আড়ালে আততায়ী – ৮

৷৷ আট ৷৷

দীপকাকু বলে থাকেন গোয়েন্দাগিরি হচ্ছে সম্ভাবনার অনুসন্ধান। বিপুল ধৈর্যের সঙ্গে এবং একাগ্র চিত্তে সন্ধান চালিয়ে যেতে হয়। সাফল্য আসে আপনা থেকেই। ডা. রায়ের কেসটাতে দীপকাকু তাঁর উক্তি হাতে নাতে প্রমাণ করলেন। আজ এই তদন্তের যবনিকা পতন হতে চলেছে। ঝিনুকরা এখন চলেছে ডা. অলকেশ রায়ের বাড়িতে। দীপকাকু ঝিনুকদের বাড়িতে সকালের জলখাবার সারলেন। তার আগেই বাবাকে বলেছেন, রজতদা, আজ একটু বেলা করে অফিসে যাবেন। কেসের শেষ পার্টটা বড় ইচ্ছে করছে আপনাকে দেখাতে।

সিকিউরিটি এজেন্সিটা বাবার। দেরি করে গেলে কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার নেই। তাই বাবা বলেছিলেন, যেতে তো আমার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু যবনিকাপাতটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারব তো? ফাঁক থেকে যাবে না? তুমি তো কেসটার ব্যাপারে আমার সঙ্গে সে ভাবে আলোচনাই করোনি। ঝিনুকও তথ্য দিয়েছে সামান্য কিছু। এখন আবার বলছে অপরাধীর নাম জানে। কিন্তু বলবে না। যেহেতু ও জানে না কী কী সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে তুমি শনাক্ত করেছে অপরাধীকে।

—চলুন না। আজকের মিটিং-এর পর ঝিনুকের কাছে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আপনি যেটুকু বুঝবেন না, পরে ঝিনুক আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। বলেছিলেন দীপকাকু। প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন বাবা ।

বাবার গাড়িতেই যাওয়া হচ্ছে একবালপুরে ডা. রায়ের বাড়িতে। গাড়ি চালাচ্ছে ঝিনুকদের ড্রাইভার আওদা।

ঝিনুক সত্যিই জানে কে অপরাধী। সেটা জেনেছে ঘটনাচক্রে। ব্যক্তিটির অপরাধ কী পদ্ধতিতে চিহ্নিত করলেন দীপকাকু, ঝিনুককে বলার সুযোগ পাননি। আজ সকালে ফোন করে বললেন, তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি। আজকেই ডা. রায়ের কেসটার ফয়সালা হয়ে যাবে।

ঝিনুক তো অবাক! এত তাড়াতাড়ি কেসটা সমাধান করে ফেলবেন দীপকাকু ভাবতে পারেনি! তার মানে চুপিসারে এমন কিছু তদন্ত চালিয়েছেন, যা ঝিনুককে বলেননি। সেগুলো কী হতে পারে, সেটাই এখন গাড়ির পিছনে বসে ভাবছে ঝিনুক। পাশে বাবা। ড্রাইভার আশুদার পাশের সিটে দীপকাকু।

গত পরশু কমল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীপকাকু ঝিনুককে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ভবানীপুরে। একে তাকে জিজ্ঞেস করে খুঁজে বার করলেন কমলবাবুর দোকান, “বিশ্বাস ফার্নিচার’। শো রুমটা এলগিন রোডের উপরে। কাউন্টারে ছিলেন কমলবাবুর ছেলে। বাবার সঙ্গে চেহারার অনেক মিল। দীপকাকু কমলবাবুর ছেলেকে বললেন, একটা ডবল বেড খাট নেব। ডেলিভারি দিতে হবে দুর্গাপুরে। কী ভাবে দেবেন?

—ট্রান্সপোর্টে পাঠিয়ে দেব। তার জন্য আলাদা পে করতে হবে আপনাকে, বলেছিলেন কমলবাবুর ছেলে।

দীপকাকু তখন বলেন, ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা যদি আমি করি।

– সে ক্ষেত্রে জিনিস ড্যামেজ হলে আমরা দায় নিতে পারব না। সাফ জানিয়ে দিলেন কমলবাবুর ছেলে।

দীপকাকু জানতে চেয়েছিলেন, আপনারা কোন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিকে দিয়ে জিনিস পাঠান?

– জয়গুরু ট্রান্সপোর্ট। বললেন কমলবাবুর ছেলে।

ঝিনুকের খুব চেনা চেনা ঠেকছিল কোম্পানির নামটা। এর পরে যখন দীপকাকু জানতে চাইলেন, ল্যান্সডাউনের জয়গুরু ট্রান্সপোর্ট তো ?

ঝিনুকের মনে পড়ে গিয়েছিল ডা. রায়ের মৃত্যুর পরই এই কোম্পানিতেই চাকরি নিয়েছিল ড্রাইভার নন্দ গড়াই। কমলবাবুর ছেলের থেকে সায় পাওয়া গেল কোম্পানিটা ল্যান্সডাউনেই। যেহেতু এলগিন রোড থেকে ল্যান্সডাউন কাছেই, তাই তাঁরা ওই কোম্পানিটাকে বেছেছেন। কোম্পানির সার্ভিস ভাল। দূরত্ব কমের জন্য ট্রান্সপোর্টেশন খরচা খানিকটা বাঁচে।

—ঠিক আছে। পরে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব বলে ‘বিশ্বাস ফার্নিচার’ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন দীপকাকু। মোটরবাইকে ওঠার আগে ফোন করলেন বন্ধু রঞ্জনকাকুকে। যিনি লালবাজারের ইন্সপেক্টর। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিটার নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে বললেন, তুই ওদের একটু বলে দে আমার ইনভেস্টিগেশনে যেন হেল্প করে।

এরপরই ঝিনুকরা পৌঁছেছিল ‘জয়গুরু ট্রান্সপোর্ট’ কোম্পানিতে। যাওয়ার পথে ঝিনুক দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কী ভাবে আন্দাজ করলেন যে কোম্পানিতে ড্রাইভারি করত নন্দ গড়াই। তাদের দিয়েই জিনিস পাঠায় ‘বিশ্বাস ফার্নিচার’?

