পরিশিষ্ট

আদিম রিপু – ১৭

তিনজনে আসিয়া আমাদের বসিবার ঘরে উপবিষ্ট হইয়াছি। প্রভাত ও আমি দুইটি চেয়ারে বসিয়াছি‌, ব্যোমকেশ তক্তপোশের উপর বইয়ের থলিটি লইয়া বসিয়াছে। রাত্রি প্রায় দুইটা; বাহিরে নগর-গুঞ্জন শান্ত হইয়াছে।

ব্যোমকেশের মুখ গভীর‌, একটু বিষন্ন। সে চোখ তুলিয়া একবার প্রভাতের পানে ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; প্রভাতের মুখে কিন্তু অপরাধের গ্লানি নাই‌, ধরা পড়বার সময় যে চকিত ভয় ও বিস্ময় তাহাকে অভিভূত করিয়াছিল‌, তাহা তিরোহিত হইয়াছে। সে এখন সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ, সকল প্রকার সম্ভাবনার জন্য প্ৰস্তুত।

ব্যোমকেশ একে একে বইগুলি থলি হইতে বাহির করিল। বোর্ডে বাঁধাই বাদামী রঙের বইগুলি‌, বাহির হইতে দৃষ্টি-আকর্ষক নয়। কিন্তু ব্যোমকেশ যখন তাহাদের পাতা মেলিয়া ধরিল‌, তখন উত্তেজনায় হঠাৎ দম আটকাইবার উপক্রম হইল। প্ৰত্যেক বইয়ের প্রত্যেকটি পাতা এক একটি একশত টাকার নোট।

ব্যোমকেশ বইগুলি একে একে পর্যবেক্ষণ করিয়া পাশে রাখিল‌, প্ৰভাতকে জিজ্ঞাসা করিল,  ‘সবসুদ্ধ কত আছে বইগুলোতে?’

প্রভাত বলিল‌, ‘প্রায় দু’ লাখ। কিছু আমি খরচ করেছি।’

‘দয়ালহরি মজুমদারকে যে টাকা দিয়েছেন তা ছাড়া আর কিছু খরচ হয়েছে?’

প্ৰভাতের চোখের দৃষ্টি চকিত হইল; ব্যোমকেশ এত কথা কোথা হইতে জানিল এই প্রশ্নটাই যেন তাহার চক্ষু হইতে উঁকি মারিল। কিন্তু সে কোনও প্রশ্ন না করিয়া বলিল‌, ‘আরও কিছু খরচ হয়েছে‌, সব মিলিয়ে চোঁদ পনেরো হাজার।’

ব্যোমকেশ তখন বইগুলির উপর হাত রাখিয়া শাস্তকণ্ঠে বলিল‌, ‘প্রভাতবাবু্‌, এইগুলোর জন্যেই কি আপনি অনাদি হালদারকে খুন করেছিলেন?’

প্রভাত দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িল‌, ‘না‌, ব্যোমকেশবাবু।’

‘তবে কি জন্যে একাজ করলেন বলবেন কি?’

প্রভাত একবার যেন বলিবার জন্য মুখ খুলিল‌, তারপর কিছু না বলিয়া মুখ বন্ধ করিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি যদি না বলেন‌, আমিই বলছি।–শিউলীর সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়ে অনাদি হালদার নিজে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। এইজন্যে–কেমন?’

প্রভাত কিছুক্ষণ বুকে ঘাড় গুজিয়া যখন মুখ তুলিল‌, তখন তাহার রগের শিরাগুলো উচু হইয়া উঠিয়াছে। তাহার দাঁতের গড়নে যে হিংস্ৰতা আগে লক্ষ্য করিয়াছিলাম‌, কথা বলিবার সময় তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল; সে অবরুদ্ধ স্বরে বলিল‌, ‘হ্যাঁ। অনাদি হালদার শিউলীর বোপকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে রাজী করিয়েছিল–’ এই পর্যন্ত বলিয়া সে থামিয়া গেল‌, নীরবে বসিয়া যেন অন্তরের আগুনে ফুলিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম তাহলে।–কিন্তু আপনি কেষ্টবাবুকে মারতে গেলেন কেন?’

