পাঁচ
অনাদি হালদারের বাসায় যখন পৌঁছিলাম, তখন রাত্রি সাড়ে চারটা। কলিকাতা শহর দুপুর রাত্রি পর্যন্ত মাতামাতি করিয়া শেষ রাত্রির গভীর ঘুম ঘুমাইতেছে।
নীচের তলায় সদর দরজা খোলা। সিঁড়ির ঘরে কেহ নাই। ষষ্ঠীবাবু বোধ করি ক্লান্ত হইয়া শুইতে গিয়াছেন। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া দেখিলাম, দরজার হুড়কা ভাঙা; কবাট ভাঙে নাই, হুড়কাটা ভাঙিয়া একদিকে ছিটকাইয়া পড়িয়াছে। আমরা ব্যোমকেশকে অগ্রে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলাম।
আমরা প্রবেশ করিতেই ঘরে যেন একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। ঘরে কিন্তু মাত্র তিনটি লোক ছিল; ননীবালা, প্রভাত ও ন্যাপা। তাহারা একসঙ্গে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ন্যাপা বলিয়া উঠিল, ‘কে? কে? কি চাই?’ বলিয়াই আমাদের পশ্চাতে কেষ্টবাবুকে দেখিয়া থামিয়া গেল। ননীবালা থলথলে মুখে প্রকাণ্ড হাঁ করিয়া নিজের অজ্ঞাতসারেই উচ্চকণ্ঠে স্বগতোক্তি করিলেন, ‘অ্যাঁ, ব্যোমকেশবাবু!’ তিনি আমাদের দেখিয়া বিশেষ আহ্লাদিত হইয়াছেন মনে হইল না। প্রভাত বুদ্ধিহীনের মত চাহিয়া রহিল।
ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া ননীবালার উদ্দেশে বলিল, ‘কেষ্টবাবু আমাকে ডেকে এনেছেন। পুলিস এখনও আসেনি?’
ননীবালা মাথা নাড়িলেন। ব্যোমকেশ ন্যাপার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে বিহ্বলভাবে বলিয়া উঠিল, ‘আপনি—ব্যোমকেশবাবু, মানে—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। ইনি আমার বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন আমরা এসেছিলাম মনে আছে বোধহয়। আপনি পুলিস ডাকতে গিয়েছিলেন না? কী হল?’
ন্যাপা কেমন যেন বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিল, চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘পুলিস—হ্যাঁ, থানায় গিয়েছিলাম। থানায় কেউ ছিল না, একটা জমাদার টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার কথা শুনে রেগে উঠল, বললে, যাও যাও, একটা হিন্দু মরেছে তার আবার এত হৈ-চৈ কিসের। লাশ রাস্তায় ফেলে দাওগে। আমি চলে আসছিলাম, তখন আমাকে ডেকে বললে—ঠিকানা রেখে যাও, সকালবেলা দারোগা সাহেব এলে জানাবো। আমি অনাদিবাবুর নাম আর ঠিকানা দিয়ে চলে এলাম।’
ক্ষেত্রবিশেষে পুলিসের অবজ্ঞাপূর্ণ নির্লিপ্ততা এবং ক্ষেত্রান্তরে অতিরিক্ত কর্তব্যবোধ সম্বন্ধে কোনও নূতনত্ব ছিল না; বস্তুত অভ্যাসবশেই আশা করিয়াছিলাম যে, পুলিস সংবাদ পাইবামাত্র ছুটিয়া আসিবে। ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কেষ্টবাবুকে আপনারা অনাদিবাবুর হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে এই ব্যাপারের তদন্ত করতে চাই। কারুর আপত্তি আছে?’
কেহ উত্তর দিল না, ব্যোমকেশের চক্ষু এড়াইয়া এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। তখন ব্যোমকেশ বলিল, ‘লাশ ব্যালকনিতে আছে, আপনারা কেউ ছুঁয়েছেন কি?’
