তিন
দূষিত, পচা বিশাল বিলের মাঝখানে বাড়িটাই একমাত্র উঁচু জায়গা। বিলটা কোথাও বেশি গভীর, কোথাও কম, জলজ গাছ এত বেশি যে গোটা জলাভূমি
ঢাকা পড়ে আছে।
সবচেয়ে কাছের শহরটা ছয় মাইল দূরে। মিসিসিপি নদীর ধারে, জলমগ্ন জলাভূমির কিনারায় ওখানে খুব কম লোকই বসবাস করে। তারা শুধু যে বিলটাকে ভয় পায় তাই নয়, বাড়িটাও তাদের মনে আতঙ্কের একটা উৎস। জলা আর বাড়ি, দুটোকেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তারা।
খুব যারা বুড়ো তাদের মুখ থেকে শোনা যায় কোথাকার কোন এক ইংরেজ নাকি বাড়িটা তৈরি করেছিল, সেই আঠারোশো বিশ কি বাইশ সালের দিকে। লোকটার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল জলাটাকে পোষ মানাবে, বাসযোগ্য আর সুগম্য করে তুলবে মানুষের জন্যে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারেনি। এক মেয়েলোককে নিয়ে অশান্তি দেখা দেয়-কারও কারও গল্পে একাধিক মেয়ের কথা বলা হয়-তারপর দেখা দেয় মৃত্যু। বাড়িটা যে ভূতুড়ে এ-ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহ নেই। ব্যাখ্যাহীন শব্দ অনেকেই শুনেছে। অশুভ বাড়িটাকে পাহারাও দেয় অশুভ শক্তি-একদল সাপ। একেকটা সাপ নাকি ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট লম্বা, জলাভূমির অন্য কোন অংশে ওগুলোকে দেখা যায় না, শুধু বাড়িটার চারপাশেই ওগুলোর আড্ডা। সবচেয়ে কাছের মুদি দোকানদার ব্যাট জনসন। তার ধারণা, ‘সাপগুলো ডেলাভাইলকে মোটেও বিরক্ত করে না।’
ডেলাভাইল বোবা আর কালা। ছেলেপিলেরা তাকে দেখলে ছুটে পালায়, বড়রাও কেউ তাকে পছন্দ করে না। তার সাথে যোগাযোগ একমাত্র ব্যাট জনসনেরই আছে, তবে সাপগুলো যেহেতু ডেলাভাইলকে বিরক্ত করে না, কাজেই ব্যাট জনসনও ডেলাভাইলকে বিরক্ত করে না।
সাত কি আট দিন পর একবার করে মারশ্ হপার নিয়ে বিল পেরোয় বোবাটা, তারপর পাঁচ মাইল জলা পায়ে হেঁটে ব্যাটা জনসনের দোকানে পৌছায়, হাতে থাকে জিনিস-পত্রের একটা তালিকা। জিনিসগুলো নিয়ে আবার পাঁচ মাইল হাঁটে সে, মারশ্ হপারে উঠে বিলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
বাড়িটায় একটা মেয়েলোকও থাকে। অনেক লোকই মাঝে মধ্যে দেখেছে তাকে, কোন সন্দেহ নেই জিনিস-পত্রের নাম লেখা তালিকাটা সে-ই বোবার হাত দিয়ে ব্যাট জনসনের দোকানে পাঠায়। মেয়েলোকটা যে এক ধরনের ডাইনী তাতে আর সন্দেহ কি, তা না হলে কি অমন ভূতুড়ে একটা বাড়িতে এতদিন ধরে বাস করতে পারে?
