আড়ালে আততায়ী – ৭

৷৷ সাত ।।

পরের দিন সকাল আটটা। চেতলার শঙ্কর বোস রোডে ডা. অলকেশ রায়ের বন্ধু কমল বিশ্বাসের বাড়ির সামনে ঝিনুকরা। দোতালা বাড়ি, খুব পুরনো নয়। মোটর বাইক রেখে দীপকাকু এগিয়ে গিয়ে গ্রিলের গেটটা খুললেন। ঝিনুক আছে পিছনে। বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে দীপকাকু একবার উপর দিকে তাকালেন। কী দেখলেন আন্দাজ করতে পারছে ঝিনুক, দেখে নিলেন ছাদের পাঁচিলে টবসুদ্ধ গাছ আছে কি না। আগের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটা ভুলতে পারেননি।

দরজার বেল টিপেছেন দীপকাকু। একটু পরেই খুলে গেল দরজা। সাদামাটা চেহারার মলিন পোশাকের একজন বয়স্ক মানুষ। খুব সম্ভবত এ বাড়ির কাজের লোক। দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

—কমলবাবুকে। বলো দীপঙ্কর বাগচী এসেছে। ফোনে কথা হয়ে আছে ওঁর সঙ্গে। বললেন দীপকাকু।

লোকটি বলল, আসুন। ভিতরে এসে বসুন। বাবু ছাদে হাঁটতে গেছেন। ডেকে দিচ্ছি।

ঘরে ঢুকে ঝিনুক তো থ! বাইরে থেকে বোঝা যায়নি এ বাড়ির এত বড় ড্রয়িং রুম আর তেমনি সাজানো! কী সব ফার্নিচার! সবই পুরনো আমলের। অথচ ঝকঝক করছে।

সোফায় এসে বসেছে ঝিনুকরা। এটাও রীতিমতো অ্যান্টিক। দীপকাকু চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন, এঁদের রুচি আছে বলতে হবে।

কমল বিশ্বাসের কাছে দীপকাকু এসেছেন কেসের কিছু জট কাটাতে। অনেক আগেই হয়তো আসা উচিত ছিল। কমল বিশ্বাস ছিলেন ডা. রায়ের সবচেয়ে কাছের লোক। ডাক্তারবাবুর অনেক পার্সোনাল কথা নিশ্চয়ই জানেন।

ভিতর ঘরের দরজার ভারী পর্দাটা সরে গেল। মেদহীন লম্বা চেহারার যে মানুষটি ঘরে এলেন, নিশ্চয়ই কমল বিশ্বাস। পরনে ট্যাকাটের লোয়ার আর টি শার্ট। জোড়হাতে নমস্কারের ভঙ্গি বললেন, বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

প্রতি নমস্কার জানিয়ে দীপকাকু বললেন, না না, কোনও অসুবিধে হয়নি।

সিঙ্গল সোফায় দীপকাকুর মুখোমুখি বসলেন কমলবাবু। বললেন, আপনাকে কী ধরনের হেল্প করতে পারি?

ফোনে আপনাকে তো বলেছি আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। ডাক্তারবাবু আমাকে একটা কাজে নিয়োগ করেছিলেন। আপনাকে কি বলেছিলেন সে কথা ?

—না, বলেনি। খুবই চাপা স্বভাবের মানুষ ছিল। তবে ও যে কোনও গোয়েন্দার দ্বারস্থ হবে, সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। -কী করে?

— হসপিটালে ছেলের সঙ্গে ওর দেখা হওয়ার ঘটনাটা আপনাকে তো অলকেশ বলেইছে। সায়ন বেঁচে আছে এবং কলকাতায় দেখা গিয়েছে, এরপর তো ও ছেলেকে খোঁজার জন্য জোর দেবেই। পুলিশকে বলে খোঁজাতে পারবে না। যেহেতু সায়ন ফেরার আসামি। . আর আপনি যতই পুলিশের লোক হওয়ার ভান করে তদন্ত করুন না কেন, ধরা পড়ে যাচ্ছেন আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টটির জন্য। এত অল্প বয়সে, সম্ভবত ওর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি, এখনই এই চাকরিটা ভর পাওয়ার কথা নয়।

