তিনজনে নীরবে বসিয়া আদা-গন্ধী চা সেবন করিলাম। রাত্ৰি শেষ হইয়া আসিতেছে।
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ননীবালা দেবী যখন প্রথম আমার কাছে এলেন তখন সমস্ত ব্যাপারটা আমি উল্টো দিক থেকে দেখলাম। প্রভাতবাবুর জীবনের কোনও আশঙ্কা আছে কিনা এইটেই হল প্রশ্ন। ননীবালা যা বললেন তা থেকে ভয়ের কারণ আমি কিছু দেখতে পেলাম না। তবু বলা যায় না। দিনকাল খারাপ, নরহত্যা সম্বন্ধে মানুষের মন থেকে অনেক দ্বিধা সঙ্কোচ সরে গেছে ; একটা আদিম বর্বরতার মনোভাব আমাদের চেপে ধরেছে। আমি তদারক করতে বেরুলাম।
‘প্রভাতবাবুকে দেখলাম; নিমাই নিতাই, অনাদি হালদার, নৃপেন, কেষ্ট দাস, সকলকেই দেখলাম। ননীবালা আবার এলেন, তাঁকে বললাম, প্রভাতবাবুকে মেরে কারুর কোনও লাভ নেই, বরং অনাদি হালদারকে মেরে লাভ আছে। তারপর কালীপুজোর রাত্রে সত্যিই অনাদি হালদার খুন হল।
‘শেষ রাত্রে কেষ্ট দাস এসে আমাকে নিয়ে গেল। সকলের বিশ্বাস কেষ্ট দাসই খুন করেছে। আমি গিয়ে সব দেখেশুনে বুঝলাম, এ রাগের মাথায় খুন নয়, প্ল্যান করে খুন; কেষ্ট দাস যদি খুন করত তাহলে খুন করবার আগেই অনাদি হালদারের সঙ্গে ঝগড়া করত না। তাছাড়া, যত ঝগড়াই হোক, যে-হংস স্বর্ণডিম্ব প্রসব করে তাকে খুন করবে। এমন আহাম্মক কেষ্ট দাস নয়।
‘তবে একটা কথা আছে। কেষ্ট দাস যদি অনাদি হালদারকে খুন করে একসঙ্গে মোটা টাকা হাততে পারে তাহলে সে খুন করবে। কিন্তু এ যুক্তি বাড়ির অন্য লোকগুলির সম্বন্ধেও খাটে। এ যুক্তি মেনে নিলে স্বীকার করতে হয় যে অনাদি হালদারের বাড়িতে অনেক নগদ টাকা ছিল।
সর্বদা তার কোমরে থাকত। আমি যখন আলমারি খুললাম তখন তাতে মাত্ৰ শ আড়াই টাকা পাওয়া গেল। তবে কি এই সামান্য টাকা রাখবার জন্যে অনাদি হালদার স্টীলের আলমারি কিনেছিল?
‘আলমারিতে টাকা পাওয়া গেল না বটে কিন্তু দেখা গেল বইয়ের থাকা থেকে কয়েকটা বই অদৃশ্য হয়েছে। বাকি বইগুলো রামায়ণ মহাভারত জাতীয়। প্রশ্ন : স্টীলের আলমারিতে এই জাতীয় নিতান্ত সাধারণ বই রাখার মানে কি?