বিশেষ করে ভিড় আর গ্যাঞ্জামের সময়টায় বাড়িটার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে লোকজন। গ্যাঞ্জামটা কখন শুরু হবে সবাই তারা জানতে পারে। ব্যাট জনসনই তাদেরকে জানায়। সে জানতে পারে জিনিস-পত্রের তালিকা দেখে। গ্যাঞ্জামের দিনটায় দু’বার আসা-যাওয়া করতে হয় ডেলাভাইলকে, কারণ বাড়িতে সেদিন অতিরিক্ত অনেক জিনিস দরকার হয়। তারপর, সন্ধ্যার দিকে, সত্যি সবার দূরে সরে থাকা উচিত। চেনা অচেনা কত রকম শব্দ হবে, গাড়ি আসা যাওয়া করবে, অতিরিক্ত মাশ্ হপার দেখা যাবে, আর বাড়িটা হঠাৎ করে ঝলমলে হয়ে উঠবে উজ্জ্বল আলোয়। কখনও কখনও সঙ্গীতও শুনতে পাওয়া যায়। ক্ষীণ আর্তচিৎকারও নাকি কেউ কেউ শুনেছে বলে দাবি করে। একদিনের ঘটনা, তা প্রায় বছরখানেক হয়ে এল, প্রাণ চঞ্চল জন লিবি-যে ভয় কাকে বলে জানত না-তার নিজের মারশ্ হপার নিয়ে দু’মাইল উজানে গিয়ে পৌঁছায়; ইচ্ছে, গোপনে কিছু ছবি তুলবে।
তারপর আর জন লিবিকে কেউ কখনও দেখেনি। তবে তার মারশ্ হপারটা পাওয়া গিয়েছিল, ভাঙাচোরা টুকরো অবস্থায়, যেন কোন বিরাট জানোয়ার-বা সাপ-ওটার ওপর মনের ঝাল মিটিয়েছে।
এই হপ্তায় আবার বাড়িটায় ভিড় আর গ্যাঞ্জাম হবে।
বাড়িটার দরজা-জানালা আর বেশিরভাগ দেয়াল জাল দিয়ে ঘেরা থাকে, সে লোহার জালেও মরচে ধরেছে। কিন্তু খুব কম লোকই জানে যে বাড়িটা পাথরের তৈরি। প্রাচীন বাড়িটার ভেতরের অংশ ভেঙে নতুন করে পাথর আর ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
প্রতি মাসেই এ-ধরনের ভিড় হয় বাড়িটায়। এ মাসে লোক এসেছে এগারোজন! দু’জন লন্ডন থেকে, তিনজন নিউ ইয়র্ক থেকে, একজন জার্মান, একজন ফরাসী, একজন সুইডিস, একজন ল্যাটিন আমেরিকান, বিশাল বপু যে লোকটা প্রতি মাসেই আসে সে বাস করে তেল আবিবে, আর এসেছে ওদের লীডার। লীডারের নাম সও মং, যদিও বাইরের দুনিয়ায় সম্পূর্ণ অন্য এক নামে পরিচিত সে।
সময় নিয়ে এবং আয়েশ করে ডিনার সারল তারা। মদ আর কফি পানের পর সবাই গিয়ে বসল কনফারেন্স রূমে, সেটা বাড়ির পিছন দিকে।
লম্বা কামরাটা সাদা রঙ করা, ফ্রেঞ্চ উইন্ডোগুলোয় একই রঙের ভারী পর্দা ঝুলছে, ওগুলোর সামনে দাঁড়ালে বিল আর জলার দূর প্রান্ত পর্যন্ত দেখা যায়। কামরার চার দেয়ালে চারটে পেইন্টিং, প্রতিটির নিচে পিতলের শেডের ভেতর আলো জ্বলছে। পেইন্টিংগুলোর মধ্যে দুটো পোলস্, একটা মিরো, অপরটা ক্লাইন। ক্লাইনের শিল্পকর্মটি সম্প্রতি হাইজ্যাক করা আরও অনেক মূল্যবান জিনিস-পত্রের সাথে পাওয়া গেছে। পেইন্টিংটি সও মঙের এতই ভাল লেগে গেছে যে আর সব জিনিসের সাথে ওটা বিক্রি করা হয়নি।
পালিশ করা একটা ওক টেবিল কামরার মাঝামাঝি জায়গা প্রায় সবটুকু দখল করে রেখেছে। এগারোজন মানুষের জন্যে এগারোটা চেয়ার, প্রত্যেকটা চেয়ারের সাথে ঝুলছে নাম লেখা কার্ড। টেবিলে সবার সামনে রয়েছে ব্লটার, পানীয়, কাগজ, অ্যাশট্রে আর এজেন্ডা।
