আড়ালে আততায়ী – ৩

৷৷ তিন ৷৷

আজও নিজের মোটরবাইক বা ঝিনুকদের গাড়ি নেননি দীপকাকু। অ্যাপক্যাব ভাড়া করেই ডা. রায়ের একবালপুরের বাড়ির সামনে পৌঁছল ঝিনুকরা। গাড়ি থেকে নেমেই ঝিনুক চেহারায় অসুস্থ ভাব এনে ফেলেছে। গেট পার হতেই হোঁচট খেল চোখ। সদর দরজা বন্ধ। ঝিনুক বলে ওঠে, পেশেন্ট দেখছেন না আজ! তার মানে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। হয়তো ওঁরই শরীর খারাপ

—এমনও হতে পারে রবিবার পেশেন্ট দেখেন না। বলে দীপকাকু পৌঁছলেন সদরের সামনে। পাশের দেওয়ালে টাঙানো নেমপ্লেটে চোখ বুলিয়ে বললেন, এখানে অবশ্য সেরকম কোনও নোটিশ দেওয়া নেই ।

বন্ধ দরজার মাথার উপরের দিকে ডোরবেলের সুইচ। টিপলেন দীপকাকু। ভিতরে বেল বাজছে শোনা গেল। ঝিনুকরা অপেক্ষা করছে। দরজা খুলছে না কেউ। দীপকাকু আবার হাত তুলেছেন বেল বাজাতে, খুলে গেল দরজা। সামনে দাঁড়িয়ে তাপস, ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার। দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারবাবু আজ পেশেন্ট দেখছেন না ?

তাপসবাবু চুপ করে আছেন। মুখটা বিষণ্ণ। দীপকাকু ফের জানতে চান, ডা. রায় কি বাড়িতে আছেন? ওঁর সঙ্গে আমার জরুরি দরকার। —ডাক্তারবাবু নেই। মারা গিয়েছেন।

মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠল ঝিনুকের। ভুল শুনল কি? না, ঠিকই শুনেছে। বিষম বিস্ময়ে দীপকাকু বলে উঠলেন, সে কী! কবে? কী হয়েছিল?

গত পরশু মারা গিয়েছেন। রেলের লাইনে কাটা পড়ে চুপ করে রইলেন দীপকাকু। মাথা নামিয়ে নিয়েছেন। খবরের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে মুখ তুলে জানতে চাইলেন, অ্যাক্সিডেন্টটা কোথায় ঘটেছে?

—কাঁকুলিয়া লেভেল ক্রসিং-এর লাইনে।

–ওখানে ওঁর যাওয়ার কারণ? জিজ্ঞেস করার পর দীপকাকু উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে পার্স বার করে আনলেন। সেটা থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে ধরে বললেন, আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ডাক্তারবাবু আমাকে একটা কাজ দিয়েছিলেন। এদিকে এরকম একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে আরও কিছু জানার আছে আমার। আপনার সঙ্গে কি একটু বসে কথা বলা যেতে পারে ?

দীপকাকুর হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে তাপসবাবু বললেন, আসুন ভিতরে।

তাপসবাবুকে অনুসরণ করে ঝিনুকরা ঢুকল ঘরে। আগের দিন এই ঘরটাই পেশেন্ট পার্টিতে ভর্তি ছিল। আজ কেউ নেই। একেবারে খাঁ খাঁ করছে। ঝিনুকের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ডাক্তারবাবু মানুষটা নেই। মনে হচ্ছে চেম্বারের ওই কাঠের সুইংডোরটা ঠেললেই ব্যক্তিত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে সপ্রতিভ মানুষটাকে নিশ্চয়ই দেখা যাবে। মৃত্যুর কোনও আগাম ঘোষণাই ছিল না ওই চেহারায়।

দেওয়াল ঘেঁষা ভিজিটার্সদের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন দীপকাকু। পাশে ফাঁকা জায়গায় হাত নির্দেশ করে তাপসবাবুকে বসতে বললেন। বসলেন তাপসবাবু। ঝিনুক দাঁড়িয়ে রইল। দীপকাকু শার্টের পকেট থেকে মোবাইল বার করে স্ক্রিনের উপর হাত বুলিয়ে থামলেন। মোবাইলের মুখটা তাপসবাবুর দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একে চেনেন?