সকলে মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিল।
আমরা তখন ব্যালকনিতে প্রবেশ করিলাম। দেয়ালের গায়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলিতেছিল, তাহার নির্নিমেষ আলোতে দেখিলাম অনাদি হালদারের মৃতদেহ কাত হইয়া মেঝের উপর পড়িয়া আছে, মুখ রাস্তার দিকে। গায়ে শাদা রঙের গরম গেঞ্জি, তাহার উপর বালাপোশ। বুকের উপর হইতে বালাপোশ সরিয়া গিয়োছে, গেঞ্জিতে একটি ছিদ্র; সেই ছিদ্রপথে গাঢ় রক্ত নির্গত হইয়া মাটিতে গড়াইয়া পড়িয়াছে। মৃতের মুখের উপর পৈশাচিক হাসির মত একটা বিকৃতি জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ নত হইয়া পিঠের দিক হইতে বালাপোশ সরাইয়া দিল। দেখিলাম এদিকেও গেঞ্জির উপর একটি সুগোল ছিদ্র। এদিকে রক্ত বেশি গড়ায় নাই, কেবল ছিদ্রের চারিদিকে ভিজিয়া উঠিয়াছে। বন্দুকের গুলি দেহ ভেদ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।
মৃতদেহ ছাড়িয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, অন্যমনস্কভাবে বাহিরে রাস্তার দিকে তাকাইয়া রহিল। আমি হ্রস্বকণ্ঠে প্রশ্ন করিলাম, ‘কি মনে হচ্ছে?’
ব্যোমকেশ অন্যমনে বলিল, ‘এই লোকটাই সেদিন আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিল, আশ্চর্য নয়?…..মৃতদেহ শক্ত হতে আরম্ভ করেছে……বোধহয় অনাদি হালদার রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বাজি পোড়ানো দেখছিল—’ ব্যোমকেশ রাস্তার পরপারে বড় বাড়িটার দিকে তাকাইল, ‘কিন্তু গুলিটা গেল কোথায়? শরীরের মধ্যে নেই, শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে—’
ব্যোমকেশের অনুমান যদি সত্য হয় তাহা হইলে গুলিটা ব্যালকনির দেয়ালে বিঁধিয়া থাকিবার কথা। কিন্তু ব্যালকনির দেয়াল ছাদ মেঝে কোথাও গুলি বা গুলির দাগ দেখিতে পাইলাম না। বন্দুকের গুলি ভেদ করিয়া বাহির হইবার সময় কখনও কখনও তেরছা পথে বাহির হয়; কিম্বা অনাদি হালদার হয়তো তেরছাভাবে দাঁড়াইয়া ছিল, গুলি ব্যালকনির পাশের ফাঁক দিয়া বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু, লাশ যেভাবে পড়িয়া আছে, তাহাতে মনে হয়, অনাদি হালদার রাস্তার দিকে সুমুখ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, বুকে গুলি খাইয়া সেইখানেই বসিয়া পড়িয়াছে, তারপর পাশের দিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে।
সামনে রাস্তার ওপারে ওই বাড়িটা। মাঝে ৭০/৮০ ফুটের ব্যবধান। হয়তো ওই বাড়ির দ্বিতল বা ত্রিতলের কোনও জানালা হইতে গুলি আসিয়াছে।
ব্যালকনিতে গুলির কোনও চিহ্ন না পাইয়া ব্যোমকেশ আর একবার নত হইয়া মৃতদেহ পরীক্ষা করিল। বালাপোশ সরাইয়া লইলে দেখিলাম, নিম্নাঙ্গে ধুতির কষি আল্গা হইয়া গিয়াছে, কোমরে ঘুন্সির মত একটি মোটা কালো সুতা দেখা যাইতেছে। ঘুন্সিতে ফাঁস লাগানো একটি চাবি। ব্যোমকেশ চাবিটি নাড়াচাড়া করিয়া দেখিল, তারপর সন্তর্পণে খুলিয়া লইয়া মৃতদেহের উপর আবার বালাপোশ ঢাকা দিয়া বলিল, ‘চল, দেখা হয়েছে।’
বাহিরে তখনও রাত্রির অন্ধকার কাটে নাই। রাস্তা দিয়া শাকসব্জি বোঝাই লরি চলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কলিকাতা শহরের বিরাট ক্ষুধা মিটাইবার আয়োজন চলিতেছে।
ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম, যে চারিজন লোক ঘরের মধ্যে ছিল তাহারা আগের মতই দাঁড়াইয়া আছে, কেহ নড়ে নাই। ব্যোমকেশ হাতের চাবি দেখাইয়া বলিল, ‘মৃতদেহের কোমরে ছিল। কোথাকার চাবি?’
একে একে চারিজনের মুখ দেখিলাম। সকলেই একদৃষ্টে চাবির পানে চাহিয়া আছে, কেবল ন্যাপার মুখে ভয়ের ছায়া। অবশেষে ননীবালা বলিলেন, ‘অনাদিবাবুর শোবার ঘরে লোহার আলমারি আছে, তারই চাবি।’
‘লোহার আলমারিতে কি আছে? টাকাকড়ি?’