–ঠিকই, এই কেসে এটা আমার একটা দুর্বল দিক। মেনে নিলেন দীপকাকু।

আগের কথার জের টেনেই কমলবাবু বললেন, আপনার উপর যে অ্যাটাকটা হল, সেটাও এই কারণে। পুলিশকে মারার সাহস সহজে কেউ করে না। কড়া তদন্তের মুখে পড়তে হয়।

নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে ঝিনুকের। তার জন্যই দীপকাকুর মৃত্যু সংশয় দেখা দিয়েছিল। দীপকাকু অবশ্য পয়েন্টটাকে গুরুত্ব দিলেন না। কমলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ঘটনাটা কী করে জানলেন ?

– -অলকেশের ভাইরা বলেছে। ওরা তো আমাকে ওদের ফ্যামিলির লোকই মনে করে।

-কে আমার উপর টবটা ফেলতে গিয়েছিল, এ ব্যাপারে কী বলছেন ওঁরা।

—ওরা আপনাকে যা বলেছে, আমাকেও তাই। বিড়াল, হনুমান অথবা পাখিদের কাজ। ছাদের খিল তো লাগানোই ছিল। কে যাবে উপরে?

দীপকাকু মোবাইল সেট বার করে ফেলেছেন। হুমকির এস এম এসটা স্ক্রিনে এনে মোবাইলটা দিলেন কমলবাবুর হাতে। মেসেজটা পড়ে কমলবাবু উঠলেন, ওরেঃ বাবা! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার!

এরপর কপাল কুঁচকে এস এম এসটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগলেন কমলবাবু। ভাবনা শেষ করে বললেন, এমন নয়তো, টবটা পড়ার পর কেউ ওটাকে হুমকি হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। লোকটা ঘটনার কাছাকাছি ছিল। এই নাম্বারে ফোন করে লোকটাকে ট্রেস করার চেষ্টা করেছেন?

—করেছি। সিমকার্ডটা জাল। আচ্ছা, একটা আন্দাজ দিন তো, আমি যে ডাক্তারবাবুর মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছি, এতে কার স্বার্থে ঘা লাগছে? -এর উত্তর তো খুব সোজা। যে অলকেশকে খুন করেছে। যদিও অলকেশকে ধাক্কা মেরে ট্রেনের নীচে ফেলে দেওয়াটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অলকেশের বোন শ্রাবণী সম্ভবত বানিয়ে বলছে ওটা। বড়দার টাকাকড়ি যাতে অন্য দুই দাদা হাতাতে না পারে তার জন্য বাড়িতে পুলিশ ঢুকিয়ে দিয়েছে।

শ্রাবণী দেবীর বদনাম শুনতে খারাপ লাগে ঝিনুকের। বাড়িতে পুলিশ ঢোকানোর প্ল্যানটা দীপকাকুই দিয়েছেন ওঁকে। দীপকাকু এখন বললেন, তথাটা বানানো নয়। যে দেখেছে ডা. রায় কে ধাক্কা মারা হয়েছে, তাকে জেরা করছি আমরা। মনে হয়নি মিথ্যে বলছে।

মিথ্যে এখন দীপকাকু বললেন। কী অবলীলায়! কমলবान বলেন, এরপর আমার আর কী বলার থাকতে পারে। অপরাধ যখন ঘটেছে, অপরাধীকে ধরা গোয়েন্দা, মানে আপনার কাজ।

ঝিনুকদের জন্য চা-স্ন্যাক্স এসে গেল। যে লোকটি দরজা খুলে দিয়েছিল, নিয়ে এল সে।

কমলবাবু বললেন, নিন। চা-টা খেয়ে নিন। চা ঝিনুক খায় না। কেউ না জিজ্ঞেস করে এনে দিলে, ইদানীং খেয়ে নেয়। কাউকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে চায় না। পেস্ট্রিতে কামড় দিয়ে চায়ের কাপ তুলে নিলেন দীপকাকু। বললেন, আপনি তো ডা. রায়ের খুব কাছের লোক ছিলেন। ওঁর কোনও শত্রু ছিল কি?