ঝিনুক দেখে মোবাইলে ডাক্তারবাবুর দেওয়া সেই ফটো। দীপকাকু ফোনে কপি করে নিয়েছেন। তাপসবাবু বললেন, এটা তো ডাক্তারবাবুর ছেলে বাবলার ছবি। যে পাঁচ বছর হল নিরুদ্দেশ।

ফোন পকেটে ফেরত নিলেন দীপকাকু। আসলে নিশ্চিত হয়ে নিলেন ডা. অলকেশ রায় যে ফটোটা দিয়েছিলেন সেটা সত্যিই ওঁর ছেলের কি না। ফের কথা শুরু করলেন দীপকাকু, তাপসবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারবাবু তো বাইরে গেলে নিজের গাড়িতে যান। লেভেল ক্রসিং-এর রেললাইনের উপর হাঁটছিলেন কেন?

– গাড়িতেই গিয়েছিলেন। ড্রাইভার বলছে রেলগেট উঠতে দেরি হচ্ছে দেখে উনি গাড়ি থেকে নেমে রেললাইন ক্রস করতে যান। রেলগেটের ওপারেই কোনও কাজ ছিল আর্জেন্ট। সে কাজ আর করা হয়ে উঠল না।

—কী কাজ ছিল ড্রাইভার জানে? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু। তাপসবাবু বললেন, জানে না। কাজটা কী ড্রাইভারকে বলেননি ডাক্তারবাবু। শুধু বলেছিলেন, গেট উঠলে ওপারে আয়। আমি ওখানেই থাকব।

—ড্রাইভার কি এখন এ বাড়িতে আছে? ওর সঙ্গে কথা বলাতে পারবেন?

—না, গতকালই কাজ ছেড়ে দিয়েছে নন্দ। এ বাড়ি থেকে মাসের মাইনে মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর।

– আপনি চাকরি ছাড়েননি কেন?

—এ বাড়ির মেজকর্তা আমাকে আর কিছুদিন থেকে যেতে বললেন। ডাক্তারবাবুর খোঁজে পেশেন্টরা আসছে, জবাব দেওয়ার জন্য তো কাউকে চাই। আমি না থাকলে পেশেন্ট পার্টির বেল শুনে বেরিয়ে এসে বলতে হবে ওঁদের। যদিও দোতলার বারান্দা থেকেই বলবেন। নীচের সদরে এসে বলতে হবে না। এই ঘরের উপরটাতেই থাকেন মেজকর্তারা। বার বার এসে বলাটা তো ঝামেলার।

একটু ভেবে নিয়ে দীপকাকু বললেন, সদরের পাশে ডাক্তারবাবুর নেমপ্লেটটা খুলে নিলে কোয়ারি কিছুটা কমবে।

—নামের বোর্ডটা নিশ্চয়ই পরশু খুলে ফেলা হবে। কাল তো ডাক্তারবাবুর কাজ, মানে শ্রাদ্ধ-শান্তি। অপঘাতে মৃত্যু, তিন রাত্রি পেরোলে চারদিনের দিন কাজ। শ্রাদ্ধের আগে বোর্ডটা খুলতে বাড়ির কারুর মন চাইছে না। বলে থামলেন তাপসবাবু। ফের বলে উঠলেন, বোর্ড খুললেও এখনও মাস খানেক ধরে পেশেন্টরা আসবে। পুরনো সব পেশেন্ট। রিপোর্ট দিতে আসবে তারা।

—তার মানে আরও একমাস আপনার চাকরি থাকবে। স্যালারি দেবেন মেজকর্তা। তারপর কী করবেন? আনঅফিসিয়াল ডাক্তারি? ডাক্তারবাবুর থেকে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখেছেন?