সকলেই মাথা নাড়িল, কেহ জানে না। ননীবালা বলিলেন, ‘কি করে জানব। অনাদিবাবু কি কাউকে আলমারি ছুঁতে দিত? কাছে গেলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠত—’ প্রভাতের চোখের দিকে চাহিয়া ননীবালা থামিয়া গেলেন।
ন্যাপা অধর লেহন করিয়া বলিল, ‘আলমারিতে টাকাকড়ি বোধহয় থাকত না। কর্তা ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেন।’
ব্যোমকেশ চাবি পকেটে রাখিয়া বলিল, ‘আলমারিতে কি আছে পরে দেখা যাবে। এখন আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।—বাড়িতে ঢোকবার বেরুবার রাস্তা ক’টা?’
সকলে ভাঙা দ্বারের দিকে নির্দেশ করিল, ‘মাত্র ওই একটা।’
‘অন্য দরজা নেই?’
‘না।’
ব্যোমকেশ বেঞ্চির একপাশে বসিয়া বলিল, ‘বেশ। তার মানে অনাদিবাবুর যখন মৃত্যু হয় তখন বাড়িতে কেহ ছিল না, বাইরে থেকে গুলি এসেছে। প্রভাতবাবু, আপনি বলুন দেখি, আপনি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?’
প্রভাত মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া কিছুক্ষণ তাহার অগোছালো চুলে হাত বুলাইল, তারপর চোখ তুলিয়া বলিল, ‘আমি মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম আন্দাজ সাড়ে আটটার সময়।’
‘ও, আপনারা দু’জনে একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, মা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।’
‘তাই নাকি?’ বলিয়া ব্যোমকেশ ননীবালার পানে চাহিল।
ননীবালা বলিলেন, ‘আমার তো আর সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে না, ন’মাসে ছ’ মাসে একবার। কাল ঐ যে কি বলে শেয়ালদার কাছে সিনেমা আছে সেখানে ‘জয় মা কালী’ দেখাচ্ছিল, তাই দেখতে গিছলুম। এ বাড়ির রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়া আটটার মধ্যেই চুকে যায়, তাই রাত্তিরের শো’তে গিয়েছিলুম। প্রভাত বলল—’
ব্যোমকেশ তাঁহাকে থামাইয়া দিয়া বলিল, ‘আপনারা যখন বেরিয়েছিলেন তখন বাড়িতে কে কে ছিল?’
প্রভাত বলিল, ‘কেবল অনাদিবাবু ছিলেন। নৃপেনবাবু আটটার পরই বেরিয়ে গিয়েছিলেন।’
ব্যোমকেশ ন্যাপার দিকে ফিরিল, কিন্তু কোথায় ন্যাপা! সে এতক্ষণ ভিতর দিকের একটা দরজার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, কখন অলক্ষিতে অন্তর্হিত হইয়াছে।
ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ননীবালার দিকে ফিরিয়া হাত উল্টাইয়া প্রশ্ন করিল, ননীবালা অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া নীরবে দেখাইয়া দিলেন—ন্যাপা ওই দ্বার দিয়াই অন্তর্হিত হইয়াছে। ব্যোমকেশ তখন বিড়াল-পদক্ষেপে সেই দিকে চলিল; আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম।
খানিকটা সরু গলির মত, তারপর একটা ঘর। আলো জ্বলিতেছে। আমরা উঁকি মারিয়া দেখিলাম, ঘরের এক কোণে একটা টেবিলের দেরাজ খুলিয়া ন্যাপা ভিতরে হাত ঢুকাইয়া দিয়াছে এবং অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে কিছু খুঁজিতেছে। আমাদের দ্বারের কাছে দেখিয়া সে তড়িদ্বেগে খাড়া হইল এবং দেরাজ বন্ধ করিয়া দিল।
আমরা প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশ অপ্রসন্ন স্বরে বলিল, ‘এটা আপনার ঘর?’
ন্যাপা কিছুক্ষণ বোকার মত চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, আমার ঘর।’
‘আপনি না বলে চলে এলেন কেন? কি করছেন?’
