অপরাহ্নে পুঁটিরাম যখন চা লইয়া আসিল তখন লক্ষ্য করিলাম, তাহার মুখখানা শীর্ণ ও কেন্দনাক্লিষ্ট। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি রে, কি হয়েছে?’
পুঁটিরাম বলিল, ‘আবার অম্বলের ব্যথা ধরেছে বাবু।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি ওষুধ দিচ্ছি, তুই শুয়ে থাকগে যা। এ বেলা আর তোকে রাঁধতে হবে না।’
কিছুদিন হইতে পুঁটিরামকে অম্লশূলে ধরিয়াছে; বিশুদ্ধ কাঁকর এবং তেঁতুল বিচির গুড়া তাহার সহ্য হইতেছে না। ব্যোমকেশ তাহাকে যোয়ানের জল দিয়া ফিরিয়া আসিলে বলিলাম, নীচে খবর পাঠাই, মেসেই আজ আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হোক।’
ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল, ‘না, চল আজ কোনও হোটেলে খেয়ে আসি। আজ পাঁচশো টাকা হাতে এসেছে, বর্বরস্য ধনক্ষয়ং হওয়া দরকার।’
আমি তাহার এই লঘুতায় সায় দিতে পারিলাম না, বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কিছু মনে করো না। ওই পাঁচশো টাকা যে ঘুষ যখন বুঝতে পেরেছ তখন ও টাকা নেওয়া কি তোমার উচিত হয়েছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে পারি। কিন্তু তা করব না। টাকা আমার চাই তাই নিয়েছি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারব না।’
‘কিন্তু ধরো-যদি শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে, নিমাই নিতাই খুন করেছে, তখন কি করবে? ঘুষ খেয়ে কথাটা চেপে যাবে?’
‘না, চেপে যাব না, ওদেরই ধরিয়ে দেব। অবশ্য যদি পুলিস ধরতে চায়। মনে রেখো, অনাদি হালদারের খুনের তদন্তু করবার জন্যই ওরা আমাকে টাকা দিয়েছে, ঘুষ বলে দেয়নি।’
‘তা যদি হয় তাহলে স্বতন্ত্র কথা।’
‘তোমার ভয় নেই, ঘুষ খেয়ে আমি অধৰ্ম করব না। অধৰ্ম করার মতলব যদি থাকত তাহলে পাঁচশো টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট হতাম না, রীতিমত আখেরের রেস্ত করে নিতাম।’ বলিয়া ব্যোমকেশ হাসিল।
চা শেষ করিয়া সিগারেট ধরাইলাম। এ বেলা বোধহয় আর অতিথি অভ্যাগতের শুভাগমন হইবে না ভাবিতেছি, প্রভাত আসিয়া উপস্থিত। তাহার হাতে একটি বৌচুকা, চেহারা দেখিয়া বোঝা যায়, সম্প্রতি রোগ হইতে উঠিয়াছে, চোখের মধ্যে দুর্বলতার চিহ্ন এখনও লুপ্ত হয় নাই। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন। এখন শরীর কেমন?’
লজিত হাসিয়া প্ৰভাত বলিল, ‘সেরে গেছে। সেদিন অনেক কষ্ট দিলাম। আপনাদের।’
‘কিছু না। হাতে ওটা কি?’
‘একটু মিষ্টি। ভীম নাগের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম কিছু নিয়ে যাই।’
বোঁচ্কা খুলিলে দেখা গেল, মিষ্টি অল্প নয়, প্রায় কুড়ি পঁচিশ টাকার কড়া পাকের সন্দেশ। সেদিন ব্যোমকেশ তাহার উপকার করিয়াছিল, ডাক্তার গাড়ি-ভাড়া প্রভৃতির খরচ লয় নাই, তাই প্রভাত অত্যন্ত শিষ্টভাবে তাহা প্রত্যাৰ্পণ করিতে চায়। ব্যোমকেশ উল্লসিত হইয়া বলিল, ‘আরে আরে, এ যে স্বর্গীয় ব্যাপার। অজিত, আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম বল তো?’
বলিলাম, যতদূর মনে পড়ে তুমি আমার মুখ দেখেছিলে এবং আমি তোমার মুখ দেখেছিলাম।’
‘তবেই বোঝে, আমাদের মুখ দুটো সামান্য নয়। যাহোক, খাবারগুলো সরিয়ে রাখা ভাল, বাইরে ফেলে রাখা কিছু নয়।’ ব্যোমকেশ সন্দেশগুলি ভিতরে রাখিয়া আসিয়া বলিল, ‘প্রভাতবাবু্, চা খাবেন নাকি?’
‘আজ্ঞে না, আমি চ খেয়ে এসেছি।’ সে ঘরের এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল, ‘এখানে কেবল আপনারা দু’জনে থাকেন বুঝি?’।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘উপস্থিত দু’জনেই আছি। আমার স্ত্রী এবং ছেলে এখন পাটনায়।’
প্রভাতের চোখ দুইটি যেন নৃত্য করিয়া উঠিল—’পাটনায়!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, যা হাঙ্গামা চলেছে, তাদের বাইরে রেখেছি। আপনি বুঝি পাটনা এখনও ভুলতে পারেননি।’
‘পাটনা ভুলব!’ প্ৰভাতের স্বর গাঢ় হইয়া উঠিল—’জন্মে অব্দি পাটনাতেই কাটিয়েছি। কত বন্ধু আছে সেখানে। ইশাক সাহেব আছেন।’
‘ইশাক সাহেব?’
‘আমার ওস্তাদ। তাঁর দোকানে চাকরি করতাম, তিনি হাতে ধরে আমাকে দপ্তরীর কাজ শিখিয়েছিলেন। এমন ভাল লোক হয় না, দেবতুল্য লোক। এখন বুড়ো হয়েছেন.কে তাঁর দোকানে কাজ করছে কে জানে…হয়তো তিনি একই কাজ করেছেন।’ প্ৰভাত নিশ্বাস ফেলিল।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘পাটনায় কোন পাড়ায় থাকেন তিনি?’
‘সিটিতে থাকেন। সেখানে সকলেই তাঁকে চেনে। আমার আর ওদিকে যাওয়া হয়নি, সেই যে পাটনা থেকে এসেছি, আর যাইনি। ব্যোমকেশবাবু্, আপনি নিশ্চয় মাঝে মাঝে পাটনা যান? এবার যখন যাবেন ইশাক সাহেবকে দেখে আসবেন? কেমন আছেন তিনি-বড় দেখতে ইচ্ছে করে।’
‘নিশ্চয় দেখা করব। তারপর এদিকের খবর কি? কেষ্টবাবু কেমন আছেন?’
প্রভাত বলিল, ‘কেষ্টবাবু চলে গেছেন।’
চলে গেছেন?’
‘হ্যাঁ। আমার বাসায় ওঁর পোষাল না। মা’র সঙ্গে দিনরাত খিটিমিটি লাগত। তারপর একদিন নিজেই চলে গেলেন।’
‘যাক, আপনার ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামল। আর নৃপেনবাবু? তিনি কি আপনার দোকানে কাজ করছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি কাজ করেন?’