টেবিলের মাথার চেয়ারটা দখল করল’ সও মং, তাকে বসতে দেখে তারপর সবাই বসল।
‘চলতি মাসে এজেন্ডায় মাত্র তিনটে বিষয় রয়েছে,’ শুরু করল সও মং। ‘বাজেট, ফ্লাইট বি টুয়েলভ ব্যর্থতা, আর অপারেশন বুলডগ সম্পর্কে আলোচনা। বেশ, তাহলে কাজ শুরু করা যাক। মি. আকিভা নোভিক, বাজেট প্রসঙ্গে, প্লীজ।’
তেল আবিবের অধিবাসী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘদেহী পুরুষ, গায়ের রঙ তামাটে, খাড়া নাক। সুদর্শন ইহুদি লোকটার চেহারাই শুধু নয়, তার কণ্ঠস্বরও বহু যুবতীর হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। ‘এ-কথা বলতে পেরে আমি আনন্দিত যে,’ শুরু করল সে, ‘ফ্লাইট বি টুয়েলভ থেকে যা আশা করা হয়েছিল তা না পেলেও, আমাদের সুইটজারল্যান্ড, লন্ডন আর নিউ ইয়র্কের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা জমা আছে—মোটা অঙ্ক বলতে, যথাক্রমে, চারশো মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক, পঞ্চাশ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং, আর একশো পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে এই টাকায় আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব। তাছাড়া, আমাদের পরবর্তী অপারেশনগুলো যদি সফল হয়, মহামান্য লীডারের সাথে একমত হয়ে আমি ও বলতে পারি সফল না হবার কোন কারণ নেই, তাহলে আমাদের মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ এক বছরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।’ পরিচিত মন-ভোলান হাসি দেখা গেল তার মুখে, উপস্থিত শ্রোতারা সবাই হেলান দিল যে যার চেয়ারে, ঢিল পড়ল সবার পেশীতে
টেবিলের ওপর শক্ত একটা ঘুসি মারল সও মং। ‘ভেরি গুড।’ তার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য। ‘কিন্তু ফ্লাইট বি টুয়েলভে আমাদের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষ করে এই অপারেশনটার জন্যে আপনার এতদিন ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর, হের এফেন।’ চেহারায় আক্রোশ ফুটে উঠল, হিংসদৃষ্টিতে জার্মান প্রতিনিধি ফন এফেনের দিকে তাকাল সে। ‘আর সবার মত আপনিও জানেন, হের এফেন, এ-ধরনের পরিস্থিতিতে হার্মিসের একজিকিউটিভ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের চরম মূল্য দিয়ে ব্যর্থতার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে।
ফন এফেন মোটাসোটা, চামড়া ছাড়ানো লালচে মাংসের মত মুখের রঙ, পশ্চিম জার্মানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার রয়েছে দোর্দণ্ড প্রতাপ। সও মঙের কথা শুনে তার লালচে মুখ ফ্যকাসে হয়ে গেল।
‘তবে, এখানে একটা ব্যতিক্রম ঘটেছে,’ আবার বলল সও মং। আপনি যাদের কাজ দিয়েছিলেন, তাদের একজন দায়িত্বে অবহেলা করেছে। হের এফেন, অবশেষে আমরা আপনার আর্থার মার্টিনসনকে খুঁজে পেয়েছি।’
