আট । ভাগ্যলক্ষ্মীর ত্যাজ্যপুত্র
ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিরা পাঁচ-পাঁচ বার নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সম্মিলিত হয়েছিল, কিন্তু পাঁচবারই তাদের আর্তনাদ করতে হয়েছে একজন মাত্র মানুষের পায়ের তলায় পড়ে!
এইবারে ষষ্ঠবারের জন্যে তারা আবার সম্মিলিত হল। এবারে দলে আছে রুশিয়া, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড ও সুইডেন।
নেপোলিয়ন রুশিয়ায় নিজের সর্বনাশ করে এসেছেন। যে শিক্ষিত সেনাদলের জন্যে ইউরোপে তিনি অপরাজেয় হয়েছিলেন, তাদের কঙ্কাল পড়ে আছে এখন রুশিয়ার তুষার-মরুর মধ্যে।
কিন্তু নেপোলিয়ন নামের এমনই মোহিনীশক্তি, আবার তাঁর আহ্বানে প্রাণ দিতে ছুটে এল দলে দলে নতুন বীর! যদিও এই নতুন বাহিনীর মধ্যে আগেকার মতন শিক্ষিত ও রণপ্রবীণ সেপাই নেই, তবু তাদের নিয়েই আবার তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করলেন না।
প্রথমে লড়াই হল প্রুশিয়া ও রুশিয়ার সঙ্গে (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে)।
একেবারে কাঁচা সেপাই, তার উপরে কামানের অভাব—কামানও খোয়া গেছে রুশিয়ায়। তবু লুটজেন ও বউটজেন ক্ষেত্রে মায়াবী নেপোলিয়নকে সঙ্গে পেয়ে নবীন ফরাসি সৈনিকরা এমন উন্মাদনা ও বীরত্ব প্রকাশ করলে যে, শত্রুরা দুইবারই পলায়ন করতে বাধ্য হল।
নেপোলিয়ন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আজ বিশ বৎসর ধরে ফরাসি সৈন্য চালনা করছি, কিন্তু এর চেয়ে সাহস আর ঐকান্তিকতা আর কখনও দেখিনি! আমার সাহসী, নবীন সৈন্য এরা। গৌরব আর বীরত্বের ধারা এদের শিরায় শিরায়।’
নেপোলিয়ন আবার বার্লিনের কাছে! রুশ ও প্রুশিয়ানরা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়াও ভিড়ে গেল তাদের দলে। সংখ্যায় তারা দুই লক্ষ। রুশ ও প্রুশিয়ানদেরও ফৌজে হাজার হাজার নতুন সেপাই এসে যোগ দিয়েছে। সুইডেনও পাঠিয়েছে কয়েক হাজার সৈন্য। দাদা জোসেফের ভায়রাভাই বার্নাদেটকে নেপোলিয়ন দয়া করে সুইডেনের সিংহাসন দান করেছিলেন, এখন সে তারই প্রতিদান দিতে এসেছে উপকারীর মাথার উপরে খাঁড়া তুলে।
অন্যান্য সেনাপতিদের সসৈন্যে দিকে দিকে রেখে মূল ফৌজ নিয়ে নেপোলিয়ন শত্রুদের আক্রমণ করলেন। কিন্তু শত্রুরা যুদ্ধ করতে লাগল নতুন পদ্ধতিতে। নেপোলিয়নকে দেখলেই তারা পশ্চাৎপদ হয়, আর লড়াই করে হারায় অন্যান্য ফরাসি সেনাপতিদের। তবু নেপোলিয়ন ড্রেসডেন শহরের কাছে আবার তাদের যুদ্ধে নামতে বাধ্য করলেন। এখানে শত্রুদের সঙ্গে ছিলেন ভূতপূর্ব ফরাসি সেনাপতি জেনারেল মোরো—যাঁর মুণ্ডু কাটা যায়নি নেপোলিয়নেরই উদারতায়!
