তিন
পরদিন সকালবেলা ব্যোমকেশ সংবাদপত্র পাঠ শেষ করিয়া কিছুক্ষণ ছটফট করিয়া বেড়াইল, তারপর বলিল, ‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ। চল, অনাদি হালদারকে দর্শন করে আসা যাক। ভাইপোদের দর্শন পেলাম, আর খুড়োকে দর্শন করলাম না, সেটা ভাল দেখায় না।’
বলিলাম, ‘ভাইপোদের কাছে তো খুড়োর ঠিকানা চেয়েছিল। খুড়োর কাছে কি চাইবে?’
ব্যোমকেশ হাসিল, ‘একটা কিছু মাথায় এসেই যাবে।’
বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ বাহির হইলাম। বৌবাজারের নম্বরের ধারা কোন্দিক হইতে কোন্দিকে গিয়াছে জানা ছিল না, নম্বর দেখিতে দেখিতে শিয়ালদহের দিকে চলিয়াছি। কিছুদুর চলিবার পর ফুটপাথে বাঁটুল সর্দারের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘কি বাঁটুল, এ পাড়াটাও কি তোমার এলাকা?’
বাঁটুল তৈলাক্ত মুখে কেবল হাসিল, তারপর পাল্টা প্রশ্ন করিল, ‘আপনারা এ পাড়ায় এলেন যে কর্তা? কিছু দরকার আছে নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ।—১৭২/২ নম্বরটা কোন্দিকে বলতে পার?’
বাঁটুলের চোখে চকিত সতর্কতা দেখা দিল। তারপর সে সামলাইয়া লইয়া বলিল, ‘১৭২/২ নম্বর? ওই যে নতুন বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, ওর পাশেই।’
আমরা আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম। কিছুদূর গিয়া ফিরিয়া দেখি বাঁটুল তখনও ফুটপাথে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে তাকাইয়া আছে, আমাকে ফিরিতে দেখিয়া সে উল্টা মুখে চলিতে আরম্ভ করিল।
আমি বলিলাম, ‘ওহে ব্যোমকেশ, বাঁটুল—’
সে বলিল, ‘লক্ষ্য করেছি। বোধ হয় ওদের চেনে।’
আরও খানিকদূর অগ্রসর হইবার পর নূতন বাড়ির সম্মুখীন হইলাম। চারিদিকে ভারা বাঁধা, মিস্ত্রীরা গাঁথুনির কাজ করিতেছে। একতলার ছাদ ঢালা হইয়া গিয়াছে, দোতলার দেয়াল গাঁথা হইতেছে। সম্মুখে কন্ট্রাকটরের নাম লেখা প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড। কন্ট্রাকটরের নাম গুরুদত্ত সিং। সম্ভবত শিখ।
বাড়ি পার হইয়া একটি সঙ্কীর্ণ ইট-বাঁধানো গলি, গলির ওপারে ১৭২/২ নম্বর বাড়ি। দোতলা বাড়ি, সদর দরজার পাশে সরু এক ফালি দাওয়া; তাহার উপরে তাহারই অনুরূপ রেলিং-ঘেরা ব্যালকনি। নীচের দাওয়ায় বসিয়া এক জীর্ণকায় পলিতকেশ বৃদ্ধ থেলো হুঁকায় তামাক টানিতেছেন। আমাদের দেখিয়া তিনি হুঁকা হইতে ওষ্ঠাধর বিমুক্ত না করিয়াই চোখ বাঁকাইয়া চাহিলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা কি অনাদি হালদারের বাসা?’
বৃদ্ধ হুঁকার ছিদ্র হইতে অধর বিচ্ছিন্ন করিয়া খিঁচাইয়া উঠিলেন, ‘কে অনাদি হালদার আমি কি জানি! এ আমার বাসা—নীচের তলায় আমি থাকি।’
ব্যোমকেশ বিনীত স্বরে বলিল, ‘আর ওপরতলায়?’
বৃদ্ধ পূর্ববৎ খিঁচাইয়া বলিলেন, ‘আমি কি জানি! খুঁজে নাও গে। অনাদি হালদার! যত সব—’ বৃদ্ধ আবার হুঁকায় অধরোষ্ঠ জুড়িয়া দিলেন।
বৃদ্ধ হঠাৎ এমন তেরিয়া হইয়া উঠিলেন কেন বোঝা গেল না। আমরা আর বাক্যব্যয় না করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। লম্বাটে গোছের একটি ঘর, তাহার একপাশে একটি দরজা, বোধ হয় নীচের তলার প্রবেশদ্বার; অন্য দিকে এক প্রস্থ সিঁড়ি উপরে উঠিয়া গিয়াছে।
আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিব কিনা ইতস্তত করিতেছি, এমন সময় সিঁড়িতে দুম্ দুম্ শব্দ শুনিয়া চোখ তুলিয়া দেখি, ইয়া-লম্বা-চওড়া এক সর্দারজী বাঁকের মোড় ঘুরিয়া নামিয়া আসিতেছেন। অনাদি হালদারের বাসা সম্বন্ধে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কারণ ইনি নিশ্চয় কন্ট্রাকটর গুরুদত্ত সিং। তাঁহার পরিধানে মখ্মলী কর্ডুরয়ের পাৎলুন ও গ্যাবারডিনের কোট, দাড়ি বিনুনি করা, মাথায় কান-চাপা পাগ্ড়ি। দুই বাহু মুগুরের মত ঘুরাইতে ঘুরাইতে তিনি নামিতেছেন, চক্ষু দুটিও ঘুরিতেছে। আরও কাছে আসিলে তাঁহার দাড়ি-গোঁফে অবরুদ্ধ বাক্যগুলিও আমাদের কর্ণগোচর হইল। বাক্যগুলি বাঙলা নয়, কিন্তু তাহার ভাবার্থ বুঝিতে কষ্ট হইল—‘বাংগালী আমার টাকা দেবে না! দেখে নেব কত বড় অনাদি হালদার, গলা টিপে টাকা আদায় করব। আমিও পাঞ্জাবী, আমার সঙ্গে লারে-লাপ্পা চলবে না—’ সর্দারজী সবেগে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
ব্যোমকেশ আমার পানে চাহিয়া একটু হাসিল, নিম্নস্বরে বলিল, ‘অনাদিবাবু দেখছি জনপ্রিয় লোক নয়। এস, দেখা যাক।’
সিঁড়ির ঊর্ধপ্রান্তে একটি দরজা, ভিতর দিকে অর্গলবদ্ধ। ব্যোমকেশ কড়া নাড়িল।
অল্পকাল পরে দরজা একটু ফাঁক হইল, ফাঁকের ভিতর দিয়া একটি মুখ বাহির হইয়া আসিল। ভেট্কি মাছের মত মুখ, রাঙা রাঙা চোখ, চোখের নীচের পাতা শিথিল হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে। শিথিল অধরের ফাঁকে নীচের পাটির দাঁতগুলি দেখা যাইতেছে।
রাত্রিকালে এরূপ অবস্থায় এই মুখখানি দেখিলে কি করিতাম বলা যায় না, কিন্তু এখন একবার চমকিয়া স্থির হইলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনাদিবাবু—?’
মুখটিতে হাসি ফুটিল, চোয়ালের অসংখ্য দাঁত আরও প্রকটিত হইল। ভাঙা ভাঙা গলায় ভেট্কি মাছ বলিল, ‘না, আমি অনাদিবাবু নই, আমি কেষ্টবাবু। আপনারাও পাওনাদার নাকি?’
‘না, অনাদিবাবুর সঙ্গে আমাদের একটু কাজ আছে।’
এই সময় ভেট্কি মাছের পশ্চাতে আর একটি দ্রুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল,—‘কেষ্টবাবু, সরুন সরুন—’
কেষ্টবাবুর মুণ্ড অপসৃত হইল, তৎপরিবর্তে দ্বারের সম্মুখে একটি যুবককে দেখা গেল। ডিগ্ডিগে রোগা চেহারা, লম্বা ছুঁচালো চিবুক, মাথার কড়া কোঁক্ড়া চুলগুলি মাথার দুই পাশে যেন পাখা মেলিয়া আছে। মুখে একটা চট্পটে ভাব।
‘কি চান আপনারা?’