— পরে বলব। বলে এখনও বলেননি দীপকাকু। আজ নিশ্চয়ই জানা যাবে। জয়গুরু কোম্পানিতে ফোন করে দিয়েছিলেন রঞ্জনকাকু। পুলিশের ফোন পেয়ে ওরা দীপকাকুকে হেল্প করার জন্য রেডি ছিল। দীপকাকু ওদের কাছে চাইলেন ‘বিশ্বাস ফার্নিচার’ গত তিন মাসে কোথায় কোথায় গুডস্ পাঠিয়েছে বা আনিয়েছে তার লিস্ট।

কম্পিউটারে ছাপা লিস্ট পাওয়া গেল ওদের থেকে। দেখা গেল গত দু’মাস কেন, তিন মাসে একবারও নৈহাটি থেকে আসেনি বিশ্বাস ফার্নিচারের গুডস্। অথচ কমল বিশ্বাস বলছেন ফ্রেঞ্চ ক্যাবিনেটটা আনিয়েছেন নৈহাটি থেকে। এদিকে লিস্টে একটা ব্যাপার চোখ টানছে, চন্দননগরের লালবাগানে বেশ ক’বার বিশ্বাস ফার্নিচারের হয়ে জয়গুরু কোম্পানির গাড়ি গিয়েছে এসেছে। যে বাড়িতে গিয়েছে, নাম ‘সাহেব কুঠি’।

‘জয়গুরু ট্রান্সপোর্ট’ কোম্পানি থেকে বেরিয়ে এসে দীপকাকু ঝিনুককে বলেছিলেন, শুধু ক্যাবিনেটটা নয়, ওই বাড়িটা থেকে আরও অনেক ফার্নিচারই আনিয়েছেন কমলবাবু। সেটা আমাদের কাছে চেপে যাওয়ার কারণটা কী? মনে হচ্ছে কাল-পরশু চন্দননগরের ‘সাহেব কুঠি’তে একবার যেতে হবে।

কথা শেষ করে দীপকাকু মোটর বাইকে উঠতে যাবেন, ফোন এল ওঁর মোবাইলে। এ প্রান্তের কথা শুনে ঝিনুক বুঝতে পেরেছিল ফোন করেছেন রেল পুলিশের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জহর সাহা। কথাবার্তা সেরে নিয়ে দীপকাকু ঝিনুককে যা বললেন, এক পিঠের বাক্যালাপ শুনেই মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেছিল ঝিনুক। জহর সাহা খবর দিলেন, মৃত্যুর আগের সাতদিন ডা. রায়ের ফোনে যে চারটে নামহীন নাম্বারের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে একটাতে ডাক্তারবাবু দু’বার ফোন করেছিলেন, দু’বার ফোন এসেছিল ওই নাম্বার থেকে। সেটা মাঝে মাঝে সচল হচ্ছে টাওয়ার লোকেশন দেখাচ্ছে চন্দননগর জি টি রোডের আশেপাশে।… একটু চিন্তা ভাবনা করে নিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, খবরটা এই কেসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইম্পর্টান্ট হওয়ার চান্স আছে। চলো, এখনই চন্দননগর রওনা হই। বউদিকে বলে দাও তোমার ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।

মাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল ঝিনুক। সেদিন তখনও ঠিক মতো সকালের জলখাবার খাওয়া হয়নি। চন্দননগর যাওয়ার পথে দিল্লি রোডের ধাবায় খাওয়া হল। দু’ঘণ্টা মতো লাগল চন্দননগর পৌঁছোতে। লালবাগান অঞ্চলে ‘সাহেব কুঠি’ বাড়িটা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি। বেশ পরিচিতি আছে বাড়িটার। মজার ব্যাপার এই, বাড়িটার আসল নাম ‘সাহেব কুঠি’ নয়। কোনও এক ফরাসি থাকত বলেই এই নাম। বাড়িটার এমনই ভগ্নদশা, আসল নামটা পড়া গেল না। গেটের থামে গাঁথা শ্বেত পাথরের নামফলকটায় শ্যাওলা জমে গেছে। লোহার গেটটা কোনও রকমে বন্ধ করা ছিল। সেটা খুলে কিছুটা হেঁটে পৌঁছোতে হল সদরে। হাঁটাপথটুকুর দু’পাশে রীতিমতো ঝোপ-জঙ্গল, সদরের কলিং বেল অকেজো। দীপকাকু দরজার কড়া নেড়ে, ‘কেউ আছেন! কেউ আছেন!’ বলে বেশ ক’বার হাঁক পাড়ার পর দরজা খুললেন প্রায় ন্যাড়া মাথার এক ভদ্রলোক। পরনে মলিন পাজামা-পাঞ্জাবি। দীপকাকু বলেছিলেন, আমি পুরনো ফার্নিচার কিনতে চাই। আছে কিছু।

– — অল্পই আছে। আগে দেখে নিন। যদি পছন্দ হয়, মালিককে ডেকে পাঠাতে হবে। বলে ঘুরে গিয়ে হাঁটা লাগিয়েছিলেন ভদ্রলোক, দীপকাকু বলে ওঠেন, আপনাকে আমি চিনেছি সায়ন রায়। বাবার মৃত্যুর কারণে মাথা কামিয়েছেন। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আপনার অটুট। আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন না। পুলিশের কাছে স্যারেন্ডার করুন। ক’বছর না হয় জেল হবে। তারপর নতুন করে বাঁচবেন।

দীপকাকুর দিকে খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন ভদ্রলোক। ঝিনুকও বিস্ময়ের সীমা পার করে গিয়েছিল। সায়নবাবু, মানে প্রয়াত ডা. রায়ের ছেলে মুখে দু’হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন মেঝেতে।… গাড়ি ব্রেক কষতে ঝিনুকের সম্বিত ফিরল। ডা. রায়ের বাড়ির গেটে এসে পড়েছে তারা।