ক্ৰোধ ভুলিয়া প্রভাত সবিস্ময়ে ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল। বলিল‌, ‘সে কি! কেষ্টবাবুর কথা আমি তো কিছু জানি না।’

ব্যোমকেশ সন্দেহ-কণ্টকিত দৃষ্টিতে প্ৰভাতকে বিদ্ধ করিল—’আপনি কেষ্ট দাসকে খুন করেননি?’

প্রভাত বলিল‌, ‘না‌, ব্যোমকেশবাবু। কেষ্টবাবু গত আট মাসে আমার কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিয়েছে। তার মরার খবর পেয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু আমি তাকে খুন করিনি। বিশ্বাস করুন‌, আমি যদি খুন করতাম‌, আজ আপনার কাছে অস্বীকার করতাম না।’

ব্যোমকেশের মুখখানা ধীরে ধীরে প্রফুল্ল হইয়া উঠিতে লাগিল‌, যে বিষন্নতা কুয়াশার মত তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল‌, তাহা যেন কাটিয়া গেল। সে বলিল‌, ‘কিন্তু‌, কেষ্ট দাসকে তাহলে খুন করলে কে?’

‘তা জানি না। তবে—‘ প্ৰভাত ইতস্তত করিল।

‘তবে? প্রভাত একটু সঙ্কুচিতভাবে বলিল‌, ‘দশ-বারো দিন আগে বাঁটুল সর্দার আমার কাছে এসেছিল। বাঁটুলকে আপনারা বোধহয় চেনেন না।–’

‘খুব চিনি। এমন কি আপনার সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ তাও জানি। তারপর বলুন।’

‘বাঁটুল আমাকে কেষ্টবাবুর কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল; কেষ্টবাবু কে‌, অনাদিবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কী জানে‌, এই সব। আমি বাঁটুলকে সব কথাই বললাম। তারপর—‘

ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল‌, বলিল‌, ‘যাক‌, এবার বুঝেছি। আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে কেষ্ট দাসের টাকার ক্ষিদে মেটেনি‌, সে গিয়েছিল বাঁটুলকে ব্ল্যাকমেল করতে। অতিলোভে তাঁতী নষ্ট।’—ব্যোমকেশ হাঁক দিল‌, ‘পুঁটিরাম!’

পুঁটিরাম ভিতর দিকের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুঁটিরাম, তিন পেয়ালা চা হবে?’

পুঁটিরাম বলিল‌, ‘আজ্ঞে‌, দুধ নেই বাবু।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কুছ পরোয়া নেই‌, আদা দিয়ে চা তৈরি কর। আর কয়লার আংটা ঠিক করে রেখেছ?’

‘আজ্ঞে।’

‘বেশ‌, এবার তাতে আগুন দিতে পার।’

পুঁটিরাম প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্রভাতবাবু্‌, আপনার মা-ননীবালা দেবী বোধহয় কিছু জানেন না?’

‘আজ্ঞে না।’ প্ৰভাত কিছুক্ষণ বিস্ময়-সন্ত্রমভরা চোখে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আপনি কি সবই জানতে পেরেছেন‌, ব্যোমকেশবাবু?’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘বোধহয় পেরেছি। তবে বলা যায় না‌, কিছু ভুলচুক থাকতে পারে। যেমন কেষ্ট দাসের মৃত্যুটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছিলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল‌, ছুরি আপনার অস্ত্র নয়।’

আমি বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, কি করে সব বুঝলে বল না‌, আমি তো এখনও কিছু বুঝিনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, বলছি। অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে‌, তা আমি পাটনা যাবার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন ভেবেছিলাম অনাদি হালদারের মৃত্যু সম্বন্ধে কারুরই যখন কোনও গরজ নেই‌, তখন আমারই বা কিসের মাথা ব্যথা। কিন্তু ফিরে এসে যখন দেখলাম। কেষ্ট দাসও খুন হয়েছে‌, তখন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। যে লোক মানুষ খুন করে নিজের জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে চায়‌, তাকে শাসন করা দরকার। যাহোক‌, এখন দেখছি। আমি ভুল করেছিলাম‌, প্রভাতবাবু কেষ্ট দাসকে খুন করেননি। আমি একটা কঠোর কর্তব্যের হাত থেকে মুক্তি পেলাম।–এবার গল্পটা শোনো। প্রভাতবাবু্‌, যদি কোথাও ভুলচুক হয়। আপনি বলে দেবেন।’

ব্যোমকেশ অনাদি হালদারের কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। বিস্ময়ের সহিত অনুভব করিলাম‌, আজকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নূতন। ব্যোমকেশ হত্যাকারীকে বন্ধুর মত ঘরে বসাইয়া হত্যার কাহিনী শুনাইতেছে‌, এরূপ ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটে নাই।

-‘অনাদি হালদার গত যুদ্ধের সময় কালাবাজারে অনেক টাকা রোজগার করেছিল। বোধহয় আড়াই লাখ কি তিন লাখ। প্রভাতবাবু্‌, আপনি ক’খানা বই বেঁধেছিলেন?’

প্ৰভাত বলিল‌, ‘ছ’খানা। প্রত্যেকটাতে চারশো নোট ছিল।’

‘অর্থাৎ দু’ লাখ চল্লিশ হাজার।–বেশ‌, ধরা যাক অনাদি হালদার পৌঁনে তিন লাখ কালো টাকা রোজগার করেছিল। প্রশ্ন উঠল‌, এ টাকা সে রাখবে কোথায়? ব্যাঙ্কে রাখা চলবে না‌, তাহলে ইনকাম ট্যাক্সের ডালকুত্তারা এসে টুটি টিপে ধরবে। অনাদি হালদার এক মতলব বার করল।

‘অনাদি হালদার যেমন পাজি ছিল‌, তেমনি ছিল তার কুচুটে বুদ্ধি। আজ পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্সের পেয়াদাকে ফাঁকি দেবার অনেক ফন্দি-ফিকির বেরিয়েছে‌, সব আমার জানা নেই। কিন্তু অনাদি হালদার যে ফন্দি বার করল‌, সেটাও মন্দ নয়; প্রথমে সে টাকাগুলো একশো টাকার নোটে পরিণত করল। সব এক জায়গায় করল না; কিছু কলকাতায়‌, কিছু দিল্লীতে‌, কিছু পাটনায়; যাতে কারুর মনে সন্দেহ না হয়।

‘পাটনায় যাবার হয়তো অন্য কোনও উদ্দেশ্যও ছিল। যাহোক‌, সেখানে সে দপ্তরীর খোঁজ নিল; প্রভাতবাবু তার বাসায় এলেন বই বাঁধতে। বিদেশে বাঙালীর ছেলে প্রভাতবাবুকে দেখে অনাদি হালদারের পছন্দ হল। এই ধরনের দপ্তরী সে খুঁজছিল‌, সে প্রভাতবাবুকে আসল কথা বলল; এও বলল যে‌, সে তাঁকে পুষ্যিপুত্তুর নিতে চায়। পুষ্যিপুত্তুর নেবার কারণ‌, এত বড় শুপ্তকথা জানবার পর প্রভাতবাবু চোখের আড়াল না হয়ে যান।

‘প্রভাতবাবু বই বেঁধে দিলেন। পুষ্যিপুত্তুর নেবার প্রস্তাব পাকাপাকি হল। অনাদি হালদার প্ৰভাতকে আর ননীবালা দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এল। নোটের বইগুলো অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আলমারিতে উঠল। স্টীলের আলমারি‌, তার একমাত্ৰ চাবি থাকে অনাদি হালদারের কোমরে। সুতরাং কেউ যে আলমারি খুলবে‌, সে সম্ভাবনা নেই। যদি-বা কোনও উপায়ে কেউ আলমারি খোলে‌, সে কী দেখবে? কতকগুলো বই রয়েছে‌, মহাভারত‌, রামায়ণ ইত্যাদি। টাকাকড়ি সামান্যই আছে। বই খুলে বইয়ের পাতা পরীক্ষা করার কথা কারুর মনে আসবে না। এছাড়া বাইরের লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে ব্যাঙ্কেও কয়েক হাজার টাকা রইল।

‘অনাদি হালদারের কলকাতার বাসায় আরও দু’জন লোক ছিল-কেষ্ট দাস আর নৃপেন। নৃপেন ছিল তার সেক্রেটারি। অনাদি হালদার ভাল লেখাপড়া জানত না‌, তাই ব্যবসার কাজ চালাবার জন্যে নৃপেনকে রেখেছিল। আর কেষ্ট দাস জোর করে তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। কেষ্ট দাস ছিল অনাদি হালদারের ছেলেবেলার বন্ধু, অনাদির অনেক কুকীর্তির খবর জানত, নিজেও তার অনেক কুকীর্তির সঙ্গী ছিল।

‘অনাদি হালদার সতেরো-আঠারো বছর বয়সে নিজের ব্যাপকে এমন প্রহার করেছিল যে‌, পরদিনই বাপটা মরে গেল। পিতৃহত্যার বীজ ছিল অনাদির রক্তে। জীবজগতে বাপ আর ছেলের সম্পর্ক হচ্ছে আদিম শত্রুতার সম্পর্ক; সেই আদিম পাশবিকতার বীজ ছিল অনাদি হালদারের রক্তে। বাপকে খুন করে সে নিরুদ্দেশ হল। আত্মীয়স্বজনেরা অবশ্য কেলেঙ্কারির ভয়ে ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দিলে।

‘অনেকদিন পরে অনাদির সঙ্গে কেষ্ট দাসের আবার দেখা; দু’জনে মিলে এক মারোয়াড়ীর ঘরে ডাকাতি করতে গেল। অনাদি মারোয়াড়ীকে খুন করে টাকাকড়ি নিয়ে ফেরারী হল‌, কেষ্ট দাস লুটের বাখরা কিছুই পেল না।

‘এবার কুড়ি বছর পরে অনাদির সঙ্গে আবার কেষ্ট দাসের কথা। অনাদি তখন বৌবাজারের বাসা নিয়ে বসেছে; কেষ্ট দাস তাকে বলল‌, তুমি খুন করেছ‌, যদি আমাকে ভরণপোষণ না কর‌, তোমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেব। নিরুপায় হয়ে অনাদি কেষ্ট দাসকে ভরণপোষণ করতে লািগল।

‘এদিকে অনাদি হালদারের দুই ভাইপো নিমাই আর নিতাই খবর পেয়েছিল যে‌, খুড়ো অনেক টাকার মালিক হয়ে কলকাতায় এসে বসেছে। তারা অনাদির কাছে যাতায়াত শুরু করল। অনাদি ভারি ধূর্ত‌, সে তাদের মতলব বুঝে কিছুদিন তাদের ল্যাজে খেলালো‌, তারপর একদিন তাড়িয়ে দিলে। নিমাই নিতাই দেখল‌, খুড়োর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায়‌, তারা খুড়োর ভাবী পুষ্যিপুত্তুরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হল না। গুখাঁ দরোয়ান দেখে তারা প্রভাতবাবুর দোকানে যাওয়া বন্ধ করল।

‘কিন্তু এত টাকার লোভ তারা ছাড়তে পারছিল না। কোনও দিকে কিছু না পেয়ে তারা অনাদি হালদারের বাসার সামনে হোটেলে ঘর ভাড়া করল‌, অষ্টপ্রহর বাড়ির ওপর নজর রাখতে লািগল। এতে অবশ্য কোনও লাভ ছিল না‌, কিন্তু মানুষ যখন কোনও দিকেই রাস্তা খুঁজে না পায়‌, তখন যা হোক একটা করেই মনকে ঠাণ্ডা। রাখে। নিমাই নিতাই পালা করে হোটেলে আসত‌, আর চোখে দূরবীন লাগিয়ে জানালায় বসে থাকত। অজিত‌, তোমার মনে আছে বোধহয়‌, ননীবালা যেদিন প্রথম এসেছিলেন‌, তিনি বলেছিলেন‌, সর্বদাই যেন অদৃশ্য চক্ষু তাঁদের লক্ষ্য করছে। সে অদৃশ্য চক্ষু নিমাই-নিতাইয়ের।

‘যাহোক‌, দিন কাটছে। অনাদি হালদার জমি কিনে বাড়ি ফেদেছে। প্রভাতবাবুকে সে পুষ্যিপুকুর নেবার আশ্বাস দিয়ে এনেছিল‌, প্রথমটা তাঁর সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করল। তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দোকান করে দিলে; অ্যাটনীর কাছে গিয়ে পুষ্যিপুতুর নেবার বিধি-বিধান জেনে এল। কিন্তু বাঁধা-বাঁধির মধ্যে পড়বার খুব বেশি আগ্রহ তার ছিল না‌, সে পাকাপাকি লেখাপড়া করতে দেরি করতে লাগল। প্রভাতবাবু দোকান নিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন‌, ননীবালা দেবী জানেন না যে পুষ্যিপুত্তুর নিতে হলে লেখাপড়ার দরকার। তাই এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করল না।

‘তারপর এক ব্যাপার ঘটল। প্রভাতবাবু শিউলী মজুমদারকে দেখে এবং তার গান শুনে মুগ্ধ  হলেন। তিনি শিউলীদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলেন। দয়ালহরি মজুমদার ঘুঘু লোক, সে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারল যে প্রভাতবাবু বড়লোকের পুষ্যিপুতুর ; প্রভাতবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে তার আপত্তি হল না। দয়ালহরি মজুমদারের চালচুলো নেই, সে ভােবল ফাঁকতালে যদি মেয়ের বিয়েটা হয়ে যায়, মন্দ কি!

‘প্রভাতবাবু ননীবালা দেবীকে শিউলীর কথা বললেন। ননীবালা অনাদি হালদারকে বললেন। প্রভাতবাবুর বিয়ে দিতে অনাদি হালদারের আপত্তি ছিল না, সে বলল, মেয়ে দেখে যদি পছন্দ হয় তো বিয়ে দেব।

‘তখন পর্যন্ত অনাদি হালদারের মনে কোনও বদ-মতলব ছিল না, নেহাৎ বরকতা সেজেই সে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু শিউলীকে দেখে সে মাথা ঠিক রাখতে পারল না। মানুষের চরিত্রে যতরকম দোষ থাকতে পারে, কোনটাই অনাদি হালদারের বাদ ছিল না। সে ঠিক করল, শিউলীকে নিজে বিয়ে করবে।

‘বাসায় ফিরে এসে সে বলল, মেয়ে পছন্দ হয়নি। তারপর তলে তলে নিজে ঘটকালি আরম্ভ করল। দয়ালহরি মজুমদার দেখল, দাঁও মারবার এই সুযোগ; সে ঝোপ বুঝে কোপ মারল। অনাদি হালদারকে বলল, তুমি বুড়ো, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব কেন? তবে যদি তুমি দশ হাজার টাকা দাও—

‘এইভাবে কিছুদিন দর-কষাকষি চলল, তারপর রফা হল, অনাদি হালদার পাঁচ হাজার টাকা হ্যান্ডনেটের ওপর ধার দেবে। বিয়ের পর হ্যান্ডনোট ছিড়ে ফেলা হবে।

বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে নিয়ে অনাদি হালদার ভাবতে বসল, কি করে প্রভাতবাবুকে তাড়ানো যায়। পুষ্যিপুত্তুর নেবার আগ্রহ কোনওকালেই তার বেশি ছিল না, এখন তো তার পক্ষে প্রভাতবাবুকে বাড়িতে রাখাই অসম্ভব। প্রভাতবাবুর প্রতি তার ব্যবহার রূঢ় হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ সে তাঁকে তাড়িয়ে দিতেও পারল না। প্রভাতবাবু বইবাঁধানো নোটের কথা যদি পুলিসের কাছে ফাঁস করে দেন, অনাদি হালদারকে ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে জেলে যেতে হবে।

‘প্রভাতবাবু ভিতরের কথা কিছুই জানতেন না। সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়াতে তিনি খুবই মুষড়ে পড়লেন, তারপর ঠিক করলেন অনাদিবাবুর অমতেই শিউলীকে বিয়ে করবেন, যা হবার হবে। তিনি দয়ালহরির বাসায় গেলেন। দয়ালহরি তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে এবং জানিয়ে দিলে যে, অনাদি হালদারের সঙ্গে শিউলীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।’

এই পর্যন্ত বলিয়া ব্যোমকেশ থামিল। টিন হইতে সিগারেট বাহির করিতে করিতে বলিল, ‘এই হচ্ছে অনাদি হালদারের মৃত্যুর পটভূমিকা। এর মধ্যে খানিকটা অনুমান আছে, কিন্তু ভুল বোধহয় নেই। প্রভাতবাবুকি বলেন?’

প্রভাত বলিল, ‘ভুল নেই। অন্তত যতটুকু আমার জ্ঞানের মধ্যে, তাতে ভুল নেই।’ পুটরাম চা লইয়া প্রবেশ করিল।