‘অ্যা, তাই নাকি?’ ফন এফেন হাত কচলাতে শুরু করে জানাল, সে-ও আর্থার মার্টিনসনকে খুঁজছিল। তার সেরা লোকদের দিয়ে খোঁজ করিয়েও লোকটাকে পায়নি সে।
‘হ্যাঁ, তাকে আমরা পেয়েছি, গম্ভীর সুরে বলল সও মং, তারপর পর পর দু’বার হাততালি দিল, হাততালি নয় যেন পিস্তলের আওয়াজ। ‘পাওয়া যখন গেছে, দেরি না করে তাকে তার বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দেয়াই উত্তম বলে মনে করি আমি। যাকে যেখানে পাঠানোর কথা তাকে সেখানে পাঠাতে দ্বিধা করা আমাদের সাজে না। আইন-শৃংখলা আর নীতিমালা মেনে চলার ওপরই নির্ভর করছে হার্মিস-এর সাফল্য।’ বড়সড় একটা জানালার পর্দা নিঃশব্দে সরে গেল এক পাশে, সেই সাথে ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে এল কামরার ভেতরে আলোগুলো। জানালার বাইরে, কাছাকাছি চারদিকের পরিবেশ দিনের মত উজ্জ্বল দেখাল। ইনফ্রা-রেড ডিভাইস,’ ব্যাখ্যা করল সও মং। ‘সাধারণ আলোয় এ-বাড়ির প্রহরীরা যাতে ভয় না পায়। ওই যে, ‘আপনার মি. মার্টিনসন আসছে।
টেকো, ভীত-সন্ত্রস্ত এক লোক, পরনে নোংরা সুট, ভাঁজ নষ্ট হয়ে গেছে। জানালার ঠিক সামনে ছোট্ট সমতল মাটিতে পথ দেখিয়ে আনা হলো তাকে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, পায়ে লোহার শিকল জড়ানো, কাজেই তাকে টেনে নিয়ে আসতে কোন অসুবিধেই হলো না ডেলাভাইলের। লোকটার বিস্ফারিত চোখ জোড়া দিশেহারা ভঙ্গিতে এদিক ওদিক ঘুরছে, যেন গাঢ় অন্ধকারের ভেতর অচেনা কি যেন একটা বিপদ থেকে পালাবার পথ খুঁজছে সে।
ডেলাভাইল তাকে সমতল, পরিষ্কার জায়গার মাঝখানে এনে দাঁড় করাল, ওখানে একটা ধাতব পোল রয়েছে খাড়াভাবে, জানালার কাঁচ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে। কামরার ভেতর থেকে দর্শকরা এখন দেখতে পাচ্ছে মার্টিনসনের বাঁধা হাত থেকে রশির একটা লম্বা প্রান্ত দু’ফুটের মত নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। পোলটার সাথে রশিটা বাঁধল ডেলাভাইল, ঘুরল, জানালার দিকে ফিরে হাসল একটু, তারপর পায়ের শিকল খুলে দিয়ে বেরিয়ে গেল দৃষ্টিসীমা থেকে।
ডেলাভাইল সরে যাবার সাথে সাথে মার্টিনসনের মাথার ওপর থেকে ঝপ্ করে কি যেন একটা পড়ল। পরমুহূর্তে চেনা গেল জিনিসটা লোহার একটা খাঁচা খাঁচার ফ্রেমটা ভারী মজবুত ইস্পাতের রড দিয়ে তৈরি। গ্রিলগুলো এত শক্ত যে কোন মানুষের সাধ্য নেই খালি হাতে ভাঙে। গ্রিল শুধু খাঁচার তিন দিকে, বাকি একটা দিক খোলা। খাঁচার ছাদ লোহার রড দিয়ে তৈরি। খোলা মুখটা শেষ হয়েছে পানির একেবারে কিনারার কাছে, জানালা থেকে পানির কিনারা নয় ফুটের মত দূরে। খাঁচার ভেতর ছটফট করছে মার্টিনসন, পোল থেকে হাতের বাঁধন খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।
‘কি করেছে সে?’ আমেরিকানদের একজন জিজ্ঞেস করল। তার নাম জেফরি অ্যাডামস্, লস অ্যাঞ্জেলসের ইউনিয়ন কর্স প্রধান। তার সব চুল সাদা, কিন্তু গোঁফ জোড়া লালচে।