একতলায় পেশেন্ট পার্টির বসার জায়গাতে মিটিং শুরু হয়েছে। মিটিং-এ দীপকাকু যাদের ডেকেছিলেন, সকলেই এসেছেন। এ ঘরে অনেকগুলো চেয়ার এনে গোল করে সাজানো হয়েছে। মিটিং-এর লোকজন বসেছেন সেখানে। আছেন ডা. অলকেশ রায়ের দুই ভাই।

বোন শ্রাবণীদেবীও এসেছেন। হাজবেন্ড প্রবীর গুপ্ত আছেন সঙ্গে। ডা. রায়ের কম্পাউন্ডার তাপস কুণ্ডু আছেন। রেলের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জহর সাহা, ডা. রায়ের বন্ধু কমল বিশ্বাসও উপস্থিত। এ ছাড়া ঝিনুকরা তিনজন। দীপকাকু সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মিটিংটা অ্যাটেন্ড করার জন্য। এবার দীপকাকু বলা শুরু করলেন, তদন্তের স্বার্থে এই কেসটাতে আমার পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছিল। ইতিমধ্যে সকলেই জেনে গিয়েছেন আমার পরিচয়। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ডাক্তার রায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তাঁর নিরুদ্দেশ ছেলে সায়ন রায়কে খুঁজে দেওয়ার জন্য। শর্ত ছিল, কাজটা খুব গোপনে করতে হবে। কারণ সায়নের সঙ্গে তিনি দেখা করুন এটা তাঁর পরিবারের লোক চায় না। তাঁরা মনে করেন সায়ন ইচ্ছাকৃতভাবে অয়নকে মোটরবাইকের ধাক্কা মেরেছে। এই মনে হওয়াটা অয়ন মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোকের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় বিচার করলে বোঝা যাবে ওটা ছিল দুর্ঘটনা। তবে সায়নের অত র‍্যাশ ড্রাইভ করাটা অবশ্যই দোষের ছিল। ডা. রায়ের ধারণা ছিল ঘটনাটা যে নিছকই দুর্ঘটনাটা, ইচ্ছে করেই মানতে চাননি তাঁর দুইভাই। সায়ন ফিরে এসে বাবার সম্পত্তি পাক, চাননি তাঁরা। বড়দার বিষয়-আশায় ভোগ করার বাসনা ছিল তাঁদের।

চেয়ারে বসা সমরেশ হাত তুলে বলে উঠলেন, আমার এ ব্যাপারে কিছু বলার আছে।

—জানি আপনি স্বপক্ষে যুক্তি দেবেন। কিন্তু আমার কেসের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। আমাকে বলতে দিন প্লিজ। নয়তো খেই হারিয়ে ফেলব। বললেন দীপকাকু।

হাত নামিয়ে নিলেন সমরেশবাবু। ফের দীপকাকু বলতে থাকলেন, মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে ডা. রায় সায়নের দেখা পান ‘রিলাইফ’ হসপিটালের লাউঞ্জে, ভিজিটিং আওয়ার্সে। কমলবাবুর এক আত্মীয় ভর্তি ছিলেন ওই হসপিটালে। আত্মীয়কে দেখতে গিয়ে উনিই প্রথম দেখেন সায়নকে, তারপর ডা. রায়কে দেখান। বাবাকে দেখে সায়ন পালিয়ে যায়। এই ঘটনার পর ডা. রায় আমাকে ছেলেকে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োগ করেন। হসপিটালের সিসি টিভি ফুটেজে আমি সায়নকে দেখি। ওই একদিনের ফুটেজেই ওকে দেখা যায়। আর একদিন দেখেছিলেন কমলবাবু। ধরে নিয়েছিলাম সেদিন হয়তো সায়ন ভিড়ের আড়ালে ছিল। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি ওর ছবি। তা হলে মাত্র দু’দিন সায়ন গিয়েছিল রিলাইফে। কেন গিয়েছিল? ওর কোনও পেশেন্ট ভর্তি থাকলে, আরও বেশ কিছুদিন দেখতে যাওয়ার কথা। তা ছাড়া যে মানুষটা পাঁচ বছর ধরে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে আছে, সে হঠাৎ ওরকম ব্যস্ত, জনবহুল হাসপাতালে চলে আসবে কেন? এটা নিয়েই আমার সন্দেহ শুরু হয়। এমন নয়তো সায়ন যাতে ডা. রায়ের চোখে পড়ে, সেই জন্যই ওকে ওখানে দেখা গিয়েছিল? এরপরই ডা. রায় ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান। স্পটে গিয়ে দেখলাম লেভেল ক্রসিং-এর মাঝে পাঁচটা লাইন। ক্যানিং লাইনের আপ এবং ডাউন, বজবজ লাইনের আপ-ডাউন। গুডস ট্রেনের জন্য একটা। অতক’টা লাইন আমার কাছে একটা ফাঁদ বা ফেলে রাখা জালের অনুভূতি নিয়ে এল। এই জালের ফাঁদে ফেলা হয়নি তো ডা. রায়কে? ফেলার কারণ হিসেবে মনে হল, ডাক্তারবাবু আমাকে বলেছিলেন সায়নের সঙ্গে একবারটি কথা বলার ব্যবস্থা করিয়ে দিতে। তারপর যদি আমি সায়নকে পুলিশের হাতে তুলে দিই, ওঁর আপত্তি নেই। আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, ডাক্তারবাবু ওই একবার দেখাতেই সায়নকে এমন কিছু দিয়ে যেতে চান, যা ওর ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত এবং সুগম করবে। কিন্তু কোনও একজন বা একাধিক লোক চায় না ডাক্তারবাবু ওই সুবিধেটা সায়নের জন্য করে দেন। তাই কি তাঁকে আটকানো হল মৃত্যুর মতো একটা ব্যবস্থা নিয়ে। এই চরম পথটা নেওয়ার মানেই হচ্ছে সায়নকে ডা. রায় যেটা দিতে চেয়েছিলেন, তা অত্যন্ত মহার্ঘ। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টটা হয় চারটে দশ নাগাদ। পরে আমি রেলের টাইম টেবিল চেক করে যখন দেখি, ওই সময় চারটে লাইন দিয়েই ট্রেন যাওয়ার কথা। তখন আমার সন্দেহ আরও গাঢ় হতে থাকে, সময় বেছেই কি ডাক্তারবাবুকে কেউ ওখানে যাওয়ার ডাক পাঠানো হয়েছিল ? একটা ট্রেন এড়িয়ে গেলেও, পরেরটা এমনকি তার পরের ট্রেনগুলোর একটাতে ধাক্কা খেতেনই।

