ব্যোমকেশ নড়িয়া চড়িয়া বসিল।
পুঁটিরাম!
পুঁটিরাম দরজা দিয়া মুণ্ড বাড়াইল।
‘আগুনের আংটা নিয়ে এস।’
আমি বলিলাম, অনেকক্ষণ ধরে আংটার কথা শুনছি, কিন্তু আংটা কি হবে এখনও জানতে পারিনি।–হোম-টোম করবে নাকি?’
‘ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, হোম করব। এই নোটগুলো আগুনে আহুতি দেব?
‘মানে?’
‘মানে নোটগুলো পুড়িয়ে ফেলব।’
আর্তনাদ করিয়া উঠিলাম–’অ্যাঁ! দু’ লাখ টাকা পুড়িয়ে ফেলবে!’
‘হ্যাঁ। এই নোটগুলো কালো টাকা, অভিশপ্ত টাকা; এর ন্যায্য মালিক কেউ নেই। আজকের পুণ্য দিনে দেশমাতৃকার চরণে এই হবে আমাদের অঞ্জলি।’
‘কিন্তু–কিন্তু, পুড়িয়ে ফেললে দেশমাতৃকা পাবেন কি? তার চেয়ে যদি ওই টাকা আমাদের নতুন গভর্নমেণ্টকে দেওয়া যায়—’
‘একই কথা, অজিত। পুড়িয়ে ফেললেও রাষ্ট্রকেই দেওয়া হবে। ভেবে দেখ, নোটগুলো তো সত্যিকারের টাকা নয়, গভর্নমেন্টের হ্যান্ডনোট মাত্র। হ্যান্ডনোট পুড়িয়ে ফেললে গভর্নমেন্টকে আর টাকা শোধ দিতে হবে না, দু’ লাখ টাকা তার লাভ হবে। কিন্তু এখন যদি নোটগুলো ফেরত দিতে যাও, অনেক হাঙ্গামা বাধবে। গভর্নমেন্ট জানতে চাইবে কোথা থেকে টাকা এল, তখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। তার দরকার কি! এই ভাল, আগুনে যা আহুতি দেব তা দেবতার কাছে পৌঁছবে। —প্রভাতবাবু্, আপনি কি বলেন?’
প্রভাত বুদ্ধি-ভ্ৰষ্ট্রের মত ফ্যালফ্যাল চক্ষে চাহিয়া বসিয়া ছিল, কষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিল, ‘আমার কিছু বলবার নেই, আপনি যা ভাল বোঝেন তাই করুন।’
পুঁটিরাম গানগনে আগুনের আংটা আনিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে রাখিল। ব্যোমকেশ তাঁহাকে বলিল, ‘তুই এবার ঘুমোগে যা।’
পুঁটিরাম চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ আমাদের মুখের পানে চাহিয়া হাসিল। তারপর বইয়ের পাতা ছিঁড়িয়া আগুনে ফেলিতে লাগিল। মন্দ্রস্বরে বলিল, ‘স্বাহা, স্বাহা, স্বাহা—‘
আমি আর বসিয়া দেখিতে পারিলাম না, উঠিয়া গিয়া জানালার সম্মুখে দাঁড়াইলাম। ব্যোমকেশ আমার বন্ধু, তাহাকে আমি ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি; কিন্তু আজ তাহার চরিত্রের একটা নূতন দিক দেখিতে পাইলাম। সে যাহা করিল। আমি তাহা পারিতাম না, নিজের হাতে দুই লক্ষ টাকা পুড়াইয়া ফেলিতে পারিতাম না।
‘স্বাহা, স্বাহা–’
ঘণ্টাখানেক পরে ব্যোমকেশ ও প্রভাত আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। সূর্য উঠিয়াছে, চারিদিকে মঙ্গলবাদ্য বাজিতেছে। পিছন ফিরিয়া দেখিলাম আংটার চারিপাশে কাগজ-পোড়া ছাই স্তুপীভূত হইয়াছে। কালো টাকার কালো ছাই।
তিনজনে জানালার ধারে কিয়াৎকাল দাঁড়াইয়া রহিলাম। প্ৰভাত প্ৰথমে কথা কহিল, কম্পিত স্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আমি-আমার সম্বন্ধে-আপনি যদি আমাকে খুনের অপরাধে ধরিয়ে দেন। আমি অস্বীকার করব না।’
না। সব সভ্য দেশেই প্ৰথা আছে পর্ব দিনে বন্দীরা মুক্তি পায়, আপনিও মুক্তি পেলেন। আপনার দোকান আমরা কিনব বলেছিলাম, যদি আপনি বিক্রি করে চলে যেতে চান আমরা দোকান নেব। কিম্বা যদি আমাদের কাছে দোকানের অর্ধাংশ বিক্রি করে অংশীদার করে নিতে চান তাতেও আপত্তি নেই।’
প্রভাত ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। শেষে চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, এ আমার কল্পনার অতীত।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা যে কালে বাস করছি সেটাই যে কল্পনার অতীত। আমরা বেঁচে থেকে ভারতের স্বাধীনতা দেখে যাব এ কি কেউ কল্পনা করেছিল? কিন্তু ওকথা যাক। আপনি প্ৰাণদণ্ড থেকে মুক্তি পেলেন বটে। কিন্তু একেবারে মুক্তি পাবেন না। কিছু দণ্ড আপনাকে ভোগ করতে হবে। এ সংসারে কর্মফল একেবারে এড়ানো যায় না।’
প্রভাত বলিল, ‘কি দণ্ড বলুন, আপনি যে দণ্ড দেবেন। আমি মাথা পেতে নেব।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে নিজের পরিচয় জানতে হবে।’
প্রভাত চক্ষু বিস্ফারিত করিল–’নিজের পরিচয়।’
‘হ্যাঁ। নিজের পরিচয় আপনি জানেন কি?-পিতৃনাম?’