‘বি.এ. টুয়েলভের ব্যাক-আপ টীমের লীডার ছিল সে,’ জবাব দিল ফন এফেন। ‘কিন্তু কমরেডদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেনি।’
‘মি. অ্যাডামস্,’ হাত তুলে বলল সও মং, ‘ঠিক কি ঘটেছিল, সব আমাদেরকে বলেছে মার্টিনসন। আর সবাই কিভাবে মারা গেল, কে মারল ইত্যাদি। ওই যে, প্রহরীদের একজন মি. মার্টিনসনকে দেখতে পেয়েছে। আমার অনেক দিনের শখ, বড়-একটা পাইথন জ্যান্ত একটা মানুষকে গিলে খেয়ে ফেলছে নিজের চোখে দেখব।’
ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে হার্মিসের একজিকিউটিভ কমিটি চেহারায় আতঙ্ক আর স্তম্ভিত বিস্ময় নিয়ে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ইনফ্রা-রের কল্যাণে জলাভূমির কিনারা পর্যন্ত দিনের আলোর মত উজ্জ্বল দেখছে তারা। দুর্ভাগ্যের শিকার অসহায় লোকটার চিৎকারও তারা শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার। ঝোপ-ঝাড় আর বুনো ঘাসের ভেতর দিয়ে বিরাটাকার সরীসৃপটাকে এগিয়ে আসতে দেখতে পাচ্ছে সে। পানির কিনারায় ঘাস আর ঝোপ মাথা নোয়াচ্ছে।
পাইথনটা বিশাল। কম করেও ত্রিশ ফুট লম্বা। মোটা, নিরেট শরীর। চওড়া তেকোনা মাথা। আর্থার মার্টিনসন, থরথর করে কাঁপছে, ঠকঠক করে বাড়ি খাচ্ছে দাঁত, পোলটার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করল, খাঁচার দূর প্রান্তে সরে যেতে চাইছে, যেন ওখানে যেতে পারলে রক্ষা পাবে।
পাইথনটা হঠাৎ করে দ্রুত সামনে বাড়ল। প্রাচীন শিকড়ের মত মার্টিনসনকে পেঁচিয়ে ফেলল ওটা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শিকার আর শিকারীর মুখ একই লেভেলে পৌঁছুল-মানুষ এবং সাপ পরস্পরের সাথে জড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক দুলছে, যেন অশ্লীল মৃত্যু-নাচে বিভোর। সাপের চওড়া ফণা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে একটানা চিৎকার করছে মার্টিনসন, হিংস্র আক্রোশে সাপটার খোলা চোয়াল বিস্তৃত হচ্ছে ঘন ঘন। বিস্ফারিত দু’জোড়া চোখের দৃষ্টি কয়েক সেকেন্ড এক হয়ে থাকল, দর্শকরা পরিষ্কার দেখতে পেল লোকটার শরীরে আরও এঁটে বস, সাপের প্যাচ। মনে হলো মার্টিনসনের হাড়গুলো মট মট করে ভেঙে যাবে সব।
তারপর অসাড় হয়ে গেল মার্টিনসন, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সাপ এবং মানুষ মাটিতে লম্বা হলো। দর্শকদের একজন, জানালার পিছনে সম্পূর্ণ নিরাপদ, গুঙিয়ে উঠল। তিনটে ক্ষিপ্র ঝাঁকির সাথে মার্টিনসনের দেহ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পাইথন, এখন গভীর আগ্রহের সাথে ভোজ্যবস্তুটা পরীক্ষা করছে। ছোবল দিয়ে প্রথমে রশির বাঁধন ছিঁড়ল পাইথন, চোয়াল দিয়ে ধরে সরিয়ে দিল দূরে, তারপর মাথা ঘুরিয়ে এগোল মার্টিনসনের পায়ের দিকে।
আরে, আরে! এ যে একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’ সও মং জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ওহ্, গড়, সাপটা মার্টিনসনের জুতো খুলছে!’
