আড়ালে আততায়ী – ১

।।এক।।

সকাল প্রায় দশটা। অ্যাপক্যাবে চেপে ঝিনুক দীপকাকুর সঙ্গে চলেছে একবালপুরে। নতুন কেস এসেছে দীপকাকুর। ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন। এটাই প্রথম সাক্ষাৎ। ক্লায়েন্ট একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। নাম অলকেশ রায়। উনিই দীপকাকুকে বলেছেন ভাড়া গাড়িতে আসতে। নিজের গাড়িতে নয়। দীপকাকুর নিজের গাড়ি বলতে মোটরবাইক। তদন্তের প্রয়োজনে কখনও ঝিনুকদের গাড়িটা ব্যবহার করেন। আজ দুটো গাড়িই কাজে লাগল না।

গতরাতে ডিনার সেরে ঝিনুক যখন শুতে যাবে, দীপকাকুর ফোন এল ওর মোবাইলে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, কাল সকালে ফ্রি আছ? কেসে অ্যাসিস্ট করার গন্ধ পেয়েছিল ঝিনুক। বলেছিল, হ্যাঁ, একদম ফ্রি। এখন তো পুজোর ছুটি চলছে কলেজে। খুলবে সেই ভাইফোঁটার পর।

-ওকে। তা হলে বউদিকে বলে দাও ব্রেকফাস্ট তোমাদের বাড়িতে সারব। তারপর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব ক্লায়েন্টের বাড়ি । দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে যেতে হবে সেখানে। ছাড়ছি। গুড নাইট ।

দীপকাকু ফোন কাটতেই ঝিনুক শূন্যে ডান হাতটা এমনভাবে ঝাঁকিয়ে ছিল, যেন স্কোর করল কোনও খেলায়। সব কেসে তো দীপকাকু তাকে অ্যাসিস্ট করার জন্য ডাকেন না। মাকে গিয়ে দীপকাকুর আসার খবরটা জানিয়েছিল ঝিনুক। ব্রেকফাস্টে কী বানানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে বসে গেলেন মা। দীপকাকু মায়ের রান্নার মস্ত বড় ফ্যান। তার উপর পুজোর পর দীপকাকু প্রথম আসছেন। বলতে গেলে বিজয়ার খাওয়া।

বাইক চালিয়ে সকাল আটটা নাগাদ দীপকাকু এলেন। বিজয়ার প্রণাম, কোলাকুলি সারা হল। দাবার বোর্ড সাজিয়ে রেখেছিলেন বাবা। দীপকাকু খেলায় বসতে আগ্রহ দেখালেন না। এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে বলেছিলেন, একমাত্র রোববার দাবায় আমার মাথা ভাল কাজ করে। আজ খেলতে বসলে হেরে ভূত হয়ে যাব।

সাধারণত রবিবারই দীপকাকু বাবার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসেন। দাবা খেলেন। আজ না খেলার কারণ, হাতে সময় কম। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ক্লায়েন্টের সঙ্গে। এদিকে মায়ের হাতের জলখাবারটাও তারিয়ে তারিয়ে সারতে চান। মা পিৎজা খাওয়ালেন গরম গরম। আর কাস্টার্ড বানিয়ে রেখেছিলেন কাল রাতেই। খাওয়া চলাকালীন বাবা দীপকাকুকে জিজ্ঞেস করলেন, এবারের কেসটা কী নিয়ে?

খাবার মুখে থাকা অবস্থায় দীপকাকু বলেছিলেন, এখনও জানি না। ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারব।… এরপর ক্লায়েন্টের পরিচয় এবং ঠিকানা বললেন। বাবা একটু অবাক হয়ে বলেন, তোমার এজেন্সির অফিসে না এসে, কেসের ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে, ভদ্রলোক তোমাকে ডেকে পাঠালেন, আর তুমি রাজি হয়ে গেলে দেখা করতে! এত অ্যাভেলেবল হওয়া কি তোমার পক্ষে উচিত হচ্ছে? তুমি এখন একজন প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা। দীপঙ্কর বাগচী নামটা যথেষ্টই পরিচিত। অনেকেই জানে।

— ভদ্রলোকের ডেকে পাঠানোর ধরনটাতে রাজি হয়েছি। বলেছিলেন দীপকাকু।

ঝিনুক জানতে চেয়েছিল, ধরনটা কীরকম ছিল?