‘অনাদিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘কিছু দরকার আছে কি? অনাদিবাবু বিনা দরকারে কারুর সঙ্গে দেখা করেন না।’
‘দরকার আছে বৈ কি। পাশে যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে সেটা বোধ হয় তাঁরই। ওই বাড়ি সম্বন্ধে কিছু জানবার আছে। আপনি—?’
‘আমি অনাদিবাবুর সেক্রেটারি। আপনারা একটু বসুন, আমি খবর দিচ্ছি। এই যে, ভেতরে বসুন।’
আমরা সিঁড়ি হইতে উঠিয়া ঘরে প্রবেশ করিলাম। যুবক চলিয়া গেল।
ঘরটি নিরাভরণ, কেবল একটি কেঠো বেঞ্চি আছে। আমরা বেঞ্চিতে বসিয়া চারিদিকে চাহিলাম। সিঁড়ির দরজা ছাড়া ঘরে আরও গুটিতিনেক দরজা আছে, একটি দিয়া সদরের ব্যালকনি দেখা যাইতেছে, অন্য দুইটি ভিতর দিকে গিয়াছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর দেখিলাম ভিতর দিকের একটি দরজা একটু ফাঁক করিয়া একটি স্ত্রীলোক উঁকি মারিল। চিনিতে কষ্ট হইল না—ননীবালা দেবী। তিনি বোধ হয় রান্না করিতেছিলেন, বাহিরে লোক আসার সাড়া পাইয়া খুন্তি হাতে তদারক করিতে আসিয়াছেন। আমাদের দেখিয়া তিনি সভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন। ব্যোমকেশ নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া তাঁহাকে অভয় দিল। ননীবালা ধীরে ধীরে সরিয়া গেলেন।
অন্য দরজা দিয়া যুবক বাহির হইয়া আসিল।
‘আসুন।’
যুবকের অনুগামী হইয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। একটি ঘরের দরজা ঠেলিয়া যুবক বলিল, ‘এই ঘরে অনাদিবাবু আছেন, আপনারা ভিতরে যান।’
ঘরে ঢুকিয়া প্রথমটা কিছু ঠাহর হইল না। ঘরে আলো কম, আসবাব কিছু নাই, কেবল এক কোণে গদির উপর ফরাস পাতা। ফরাসের উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া একটি লোক আমাদের দিকে তাকাইয়া আছে। আধা অন্ধকারে মনে হইল একটা ময়াল সাপ কুণ্ডলী পাকাইয়া অনিমেষ চক্ষে শিকারকে লক্ষ্য করিতেছে।
চক্ষু অভ্যস্ত হইলে বুঝিলাম, ইনিই অনাদি হালদার বটে; ভাইপোদের সঙ্গে চেহারার সাদৃশ্য খুবই স্পষ্ট। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ; বেঁটে মজবুত চেহারা, চোখে মেদমণ্ডিত মোঙ্গলীয় বক্রতা। গায়ে বেগুনি রঙের বালাপোশ জড়ানো।
আমরা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিলাম। অনাদিবাবু স্তিমিত নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিবার পর ব্যোমকেশ নিজেই কথা কহিল, ‘আমরা একটু কাজে এসেছি। ইনি অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ববঙ্গ থেকে সম্প্রতি এসেছেন, কলকাতায় বাড়ি কিনে বাস করতে চান।’
অনাদিবাবু এবার কথা বলিলেন। আমাদের বসিতে বলিলেন না, স্বভাব-রুক্ষ স্বরে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন, ‘তুমি কে?’