ন্যাপা পাংশুমুখে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘কিছু না—এই—একটা সিগারেট খাব বলে ঘরে এসেছিলাম—তা খুঁজে পাচ্ছি না—’
খুঁজিয়া না পাওয়ার কথা নয়, সিগারেটের প্যাকেট টেবিলের এক কোণে রাখা রহিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কি? সিগারেটের প্যাকেট বলেই মনে হচ্ছে।’
ন্যাপা যেন আঁতকাইয়া উঠিল—‘অ্যাঁ—! ও—হ্যাঁ—দেশলাই—দেশলাই খুঁজে পাচ্ছি না—’
ব্যোমকেশ একবার তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া নিজের পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া দিল—‘এই নিন। ন্যাপা কম্পিত হস্তে দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইল।’
আমি ঘরের চারিদিকে একবার তাকাইলাম। ক্ষুদ্র ঘর, আসবাবের মধ্যে তক্তপোশের উপর বিছানা, একটি দেরাজযুক্ত টেবিল ও তৎসংলগ্ন চেয়ার। ঘরে একটি গরাদ লাগানো জানালা আছে।
জানালাটা খোলা রহিয়াছে। ব্যোমকেশ তাহার সামনে গিয়া দাঁড়াইল, আমিও গেলাম। আকাশ ফরসা হইয়া আসিতেছে। জানালা দিয়া অর্ধ-সমাপ্ত নূতন বাড়িটা দেখা গেল। মাঝখানে গভীর খাদের মত গলি গিয়াছে।
‘নৃপেনবাবু, আপনার বাড়ি কোথায়?’
ব্যোমকেশের এই আকস্মিক প্রশ্নে নৃপেন প্রায় লাফাইয়া উঠিল। সে টেবিলের কিনারায় ঠেস দিয়া সিগারেটে লম্বা টান দিতেছিল, বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া বলিল, ‘বাড়ি—?’
‘হ্যাঁ, দেশ। নিবাস কোথায়? কোন জেলায়?’
নৃপেন ভ্যাবাচাকা খাইয়া বলিল, ‘নিবাস? চব্বিশ পরগণা, ডায়মন্ডহারবার লাইনের খেজুরহাটে।’
ব্যোমকেশ জানালার দিক হইতে ফিরিয়া নৃপেনের পানে চাহিয়া রহিল, বলিল, ‘খেজুরহাট! আপনি খেজুরহাটের রমেশ মল্লিককে চেনেন?’
নৃপেন দগ্ধাবশেষ সিগারেট ফেলিয়া যেন ধূমরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘চিনি। আমাদের পাড়ায় থাকেন।’
‘খেজুরহাটে আপনার কে আছেন?’
‘খুড়ো।’
‘বাপ নেই?’
‘না।’
‘ভাল কথা, আপনার পুরো নামটা কী?’
‘নৃপেন দত্ত।’
ব্যোমকেশ নৃপেনের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, একটু ঘনিষ্ঠতার সুরে বলিল, ‘নৃপেনবাবু, আপনাকে দেখে কাজের লোক বলে মনে হয়। আপনি কতদিন অনাদিবাবুর সেক্রেটারির কাজ করছেন?’
নৃপেন একটু ভাবিয়া বলিল, ‘প্রায় চার বছর।’
‘চার বছর? এতদিন টিকে ছিলেন?’
নৃপেন চুপ করিয়া রহিল।
‘অনাদিবাবুর কেউ শত্রু ছিল কিনা আপনি নিশ্চয় জানেন?’
নৃপেন অসহায় মুখ তুলিল, ‘কার নাম করব? যার সঙ্গে কর্তার পরিচয় ছিল তার সঙ্গেই শত্রুতা ছিল। ঝগড়া করা ছিল ওঁর স্বভাব।’
‘বাড়ির সকলের সঙ্গেই ঝগড়া চলত?’
‘সকলকেই উনি গালমন্দ করতেন। কিন্তু আমরা ওঁর অধীন, আমাদের চুপ করে থাকতে হত। কেবল কেষ্টবাবু মাঝে মাঝে—’
‘প্রভাতকে অনাদিবাবু গালমন্দ করতেন?’
‘ঠিক গালমন্দ নয়, সুবিধে পেলেই খোঁচা দিতেন। প্রভাতবাবু কিন্তু গায়ে মাখতেন না।’
‘আচ্ছা, ওকথা থাক। বলুন দেখি কাল রাত্রে আপনি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?’
‘আটটার পরই বেরিয়েছিলাম।’
‘ফিরলেন কখন?’
‘আন্দাজ একটায়। ফিরে দেখলাম, ননীবালা দেবী আর প্রভাতবাবু দোর ঠেলাঠেলি করছেন।’
‘আপনি আটটা থেকে একটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’
‘সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।’
‘আপনিও ‘জয় মা কালী’ দেখতে গিয়েছিলেন?’
‘না, আমি একটা ইংরিজি ছবি দেখতে গিছলাম।’
‘ও! অত রাত্রে ফিরলেন কি করে?’
‘হেঁটে।’
লক্ষ্য করলাম ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নৃপেন অনেকটা ধাতস্থ হইয়াছে, আগের মত ভীত বিচলিত ভাব আর নাই। ব্যোমকেশ বলিল, ‘চলুন, এবার ওঘরে যাওয়া যাক।’