দেহটা পিছিয়ে এনে মোচড় খেলো সাপ, মার্টিনসনের পায়ের সাথে একই সরলরেখায় চলে এল ওটার মাথা। পা দুটোকে ঠেলে এক করল। তারপর হাঁ করল মুখ। অবিশ্বাস্য চওড়া চোয়ালের ভেতর ঢুকে গেল মার্টিনসনের গোড়ালি।
গোটা ব্যাপারটা শেষ হতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল, তবু কামরার ভেতর ভিড়টা একবারও নড়ল না, সবাই যেন সম্মোহিত হয়ে পড়েছে। কয়েকবার করে ঢোক গিলল পাইথন, প্রতিবার ঢোক গেলার সময় ঝাঁকি খেলো তার শরীর, তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। বিশ্রামের সময়টায় এক চুল নড়ল না। যতক্ষণ না মার্টিনসন সম্পূর্ণ উদরস্থ হলো ততক্ষণ চলল এই রোমহর্ষক কাণ্ড। সাপটা তারপর চুপচাপ শুয়ে থাকল, ভূরিভোজনের পর ক্লান্ত। ওটার লম্বা শরীর বেঢপ আকৃতি নিয়ে ফুলে আছে, পুরোটা দৈর্ঘ্যের মাঝামাঝি জায়গায়। ফোলার আকৃতি দেখে দর্শকদের বুঝতে অসুবিধে হলো না চাপ খেয়ে ছোট হয়ে যাওয়া ওটা একটা মনুষ্য দেহ।
‘আমাদের সবার জন্যে একটা ইন্টারেস্টিং শিক্ষা।’ আবার হাত দিয়ে পিস্তলের মত আওয়াজ করল সও মং। পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল জানালা, আলোকিত হয়ে উঠল কামরা। কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে, কোন শব্দ না করে টেবিলের সামনে ফিরে এল সবাই-অনেকেই কাঁপছে।
জার্মান প্রতিনিধি ফন এফেন, ব্যক্তিগতভাবে জীবিত আর্থার মার্টিনসনকে যে চিনত, কাঁপা কাঁপা গলায় সে-ই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল, ‘আপনি বললেন,’ আবার শুরু করার আগে দু’বার ঢোক গিলতে হলো তাকে, একবার ঘাম মুছতে হলো কপালের, ‘আপনি বললেন, মার্টিনসন সব কথা বলেছে…
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল সও মং। ‘কথা বলেছে। বলা চলে প্রাণ খুলে গান গেয়ে গেছে। তার মুখ থেকেই তো জানতে পারলাম, বি.এ. ফ্লাইট টুয়েলভে আমাদের অপেক্ষায় কমান্ডো ছিল। কেউ বেঈমানী করেছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা চলছে। তবে এমনও হতে পারে যে দুর্লভ বা খুব বেশি মূল্যবান কার্গো পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, কমান্ডোরা ছিল সেই ব্যবস্থারই অংশবিশেষ।
‘প্রথম থেকেই শুরু করি। অপারেশনটা শুরু হয় প্ল্যান অনুসারেই, ঘড়ির কাঁটা ধরে। প্রশংসা করি মেয়েটার, ওই বিশেষ ফ্লাইটে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে সে, শরীরে লুকিয়ে স্মোক ক্যান আর অস্ত্রগুলো প্লেনে তোলে। কোন সন্দেহ নেই হামলাটা শুরুও করা হয়েছিল যথাসময়ে, একেবারে নির্দিষ্ট সেকেন্ডে। কিন্তু আর্থার মার্টিনসন অংশ গ্রহণ করেনি। তার অজুহাত ছিল, প্লেনের পিছনে আটকা পড়ে সে। যতদূর জানা গেছে, বি. এ. টুয়েলভে পাঁচজন কমান্ডো ছিল। মার্টিনসনের বিবরণ অনুসারে, তারা সবাই ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টিটেরোরিজম অর্গানাইজেশনের সদস্য। এবং তাদের কমান্ডার বা লীডার ছিল…,’ থামল সও মং, সবার দিকে পালা করে তাকাল একবার, ‘…আমাদের, আই মীন, হার্মিসের পরম শত্রু।
