আড়ালে আততায়ী – ৫

৷৷ পাঁচ ৷৷

দীপকাকু যেমনটা চেয়েছিলেন, তদন্ত এগোচ্ছে সেইভাবেই। আজ দুপুরে রেল পুলিশের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জহর সাহা ডা. অলকেশ রায়ের বাসস্থান সার্চ করতে এসেছেন, সঙ্গে ঝিনুক আর দীপকাকু। সার্চের অর্ডার জোগাড় করতে তিনদিন লেগেছে। অর্ডার বার করার প্রধান শর্ত ছিল, ডা. রায়ের রক্ত সম্পর্কিত কোনও আত্মীয়কে জি আর পিতে কমপ্লেনট করতে হবে এই মর্মে, আমার আপনজনের ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টটা বেশ রহস্যজনক। আরও খতিয়ে তদন্ত করা হোক।

পরিস্থিতি বিচার করে দীপকাকু বুঝেছিলেন ডাক্তারবাবুর দুই ভাই কোনও কমপ্লেন্‌ট দায়ের করবেন না। ঝিনুক ভাবতে বসেছিল তা হলে কাকে দিয়ে কমপ্লেন্‌ট লেখাবেন দীপকাকু? ডা. রায়ের ছোল সায়নও যে নিরুদ্দেশ। আর একজন রিলেটিভের কথা একেবারে মাথায় আসেনি ঝিনুকের। দীপকাকুর এসে গিয়েছিল জহর সাহার সামনে বসেই। তখনই তাঁর কথা উল্লেখ করেননি এই কারণে, বদি সেই মানুষটি কমপ্লেন্ট করতে রাজি না হন! মানুষটির সঙ্গে কথা না বলে দীপকাকু নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। অফিসার সাহার সঙ্গে কথাবার্তা সেরে দীপকাকু যখন জি আর পি থানার বাইরে এলেন, নিজের মোটর বাইকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ফোনে ধরেছিলেন ডা. রায়ের কম্পাউন্ডার তাপস কুণ্ডুকে। ডা. রায়ের বোনের ফোন নাম্বার চাইলেন। উনি কোথায় থাকেন, জেনে নিলেন সেটাও।

ঝিনুকের মনে হয়েছিল তাই তো, ডাক্তার রায়ের বোনের কথা তার মাথায় আসেনি একবারও! নিজের বোন মানে রক্ত সম্পর্কিত আইনত কমপ্লেন্ট করতে পারেন।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাপস কুণ্ডু ডা. রায়ের বোনের নাম, ফোন নাম্বার, ঠিকানা এস এম এস করে দীপকাকুর মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ফাঁকে দীপকাকু গভীর চিন্তা করতে করতে একটা সিগারেট শেষ করেন। দাঁড়িয়েছিলেন থানার বাইরে, নিজের মোটরবাইকের পাশে। মুড ছিল খুব সিরিয়াস। হয়তো টেনশনে ছিলেন এই ভেবে যে, ডাক্তারবাবুর বোন আদৌ রাজি হবেন তো কমপ্লেনট করতে ?

তাপস কুণ্ডুর থেকে এস এম এস পেয়েই ভদ্রমহিলাকে ফোন করেছিলেন দীপকাকু। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর বলেছিলেন, আপনার বড়দা অলকেশ রায় আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। কাজটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রয়াত হলেন উনি। ওই তদন্তের ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলতে চাই। আপনি যদি প্লিজ আমায় একটু সময় দেন !

ভদ্রমহিলা তখনই চলে আসতে বলেছিলেন ওঁর বাড়িতে। বাড়ি পাইকপাড়ায়। মহিলার নাম শ্রাবণী গুপ্ত। ঝিনুককে নিয়ে দীপকাকু রওনা দিয়েছিলেন। দীপকাকুর পৈতৃক বাড়ি মেদিনীপুরে। কলেজ শেষ করে কলকাতায় এসেছিলেন। অথচ কলকাতার রাস্তাঘাট এত ভালভাবে চেনেন, মনে হবে জন্মাবধি এখানেই আছেন। শ্রাবণী দেবীর বাড়ি খুঁজে পেতেও কোনও সমস্যা হল না। প্রাচীন বাড়ি, নাম ‘গুপ্ত ভিলা’। শ্রাবণী দেবী সৌজন্য সহকারে দীপকাকু, ঝিনুককে বসিয়েছিলেন ওঁদের বৈঠকখানায়। বেশ স্নিজ অভিজাত দেখতে মহিলাকে। বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি। দীপকাকুর গড়পড়তা উচ্চতা, ইন না করে পরা শার্ট, আদ্যিকালের চশমার ফ্রেম দেখে শ্রাবণী দেবী বোধহয় খানিক দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। বলে উঠছিলেন, আপনি সত্যি গোয়েন্দা? আমি আসলে সত্যিকারের ডিটেকটিভ জীবনে এই প্রথম দেখছি।

কথা কেড়ে দীপকাকু বলেছিলেন, গোয়েন্দা সম্বন্ধে আপনার যা কিছু ধারণা, বই পড়ে এবং সিনেমা নাটক দেখে, তাই তো?

—একদম ঠিক বলেছেন। সায় দিয়েছিলেন শ্রাবণীদেবী।

দীপকাকু নিজের ভিজিটিং কার্ড বার করে শ্রাবণী গুপ্তকে দিয়েছিলেন। ঝিনুকের পরিচয় দিয়েছিলেন নিজের সহকারী হিসেবে। এই প্রথম একজন ঝিনুকের এই বিশেষ পরিচয়টা জেনে এতটুকু অবাক হলেন না। সম্ভবত ডিটেকটিভদের কাজটা নিয়েই ওঁর ধারণা খুব সীমিত। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ হতে না হতেই ভিতর বাড়ি থেকে এসে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন শ্রাবণীদেবীর হাজবেন্ড প্রবীর গুপ্ত। দীপকাকু খুব তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। শ্রাবণীদেবীকে বলেছিলেন, আপনার বড়দা তাঁর নিরুদ্দেশ ছেলের খোঁজে আমাকে নিয়োগ করেছিলেন। কাজে নেমে আমি যখন কিছু আশাপ্রদ ফল পাচ্ছি, ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেলেন ডাক্তারবাবু। এই মৃত্যুটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোনও একজন অথবা একাধিক লোক চায় না আপনার বড়দার সঙ্গে তাঁর সন্তানের দেখা হোক। না চাওয়ার কারণ হচ্ছে সম্পত্তি। ডাক্তারবাবু কেন সায়নের সঙ্গে দেখা করতে চান, তা আমাকে বলেননি। তবু আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না। নিজের সম্পত্তি ফেরার হয়ে থাকা ছেলেকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই কাজে যাতে সফল না হতে পারেন, তার জন্যই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টটা সংঘটিত হয়েছে। এই ধারণাটা আমার আরও দৃঢ় হয়েছে আপনার দাদার ড্রাইভার নন্দ গড়াইয়ের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না দেখে। মৃত্যুর সময় ঠিক কী ঘটেছিল, তার সব চেয়ে বড় সাক্ষী নন্দ গড়াই। গাড়ি নিয়ে সে ছিল দুর্ঘটনাস্থলের খুব কাছে।