‘আলমারিতে ব্যাঙ্কের চেক বই ছিল, তা থেকে জানা গেল যে ব্যাঙ্ক থেকে যে-পরিমাণ টাকা বার করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি টাকা অনাদি হালদার তার নতুন বাড়ির কনট্রাকটর গুরুদত্ত সিংকে দিয়েছে। বাকি টাকা এল কোথা থেকে? অনাদি হালদার নিশ্চয় কালো টাকা রোজগার করেছিল এবং তা আলমারিতে রেখেছিল। বর্তমানে টাকা যখন আলমারিতে নেই তখন হত্যাকারীই তা সরিয়েছে।
‘হত্যার মোটিভ পাওয়া গেল। কিন্তু হত্যাকারী লোকটা কে? এবং কেমন করে সে বাড়িতে দুল্ল মৃত্যুর সময় অনাদি হালদার বাড়িতে একলা ছিল এবং বাড়ির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ‘অনাদি হালদার গুলি খেয়েছিল সদরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। শ্ৰীকান্ত হোটেলের জানলা থেকে তাকে সহজেই গুলি করে মারা যায়। কিন্তু তার আলমারি থেকে টাকা সরানো যায় না। সুতরাং শ্ৰীকান্ত হোটেল থেকে মেরে কোনও লাভ নেই।
‘নিমাই নিতাই যখন উকিল নিয়ে হাজির হল এবং দাবি করল যে তারাই অনাদি হালদারের ওয়ারিশ, প্রভাতবাবু আইনত পুষ্যিপুত্তুর নয়, তখন আর একটা মোটিভ পাওয়া গেল। অনাদি হালদার পাকাপাকি পুষ্যি নেবার আগে যদি তাকে সরানো যায় তাহলে সব সম্পত্তি ভাইপোদের আশাবে। অনাদি হালদার নিশ্চয় উইল করেনি। এ দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকেরা উইল করে না।
‘নিমাই নিতাইয়ের পক্ষে খুড়োর গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা করা নেহাৎ অবিশ্বাস্য নয়। এখন দেখা যাক তাদের কার্যকলাপ। হত্যার ছমাস আগে তারা শ্ৰীকান্ত হোটেলের ঘর ভাড়া নিয়েছিল এবং নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করত। হোটেলের চাকরদের সঙ্গে তাদের মুখ চেনাচেনি হয়েছিল। যারা খুড়োকে খুন করতে উদ্যত হয়েছে তাদের পক্ষে এতটা খোলাখুলি ভাব কি স্বাভাবিক? আগেই বলেছি, এ গ্ল্যান করে খুন; খুনী ঠিক করেছিল, কালীপুজোর রাত্রে খুন করবে, বাজি পোড়ানোর শব্দে যাতে বন্দুকের আওয়াজ চাপা পড়ে যায়! তাই যদি হয় তবে ছ। মাস আগে থেকে ঘর ভাড়া নেবার অর্থ কি? তাছাড়া কালীপুজোর রাত্রে খুড়ো যে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াবে তার নিশ্চয়তা কি? এ রকম অনিশ্চিতের ওপর নির্ভর করে কেউ প্ল্যান করে না। আবার গুলিটা অনাদি হালদারের শরীর ভেদ করে গিয়েছিল, অথচ সেটা ব্যালকনিতে পাওয়া গেল না। এও ভাববার কথা।
‘সুতরাং শ্ৰীকান্ত হোটেলের জানলা থেকে নিমাই নিতাই খুড়োকে মেরেছিল এ প্রস্তাব টেকসই নয়। যেই মারুক বাড়ির ভেতর থেকে মেরেছে। দেখা যাক, বাড়ির ভেতর থেকে মারা সম্ভব কিনা।
‘সদর দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু বাড়ির পিছন দিকে ছাদে যাবার দরজাটা খোলা থাকত, অনাদি হালদার রাত্রে শুতে যাবার আগে নিজের হাতে সেটা বন্ধ করত। তাছাড়া দরজার ছিটুকিনি খুব শক্ত ছিল না, দু’ চারবার দরজায় নাড়া দিলে ছিটুকিনি খুলে পড়ত। মনে করা যাক, সেদিন রাত্রি আন্দাজ এগারোটার সময় একজন চুপিচুপি এসে অনাদি হালদারের নতুন বাড়িতে ঢুকল। নতুন বাড়ির একতলার ছাদ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, চারিদিকে ভারা বাঁধা। হত্যাকারী ছাদে উঠল; দুই বাড়ির মাঝখানে সরু গলি আছে, হত্যাকারী ভারা থেকে একটা লম্বা তক্তা নিয়ে দুই বাড়ির মাঝখানে পুল বাঁধল, তারপর সেই পুল দিয়ে পুরনো বাড়িতে পেরিয়ে এল। ছাদের দরজা খোলা থাকবার কথা, কারণ অনাদি হালদার তখনও শুতে যায়নি।
‘দেখা যাচ্ছে, একজন চটপটে লোকের পক্ষে বাড়িতে ঢোকা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কে সেই চট্টপটে লোকটি? নিমাই নিতাই নয়, কারণ আলমারিতে অনেক কালো টাকা আছে একথা তাদের জানবার কথা নয়; একথা কেবল বাড়ির লোকই জানতে পারে কিম্বা আন্দাজ করতে পারে।
‘বাড়িতে চারজন লোক আছে-ননীবালা, কেষ্ট দাস, নৃপেন আর প্রভাতবাবু। এদের মধ্যেই কেউ অনাদি হালদারকে খুন করেছে। যদি বল, নিমাই নিতাই বাড়িতে ঢুকে খুন করেছে এবং আলমারি থেকে মাল নিয়ে সাটুকেছে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তারা সাত-সকালে এসে বাড়ি দখল করতে চেয়েছিল কেন? চুপ করে বসে থাকাই তো তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। যথাসময়ে আদালতের মারফত দখল তারা পেতই। তারা খুন করেনি বলেই তাড়াতাড়ি এসে বাসার দখল নিতে চেয়েছিল, যাতে আলমারির জিনিসপত্র এরা সরিয়ে ফেলতে না পারে।
‘যাহোক, রইল বাড়ির চারজন। এরা সকলেই অবশ্য বাইরে ছিল, কিন্তু কারুর পাকা অ্যালিবাই নেই। ননীবালা দেবীকে বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ তিনি মোটা মানুষ, তাঁকে চট্টপটেও বলা চলে না। তক্তার ওপর দিয়ে গলি পার হওয়া তাঁর সাধ্য নয়।
‘বাকি রইল কেষ্ট দাস প্রভাতবাবু আর নৃপেন। গোড়ার দিকে নৃপেনের ওপরেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়, চালচলন খুবই সন্দেহজনক। আলমারিতে যে অনেক টাকা আছে। এটা তার পক্ষে জানা সবচেয়ে বেশি সম্ভব, কারণ সে অনাদি হালদারের সেক্রেটারি, টাকাকড়ির হিসেব রাখে। কিন্তু যখন জানতে পারলাম। সে আলমারির চাবি তৈরি করেছিল তখন তাকেও বাদ দিতে হল। অনাদি হালদারকে খুন করবার মতলব যদি তার থাকত। তবে সে চাবি তৈরি করতে যাবে কেন? অনাদি হালদারের কোমরেই তো চাবি রয়েছে।