ব্যোমকেশের চক্ষু প্রখর হইয়া উঠিল, কিন্তু সে সহজভাবে বলিল, ‘আমি এঁর এজেন্ট। জানতে পারলাম আপনি পাশেই বাড়ি তৈরি করাচ্ছেন, ভাবলাম হয়তো বিক্রি করতে পারেন। তাই—’
অনাদিবাবু বলিলেন, ‘আমি নিজে বাস করব বলে বাড়ি তৈরি করাচ্ছি, বিক্রি করবার জন্যে নয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা তো বটেই। তবে আপনি ব্যবসাদার লোক, ভেবেছিলাম লাভ পেলে ছেড়ে দিতে পারেন।’
‘আমি দালালের মারফতে ব্যবসা করি না।’
‘বেশ তো, আপনি অজিতবাবুর সঙ্গে কথা বলুন, আমি সরে যাচ্ছি।’
‘না, কারুর সঙ্গে বাড়ির আলোচনা করতে চাই না। আমি বাড়ি বিক্রি করব না। তোমরা যেতে পারো।’
অতঃপর আর দাঁড়াইয়া থাকা যায় না। এই অত্যন্ত অশিষ্ট লোকটার সঙ্গ আমার অসহ্য বোধ হইতেছিল, কিন্তু ব্যোমকেশ নির্বিকার মুখে বলিল, ‘কিছু মনে করবেন না, বাড়িটা তৈরি করাতে আপনার কত খরচ হবে বলতে বাধা আছে কি?’
অনাদিবাবুর রুক্ষ স্বর আরও কর্কশ হইয়া উঠিল, ‘বাধা আছে।—ন্যাপা! ন্যাপা! বিদেয় কর, এদের বিদেয় কর—’
সেক্রেটারি যুবকের নাম বোধ করি ন্যাপা, সে দ্বারের বাহিরেই দাঁড়াইয়া ছিল, মুণ্ড বাড়াইয়া ত্বরান্বিত স্বরে বলিল, ‘আসুন, চলে আসুন—’
মানসিক গলা-ধাক্কা খাইয়া আমরা বাহিরে আসিলাম। যুবক সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিল, একটু লজ্জিত হ্রস্বকণ্ঠে বলিল, ‘কিছু মনে করবেন না, কর্তার আজ মেজাজ ভাল নেই।’
ব্যোমকেশ তাচ্ছিল্যভরে বলিল, ‘কিছু না।—এস অজিত।’
রাস্তায় বাহির হইয়া আসিলাম। ব্যোমকেশ মুখে যতই তাচ্ছিল্য দেখাক, ভিতরে ভিতরে উষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে তাহা তাহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর সে আমার দিকে চাহিয়া ক্লিষ্ট হাসিল, বলিল, ‘দু’রকম ছোটলোক আছে—অসভ্য ছোটলোক আর বজ্জাত ছোটলোক। যারা বজ্জাত ছোটলোক তারা শুধু পরের অনিষ্ট করে; আর অসভ্য ছোটলোক নিজের অনিষ্ট করে।’
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘অনাদি হালদার কোন্ শ্রেণীর ছোটলোক?’
‘অসভ্য এবং বজ্জাত দুইই—।’
সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু দিবানিদ্রা দিব কিনা ভাবিতেছি, দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখি ননীবালা দেবী।
ননীবালা শঙ্কিত মুখ লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। ব্যোমকেশ ইজিচেয়ারে ঝিমাইতেছিল, উঠিয়া বসিল। ননীবালা বলিলেন, ‘আজ আপনাদের ও-বাড়িতে দেখে আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে গেছল, অনাদিবাবু যদি জানতে পারেন যে আমি—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসুন। অনাদিবাবুর জানবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আমরা গিয়েছিলাম তাঁর নতুন বাড়ির খরিদ্দার সেজে। সে যাক, আপনি এখন একটা কথা বলুন তো, অনাদি হালদার কি রকম লোক? সোজা স্পষ্ট কথা বলবেন, লুকোছাপার দরকার নেই।’
ননীবালা কিছুক্ষণ ড্যাবডেবে চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যার মত শব্দের স্রোত তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল,—‘কি বলব আপনাকে, ব্যোমকেশবাবু—চামার! চামার! চোখের চামড়া নেই, মুখের রাশ নেই। একটা মিষ্টি কথা ওর মুখ দিয়ে বেরোয় না, একটা পয়সা ওর ট্যাঁক থেকে বেরোয় না। টাকার আন্ডিল, কিন্তু আঙুল দিয়ে জল গলে না। এদিকে উন থেকে চুন খস্লে আর রক্ষে নেই, দাঁতে ফেলে চিবোবে। আগে একটা বামুন ছিল, আমি আসবার পর সেটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে; এই দেড় বছর হাঁড়ি ঠেলে ঠেলে আমার গতরে আর কিছু নেই। কি কুক্ষণে যে প্রভাতকে ওর পুষ্যিপুত্তুর হতে দিয়েছিলুম! যদি উপায় থাকত হতচ্ছাড়া মিন্সের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে পাটনায় ফিরে যেতুম।’ এই পর্যন্ত বলিয়া ননীবালা রণক্লান্ত যোদ্ধার মত হাঁপাইতে লাগিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কতকটা এইরকমই আন্দাজ করেছিলাম। প্রভাতের সঙ্গে ওর ব্যবহার কেমন?’
