আড়ালে আততায়ী – ৬

৷৷ ছয় ৷৷

কলকাতায় সবে আলো ফুটছে। ঝিনুক, দীপকাকু এখন ওয়াটগঞ্জের ফুটপাতে উবু হয়ে বসে। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ফিট বিশেক। উল্টো ফুটপাতের গায়ে ডা. রায়ের ড্রাইভার নন্দ গড়াইয়ের বাড়ি। নন্দ গড়াইকে ধরার পরিকল্পনা নিয়ে ঝিনুকরা ওঁত পেতে আছে। ঝিনুকরা ফুটপাতে থাকলেও, আসলে মিশে আছে একটা রুটি তৈরির দোকানে। এরা হিন্দিভাষী। ভোর থেকেই গোটা পরিবার মিলে ফুটপাতে উনুন জ্বেলে রুটি, লেট্টি তৈরি করতে বসে যায়। গতকাল দীপকাকু জায়গাটা দেখে গিয়েছেন। তারপর অফিসার সাহাকে ফোনে বলেছেন জি আর পি’র জিপ যেন দীপকাকু-ঝিনুককে ভোররাতে এই দোকানে নামিয়ে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে এই পরিবারটিকে রেলপুলিশ বলবে দীপকাকু-ঝিনুক তাদের লোক । একজনের উপর নজর রাখার জন্য এখানে থাকছে। এদেরকে ফ্যামেলির মেম্বারের মতো সঙ্গে রাখো। এরা যে পুলিশের লোক বাইরের কেউ যেন না জানে।

পুলিশের নির্দেশ সাধারণ মানুষ মান্য করে। এরাও করছে। আপন করে নিয়েছে ঝিনুকদের। এদের সঙ্গে মিশে থাকার জন্য ঝিনুক-দীপকাকুকে ছদ্মবেশ নিতে হয়েছে। ঝিনুক পরে আছে রংচটা সালোয়ার-কামিজ, পায়ে প্লাস্টিকের চটি। দীপকাকুর পরনে সাত পুরনো পাজামা, শার্ট আর হাওয়াই চটি। আজ এই পোশাকেই বাইক চালিয়ে রাত তিনটের সময় ঝিনুকদের বাড়ি এসেছিলেন দীপকাকু। আসবেন বলে রেখেছিলেন বলে চিনতে অসুবিধে হয়নি। নয়তো এরকম নিখুঁত ছদ্মবেশে ওঁকে চেনা অসম্ভব ছিল। ঝিনুকের এই ড্রেস দীপকাকুই এনেছিলেন সঙ্গে করে। বলেছিলেন, এগুলো পরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। জি আর পি’র গাড়ি আসার টাইম হয়ে গেল।

এত সব আয়োজন দেখে বাবা দীপকাকুকে বললেন, আমার গাড়িটা নিয়ে গেলেই তো পারতে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে ওতেই। নন্দ গড়াই বাড়িতে ঢুকতে গেলেই গিয়ে ধরতে।

উত্তরে দীপকাকুর যুক্তি ছিল, নন্দ গড়াইয়ের বাড়ির রাস্তাটা সরু। বড়গাড়ি ঢুকে এলে আমাদের গাড়ি সরাতে হবে। সেটা যদি নন্দ বাড়ি ঢোকার সময় ঘটে। ওকে খেয়ালই করতে পারব না। ত ছাড়া বাড়ি ঢোকার আগে নন্দ গড়াই পাড়ার পরিস্থিতিটা নিরাপদ কিনা বুঝে নেবে। সেখানে বাড়ির উল্টো দিকে অচেনা গাড়ি দেখলো সন্দেহ হবে ওর।…এই ছদ্মবেশের প্ল্যানটাও সেই কারণে, ঝিনুকদের যাতে বেপাড়ার না মনে হয়।

নন্দ গড়াই আজ তার বাড়ি আসতে পারে, এই সম্ভাবনাটা দীপকাকু বার করেছেন বেশ অদ্ভুত কায়দায়। গত পরশুর আগের দিন ডা. রায়ের বাড়ির ছাদ থেকে টব ফেলে দীপকাকুকে যখন থ্রেটেন করা হল, ঝিনুকদের বাড়ি এসে দীপকাকু বলেছিলেন- আমাদের এখন প্রধান কাজ নন্দ গড়াইকে খুঁজে বার করা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ওর থেকেই পাওয়া যাবে। যেগুলো গোপন করে নন্দ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

– -কী করে খুঁজে পাবে? সে তো ফোন অফ করে রেখেছে। বলেছিলেন বাবা।

দীপকাকু বাবার কথার উত্তর না দিয়ে ঝিনুকের দিকে নিজের অ্যান্ডড্রয়েড ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, দেখো তো নন্দ গড়াইয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে কি না। তাপস কুণ্ডুর ফ্রেন্ডস থেকে ওকে খুঁজবে। তাপসকে সহজে পেয়ে যাবে। ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অ্যাকসেপ্ট করতে বলেছিলাম। করেছে।

বেশিদিন হয়নি দীপকাকু ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তবে তাতে প্রকৃত দীপকাকুকে পাওয়া যাবে না। কভার ফটো নেই। ডি পি-টা একটা হরিণের মুখের। অ্যাবায়ুটে শুধু সেলফ এমপ্লয়েড লেখা। অ্যাকাউন্টটা তদন্তের কাজে ব্যবহার করার জন্য করেছেন।

নন্দ গড়াইয়ের প্রোফাইল পাওয়া গিয়েছিল। দীপকাকুর আন্দাজ মতো ঝিনুক বার করেছিল একটা দারুন ব্যাপার, তিনদিন বাদেই নন্দ গড়াইয়ের জন্মদিন। গত বছরের জন্মদিনের বেশ কিছু ফটো আছে নন্দ গড়াইয়ের প্রোফাইলে। বাবা-মা-কে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। বাড়ির মেঝেতে সাজিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে নন্দ গড়াইকে। দীপকাকুকে ফোনটা দিয়ে ফটোগুলো দেখতে বলেছিল ঝিনুক। উনি প্রোফাইল থেকে আরও একটা ফটো বার করলেন। যেটা সম্প্রতি পোস্ট করেছে নন্দ গড়াই। ছবিটা তার নিজের। একটা গাড়ি সারানোর গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফটোটা বাবা আর ঝিনুককে দেখিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, লোকটা এত বোকা, ভেবেছে এই ফটোতে বোঝা যাবে না ও কোথায় আছে। আরে বাবা, তোমার পিছনে যে ক’টা গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখা যাচ্ছে, সবই ওয়েস্ট বেঙ্গলের। পশ্চিমবঙ্গেই গা ঢাকা দিয়ে আছে নন্দ গড়াই। খুব সম্ভাবনা আছে জন্মদিনে একবার বাড়িতে আসার।

তখনই দীপকাকু সিদ্ধান্ত নেন আজ নন্দ গড়াইকে ধরার চেষ্টা করা হবে। এরপর ঝিনুক সেই কৌতূহলটা মেটানোর জন্য দীপকাকুকে বলেছিল, ডাক্তারবাবুর ফাইলের যে কাগজটা আপনি পকেটে পুরলেন, ওটাতে কী সূত্র আছে?