‘ভেবে দেখা। নৃপেনের স্বভাবটা ছিচকে চোরের মত। সে চাবি তৈরি করেছিল, মতলব ছিল অনাদি হালদার যখন বাড়ি থাকবে না। তখন আলমারি খুলে দুচার টাকা সরাবে। কিন্তু সরাবার সুযোগ বোধহয় তার হয়নি। চাবিটা তার টেবিলের দেরাজে রেখেছিল। সে-রাত্রে সিনেমা থেকে ফিরে এসে যখন দেখল অনাদি হালদার খুন হয়েছে তখন সে চাবির কথা সাফ ভুলে গেল। তারপর আমি অনাদি হালদারের কোমর থেকে চাবি নিয়ে সবাইকে দেখলাম, তখন নৃপেনের মনে পড়ে গেল। সর্বনাশ! পুলিস এসে যদি তার দেরাজে চাবি পায় তাহলে তাকেই খুনী বলে ধরবে। সে কোনও মতে চাবিটাকে বিদেয় করবার চেষ্টা করতে লাগল এবং শেষ পৰ্যন্ত এক ফাঁকে চাবিটা জানিলা দিয়ে গলিতে ফেলে দিলে।
‘চাবিটা আমি সকালবেলা গলিতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম নৃপেন খুন করেনি। তারপর আমার বন্ধু রমেশ মল্লিকের চিঠি পেয়ে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। নৃপেন ছিঁচকে চোর, মানুষ খুন করবার সাহস তার নেই।
‘বাকি রইল কেষ্ট দাস আর প্রভাতবাবু।
‘সেদিন সন্ধ্যেবেলা কেষ্ট দাস এখানে এল। রাত্রে তাকে মদ খাইয়ে অনাদি হালদারের পুরনো ইতিহাস জেনে নিলাম। কেষ্ট দাসও সেদিন আমার কাছে একটা কথা জানতে পেরেছিল। আমি তাকে কথায় কথায় বলেছিলাম যে প্রভাতবাবু দপ্তরীর কাজ জানেন। কথাটা সে আগে জানত না।
‘যাহোক, তারপর কয়েকদিন কেটে গেল। দেখলাম নৃপেন আর কেষ্ট দাস পুরনো বাসাতেই রয়েছে। তারা যদি টাকা মেরে থাকে তাহলে পুরনো বাসা কামড়ে পড়ে আছে কেন? তাদের চলে যাবার যথেষ্ট ওজুহাত রয়েছে, অনাদি হালদার মরে যাবার পর ওদের বাড়িতে থাকার আর কোনও ছুতো নেই। টাকাগুলোই বা রাখল কোথায়? ব্যাঙ্কে নিশ্চয় রাখবে না, অন্য কোনও লোকের হাতেও দেবে না। তবে?
‘কলকাতায় ওদের অন্য কোনও আস্তানা নেই, যেখানে টাকা লুকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু প্রভাতবাবুর একটা আস্তানা আছে-দোকান। তিনি যদি খুন করে টাকা সরিয়ে থাকেন তাহলে টাকা লুকিয়ে রাখার কোনও অসুবিধা নেই।
‘দোকান-বইয়ের দোকান। বিদ্যুৎ চমকের মত সমস্ত ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল, প্রভাতবাবু পাটনায় হিসেবের খাতা বাঁধেননি, বেঁধেছিলেন একশো টাকার নোট-অনাদি হালদার তাঁর বাঁধানো বইগুলোকে রামায়ণ মহাভারতের সঙ্গে মিশিয়ে আলমারিতে রেখেছিল-প্রভাতবাবু অনাদি হালদারকে মারবার পর তার কোমর থেকে চাবি নিয়ে আলমারি থেকে নোটের বইগুলো বার করে নিজের দোকানে এনেছিলেন-দোকানের হাজারখানা বইয়ের মধ্যে নোটের বইগুলো প্ৰকাশ্যে সাজানো আছে-বাইরে থেকে বই দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না
‘আগাগোড়া প্লাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
‘কিন্তু–
‘প্রভাতবাবু টাকার লোভে এমন কাজ করবেন? প্রভাতবাবুর চরিত্র যতখানি বুঝেছিলাম তাতে তাঁকে অর্থলোভী বলে মনে হয়নি। উপরন্তু অনাদি হালদারের মৃত্যুতে প্রভাতবাবুর ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি; সে বেঁচে থাকলে তাঁকে পুষ্যিপুত্তুর নেবে, সমস্ত সম্পত্তি পাবার সম্ভাবনা। নগদ টাকার লোভে সেই সম্ভাবনা তিনি নষ্ট করবেন?