দীপকাকুর কথায় মুখটা আরও বিমর্ষ হল তাপসবাবুর। হতাশা শ্বাস ফেলে বললেন, ওটাই তো সমস্যা। ডাক্তারবাবু আমায় কিছুই শেখাননি। ওষুধ দিতেন নিজের হাতে। ওষুধের আসল নাম শিশির গা থেকে খুলে ফেলে কোড নাম ইউজ করতেন। আমার কাজ ছিল শুধু পেশেন্টের নাম লেখা আর লিস্ট দেখে ডাক্তারবাবুর কাছে পাঠানো।

-ডাক্তারবাবুর কাছে কতদিন কাজ করছেন?

—তা প্রায় আট বছর। আমার আগে যিনি কাজ করতেন, তাঁকেও ডাক্তারবাবু চিকিৎসার কিছু শেখাননি। তিনি রাগ করেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

–আগের দিন এসে বুঝেছি ডাক্তারবাবুর ভাল পসার ছিল বিদ্যেটা কাউকে দিয়ে গেলে রুগিদের উপকার হত। ছেলে পলাতক না হলে হয়তো তাকেই তৈরি করতেন। কথাগুলো যেন নিজেকেই বললেন দীপকাকু।

তাপসবাবু সহমত হলেন না। বললেন, ছোলের কোনও আগ এইই ছিল না ডাক্তারিতে। শুনেছি ডাক্তারবাবু ওকে হোমিওপ্যাপি কলেজে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন, সায়ন রাজি হয়নি। জেনারেল সাবজেক্ট নিয়ে বিএ পাস করেছে। বিজনেস করার ঝোঁক ছিল ছেলের। বাবার থেকে টাকা চেয়ে পায়নি। আসলে আড্ডাবাজ ছিল তো খুব। ডাক্তারবাবু ভরসা পাননি টাকা দিতে। যদি উড়িয়ে দেয় সব।

দীপকাকু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে তাপসবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, কাঁকুলিয়ার ওদিকে কি ডাক্তারবাবুর চেনা পরিচিত কেউ থাকেন? যাঁর কাছে যেতেন কখনও সখনও ?

-আমার জানা নেই। এটা ভাল বলতে পারত নন্দ। গাড়ি চালিয়ে ও-ই তো সব জায়গায় ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যেত।

—নন্দর ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই আছে আপনার কাছে। বলুন তো নাম্বারটা। নন্দর পুরো নামটাও বলবেন।

নন্দ গড়াই। বলার পর নিজের মোবাইল দেখে ফোন নাম্বার বললেন তাপসবাবু। দীপকাকু নাম্বারটা সেভ করলেন ফোনে, ঝিনুকও করল। এরপর দীপকাকু বললেন, এবার আপনার পুরো নাম বলুন, আর ফোন নাম্বারটা দিয়ে রাখুন। দরকারে ফোন করতে পারি।

– অবশ্যই করবেন। বলার পর তাপসবাবু পুরো নাম বললেন। ওঁর টাইটেল ‘কুণ্ডু’। ফোন নাম্বার দিলেন। এবারও দীপকাকুর সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকও নাম, নাম্বার সেভ করল মোবাইলে।

বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন দীপকাকু। তাপসবাবুকে বললেন, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করব। আপাতত আমার কথা এ বাড়ির কাউকে জানাবেন না। আশা করি কথাটা রাখবেন।

– আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। কেউ জানবে না। তবে আমি কি একটা কথা জানতে পারি ?

– বলুন ?

– ডাক্তারবাবু আপনাকে কী কাজ দিয়েছিলেন?

-এখনই এটা বলতে পারছি না। সময় মতো নিশ্চয়ই জানাব। চলি। বলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন দীপকাকু। ঝিনুক সঙ্গ নিল ডা. রায়ের বাড়ির গেট পেরিয়ে ফুটপাতে এসেছে ঝিনুকরা। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্যাক্সি। দীপকাকু বললেন, চলো, ট্যাক্সিটা ধরি।

রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সির কাছে পৌঁছল ঝিনুকরা দীপকাকু গাড়ির পিছনের দরজা খুলতে খুলতে ড্রাইভারকে বললেন, কাঁকুলিয়া রোড যাব।