দম নিতে থামলেন দীপকাকু। তাপস কুণ্ডু বললেন, জল খাবেন? ঘরে আছে কিন্তু।

মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে দীপকাকু ফের শুরু করলেন, ড্রাইভার নন্দ গড়াই কাজ ছেড়ে যাওয়ার আগে এ বাড়িতে বলে গেল লেভেল ক্রসিং-এর গেট ফেলা আছে দেখে ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে নেমে ওপারে যাচ্ছিলেন, যেতে গিয়ে হল অ্যাক্সিডেন্ট। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, ডাক্তারবাবুর কিসের এত তাড়া ছিল? গেট ওঠা অবধি অপেক্ষা করলেন না কেন? কাঁকুলিয়ার দিকে কী কাজে যাচ্ছেন, কেন বলেননি নন্দকে। নিশ্চয়ই গোপন কোনও কাজে যাচ্ছিলেন। নন্দ গড়াইয়ের স্টেটমেন্টস আমার কাছে ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। এদিকে সে বেপাত্তা। বুঝলাম, নিশ্চয়ই নন্দ কিছু লুকোতেই গা ঢাকা দিয়েছে। ইতিমধ্যে অফিসার সাহার সহযোগিতায় আমি কথা বললাম ঘাতক ট্রেনের মোটরম্যানের সঙ্গে। উনি বললেন, ধাক্কা খাওয়ার আগের মুহূর্তে ফোনসেট বার করতে যাচ্ছিলেন ডা. রায়।

আমি অনুমান করলাম, বোধহয় অন্যমনস্ক করার জন্যই ফোনটা করা হয়েছিল। ডা. রায়ের ফোনের কললিস্ট চেক করতে বললাম। দেখা গেল অ্যাক্সিডেন্টের আগের মুহূর্তে যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল, সেটা জাল সিমকার্ডের নাম্বার। নিশ্চিত হলাম যে কল করা হয়েছিল ডা. রায়কে মৃত্যুমুখে ফেলার জন্যই। সেই ফোন নাম্বার ফের সক্রিয় হল আমাকে হুমকি দেওয়ার জন্য। টব ফেলাটা ইচ্ছাকৃত জানিয়ে দেওয়া হল। গলা চিনে ফেলার আশঙ্কায় এস এম এস করা হয়েছিল। বুঝতে বাকি রইল না, অপরাধী আছে আমার আশেপাশেই। যার সঙ্গে আমার কথোপকথন হয়েছে অথবা হবে। সেই সতর্কতায় এস এম এস।

থামলেন দীপকাকু। টানা কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। জহর সাহা বলে উঠলেন, এক রাউন্ড চায়ের ব্যবস্থা করা যাবে?

—নিশ্চয়ই যাবে। বললেন ডা. রায়ের ছোট ভাই কমলেশ। কোন বার করে সম্ভবত স্ত্রীকে কল করে বললেন, আমাদের সবার জন্য চা পাঠাও তো।

দীপকাকু আবার বলতে থাকলেন, ফাঁদ পেতে ধরলাম নন্দ গড়াইকে। সে বলল ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর একজন বন্দুক দেখিয়ে তার থেকে ডাক্তারবাবুর ফাইল ছিনতাই করে। এরপরই রেলের লাইনের উপর ডাক্তারবাবুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা চেপে যায় নন্দ। আপনাদের যদি ঘটনাটা বলত, আপনারা মনে করতেন সে নিজেই জিনিসটা সরিয়ে ছিনতাইয়ের দোহাই দিচ্ছে।

অ্যাক্সিডেন্ট এবং ছিনতাই দুটো কাছাকাছি সময় ঘটেছে দেখে বেশ সংশয়ে পড়ে গেলাম। ডা. রায়কে মারার কারণ ধরেছিলাম, সারনের কাছে পৌঁছোতে না দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে ছিনতাই এসে গেল কোথা থেকে? ছিনতাইটাও পূর্ব পরিকল্পিত? লোকটা জানত সে বেটা চায়, আছে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে?— আমি ভেবে দেখলাম ডাক্তারবাবুর সবচেয়ে কাছের মানুষ কমলবাবুর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। উনি জানেন ডাক্তারবাবুর অনেক পার্সোনাল ব্যাপার। সারনের ব্যাপারে ওঁর সঙ্গেই তো আলোচনা করতেন ডা. রায়। কমলবাবুর বাড়ি গিয়ে একটা ভাল সূত্র পেলাম। ওঁর লেখা বই ভচ্ছাবার্তাসহ সই করে দিলেন আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকে। হাতের লেখাটা মিলে গেল ডা. রায়ের ফাইলের একটা কাগজের লেখার সঙ্গে। যেটা আমি আমি সংগ্রহ করেছিলাম ডাক্তারবাবুর বেডরুম থেকে। ফাইলের ওই কাগজটাতেই পেয়েছিলাম একটা ওষুধের নাম দেওয়ার প্রয়াস। হাতের লেখাটা ডাক্তারবাবুর নয়, কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ওর লেখা আমি ততক্ষণে চিনে গিয়েছি। তিনটে নাম দেওয়া হয়েছিল ওষুধটার স্টপ এপিলেপ্সি, মৃগী নিবারক, মূর্ছাভঙ্গ শ্রাবণীদেবীর থেকে আমি জেনেছি ডা. রায় তিনটে রোগের খুব ভাল ওষুধ দিতেন, এপিলেপ্সি, শ্বাসকষ্ট এবং হাঁটুর যন্ত্রণা। অর্থাৎ এপিলেপ্সির ওষুধ বাজারে আনার জন্য নাম বাছা হচ্ছিল। কমলবাবুর হস্তাক্ষরে লেখা নাম মানেই দুই বন্ধু বসে বাজারে ওষুধটা আনার ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু আমি যখন ডা. রায়ের ব্যাপারে কমলবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, এপিলেপ্সির ওষুধ বাজারে আনার পরিকল্পনাটার কথা বলেননি।

—বলিনি, প্রসঙ্গ আসেনি বলে। আপনাকে তো আরও অনেক কথাই বলিনি। সব বলতে হবে, এরকম কোনও কথা ছিল না কি? রাগ এবং বিরক্তির সুরে বলে উঠলেন কমল বিশ্বাস।

দীপকাকু বললেন, তা ছিল না। তবে এই পয়েন্টটা আপনি ইচ্ছে করে চেপে গিয়েছিলেন। ডা. রায়ের মৃত্যু রহস্য তো এটাকে ঘিরেই। যাই হোক, যা বলছিলাম, কমলবাবুর বাড়ি গিয়ে আমি জানতে পারি ওঁর ফার্নিচারের বিজনেস, তার মানে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিকে কাজে লাগে। এদিকে ড্রাইভার নন্দ গড়াই আমাকে বলেছে তাকে একটা লোক যেচে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গাড়ি চালানোর অফার দেয়। আমার মনে হতে থাকে কমলবাবু যে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেন, তাদের কাউকে দিয়ে নন্দকে কাজের অফার দেননি তো? উনি হয়তো চান নন্দ গড়াই সমস্ত জেরা থেকে দূরে থাকুক। তা হলেই ছিনতাইয়ের ঘটনাটা আড়ালে থেকে যাবে। ডা. রায়ের ফাইল ছিনতাইয়ের সঙ্গে কি কমলবাবুর কোনও যোগ আছে?

–বাঃ, গল্পটা তো বেশ জমিয়ে দিয়েছেন মশাই। উপহাসের সুরে বলে উঠলেন কমল বিশ্বাস।

দীপকাকুর বদলে উত্তর দিলেন অফিসার সাহা। বললেন, পুরোটা শুনবেন কিন্তু। আমি তো শুনেছি। শেষের দিকে আরও জমাটি।

চা এসে গেল। ট্রেতে কাপ বসিয়ে হারু নিয়ে এসেছে চা। দীপকাকু একটা কাপ তুলে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, কমলবাবুকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম না কোন ট্রান্সপোর্টে জিনিস পাঠান। উনি সতর্ক হয়ে যেতেন। ওঁদের শোরুমে গিয়ে কমলবাবুর ছেলের থেকে জানলাম ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নাম। আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হল, ওই কোম্পানিরই চাকরির অফার পেয়েছে নন্দ গড়াই।

—সেটা যে আমিই পাইয়ে দিয়েছি, তার কি কোনও প্রমাণ আছে? ঝাঁঝের গলায় জানতে চাইলেন কমলবাবু।

ঠান্ডা স্বরে দীপকাকু বললেন, এখনই এত অধৈর্য হচ্ছেন কেন? আমাকে আর একটু বলতে দিন। তখন দেখবেন এ সব ছোট খাটো বিষয়ের প্রমাণ দরকারই পড়ছে না।

কাপে শেষ চুমুক মেরে সমরেশবাবু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনি বলে যান তো মশাই। থামবেন না।

শুরু করলেন দীপকাকু, এ বার গেলাম সেই ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে। কমলবাবুরা গত তিনমাসে কোথায় কোথায় যাওয়ার জন্য ওদের গাড়ি ব্যবহার করেছেন তার লিস্ট নিলাম। সেখানে নৈহাটির নাম ছিল না। অথচ কমলবাবুর বাড়িতে একটা ফ্রেঞ্চ স্টাইল অ্যান্টিক ক্যাবিনেট দেখেছি, যেটা উনি আমাদের বলেছেন দু’ মাস আগে নৈহাটি থেকে আনিয়েছেন। এদিকে লিস্টে চন্দননগরের একটা ঠিকানা পাচ্ছি বারবার। বাড়ির নাম ‘সাহেব কুঠি’। বুঝলাম ওই বাড়ি থেকে কমলবাবুর অনেক কিছু আনিয়েছেন। কিন্তু সেটা গোপন করতে চাইছেন কেন? চন্দননগরের ওই ঠিকানায় আমাকে একবার যেতে হবে, দেখতে হবে ব্যাপারটা কী? সেদিনই যেতাম না, যেতে হল অফিসার সাহার ফোন পেয়ে। ডা. রায়ের ফোনের কল লিস্টে চারটে নামহীন নাম্বারের মধ্যে একটা নাম্বার এমন, যেটাতে ডাক্তারবাবুও কল করেছিলেন। ওঁর মৃত্যুর পর সেই নাম্বারকে ট্রেস করা যাচ্ছিল না। অফিসার সাহা ফোনে জানালেন সেটা সক্রিয় হয়েছে। টাওয়ার লোকেশন পাওয়া যাচ্ছে চন্দননগরের জিটি রোডের কাছে। আমি দেখলাম ‘সাহেব কুঠির’ ঠিকানা জি টি রোডের পাশেই, লালবাগানে। মনে হল ওখানে গেলে অনেক রহস্যের কিনারা করতে পারব। তখনই রওনা দিলাম।

থামলেন দীপকাকু। দম নিয়ে শুরু করলেন বলতে, সাহেব কুঠিতে গিয়ে আমি সক্রিয় হয়ে ওঠা সেই ফোনের মালিককে পেলাম, তিনি এ বাড়ির নিরুদ্দেশ ছেলে সায়ন রায়।

ঘর জুড়ে বিস্ময়ের শ্বাস বয়ে গেল। কে যেন বলে উঠল, সত্যি!