টেবিল ঘিরে বসা লোকগুলো অপেক্ষায় থাকল, কি না কি শুনতে হবে এই আশঙ্কায় টান টান হয়ে উঠল সবার পেশী।
দুনিয়াটা ভাল জায়গা নয়, এতদিন এই মিথ্যে বুলি-বচন শুনে এসেছি আমরা। প্রচলিত সিস্টেমের অধীনে সত্যি দুনিয়াটা ভাল জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই দোষ দুনিয়ার নয়, দোষ তাদের যারা দুনিয়াটা চালাচ্ছে। অনেক ধৈর্য ধরা হয়েছে, অনেক অত্যাচার আর নিষ্পেষণ সহ্য করা হয়েছে, কিন্তু আর নয়। এবার আমাদের ঘুম ভেঙেছে। আমরা জেগেছি। বহু বছরের সাধনায় ইউনিয়ন কর্স-এর গর্ভে জন্ম নিয়েছে একটা আদর্শ বা নীতি। আমরা যারা সেই নীতি বা আদর্শের অনুসারী তাদেরকে অবশ্যই সুন্দর আর অসুন্দরের পার্থক্য নির্ণয় করতে শিখতে হবে। একটা আধুনিক অট্টালিকার সামনে যদি বেঢপভাবে বেড়ে ওঠা ঝোপ-ঝাড় থাকে, সেটা অসুন্দর দেখায়-উচিত হবে ঝোপ-ঝাড় অর্থাৎ অসুন্দরকে কেটে সাফ করে ফেলা। মানব সমাজেও সুন্দর আর অসুন্দর সহাবস্থান করছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। সুশ্রী, রুচিসম্পন্ন, ক্ষমতাধর, মেধাবী আর বুদ্ধিমান যারা তারাই সুন্দর। আর যারা নিজেদেরকে অসহায় মনে করে, যারা কুশ্রী, দুর্বল আর ভোঁতা, তাদের এ-দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। দুনিয়াকে বাসযোগ্য করতে হলে অবশ্যই লোকসংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এ-সবই আমাদের আদর্শ বা নীতির অন্তর্ভুক্ত।
‘কিন্তু প্রথমে আমাদেরকে ক্ষমতা দখল করতে হবে। তারপর নীতির বাস্তবায়ন। আর ক্ষমতা দখল করতে হলে অনেক বাধা পেরোতে হবে আমাদেরকে। আপনারা জানেন, সও মং নামটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। সও মং ছিলেন আমাদের নমস্য গুরু। ইউনিয়ন কর্সের ছদ্মনাম হার্মিস ও তাঁর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি আমরা। সও মং আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ তিনি আমাদের মধ্যে রেখে গেছেন, রেখে গেছেন হার্মিসের মত অক্ষয় একটা প্রতিষ্ঠান।
‘আপনারা জানেন, হার্মিসের গঠনতন্ত্র খানিকটা রদবদল করা হয়েছে। হার্মিসকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করার সময় একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হয়েছিলাম। এর আগে বহুবার দেখা গেছে, কোন প্রতিষ্ঠান যদি বৈপ্লবিক কোন আদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করতে চায়, প্রথম আঘাতটা আসে তার নেতার ওপর। নেতা না থাকলে কোন সংগঠন টিকে থাকতে পারে না। তাই আমরা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের নেতাকে আমরা সও মং বলে সম্বোধন করব না, তাকে এমনকি একজন বাদে আমরাও কেউ চিনব না। সেই একজন হলাম আমি। সও মং নই, তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। যদি কোন আক্রমণ আসে, নেতা মনে করে আমার ওপরই আসবে। আপনারা সবাই আমার নির্দেশে চলবেন, কারণ আমার কাছ থেকে নির্দেশগুলো আসলে আপনারা আমাদের নেতার কাছ থেকেই পাচ্ছেন। এখানে মোট আমরা এগারোজন রয়েছি, একজন বাদে কেউ আমরা তাঁকে চিনি না, কিন্তু তিনি আমাদের সবাইকে চেনেন, এবং কে জানে এই মুহূর্তে তিনি হয়তো আমাদের মাঝে উপস্থিতও রয়েছেন।’