ড্রেসডেনের যুদ্ধই হচ্ছে বিজয়ী নেপোলিয়নের শেষ বড় যুদ্ধ (১৮১৩, জুলাই)। এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি বিশ হাজার শত্রু বন্দি করেন। এবং এইখানেই মারা পড়েন জেনারেল মোরো।
কিন্তু যুদ্ধে জিতলে কী হবে, এবারে শত্রুসংখ্যা যেন অনন্ত! তাদের কাবু করা অসম্ভব। উপরন্তু তারা নেপোলিয়নের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করে না, যেখানে নেপোলিয়ন নেই, সেইখানেই তাদের আবির্ভাব! এমনি করে দিনে দিনে ফরাসিরা যত দুর্বল হয়ে পড়ছে, শত্রুরা হয়ে উঠছে ততই প্রবল!
তারপরে আরম্ভ হল লিপজিকের তিনদিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধ। আসলে এটি হচ্ছে ধারাবাহিক ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধের সমষ্টি (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে, ১৬ থেকে ১৮ পর্যন্ত)। মিত্রপক্ষে ছিল তিনলক্ষ সৈন্য এবং নেপোলিয়নের সৈন্য-সংখ্যা মাত্র এক লক্ষ বিশহাজার। তার উপরে যুদ্ধের সময়ে তাঁর সামন্ত রাজাদের বহু সৈন্য শত্রুপক্ষে গিয়ে যোগদান করেছিল। তবু নেপোলিয়ন প্রাণপণে লড়লেন, কিন্তু প্রায় ষাট হাজার শত্রু বধ করেও অসম্ভবকে আর সম্ভব করতে পারলেন না। অবশেষে তাঁর কামানের গোলাও ফুরিয়ে গেল। কেবল গোলা নয়, ফরাসিদেরও লোকক্ষয় হল পঞ্চাশ হাজার। তাঁর পক্ষে তখন পশ্চাৎপদ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।
এই পরাজয়ের পর সমগ্র ইউরোপের দিকে দিকে নতুন নতুন শত্রু নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। এমনকী, তাঁর দয়ায় আজ যারা মাথায় পড়েছে রাজমুকুট, তারাও শত্রুরূপে আত্মপ্রকাশ করতে লজ্জিত হল না—এমনকী তাঁর ভগ্নীপতি ও হাতেগড়া নেপলসের রাজা মুরাট পর্যন্ত! ইতালিতে আবার ফরাসি প্রভুত্ব বিলুপ্ত হল, স্পেনেও তাই!
নেপোলিয়ন তখন সন্ধিপ্রার্থনা করলেন! মিত্রপক্ষ সন্ধির যে শর্ত দিলেন তা অন্যায় নয়। নেপোলিয়নকে তাঁরা কেবল ফ্রান্সরাজ্য ছেড়ে দিতে রাজি হলেন, কিন্তু সে শর্ত বাতিল করে নেপোলিয়ন নিজের দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনলেন নিজেই!
আবার যুদ্ধ আরম্ভ হল, নেপোলিয়ন লড়তে লাগলেন সপ্তরথীর দ্বারা বেষ্টিত একা অভিমন্যুর মতন! মিত্রপক্ষের অসংখ্য সৈন্যের তুলনায় তাঁর সৈন্যবল নগণ্য! সাধারণ সৈনিকের মতন তিনি যুদ্ধসাগরে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন, তাঁর চারিদিক দিয়ে ছুটতে থাকে মৃত্যু-ঝটিকা!
মন্টরিউ যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই যেখানে ঘোরতর হয়ে উঠেছে, নেপোলিয়ন সেইখানে গিয়ে হাজির! অশ্বপৃষ্ঠে নয়, পদব্রজে!