– – অলকেশের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল, ছেলেকে নিয়ে চিন্তা। এর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর চিন্তা আরও বেড়ে ছিল। খালি বলত, ছেলেটার কী হবে! কোথায় পড়ে আছে, কী খাচ্ছে, আদৌ বেঁচে আছে তো… এই সব ভাবনাতে কাহিল থাকত। এই টেনশন থেকেই শরীর খারাপ হল। ভর্তি করতে হল নার্সিংহোমে।

– হ্যাঁ, শুনেছি। আপনিই অ্যাডমিট করেন।

শুধু অ্যাডমিট করানো নয়, সেই রাতটা আমি নার্সিংহোমে ছিলাম। ওর বাড়ির কেউ ছিল না। এটুকু তো আমায় করতেই হবে। ও আমার কতদিনের বন্ধু!

– কতদিনের? চা খেতে খেতে জানতে চাইলেন দীপকাক স্ন্যাক্স প্রায় একাই খেলেন। ঝিনুক নিয়েছে অল্প।

কমলবাবু বলছেন, ও আমার স্কুলবেলার বন্ধু। কলেজেও একসঙ্গে পড়ার ইচ্ছে ছিল, আমার বাবা সে সুযোগ দিলেন না। কমার্স নিয়ে পড়তে পাঠালেন। যেহেতু বাবার বিজনেস ছিল। পরে যার হাল ধরতে হবে আমাকে।

– আপনি এখন কি বাবার বিজনেসটাই করছেন? – হ্যাঁ ।

– কিসের বিজনেস ?

—ফার্নিচারের। কাঠের ফার্নিচার। শোরুম ভবানীপুরে। দোকানের নাম ‘বিশ্বাস ফার্নিচার’।

উত্তর শুনে চুপ করে আছেন দীপকাকু। কী যেন ভাবছেন। একটু পরে বলে উঠলেন, আপনার বন্ধু হোমিওপ্যাথি পড়তে গেলেন কেন? কার উৎসাহে ?

—উৎসাহটা পেয়েছিল ওর বাবার বন্ধুকে দেখে। ডাক্তার জীবন দত্ত। বসতেন খিদিরপুরে। সার্থক নামের লোক মশাই, কত লোকের যে জীবন দান করেছে! অ্যালোপ্যাথি ফেল মেরে গেলে লোকে ওঁর কাছে আসত। অলকেশ কলেজ থেকে বেরনোর পর অনেক দিন ওঁর আন্ডারে কাজ করেছে।

—ডা. রায় ওষুধের যে কোড নেম ব্যবহার করতেন, সেটা নিশ্চয়ই ডাক্তার জীবন দত্তর কোড, তাই না?

—একদম ঠিক ধরেছেন। ও এমন কোড, কেউ এখনও অবধি ব্রেক করতে পারেনি।

শেষ কথাটা দীপকাকু শুনলেন কিনা সন্দেহ আছে। খুবই অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাঁকে। সারা ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন, আপনি সম্ভবত পুরনো ফার্নিচারের বিজনেস করেন। ঘরে এত অ্যান্টিক ফার্নিচার!

– পুরনো ফার্নিচারের বিজনেস করি বটে, তবে এটা আমার শখও বলতে পারেন। ভবানীপুরের শোরুমে নতুন ফার্নিচারই বেশি। ছেলে দেখাশোনা করে দোকানটা। আমি পুরনো ফার্নিচার কেনাবেচা নিয়ে আছি।

-আপনারা কটি সন্তান ?

—দুটি। একটি ছেলে, ছোটটি মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে নিয়ে ঘরের এক কোনে একটা ফার্নিচারের দিকে আঙুল নির্দেশ করে দীপকাকু বললেন, ওই ক্যাবিনেটটা কিন্তু বেমানান। মানে এই ঘরের সাজসজ্জার নিরিখে।

– –কেন? কী দেখে এই কথা বলছেন? বাড়তি কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন কমল বিশ্বাস।

দীপকাকু বললেন, আপনার এ ঘরে ওই একটি বাদে সব ফার্নিচারই ব্রিটিশ স্টাইলের। অ্যান্টিক ব্রিটিশ ফার্নিচার। ওই ক্যাবিনেটটাই শুধু ফ্রেঞ্চ স্টাইল। ওটাও অ্যান্টিক।