–হয়তো অনেক কিছু আছে অথবা ব্লুটা কোনও কাজে লাগবে না। যাচাই না করা অবধি বলা কঠিন। উত্তর দিয়েছিলেন দীপকাকু। আসলে বুঝিয়েছিলেন ব্যাপারটা এখনই ভাঙতে চান না।

সে যাই হোক, পরিস্থিতি আপাতত যা দাঁড়িয়েছে, বাবা তো বটেই, অফিসার সাহাও দীপকাকুকে জানিয়েছে যে, ডা. রায়ের মৃত্যুর পিছনে ষড়যন্ত্র হয়েছে, এই অনুমান আপনার একেবারে অব্যর্থ। নয়তো দীপকাকুকে ওরকম মারাত্মক হুমকি দেওয়া হত না। ঘাতক সেই ফোন নাম্বারটাও সচল হত না নতুন করে। ওই নাম্বারটাই ডাক্তারবাবুকে রেললাইনের উপর অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল।

মাঝের দু’দিন এই কেসটা নিয়ে দীপকাকু কী কী কাজ করেছেন, ঝিনুক জানে না। একটা তথ্যই শুধু দিয়েছেন, হার্ট অ্যাটাকের জনা যে নার্সিংহোমে অ্যাডমিটেড হয়েছিলেন ডা. রায়, সী সেখানে গিয়েছিলেন। রিপোর্ট নিয়েছেন ডাক্তারবাবুর তখনকার অবস্থার। তাতে যা দেখা যাচ্ছে, হার্টে কোনও ব্লক ছিল না ডা. রায়ের। ব্লাডপ্রেশার ছিল হাই আর হার্ট অ্যাটাকের সমস্ত লক্ষণই ছিল। নার্সিংহোমের ডাক্তাররা মনে করছেন, যে কোনও কারণেই হোক, কিছুক্ষণের জন্য ডা. রায়ের হার্টের ধমনী ব্লকড় হয়েছিল।

বাবা কিন্তু এই কেসের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে দীপকাকু যেদিন ঝিনুককে বাড়ি দিতে এলেন, ঘটনাটা শুনে বাবা বললেন, আততায়ী তার মানে ও বাড়িতেই আছে। টবটা যখন পড়ল ও বাড়ির ছাদ থেকে।

দীপকাকু বলেছিলেন, পাশের বাড়ির ছাদ থেকেও আততায়ী চলে আসতে পারে। ডান পাশের বাড়িটা ডা. রায়ের বাড়ির একেবারে গা লাগোয়া। আবার এমনও হতে পারে যে টবটা ফেলেছে, সে আসল অপরাধী নয়। মূল অপরাধী তাকে দিয়ে ফেলিয়েছে। মেন কালপ্রিট ডাক্তারবাবুর দুই ভাই কিংবা বাইরের যে কেউ হতে পারে। অর্ডার দিয়ে ফেলানো হয়েছে টবটা।… এসব ভাবতে ভাবতে ঝিনুকের চোখ বারে বারে চলে যাচ্ছে লিট্টি বানানোর দিকে। খাবারটার নাম শুনেছে আগে, বানাতে দেখছে প্রথমবার। মিষ্টির দোকানের খাস্তা কচুরির মতো দেখতে। তেলে বা ঘিয়ে ভাজছে না এরা। জ্বলন্ত উনুনের উপর তারের জাল রেখে সেঁকছে। দীপকাকু দূরে উবু হয়ে বসে থাকা দীপকাকুকে হঠাৎ উঠে আসতে দেখা গেল। ঝিনুক সচকিত হয়ে তার উল্টো ফুটপাতে নন্দ গড়াইয়ের বাড়ির দিকে তাকাল। না, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দীপকাকু ঝিনুকের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে?

সত্যিই খিদে পেয়েছে ঝিনুকের। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠেছে বলেই হয়তো। দীপকাকু উত্তরের প্রত্যাশা না করে লিটি বানাচ্ছেন যে মহিলা, তার কাছে পৌঁছে গেলেন। দুটো কেটে একটা করে লিটি নিয়ে এসে বসলেন ঝিনুকের পাশে। একটা প্লেট ঝিনুককে দিয়ে বললেন, খাও। আগে তো কখনও খাওনি। দারুণ টেস্ট !