এতদূর বলে থেমেছিলেন দীপকাকু। ঝিনুক খেয়াল করেছিল কিছু তথ্য দীপকাকু গোপন করে যাচ্ছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তাঁর ছেলের দেখা হয়েছিল ‘রিলাইফ’ হাসপাতালের লাউঞ্জে, এ কথাটা বেমালুম চেপে গেলেন। কেন বলেননি, ঝিনুক জিজ্ঞাসা করেছিল শ্রাবণী দেবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে। দীপকাকু বলেছিলেন, কাজ হাসিলের জন্য যতটুকু বলার দরকার, ততটাই বলেছি।

প্রথম দফার কথা শেষ হতে চা-বিস্কিট নিয়ে এসেছিল শ্রাবণীদেবীর কাজের মহিলা। চা পর্ব মিটতে দীপকাকু ফের বলতে থাকেন, ডাক্তারবাবুর মৃত্যুর পর আমি তদন্ত স্থগিত রাখতে পারতাম। কিন্তু আমার বিবেক সেটা করতে দিল না। ডা. রায়ের সঙ্গে আমার যে সামান্য আলাপ হয়েছিল, তাতেই বুঝেছিলাম খুবই ভাল মনের মানুষ। উনি এ ভাবে ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে মারা যাবেন, এটা মেনে নিতে পারছি না।

শ্রাবণীদেবীর হাজবেন্ড প্রবীরবাবু তখন বলেছিলেন, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে কাউকে মেরে ফেলা কি এতটাই সহজ? এর স্বপক্ষে আপনার কাছে সেরকম জোরাল কোনও আভাস বা ইঙ্গিত আছে কি? না কি গোটাটাই আপনার অনুমান?

এর উত্তরে দীপকাকু বলেন, অনুমানটাও তৈরি হয় কিছু যুক্তির উপর নির্ভর করে। সেই যুক্তি আমার আছে। সেটা ধরে আমি এগোতে পারছি না, কারণ মৃত্যুটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে। রেল পুলিশ তেমনটাই রিপোর্ট দেবে কোর্টে। ডা. রায়ের দুই ভাইই সেটাই মেনে নেবেন। কেননা দাদার মৃত্যু নিয়ে তাঁদের মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি। যদি জাগত, তাঁরা রেলপুলিশকে বলতে পারতেন অ্যাক্সিডেন্টটা নিয়ে খতিয়ে তদন্ত হোক । আইনমাফিক রেলপুলিশকে শুনতে হত সে কথা। যেহেতু তাঁরা মৃতের রক্তের সম্পর্কের ভাই। আমি তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগাতে যাচ্ছি না এই অনুমানে, দু’জনের কেউ শুনবে না আমার পরামর্শ। কেননা, ডাক্তারবাবুর থেকে শুনেছি দুই ভাইয়ের পরিবার ওঁকে প্রায় নজরবন্দি অবস্থায় রেখেছে।

এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে সায় দিয়েছিলেন শ্রাবণীদেবী। বলেছিলেন, বড়দা একেবারে ঠিক কথাই বলেছে। গোটা বাড়ির লোক বড়দাকে চোখে চোখে রাখত। রীতিমতো কোণঠাসা করে রেখেছিল। কোনও ভাবেই দাদা যেন বাবলার সঙ্গে দেখা না করতে পারে। বাবলা হচ্ছে সায়নের ডাক নাম।

দীপকাকু বলেছিলেন, জানি।

ফের শ্রাবণীদেবী বলতে থাকেন, দোষ যদি বাবলা করে থাকে, তার শাস্তি বড়দাকে পেতে হবে কেন বলুন তো? বড়বউদিকেও অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে বাড়ির লোকের কাছে। সেই কষ্টেই বেচারি তাড়াতাড়ি চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। এখন দাদাও রইল না। বড়দাকে সত্যিই যদি প্ল্যান করে ট্রেনের মুখে ফেলা হয়ে থাকে, সেটা প্রমাণ করার জন্য আমি আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি বলুন ?

দীপকাকু তখন জি আর পিতে ব্লাড রিলেটেড আত্মীয় কমপ্লেন্টের কথাটা গুছিয়ে বললেন। একই সঙ্গে জানালেন, ডা. রায়ের বসবাসের জায়গাটা সরোজমিনে দেখতে চান। দেখবেন রেলের তদন্ত অফিসারের সঙ্গে। যাঁর সঙ্গে দীপকাকুর ব্যাপারে কথা হয়ে আছে।

এই পয়েন্টে এসে প্রবীরবাবু জানতে চান, বড়দার ঘরে আপনি ঠিক কী ধরনের সূত্র খুঁজে পেতে চাইছেন?

দীপকাকু বলেছিলেন, এমন কোনও ক্লু খুঁজে পেতে চাইছি যার থেকে বোঝা যাবে ডাক্তারবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর সম্পর কোনও যোগাযোগ আছে কিনা। উপার্জিত অর্থ কোথায়, কী ভাবে রাখতেন? ব্যাঙ্কের পাস বই, যদি কোনও ফিক্সড ডিপোজিট থাকে, তার সার্টিফিকেট। শেয়ারে ইনভেস্ট করে থাকলে, সে সব পেপার্স কী অবস্থায় আছে দেখতে হবে। ছেলের নামে উইল করে রেখেছেন কি না, খুঁজতে হবে সেটাও। এগুলো দেখে ভাল করে বিচার করলেই আমরা বুঝতে পারব সায়নকে কতটা টাকা কীভাবে উনি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন? এরপর দেখতে হবে এই ব্যবস্থার কথা কে কে জানতে পেরেছিল? তাদের মধ্যে কোনও একজন অথবা দু’চারজন মিলে চায়নি সায়ন টাকাটা পাক। তাই ওই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের পরিকল্পনা। অবশ্য আমার অনুমান য মিলবেই, এমন গ্যারান্টি দিতে পারছি না। তবে তদন্তটা চালানো উচিত এটা মনে করছি।

দীপকাকুর কথা মেনে নিয়েছিলেন শ্রাবণীদেবী। বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তদন্ত হওয়া উচিত। বড়দার রোজগার তো কম ছিল না। কাঁচা টাকা আর পাবেন বলে মনে হয় না। মেজদা, ছোড়দা এতক্ষণে ভাগ করে নিয়েছে। ব্যাঙ্কের কাগজগুলো পেলেও পেতে পারেন। আপনার কথা মতো আমি অবশ্যই জি আর পিতে মৃত্যুটা সন্দেহজনক বলে কমপ্লেন্ট করব। কমপ্লেন্ট লেখার সময় আপনি একটু সঙ্গে থাকবেন।

—নিশ্চয়ই থাকব। বলে সোফা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন দীপকাকু। ফের বসে পড়ে বলেছিলেন, আচ্ছা, আমায় একটা কথা বলুন তো, আপনার বড়দার এই যে এত পেশেন্ট, এটা কত বছর ধরে চলছে? মানে, আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছি ডা. রায়ের কতটা পরিমাণ সম্পত্তি থাকতে পারে ?