হারু এসে ফাঁকা কাপগুলো ট্রেতে উঠিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দীপকাকু বলতে থাকলেন, সায়নের কাছে গিয়ে ছিনতাইয়ের রহস্য পরিষ্কার হল আমার কাছে। নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সায়ন বছর দুয়েক এদিক ওদিক ঘুরে সাহেব কুঠিতে কেয়ারটেকারের কাজে ঢুকেছিল। আত্মগোপনের জন্য ওই ভাঙা বাড়ি আদর্শ জায়গা। ঘটনাচক্রে মাস কয়েক আগে ও বাড়ির পুরনো ফার্নিচার কিনতে গিয়ে কমলবাবু সায়নের দেখা পান। তখনই তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সায়নকে দিয়ে তার বাবার কাছ থেকে তিনটে ওষুধের ফর্মুলা হাতিয়ে নেবেন। শ্বাসকষ্ট, হাঁটুর যন্ত্রণা, এপিলেপ্সি, এই তিনটে রোগের খুবই কার্যকারী ওষুধ দেন ডা. রায়। বিভিন্ন ওষুধ পরিমাণ মতো মিশিয়ে সেটা বানান। এই বিদ্যেটা তিনি পেয়েছিলেন তার গুরু ডা. জীবন দত্তর থেকে। ওষুধের পেটেন্ট নিতে পারেননি। কারণ, পেটেন্ট পেতে কোন ওষুধ কী কাজ করছে, লিখতে হয় প্রমাণ সহ । যা হোমিওপ্যাথি ওষুধের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কমলবাবু যথেষ্ট সম্পন্ন মানুষ, আরও বড়লোক হওয়ার লোভে তিনি বহুদিন ধরেই বন্ধুর ওই তিনটে ওষুধের ফর্মূলা হাতাতে চাইছিলেন। ওষুধগুলো রেজিস্ট্রি ছাড়া টোটকার মতো বাজারে আনতেন। বন্ধুকে পার্টনারশিপে ওই সব ওষুধের বিজনেসেরও অফার দিয়েছিলেন। এপিলেপ্সির ওষুধের জন্য রাজিও করে ফেলেছিলেন প্রায়। সেই কারণে নাম ঠিক করা চলছিল। শেষমেশ রাজি হননি ডা. রায়। তাঁর ইচ্ছে ছিল ফর্মূলা দিয়ে যাবেন সায়নকে। তাই উনি সায়নের সঙ্গে একবারটি দেখা করিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন আমাকে। ছেলে যাতে ওই ফমূ র্লার ওষুধ বেচে বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারে। কমলবাবুও টের পেয়েছিলেন বন্ধুর সুপ্ত বাসনার কথা। সায়নের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ডা. রায়ের ইচ্ছেটা আরও জাগিয়ে তোলার জন্য কমলবাবু একটা ফন্দি আঁটেন, বন্ধুকে একবার মৃত্যুর মুখোমুখি করিয়ে দিলে ছেলেকে ফর্মুলাটা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবে। ডা. রায় নিজের ওষুধ পুরিয়া করে রাখতেন, কমলবাবু হারুকে টাকার লোভ দেখিয়ে সেই পুরিয়াতে মেশালেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ অ্যাকোনাইট। যেদিন দুই বন্ধু ক্লাসিকাল মিউজিকের প্রোগ্রাম দেখতে যাচ্ছিলেন ওষুধ মেশানো হয়েছিল সেই দিন। অ্যাকোনাইট হারুকে এনে দিয়েছিলেন কমলবাবু। কারণ, ডা. রায়ের স্টক থেকে সেটা জোগাড় করা যাবে না। ওষুধের লেভেল খুলে উনি কোড নাম দিয়ে রাখেন। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কারণে হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যাপারে সামান্য কিছু জানতেন কমলবাবু। নিজেও পড়াশোনা করেছেন। ওঁর স্টাডির র‍্যাকে আমি বেশ ক’টা হোমিও চিকিৎসার বই দেখেছি। অ্যাকোনাইটের কতটা ডোজ দিলে ডা. রায় মরবেন না, মৃত্যুর আগের কষ্টটা পাবেন, জানতেন কমলবাবু। সেই অনুপাতে পুরিয়াতে মেশানো হয়েছিল অ্যাকোনাইট।

থামলেন দীপকাকু। কমলবাবু দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এই ঘটনার প্রমাণ চাইবেন না। কাল থানায় গিয়ে হারু জবানবন্দি দিয়ে এসেছে। আমিই এ বাড়িতে এসে হারুকে ফাঁকা ঘরে জেরা করার পর থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। হারু একথাও বলেছে ছাদের টপটা ওকে দিয়েই ফেলিয়েছিলেন আপনি। একটু উনিশ-বিশ হলে ওই ঘটনায় মারাও যেতে পারতাম আমি।

থমথমে মুখে নিরুত্তর রইলেন কমলবাবু। ফের দীপকাকু সবার উদ্দেশে বলতে থাকলেন, অ্যাকোনাইটের প্রভাবে ডা. রায় অসুস্থ হলেন। যার লক্ষণ অনেকটা হার্ট অ্যাটাকের মতো। ডাক্তারবাবু ভেবে উঠতে পারেননি তাঁর ওষুধে অ্যাকোনাইট মেশানো হয়েছে নার্সিংহোম থেকে ফিরে এলেন উনি। ঠিক এই সময়ে কমলবাবু সায়নকে বোঝালেন তোমার বাবা তিনটে ওষুধের ফর্মুলা তোমাকে দিয়ে যেতে চান। তুমি তো সেই ফর্মুলা কোনওদিন কাজে লাগাতে পারবে না। ফর্মুলা থেকে ওষুধ তৈরি করে বিক্রি করতে গেলে পুলিশ তোমায় ধরে ফেলবে। এখনও তুমি তাদের খাতায় ফেরার আসামি। বাবার থেকে ফর্মূলা নিয়ে তুমি আমায় বেচে দাও। আমি তোমায় দশ লাখ টাকা দেব।