প্রতিনিধিরা সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
সও মং তাড়াতাড়ি শুরু করল আবার, ‘আমাদের নমস্য গুরু, আদি সও মঙের একজন পরম শত্রু ছিল, আজও বেঁচে আছে সে। মার্টিনসন তাকে পরিষ্কার চিনতে পেরেছে বি.এ. ফ্লাইট টুয়েলভে। আমাদের আদর্শ বাস্তবায়নের পথে এই শক্তিশালী শত্রু একটা বড় বাধা। আপনারা তাকে চেনেন, নাম বললেই চিনতে পারবেন। তার নাম মেজর মাসুদ রানা। বি.এ. ফ্লাইট টুয়েলভে ছিল সে, আমাদের বেশিরভাগ ক্ষতি তার হাতেই হয়েছে।’
প্রতিনিধিদের চেহারা কঠোর হয়ে উঠল, সবাই তাকিয়ে আছে সও মঙের দিকে।
প্রথম কথা বলল জেফরি অ্যাডামস্, ‘আপনি চান, রানাকে আমি খতম করার ব্যবস্থা করি?’
সও মঙের প্রতিনিধি তাকে থামিয়ে দিল, ‘তাকে খতম করার চেষ্টা এর আগেও হয়েছে। কোন লাভ হয়নি। না, প্রচলিত উপায়ে কিছু করা যাবে না। তার পিছনে লোক লাগিয়ে আমরা কোন সুবিধে করতে পারব না। আমাদের নেতা তার সাথে বিশেষ একটা হিসাব মেটাতে চান। আমি বিশেষ একটা ব্যবস্থা করেছি, সেটাকে আপনারা টোপ বলতে পারেন। টোপটা যদি গেলে, না গেলার কোন সম্ভাবনা আমি তো অন্তত দেখি না, মাসুদ রানাকে অচিরেই আপনারা আটলান্টিকের এদিকে আমাদের সঙ্গ উপভোগ করতে দেখতে পাবেন। আমাদের নেতা চান, আজ যেভাবে মার্টিনসনের সাথে হিসাব মেটানো হলো, মাসুদ রানার সাথেও ওই একই কায়দায় হিসাব মেটানো হবে।’
এক এক করে আবার সবার দিকে তাকাল সও মং, দেখে নিল আলোচ্য বিষয়ে সবার সবটুকু মনোযোগ আছে কিনা। শিগগিরই,’ বলে চলল সে, ‘আমরা আমাদের ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি। সিকিউরিটির কারণে আপাতত অপারেশনটার নাম রাখা হয়েছে-বুলডগ। আমেরিকার তরফ থেকে বিরাট একটা হুমকি হলো ফ্লাইং ড্রাগন। পৃথিবীর কক্ষপথে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে ওগুলো। ওই ফ্লাইং ড্রাগনগুলোই আমাদের টার্গেট। অসুন্দরের ধ্বংসসাধনে ওগুলোই হবে আমাদের মোক্ষম হাতিয়ার। কিন্তু তার আগে হার্মিসের মুঠোয় ধরা পড়তে হবে মাসুদ রানাকে। কারণ আমাদের ডিটেলড্ প্ল্যানে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।’
কামরার ভেতর গম্ভীর গুঞ্জন শোনা গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে একমত হলো সবাই। সোনার চেইন লাগানো হাতঘড়ির দিকে তাকাল সও মং, বলল, ‘আন্দাজ করি, সম্ভবত এরই মধ্যে আমার টোপ গিলে ফেলা হয়েছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আমরা মাসুদ রানাকে মুখোমুখি দেখতে পাব। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, সে জানবে না কার সাথে তার দেখা হলো বা কি লেখা আছে তার কপালে।