—ওরে বাবা! আপনি তো দেখছি ফার্নিচারের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই বিষয়ে চর্চাও আছে মনে হচ্ছে। প্রশংসার কণ্ঠে বললেন কমলবাবু।

ঝিনুক জানে দীপকাকুর পড়াশোনার রেঞ্জ কতটা! বহুবার প্রমাণ পেয়েছে। প্রশংসিত হয়ে দীপকাকু একটু যেন লজ্জা পেলেন। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ফ্রেঞ্চ ফার্নিচার তো বেশ রেয়ার। চন্দননগর থেকে পেলেন নাকি? ওখানেই তো ফরাসী উপনিবেশ ছিল। বেশিদিন হয়নি কালেকশন করেছেন। সদ্য পালিশ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।

—হ্যাঁ, আন্দাজ আপনি ভালই করেছেন। চন্দননগর, মানকুণ্ডু থেকে আগে আমি অনেক ফ্রেঞ্চ অ্যান্টিক ফার্নিচার পেয়েছি। তবে এটা আমি পেলাম নৈহাটির এক জমিদার বাড়ি থেকে। মাস দুয়েক হল। চন্দননগর, চুঁচুড়ার ওপারেই তো নৈহাটি, গঙ্গা পেরিয়ে ফার্নিচারটা জোগাড় করতে অসুবিধে হয়নি জমিদারবাবুর। ও বাড়িতে আরও কিছু ফ্রেঞ্চ ফার্নিচার আছে। এখনকার মালিক বিশাল দাম হাঁকছে। বলে থামলেন কমলবাবু। কী একটু ভেবে নিয়ে সংকোচের সঙ্গে বললেন, এই সব অ্যান্টিক ফার্নিচার নিয়ে আমি একটা বই লিখেছি। আপনি সমঝদার মানুষ। বইটা দিতে ইচ্ছে করছে।

–আরেঃ, এ তো আমার সৌভাগ্য। খুশির গলায় বললেন দীপকাকু ।

কমল বিশ্বাস বলেন, বইটা আছে স্টাডিতে। দাঁড়ান এনে দিচ্ছি। -চলুন না, আমরাও যাই আপনার পড়ার ঘরে। সেখানে নিশ্চয়ই আরও কিছু ফার্নিচার দেখতে পাব ।

দীপকাকুর আবদারে ‘না’ বললেন না কমলবাবু। বললেন, আসুন।

স্টাডি একতলাতেই। এখানেও অনেক অ্যান্টিক ফার্নিচার কোনটা কোন আমলের ঝিনুকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। দীপকাকু ফার্নিচারগুলোর উপর চোখ বোলাচ্ছেন। এ ঘরে তাক ভর্তি অনেক বইও আছে। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোকের লেখাপড়ার প্রতি বেশ ঝোঁক আছে। তা না থাকলে বই লিখবেন কেন? র‍্যাক থেকে নিজের বই বার করলেন কমলবাবু। দীপকাকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, পড়বেন কিন্তু, ফিডব্যাক দেবেন।

বইটা হাতে নিলেন দীপকাকু। পাশ থেকে ঝিনুক দেখল বইটার নাম, ভারতের পুরনো আসবাব।

দীপকাকু বইটা কমলবাবুকে ফেরত দিয়ে বললেন, এটাতে আমার অ্যাসিস্ট্যান্টের নাম লিখে সই করে দিন। বন্ধুদের দেখাতে পারবে। লেখক সই করে বই দিয়েছেন, এটা ওদের বয়সে খুবই গর্বের ব্যাপার।

টেবিলে থেকে পেন নিয়ে এসে কমলবাবু ঝিনুককে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম।

—আঁখি সেন। বলল ঝিনুক।

খুশি মুখে সই দিতে দিতে কমলবাবু বললেন, আমার তো এই একটাই বই। সই দেওয়াটা আমার কাছেও বেশ গর্বের ব্যাপার। বইটা ঝিনুকের হাতে দিলেন কমলবাবু। ঝিনুক ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলল। দীপকাকু বললেন, আমরা তা হলে এখন আসি? —চলুন, আপনাদের এগিয়ে দিই। বললেন কমল বিশ্বাস।