উত্তর দিতে একটু সময় নিয়েছিলেন শ্রাবণীদেবী। অতীত ঝালিয়ে নিতে নিতে বললেন, বড়দার পসার ধীরে ধীরেই বেড়েছে। লাস্ট দশ বছর তুঙ্গে উঠেছিল প্র্যাকটিস। আসলে বড়দা তিনটে রোগের ওষুধ দিত দারুণ। এক হচ্ছে, এপিলেপ্সি, দুই, হাঁটুর যন্ত্রণা, তিন, শ্বাসকষ্ট। দূর দূর জেলা থেকে রুগিরা আসত বড়দাকে দেখাতে। যতদিন গিয়েছে, নাম ছড়িয়ে পড়েছে বড়দার।

এই কথার পরই ঝিনুকরা বিদায় নিয়েছিল গুপ্তভিলা থেকে। গতকাল দীপকাকু শ্রাবণীদেবীকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিয়ালদার জি আর পি থানায় কমপ্লেন্ট করতে। প্রবীরবাবুও ছিলেন সঙ্গে। কমপ্লেন্টের বয়ান কী হবে বলে দিয়েছিলেন রেলের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জহর সাহা। উনি সব চেয়ে ভাল জানেন কী ধরনের অভিযোগ করলে রেল পুলিশ আলাদা ভাবে তদন্ত করতেআগ্রহী হয়। কমপ্লেন্টে লেখা হয়েছে, ‘আমার দাদা ওই রুটে কখনওই যাতায়াত করেন না। খতিয়ে দেখা হোক, কেন গিয়েছিলেন সেদিন? কেউ কি প্ল্যান করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? দাদার মধ্যে আত্মহত্যার কোনও লক্ষণ ছিল না। কেউ দাদাকে ট্রেন আসার সময় রেলের ট্র্যাকে ঠেলে ফেলে দেয়নি তো? প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে অনুরোধ করছি।’

আজ ঝিনুককে বাড়ি থেকে নিতে এসে বাবাকে এ সব কথা জানালেন দীপকাকু। বাবা বলেছিলেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই কেসটাতে তুমি অতিরিক্ত অনুমানের ভিত্তিতে এগোচ্চো প্রায় কল্পনার সামিল।

– একথা কেন বলছেন? অসন্তুষ্ট স্বরে জানতে চেয়েছিে দীপকাকু।

বাবা তখন বললেন, অন্য কোনও গাড়ি দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা মেরে কাউকে মেরে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ট্রেন তো কারুর ইচ্ছে পালন করবে না। নিজের নিয়ম মেনে চলবে। তাতে যদি কারুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সেটাকে দুর্ঘটনা ভাবা ছাড়া উপায়ন্তর থাকে না।

এর উত্তর যেন রেডিই ছিল দীপকাকুর কাছে। বলে উঠেছিলেন। আপনি যে ট্রেনের নিয়মের কথা বলছেন আমার ধারণা ওই নিয়মের জালেই ডাক্তারবাবুকে এনে ফেলা হয়েছিল। জালটা আবছা ভাবে হলেও আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। কেন মেরে ফেলা হল ওঁকে, মারল, যখন বার করতে পারব তদন্তের মাধ্যমে, জালটা আপনিই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আসলে আততায়ী অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অপরাধটা সে এমন ভাবে করেছে, যাতে কিছুতেই তাকে ধরা না যায়। তাকে ধরাটাই আমার চ্যালেঞ্জ।

বাবা আর কথা বাড়াননি। ওঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল খোঁচা মেরে দীপকাকুর মুখ থেকে যদি এই কেসের ব্যাপারে আরও কিছু সূত্র বার করা যায়। দীপকাকু সবটা খোলসা করেন না। মাথার ভিতর অনেক ক্যালকুলেশন চলতে থাকে তাঁর। যেমন, ডা. রায়ের বাড়ি এসে দীপকাকু ঠিক কী খুঁজছেন, এখন অবধি বুঝে উঠতে পারেনি ঝিনুক। সে শুধু দীপকাকু আর মি. সাহার পিছন পিছন ঘুরে যাচ্ছে সম্ভবত জহর সাহাও আঁচ করতে পারছেন না, দীপকাকু কোন সূত্রের সন্ধানে আছেন।

রেল পুলিশের দশ সিটের বড় গাড়িতে এ বাড়িতে এসেছে ঝিনুকরা। পুলিশের ড্রাইভার নিয়ে মোট ছ’জন এসেছে। অফিসার সাহার সঙ্গে আছেন দু’জন কনস্টেবল। যাঁরা এখন বাড়ির সদর দরজায় মোতায়েন। ডা. রায়ের বাড়িতে ঢোকার আগে জি. আর. পি’র গাড়ি একবার লোকাল থানায় গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন অফিসার সাহা। দীপকাকু গাড়িতেই ছিলেন। ঝিনুক দীপকাকুর কাছে জানতে চেয়েছিল, মি. সাহা লোকাল থানায় এলেন কেন?

উত্তরে দীপকাকু বললেন, ডা. রায়ের ঘর সার্চ করতে যাচ্ছেন জানাতে গেলেন। সার্চ করতে গিয়ে যদি কোনও ধরনের বাধা পান, মানে স্থানীয়রা অথবা বাড়ির লোক হয়তো মি. সাহাকে কাজ করতে দিল না। তখন লোকাল থানার ফোর্স গিয়ে সাহাবাবুকে হেল্প করবে। রেল পুলিশ লোকাল থানার সঙ্গে এমন যোগসাজশেই কাজ করে থাকে।

ডা. রায়ের বাড়িতে এসে কোনও বাধার মুখেই পড়তে হয়নি। দলবল নিয়ে সদর দরজার সামনে এসে কলিং বেল টিপে ছিলেন অফিসার সাহা। আগের দিনের মতোই দরজা খুলতে একটু সময় লেগেছিল। সেই ফাঁকে ঝিনুক খেয়াল করে দরজার পাশে ডাক্তারবাবুর নাম লেখা বোর্ডটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাপস কুণ্ডুই খুলেছিলেন সদর দরজা। পুলিশি পোশাকের লোকজন দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বেশ। চেনা মুখ বলতে দীপকাকু আর ঝিনুক। যাদের পরনে পুলিশের পোশাক নেই। তাপস কুণ্ডু অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিলেন দীপকাকুর দিকে। দীপকাকু ওঁর সামনে গিয়ে জানালেন এ বাড়িতে আগমনের হেতু। তাঁর সঙ্গে এটাও বলেন, ডাক্তারবাবুর দু’ভাইকে ডেকে দিন। ঝিনুকদের ঘরে ঢুকতে দিয়ে তাপসবাবু বলেছিলেন, ছোটভাই এখন অফিসে। মেজকর্তা বাড়ি আছেন। উনি রিটায়ার করেছেন কিছুদিন হল। ওঁকে ডেকে দিই তা হলে?

—ডাকুন। এটা বলেছিলেন অফিসার সাহা ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তারবাবুর ভিজিটার্সদের ঘরে এসেছিলেন মেজভাই। মি. সাহা ততক্ষণে তাপস কুণ্ডুর চেয়ার টেবিলের দখল নিয়েছেন। যেখানে বসে তাপসবাবু পেশেন্টদের নাম ডাকতেন। অফিসার সাহাই কথা শুরু করেছিলেন ডা. রায়ের ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথমে নাম জানতে চাইলেন। নাম সমরেশ রায়। এটা ঝিনুক জানত। ডা. রায় বলেছিলেন। অফিসার সাহা কী কারণে এসেছেন জানালেন সমরেশবাবুকে। রেলের সার্চ অর্ডারটা দেখালেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার দাদার লিভিং রুমটা কোথায়?

—এই এক তলাতেই। প্রথমে এই ঘরটা। তারপর রুগি দেখার চেম্বার। পাশেই শোওয়ার ঘর, কিচেন, বাথরুম, বলেছিলেন সমরেশবাবু।

মি. সাহা বললেন, আপনার দাদার পোশানে যে যে জায়গায় চাবি দেওয়া আছে, সে চাবিগুলো কোথায় জানেন?

—সব চাবি আমার কাছেই আছে। নিয়ে আসছি এক্ষুণি। বলার পর কী একটু ভেবে নিয়ে সমরেশবাবু ফের বলেছিলেন, দাদার আলমারি থেকে বেশ কিছু দরকারি জিনিস আমি নিজের কাছে রেখেছি। চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে। দাদার কম্পাউন্ডার দিনে এখানে থাকলেও, রাতে তো থাকে না, তাই।

– দরকারি জিনিস বলতে? এই প্রশ্নটা করেছিলেন দীপকাকু। সমরেশবাবু বললেন, দাদার ব্যাঙ্কের কাগজপত্র, কুড়ি হাজার টাকা। আর একটা উইল।

-কিসের উইল? ফের দীপকাকুর প্রশ্ন।

উত্তরে সমরেশবাবু বলেছিলেন, দাদা এ বাড়ির নিজের অংশটা ছেলেকে দিচ্ছে। তার উইল।

অফিসার সাহা বললেন, ডা. রায়ের যা কিছু আপনার হেফাজতে আছে। সব নিয়ে আসুন।

জিনিসগুলো আনতে দশ মিনিটও লাগেনি সমরেশবাবুর। সেই ফাঁকে দীপকাকু তাপস কুণ্ডুর থেকে জেনেছিলেন এ বাড়ির গোটা পরিস্থিতি। দুই ভাইয়ের পরিবারের সদস্য এবং কাজের লোক ক’জন, কে কোথায় থাকে? যা জানা গেল, একতলার পিছন পোশানে থাকেন ডা. রায়ের ছোট ভাই, যাঁর নাম কমলেশ রায়। স্ত্রী নিয়ে তাঁর পরিবার চার জনের। দুই সন্তানের একটি ছেলে। অপরটি মেয়ে। সমরেশবাবু দোতলায় থাকেন, আগের সাক্ষাতে বলেছিলেন তাপস কুণ্ডু। এবার জানা গেল দোতলাটা পুরো বাড়ি জুড়ে নয়, বাড়ির হাফ পোশান। স্ত্রী এবং এক ছেলেকে নিয়ে সমরেশবাবুর তিনজনের সংসার। বড়ছেলে অয়নকে হারিয়েছেন আগেই। সেই দুর্ঘটনায়। বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক বলতে একজন, হারু। ডাক্তারবাবুর দেখাশোনা হারুই করত। হারু এখন মেজকর্তার সংসারে কাজ করছে। বাকি তিনটে ঠিকে কাজের লোক আছে। যারা তিনজনে তিন ভাইয়ের পোশানে কাজ করে। ডাক্তারবাবুর ঠিকে কাজের লোকটিকে আসতে বারণ করেছেন মেজকর্তা। তাপসবাবুর তো এখন বিশেষ কোনও কাজ নেই। ডা. রায়ের পোশানটা উনিই ঝাড়পোছ করে পরিস্কার রাখছেন।

দীপকাকু তাপস কুণ্ডুর সঙ্গে কথা থামিয়েছিলেন সমরেশবাবুকে ঘরে ফিরে আসতে দেখে। সমরেশবাবুর এক হাতে ছিল চাবির গোছা। অন্য হাতে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে ছিল ব্যাঙ্কের কাগজপত্র, নগদ টাকা, উইল। সব কিছু টেবিলের উপর রেখেছিলেন। চেয়ারে তখন অফিসার সাহা। দীপকাকুর জন্য একটা টুল এনে দিয়েছিলেন তাপস কুণ্ডু। জহর সাহা, দীপকাকু কাগজপত্রগুলো খুটিয়ে দেখলেন। নগদ টাকা গুলো গুনলেন। পাঁচশো আর একশোর নোট। খুচরো নোট ছিল সামান্যই। দুজনেই উইলটা পড়ে দেখে নিলেন। গোটা কাজটা করতে মিনিট পঁয়তাল্লিশ মতো লেগেছিল।

ক্যারিব্যাগে আনা জিনিসপত্র সমরেশবাবুকে ফেরত দিয়ে দীপকাকু বলেছিলেন, এগুলো আপনার হেফাজতেই রাখুন।

ব্যাগটা নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সমরেশ রায়। আর আসেননি। ঝিনুক তখন ভেবেছিল, যাক কাজ প্রায় শেষ হল। দীপকাকু তো ডা. রায়ের সম্পত্তির খতিয়ান বুঝতে চেয়েছিলেন, সেটা তো হয়ে গেল। কিন্তু দেখা গেল, তা নয়। ডাক্তারবাবুর তিনটে আলমারি আছে, সমরেশবাবু এনে দেওয়া চাবি দিয়ে এক এক করে সেগুলো খুলেছেন দীপকাকু। ভিতরের জিনিসপত্র দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। তিনটে আলমারির একটা ছিল শোওয়ার ঘরে, একটু আগে সেটার সার্চিং সেরে দীপকাকু চলে এসেছেন ডাক্তারবাবুর রিডিং টেবিলের কাছে। সেখানকার কাগজপত্র দেখছেন। পাশে আছেন অফিসার সাহা। দীপকাকুর কথা মতো উনি সার্চ করার অ্যাক্টিং করে যাচ্ছেন। তদন্তের এই খানাতল্লাশি পর্বটা ঝিনুকের সব চেয়ে বোরিং লাগে। সেটা আরও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, যখন ঝিনুক বুঝতে পারে না দীপকাকু আসলে ঠিক কী ধরনের সূত্রের সন্ধানে আছেন। ঝিনুকের কেমন যেন মনে হচ্ছে এই কেসটাতে দীপকাকু বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। নিজের অনুমানগুলোকে সঠিক প্রতিপন্ন করতে হাতড়াচ্ছেন অদরকারি জিনিস। কেসে অগ্রগতি বলতে খুব সামান্যই। মোটরম্যানের অবজার্ভেশন শুনে দীপকাকু অনুমান করেছিলেন। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ডা. রায়ের মোবাইলে কোনও কল এসেছিল। শার্টের পকেট থেকে উনি ফোনসেট বার করতে গিয়েছিলেন। মিলে গিয়েছে দীপকাকুর কথা। রেল পুলিশের হেফাজতে থাকা ডা. রায়ের মোবাইল চেক করে দেখা গিয়েছে বিকেল চারটে দশে ফোন এসেছিল নামহীন নাম্বার থেকে। সেই নাম্বারটায় ফোন করা হলে শুনতে হচ্ছে, নাম্বার ডাজ নট এক্সিট। যে ফোন কোম্পানির নাম্বার, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অফিসার সাহা। জানতে চেয়েছেন নাম্বার হোল্ডারের নাম-ঠিকানা। তথ্যগুলো দিয়েছে ফোন  কোম্পানি। দেখা গিয়েছে ঠিকানা অস্তিত্বহীন, নামটাও তার মানে মিথ্যে। বোঝাই যাচ্ছে জাল সিমকার্ড ব্যবহার করেছিল কেউ। ওই ধরনের ফেক নাম্বার থেকে ফোন করা মানেই ব্যক্তির উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। হতেই পারে ট্রেন এসে পড়ার আগের মুহূর্তে ডা. রায়কে অন্যমনস্ক করে দেওয়ার জন্য কলটা করেছিল সে। ডা. রায়ের ফোনের কল লিস্ট থেকে দেখা যাচ্ছে নাম্বারটা থেকে ওই একবারই ফোন এসেছিল। ডা. রায়ের কাছে আসা লাস্ট কল নিয়ে তদন্তটা অফিসার সাহা একাই করেছেন। দীপকাকুকে ফলাফল জানিয়েছেন ফোনে। আজ যখন ঝিনুকরা এ বাড়িতে আসার আগে জি আর পি থানায় গিয়েছিল, জহর সাহা দীপকাকুকে ডা. রায়ের ফোনের কললিস্ট দিলেন। মারা যাওয়ার আগের সাতদিনের লিস্ট। ওই ক’দিন যাদের ফোন এসেছে এবং উনি যাকে যাকে ফোন করেছেন। সব আছে লিস্টে। দীপকাকুর সঙ্গে ফোন চলাচলি হয়েছে সেটাও আছে। চারটে নামহীন নাম্বার পাওয়া গেল। যার একটাতে দু’বার কল করেছেন ডাক্তারবাবু। নাম্বারটা থেকে কল এসেছে দু’বার। দীপকাকু চারটে নাম্বারের ইউজারদের ট্রেস করতে বলেছেন অফিসার সাহাকে। তদন্ত আছে এখন অবধি এই পর্যায়ে। এটাকে প্রাথমিক অবস্থাই বলা ভাল। আরও অনেকটা দূর যেতে হবে দীপকাকুকে… ঝিনুকের ভাবনা হোঁচট খেল একটা দৃশ্য দেখে। ডা. রায়ের রিডিং টেবিলে বসে দীপকাকু একটা কভার ফাইলের কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। হঠাৎ একটা কাগজ তুলে ভাঁজ করে শার্টের পকেটে পুরলেন। পোরার আগে চকিতে দেখে নিয়েছেন তাপসবাবু আর মি. সাহার অবস্থান। অর্থাৎ ওঁদের অগোচরে কাগজটা রাখতে চেয়েছেন নিজের কাছে। দীপকাকুর পরেই ঝিনুকও তাকিয়েছে ঘরের বাকি দু’জনের দিকে, অফিসার সাহা ক্লান্ত হয়ে ডা. রায়ের বিছানায় বসে আছেন। দীপকাকু কী করছেন সেদিকে লক্ষ্য নেই। তাপস কুণ্ডু দেওয়ালে হেলান দিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছেন মেঝেতে।

কভার ফাইল বন্ধ করে যথাস্থানে রাখলেন দীপকাকু। চেয়ার থেকে উঠে পাশেই বইয়ের র‍্যাকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। দেওয়ালে গর্ত করা র‍্যাক। সামনের কাঠের ফ্রেমের উপরে কাচের ব্লাউডি পাল্লা। কাচের এপার থেকে বই দেখতে দেখতে গলা তুললেন দীপকাকু, ডাক্তারবাবুর ওষুধের স্টক কোথায় আছে?

প্রশ্নটা তাপসবাবুর উদ্দেশে। চমকে মেঝে থেকে দৃষ্টি তুঙ্গে উনি বললেন, ওষুধের আলাদা ঘর আছে স্যার। ল্যাবরেটরি বলতে পারেন। ও ঘরে কাউকে অ্যালাউ করতেন না। আমাকেও না। রুগি দেখার আগে ওই ঘর থেকে একটা ওষুধের বাক্স নিয়ে এসে চেম্বারে বসতেন। রুগি দেখা হয়ে গেলে বাক্সটা রেখে দিতেন ওষুধের ঘরে ঘরটায় তালা মেরে রাখতেন সব সময় ৷

কথাটা শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন দীপকাকু। তাপসবাবুর দিকে তাকালেন ভাল করে। বোঝা যাচ্ছে ওঁর দেওয়া তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে দীপকাকুর কাছে। বললেন, চলুন, ডাক্তারবাবুর ওষুধের ঘরটা এবার দেখি।

এই রুমে দু’টো দরজা। যেটা দিয়ে ঢুকেছিল ঝিনুকরা, সে দিকে না গিয়ে অন্য দরজাটা লক্ষ্য করে এগোলেন তাপস কুণ্ডু। ঘরের বাকি তিনজন ওঁকে অনুসরণ করল।

একটা প্যাসেজে এসে পড়েছে ঝিনুকরা। আধো অন্ধকার প্যাসেজ। দেওয়ালের সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন তাপসবাবু কিছুটা এগোতেই কিচেন, ডান দিকে। দীপকাকু দাঁড়িয়ে পড়লেন কিচেনের ভিতরে চোখ বুলিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবুর একার রান্না এখানেই হত? ঘরটা ব্যবহার হত বোঝা যাচ্ছে।

উত্তর দেওয়ার কথা তাপসবাবুর। উনিই বললেন, একার রান্না নয়, দু’জনের। হারুও খেত। রান্নাও করত সে।

-ডাক্তারবাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ভাইয়েরা ওঁকে নিজেদের কাছে খেতে বলেননি? জানতে চাইলেন দীপকাকু।

তাপস কুণ্ডু বললেন, বলেছে কি না বলতে পারব না। আমি যাব থেকে কাজ করছি, তিন ভাইয়ের আলাদা রান্নাঘরই দেখে এসেছি।

আট বছর তাপসবাবু ডাক্তারবাবুর কাছে আছেন, তথাটা থেকেই পাওয়া। কিচেনের দরজা ছেড়ে এগোলেন দীপকাকু। কায়ক পা গিয়েই বাঁ দিকে তালা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল ঝিনুকরা। তাপসবাবু বললেন, এটাই ওষুধের ঘর।

দীপকাকুর প্যান্টের পকেটে আছে সমরেশবাবুর দিয়ে যাওয়া চাবি। সবগুলো বার করলেন। ওষুধ ঘরের চাবি বেছে নিয়ে তালা খুললেন তাপসবাবু। ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। ঝিনুকরা একে একে ঢুকল ঘরে। সব’কটা জানলা বন্ধ। হোমিওপ্যাথি ওষুধের গন্ধে ম ম করছে ঘর। আসলে অ্যালকোহলের গন্ধ। যা হোমিওপ্যাথি ওষুধের প্রধান উপাদান। গন্ধের চোটে মাথা ঝিমঝিম করছে ঝিনুকের।

ঘরটাকে বাস্তবিকই ল্যাবরেটরি আখ্যা দেওয়া যায়। ছোট বড় নানা রকমের শিশি, জার। তার কোনটাতে তরল, কোনওটায় সাদা পাউডার। হোমিওপ্যাথি ওষুধে যাকে সুগার অব মিল্ক বলে। দীপকাকু জার-শিশি একটা করে তুলে দেখছেন। দেখছেন মি. সাহাও। ওঁরটা অবশ্য অভিনয়। যেটা দীপকাকু করতে বলেছেন ওঁকে। তাপসবাবুর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দীপকাকু বললেন, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, কোনও শিশি বা জারের গায়ে ওষুধের আসল নাম নেই। লেবেল পাল্টে কোড নাম দিয়েছেন ডাক্তারবাবু।

একটু ভেবে নিয়ে দীপকাকু ফের বলেন, আচ্ছা, এ সব হোমিওপ্যাথি ওষুধই তো? অ্যালোপ্যাথি ট্যাবলেট গুঁড়ো করে সুগার অব মিল্কে মিশিয়ে চালাতেন না তো? অনেক অসৎ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এমন করে শুনেছি।

তাপসবাবু বলে উঠলেন, না না, আমাদের ডাক্তারবাবু সে সব করতেন না। হোমিওপ্যাথির উপর ছিল তাঁর বিরাট আস্থা। তবে আমার আন্দাজ, উনি হোমিওপ্যাথির দু-তিনরকম ওষুধ ভাগ মতো মিশিয়ে, নতুন ওষুধ তৈরি করতেন। যদিও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় এমনটা করার কথা নয়। মানে কলেজে এই পদ্ধতি পড়ানো হয় না তবু অনেক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারই এটা করে থাকে।

-ডা. রায় যে এমন করতেন, কিসের ভিত্তিতে বলছেন? আপনি কি দেখেছেন? আপনাকে তো এ ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হত না বলছেন।

দীপকাকুর কথার উত্তরে তাপস কুণ্ডু বললেন, না, আমি দেখিনি আমার আগে যিনি কাজ করতেন শ্রীবাসবাবু, তাঁর কাছে শুনেছি। ডাক্তারবাবু এমনিতে দরজা বন্ধ করে ওষুধ তৈরি করতেন। শ্রীবাসবাবু কয়েকবার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিলেন। তারপর থেকে ভিতরের ছিটকিনি তুলে দিতেন ডাক্তারবাবু।

হাতের শিশি-বোতল যথাস্থানে রেখে দীপকাকু বললেন, ঘরটা কেমন যেন অগোছাল লাগছে। সাধারণত ল্যাবরেটরিতে যারা কাজ করেন, জায়গাটা গুছিয়ে রাখেন। ডাক্তারবাবু এরকম অবস্থায় রাখতেন ঘরটা?

– আমার যেহেতু ভিতরে ঢোকার পারমিশন ছিল না, জানতাম না ঘরটা কেমন অবস্থায় থাকত। এ ব্যাপারটা হারু ভাল বলতে পারবে। মাঝে মাঝে হারু ঘরটা ঝাড়পৌঁছ করত।

হারুকে একবার ডেকে আনুন তো।

দীপকাকুর নির্দেশ শুনে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন তাপস কুণ্ডু। বড় করে শ্বাস ছেড়ে অফিসার সাহা বলে উঠলেন, কী মশাই অনেকক্ষণ ধরে তো ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, লাভ হচ্ছে কিছু?

ঘরের এক কোণে বইয়ের র‍্যাক আর টেবিল চেয়ার, সেই দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দীপকাকু বললেন, লাভ যে একেবারে হয়নি বলব না। তবে লক্ষ্যে পৌঁছোতে এখনও অনেক দেরি।

আপনি ঠিক কী ধরনের কু খুঁজছেন, কিছুই তো বুঝছি না। হিন্টও দিচ্ছেন না কোনও। মাঝখান থেকে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে আমার। বলে সত্যি সত্যিই বড় একটা হাই তুলে ফেললেন অফিসার সাহা।

দীপকাকু টেবিলের উপরে থাকা বই-খাতাগুলো দেখছেন। একটা মোটা ডায়েরি তুলে নিয়ে পাতা উলটে পড়তে থাকলেন। একটু পরে বললেন, এ তো দেখছি রীতিমতো ফর্মুলা লেখা আছে। যদিও সব কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। অঙ্কের প্লাস, মাইনাস ধরনের সাইনগুলোই শুধু চেনা লাগছে।

ঝিনুক এগিয়ে গিয়ে চোখ রাখল ডায়েরির পাতায়। দীপকাকু একেবারে ঠিক কথাই বলেছেন। মি. সাহা বললেন, আমি এরকম আরও কয়েকজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কথা জানি, যারা কী ওষুধ দিচ্ছে, অন্যকে জানতে দেয় না। ওষুধের কোড তৈরি করে রাখে।

–স্যর, হারু। তাপস কুণ্ডুর গলা।

দরজার দিকে ঘুরে তাকালেন দীপকাকু। একই সঙ্গে মি. সাহা এবং ঝিনুকও। তাপসবাবুর পাশে বছর তিরিশেকের হারু। একটু গেঁয়ো হাবভাব, ঘাবড়ে আছে বেশ। দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পুরো নাম ?

—হারাধন প্রামাণিক। বলল হারু।

দীপকাকু পরের প্রশ্নে গেলেন, এই ঘরটা তো তুমিই পরিষ্কার করো। ডাক্তারবাবু কি বই-খাতা, শিশি-বোতল এরকম এলোমেলো করে রাখতেন?

– আমি ওসব দিকে দেখতাম না। কখনও হাতও লাগাইনি ওষুধপত্তরে। ডাক্তারবাবুর নিষেধ ছিল। শুধু মেঝে ঝাঁটা দেওয়া মোছা ছিল আমার কাজ। বলল হারু।

অফিসার সাহা ধমকে বলে উঠলেন, ঘরে আসতে, চোখে পড়ত না জায়গাটা অগোছালো আছে কি না, তা কি কখনও হয় ?

থতমত খেয়ে হারু বলে, কখনও দেখতাম পরিষ্কার আছে. কখনও আবার ছড়ানো ছেটানো।

–তুমি লাস্ট কবে এ ঘর পরিষ্কার করেছ? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু।

হারু বলল, ডাক্তারবাবু মারা যাওয়ার আগেই ঝাড়পোঁছ বা হয়েছে। তারপর আর এ ঘর পরিষ্কার করা হয়নি।

– আচ্ছা, এবার তোমায় একটা অন্য কথা জিজ্ঞেস করি, মারা যাওয়ার ক’দিন আগে ডাক্তারবাবু কি একটু অস্থির মতো ছিলেন? মানে, সব সময় কিছু চিন্তা করছেন, ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে না…

দীপকাকুর প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিচ্ছে হারু। বলে ওঠে, না, সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না।

—ঠিক আছে তুমি এখন যাও। সমরেশবাবুকে একবার আসতে বলো। আমরা বাইরের ঘরে আছি। বললেন দীপকাকু।

হারু ফিরে গেল। দীপকাকু দরজার দিকে পা বাড়িয়ে তাপসবাবুর উদ্দেশে বললেন, ওই ঘরটা আগের মতোই তালা দিয়ে রাখুন।

পেশেন্ট পার্টির বসার ঘরটায় ফিরে এসেছে ঝিনুকরা। বাইরে সন্ধে নেমেছে। ঘরের আলো জ্বালিয়েছেন তাপস কুণ্ডু। অফিসার সাহা আগের মতোই তাপসবাবুর চেয়ার-টেবিলে। দীপকাকু টুলে। ঝিনুক, তাপস কুণ্ডু দাঁড়িয়ে। ভিতর দরজা দিয়ে ঘরে এলেন সমরেশবাবু। ওঁর বসার জন্য একটা টুল আগে থেকেই তাপসবাবু দীপকাকুদের সামনে রেখেছিলেন। অফিসার সাহা হাত নির্দেশ করে ওটায় বসতে বললেন সমরেশবাবুকে। বসলেন উনি। কথা শুরু করলেন দীপকাকু, আপনার থেকে কয়েকটা জিনিস জানার আছে।

-বলুন। যতটা জানি বলব। বললেন সমরেশবাবু।

দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মানে বাড়ির লোকেদের অসুখবিসুখ হলে ডাক্তারবাবুর ওষুধ খেতেন, নাকি অন্য কোনও অ্যালোপ্যাথিক হাউজ ফিজিশিয়ানকে দেখান আপনারা?

– — ছোট খাটো রোগে আমরা দাদার ওষুধই খেতাম। সিরিয়াস কিছু হলে বাড়ির কাছে একজন অ্যালোপ্যাথ আছেন, তাকে দেখাই।

সমরেশবাবু উত্তর শুনে দীপকাকু এবার জানতে চান, ডাক্তারবাবু নিজের জন্য কি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার সাহায্য নিতেন ?

—একেবারেই না। দাদার অবশ্য রোগভোগ বিশেষ ছিল না। হাই ব্লাড প্রেশার ছিল। নিজের ওষুধই খেত দাদা। কিন্তু তা দিয়ে সামলাতে পারেনি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল একদিন। নার্সিং হোমে অ্যাডমিট করাতে হয়েছিল।

ডাক্তারবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল দীপকাকু জানেন। ডা. রায়ই বলেছিলেন। নার্সিংহোম যাওয়াটা জানত না ঝিনুকরা। অসুস্থতার ব্যাপারটা না জানার ভান করে দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কী হয়েছিল ডাক্তারবাবুর? নার্সিংহোম মানে তো সিরিয়াস ব্যাপার!

—ডাক্তাররা বলেছে মাইলড্ অ্যাটাক। প্রেশার খুব হাই ছিল। নিজে বুঝতে পারেনি। বন্ধুর সঙ্গে ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের প্রোগ্রাম দেখতে যাচ্ছিল দাদা। গাড়িতে হার্ট অ্যাটাক হল। কমলদা দাদাকে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল বলেই সে যাত্রায় বোধহয় বেঁচে গেল।

-কমলদা কে? দীপকাকু জানেন, তবু জিজ্ঞাসা করলেন।

সমরেশবাবু বলছেন, যে বন্ধুর কথা বললাম সে। পুরো নাম কমল বিশ্বাস। চেতলায় থাকে। দাদার পুরনো বন্ধু। কমলদা গাড়ি নিয়ে এসেছিল দাদাকে ফাংশানে নিয়ে যেতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরই দাদা অসুস্থ বোধ করতে থাকে। শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়। দাদা নিজেই কমলদাকে বলে, আমাকে হসপিটালে নিয়ে চ। মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। কাছেই আর এম সি নার্সিংহোমটা ছিল. কমলদা ওখানেই অ্যাডমিট করে দাদাকে।

—ক’দিন ছিলেন নার্সিংহোমে? জানতে চাইলেন দীপকাকু।

সমরেশবাবু বললেন, দু’রাত, তিন দিন। দাদাই জেদ করে বাড়ি চলে এল। তবে ক্লিনিকাল টেস্ট সব হয়েছে। সিরিয়াস কিছু পাওয়া যায়নি।

—তারপর থেকে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধই খেতেন নিশ্চয়ই। বললেন দীপকাকু।

নিচের ঠোঁট উল্টে গলায় হাল ছাড়া ভাব এনে সমরেশবাবু বললেন, কোথায় আর খেল! এক সপ্তাহ যেতেই সব অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ বাতিল করে দিল। ফিরে গেল নিজের ওষুধে। সকালে উঠে ওষুধ পুরিয়া করে রাখা, সময় ধরে সেগুলো খাওয়া দাদার অনেকদিনের অভ্যাস। আবার সেভাবেই ওষুধ খাওয়া শুরু করেছিল। আমরা এটা জানলাম হারুর থেকে। দাদাকে এসে বললাম, এখনই কেন বন্ধ করলে অ্যালোপ্যাথি? আরও অন্তত কয়েকমাস খাও। এতবড় একটা ফাঁড়া থেকে অ্যালোপ্যাথিই তো বাঁচাল। দাদা আমার কথা শুনল না। বলল, হোমিওপ্যাথি অ্যালোপ্যাথির চেয়ে কোনও অংশ কম নয়। বরং অ্যালোপ্যাথিতে অনেক সাইড এফেক্ট থাকে।

সমরেশবাবুর বলা শেষ হতেই ভিতর দিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক। পরনে অফিসের পোশাক, পায়ে অবশ্য হাওয়াই চটি। হাতজোড় করে দীপকাকু এবং মি. সাহার উদ্দেশে বললেন, নমস্কার, আমি এ বাড়ির ছোটছেলে কমলেশ রায়।

দীপকাকু ভঙ্গিতে প্রতি নমস্কার জানালেন। অফিসার সাহা কিন্তু মেজাজের গলায় বলে উঠলেন, আপনাকে তো ডাকা হয়নি। আপনি কেন এলেন ঘরে?

থতমত খেয়ে গেলেন কমলেশ রায়। বললেন, না, মানে, মেজ অফিসে ফোন করে বলল বাড়িতে পুলিশ এসেছে। সার্চ হচ্ছে বড়দার ঘর। অফিসে থেকে ফিরে এক গ্লাস জলও খাইনি। জাস্ট জুতোটা ছেড়ে চলে এলাম দেখতে কেন হচ্ছে তল্লাশি!

–মেজদা সার্চ হচ্ছে বললেন অথচ কেন হচ্ছে বলেননি? বিস্ময়ের গলায় প্রশ্নটা রাখলেন মি. সাহা।

কমলেশবাবু বললেন, বলেছে মেজদা। ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার হয়নি। আমাদের বোন নাকি রেলপুলিশে কমপ্লেন্‌ট করেছে, বড়দার অ্যাক্সিডেন্টটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে তার। ফোনে মেজদার থেকে এটা জানার পর বোনকে কল করলাম। ফোন তুলছে না সে। কেন বড়দার মৃত্যুটাকে শুধুই অ্যাক্সিডেন্ট মনে হচ্ছে না বোনের, জিজ্ঞেস করতাম। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কেন সে এই অভিযোগ আনছে?

– – আপনার বোন কার থেকে নাকি খবর পেয়েছেন, ডা. রায়কে ধাক্কা মেরে ট্রেনের সামনে ফেলা দেওয়া হয়েছে। সত্যিই এটা ঘটেছে কি না, ঘটলে কে ঘটিয়েছে? সেটাই ইনভেস্টিগেট করছি আমরা। – ধাক্কা মেরে ফেলা হয়েছে ট্রেনের নীচে! বিস্ময়ের সঙ্গে অফিসার সাহার কথাটা রিপিট করলেন কমলেশ রায়।

ঝিনুক বুঝতে পারছে কমলেশবাবুর মুখ বন্ধ করতেই সাহাবাবু তথ্যটা এভাবে পরিবেশন করলেন। এবার দীপকাকুকে বললেন, আমাদের এখানকার কাজ মোটামুটি শেষ। তাই তো নাকি, মি. বাগচী ?

দীর্ঘক্ষণের অনুসন্ধান পর্বে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন অফিসার সাহা। দীপকাকু সেটা অনুধাবন করে বললেন, হ্যাঁ, আর কিছু দেখার নেই। একবার জাস্ট ডা. রায়ের গাড়িটা দেখব। আপনি কন্সটেবলদের নিয়ে থানায় চলে যান। আমি তো বাড়ি ফিরব। ট্যাক্সি নিয়ে নেব’খন।

–ওকে, তাই হোক। বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন অফিসার সাহা।

দীপকাকু এবার সমরেশবাবুকে বললেন, আপনার দাদার গাড়ি বাড়িতেই আছে তো?

-আছে। গ্যারেজ বাগানে। চলুন। বলেও দাঁড়িয়ে গেলেন সমরেশবাবু। ফের বললেন, গাড়ির কাগজপত্র, মানে, ইন্সুরেন্স পেপার, পারমিট এসব কিন্তু আমার কাছে রেখে দিয়েছি। সেগুলো কি নিয়ে আসব?

—নিয়ে আসুন। গাড়ির চাবিটাও আনবেন। ভিতরটা একবার দেখব।

দীপকাকুর কথা শুনে ভিতর দরজার দিকে এগোলেন সমরেশবাবু। কমলেশবাবু দীপকাকুকে বললেন, চলুন, গ্যারেজে নিয়ে যাই আপনাকে ।

বাইরে সন্ধে নেমে গিয়েছে। দোতলার জানলা গলে আলো পড়েছে বাড়ির গা লাগোয়া বাগানে। একধারে গ্যারেজঘর। আলো জ্বলছে সেখানেও। দীপকাকু ডা. রায়ের গাড়ি খুঁটিয়ে দেখছেন। গাড়ির ভিতরে ঢুকে এটা সেটা দেখে নিয়ে খুললেন ড্যাশবোর্ড। প্লাগওলা তার, কিছু টুলস বেরল। আবার সব জায়গা মতো রেখে বন্ধ করলেন। আজকের তল্লাশি পর্বে দীপকাকু শুধুমাত্র একটি কাগজই পকেটে পুরেছেন। তাতে কী আছে জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে ঝিনুকের। কিন্তু জানার এখন উপায় নেই ।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন দীপকাকু। বললেন, ঠিক আছে, দেখা হয়ে গিয়েছে আমার। গাড়ি লক করে শাটার টেনে দিন গ্যারেজের সমরেশবাবু গ্যারেজ বন্ধ করছেন। দীপকাকু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমলেশবাবুকে বললেন, আজকের মতো আমাদের কাজ শেষ। পরে দরকার পড়লে আবার আসতে হতে পারে।

—নিশ্চয়ই আসবেন। বড়দার মৃত্যুর পিছনে যদি কোনও অপরাধমূলক ব্যাপার থেকে থাকে, আমরাও চাই সেটা প্রকাশ্যে আসুক। বললেন কমলেশবাবু।

দীপকাকু এগিয়ে যাচ্ছেন গেটের দিকে। ঝিনুক অনুসরণ করতে যাবে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে উপর থেকে বস্তার মতো কী যেন আছড়ে পড়ল দীপকাকুর সামনে। আওয়াজ হল বিকট! বুক ফাঁকা হয়ে গেছে ঝিনুকের। একটুর জন্য বেঁচে গেলেন দীপকাকু! ডা. রায়ের দুই ভাই কী পড়ল দেখতে ছুটে এলেন। ঝিনুকও এগিয়ে গেল। গাছশুদ্ধ বিশাল টব পড়েছে ছাদ থেকে।

দীপকাকু উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলেন, ছাদের সিঁড়িটা কোন দিকে? দেখতে হবে কে ফেলল টবটা?

—আসুন আমার সঙ্গে। বলে বাড়ির পিছন দিকে দৌড়োলেন সমরেশবাবু।

ঝিনুকরা ছাদে চলে এসেছে। আলো জ্বালানো হয়েছে ছাদের। পাঁচিলের উপর টবটা যেখানে ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ঝিনুকরা যখন সিঁড়ি দিয়ে এল, ছাদের দরজার খিল লাগানো ছিল। সেই যুক্তিতেই সমরেশবাবু এখন বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে হনুমান বা বিড়ালের কাজ। অথবা পাখিরা ঝটাপটি করতে করতে ফেলে দিয়েছ টবটা।

–আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। সন্ধে নেমে গেলে এত অ্যাকটিভ থাকে না পশুপাখিরা। আমি নিশ্চিত এটা তাদের থেকে উন্নত প্রাণীর কাজ। কেউ ছাদে উঠে কাজটি করে, খিল দিয়ে নেমে গেছে। বললেন দীপকাকু।

সমরেশবাবু বলে ওঠেন, কে হতে পারে সেই লোক?

-জানা যেত, যদি না আপনি আমার আগে এখানে এসে দাঁড়াতেন। বদমাইশটার পায়ের ছাপ মুছে গিয়েছে।

– -আমি মুছে দিয়েছি মিন করছেন না তো?

সমরেশবাবু কথার কোনও উত্তর না দিয়ে দরজার দিকে এগোলেন দীপকাকু।

ঝিনুক, দীপকাকু এখন ট্যাক্সিতে। ঝিনুককে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরবেন দীপকাকু। একটু আগেই তাঁকে প্রায় খুন করার চেষ্টা হয়েছে, সেটা নিয়েই নিশ্চয়ই ভেবে যাচ্ছেন। ঝিনুকও ওই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটার ঘোর এখনও কাটাতে পারছে না। আর একটু হলেই দীপকাকু ‘নেই’ হয়ে যেতেন।

নোটিফিকেশনের সাউন্ড এল দীপকাকুর মোবাইলে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বার করলেন। স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে পড়তে লাগলেন টেক্সট, হাসি ফুটে উঠল মুখে। ফোন সেটটা ঝিনুককে দিয়ে বললেন, পড়ো।

এস এম এস এসেছে। রোমান হরফে লেখা আছে, ‘ওটা ছিল থ্রেট। ইচ্ছে করে টিপ ফসকেছি, তাই বেঁচে গেলেন। কেসটা ছেড়ে দিন। নয়তো পরের বার টিপ ফসকাবে না।’… পড়া শেষ করে ঝিনুক অবাক হয়ে দীপকাকুর দিকে তাকায়। উনি মুচকি হাসিসহ বললেন, কোন নাম্বার থেকে এসেছে দেখো!

নাম্বারটা দেখে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে যায় ঝিনুক ! এ তো সেই নাম্বার, ডা. রায়ের মৃত্যুর আগে যে নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। এটা দেখার পরও দীপকাকু হাসছেন!