ইচ্ছা ছিল সত্যবতী ও খোকাকে লইয়া একসঙ্গে কলিকাতায় ফিরিব, সত্যবতীও এতদিন বাহিরে বাহিরে থাকিয়া ঘরে ফিরিবার জন্য দড়িাছেড়া হইয়াছিল, কিন্তু তাহা সম্ভব হইল না। পাটনায় দীর্ঘকাল থাকার ফলে বেশ একটি সংসার গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহা গুটিাইয়া লইবার ভার এক সুকুমারের ঘাড়ে চাপাইয়া চলিয়া যাইতে পারিলাম না। কথা হইল হগুপ্তাখানেক পরে সুকুমার সুন্টু ইয়া ফিরিবে, আমরা আগে গিয়া বাসাটা সাজাইয়া গুছইয়া সত্যবতীর উপযোগী করিয়া রাখিব।
১৩ আগস্ট প্রত্যুষে আমি ও ব্যোমকেশ কলিকাতায় পৌঁছিলাম।
তখনও সুযোদয় হয় নাই। বাসার সম্মুখে ট্যাক্সি হইতে নামিয়া দেখি আমাদের সদর দরজার সামনে ভিড় জমিয়াছে। ভিড়ের মধ্যে পুঁটিরামকে দেখা গেল। ব্যাপার কি। আমরা ভিড় ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। একটি মৃতদেহ ফুটপাথে পড়িয়া আছে, পিঠের বাঁ দিকে রক্তের দাগ শুকাইয়া জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে। দৃষ্টিহীন চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া খোলা।
চিনিতে কষ্ট হইল না, কেষ্টবাবু।
এখনও পুলিস আসিয়া পৌঁছে নাই। আমরা ভিড়ের বাহিরে আসিলাম, পুঁটিরামকে ডাকিয়া লইয়া উপরে চলিলাম। ব্যোমকেশের মুখ লোহার মত শক্ত হইয়া উঠিয়াছে, চোখে চাপা আগুন।
নিজেদের বসিবার ঘরে গিয়া দু’জনে উপবিষ্ট হইলাম। কেষ্টবাবুর হঠাৎ ভাগ্যোন্নতি যে এইরূপ পরিণতি লাভ করিবে তাহা কে ভাবিয়ছিল। আমি বলিলাম, ‘আমার ধারণা হয়েছিল কলকাতায় সম্মুখ-সমর বন্ধ হয়েছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এটা সম্মুখ-সমর নয়, কেষ্ট দাসকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছে। পুঁটিরাম, তুই চিনতে পারলি?’
পুঁটিরাম বলিল, ‘আজ্ঞে চিনেছি, উনি সেই ভেটুকিমাছবাবু। কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিলেন, আপনার কথা জিজ্ঞেস করলেন।’
‘কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিল?’
‘আজ্ঞে। আমি বললাম, চিঠি পেয়েছি, বাবুরা কাল সকালে আসবেন। তখন তিনি চলে গেলেন। ‘
‘হুঁ। আচ্ছা পুঁটিরাম, তুই চা তৈরি কর গিয়ে।’
ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় পা ছড়াইয়া কড়িকাঠের দিকে ভ্রূকুটি করিয়া রহিল। আমি জানালায় গিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম ফুটপাথে পুলিসের আবির্ভাব হইয়াছে, ভিড় সরিয়া গিয়াছে। কেষ্টবাবুকে একটা মোটর ভ্যানে তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। পুলিস কেষ্টরাবুর নাম ধাম জানিতে পারিল কিনা বোঝা গেল না। তাহারা লাশ লইয়া চলিয়া গেল।
চা আসিল। ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল, ‘লাশ দেখে মনে হয় শেষরাত্রির দিকে-রাত্রি তিনটে-চারটের সময়, কেষ্ট দাস খুন হয়েছে। প্রথম যেদিন কেষ্টবাবু আমার কাছে আসে সেও রাত্রি তিনটে-চারটের সময়। কিন্তু তখন একটা কারণ ছিল, আজ এতরাত্রে কি জন্যে আসছিল?’
বলিলাম, ‘তোমার কাছেই আসছিল তার প্রমাণ কি? মাতাল দাঁতাল মানুষ-হয়তো এই দিক দিয়ে যাচ্ছিল, গুণ্ডা ছুরি মেরেছে—’
না, এতবড় সমাপতন সম্ভব নয়, কেষ্ট দাস আমার কাছেই আসছিল। কাল সন্ধ্যেবেলা এসেছিল, আমি নেই শুনে ফিরে গিয়েছিল। তারপর রাত্রে এমন কিছু ঘটল যে সে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না–ব্যোমকেশ হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘ভেবেছিলাম অনাদি হালদারের ব্যাপারটা ভুলে যাব, কিন্তু এরা ভুলতে দিলে না।’
‘অনাদি হালদারের সঙ্গে কেষ্টবাবুর মৃত্যুর সম্বন্ধ আছে নাকি?’
ব্যোমকেশ আমার প্রতি একটি কৃপাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, তারপর আরাম-কেদারায় লম্বা হইল।
বেলা আটটা নাগাদ বিকাশ দত্ত আসিল। তাহার আর সেই অন্তঃশূন্য চুপিসানো ভাব নাই; আমাদের দেখিয়া দাঁত খিঁচাইয়া বলিল, ‘এই যে আপনারা এসে গেছেন স্যার। আমি পাটনায় চিঠি লিখতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার দেখে যাই। কিছু নতুন খবর আছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসুন, খবর শুনব। নিজের কথা আগে বলুন। আট-নয় মাস বাইরে ছিলাম, আপনার অসুবিধে হয়নি তো?’
বিকাশ বলিল, ‘অসুবিধে হয়েছিল স্যার। কিন্তু সে কিছু নয়। এখন সামলে নিয়েছি। তিন মাইল ঘাস কিনেছি, তাতেই চলে যাচ্ছে।’
‘তিন মাইল ঘাস!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।’
বিকাশ তিন মাইল ঘাসের রহস্য প্রকাশ করিল। রেল লাইনের দু’ধারে যে ঘাস জন্মায়, রেলের কর্তৃপক্ষ নাকি তাহা প্রতি বৎসর জমা দিয়া থাকেন। বিকাশ তিন মাইল ঘাস জমা লইয়াছে এবং গোয়ালাদের সেই ঘাস বিক্রয় করিতেছে। বিকাশের কোন কষ্ট নাই, গোয়ালারা অগ্রিম পয়সা দিয়া গরু মোষ চরায়; বিকাশের কিছু লাভ থাকে।
বিকাশ বলিল, ‘তাছাড়া চাকরিটা বোধহয় এবার ফিরে পাব স্যার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ বেশ, এবার কি নতুন খবর আছে বলুন। আপনার ছাত্রকে আজ সকালে পড়াতে যাননি?’
বিকাশ বলিল, ‘পড়ােব কাকে স্যার? পাখি উড়েছে।’
‘সে কি?’
‘সেই খবরই তো দিতে এলাম। গোড়ার দিক থেকে বলব, না শেষের দিক থেকে?’
‘গোড়ার দিক থেকে বলুন।’
আপনাকে যে সব খবর দিয়েছিলাম তারপর আর নতুন খবর কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। টিমে-তে তালায় চলছিল, তবু লেগে রইলাম। বসে না থাকি বেগার খাটি। মাসখানে আগে জানতে পারলাম দয়ালহরি মজুমদারের নামে একজন পাঁচ হাজার টাকার মামলা ঠুকে দিয়েছে। দয়ালহরি বুড়োর ভাবগতিক দেখে মনে হল সে কেটে পড়বার মতলবে আছে। দিন কয়েক পরে হঠাৎ একদিন প্ৰভাত এসে উপস্থিত। প্ৰভাতকে আগে দেখিনি, এই প্রথম দেখলাম। বুড়ো তাকে ঢুকতেই দিচ্ছিল না, তারপর ঘরে এনে বসালো। দোর বন্ধ করে কথাবাতা হল, আমি জানলায় কান লাগিয়ে শুনলাম। প্ৰভাত বলছে, আমি আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি, দোকান বাঁধা রেখে যেখান থেকে হোক পাঁচ হাজার টাকা যোগাড় করব, আপনি হ্যান্ডনোটের টাকা শোধ করে দিন। বুড়ো পাঁচ হাজার টাকার বদলে প্ৰভাতের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী হল।
‘এদিকে গদানন্দর সঙ্গে—ভাল কথা, জগদানন্দ অধিকারীর ডাক-নাম গদানন্দ-শিউলীর ভেতরে ভেতরে কিছু চলছিল। গদানন্দ সম্বন্ধে যা জানতে পেরেছি, মেয়ে ধরা ওর পেশা, বেটা দালাল। সে যাহোক, হস্তাখানেক পরে প্রভাত একটা ছোট্ট অ্যাটাচি-কেস হাতে নিয়ে এল; বুঝলাম টাকা এনেছে। তারপর জানালায় কান লাগিয়ে শুনলাম, বুড়ো বলছে, তুমি ভাল ছেলে, অনাদি হালদার তোমার নামে মিছে কথা বলেছিল। আমি তোমার সঙ্গে শিউলীর বিয়ে দেব। কিন্তু শ্রাবণ মাসে আর বিয়ের দিন নেই, অস্ত্ৰাণ মাসে বিয়ে হবে। প্রভাত খুশি হয়ে চলে গেল।
‘তারপর কি ব্যাপার হল জানি না, গত ৭ই আগস্ট পড়াতে গিয়ে শুনলাম গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে উধাও হয়েছে। বুড়োর সাজিশ ছিল। কিনা বলতে পারি না, আমার বিশ্বাস বুড়েই নাটের গুরু। যাহোক, সেদিন সন্ধ্যেবেলা প্রভাত এল। খুব খানিকটা চেঁচামেচি হল। প্রভাত টাকা ফেরত চাইল, বুড়ো হাত উল্টে বলল, টাকা কোথায় পাব, শিউলী আর গদানন্দ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। প্রভাত রাগে ধুকতে ধুকতে ফিরে গেল। বেচারার জাতও গেল পেটও ভরল না।
‘কাল সকালবেলা পড়াতে গিয়ে দেখি বাড়ির দরজা খোলা, বাড়িতে কেউ নেই। বুড়ো ছেলেটাকে নিয়ে কেটে পড়েছে।’
গল্প শেষ করিয়া বিকাশ একটা বিড়ি ধরাইয়া ফেলিল, বলিল, ‘এসব খবর আপনার কাজে লাগবে কিনা জানি না। স্যার, কিন্তু এর বেশি আর কিছু যোগাড় করা গেল না।’
‘সব খবর কাজের খবর?–ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল, তারপর চোখ খুলিয়া বলিল, ‘গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে কোথায় গেছে আপনি জানেন না বোধহয়?’
‘না। যদি বলেন খুঁজে বার করতে পারি।’
ব্যোমকেশ একটু মৌন থাকিয়া বলিল, ‘আর একটা কোজ আপনাকে করতে হবে।’
এই সময় দরজায় টোকা পড়িল।
দ্বার খুলিয়া দেখি প্রভাত। তাহার চুল উল্কখুষ্ক, মুখ শীর্ণ, চেখভরা ক্লান্তি। তাহাকে দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন, প্রভাতবাবু্, আমরা ফিরেছি। খবর পেলেন কোত্থেকে?’
প্রভাত চেয়ারে বসিল। বিকাশকে সে লক্ষ্যই করিল না; বিকাশও তক্তপোশের এক কোণে এমনভাবে গুটিসুটি হইয়া বসিল যে প্রায় অদৃশ্য হইয়া গেল। প্রভাত বলিল, ‘খবর পাইনি, দেখতে এলাম। যদি এসে থাকেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ। কেষ্টবাবু মারা গেছেন। আপনি শোনেননি বোধহয়।’
প্রভাত কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল, যেন কেষ্টবাবুর মরা-বাঁচা সম্বন্ধে তাহার তিলমাত্র কৌতুহল নাই।
‘না, শুনিনি। কি হয়েছিল?’
‘কাল রাত্রে কেউ তাকে ছুরি মেরেছিল।’
উদাসীনকণ্ঠে প্ৰভাত বলিল, ‘ও–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক ওকথা। দয়ালহরিবাবুর নামে নিমাই নিতাই পাঁচ হাজার টাকার হ্যান্ডনোটের উপর নালিশ করেছে জানেন নিশ্চয়।’
প্ৰভাতের মুখ বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল। সে বলিল, ‘জানি। কিন্তু ওকথাও যেতে দিন, ব্যোমকেশবাবু। মানুষের অ-মনুষ্যত্ব দেখে দেখে আমার মন বিষিয়ে গেছে। আমি আপনাকে জানাতে এসেছিলাম যে, আর আমার এখানে মন টিকছে না, আমি শীগগিরই চলে যাব।’
‘সে কি, কোথায় যাবেন?’
‘তা এখনও ঠিক করিনি। পাটনায় ফিরে যেতে পারি। যেখানেই যাই দু’ মুঠো জুটে যাবে। কলকাতায় আর নয়।’
‘কিন্তু–আপনার দোকান?’
‘দোকান বিক্রি করে দেব–’ প্ৰভাতের মুখ ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল, সে আমার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘অজিতবাবু্, আপনার জানাশোনা কেউ আছে, যে বইয়ের দোকান কিনতে পারে? বেশি দাম আমি চাই না। তিন হাজার-আড়াই হাজার পেলেও আমি বিক্রি করে দেব।’
ভাবিতে লাগিলাম, জানাশোনার মধ্যে এমন কে আছে যে, বইয়ের দোকান কিনিতে পারে! হঠাৎ ব্যোমকেশ এক অদ্ভুত কথা বলিয়া বসিল, ‘আমরা কিনতে পারি। আমি আর অজিত কিছুদিন থেকে পরামর্শ করছি একটা বইয়ের দোকান খুলব। অজিত নিজে লেখক, ও চালাতে পারবে। আপনার দোকানটা যদি পাওয়া যায় তাহলে তো ভালোই হয়।’
প্রভাতের মুখে একটু সজীবতা দেখা দিল, সে বলিল, ‘আপনারা নেবেন? তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? আপনার নিলে দোকান বিক্রি করেও আমার দুঃখ হবে না। তাহলে–’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কত টাকার বই আছে আপনার দোকানে?’
প্রভাত বলিল, ‘হিসেব না দেখে কিছু বলতে পারি না, কিন্তু চার হাজার টাকার কম হবে না।’
‘বেশ, কাল সকালে গিয়ে আমরা আপনার হিসেবপত্র দেখব। দোকানের ওপর মর্টগেজ নেই তো।’
‘আজ্ঞে না।’
‘তাহলে কথা রইল, কাল আমরা আপনার কাগজপত্র দেখব, স্টক মিলিয়ে নেব। যা ন্যায্য দাম তাই আপনি পাবেন। কিন্তু একটা কথা। ১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের দখল দিতে হবে। স্বাধীনতার প্রথম প্ৰভাতে ব্যবসা আরম্ভ করতে চাই।’
‘তাই হবে। যখন দখল চাইবেন তখনই দেব। আজ উঠি, হিসেবের কাগজপত্র ঠিক করে রাখতে হবে।’
‘আচ্ছা। ভাল কথা, নৃপেনবাবু এখনও আছেন?’
‘আছেন। তাঁকে অবশ্য বলে দিয়েছি যে আমি দোকান রাখব না। তিনি অন্য চাকরি খুঁজছেন, পেলেই চলে যাবেন।–আপনারা কি তাঁকে রাখবেন?’
‘রাখতেও পারি। তাকে একবার এখানে পাঠিয়ে দেবেন।’
‘দোকানে গিয়েই পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা, নমস্কার।’
প্রভাত দ্বারের বাহিরে যাইবামাত্র ব্যোমকেশ এক লাফ দিয়া বিকাশকে ধরিল, দ্রুত-হ্রস্ব কণ্ঠে তাহার কানে কানে কথা বলিয়া তাহার হাতে কয়েকটা নোটি গুজিয়া দিল। আমি কেবল তাহার কািল শুনতে পাইলাম মনে থাকে যেন কাল হৰি বাটো পর্যন্ত একটি আপনার নেই।’
বিকাশ একবার দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়িল, তারপর জ্যা-মুক্ত তীরের মত সাঁ করিয়া বাহির হইয়া গেল।
ঘর খালি হইয়া গেলে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাণ্ডকারখানা কি?’
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া চেয়ারে অঙ্গ প্রসারিত করিল, ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, ‘একটা মস্ত সুযোগ হাতে এসেছে, অজিত, এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়।’
‘কোন সুযোগের কথা বলছ?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই ধরে বইয়ের দোকানটা। যদি পাওয়া যায়, ছাড়া উচিত কি? বইয়ের ব্যবসা খুব লাভের ব্যবসা; তুমিও মনের মত একটা কাজ পাবে। শুধু বই লিখে আজকাল কিছু হয় না। দেখছ তো, তোমাদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান সাহিত্যিক তাঁরা গুটি গুটি ব্যবসায়ে ঢুকে পড়েছেন এবং বেশ দুধে-ভাতে আছেন।’
কথাটা সত্য। বইয়ের ব্যবসায় পয়সা আছে, বিশেষত যদি স্কুল-পাঠ্য পুস্তকের বাজার কোণ-ঠাসা করা যায়। তবু মৌখিক আপত্তি তুলিয়া বলিলাম, কিন্তু এই দুঃসময়ে হঠাৎ এতগুলো টাকা বার করা কি ভাল?’
সে বলিল, দু’জনে ভাগাভাগি করে দিলে গায়ে লাগবে না। তুমি হবে খাটিয়ে অংশীদার, আর আমি-ঘুমন্ত অংশীদার।’
আধা ঘণ্টা পরে নৃপেন আসিল। বলিল, ‘প্রভাতবাবু পাঠালেন। আপনি আমায় ডেকেছেন?’
‘হ্যাঁ, বসুন। ঐ চেয়ারে।’ ব্যোমকেশ কঠিন চক্ষে কিয়ৎকাল তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আপনার সব কীর্তিই আমি জানতে পেরেছি। রমেশ মল্লিক। আমার বন্ধু।’
ন্যাপা চমকিয়া কাষ্ঠমূর্তিতে পরিণত হইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনাদি হালদারের আলমারির চাবি আপনি তৈরি করেছিলেন। আলমারিতে অনেক টাকা ছিল, সে টাকা কোথায় গেল? আমি যদি পুলিসকে খবর দিই তারা জানতে চাইবে। আপনি কী উত্তর দেবেন?
ন্যাপা অধর লেহন করিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি কথাটা পুলিসের কানে না তুলতে পারি, যদি আপনি আমার একটা কাজ করেন।’
ন্যাপার কণ্ঠ হইতে ভাঙা-ভাঙা আওয়াজ বাহির হইল, ‘কি কাজ?’
‘আর একটা চাবি তৈরি করে দিতে হবে।’