খেতে খেতে উত্তর দিলেন দীপকাকু। বলেছিলেন, ফোন করে ভদ্রলোক প্রথমে নিজের নাম, পেশা জানিয়ে বলেছিলেন, তিনি গোয়েন্দার শরণাপন্ন হচ্ছেন, এটা কাউকে জানতে দিতে চান না। উনি নিজের গাড়িতে আমার অফিসে এলে ওঁর ড্রাইভার সাক্ষী থেকে যাবে। বাসে বা ট্যাক্সিতেও আসতে ভরসা পাচ্ছেন না। পাছে কেউ ফলো করে জেনে নেয় কোথায় যাচ্ছেন। এমনকি আমাকেও বারণ করলেন পার্সোনাল গাড়িতে ওঁর বাড়ি যেতে। কারণ, গাড়ির নাম্বারের সূত্র ধরে আমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবে। এঁকে এত সাবধানতা নিতে দেখেই আমার আগ্রহ বাড়ল। মনে হল কেসটার মেটেরিয়াল থাকবে। ভাবলাম, যাই, দেখা করি। তা ছাড়া অসুস্থ অশক্ত ক্লায়েন্টের বেলায় আমি তো দেখা করতে যাই। নিজের পজিশন পরিচিতি নিয়ে ভাবি না।

এরপর বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা কী পরিচয় নিয়ে ওঁর বাড়িতে যাবে?

—উনি যেহেতু ডাক্তার, রুগির পরিচয় নিয়ে যেতে বলেছেন চেম্বারটা ওঁর বাড়ির একতলায়। বলার পর একটু থেমে দীপকাকু ফের বলে উঠেছিলেন, আমি বলে নিয়েছি আমার সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে। সে হবে পেশেন্ট। আমি তার গার্জেন।

ব্যবস্থাটা পছন্দ হয়নি ঝিনুকের। মুখে সেটা প্রকাশ করার ঝুঁকি নেয়নি। অ্যাসিস্ট করার সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। ঝিনুক বাধা ছাত্রীর মতো জানতে চেয়েছিল, পেশেন্ট সাজার জন্য বিশেষ কোনও ড্রেস পরতে হবে কি?

-না না, আলাদা কোনও ড্রেস লাগবে না। চেহারায় একটা ঝিমানো ভাব যেন থাকে। বলেছিলেন দীপকাকু। বাবা তখন বললেন, পেশেন্ট তুমিই সাজতে পারতে। ওই ভাবটা তোমার চেহারায় অটোমেটিক্যালি থাকে যখন ভাবনাচিন্তার জগতে থাকো।

ফিজিকাল মুভমেন্টের সময় তোমার অবশ্য উল্টো রূপ! ঝিনুক কতটা অসুস্থতার অ্যাক্টিং করতে পারবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। যা ছটফটে মেয়ে।

দীপকাকু বলেছিলেন এখন আর কিছু করার নেই। করতেই হবে অ্যাক্টিং। অ্যাসিস্ট্যান্ট পেশেন্ট হবে বলা হয়ে গিয়েছে ওঁকে। অ্যাপক্যাবের পিছনের সিটে দীপকাকুর পাশে বসে ঝিনুক শরীরে ঝিমানো ভাবটা আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে ভাবে আসছে কই ! গাড়িতে এসি চললেও, জানলার কাচের ওপারে শরতের উজ্জ্বল রোদ। পুজোর প্যান্ডেলগুলো এখনও সব খোলা হয়নি। রয়ে গিয়েছে বাঁশের খাঁচা, বিজ্ঞাপনের বড় বড় হোর্ডিং, আশপাশে দিব্যি উৎসবের আমেজ। এসবের মাঝে শরীর খারাপের কথা ভাবতে কারুর ভাল লাগে!

কিছুক্ষণ হল দীপকাকু বাঁ দিকের জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। এখন ড্রাইভারের উদ্দেশে বলে উঠলেন, এবার একটু স্লো চালান তো ভাই। ফুটপাত ঘেঁষে চালাবেন।

গাড়ির স্পিড কমল। ঝিনুকরা তার মানে পৌঁছে গিয়েছে মনে হচ্ছে। একটু পরেই দীপকাকু বললেন, ব্যস, দাঁড় করান গাড়ি।

ড্রাইভার নির্দেশ পালন করল। গাড়িতে বসেই ভাড়া মেটালেন দীপকাকু। নেমে এসে বাঁ দিকে তাকিয়ে বললেন, এই বাড়িটাই মনে হচ্ছে।

ঝিনুক কোনও বাড়ি দেখতে পাচ্ছে না। ফুটপাতের উপর দু’টো দোকানের প্লাস্টিক ঢাকা ব্যাক পোশান। এর পিছনেই নিশ্চয়ই বাড়ি। দীপকাকু প্রথমবার এখানে এলেন, ডাক্তারবাবুর দেওয়া পথনির্দেশ অনুযায়ী ঠিক আন্দাজ করে নিলেন বাড়িটা!

ফুট দশেক হাঁটতেই দেখা গেল বাড়ির বিশাল গেট। লোহার, জাফরি ডিজাইন। এবার পুরো বাড়িটা চোখের সামনে। বয়স দু’শো তো হবেই। বাড়ির আর্কিটেকচার অন্তত তেমনটাই বলছে। গেট আধখোলা, ঢুকে পড়লেন দীপকাকু। সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ঝিনুককে বললেন, এখানে তোমার নাম ইলোরা গুপ্ত। পেশেন্ট দেখার লিস্টে এই নামটাই দেওয়া আছে। আমি তোমার নিজের কাকা। এই পরিচয়ে আমরা আসছি বলা আছে ডাক্তারবাবুকে। আমি রজতদার বন্ধু, এই পরিচয় এখানে চলবে না।

বুঝে নিয়ে ঘাড় কাত করে ঝিনুক। দীপকাকু বাবার বন্ধু হাতে পারেন, বয়সে বাবার থেকে অনেকটাই ছোট। ঝিনুককে একবার জরিপ করে নিয়ে দীপকাকু ফের বলেন, তোমাকে দেখে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না। চোখে ক্লান্তি ভাব আনো আর বডি মুভমেন্ট স্লো করে দাও। ওতেই কাজ হয়ে যাবে।

অসুস্থতার অভিনয় এত সোজা আগে বোঝেনি ঝিনুক। চোখ ঢুলু ঢুলু করে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে অনুসরণ করল দীপকাকুকে। সদর দরজার পাশের দেওয়ালে ডাক্তারবাবুর নেমপ্লেট। কাঠের বোর্ডে বড় বড় করে লেখা, ডাঃ অলকেশ রায়, ডি.এম.এস (ক্যাল)।

ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, এত ভিড়! হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে এত পেশেন্ট মানে তিনি খুবই নামকরা। দেওয়াল ঘেঁষা বেঞ্চে পর পর লোক বসে। নারী-পুরুষ-বাচ্চা। চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায় নানান বিত্তের মানুষ এরা। বড়লোক, গরিব, মধ্যবিত্ত মিলিয়ে মিশিয়ে। ঝিনুকদের মুখোমুখি একটা বন্ধ দরজা, ওটাই সম্ভবত ডাক্তারবাবুর বসার জায়গা। দরজার পাশে চেয়ার-টেবিলে বছর পঁয়ত্রিশ, মানে দীপকাকুর কাছাকাছি বয়সী একটা লোক বসে দীপকাকুর উদ্দেশে উনি বললেন, নাম লেখা আছে? নাকি লেখাবেন?

— লেখা আছে। ইলোরা গুপ্ত। বললেন দীপকাকু।

ডাক্তারবাবুর সহকারী খাতা দেখে বললেন, হ্যাঁ, ছ’নম্বরে নাম বসুন। তিন নম্বর সবে গিয়েছে।

কম্পাউন্ডারবাবুর টেবিল লাগোয়া বেঞ্চের কিছুটা ফাঁকা ছিল। ঝিনুকরা সেখানে গিয়ে বসল। ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করার মতো বোরিং ব্যাপার খুব কমই আছে। দীপকাকুর মতো উঁচুদরের ডিটেকটিভকেও বসে থাকতে হচ্ছে এরকম নিষ্ক্রিয়ভাবে! কেসের স্বাথেই বসে আছেন, অথচ জানেন না কী বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। সে হাতে না নিয়েই নেমে পড়েছেন কাজে। এমন তো হতেই পারে, সেটা পছন্দ হল না দীপকাকুর। তদন্তে নামলেন না। তখন এই অপেক্ষাটা জলে যাবে।

তিন নম্বরের পেশেন্টপার্টি বেরিয়ে এল চেম্বার থেকে। চার নম্বরের নাম ডেকে কম্পাউন্ডারবাবু দীপকাকুর দিকে ঘাড় ঘোরালেন। বললেন, আপনার পেশেন্টের নাম ডাক্তারবাবু তো নিজে খাতায় লিখেছেন। ফোন করেছিলেন? ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পরিচয় আছে আপনার?

—না আমার সঙ্গে নেই। আমার এক রিলেটিভ ডাক্তারবাবুর খুব চেনা। সে ফোন করে নামটা লিখিয়েছে। অবলীলায় মিথ্যে বলে গেলেন দীপকাকু। অবিশ্বাস করার কিছু নেই। কম্পাউন্ডার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভদ্রলোকের এই বাড়তি কৌতূহলটা ঝিনুকের তেমন সুবিধের ঠেকল না। ডাক্তারবাবুর গতিবিধির উপর খানিকটা নজরদারি করা হল যেন। তা হলে কি ডাক্তারবাবু এই ধরনের লোকগুলোকে নিয়েই সতর্ক রয়েছেন, যারা তাঁর আশেপাশে থাকে। লক্ষ্য রাখছে ডাক্তারবাবু কোনও গোয়েন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন কি না? যে কারণে ডাক্তারবাবু নিজে দীপকাকুর অফিসে যেতে পারেননি। ঝিনুকদের এখানে আসতে হয়েছে অ্যাপক্যাব ভাড়া করে। এখন যেটা জানার, ডাক্তারবাবুর গোয়েন্দার দরকার পড়ছে কেন? এবং দরকারটা আশেপাশের লোকের কাছে কেন গোপন রাখতে চাইছেন?

প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল। পেশেন্ট দেখতে বড্ড সময় নিচ্ছেন ডাক্তারবাবু। এতই যদি সময় লাগবে, কেন আসতে বললেন দশটায় ভেবেছিলেন হয়তো বাঙালির স্বভাবদোষ অনুযায়ী দীপকাকুও পেটি করবেন পৌঁছোতে। এদিকে অসুস্থতার ভান করে বসে থাকতে গিয়ে ঝিনুক এবার সত্যিকারের না অসুস্থ হয়ে পড়ে। যদিও অপেক্ষা শেষ হতে চলল। পাঁচনম্বর পেশেন্ট গিয়েছে ভিতরে।… ভাবনা শেষ হতেই কম্পাউন্ডারবাবু হাঁক দিলেন, ইলোরা গুপ্ত!

দীপকাকুর সঙ্গে ঝিনুকও উঠে দাঁড়াল বেঞ্চ ছেড়ে। ছদ্মনামটি খারাপ দেননি দীপকাকু। শুনতে বেশ ভালই লাগল। ঝিনুকের ভাল নাম আঁখি সেন, তার চেয়েও কি নামটা সুন্দর?

সুইংডোর ঠেলে চেম্বারে ঢুকল ঝিনুকরা। ডাক্তারবাবুর বয়স পঁয়ষট্টির একটু কম বেশি। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন দীপকাকুকে। যদিও কপালটা একটু কুঁচকে আছে, সেটা নির্ঘাত দীপকাকুর নিরীহ চেহারার কারণে। গোয়েন্দা হিসেবে মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্রথমবার দেখায় এটা সকলেরই হয়। ডাক্তারবাবু বলে ওঠেন, ভেরি সরি, অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল আপনাদের আমি ডেকে নিতেই পারতাম, তাতে সন্দেহ হত তাপসের।

কম্পাউন্ডারের নামটা জানা হল। টেবিলের এপারের চেয়ার টেনে দীপকাকু বসলেন। ঝিনুকের দিকে হাত নির্দেশ করে ডাক্তারবাবুকে বললেন, এ হল আমার সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট। নাম আঁখি সেন।

ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে ডা. অলকেশ রায় বললেন, সে তো বুঝতেই পারছি, বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। এত অল্পবয়সী অ্যাসিস্ট্যান্ট! পেশেন্ট হিসেবে মহিলার নাম লিখতে বলেছিলেন বটে, কিন্তু এ যে দেখছি স্কুল ছাত্রী।

– স্কুল না, কলেজ। ফার্স্টইয়ার। বলল ঝিনুক।

অলকেশবাবু বললেন, তাও তো সেই স্টুডেন্ট। যাই হোক বসো মা।

দীপকাকুর পাশে ফাঁকা চেয়ারটায় বসল ঝিনুক। এখন তার একটাই স্বস্তি, অসুস্থতার ভান করতে হবে না।

ডাক্তারবাবুর উদ্দেশে দীপকাকু বললেন, এবার আপনার সমস্যাটা বলুন।

কথা শুরু করতে যাবেন ডা. অলকেশ রায়, দীপকাকু ঝিনুকের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, দরজাটা একটু ঠেলে দেখে নাও তাপসবাবু আড়ি পেতেছেন কিনা?

মুহূর্তে চেয়ার থেকে উঠে ঝিনুক চলে যায় সুইংডোরের কাছে। পাল্লা সামান্য ঠেলে দেখে, না, কেউ নেই। মাথা নেড়ে সেটা বুঝিয়ে দেয় দীপকাকুকে। ফিরে আসতে থাকে চেয়ারে। ডাক্তারবাবু অবাক গলায় দীপকাকুর কাছে জানতে চান, ব্যাপারটা কী হল? তাপস আড়ি পাতবে কেন ?

—পেশেন্টদের লিস্টে আপনি নিজের হাতে ইলোরা গুপ্ত নামটা লিখেছেন দেখে তাপসবাবুর খটকা লেগেছে। জিজ্ঞেস করছিলেন আপনার সঙ্গে আমার কেমন পরিচয় ? কৌতূহল মেটাতে উনি এখন আমাদের কথায় কান পাততে পারেন, তাই বললাম একবার দেখে নিতে।

দীপকাকুর বলা শেষ হতেই ডা. অলকেশ রায় বললেন, আমার মূল সমস্যা এটাই। সবচেয়ে কাছের লোকেদের কাছে নজরবন্দি হয়ে আছি। ঠিক কারা কারা নজর রাখছে ঠাহর করতে পারছি না ।

—বিশদে বলুন। বললেন দীপকাকু।

ডা. রায় শুরু করলেন বলতে, আমরা তিনভাই এক বোন । তিনভাই পরিবার নিয়ে এই বাড়িতেই থাকি। বোন তার শ্বশুর বাড়িতে। আমার নিজস্ব পরিবার বলতে আমি এখন একাই। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক হল। আমার একটিই মাত্র পুত্রসন্তান, সে পাঁচবছর হল নিরুদ্দেশ।

-কেন? জানতে চাইলেন দীপকাকু।

-বলব। ওর কারণেই আপনাকে ডেকেছি। বলে নিয়ে ডাক্তারবাবু একটু চুপ থেকে বোধহয় কথা গুছিয়ে নিলেন, ফের শুরু করলেন, আমাদের পরিবারে বিরাট এক বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে আমার ছেলের কারণে। তার মোটরবাইকের ধাক্কায় মারা গিয়েছে আমার পরের ভাইয়ের বড় ছেলে। সেই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটানোর পর থেকে আমার ছেলে পলাতক।

ছেলের তখন বয়স কত? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু, ডাক্তারবাবু বললেন, পঁচিশ।

—কোথায় ঘটেছিল অ্যাক্সিডেন্ট?

—বাড়ির যে গেট দিয়ে আপনারা ঢুকলেন, সেখানেই। আমার ছেলে মোটরবাইক চেপে ঢুকছিল বাড়িতে, বেশ স্পিডেই ঢুকছিল। তখন গেট দিয়ে বেরোচ্ছে আমার ভাইপো, সাইকেলে ছিল সে আমার ছেলের বাইকের ধাক্কায় ভাইপো ছিটকে গিয়ে পড়ে লোহার গেটে। বিচ্ছিরি ভাবে মাথায় আঘাত লাগে। ইন্টারনাল হেমারেজ হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার।

– আপনাদের বাড়ির সামনের ফুটপাতে যে দোকান দুটো ঢোকার সময় দেখলাম, সেটা কি অ্যাক্সিডেন্টটার আগে থেকে আছে?

দীপকাকুর হঠাৎ এই অপ্রাসিঙ্গক প্রশ্নটা কেন করলেন বুঝল না ঝিনুক। ডা. রায় কিন্তু উৎসাহিত হলেন। বলে উঠলেন, আমি তার মানে উপযুক্ত লোকের সঙ্গেই কথা বলছি। যে আপনার নাম রেফার করেছিল, কিছু ভুল করেনি। একটু থেমে ডাক্তারবাবু ফের বলতে থাকেন, আপনি ঠিকই ধরছেন, ফুটপাতের দোকান দুটোর কারণে আমাদের বাড়ির গেট আড়ালে থাকে। আমার ছেলে বাইকে চেপে আসছিল ওই দিক থেকেই। ওর দোষ একটাই, স্পিডে ঢুকছিল বাড়িতে। খুড়তুতো ভাই যে সাইকেলে চেপে গেট দিয়ে বেরোচ্ছে দেখার সুযোগ পায়নি, ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। মানে পুরোটাই অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু আমার মেজভাই বাবলার নামে ইচ্ছাকৃত খুনের কেস করল।

–‘বাবলা’ আপনার ছেলের ডাকনাম । ভাল নামটা কী? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু।

—সায়ন রায়। আমার ভাইপোর নাম ছিল অয়ন। বড়দাদার সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছিল। অয়নের ডাকনাম ছিল অপু। দু ভাইয়ের মধ্যে ভাবও ছিল খুব। কিন্তু আমার মেজভাই এবং তার স্ত্রী পুত্রশোকে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে বসল। বলতে লাগল অপু যেহেতু লেখাপড়ায় ভাল, বাবলা হিংসে করত তাকে। সেই হিংসে থেকেই এই ইচ্ছাকৃত অ্যাক্সিডেন্ট, মানে খুন।

—অ্যাক্সিডেন্ট যখন রাস্তায় বা ফুটপাতে ঘটেছে, পুলিশ suo moto কেস করতে পারত। সে সুযোগ বোধহয় তারা পায়নি। বললেন দীপকাকু।

উত্তরে ডা. রায় বলতে থাকলেন, এগজ্যাক্টলি। পুলিশ অকুস্থলে এসে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বাবলার নামে কেস করতেই পারত। তাতে মামলাটা হত অনিচ্ছাকৃত খুনের। দোষী সাব্যস্ত হলে বাবলার তিন-চার বছরের বেশি জেল হত না। কিন্তু আমার মেজভাই থানায় কমপ্লেন করল ইচ্ছাকৃত খুনের। কোর্টে মামলা রুজু হল সেই অভিযোগে। এদিকে কেস লড়ার কোনও পরিস্থিতি নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তি ফেরার। পুলিশের ভাষায় অ্যাবস্কন্ডেড়। হুলিয়া জারি হল বাবলার নামে। পুলিশ আজও ওকে খুঁজছে।

এখনও বোঝা যাচ্ছে না ডাক্তারবাবুর গোয়েন্দার প্রয়োজন পড়ল কেন? দীপকাকু জানতে চাইলেন, আপনার ছেলে, মানে সায়ন কখন নিরুদ্দেশ হল? পুলিশের কাছে ওর নামে কমপ্লেনট হওয়ার পর?

– না, তার আগেই। রক্তাক্ত অপুকে আমার গাড়িতে তুলে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি, সঙ্গে ছিল মেজভাই সমরেশ, মানে অপুর বাবা আর আমার ছেলে বাবলা। সমরেশ নিজের ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে দিশেহারা। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল বাবলার উপর। নানান কথা শোনাচ্ছিল বাবলাকে। তার মধ্যে ছিল ওই দু’টো অভিযোগ তুই অপুকে হিংসে করতিস। এত হিংসে, যে খুন করতে গেলি! এটাকে অ্যাক্সিডেন্ট বলে চালাতে দেব না। অপুর যদি কিছু হয়ে যায়, আজীবন জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব তোকে… অপুর মাথা ছিল আমার কোলে, গাড়িতে বসেই টের পেলাম সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। হসপিটালে পৌঁছে হঠাৎ টের পাই বাবলা আশপাশে নেই। সেই যে গেল, আর ফিরল না বাড়ি ।

—তারপর আর ওর কোনও খবর পাননি? জিজ্ঞেস করলেন দীপকাকু।

ডাক্তারবাবু বললেন, পেয়েছি। সেই কারণেই ডেকেছি আপনাকে। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিই। বাবলা কিন্তু জেল খাটার ভয়ে আত্মগোপন করে নেই। ও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে তীব্র অনুতাপের কারণে। বাড়ির কাউকে নিজের মুখ দেখাতে চায় না। খুন না করুক, ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য সে-ই তো দায়ী। স্বাভাবিক ভাবে ছেলের ওই কৃতকর্মের কারণে আমি, আমার স্ত্রী ভীষণ এক অপরাধবোধ সঙ্গী করে এই পরিবারে থাকছিলাম। আজও থাকি আমি। ছেলেকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারিনি। লেখাপড়ায় মন নেই। ইচ্ছে নেই কেরিয়ার গড়ার। মোটরবাইক নিয়ে সারাদিন টো টো কোম্পানি। গাড়িটা চালাতও অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে, মানে হিরোগিরি। ওর মা পলাতক ছেলের চিন্তায় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ল। কথাবার্তা কমে গিয়েছিল একেবারে। হার্টের রোগে মারা গেল।

– কিন্তু বাড়ির লোকেরা কি এখনও মনে করে সায়ন খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে অয়নকে বাইকের ধাক্কা মেরেছিল? অনেকদিন তো কেটে গিয়েছে। থিতিয়েছে শোকতাপ। ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই যে কেউ বুঝতে পারবে ওটা খুন ছিল না। নেহাতই দুর্ভাগ্যজনক একটা অ্যাক্সিডেন্ট।

মনে মনে বাড়ির লোক সেটা বুঝলেও, মুখে কখনও স্বীকার করে না। মামলাও তোলেনি। তাই পুলিশের কাছে আজও বাবলা ফেরার আসামি।

দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, কেন মুখে স্বীকার করে না?

-এর পিছনে সম্পত্তির ব্যাপার রয়েছে যে। বলে থামলেন ডা. রায়। ফের বললেন, এরা চায় বাবলা কোনও দিনই না ফিরুক। তা হলে আমার মৃত্যুর পর পুরো বাড়িটা দু’ভাইয়ের দখলে চলে যাবে। বাইরে থেকে দেখে আপনি বুঝতে পারেননি বাড়িটা কত বড়। আর এই অঞ্চলে এতটা জায়গা নিয়ে এই বাড়ির বাজারদর কী হতে পারে, তা নিশ্চয়ই আপনার আন্দাজ আছে?

-তা আছে। তবে এই সম্পত্তি তো আপনাদের তিনজনের নয় চারজনের। বোন আছে আপনার। খেয়াল করালেন দীপকাকু ।

ডাক্তারবাবু বললেন, বাড়ি বিক্রি হলে তখন ভাগ দিতে হবে বোনকে। তা না হলে ভোগ দখল করে যাবে আমার দুই ভাই।

– আর আপনার টাকাকড়ি, স্ত্রীর গয়না এসবের কী ব্যবস্থা করছেন?

দীপকাকুর প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তারবাবু বলেন, ব্যাঙ্কের লকারে আছে গয়না, টাকা অ্যাকাউন্টে। সব জায়গায় নমিনি আমার ছেলে।

কিন্তু সে এ সব পাবে কী ভাবে? আমার মৃত্যুর পর এগুলো নিতে এলে, অ্যারেস্টেড হবে প্রথমে। ওর হয়ে মামলাই বা লড়বে কে? আমি তো তখন নেই। আর সত্যি বলতে কী, আমি বোধহয় সত্যিই বেশিদিন নেই। দিন কুড়ি আগে হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হার্ট অ্যাটাক। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবলার সঙ্গে দেখা করে ওর জীবনটা চলার মতো রসদ দিয়ে যেতে। বেচারা লঘু পাপে গুরুদণ্ড পাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থাটা আপনাকে করে দিতে হবে।

—বুঝলাম। এবার বলুন সায়নের সম্বন্ধে আপনার কাছে কী খবর আছে?

দীপকাকুর প্রশ্ন শেষ হতেই পিছনের দরজায় ‘ঠক ঠক’। ডা. রায় গলা তুলে বললেন, এসো!

দরজার একটা পাল্লা ঠেলে মুখ বাড়ালেন কম্পাউন্ডার তাপস। বললেন, আজ পেশেন্টের চাপ আছে। দেখানোর জন্য ছটফট করছে তারা।

—তুমি তো জানো আমি সময় নিয়ে পেশেন্ট দেখি। এই কেসটা বেশ ক্রিটিকাল। আরও খানিকটা টাইম লাগবে। বাইরেটা সামলানোর দায়িত্ব তোমার।

ডাক্তারবাবুর কথা শুনে নিয়ে মাথা বাইরে করে নিলেন তাপস। ফের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু দীপকাকুকে বললেন, আপনার অনুমান সঠিক। তাপসের সন্দেহ হয়েছে আপনারা আদৌ পেশেন্টপার্টি কি না? নয়তো রুগি দেখাকালীন ও আমাকে এভাবে তাড়া দেয় না। হুম। যাক, সায়নের ব্যাপারে বলুন। প্রসঙ্গে ফেরালেন দীপকাকু।

ডা. রায় বলতে থাকলেন, ছেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে দিন পাঁচেক আগে। বিজয়া দশমীর পরের দিন। আমার বন্ধু কমল পুজোর ক’টা দিন হাসপাতাল যাতায়াত করছিল তার এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। সেখানেই একদিন ভিজিটিং আওয়ার্সে দেখতে পায় বাবলাকে। বুদ্ধি করে সেদিন ওর সঙ্গে কথা বলতে যায়নি কমল। তাহলে বাবলা সেই যে পালাত, আর হসপিটালটায় যেত না। ও-ও নিশ্চয়ই কোনও পেশেন্টকে দেখতে এসেছিল ভিজিটিং আওয়ার্সে। কমল আমাকে এসে বলল, কাল চল হসপিটালে। ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার চান্স আছে।

কথা কেটে ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, কোন হসপিটাল ?

—রিলাইফ। চেনো নিশ্চয়ই? বাইপাসের ধারে। বললেন ডা. রায়। ঝিনুক বলল, ‘রিলাইফ’ কে না চেনে! বিরাট নামী হসপিটাল। ফের শুরু করলেন ডাক্তারবাবু, তো যা বলছিলাম। কমলের সঙ্গে গেলাম হসপিটালে। সেদিন দেখা হল না। পরের দিন ভিজিটিং আওয়ার্সে আবার গেলাম। এবার দেখতে পেলাম। রিসেপশনের একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল। আমি কাছে গিয়ে পিঠে টোকা মারলাম। ঘুরে তাকিয়েই হন্তদন্ত হয়ে পালাল। আমি, কমল দু’জনেই ছুটলাম ওর পিছনে। নাম ধরে ডাকলাম। ঘুরেও তাকাল না। রাস্তায় নেমে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল !

চুপ করে গেলেন ডা. রায়। একটু পরে ফের বলে উঠলেন, জানি ও আর আসবে না হসপিটালটায়, তবু পরের দিন গিয়েছিলাম। যদি আসে। আসেনি।

কথার শেষের দিকে গলাটা একটু ভেঙে গেল ডা. রায়ের। দীপকাকু বললেন, ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যখন ব্যর্থ হলেন, ফিরে এসে রিসেপশনের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেননি তার সঙ্গে কী কথা বলছিল সায়ন?

সে দিন জিজ্ঞাসা করার কথা মাথায় আসেনি। পরের দিন মেয়েটিকে বাবলার চেহারার বর্ণনা দিয়ে এবং টাইমটা বলে জানতে চেয়েছিলাম কী কথা হয়েছে? মেয়েটি কিছুই মনে করতে পারল না। পারা সম্ভবও নয়। কত লোকের সঙ্গে ওদের কথা বলতে হয়! আলাদা করে কাউকে মনে রাখা মুশকিল ।

ডা. রায় থামতেই দীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন, এবার বলুন আমাকে কী করতে হবে?

-সায়নকে খুঁজে দিতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের। ওকে যখন কলকাতায় দেখা গিয়ছে, আছে নাগালের মধ্যেই। ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়নি।

ডাক্তারবাবুর এই কথায় দীপকাকু কোনও মন্তব্য করলেন না। টেবিলে হাত রেখে ক্রমপর্যায়ে চার আঙুলের টোকা দিচ্ছেন ঝিনুক ডাক্তারবাবুর উদ্দেশে বলে, আপনি কী করে শিওর হচ্ছেন নাগালের মধ্যেই আছে সায়ন? আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় চলে গিয়েছে। কেটে গেছে পাঁচটা দিন।

—বাবলা যখন নিরুদ্দেশ হল, ধরেই নিয়েছিলাম ভিন রাজ্যে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশ কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও যাওয়া অসম্ভব নয়। এমনিতে ও খুব চালু ছেলে। হয়তো গিয়েওছিল চলে। মাঝে এত ক’টা বছর কেটে গিয়েছে, জানে ওকে খোঁজায় আলগা দিয়েছে পুলিশ। এখন সাহসে ভর করে ফিরে এসেছে কলকাতায় বা তার আশেপাশে। সাহস পাচ্ছে বলেই প্রকাশ্যে দিনের আলোয় হসপিটালে কাউকে দেখতে যাচ্ছে। সেই পেশেন্ট নির্ঘাত বাবলার খুব কাছের লোক। ফেরার থাকা জীবনে সম্ভবত তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে পেশেন্টের বাড়ি কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়।

ডা. রায়ের কথার মাঝে দীপকাকু বলে উঠলেন, পেশেন্টের বাড়ি অন্য রাজ্যেও হতে পারে। ‘রিলাইফ’ নামী হসপিটাল বহুদূর, এমনকি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান থেকেও লোকে চিকিৎসার জন্য আসে। এখানে শুধু একটাই আশার ইঙ্গিত আছে, সায়ন যদি পেশেন্টকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসে থাকে, তা হলে কলকাতার কোনও হোটেল বা গেস্ট হাউসে উঠেছিল। ওই সূত্র ধরে ওর হদিশ পাওয়ার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। আপনি সায়নের একটা ছবি দিন। নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিক আগের কোনও ফোটো।

—নিশ্চয়ই দেব। বলে টেবিলের ড্রয়ার টেনে ছবি বার করছেন ডা. রায়। তার মাঝেই দীপকাকু প্রশ্ন করলেন, লাস্ট যেদিন দেখলেন, চেহারায় তেমন কোনও বদল লক্ষ্য করলেন কি? দাড়ি রেখেছে অথবা মোটা-রোগা ধরনের কোনও পরিবর্তন?

—নাঃ, চেহারা একই রকম আছে। এই ফটোটার মতোই। বলে ছেলের ছবি দীপকাকুকে দিলেন ডাক্তারবাবু। দীপকাকু চোখ বুলিয়ে পাঁচ বাই সাত ইঞ্চির ফটোটা ঝিনুকের জিম্মায় রাখলেন। ঝিনুক দেখল, মোটরবাইকে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ন। যথেষ্ট সুদর্শন সে, যেন কোনও সিনেমার হিরো!

দীপকাকু বলে ওঠেন, আর একটা জিনিস আমায় বলুন তো, সায়নের কোনও মুদ্রাদোষ বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্য আছে কি?

ভাবতে একটু সময় নিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর বললেন, না, সে রকম কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। এটুকু শুধু বলতে পারি, ও খুব ফিটফাট থাকা পছন্দ করে।

—ঠিক আছে। দেখি কতটা কী করতে পারি। বলে সেকেন্ড খানেক বিরতি নিলেন দীপকাকু। ফের বলে উঠলেন, আমি এরপর থেকে আপনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখব। পাঁচ বছর আগে সায়নের যে ক’জন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল, তাদের নাম-ঠিকানা জোগাড় করে রাখবেন। আমার দরকার পড়তে পারে। হয়তো এখনও কোনও এক-দু’জন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে সে।

—অবশ্যই রাখব জোগাড় করে। বলে ফের ড্রয়ার টানলেন ডাক্তারবাবু। এবার বার করলেন চেকবই। দীপকাকুকে বললেন, আপনাকে কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে রাখি ?

– না, এখনই দরকার নেই। আপনি আমাকে প্রায় খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার কাজ দিয়েছেন। কতটা এগোতে পারব, একটু বুঝে নিই। তারপর অ্যাডভান্সের কথা। বলা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন দীপকাকু। দেখাদেখি ঝিনুকও উঠল।

কথা এখনও শেষ হয়নি দীপকাকুর, যে চেয়ারে বসেছিলেন তার ব্যাক পোর্সানে উপর বাঁ হাত রেখে বলতে থাকলেন, আপনাকে কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে রাখি। শুনে আপনি ডিসিশন নিন, কেসটা আমায় দেবেন কি না।

—কী কথা বলুন? জানতে চাইলেন ডা. রায়।

দীপকাকু বললেন, যদি আমি সায়নের খোঁজ পাই, আপনাকেও যেমন জানাব, পুলিশকেও ইনফর্ম করব। সায়ন আইনের চোখে ফেরার আসামি। এটা জানা সত্ত্বেও ওর খোঁজ পাওয়ার পর পুলিশকে আমার না জানানোটা দেশের নাগরিক হিসেবে অন্যায় করা হবে।

– না, না, এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। পুলিশকে আপনি অবশ্যই জানাবেন। কিন্তু তার আগে বাবলার সঙ্গে আমার কথা বলার ব্যবস্থাটা করে দিন। ওতেই আমার কাজ হয়ে যাবে। বললেন ডা. রায়।

দীপকাকু হাত বাড়িয়ে ওঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক সারলেন। তারপর ঘুরে গিয়ে এগোলেন দরজার দিকে। ঝিনুক অনুসরণ করল।