ননীবালা একটু থমকিয়া বলিলেন, ‘প্রভাতকে বেশি ঘাঁটায় না। তাছাড়া প্রভাত বাড়িতে থাকেই বা কতক্ষণ। সকাল আটটায় দোকানে বেরিয়ে যায়, দুপুরবেলা আধঘণ্টার জন্য একবারটি খেতে আসে, তারপর বাড়ি ফেরে একেবারে রাত ন’টায়। বুড়োর সঙ্গে প্রায় দেখাই হয় না।’
‘বুড়ো দোকানের হিসেবপত্র দেখতে চায় না?’
‘না, হিসেব চাইবার কি মুখ আছে, দোকান যে প্রভাতের নামে। বুড়ো প্রথম প্রথম খুব ভালমানুষী দেখিয়েছিল। প্রভাতকে জিজ্ঞেস করল—কী কাজ করবে? প্রভাত বলল—বইয়ের দোকান করব। বুড়ো অমনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করে দিলে।’
‘হুঁ। ন্যাপা কে? বুড়োর সেক্রেটারি?’
ননীবালা মুখ বাঁকাইয়া বলিলেন, ‘সেক্রেটারি না আরও কিছু—বাজার সরকার। ফড়্ফড়্ করে ইংরিজি বলতে পারে তাই বুড়ো ওকে রেখেছে। বুড়ো নিজে একবর্ণ ইংরিজি জানে না, ব্যবসার কথাবার্তা ওকে দিয়ে করায়, চিঠিপত্র লেখায়। তাছাড়া বাজার করায়, হাত-পা টেপায়। সব করে ন্যাপা।’
‘ভারি কাজের লোক দেখছি।’
‘ভারি ধুর্তু লোক, নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। দু’পাতা ইংরিজি পড়েছে কিনা।’
বুঝিলাম, প্রভাত ইংরিজি জানে না, ন্যাপা ইংরিজি জানে তাই ননীবালা তাহার প্রতি প্রসন্ন নয়।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আর কেষ্টবাবু? তিনি কে?’
‘তিনি কে তা কেউ জানে না। বুড়োর আত্মীয় কুটুম্ব নয়, জাত আলাদা। আমরা আসবার আগে থাকতে আছে। মাতাল, মদ খায়।’
‘তাই নাকি? নিজের পয়সাকড়ি আছে বুঝি?’
‘কিচ্ছু নেই। বুড়ো জুতো জামা দেয় তবে পরে।’
‘তবে মদ পায় কোথা থেকে?’
‘মদের পয়সাও বুড়ো দেয়।’
‘আশ্চর্য! এদিকে বলছেন আঙুল দিয়ে জল গলে না—’
‘কি জানি, ব্যোমকেশবাবু, আমি কিছু বুঝতে পারি না। মনে হয় বুড়ো ভয় করে। কেষ্টবাবু মাঝে মাঝে মদ খেয়ে মেজাজ দেখায়, বুড়ো কিন্তু কিছু বলে না।’
‘বটে।’ ব্যোমকেশ চিন্তাচ্ছন্ন হইয়া পড়িবার উপক্রম করিল।
ননীবালা তখন সাগ্রহে বলিলেন, ‘কিন্তু ওদিকের কি হল, ব্যোমকেশবাবু? নিমাই নিতাইকে দেখতে গিছলেন নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গিয়েছিলাম। ওরা লোক ভাল নয়। খুড়ো আর ভাইপোদের এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায় দ্যাখ। উচ্ছের ঝাড়, ঝাড়ে মূলে তেতো।’
ননীবালা ভীতকণ্ঠে বলিলেন, ‘তবে কি হবে? ওরা যদি প্রভাতকে—।’
ব্যোমকেশ ধীরস্বরে বলিল, ‘ওরা প্রভাতকে ভালবাসে না, তার অনিষ্ট চিন্তাও করতে পারে। কিন্তু আজকালকার এই অরাজকতার দিনেও একটা মানুষকে খুন করা সহজ কথা নয়, নেহাৎ মাথায় খুন না চাপলে কেউ খুন করে না। নিমাই আর নিতাইকে দেখে মনে হয় ওরা সাবধানী লোক, খুন করে ফাঁসির দড়ি গলায় জড়াবে এমন লোক তারা নয়। আর একটা কথা ভেবে দেখুন। অনাদি হালদার যদি পুষ্যিপুত্তুর নেবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাহলে একটা পুষ্যিপুত্তুরকে মেরে লাভ কি? একটা গেলে অনাদি হালদার আর একটা পুষ্যিপুত্তুর নিতে পারে, নিজের সম্পত্তি উইল করে বিলিয়ে দিতে পারে। এ অবস্থায় খুন-খারাপি করতে যাওয়া তো ঘোর বোকামি। বরং—’
ননীবালা বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করিলেন, ‘বরং কী?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বরং অনাদিবাবুর ভালমন্দ কিছু হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়।’
ননীবালা কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করিলেন, মনে হইল এই সম্ভাবনার কথা তিনি পূর্বে চিন্তা করেন নাই। তারপর তিনি উৎসুক মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘তাহলে প্রভাতের কোনও ভয় নেই?’
‘আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, এ ধরনের বোকামি নিমাই নিতাই করবে না। তবু সাবধানের মার নেই। আমি একটা প্ল্যান ঠিক করেছি, এমনভাবে ওদের কড়্কে দেব যে ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে সাহস করবে না।
‘কি—কি প্ল্যান ঠিক করেছেন, ব্যোমকেশবাবু?’
‘সে আপনার শুনে কি হবে। আপনি আজ বাড়ি যান। যদি বিশেষ খবর কিছু থাকে আমাকে জানাবেন।’
ননীবালা তখন গদগদ মুখে ব্যোমকেশকে প্রচুর ধন্যবাদ জানাইয়া প্রস্থান করিলেন। অনাদি হালদারের দ্বিপ্রহরে দিবানিদ্রা দিবার অভ্যাস আছে, সেই ফাঁকে ননীবালা বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছেন; বুড়া যদি জাগিয়া উঠিয়া দেখে তিনি বহির্গমন করিয়াছিলেন তাহা হইলে কৈফিয়তের ঠেলায় ননীবালাকে অন্ধকার দেখিতে হইবে।
অতঃপর আমি ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী প্ল্যান ঠিক করেছ? আমাকে তো কিছু বলনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাড়িতে পোস্টকার্ড আছে?’
‘আছে।’
‘বেশ, পোস্টকার্ড নাও, একখানা চিঠি লেখ। শ্রীহরিঃ শরণং লিখতে হবে না, সম্বোধনেরও দরকার নেই। লেখ—‘আমি তোমাদের উপর নজর রাখিয়াছি।’—ব্যাস্, আর কিছু না। এবার নিমাই কিংবা নিতাই হালদারের ঠিকানা লিখে চিঠিখানা পাঠিয়ে দাও।’