‘তবে কি টাকাটা গৌণ, তার চেয়ে বড় কারণ কিছু ছিল? অনাদি হালদার শিউলীর সঙ্গে প্রভাতবাবুর বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল; কিন্তু সেটা কি এতবড় অপরাধ যে তাকে খুন করতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেরিতে পেয়েছিলাম। দয়ালহরি মজুমদারের বাসা থেকে ফেরবার সময় হঠাৎ আসল কথাটা মাথায় খেলে গিয়েছিল।
‘অনাদি হালদার এমন কাজ করেছিল যাতে নিতান্ত নিরীহ লোকেরও মাথায় খুন চেপে যায়। সে দয়ালহরিকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে নিজে শিউলীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। প্রভাতবাবুর রক্তে আগুন ধরে গেল। আগুন ধরা বিচিত্র নয়, আগুনের ফুলকি তাঁর রক্তের মধ্যেই ছিল।
‘আবার একটা বরফের মত ঠাণ্ডা কূট বুদ্ধি তাঁর ছিল, সেটাও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তিনি অনাদি হালদারকে ধনেপ্ৰাণে মারবার প্ল্যান ঠিক করলেন। বাঁটুল সর্দারকে তিনি আগে থাকতেই চিনতেন, রাইফেল ভাড়া করা কঠিন হল না। কালীপুজোর রাত্রে বুড়ো পাঠাকে বলি দেবার ব্যবস্থা হল।
‘সে-রাত্রে প্রভাতবাবু ননীবালা দেবীকে সিনেমায় পৌঁছে দিয়ে দোকানে গেলেন। দোকান আলো দিয়ে সাজিয়ে সাড়ে দশটার সময় আবার বেরুলেন, এবার একটা কাপড়ের থলি পকেটে নিলেন। দোকান খোলাই রইল, গুখা দরোয়ান দরজায় পাহারায় রইল।
‘বাসার কাছে এসে প্রভাতবাবু দেখলেন বাসার সামনে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। কেউ তাঁকে লক্ষ্য করল না, তিনি নতুন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। নতুন বাড়ির মধ্যে বাঁটুল সদর রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাঁটুল অনাদি হালদারের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না, সুতরাং তার এ ব্যাপারে উৎসাহ থাকাই স্বাভাবিক।
‘ছাদের ওপর তক্তা ফেলে প্রভাতবাবু বাসায় ঢুকলেন। ছাদের দরজা সম্ভবত খোলাই ছিল; না থাকলেও ক্ষতি নেই, তিনি দু’চারবার দরজায় নাড়া দিয়ে ছিটুকিনি খুলে ফেললেন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনাদি হালদার বাজি পোড়ানো দেখছিল, পিছন দিকে শব্দ শুনে সে ফিরে দাঁড়াল। প্রভাতবাবু সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলেন। গুলিটা অনাদি হালদারের শরীর ভেদ করে রাস্তার ওপারে শ্ৰীকান্ত হোটেলের জানলা দিয়ে ঢুকে দেয়ালে আটকালো। হাই ভেলসিটি মিলিটারি রাইফেল, তার গুলি যদি নিমাই কিম্বা নিতাইকে সামনে পেতো তাকেও ফুটো করে যেত।|
‘তারপর প্রভাতবাবু মৃতের কোমর থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুললেন। নোটের বইগুলো থলিতে পুরে, চাবি আবার যথাস্থানে রেখে যে পথে এসেছিলেন সেই পথে ফিরে গেলেন। বাঁটুল অপেক্ষা করছিল, রাইফেল নিয়ে অদৃশ্য হল। প্রভাতবাবু দোকানে ফিরে গিয়ে বইগুলো উঁচু একটা তাকে সাজিয়ে রেখে দিলেন। তারপর যথাসময়ে সিনেমায় গিয়ে মা’কে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরলেন।