প্রস্তাবে রাজি হয় সায়ন। টাকার তার খুব দরকার। পাঁচ বছর ধরে বড় কষ্টে দিন গুজরান করছে সে। টাকার জন্য কমলবাবুর সমস্ত নির্দেশ পালন করতে থাকে সায়ন। ‘রিলাইফ’ হসপিটালে একদিনই যায় কমলবাবুর কথা মতো। ডা. রায় ওকে এত বছর পর দেখে উতলা হয়ে পড়েন। ক’দিন আগেই মৃত্যুকে দেখেছেন শিয়রে। যে করে হোক ছেলের হাতে ওষুধের ফর্মুলাটা দিয়ে ফেলতে চান। সেই কারণেই সায়নকে খুঁজে দিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই ব্যাপারটা কমলবাবুর কাছে গোপন থেকে যায়। সায়ন কমলবাবুর প্ল্যান অনুযায়ী ডা. রায়কে ফোন করে বলে, তোমাকে হসপিটালে দেখে, কাছে যেতে ইচ্ছে করলেও, যেতে পারিনি। পাছে তুমি আমায় পুলিশে ধরিয়ে দাও। আমি একদম ভাল নেই বাবা। ভীষণ অভাবের মধ্যে আছি।

ডাক্তারবাবু সায়নকে বলেছিলেন, তুই একবার খানিকক্ষণের জন্য হলেও আমার সঙ্গে দেখা কর। তোকে এমন কিছু দেব, তোর খাওয়া পরার অভাব হবে না ।

আমি যেহেতু ডা. রায়কে বলে রেখেছিলাম সায়নের দেখা করিয়ে দেওয়ার পর ওর হদিশ পুলিশকে দেব নৈতিক কারণে। তাই উনি ফোনের এই কথোপকথন আমাকে জানাননি।

এরপর সায়নের নাম্বারে দু’বার ফোন করেন ডা. রায়। দ্বিতীয় কলটা ধরে সায়ন। কমলবাবুর শেখানো কথাই বলে, তুমি সাতাশ তারিখ কাঁকুলিয়া লেভেল ক্রসিং-এর ওপারে চলে এসো বিকেল চারটে দশ থেকে পনেরোর মধ্যে। লেভেল ক্রসিং-এর যে গেটটার পাশে জল টাংকি আছে, তার ওপারে। ওই পাঁচ মিনিটে আমাকে যা দেওয়ার দিয়ে দিও। তার চেয়ে বেশি সময় আমি থাকতে পারব না। পুলিশের ভয় আছে।

সঠিক সময়ে যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। লেভেল ক্রসিং-এর গেট তখন বন্ধ। ওই সময়ে দুটো ডিভিশনে চারটে লাইনে লোকাল ট্রেন চলাচল করবে। সায়ন অবশ্য এ সব জানে না। সে কমলবাবুর নির্দেশ মতো লেভেল ক্রসিং-এর ওপারে না থেকে, এপারেই ছিল। আবার কমলবাবুর শেখানো কথাই ফোন করে বলল বাবাকে, আমাকে ধরার জন্য পুলিশ তোমাকে ফলো করছে। আমার জন্য যা এনেছো, ড্যাশবোর্ডে রেখে হেঁটে লাইন পেরিয়ে যাও। তারপর সিচুয়েশন কী দাঁড়ায় দেখে, আবার ফোন করব।

ফোন যে এসেছিল, তার সাক্ষী নন্দ এবং ডাক্তারবাবুর কললিস্টেও পাওয়া যাবে। ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে নেমে যেতেই নকল দাড়ি এবং হাতে খেলনা বন্দুক নিয়ে সায়ন ফাইলটা ছিনতাই করে। দাড়ি, বন্দুক সাপ্লাই দিয়েছিলেন কমলবাবু। সায়নকে বুঝিয়ে ছিলেন, তোমার আসল চেহারা ড্রাইভার যদি দেখে নেয়, পুলিশ ওর বর্ণনা শুনে স্কেচ আঁকাবে। বুঝে যাবে তুমি সেই ফেরার আসামি। তোমাকে খোঁজার জন্য আবার উঠে পড়ে লাগবে পুলিশ। আবার তুমি যদি বাবার হাত থেকে জিনিসটা নিতে যাও, অলকেশ তোমায় জোর করতে পারে পুলিশে স্যারেন্ডার করার জন্য। তাই ও সব ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। ফর্মূলা যখন হাতের কাছে, সেটা ছিনিয়ে নাও।

নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে সায়ন অকুস্থল ছেড়ে পালায়। কমলবাবু ততক্ষণে রেল গেটের ওপারে যে কেবিন আছে, তার সিঁড়িতে উঠে দেখছেন কোন ট্রেনের মুখে পড়েন ডা. রায়। আপ লক্ষ্মীকান্তপুর এসে পড়েছিল, জাল নাম্বারটা থেকে ফোন করেন ডা. রায়কে। ডাক্তারবাবু ভেবেছিলেন হয়তো সায়নের ফোন, সেট বার করতে যান। অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে যায় ।

—আমার একটা প্রশ্ন আছে। বলে উঠলেন বাবা। ঝিনুক আশ্চর্য হয়, এখন আবার বাবার কী প্রশ্ন ! বাবা বললেন, ফর্মুলা যখন হাতানোই হয়ে গেল, তখন ডা. রায়কে কেন মারতে গেলেন কমলবাবু?

– -ফর্মুলা লেখা কাগজটা হাতিয়েছেন, ডা. রায়ের মাথা থেকে তো ওষুধ বানানোর প্রক্রিয়াটা মুছতে পারেননি। কমলবাবু যখন ওষুধ বাজারে আনতেন, ডা. রায় ক্ষুব্ধ হতেন কোনও কম্পিটিটর রাখতে না চাওয়ার জন্যই ডা. রায়কে মেরে দিলেন। বললেন দীপকাকু।

কমলবাবু বলে ওঠেন, আমি যে কেবিনের সিঁড়িতে উঠে ফোন করেছিলাম, তার কোনও প্রমাণ আছে?

—আছে। কেবিন থেকে খানিক দূরে রাস্তায় একটা ইলেকট্রিক্যাল গুড্স-এর দোকান আছে তার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যাচ্ছে আপনি সিঁড়িতে উঠছেন ওই সময়। এছাড়াও আপনি যখন ফোন কছিলেন, কেবিনম্যান সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আপনাকে চার্জ করেন, কেন উঠেছেন সিঁড়িতে? আপনি বলেন আপনার পেশেন্ট অ্যাম্বুলেন্সে ওপারে আটকে আছে। গেট যাতে তাড়াতাড়ি খোলা হয়, সেটা বলতে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে তখন ওপারে কোনও অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। কোর্টে কেবিনম্যান সাক্ষী দিতে আসবেন। তাঁকে আপনার ছবি আমি দেখিয়েছি। যে ছবি আপনার বইয়ের ব্লাবে ছিল। তিনি আপনাকে চিনেছেন।

এতক্ষণে কাঁধ ঝুলে গেল কমল বিশ্বাসের। তবুও মরিয়া স্বরে দীপকাকুর উদ্দেশে বলে উঠলেন, আপনি যে এত কথা বললেন, কোর্টে এর কোনও দাম নেই। যার কথার দাম আছে, সে তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

-সায়ন পালিয়ে বেড়াচ্ছে না। সে আছে পুলিশের হেফাজতে। আমার নির্দেশে সে ফোনে আপনাকে বলেছে পালিয়ে গিয়েছে। ব্যবস্থাটা এইজন্য করেছি, যাতে আপনি না পালান।

দীপকাকুর দিকে বিপুল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কমল বিশ্বাস। দীপকাকু ফের বললেন, একটা ব্যাপারে সায়ন আপনাকে টেক্কা দিয়েছে। ছিনতাইয়ের দিনই ফাইল আপনার হাতে তুলে দেওয়ার আগে, কর্মূলার ফটো কপি করে নিয়েছিল। টাকাটাও নিয়েছে আপনার থেকে। অর্থাৎ আপনি যে ভাবছিলেন ফর্মুলা যেন কারুর কাছে না থাকে, মোনোপলি বিজনেস করবেন, তা আর হবে না।

কথা চলার ফাঁকে কখন যে অফিসার সাহা উঠে গিয়েছেন সদর দরজা খুলতে, খেয়াল করেনি ঝিনুক। উনি ফিরছেন, পিছনে প্রায় ন্যাড়া মাথার সায়ন রায়। তাঁর দু’পাশে দু’জন কনস্টেবল। অফিসার সাহা কমল বিশ্বাসকে দেখিয়ে এক কনস্টেবলকে বললেন, এঁকে অ্যারেস্ট করো।

দীপকাকু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখাদেখি ঝিনুকসত বাকিরাও ছাড়লেন চেয়ার। দীপকাকু সমরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে একটা অনুরোধ। সায়নের নামে ইচ্ছাকৃত খুনের মামলাটা তুলে নিন। আপনিও জানেন ও ইচ্ছে করে ভাইকে বাইকের ধাক্কা মারেনি। বেপরোয়া গাড়ি চালানোটা ছিল ওর শেষ। অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা হোক। অল্প ক’বছর জেল খেটে ফিরে আসবে। বেচারা এখন খুবই অনুতপ্ত, নিজের জীবনকে অভিশপ্ত মনে করছে। ওর কারণে ভাই মারা গেল এবং বাবাকেও চলে যেতে হল। পৃথিবী ছেড়ে। সায়নের গুরুজন বলতে এখন আপনারাই।

– আপনার কথাই থাকবে। সদ্য দাদাকে হারিয়েছি। আমি চাইব দাদার প্রতিনিধি হিসেবে ও বাড়ি ফিরে আসুক। অনিচ্ছাকৃত খুনের জন্য ক’বছরের জেল তো ওকে খাটতেই হবে। ওখানে আমার কিছু করার নেই। ওটা পুলিশের কেস। বললেন সমরেশবাবু। দীপকাকু ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে দরজার দিকে ঘুরতে যাচ্ছিলেন, ডা. রায়ের ছোটভাই কমলেশবাবু বললেন, এক মিনিট।

দাঁড়িয়ে পড়লেন দীপকাকু। কমলেশবাবু পরের কথাটা বলেন, আপনি আমাদের পরিবারের জন্য এত করলেন, আপনাকে তো অবশ্যই এ বাড়ির পক্ষ থেকে সম্মান দক্ষিণা দেওয়া উচিত।

মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে দীপকাকু বললেন, এই কেসটা এত কঠিন ছিল, আমি যেন নিজের সঙ্গে নিজেই লড়ছিলাম। এখন সাফল্যটাই আমার ফিজ।

–না, আপনার ফিজ্ আমি দেব। বাবা আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন, ছেলে হিসেবে সেই ফিজ্ মেটানো আমার কর্তব্য। বললেন সায়ন ।

দীপকাকু বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। আপাতত আমি গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাচ্ছি দাদা-ভাইঝির সঙ্গে। কেসটার জটিলতায় এতদিন একটা দমবন্ধ অবস্থায় কাটিয়েছি।

সদর লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছেন দীপকাকু, উনি এমনিতে শর্ট হাইটের। ঝিনুকের আজ কেন জানি ওঁকে অনেকটাই লম্বা মনে হচ্ছে। অনেকের থেকেই হাইট বেশি।

***