মিটার ডাউন করল ড্রাইভার। দীপকাকুর সঙ্গে ঝিনুকও উঠে বসল গাড়িতে। চলতে শুরু করেছে গাড়ি। ঝিনুক জিজ্ঞেস করতে যাবে, আমরা কাঁকুলিয়ায় কেন যাচ্ছি? দীপকাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে গিলে নিল প্রশ্নটা। যে রকম গম্ভীর হয়ে আছেন বোঝাই যাচ্ছে উত্তর পাওয়া যাবে না।

গোলপার্ক ছেড়ে কাঁকুলিয়া রোডে ঢুকে পড়ল ট্যাক্সি। ঝিনুক এই রাস্তায় আগে কখনও আসেনি। এত অপরিসর রাস্তার মাঝে রেলের লেভেল ক্রসিং আছে, ভাবতে একটু অবাক লাগছে। হয়তো খানিক বাদে চওড়া হবে রোড।

হল না। প্রায় পাড়ার গলি ধরে লেভেল ক্রসিং-এ এসে দাঁড়াল ট্যাক্সি। গেট ফেলা আছে। ট্রেন যাবে অথবা আসবে। ঝিনুকদের ট্যাক্সির সামনে আরও দু’টো চার চাকা, এছাড়া ফাঁক ফোঁকরে রিকশা, সাইকেল তো আছেই। দীপকাকু হঠাৎ ট্যাক্সির দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন, ড্রাইভারকে বললেন, গেট উঠলে ওপারে আসুন। আমি আছি।

কথাগুলো ভীষণ শোনা শোনা লাগল ঝিনুকের! মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ল ডা. রায় প্রায় একই কথা বলে গাড়ি থেকে নোনে গিয়েছিলেন। তারপর ট্রেনের ধাক্কা। এমনটাই ঝিনুকদের বলেছেন তাপসবাবু। দীপকাকুর জন্য দুশ্চিন্তা হতে থাকে ঝিনুকের। উনি ট্যাক্সি থেকে নামতেই, ঝিনুকও নেমে আসে। দীপকাকু বললেন, তুমি নামলে কেন?

—আপনার সঙ্গে যাব।

– আরে!, ট্যাক্সিওলা ভাববে আমরা ভাড়া না দিয়ে সরে পড়ার মতলব করছি। তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো।

এর উত্তর ঝিনুককে দিতে হল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে উঠল, না স্যার, দিদিমণি আপনার সঙ্গে যাক। আমরা লোক চিনি। ভাড়া আপনারা মারবেন না।

ঝিনুকের মুখে হাসি ফুটল। দীপকাকু এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছনে চলল ঝিনুক। মাথা হেঁট করে ফেলে রাখা লেভেল গেট পার হলেন দীপকাকু। ঝিনুকও তাই করল। সামনে পর পর বেল লাইন। দু’পাশ দেখে লাইন পার হতে লাগলেন দীপকাকু, পাশে চলল ঝিনুক। বাঁদিকে খানিক দূরে একটা রেলওয়ে স্টেশন দেখা যাচ্ছে। স্টেশনের বোর্ড পড়া যাচ্ছে না। ঝিনুক দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করে, ওটা কোন স্টেশন?

—বালিগঞ্জ। ডান দিকে ঢাকুরিয়া। এখান থেকে দেখা যাবে না। সব ক’টা লাইন ক্রস করে ঝিনুকরা এপাশে চলে এসেছে। পরের গেটটা পার না হয়ে দীপকাকু ঘুরে দাঁড়ালেন। রেলের লাইনগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ওঁর কিসের এত তাড়া ছিল? আসছে কি না খেয়াল না করেই লাইন পার হচ্ছিলেন।

কথাগুলো নিজের উদ্দেশেই বলছেন দীপকাকু। ঝিনুক টের পাচ্ছে, ডাক্তারবাবু পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তদন্ত থেমে থাनে না। দীপকাকু নিজের আগ্রহেই কাজ চালিয়ে যাবেন।

ঝিনুককে চমকে দিয়ে আপ এবং ডাউনের দু’টো লোকাল নিজেদের ক্রস করে যাচ্ছে। ট্রেন দুটো আসার কোনও আওয়াজ পেল না কেন ঝিনুক? এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল!