আড়ালে আততায়ী – ৪

৷৷ চার ৷৷

মাঝে একটা দিন কেটে গিয়েছে। বৃথা কাটেনি। দীপকাকু ডা. রায়ের তদন্তের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন গতকাল। ঝিনুককে সঙ্গে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। আজ সঙ্গে নিয়েছেন। মোটরবাইকে দীপকাকুর পিছনে বসে ঝিনুক চলেছে। শিয়ালদা স্টেশনে, রেল পুলিশের থানায়। ডা. রায় যেহেতু ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছেন, সেটার তদারকির দায়িত্ব রেল পুলিশের। ছোট করে বললে জি আর পি’র। রাজ্য পুলিশেরই একটা অংশ জি আর পি, এরা রেলের আওতাভুক্ত অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা দেখাশোনা করে। দীপকাকুর লালবাজারের বন্ধু রঞ্জনকাকুর চেনা জানা আছে রেল পুলিশের লোকজনের সঙ্গে। রঞ্জনকাকুর সাহায্য নিয়ে দীপকাকু চলেছেন ইন্সপেক্টর জহর সাহার সঙ্গে দেখা করতে। জহর সাহা হচ্ছেন ডা. রায়ের নকডাউন কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। অর্থাৎ ডা. রায় কী ভাবে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেলেন, সেটার তদন্ত করছেন। ট্রেনের নীচে পড়ে মারা যাওয়ার সমস্ত ঘটনারই তদন্ত হয় রেল পুলিশের পক্ষ থেকে। এমনটাই রুটিন। এ সব কেসে বেশির ভাগই প্রমাণ হয়, ব্যক্তিটি আত্মহত্যা করেছে অথবা তার অসাবধানতায় অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটেছে। ডা. রায়ের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছে জানতে চান দীপকাকু। ডা. রায়ের আত্মহত্যার কোনও কারণ দীপকাকু খুঁজে পাচ্ছেন না। যে মানুষটা নিজের ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন, দেখা না করেই তিনি হঠাৎ আত্মহননের পথ বেছে নেবেন কেন? এরপর পড়ে রইল আর একটা সম্ভাবনা, অসাবধানতা। এত অসাবধান হলেন কেন ডা. রায়? কী চিন্তা চলছিল মাথায়? গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বোঝার জন্যই তাঁকে রেল পুলিশের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। জি আর পি’র সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য গতকাল গিয়েছিলেন লালবাজারে রঞ্জনকাকুর কাছে। রঞ্জনকাকু ফোনে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার জহর সাহার সঙ্গে দীপকাকুর কথা বলিয়ে দেন। মি. সাহা দীপকাকুকে বলেছেন, এই ধরনের নকডাউন কেসের ক্ষেত্রে মোটরম্যান, মানে ট্রেনের চালকের বয়ান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তিনি একেবারে সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন কোন পরিস্থিতিতে মানুষটা ট্রেনের নীচে এসে পড়ছে কোর্টও মোটরম্যানের সাক্ষ্যর উপর ভরসা করে বেশি।… এই কথা বলার পর মি. সাহা জানিয়েছেন, যে লোকাল ট্রেনের নীচে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ডা. রায়ের, সেটার মোটরম্যান অ্যাক্সিডেন্টের পরই ওয়াকিটকিতে প্রথমে সেই ট্রেনের গার্ডকে রিপোর্ট করেন। তারপরই আগামী স্টেশনের, মানে বালিগঞ্জের স্টেশন মাস্টারকে ঘটনার কথা জানান। এমনটাই নিয়ম। এ ছাড়াও আর একটা অবশ্য কর্তব্য থাকে তাঁর, ডিউটি শেষ হওয়ার পর অফিসে এসে নকডাউনের রেজিস্টারে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা লিখতে হয়। মোটরম্যান লিখেওছেন সেটা মি. সাহা সব ক’টা রিপোর্ট খতিয়ে দেখেছেন। দেখার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ডা. রায়ের অসাবধানতায় অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে। কোর্টে এই মতামতটাই পেশ করবেন তিনি, সমস্তটা শুনে দীপকাকু মি. সাহাকে বলেছেন যাঁর মৃত্যু হয়েছে ওই অ্যাক্সিডেন্টে, তাঁকে তিনি চেনেন। ওঁর দেওয়া একটা কেসের তদন্ত করছেন দীপকাকু। কেন যেন দীপকাকুর মনে হচ্ছে ওই কেসের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টের কোথাও একটা যোগ আছে। সেটা বোঝার জন্য তিনি একবার সেই মোটরম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চান, যাঁর গাড়ির নীচে পড়ে মারা গিয়েছেন ডা. রায়।

মি. সাহা বলেছেন, ঠিক আছে। আমি দেখছি কী ভাবে মোটরম্যানের সঙ্গে কথা বলানো যায়।… খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি দীপকাকুকে। আজ দুপুর এগারোটা নাগাদ মি. সাহার ফোন আসে। বলেন, বিকেল চারটেয় চলে আসুন আমাদের থানায় মোটরম্যান শীতল সাধুখাঁকে ডেকে পাঠিয়েছি। আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব।

মি. সাহা দীপকাকুর জন্য যা কিছু করছেন, সবই রঞ্জনকাকুর অনুরোধে। রঞ্জনকাকুর পোস্টিং পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে। মি. সাহার ফোন পাওয়ার পরই দীপকাকু ঝিনুককে কল করেন। বলেন, তিনটে নাগাদ রেডি থেকো। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।

কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, সমস্তটা বললেন ঝিনুকদের বাড়ি এসে। উইক ডেজ হলেও, বাবা আজ বাড়ি ছিলেন। নিজের সিকিউরিটি এজেন্সির অফিসে যাননি। একটু জ্বর হয়েছে। দীপকাকুর থেকে সব কিছু শুনে বাবা বলেছিলেন, আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। ডা. রায় তোমায় তদন্ত করতে দিয়েছিলেন। মারা গেলেন তিনি। তাও কেন কাজটা চালিয়ে যাচ্ছ? তোমার পারিশ্রমিক কে দেবে?

এর উত্তরে দীপকাকু বলেছেন, দেখুন রজতদা, গোয়েন্দাগিরি আমার পেশা অবশ্যই, তার সঙ্গে নেশাও তো বটে। ইচ্ছে করলে আমি কি আর একটা দশটা, ছ’টার চাকরি জোটাতে পারতাম না? সেই এলেম এবং কোয়ালিফিকেশন দুটোই আমার ছিল। রহস্য ভেদের নেশাই আমাকে এই পেশায় এনে ফেলেছে। ডা. রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় আমি গভীর এক রহস্যের আভাস পাচ্ছি।

-কী কারণে ব্যাপারটাকে তোমার এত রহস্যজনক মনে হতে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবা।

দীপকাকু বললেন, কারণ বেশ কিছু আছে। সে সব এখনই বলা মতো জোরালো নয়। তবে একটা পয়েন্টকে অগ্রাহ্য করা যায় না —কী সেটা? এটা জানতে চেয়েছিল ঝিনুক।

দীপকাকু তখন বলেন, ডা. রায়ের গাড়ির ড্রাইভারের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার সাক্ষ্য আমার কাছে ভীষণ ডাক্তারবাবুর মৃত্যুর আগে নিকটজন বলতে সেই একমাত্র স্পটের কাছাকাছি ছিল। সেই সময় ডাক্তারবাবু ঠিক কী রকম মুডে ছিলেন, ড্রাইভার নন্দ গড়াই বলতে পারবে। সে হঠাৎ উধাও হল কেন?

—উধাও মানে কি ফেরার? নির্দিষ্ট ভাবে জানতে চেয়েছিলে বাবা।

দীপকাকু বললেন, ফেরার ঠিক নয়। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করছে। কম্পাউন্ডার তাপস কুণ্ডুর থেকে ড্রাইভারের ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম। বেশ কয়েকবার করলাম কল, প্রতিবার শুনছি সুইচড অফ। ফের তাপস কুণ্ডুকে ফোন করে নন্দ গড়াইয়ের বাড়ির ঠিকানা নিলাম। ডা. রায়ের বাড়ির কাছেই ওয়াটগঞ্জে থাকে। আজ সকালে গিয়েছিলাম সেখানে। বস্তি মতো এলাকা। ওদের টিনের চালের বাড়িটা রাস্তার উপরেই। কড়া নাড়তে বেরিয়ে এলেন বয়স্ক একটি লোক। নন্দ গড়াইয়ের খোঁজ করতে, বললেন, বাড়ি নেই। ডিউটিতে গিয়েছে। ওঁর পরিচয় জানতে চাইতে, জানালেন উনি নন্দর বাবা। তারই মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল দুই মহিলা, একজনের কোলে বাচ্চা। আন্দাজ করা যায় সে নন্দর স্ত্রী। অন্যজন নন্দর মা। বাড়ির লোকেদের যখন বললাম, নন্দর সঙ্গে খুব দরকার, ওকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। নন্দ বাড়ি ফিরবে কখন? নন্দর স্ত্রী বলল, কবে বাড়ি ফিরবে ঠিক মতো বলা যাচ্ছে না। লরিতে মাল নিয়ে পাটনা গিয়েছে। সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। আমি বললাম, বাইরে থাকতেই পারে, কিন্তু ওকে ফোনে পাচ্ছি না কেন? আপনারা কীভাবে যোগাযোগ রাখছেন? ফের নন্দর বউই উত্তর দিল, ও যখন গাড়ি চালায় ফোন অফ রাখে। যখন চালায় না, নিজেই আমাদের ফোন করে।… এতদূর বলে চুপ করে গিয়েছিলেন দীপকাকু। বাবা বলেছিলেন, সব তো ঠিকই আছে। এর মধ্যে তুমি উধাও হওয়ার কী দেখলে? গাড়ি চালানোর সময় ফোন ধরতে না চাওয়া তো ভাল স্বভাব। মোবাইল বন্ধ অবস্থায় কেউ কল করলে তার নাম্বার সেট অন করার সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় ফোন কোম্পানি। নন্দ এতক্ষণে এক দু’বার ফোন অন করেছে নিশ্চয়ই। তোমার নাম্বার তার কাছে আননোন। তাই আর কলব্যাক করেনি।

খানিক নীরব থেকে দীপকাকু বলেছিলেন, আমি ব্যাপারটা ওই লাইনে ভাবছি না। আমার যেটা অস্বাভাবিক লাগছে, নন্দ গড়াই চালাত লাইট গাড়ি। চারচাকা প্রাইভেট কার। এই ডিউটিতে খাটুনি বেশি নেই। সে হঠাৎ লরির মতো হেভি গাড়ি বেছে নিল কেন? পরিশ্রম প্রচুর। দিন-রাত জুড়ে গাড়ি চালাতে হবে।

—বেশি রোজগার হবে বলে কাজটা ধরেছে। পরিশ্রম যখন অনেক, টাকাও নিশ্চয়ই বেশি। এটা বলেছিল ঝিনুক।

উত্তরে দীপকাকু বললেন, ওর যদি বেশি রোজগারের প্রয়োজন থাকত, প্রাইভেট কার না চালিয়ে ট্যাক্সি, অ্যাপ ক্যাব কিংবা লরি চালাতে পারত আগেই। ডাক্তারবাবুর গাড়ি চালিয়ে প্রয়োজন মিটে যাচ্ছিল নন্দ গড়াইয়ের। মালিক মারা যেতেই অন্য কোনও লাইট গাড়ির চাকরি না খুঁজে, সরাসরি হেভি গাড়ি চালাতে যাওয়াটা বেশ বেমানান।

—অর্থাৎ তোমার অনুমান ডা. রায়ের ড্রাইভার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? প্রশ্ন রেখেছিলেন বাবা।

দীপকাকু বললেন, আমার ধারণা ডা. রায়ের অ্যাক্সিডেন্টের পরে এমন কোনও ঘটনা নন্দ গড়াই জানে, যেটা ও কাউকে বল চাইছে না। বললে বিপদে পড়তে পারে নন্দ গড়াই। ডা. বারের বাড়িতে যতটুকু ইনফর্মেশন না দিলে নয়, সেটুকু বলে সে আপন আড়ালে চলে গিয়েছে। আর কোনও প্রশ্নের মুখে পড়তে চাইছে না।

এই পয়েন্টটা আসতে ঝিনুক বলেছিল, আর কে জেরা করবে ওকে? সব তো মিটে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুর পোস্ট মর্টেম হয়েছে বাড়ির লোক দাহ করে ফেলেছে বডি। পারলৌকিক কাজ হয়ে গেল কাল। কেস তো এক প্রকার শেষ। নন্দ গড়াই তো আর জানে না কোনও এক গোয়েন্দা তদন্তটা চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তা হলে সে কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে?

— পালিয়েছে তদন্ত হতে পারে বুঝে। এমন কিছু ঘটেছিল ডা. রায়ের মৃত্যুর সময়। নন্দর মনে হয়েছে এটা নিয়ে পরে লোকজনের টনক নড়তে পারে। তখন ওকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। ঘটনাটা বললে ওর নিজের ফেঁসে যাওয়ার চান্স আছে। প্রশ্নটা পুলিশও ওকে করতে পারে, যদি ডা. রায়ের বাড়ির লোক পুলিশের শরণাপন্ন হয় বলেছিলেন দীপকাকু।

এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বাবা জানতে চান, কোন ব্যাপারে বাড়ির লোকেরা পুলিশের শরণাপন্ন হতে পারে বলে তোমার অনুমান?….উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাবা ফের বলতে থাকেন, একটা ব্যাপার খেয়াল রেখো, জি আর পি ডা. রায়ের বড়ি বাড়ির লোকের জিম্মায় দেওয়ার সময় ওঁর সঙ্গে যা যা ছিল, তার একটা লিস্টও দিয়েছে। জিনিসগুলো এখনও দেয়নি। অফিসিয়াল কিছু কাজ সারা হয়ে গেলেই দিয়ে দেবে। অর্থাৎ সমস্তটাই বুঝে নিয়েছে ডা. রায়ের ভাইয়েরা। এরপর আর কোন ব্যাপার পড়ে থাকতে পারে সন্দেহ করার মতোন?

— সেটা আমি কী করে জানব! নন্দ গড়াইয়ের হঠাৎ করে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া থেকে আন্দাজ করছি কিছু তথ্য গোপন করতে চাইছে সে। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। বলার পর দীপকাকু ঝিনুককে তাড়া দিয়েছিলেন বেরিয়ে পড়ার জন্য। কেন না ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে তিনটে পার করেছে। কুঁদঘাট থেকে শিয়ালদা স্টেশন অনেকটাই পথ।

মৌলালি মোড় ক্রস করল দীপকাকুর বাইক। পিছনে বসা ঝিনুক আড়চোখে নিজের রিস্টওয়াচটা দেখে, চারটে বেজে গিয়েছে। তার মানে লেট হয়ে গেল। আর একটু পরেই শিয়ালদা স্টেশন।

জি আর পি থানায় ঢুকে ইন্সপেক্টর জহর সাহা কোথায় বসেন জেনে নিলেন দীপকাকু। তারপর ওঁর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিকরা। জহর সাহার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে দীপকাকুর, সাক্ষাৎ হচ্ছে প্রথমবার। নমস্কারের ভঙ্গি করে দীপকাকু তাই বললেন, আমিই দীপঙ্কর বাগচী। সরি একটু লেট হয়ে গেল ।

মি. সাহার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। ভারী চেহারা। সপ্রতিভতার সঙ্গে বলে ওঠেন, আরে!, আপনার পথ চেয়েই তো বসে আছি। এই তো, যার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন, তিনি এসে গিয়েছেন অনেকক্ষণ।

জহর সাহার টেবিলের এ পারে তিনটে চেয়ারের একটাতে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। সাহাবাবু তাঁর দিকেই হাত নির্দেশ করেছেন। বাকি দুটো চেয়ারে ঝিনুকরা বসল। দীপকাকুর সঙ্গে মোটরম্যান শীতল সাধুখাঁর আলাপ করালেন জহর সাহা। দু’জনের মধ্যে নমস্কার বিনিময় হল। দীপকাকু ঝিনুকের পরিচয় দিলেন নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। অনেকের মতো জহরবাবু, শীতলবাবুর মুখেও অবাক ভাব ফুটে উঠল। কারণ, ঝিনুক মেয়ে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সহকারী। বয়সটাও অল্প। দীপকাকুর পরিচয় দেওয়ার সময় মি. সাহা বললেন, এঁকে লালবাজার থেকে পাঠানো হয়েছে। বোঝাই গেল শীতল সাধুখাঁ যাতে দীপকাকুকে বিশেষ গুরুত্ব দেন, সেই জন্যই বলছেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললে হয়তো শীতলবাবু ততট পাত্তা দিতেন না। আলাপ পর্বে আরও একটা নতুন জিনিস জানা হল, শীতলবাবুর অফিসিয়াল ডেজিগনেশন, এল পি পি। ভেঙে বললে, লোকোমোটিভ পাইলট প্যাসেঞ্জার। এমনিতে মোটরম্যান কথাটাই চালু। রেলের বাইরের লোক এঁদের ড্রাইভার বলেই সম্বোধন করে থাকে।

শীতল সাধুখাঁর বয়স চল্লিশের সামান্য উপরেই মনে হয়। গাঙ্গে শৌখিন দাড়ি। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে দীপকাকু ওঁকে বললেন, কোন দুর্ঘটনা নিয়ে আমি আপনার কথা শুনতে এসেছি, মি. সাহার থেকে নিশ্চয়ই জেনেছেন। এবার আমায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটার আগের মুহূর্তর একটু বিস্তারিত বর্ণনা দিন। মানে আপনি রিপোর্টে যা লিখেছেন, তার চেয়ে বেশি কিছু।

মন দিয়ে দীপকাকুর বক্তব্য শুনলেন শীতল সাধুখাঁ। তারপর শান্তভাবে বললেন, নকডডাউন রেজিস্টারে আমাদের ডিটেলেই সব কিছু লিখতে হয়। আপনি কি সেই রিপোর্ট পড়ে দেখেছেন?

–না, দেখিনি, মি. সাহা আমাকে মোটামুটি জানিয়েছেন। আমি আসলে রিপোর্টে যা না লিখলেও চলে, সেই ব্যাপারগুলো জানতে চাইছি। যেমন ধরুন, ডা. অলকেশ রায় কাউকে ধাওয়া করতে গিয়ে কি ট্রেনের সামনে এসে পড়েছিলেন? নাকি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পার হচ্ছিলেন রেলের ট্র্যাক? লাইন পার হওয়ার সময় হঠাৎ কি পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলেন? কেউ ডাকলে মানুষ যে ভাবে ফিরে তাকায়। এরকম আরও কোনও ইন্সিডেন্স কি মনে পড়ছে আপনার ? জিজ্ঞেস করার পর দীপকাকু উত্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলেন শীতল সাধুখাঁর দিকে।