‘বইয়ের দেকানে অনেক ছুটোছুটির কাজ আছে। অন্য দোকান থেকে বই আনতে হয়, ভি পি পাঠাবার জন্যে পোস্ট অফিসে যেতে হয়। এসব কাজ আগে আমাকেই করতে হত। এখন নৃপেনবাবু করেন।’
‘ভাল।’
প্রভাত এতক্ষণ বোমকেশের সঙ্গে কথা বলিতেছিল, মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাইতেছিল; এখন সে আমার দিকে ফিরিয়া বসিয়া বলিল, ‘অজিতবাবু্, আমি আপনার কাছে আসব বলেছিলাম মনে আছে বোধহয়। এইসব গণ্ডগোলে আসতে পারিনি। আপনার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে।’
‘কি অনুরোধ বলুন।’
‘আপনার একখানি উপন্যাস আমাকে দিতে হবে। আমি গরীব প্রকাশক, নতুন দোকান করেছি। তবু অন্য প্রকাশকের কাছ থেকে আপনি যা পান আমিও তাই দেব।’
নূতন প্রকাশককে বই দেওয়ায় বিপদ আছে, কখন লালবাতি জ্বালিবে বলা যায় না। একবার এক অবচিীনকে বই দিয়া ঠকিয়াছি। আমি ইতস্তত করিয়া বলিলাম, ‘তা, এখন তো আমার হাতে কিছু নেই-’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কেন, যে উপন্যাসটা ধরেছ সেটা দিতে পারো। প্রভাতবাবু্, আপনি ভাববেন না, অজিতের বই আপনি পাবেন।’
প্রভাত উৎসাহিত হইয়া বলিল, ‘যখন আপনার বই শেষ হবে তখন দেবেন। এখন আমার দোকান ভাল চলছে না, পরের বই কমিশনে বিক্রি করে কতটুকুই বা লাভ থাকে। আপনাদের আশীবাদ পেলে আমি দোকান বড় করে তুলব।; প্ৰাণপণে খাটব, কিছুঁতেই নষ্ট হতে দেব না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এই তো চাই। আপনাদের বয়সে কাজে উৎসাহ থাকা চাই। তবে উন্নতি করতে পারবেন।’
প্রভাত গদগদ মুখে পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া তাহা হইতে দুইটি নোট লইয়া আমার সম্মুখে রাখিল। দেখিলাম দুইশত টাকা। সত্যই আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছিলাম!
প্ৰভাত বলিল, ‘অগ্রিম প্ৰণামী দিলাম। বই লেখা শেষ হলেই বাকি টাকা দিয়ে যাব।’ সে উঠিয়া দাঁড়াইল।
বলিলাম, ‘রসিদ নিয়ে যান।’
সে বলিল, ‘না, না, এখন রসিদ থাক, সব টাকা দিয়ে রসিদ নেব। আজ যাই, সন্ধ্যে হয়ে গেল, এখনও দোকান খোলা হয়নি।’
প্রভাত প্ৰস্থান করিলে আমরা কিছুক্ষণ বিস্ময়-পুলকিত নেত্রে পরস্পর চাহিয়া রহিলাম। তারপর নোট দু’টি সস্নেহে পকেটে রাখিয়া বলিলাম, ‘কাণ্ডখোনা কি! এ যে শ্রাবণের ধারার মত ক্ৰমাগত একশো টাকার নোট বৃষ্টি হচ্ছে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। এত সুখ সইলে হয়।’
এই সময় দ্বারদেশে বাঁটুলের আবির্ভাব হইল। তাহার আবার চাঁদা আদায়ের সময় হইয়াছে। সে ভক্তিভারে আমাদের প্রণাম করিয়া বিলল, ‘চাঁদটিা নিতে এলাম কর্তা।’
ব্যোমকেশ আমার দিকে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসির অর্থ; জীবন-ব্যবসায়ে শুধু আমদানি নয়, রপ্তানিও আছে।
বাঁটুলকে বসাইয়া ব্যোমকেশ টাকা আনিতে গেল। কামিনীকান্তর দেওয়া নোটগুলি হইতে একটি আনিয়া বাঁটুলকে দিল–’ভাঙনি আছে বাঁটুল?’
‘আজ্ঞে, আছে।’
বাঁটুল কোমর হইতে গেজে বাহির করিল। বেশ পরিপুষ্ট গেজে; তাহাতে খুচরা রেজাগি হইতে নানা অঙ্কের নোট পর্যন্ত রহিয়াছে। কয়েকটি একশত টাকার নোটও চোখে পড়িল। বাঁটুল হিসাব করিয়া ভাঙনি ফেরত দিল, তারপর গেজে। আবার কোমরে বাঁধিল। বাঁটুলের ব্যবসা যে লাভের ব্যবসা তাহাতে সন্দেহ নাই।
ব্যোমকেশ বাঁটুলকে সিগারেট দিল—’বাঁটুল, অনাদি হালদার মারা গেছে শুনেছ বোধহয়?’
বাঁটুল চোখ তুলিল না, সযত্নে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল, ‘আজ্ঞে, শুনেছি।’
‘কেউ তাকে গুলি করে মেরেছে।’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। তাই তো গুজব।’
‘তুমি তো অনেক খবর-টাবর রাখো, কে মেরেছে আন্দাজ করতে পারো না?’
‘কলকাতায় লাখ লাখ লোক আছে, কত, তার মধ্যে কে মেরেছে কি করে আন্দাজ করব। তবে এ কথাও বলতে হয়, উনি চুলকে ঘা করলেন। আমার চাঁদা বন্ধ না করলে বেঘোরে প্রাণটা যেত না। আমি রক্ষে করতাম।’
‘বটেই তো! জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা কি উচিত! অনাদি হালদারের দুবুদ্ধি হয়েছিল। সে যাক। বাঁটুল, তোমরা রাইফেল ভাড়া দাও?’
‘আজ্ঞে, দিই।’
‘কি রকম শর্তে ভাড়া দাও?’
‘আজ্ঞে, ভাড়া একদিনের জন্যে কুল্লে পাঁচিশ টাকা; রাইফেল আর দু’টি টোটা পাবেন। তবে ভাড়া নেবার সময় তিনশো টাকা জমা দিতে হয়, রাইফেল ফেরত দিলে ভাড়া কেটে নিয়ে টাকা ফেরত দিই। আপনাদের চাই নাকি কর্তা?’
‘না, উপস্থিত দরকার নেই, দরটা জেনে রাখলাম। আচ্ছা বাঁটুল, যে-রাত্রে অনাদি হালদার খুন হয় সে-রাত্রে কাউকে রাইফেল ভাড়া দিয়েছিলে?’
বাঁটুল উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘আজ্ঞে কতা, সে কথা বলতে পারব না। একজন খদ্দেরের কথা আর একজনকে বললে বেইমানী হয়, আমাদের ব্যবসা চলে না। আচ্ছা, আজ আসি। পোন্নাম হই।’
বাঁটুল চলিয়া গেল, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ব্যোমকেশ আরাম-কেন্দারায় লম্বা হইয়া বোধকরি ঝিমাইয়া পড়িল। আমার মনটা এদিক ওদিক ঘুরিয়া দুইশত টাকার কাছে ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিল। টাকা যখন লইয়াছি তখন উপন্যাসটা তাড়াতাড়ি শেষ করিতে হইবে। অথচ তাড়াহুড়া করিয়া আমার লেখা হয় না; মনটা যখন নিশ্চিন্তু নিস্তরঙ্গ হয় তখনই কলম চলে। উপন্যাসের কথাই ভাবিতে লাগিলাম; তাহার মধ্যে নিমাই নিতাই প্রভাত বাঁটুল সকলেই মাঝে মাঝে উকিঝুকি মারিতে লাগিল।
ঘণ্টা দুই পরে পেটে ক্ষুধার উদয় হইলে বলিলাম, ‘চল, এবার বেরুনো যাক। হোটেলের খরচ আজ না হয়। আমিই দেব।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাধু সাধু।’
আমাদের বাসার অনতিদূরে একটি হোটেল আছে। দোতলার উপর হোটেল, সরু সিঁড়ি দিয়া উঠিতে হয়; সিঁড়ির মাথায় স্থূলকায় ম্যানেজার টেবিলের উপর ক্যাশ-বাক্স লইয়া বসিয়া থাকেন। আশেপাশে ছোট ছোট কুঠুরিতে টেবিল পাতা। বিশেষ জাঁকজমক নাই, কিন্তু রান্না ভাল।
হোটেলে উপস্থিত হইলে ম্যানেজার বলিলেন, ‘পাঁচ নম্বর।’ অমনি একজন ভৃত্য আসিয়া আমাদের পাঁচ নম্বর কুঠুরির দিকে লইয়া চলিল। একটি গলির দুই পাশে সারি সারি কুঠুরি; যাইতে যাইতে একটি কুঠুরির সম্মুখে গিয়া পা আপনি থামিয়া গেল। আমি ব্যোমকেশের গা টিপিলাম। পদার ফাঁক দিয়া দেখা যাইতেছে, কেষ্টবাবু একাকী বসিয়া আহার করিতেছেন। তাঁহার গায়ে সিঙ্কের পাঞ্জাবির উপর পাট করা শাল, মুখে ধনগর্বের গান্তীর্য। তাঁহার সামনে শ্বেতবস্ত্রাবৃত টেবিলের উপর অনেকগুলি প্লেটে রাজসিক খাদ্যদ্রব্য সাজানো; একটি প্লেটে আস্ত রোস্ট মুরগি উত্তানপাদ অবস্থায় বিরাজ করিতেছে। পাশে একটি বোতল।
কেষ্টবাবু পানাহারে মগ্ন, দরজার বাহিরে আমাদের লক্ষ্য করিলেন না। আমরা পাশের প্রকোষ্ঠে গিয়া বসিলাম।
ভৃত্যকে অডার দিলে সে খাবার লইয়া আসিল; আমরা খাইতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম ব্যোমকেশের প্রাক্তন প্ৰসন্নতা আর নাই, সে যেন ভাল ভাল খাদ্যগুলি উপভোগ করিতেছে না।
আধা ঘণ্টা পরে ভোজন শেষ করিয়া কোটির হইতে নিৰ্গত হইলাম! ম্যানেজারের টেবিলের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কেষ্টবাবু হোটেলের ঋণ শোধ করিতেছেন। রাজকীয় ভঙ্গীতে পকেট হইতে একশত টাকার নোট লইয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিলেন।
এই লইয়া আজ চারবার একশত টাকার নোট দেখিলাম। দেশটা সম্ভবত রাতারাতি বড়মানুষ হইয়া উঠিয়াছে, ইংরেজ বিদায় লইবার পূর্বেই আমাদের কপাল ফিরিয়াছে। স্বাধীনতা লাভের আর দেরি নাই।
ম্যানেজার ভাঙনি ফেরত দিলেন, কেষ্টবাবু তাহা অবজ্ঞাভরে পকেটে ফেলিয়া পিছন ফিরিলেন। আমরা পিছনেই ছিলাম।
চোখাচোখি হইল। কেষ্টবাবুর চোয়াল বুলিয়া পড়িল। তারপর তিনি পাকশািট খাইয়া ঝটিতি সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন।
আমরা যখন হোটেলের প্রাপ্য চুকাইয়া পথে নামিলাম কেষ্টবাবু তখন অদৃশ্য হইয়াছেন।
বাসার দিকে চলিতে চলিতে বলিলাম, আজকের দিনটা ঘটনাবহুল বলা চলে, এমন কি টাকাবহুল বললেও অত্যুক্তি হয় না। এ যেন চারিদিকে একশো টাকার নোটের হরির লুট হচ্ছে।’
ব্যোমকেশ উত্তর দিল না।
আরও খানিক দূর চলিবার পর বলিলাম, ‘কী ভাবছ এত?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল অজিত, পাটনা যাই। সকালে একটা ট্রেন আছে।’
আমি ফুটপাথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িলাম–’পাটনা যাবে! আর এদিকে?’
‘এদিকে আর কিছু করবার নেই।’
‘তার মানে অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে তা বুঝতে পেরেছ।’
‘বোধহয় পেরেছি। কিন্তু তাকে ধরবার উপায় নেই।’
আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম—’কে খুন করেছে?’
ব্যোমকেশ আকাশের দিকে চোখ তুলিল; বুঝিলাম আবোল-তাবোল আবৃত্তি করিবার উদ্যোগ করিতেছে। বলিলাম, ‘বলতে না চাও বোলো না। কিন্তু বিকাশ দত্তকে খবর সংগ্ৰহ করবার জন্যে টাকা দিয়েছ তার কি হবে?’
‘বিকাশ ওস্তাদ ছেলে, জানাবার মত খবর থাকলে সে ঠিক আমাকে জানাবে।’
‘কিন্তু আসল খবর যখন জানতেই পেরেছ তখন আর খবরে দরকার কি?’
‘দরকার হয়তো নেই, কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়। সুন্দরী যুবতীরা প্রসাধন করেন কেন? বন্ধল পরে থাকলেই পারেন। থাকেন না। তার কারণ, অধিকন্তু ন দোষায়।’
‘তুমি কি সুন্দরী যুবতী?’
‘না, আমি সুন্দর যুবক। আমার জন্যে আমার বউয়ের মন কেমন করছে। সুতরাং আর দেরি নয়। কাল সকালেই-পাটনা।’