আপেল বাগান
মুরগিদের নিয়ে অসুবিধা হলো— তারা তাদের জনসভায় সবসময় প্রধান অতিথি করে থাকে একজন শিয়ালকে। ওই শিয়ালের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না।
একবার এক কবুতর, শিয়ালদের ডেরা থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করলো, এবং মুরগিদের তা দেখিয়ে বললো— এ হাড়গুলো তোমাদের। প্রতিবার জনসভা শেষে যে-মুরগিগুলো শিয়ালকে এগিয়ে দিয়ে আসতে যায়, তারা যে কখনো ফিরে আসে না এটি খেয়াল করেছো?
হ্যাঁ, করেছি, মুরগিরা বলে, শিয়াল স্যার তাদেরকে আপেল বাগান দেখাতে নিয়ে যান। স্যার বলেছেন, বড়ো হলে আমরাও একদিন আপেল বাগান দেখার সুযোগ পাবো।
তোমরা তা বিশ্বাস করেছো? কবুতরটি বলে।
বিশ্বাস না করার কী আছে, মুরগিরা বলে, শিয়াল স্যার আগেই বলেছেন, মুরগিদের উন্নতি কখনো কবুতরেরা সহ্য করতে পারবে না। তারা নানাভাবে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। ওরা চাইবে না, তোমরা কখনো আপেল খাও। শুনো কবুতর, এই হাড় দেখিয়ে তুমি আমাদেরকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছো। কিন্তু আমরা বিপথে যাবো না। শিয়াল স্যারের ওপর আমাদের অগাধ আস্থা।
কিন্তু আমি স্বচক্ষে দেখেছি, কবুতর বলে, কটকই গাছের ঝোপে শিয়াল তোমাদের একজনকে ধরে খাচ্ছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একদিন নিজে গিয়ে দেখে আসতে পারো। আমি নিয়ে যাবো। আগামী সভার দিনই চলো?
শুনো কবুতর, মুরগিরা বলে, তুমি কি শিয়াল স্যারের ওপর আমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষা নিতে চাচ্ছো? আমরা এ ফাঁদে পা দেবো না। তুমি সাবধান হয়ে যাও।
তোমরা আমাকে ভুল বুঝছো, কবুতর বলে, শিয়ালদের কোনো আপেল বাগান নেই। ওই পাহাড় আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও আপেল বাগান পাইনি। শুধু শিয়াল আর শিয়াল।
এ পর্যায়ে একটি বুড়ো মুরগি, মাথা চুলকিয়ে বলে, আমাদের জমিরের বাপ একদিন শিয়াল স্যারের লগে পাহাড়ে গেছিলো, আঠারো মাস আগে, হে অহনও ফিরা আহে নাই, শিয়াল স্যার কইছে— হে সারাদিন বাগানে আপেল খায়, আপেল খাইয়া শইল-গতরও ভালা হইছে, কিছু আপেল একবার আমগো লাইগা পাঠাইছিলোও, কিন্তু শিয়াল স্যার আনতে ভুইলা গেছে। শুনতাছি শিয়াল স্যার আমারে আর জমিররেও আপেল বাগানে লইয়া যাইবো, আমি তো যাইবার চাই না, তয় তোমার লগে একবার যাইতে চাই কবুতর, কিন্তু শিয়াল স্যারের নামে কোনো আজেবাজে কথা কইবা না। আমারে সোজা আপেল বাগানে লইয়া যাইবা, আমি জমিরের বাপরে এক নজর দেইখা-ই আইয়া পড়মু। শিয়াল স্যার যেন এইডা আবার টের না পায়।
উপস্থিত মুরগিরা রি রি করে ওঠে। তারা বলে, জমিরের মা, তুমি কিন্তু শিয়াল স্যারের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করতেছো। শিয়াল স্যার বলছেন, যে- মুরগি কবুতরের কথায় তার নেতাকে সন্দেহ করবে, তার অপঘাতে মৃত্যু হবে। তুমি আমাদের দল থেকে বেরিয়ে যাও। একজন বললো, শরীল- গতর ভালা অইলে শিয়াল স্যার এমনিতেই তোমারে বাগানে নিতো। কয়ডা দিন অপেক্ষা করতে পারলা না।
সবাই স্লোগান দিলো- শকুনের দালাল নিপাত যাক। কবুতরেরা হুঁশিয়ার, কবুতরেরা সাবধান। জমির নিজেও এ স্লোগানে অংশ নিলো। সব মুরগি ঠুকরিয়ে জমিরের মা’কে বের করে দিলো। দৌড়ে গিয়ে একটি বাঁশঝাড়ে আশ্রয় না নিলে, জমিরের মা ওখানেই লাশ হয়ে যেতো।
কবুতরটি যতোই বলে— জমিরের বাপ জীবিত নেই, পাহাড়ে কোনো আপেল বাগান নেই, জমিরের মা ততোই কবুতরটির সাথে পাহাড়ে যাওয়ার জেদ ধরতে থাকে।
একদিন জনসভা শেষে, কবুতরটি চুপিচুপি, জমিরের মাকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দেয়। পাহাড়ে পৌঁছে তারা দেখতে পায়, শিয়াল তার পেছনে পেছনে আসা মুরগিদেরকে নিয়ে একটি ঝোপের ভেতর ঢুকছে।
এর কয়েক মিনিট পর জমিরের মা তার ভাতিজা রহমত আলির চিৎকার শুনতে পায়। রহমত আলি অরণ্যের গহীন থেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। জমিরের মা এ চিৎকার শুনে ভয়ে নিজেও চিৎকার দিয়ে ওঠে। কবুতরের সাবধানবাণীর কথা সে ভুলে যায়। কক কক কক করে দৌড়ে যায় দশ ফুট, আর অমনি জমিরের মা’র গলাটি খপ করে ধরে ফেলে একটি শিয়াল।
কবুতরটি শুনতে পায়, জমিরের মা সর্বশক্তি দিয়ে বলছে— জমির, ও বাবা জমির, শিয়ালদের কোনো আপেল বাগান নাই রে। আমাদের জনসভাই তাদের আপেল বাগান।