দৃষ্টি মেঝেতে নামিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গিয়েছেন শীতলবাবু। সেদিনের সেই অঘটনের মুহূর্তটা মনে করার চেষ্টা করছেন। যেটা ভুলে যেতেই চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। দীপকাকুর অনুরোধে মনে করতে হচ্ছে। মুখ তুললেন শীতল সাধুখাঁ। চাহনি এমন সুদৃ রপ্রসারী যেন সেইদিনের অ্যাক্সিডেন্টের সময়টা দেখতে পাচ্ছেন। বলতে শুরু করলেন, আপ লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল চালাচ্ছিলাম। ঢাকুরিয়া স্টেশন ছেড়ে বালিগঞ্জের দিকে যাচ্ছি। গাড়ির স্পিড ছিল নিয়ম মেনেই। কাঁকুলিয়া লেভেল ক্রসিং-এর আগে হুইশেল দিই। ট্র্যাক তখন পুরো ফাঁকা। স্পিড কমানোর প্রশ্ন নেই। হঠাৎ দেখি বাঁ দিক থেকে আমার ব্রেকিং ডিসট্যান্সের ভিতরে চলে এসেছেন এক ভদ্রলোক। মানে ওঁর থেকে ইঞ্জিনের দূরত্ব এতই কম, সাডেন ব্রেক মারলে আমার গাড়ির বেশ কিছু বগি উল্টে যাবে । হেভেলি ইনজিওরড হবে প্যাসেঞ্জাররা, মারাও যাবে অনেকে। প্রচুর ক্যাজুয়ালটি এড়াতেই গাড়ি রান করিয়ে যেতে হয়েছিল। ভদ্রলোকের বড়ি কাটেনি, ইঞ্জিনের ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে লাইনের পাশে পড়লেন। ওই ধাক্কায় কেউ বাঁচে না।

দীপকাকু যা জানতে চাইছেন, এই বয়ানে সেটা পরিষ্কার হল না। ফলে দীপকাকুকে ফের নির্দিষ্ট ভাবে জিজ্ঞেস করতে হল, ধাক্কা লাগার আগের মোমেন্টে ডা. রায় কি ইঞ্জিনের দিকে তাকিয়েছিলেন?

–না, শার্টের পকেট থেকে কী যেন বার করতে যাচ্ছিলেন।

—আই গট ইট। ব্যস, আর কিছু বলতে হবে না। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন দীপকাকু। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। ঝিনুকসহ বাকি দু’জনের মুখে বিস্ময়। দীপকাকুর খুশির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ঝিনুক। ডা. রায় যে শার্টের পকেট থেকে কিছু বার করতে গিয়েছিলেন, এই হিসেবটা সম্ভবত আগেই করেছিলেন দীপকাকু। অঙ্কটা মিলে যেতে ভরসা পেয়েছেন। তার মানে ওঁর ভাবনা চলছিল ঠিক পথেই। ঝিনুকের মনের কথাই বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর জ সাহা, কী মশাই, মনে হচ্ছে কোনও একটা দিশা পেলেন?

– পেয়েছি। তবে সেটা খুবই প্রাথমিক স্তর। দেখি এই কুটা পরে কতটুকু এগোতে পারি। বলার পর দীপকাকু মোটরম্যানকে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মি. সাধুখাঁ। আমাকে সময় দিলেন এতক্ষণ। ভবিষ্যতে যদি দরকার পড়ে আশা করি আপনার থেকে একই রকম সাহায্য পাব।

সৌজন্যের হাসি হেসে ঘাড় কাত করলেন শীতল সাধুরা বললেন, আমি তা হলে এখন চলি?

দীপকাকু সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। চেয়ার থেকে উঠে মি. সাধুখাঁ জহর সাহাকে বললেন, চলি, স্যার।

মি. সাহা হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক সারলেন সাধুখাঁর সঙ্গে সাধুখাঁ এগিয়ে গেলেন দরজা লক্ষ্য করে। জহর সাহা একটু ঝুঁকে এসে দীপকাকুকে বললেন, আপনার ক্লায়েন্ট শার্টের পকেট থেকে কী বার করতে গিয়েছিল বলে মনে করছেন ?

—ফোনসেট। উনি যখন রেলের ট্রাকের উপরে, কেউ এঁকে ফোন করেছিল। হয় ট্রেন আসছে জেনে করেছিল অথবা না জেনে আমার যেটা এখন সব চেয়ে আগে যেটা জানা দরকার, ওই সময় যে কলটা এসেছিল তার নাম অথবা নাম্বারটা। সেটা আপনি আমায় দিতে পারবেন। বললেন দীপকাকু।

অফিসার সাহা ঘাড় নেড়ে বলেন, তা পারব। মৃতের সঙ্গে থাকা সমস্ত জিনিসপত্র এখনও আমাদের কাস্টডিতে আছে। যার মধ্যে আছে ওঁর অ্যান্ড্রয়েড ফোন। যদিও কেসস্টাডি কমপ্লিট করে ফেলেছি। রিপোর্ট কোর্টে প্রোডিউস করব। কোর্ট থেকে অর্ডার পেলেই জিনিসপত্র ফেরত দেব মৃতের প্রথম ওয়ারিশনকে।

– প্লিজ, এটা এখনই আপনি করবেন না। রিপোর্ট দিতে একটু সময় নিন। যদি দেখা যায় সত্যিই অ্যাক্সিডেন্টের একটু আগে ওঁকে কেউ ফোন করেছিল, তখন আপনার থেকে সেই নাম্বারটা নিয়ে কলারের সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাকে। এছাড়াও আমার ক্লায়েন্টের বসবাসের জায়গাটা একবার সার্চ করা দরকার। সেটা করার অধিকার আমার নেই। আপনার আছে। আপনি যেহেতু নকডডাউন কেসটার তদন্ত অফিসার। বললেন দীপকাকু, গলায় অনুরোধের সুর।

একটু ভেবে নিয়ে অফিসার সাহা বলতে থাকেন, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমি যে তদন্তটা চালিয়ে যেতে চাই, তার কারণটা তো উপরওলাকে জানাতে হবে। মানে, আমার হায়ার অথারিটিকে। পরে কোর্টকেও জবাব দিতে হবে কোন গ্রাউন্ডে কেসটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে একটা ফোন এসেছিল, এই বেসিসে কেস টানা যাবে না। খুবই দুর্বল পয়েন্ট। ফোন যে কোনও সময় কারুর কাছে আসতেই পারে। আর যদি দেখা যায়, ফোন আসেনি। আপনার ক্লায়েন্ট অন্য কিছু বার করতে যাচ্ছিলেন পকেট থেকে। তখন তো কেস চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই থাকবে না।

– তা হলে উপায়? দীপকাকুর গলায় স্পষ্ট হতাশা।

আবার একটু চিন্তা করে নিয়ে জহর সাহা বললেন, একটা উপায় ছিল। যদি মৃতের রক্ত সম্পর্কিত কোনও আত্মীয় জি আর পিতে এফ আই আর করত এই বয়ানে যে, অ্যাক্সিডেন্টটার পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র আছে আমার ধারণা, এটা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। আমার আত্মীয় একেবারেই অসাবধানী নন। কেউ হয়তো তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের সামনে ফেলে দিয়েছে।… জি আর পি যদি কমপ্লেন গ্রাহ্য না করে, আত্মীয়টি কোর্টেও যেতে পারে। কোর্ট তখন রেলকে অর্ডার করবে তদন্ত করতে।

থামলেন মি. সাহা। একটু বিরতি নিয়ে ফের বলে উঠলেন, আপনার ক্লায়েন্টের বাড়ির লোকেরা কোনও কমপ্লেন করবেন বলে তো মনে হয় না। কেনই বা করবেন? অ্যাপারেন্টলি এটাকে সাধারণ একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হবে। আপনিই শুধু নান করছেন এর মধ্যে কোনও রহস্য আছে। আপনার এই ধারণাটা কি ক্লায়েন্টের কোনও ভাইকে বোঝাতে পারবেন? তারপর তিনি যদি কমপ্লেন করেন, আমি তদন্ত চালিয়ে যেত পারব।

–নাঃ, ভাইদের বোঝাতে পারব না। দু’ভাইয়ের সঙ্গে তেমন সদ্ভাব ছিল না ডাক্তারবাবুর। বলার পর দীপকাকু কী যেন ভাবতে লাগলেন। ভাবনা শেষ করে বললেন, দেখি, এফ আই আরটা কী ভাবে করানো যায়।

দীপকাকু কাকে দিয়ে করাবেন কমপ্লেট, আন্দাজ করতে পারছে না ঝিনুক। ডাক্তারবাবুর রক্ত সম্পর্কিত সব চেয়ে কাছের লোক তো নিরুদ্দেশ। সায়ন রায়, ডাক্তারবাবুর একমাত্র সন্তান। যার খোঁজে তদন্তে নেমেছিলেন দীপকাকু। এখন তো মনে হচ্ছে ঘুরে গিয়েছে তদন্তের অভিমুখ। অফিসার জহর সাহা বলে উঠলেন, আচ্ছা, আপনি যে বলছেন ওই ডাক্তারবাবুর বাসস্থান সার্চ করতে, তা সেখানে গিয়ে আমি কী খুঁজব? আপনার কেসের তো কিছুই জানি না।

-একটা বিশেষ বাধ্যবাধকতার কারণে আমার কোষের বিষয়টা আপনাকে বলতে পারছি না। সময় মতো নিশ্চয়ই বলব আপনি শুধু ডাক্তারবাবু বাড়ি গিয়ে সার্চ করার ভান করবেন। আমাকে রাখবেন সঙ্গে। যা দেখার আমি দেখে নেব। এছাড়াও ডাক্তারবাবুর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আমার কথা বলানোর ব্যবস্থা করে দেবেন কাইন্ডলি।

– সে সব হয়ে যাবে। আগে তো কমপ্লেন্ট করানোর ব্যবস্থা করুন। আর হ্যাঁ, এত কিছু করার পর যদি দেখা যায় নকডডাউনটা নিছকই একটা অ্যাক্সিডেন্ট, এর পিছনে কোনও রহস্য নেই। তা হলে কিন্তু ডিপার্টমেন্টে আমার পজিশন একটু খাটো হয়ে যাবে। সেটা মাথায় রাখবেন। নেহাত লালবাজার থেকে সুপারিশ এসেছে, তাই আপনার অনুরোধ এড়াতে পারছি না।

অফিসার সাহার কথাগুলো শুনে একটু যেন থম্ মেরে গেলেন দীপকাকু। প্রেস্টিজে লেগেছে বোধহয়। শান্ত গলায় বলে উঠলেন, আপনার সঙ্গে এটা আমার প্রথম সাক্ষাৎ। তাই এত সংশয়ে ভুগছেন। আলাপ গড়ালে, মানে এক সঙ্গে কাজ করতে থাকলে, আশা রাখি আপনার দুশ্চিন্তা কমাতে পারব।

—তেমনটা হলেই ভাল। বললেন অফিসার সাহা।

দীপকাকু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। ঝিনুকও উঠে পড়ল। মি. সাহার সঙ্গে হ্যান্ডশেক সেরে নিয়ে দীপকাকু বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারি আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেন্ট লেখানোর ব্যবস্থা করছি। এটা না হলে তো কাজ শুরুই করা যাবে না। চলি।

সায় সূচক ঘাড় হেলালেন অফিসার। দীপকাকু ঘুরে গিয়ে পা চালালেন। সঙ্গে চলল ঝিনুক।