আপনি কী করেন?
আপনি কী করেন? এ প্রশ্নটি যিনি করেন, তার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এটি মোটেও নিরীহ কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্নকর্তা একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করেন, এবং উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত অসৎ। তিনি নিশ্চিত হতে চান যে, আমি তার চেয়ে ক্ষমতাধর কেউ কি না। এ প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করে, আমার সাথে তিনি কেমন আচরণ করবেন, তা।
যদি বুঝতে পারেন আমি সাধারণ গফুর, আমার আয় সামান্য, আমি টেনেটুনে চলি, যাকে পাই তাকেই সালাম দিই, আমার আত্মীয়দের মাঝে কেউ অস্ত্র বহন করে না, ব্যাংক হিসাবে খরা লেগে আছে, পড়াশোনা কম, চড় মারলে টু শব্দটিও করবো না- তাহলে তিনি খুশি হন, নিরাপদ বোধ করেন, এবং মন দেন নিজের কাজে। আমার প্রতি তার আর কোনো আগ্রহ থাকে না। আমার ওজন তার কাছে এক লাফে শূন্যে গিয়ে ঠেকে।
কিন্তু যদি টের পান যে আমি বড়ো ব্যবসায়ী, আমি একটি মন্ত্রণালয় চালাই, দুটি জেলা ও তিনটি বিভাগের মালিকানা আমার ঘাড়ে, চড়ি শুল্কমুক্ত গাড়ি, অস্ত্রের সাথে রয়েছে গভীর আত্মীয়তা, লোকজন আমাকে স্যার ডাকেন, নামের আগে বসানো হয় মাননীয়, ব্যাংক হিসাব নয়, আমার নিজেরই একটি ব্যাংক আছে- তাহলে তিনি লাফ দিয়ে ওঠেন। চেয়ার এগিয়ে দেন, হাত বাড়িয়ে দেন, তোলপাড় করে তোলেন চারপাশ, এবং মনে মনে অনিরাপদ ও বিপন্ন বোধ করেন।
এর কারণ— তিনি একটি সংকটে ভোগেন, এবং তার সংকটটি সরল নয়। তিনি একই সাথে ক্ষমতাকে পছন্দ ও ঘৃণা করেন। যদি ক্ষমতাকে শুধুই পছন্দ, কিংবা শুধুই ঘৃণা করতেন, তাহলে তার এ সংকট হতো না। এমনকি ক্ষমতার প্রতি ভাবলেশহীন থাকলেও তিনি সংকটটিকে এড়াতে পারতেন। তখন ‘আমি কী করি’, এ নিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন হতে হতো না। আমি ক্ষমতাবান কি না- বিষয়টিও তাকে আলোড়িত করতো না। তিনি আমার সাথে করতে পারতেন সাধারণ ও স্বাভাবিক আচরণ।
কিন্তু একই সাথে প্রীতি ও ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ক্ষমতাকে করে তোলেন গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আগ—কের সাথে সাক্ষাতের শুরুতেই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তার ক্ষমতা নিরূপণে।
কেন একজন মানুষ ক্ষমতাকে একই সময়ে পছন্দ ও ঘৃণা করেন? বা গুরুত্বহীন ক্ষমতাকে করে তোলেন গুরুত্বপূর্ণ? এর মূল কারণ সম্ভবত, তিনি একটি রাষ্ট্রের বাসিন্দা। রাষ্ট্র তার বাসিন্দাদের ওপর কিছু সংস্কৃতি আরোপ করে। যেমন- রাষ্ট্র চায়, নাগরিকরা সারাক্ষণ উৎপাদনকর্মে নিয়োজিত থাকুক। কিন্তু কোনো নাগরিক, তার যতোটুকু প্রয়োজন ঠিক ততোটুকু উৎপাদন করলে রাষ্ট্র খুশি হয় না। রাষ্ট্র খুশি হয় তখন, যখন নাগরিকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন করেন। কারণ:
কেবল অতিরিক্ত উৎপাদন করলেই আপনি কিছু পণ্য ও সেবা বিক্রি করবেন, এবং লিপ্ত হবেন বেচাকেনায়। রাষ্ট্র তার পরিচালনা-খরচ আহরণ করে নাগরিকদের বেচাকেনা থেকে। যে-রাষ্ট্রে বেচাকেনা শূন্য, সে-রাষ্ট্র মৃত রাষ্ট্র। এ জন্য রাষ্ট্র চায়, যেকোনো মূল্যে বেচাকেনা চালু রাখতে। এর সাথে রাষ্ট্রচালকদের আরাম-আয়েশের সরাসরি সম্পর্ক আছে।
রাষ্ট্র পছন্দ করে দুটি শ্রেণীর মানুষকে–
এক: যারা অতিরিক্ত উৎপাদন করেন, এবং উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বেচাকেনা করেন। কৃষক, শ্রমিক, স্বর্ণকার, শিল্পপতি, দোকানদার, ট্র্যাভেল এজেন্ট, পেশাজীবী, এরা এ শ্রেণীর নাগরিক। এ শ্রেণী ভোগযোগ্য সম্পদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্র পরিচালনার খরচ যোগান দেন।