‘গুর্খা দরোয়ানটা জানত যে প্রভাতবাবু সে-রত্রে সারাক্ষণ দোকানে ছিলেন না। আমি যখন গুর্খা খোঁজ নিলাম তখন সে কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেছে।
‘সেদিন আমি আর অজিত প্রভাতবাবুর দোকানে যাচ্ছিলাম, দেখলাম বাঁটুল আমাদের আগে আগে যাচ্ছে। সে প্রভাতবাবুর দোকানে ঢুকতে গিয়ে পিছনে আমাদের দেখে দোকানে ঢুকল না, সোজা চলে গেল। আমরা দোকানে গিয়ে দেখলাম প্রভাতবাবুর জ্বর হয়েছে, তাড়সের জ্বর। তাঁকে নিয়ে আমার জানা এক ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার প্রভাতবাবুকে পরীক্ষা করলেন এবং পরীক্ষার ফল আমাকে আড়ালে জানালেন। তখন আর সন্দেহ রইল না।
‘প্রভাতবাবু যে অনাদি হালদারকে খুন করেছেন একথা আমার আগে আর একজন বুঝতে পেরেছিল-সে কেষ্ট দাস। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে, কেষ্ট দাস জানত যে অনাদি হালদারের আলমারিতে কালো টাকা আছে; তাই সে যখন আমার মুখে শুনল যে প্রভাতবাবু দপ্তরীর কাজ জানেন তখন চট্ট করে সমস্ত ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিলে। সে প্রভাতবাবুকে শোষণ করতে আরম্ভ করল। অজিত, তোমার মনে আছে কি, একদিন ক্রমাগত একশো টাকার নোট দেখে দেখে আমাদের চোখ ঠিকরে গিয়েছিল? এমন কি রাত্রে হোটেলে খেতে গিয়েও নিস্তার ছিল না, সেখানে কেষ্ট দাস একশো টাকার নোট বার করল। সেই নোটগুলির বেশির ভাগই এসেছিল অনাদি হালদারের বাঁধানো নোটের বই থেকে।
যাহোক, পাটনা যাবার আগে অনাদি হালদার ঘটিত ব্যাপার মন থেকে একরকম মুছে ফেলেই চলে গেলাম। কেবল বিকাশ দত্তকে বলে গেলাম দয়ালহরি মজুমদার সম্বন্ধে খবর সংগ্ৰহ করতে।
‘তারপর পাটনা থেকে ফিরে এসে দেখি-এক নতুন পরিস্থিতি। কেষ্ট দাস খুন হয়েছে। কেষ্ট দাস প্রভাতবাবুকে দোহন করছিল, তাই বিশ্বাস হল তিনিই তাকে খুন করছেন। তখন আবার আসামীকে ধরবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। কিন্তু শুধু অপরাধীকে ধরলেই চলবে না, টাকাগুলোও উদ্ধার করা চাই।
‘টাকাগুলো সহজে উদ্ধার করবার জন্যে একটু চাতুরীর আশ্রয় নিতে হল, নইলে সারা দোকান হাতড়ে নোটের বইগুলো বার করা কষ্টকর হত। হয়তো প্রভাতবাবু তল্লাশী করতে দিতেন না, পুলিস ডাকতে হত; আমার হাত থেকে সব বেরিয়ে যেত। তাই প্রভাতবাবু যখন দোকান বিক্রি করার কথা বললেন তখন ভারি সুবিধে হয়ে গেল। আমি বললাম, আমরা দোকান কিনব। সঙ্গে সঙ্গে বিকাশকে পাঠালাম নজর রাখবার জন্যে, প্রভাতবাবু দোকান থেকে কোনও জিনিস সরান কিনা।
‘দোকান কেনার ব্যবস্থা পাকা হল, স্বাধীনতা দিবসের সকালে দখল দিতে হবে। জানতাম দখল দেবার আগে কোনও সময় বইগুলো প্রভাতবাবু সরাবেন। বিকাশ খবর দিলে, দিনের বেলা তিনি কিছু সরাননি। রাত্রে আমরা দোকানে ঢুকে প্রতীক্ষা করে রইলাম। ন্যাপা চাবি তৈরি করে দিয়েছিল—’
হঠাৎ বাহির হইতে বিপুল শব্দতরঙ্গ আমাদের কৰ্ণপাটহে আঘাত করিল-রেডিও যন্ত্রের ঘুম ভাঙার আওয়াজ। আমরা চমকিয়া জানালার দিকে তাকাইলাম। বাহিরে দিনের আলো ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে।