেছে।
ডিনার সেরে হেঁটে ফিরে এল ওরা এমব্যাসীতে। ডেস্ক ক্লার্কের কাছ থেকে চাবি নিয়ে এলিভেটরে চড়ল। উঠে এল চারতলায়।
ওদের পিছনে এলিভেটরের দরজা বন্ধ হতেই তিনজন হোঁৎকা চেহারার লোক ঘিরে ধরল ওদেরকে। নিখুঁতভাবে কাটা সুট পরে আছে সবাই। পকেট থেকে রানা ভি-পি-সেভেনটি বের করার আগেই ওর কব্জি চেপে ধরল একজন, অপর একজন জ্যাকেটের ভেতর হাত গলিয়ে বের করে নিল পিস্তলটা।
‘আমরা চুপচাপ কামরার ভেতর ঢুকব, কেমন, প্রফেসর?’ ওদের একজন বলল। ‘না-না, কোন বিপদ নয়। আমরা আপনাকে এক ভদ্রলোকের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান। ঠিক আছে?’