দুই: যারা প্রথম শ্রেণীর অতিরিক্ত উৎপাদন থেকে রাষ্ট্রের জন্য কর আহরণ করে তা খরচ ও অপচয় করেন। রাষ্ট্র যারা চালান, তারা এ শ্রেণীর নাগরিক। রাষ্ট্র কারা চালান? রাষ্ট্র চালান তারা, যারা রাষ্ট্র থেকে বেতন নেন, কিংবা বেতনের সমতুল্য বৈষয়িক সুবিধাদি গ্রহণ করেন।
তবে বৈধ কর ছাড়াও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক সদস্য প্রথম শ্রেণী থেকে অবৈধ কর বা ঘুষ আদায় করে থাকে। কোনো রাষ্ট্রে প্রথম শ্রেণীটি বিলুপ্ত হলে দ্বিতীয় শ্রেণীটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোপ পায়।
প্রথম শ্রেণীটি হলো রাষ্ট্রের আর্থিক যোগানদাতা, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীটি হলো ওই যোগানকৃত অর্থের ভোক্তা ও পাহারাদার। রাষ্ট্র তার টিকে থাকার স্বার্থে দ্বিতীয় শ্রেণীটিকে প্রথম শ্রেণীর চেয়ে বাড়তি নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এ উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয় বৈষম্যমূলক বিধি ও আইন। ফলে বদরাষ্ট্রগুলোতে, দ্বিতীয় শ্রেণীর সদস্যরা ভোগ করতে পারেন ঈর্ষণীয় রাষ্ট্রীয় সুবিধা। এ সুবিধার উৎস মূলত প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের কাছ থেকে আহরিত বৈধ ও অবৈধ কর।
প্রথম শ্রেণীর নাগরিকগণ নিরস্ত্র (একমাত্র ব্যতিক্রম আমেরিকা, ওখানে সাধারণ নাগরিকরাও অস্ত্র বহন করতে পারেন)। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকরা নিজে অস্ত্র বহন করেন, অথবা অন্য অস্ত্রবাহকদের দ্বারা সুরক্ষিত থাকেন। প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরাও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের অস্ত্রের সুরক্ষা পান, যেমন পুলিশের, কিন্তু সেটি আসলে নির্বিঘ্ন উৎপাদন ও বেচাকেনার স্বার্থে।
এ জন্য খারাপ রাষ্ট্রগুলোতে (পরিবেশের প্রভাবে), প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের মনে জন্ম নেয় নানা ক্ষোভ ও হীনম্মন্যতা। এ হীনম্মন্যতা থেকেই সৃষ্টি হয় ক্ষমতাপ্রীতি ও ভীতি। তখন প্রথম শ্রেণীটিরও সাধ জাগে, শ্রেণীবদল করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাওয়ার। শ্রেণীবদলের এ স্বপ্ন কারও কারও পূরণ হয়, তবে অধিকাংশেরই হয় না। কারণ দ্বিতীয় শ্রেণীর চেয়ে প্রথম শ্রেণী অধিক জনবহুল, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে লোকবলের চাহিদা কম। চাহিদার চেয়ে আগ্রহীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তৈরি হয় প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির জন্য যে-মরিয়া যুদ্ধ, তার মূল কারণ প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের শ্রেণী পরিবর্তনের লোভ।
তবে প্রথম শ্রেণীর কিছু সদস্য সহজে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেতে পারেন। যেমন— ধনী ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী টিভিমুখ, নামকরা পেশাজীবী, তারা। একজন কৃষক বা শ্রমিকের চেয়ে রাষ্ট্রচালক হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেশি। বাংলাদেশের সংসদে এমনটি ঘটছে। আইনসভাটির সিংহভাগ সদস্য এখন ধনী ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী।
যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই শ্রেণী পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়, তাই দ্বিতীয়শ্রেণিলোভী প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের মনে জন্ম নেয় ক্ষমতার প্রতি ঘৃণা। একই সাথে, প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরা ক্ষমতাকে ভালোও বাসতে থাকেন, কারণ প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তরণের স্বপ্ন ভেতরে ভেতরে তারা বাঁচিয়ে রাখেন।
মুশকিল হলো, প্রথম শ্রেণী থেকে যারা দ্বিতীয় শ্রেণীতে সফলভাবে গমন করেন, তাদের ভেতর দেখা দেয় আরেকটি নতুন রোগ। তারা আতঙ্কে থাকেন, কে কখন এসে কেড়ে নিয়ে যায় ক্ষমতা! এ এক সংকটময় পরিণতি। এ সংকট থেকেই অনেকে জিগ্যেস করেন- আপনি কী করেন? করে নিশ্চিত হতে চান, আমি তার ক্ষমতা কেড়ে নেবো কি না।
তবে ‘আপনি কী করেন’ প্রশ্নের সবচেয়ে বড়ো শিকার শিশুরা। ইশকুলে গিয়েই তারা শুনতে পায়- তোমার বাবা কী করেন? মা কী করেন? যেহেতু শিশুরা নিজে কিছু করে না, তাই প্রশ্নকর্তা শিশুটির ক্ষমতা মাপতে চান তার বাবা-মা’র ক্ষমতা দ্বারা। বাবা-মা’র পরিচয়ই এখানে নির্ধারণ করে, শিশুটিকে ইশকুলে কতোখানি সমীহ ও কতোকেজি অবহেলা করা হবে তা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ চর্চা প্রত্যক্ষ করেছি। যাদের জন্ম কৃষক বা শ্রমিক পরিবারে, তারা ‘তোমার বাবা কী করেন’- এ ধরনের প্রশ্নে খুব বিব্রত হন। মুচির ছেলেকে তখন বলতে হয়, আমার বাবা জুতোর ব্যবসা করেন, নামকরা চারটি ব্রান্ডের ডিলার। পল্লী চিকিৎসকের ছেলেকে বলতে হয়, বাবা এমবিবিএস ডাক্তার, শহরে নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। কৃষকের ছেলে বলে, বাজারে আমরা পাঁচতলা মার্কেট বানিয়েছি, লাখ টাকা ভাড়া আসে। দিনমজুরের মেয়ে কী বলবে ভেবে পায় না। সে চুপচাপ শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু যাদের জন্ম স্যার পরিবারে, তারা এ ধরণের প্রশ্নে খুব খুশি হন। ঝলমলিয়ে উঠেন। বাবার রাজত্বের কথা গা টান টান করে বলতে থাকেন।
এর কারণ কী? এর কারণ রাষ্ট্রের আচরণ। রাষ্ট্র সবার সাথে একই আচরণ করে না। কৃষক, শ্রমিক, মজুর, দোকানদার, গরু পাইকার, ট্রাকচালক, মুচি, রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, সবজিওয়ালা, নাপিত, বাবুর্চি, নার্স, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা, বাসচালক, ঝাড়ুদার, বিড়িওয়ালা, চৌকিদার, আর্দালি, তাদের সাথে রাষ্ট্রের আচরণ একরকম; আর মন্ত্রী, সাংসদ, রাষ্ট্রপতি, মেয়র, শিল্পপতি, উপাচার্য, গভর্নর, সচিব, ডিসি, চেয়ারম্যান, ইউএনও, অভিনেতা, দালাল, শিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, বিউটিশিয়ান, বৈমানিক, পুলিশ, আর্মি, ন্যাভি, রাজনীতিক, অধ্যাপক, ঠিকাদার, ফায়ার সার্ভিস, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, বিচারপতি, নির্বাচন প্রকৌশলী, সংঘবাদী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক, লিপস্টিক, ব্যাংকার, প্রশংসাকার, লেখক, তাদের সাথে রাষ্ট্রের আচরণ অন্য রকম।
রাষ্ট্রের আচরণই এখানে নির্ধারণ করছে মানুষের সামাজিক নিয়তি। শিশুদের বোকা ভাবা ঠিক নয়। ওরা বুঝতে পারে, সমাজে তাদের বাবা-মা গৃহীত নাকি নিগৃহীত। যদি টের পায়, রাষ্ট্রের চোখে তাদের আপনজনরা একটি ভাঙা ছাতার সমান, তাহলে ইশকুলে তারা আর ওই প্রশ্নটি শুনতে চায় না। শুনলে তাদের ভেতর কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, এবং মনে মনে সংকল্প করে- আমাদেরকেও হতে হবে তাদের মতো, যারা রাষ্ট্রের চোখে ভাঙা ছাতা নয়। এ সংকল্প শিশুদেরকে নষ্ট করে ফেলে। তারা আর শিশু থাকে না।
তাদের প্রতিভাগুলো বিকৃত হতে শুরু করে। কারও হয়তো ভালো লাগতো ঘুড়ি ওড়ানো, কিন্তু ঘুড়ি ওড়াতে তার আর ইচ্ছে করে না। সে ছবি আঁকা ছেড়ে দেয়, খেলাধুলা ছেড়ে দেয়, ছড়া লেখা ছেড়ে দেয়, গান গাওয়া ছেড়ে দেয়, প্রশ্ন করা ছেড়ে দেয়, যা যা ভালো লাগতো তার সবই ছেড়ে দেয়। মানুষ থেকে শিশুটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে প্রতিযোগী। সে অংশ নেয় শ্রেণী পরিবর্তনের এক কুৎসিত ইঁদুর দৌড়ে।
এ দৌড়ে জয়ী হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প থাকে না। কারণ সে জানে, বিয়ে করার সময়ও তাকে শুনতে হবে- আপনি কী করেন- এরকম একটি প্রশ্ন। সন্তানকে ইশকুলে গিয়েই শুনতে হবে, তোমার বাবা কী করেনড়এ প্রশ্নটি। তাই এ প্রশ্নগুলোর একটি ভালো উত্তর খোঁজাই শিশুটির জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।