লিট্টির সঙ্গে আচার দেওয়া হয়েছে। ঝিনুক গরম লিট্টিতে আচার মাখিয়ে কামড় দিল। সত্যিই অপূর্ব খেতে! মাকে বানাতে বলতে হবে। বানানোটা দেখে নিয়েছে ঝিনুক। দ্বিতীয় কামড় মারতে যাবে, দীপকাকু প্লেট ফুটপাতে রেখে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। ব্ললেন, ওই মনে হয় আসছে।

ফুটপাত ক্রস করছেন দীপকাকু। ঝিনুকও চলল। তাড়াহুড়ো করছেন না দীপকাকু, ঢিমে তালে এগোচ্ছেন। তাড়াহুড়ো করলে পাখি পালাবে। বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে রাস্তার চারপাশটা ভাল করে দেখে নিচ্ছে নন্দ গড়াই। ফেসবুকের ফটো দেখেছিল বলেই ঝিনুক নন্দ গড়াইকে চিনতে পারছে। নন্দ গড়াইয়ের সামনে নিয়ে দাঁড়ালেন দীপকাকু। ঝিনুক দশ ফুট দূরত্ব থেকে স্পষ্ট শুনল দীপকাকু ওকে বলছেন, হ্যাপি বার্থ ডে নন্দ গড়াই।

চমকে দীপকাকুর দিকে তাকাল নন্দ গড়াই। তারপর যেটা করল, দীপকাকু তার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না। সজোরে দীপকাকুকে ধাক্কা মেরে নন্দ গড়াই দৌড়োতে লাগল। দীপকাকু পড়ে গেছেন মাটিতে। ঝিনুক দেরি না করে নন্দ গড়াইকে ধরতে দৌড়চ্ছে। ধরে ফেলতে পারবে বলেই মনে হচ্ছে। প্র্যাকটিসে আছে এখন। লোকটা কাছাকাছি পৌঁছতেই ঝিনুক তার ক্যারাটে শিক্ষা প্রয়োগ করে। স্পট জাম্পে ডান পাটা ছুঁড়ে দেয় নন্দ গড়াইয়ের কোমর লক্ষ্য করে। ফুটপাতে ছিটকে পড়ল নন্দ গড়াই। ঝিনুকও পড়েছে। নন্দ গড়াই উঠে দাঁড়ানোর আগেই দীপকাকু এসে ওর এক হাত মুচড়ে মাটিতে ঠেসে ধরলেন। পিস্তল বার করেছেন দীপকাকু, সেটা গড়াইয়ের মাথায় ঠেকিয়ে ঝিনুককে বললেন, ট্যাক্সি ডাকো।

ট্যাক্সিতে নন্দ গড়াইকে নিয়ে শিয়ালদার জি আর পি থানায় আসা হয়েছে। থানা চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা। দীপকাকু অফিসার সাহাকে ফোনে বলে দিয়েছিলেন, আপনি নিজের টেবিলে থাকুন। আমরা নন্দ গড়াইকে নিয়ে আসছি।

মি. সাহা সিটে বসে অপেক্ষা করছিলেন ঝিনুকদের জন্য। এই মুহূর্তে জেরা চলছে। দীপকাকু নন্দ গড়াইকে জিজ্ঞেস করছেন, তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেন?

নন্দ গড়াই বলছে, ডাক্তারবাবু যখন ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেলেন, তার একটু আগেই আমরা কাঁকুলিয়া ক্রসিং-এর কাছে পৌঁছেছিলাম। গেট ফেলা ছিল। ডাক্তারবাবুর ফোন এল, ফোনের কথা শুনে বললেন, ‘আচ্ছা, আসছি।’ তারপর গাড়ি থেকে নামতে নামতে আমাকে বলে যান, ওপারে একজন দাঁড়িয়ে আছে। করতে যাচ্ছি। গেট খুললে চলে আসিস। ডাক্তারবাবু গিয়েছেন হয়তো এক মিনিটও হয়নি, আমার জানলার পাশে এসে দাঁড়াল একটা ছেলে। রাস্তার লোকের থেকে আড়াল করে পিস্তল তাক করে রেখেছিল আমার দিকে। বলল, ড্যাশবোর্ডে একটা ফাইল আছে, দে।

পিস্তল দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছি। ড্যাশবোর্ড খুলে কালো একটা কভার ফাইল ছেলেটার হাতে দিলাম। ফাইলটা ডাক্তারবাবু কখন রেখেছেন, দেখিনি। ছেলেটার হাতে কী তুলে দিলাম, টাকা না অন্য কোনও দামি জিনিস, বুঝতে পারলাম না।

— ছেলেটা দেখতে কেমন? বয়স কত হবে? জানতে চাইলেন দীপকাকু।

নন্দ গড়াই বলল, আমার বয়সিই হবে। গালে দাড়ি আছে। চোখে সানগ্লাস ছিল।

ঝিনুক আন্দাজ করতে পারছে না নন্দ গড়াইয়ের বয়স কত হবে। তিরিশ হতে পারে, চল্লিশও। দীপকাকু কত ধরলেন, কে জানে! ফের নিজের থেকেই বলা শুরু করল নন্দ গড়াই, ছেলেটা ফাইল নিয়ে চলে যাওয়ার পরই ডাক্তারবাবুকে ফোন করে ঘটনাটা বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ লেভেল ক্রসিং-এর কাছ থেকে হইচই ভেসে এল। তার একটু আগে একটা ট্রেন পাস করেছে। ছাঁৎ করে উঠল বুক! ডাক্তারবাবুর কিছু হল না তো? উনি তো লাইন ক্রস করছিলেন! গাড়ি থেকে বেরিয়ে লেভেল ক্রসিং-এর কাছে গিয়ে দেখি, যা ভাবছিলাম তাই! তখনই ফোন করলাম ডাক্তারবাবুর দুই ভাইকে আর কমলবাবুকে। কমলবাবু হচ্ছেন ডাক্তারবাবুর বন্ধু।

দম নিতে থামল নন্দ গড়াই। ফের বলতে থাকে, ওঁরা এসে পৌঁছনোর আগে একটা বুদ্ধি এল আমার মাথায়। এঁদের বলব না ফাইল ছিনতাইয়ের ঘটনাটা। ডাক্তারবাবুকে বলতেই হত, উনি ফাইলের খোঁজ করতেন। এঁরা হয়তো জানেনই না ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ফাইলটা ছিল। যদি জেনেও থাকে, বলব ডাক্তারবাবু ওটা সঙ্গে নিয়ে রেল লাইন ক্রস করছিলেন। অ্যাক্সিডেন্টের সময় ওটা কোথায় ছিটকে গিয়েছে, কে জানে! আমি যদি ফাইলটা কীভাবে খোয়া গিয়েছে ওঁদের বলি, নাও বিশ্বাস করতে পারেন। ভাবতে পারেন আমি চুরি করেছি ফাইল। ওর ভিতর কত দামি জিনিস ছিল, তা তো জানি না। বিরাট দামি কিছু হলে অহেতুক চুরির দায়ে ধরা পড়ব। জেলও হতে পারে।

আবার থামল নন্দ গড়াই। ওর জল তেষ্টা পেয়েছে আন্দাজ করে অফিসার সাহা টেবিলে রাখা জলের গ্লাসের ঢাকা তুলে এগিয়ে দিলেন।

সত্যি তেষ্টা পেয়েছিল। এক ঢোঁকে গ্লাসের জল শেষ করে নন্দ গড়াই বলতে লাগল, চেপে গেলাম ঘটনাটা। মেজকর্তা আমার মাইনে মিটিয়ে দিলেন। ভাবলাম, এখন কয়েকমাস গা ঢাকা দিয়ে থাকি। দেখি, ফাইলের ব্যাপারে ডাক্তারবাবুর বাড়ির লোকের টনক নড়ে কি না? যদি নড়ে ওঁরা আমায় পুলিশি জেরার মুখে ফেলতে পারে। পুলিশ এড়াতে আমি দেশের বাড়িই চলে যেতাম। সেই সময় বাড়িতে একটা লোক এসে বলল, ডাক্তারবাবু মারা যাওয়ার পর তুমি তো এখনও কোনও গাড়ি ধরোনি। ট্রান্সপোর্টের গাড়ি চালাবে?

কথার মাঝখানে দীপকাকু বলে উঠলেন, তুমি কি লোকটাকে আগে থেকে চিনতে?

–না, চিনতাম না। সে নিশ্চয়ই জানত ডাক্তারবাবুর গাড়ি চালাই আমি। বলে নিয়ে প্রসঙ্গে ফিরল নন্দ গড়াই। বলল, লোকটাকে বললাম ট্রান্সপোর্টের গাড়ি যদি লরি হয়, চালাতে পারব না। দূরেও যেতে পারব না। বাড়ির কাছাকাছি থাকতে হবে। বুড়ো বাবা-মা, বউ-বাচ্চা আছে বাড়িতে। সেটা শুনে লোকটা বলল, দূরে যেতে হবে না। লোকালেই কাজ। লরিও চালাতে হবে না। ম্যাটাডোর চালাবে। ছোট হাতি যেটাকে বলে। রাজি হয়ে গেলাম লোকটার কথায়। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য মানিকতলায় এক কামরার ঘর ভাড়া নিলাম। ফোন থেকে পুরনো সিমকার্ড খুলে ফেলে লাগালাম নতুন সিম। নতুন নাম্বার থেকেই যোগাযোগ রাখতাম বাড়ির সঙ্গে। আপনারা কেউ আমার খোঁজে বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাই না?

কেউ কোনও উত্তর দিল না। ফোন এসেছে নন্দ গড়াইয়ের। প্যান্টের পকেট থেকে সেট বার করে স্ক্রিনে চোখ রাখল। দীপকাকুকে বলল, বউয়ের ফোন। দেরি হচ্ছে বলে খবর নিচ্ছে। আপনারা আমাকে এখন আটকে রাখবেন, না ছেড়ে দেবেন?

ছেড়ে দেব। বললেন দীপকাকু ।

কল রিসিভ করল নন্দ গড়াই। অপর প্রান্তকে বলল, এখনও আবঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মতো দেরি হবে। ছাড়ছি। পরে করছি।

ফোন কেটে পরের প্রশ্নের জন্য রেডি হল নন্দ গড়াই। দীপকাকু জানতে চাইলেন, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নামটা কি, যেখানে এখন চাকরি করছ? কোম্পানিটা কলকাতার কোথায় ?

-ল্যান্সডাউনে স্যার। জয়গুরু ট্রান্সপোর্ট । বলল নন্দ গড়াই। দীপকাকু বললেন, ঠিক আছে, এবার তুমি আসতে পারো। পুরনো সিমটা ভরে নেবে ফোনে। দরকারে ফোন করতে পারি।

—ওকে স্যার। বলে তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে উঠে চলে গেল নন্দ গড়াই।

অফিসার সাহা বললেন, ওকে কি এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া ঠিক হল? ব্যাটা হয়তো আবার গা ঢাকা দেবে। সব যে সত্যি বলে গেল, তারও তো কোনও মানে নেই ।

–একে ধরে রেখে লাভ নেই কিছু। আসল অপরাধী আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কেসটা জটিল হচ্ছে ক্রমশ। এত দিন শুধু প্ল্যান করে খুন, এখন তো দেখছি ছিনতাইও হয়েছে। ফাইলটায় কী ছিল জানতে হবে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে খুনের কোনও একটা যোগ তো আছে নির্ঘাত। বলে বড় করে শ্বাস ফেললেন দীপকাকু। পরমুহূর্তেই অফিসার সাহাকে বললেন, একটু চা বলুন তো। মাথা ধরে পাথরের মতো ভারী হয়ে গিয়েছে।