প্ৰভাত মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না। মা’র কাছে শুনেছি, হাসপাতালে আমার জন্ম হয়েছিল। আর কিছু জানি না।’
‘আমি জানি। আপনার পিতৃনাম, অনাদি হালদার।’
প্ৰভাতের উপর এই সংবাদের প্রতিক্রিয়া বৰ্ণনা করিবার চেষ্টা করিব না, কারণ আমি নিজেই হতভম্ব হইয়া গিয়াছিলাম। অবশেষে আত্মসংবরণ করিয়া বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ। এ কী বলছ তুমি! এর কোনও প্রমাণ আছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আছে বৈকি। প্রভাতবাবুর গায়েই প্রমাণ আছে।’
‘গায়ে!’
‘হ্যাঁ। প্রভাতবাবুর কোমরে একটা আধুলির মত লাল জডুল আছে। প্রভাতবাবু্, জডুলটা দেখতে পারি কি?’
যন্ত্রের মত প্রভাত কামিজ তুলিল। ডান দিকে কাপড়ের কষির কাছে জড়ুল দেখা গেল। ব্যোমকেশ আমাকে বলিল, ‘ঠিক এইরকম আর কোথায় দেখেছি মনে আছে বোধহয়।’
মনে ছিল। মৃত অনাদি হালদারের কোমরে চাবি পরাইবার সময় ব্যোমকেশ দেখাইয়াছিল। কিন্তু বিস্ময় ঘুচিল না, অভিভূতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু তুমি জানলে কি করে যে প্রভাতবাবুর কোমরে জডুল আছে?
‘প্রভাতবাবুকে যেদিন ডাক্তার তালুকদারের কাছে নিয়ে যাই সেদিন ডাক্তারকে ওঁর কোমরটা দেখতে বলেছিলাম।’
তবু মন দ্বিধাক্ৰান্ত হইয়া রহিল। বলিলাম, কিন্তু, একে কি প্রমাণ বলা চলে?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমাণ না বলতে চাও বলো না, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত অনুমান, legitimate inference বলতেই হবে। অনাদি হালদার খামকা পাটনায় গিয়েছিল। কেন? দপ্তরীর সহকারীকে পুষ্যিপুতুর নিতে গেল কেন? প্রভাতবাবুকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করে দেবার কি দরকার ছিল? সব মিলিয়ে দেখো, সন্দেহ থাকবে না।’
প্রভাত টলিতে টলিতে গিয়া আরাম-কেদারায় শুইয়া পড়িল, অনেকক্ষণ দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া পড়িয়া রহিল।
আমি ভাবিতে লাগিলাম, সমস্তই ঠিক-ঠিক মিলিয়া যাইতেছে বটে। অনাদি হালদার জানিত প্রভাত তাহার ছেলে, ননীবালা তাহাকে প্রতিপালন করিয়াছেন। কালাবাজারে অনেক টাকা রোজগার করিয়া সে গোপনে ছেলেকে দেখিতে গিয়াছিল। যখন দেখিল ছেলে দপ্তরীর কাজ করে তখনই হয়তো নোটগুলোকে বই বাঁধাইয়া রাখিবার আইডিয়া তাহার মাথায় আসে ছেলেকে ছেলে বলিয়া স্বীকার করার চেয়ে পোষ্যপুত্র নেওয়াই অনাদি হালদারের কুটিল বুদ্ধিতে বেশি সমীচীন মনে হইয়াছিল। …তাহার দুরন্তু প্রবৃত্তি মাঝখানে পড়িয়া সমস্ত ছারখার না করিয়া দিলে প্ৰভাতের জন্ম রহস্য হয়তো চিরদিন অজ্ঞাত থাকিয়া যাইত।|—
প্রভাত মড়ার মত মুখ তুলিয়া উঠিয়া বসিল, ভগ্নস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু্, এর চেয়ে আমার ফাঁসি দিলেন না কেন? রক্তের এ কলঙ্কের চেয়ে সে যে ঢের ভাল ছিল।’
ব্যোমকেশ তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, ‘সাহস আনুন, প্রভাতবাবু। রক্তের কলঙ্ক কার নেই? ভুলে যাবেন না যে মানুষ জাতটার দেহে পশুর রক্ত রয়েছে। মানুষ দীর্ঘ তপস্যার ফলে তার রক্তের বাঁদরামি কতকটা কাটিয়ে উঠেছে; সভ্য হয়েছে, ভদ্র হয়েছে, মানুষ হয়েছে! চেষ্টা করলে রক্তের প্রভাব জয় করা অসাধ্য কাজ নয়। অতীত ভুলে যান, অতীতের বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। আজ নতুন ভারতবর্ষের নতুন মানুষ আপনি, অন্তরে বাহিরে আপনি স্বাধীন।’
প্ৰভাত অন্ধভাবে হাত বাড়াইয়া ব্যোমকেশের পদম্পর্শ করিল–’আশীর্বাদ করুন।’