বুড়ো গোলন্দাজরা তাদের প্রিয় সম্রাটকে এই বিপদের মধ্যে এসে দাঁড়াতে দেখে একেবারে মারমুখো হয়ে উঠল।
তারা আজন্ম সৈনিক, কেউ আদবকায়দা ও মার্জিত ভাষার ধার ধারে না। ছেলেকে স্নেহশীল বাপ যেমনভাবে ধমক দেয়, তেমনি ভাবেই একজন কঠোর স্বরে বললে, ‘সম্রাট! এ তোমার জায়গা নয়!’
নেপোলিয়ন হেসে বললেন, ‘বীর, যে বুলেটে আমি মরব, এখনও তা তৈরি হয়নি!’
দুর্বল হয়েও একে একে নেপোলিয়ন আরও কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেন—কিন্তু বৃথা! শত্রুরা বেড়ে উঠছে রক্তবীজের ঝাড়ের মতন! নেপোলিয়নের সৈন্যসংখ্যা কমছে বই বাড়ছে না! প্রুশিয়ান জেনারেল ব্লুচার এ-পর্যন্ত যে কতবার তাঁর কাছ থেকে হেরে পালালেন তার আর সংখ্যা হয় না! তবু যতবারই তিনি পালান, ততবারই নতুন পল্টন নিয়ে আবার ফিরে আসেন। প্রত্যেক পরাজয়ের পর ব্লুচার যেন অধিকতর বলবান হয়ে ওঠেন!
নতুন সৈন্যদলের উপায় নেই, নতুন শক্তিলাভের সম্ভাবনা নেই, তবু নেপোলিয়ন লড়ছেন, লড়ছেন, লড়ছেন! কিন্তু বৃথা! লক্ষ লক্ষ শত্রু চারিদিক দিয়ে প্যারির দিকে ধেয়ে আসছে মহাবন্যার মতন! এই দুর্বল অবস্থায় কোনওদিক সামলাবেন তিনি? অবশেষে অসম্ভবকে লাভ করবার জন্যে ফরাসি সৈন্যদেরও আর কোনও আগ্রহ রইল না, নতুন যুদ্ধের কথা শুনলে ফরাসি সেনাপতিরাও বিরক্ত হয়ে ওঠেন! ফ্রান্সের জনসাধারণও অবিশ্রান্ত যুদ্ধপ্রবাহে পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। দেশের অধিকাংশ পরিবারই সন্তান বা পিতা বা স্বামী বা আর কারুকে হারিয়েছে—তাদের আর সৈনিক জোগান দেওয়ারও শক্তি নেই। তারাও একবাক্যে বলে উঠল, ‘যুদ্ধ নয়, আর যুদ্ধ নয়!’
নেপোলিয়ন তখনও সত্তর হাজার সৈন্য জোগাড় করতে পারতেন এবং শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অগণ্য হলেও তখনও তাঁকে এমন যমের মতন ভয় করে যে, আটঘাট বেঁধে প্যারির চারিদিক ঘিরে দূরে বসে থাকলেও, কেউ আর তাঁর কাছাকাছি আসতে রাজি নয়!
ঘরে-বাইরে বাধা পেয়ে নেপোলিয়ন সিংহাসন ত্যাগ করলেন (১৪ এপ্রিল, ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে)।
মিত্রপক্ষ বললেন, ভূমধ্যসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ এলবা, অতঃপর নেপোলিয়নকে সেইখানেই বাস করতে হবে। নিজের দ্বীপের ভিতরে তিনি স্বাধীনই থাকবেন, তাঁর সম্রাট উপাধিও বজায় রইল।
সমগ্র ইউরোপে যাঁর ছায়া ধরত না, তাঁর রাজ্য হবে এলবা দ্বীপ—চওড়ায় ছয় ও লম্বায় উনিশ মাইল!
নেপোলিয়ন আর সইতে পারলেন না, চেষ্টা করলেন সকল জ্বালা জুড়োতে। তিনি বিষপান করলেন। কিন্তু মৃত্যুও তাঁকে সাহায্য করলে না, বিষের তাড়নায় কেবল কষ্ট পেলেন মাত্র। নিয়তি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলে, অধিকতর দুর্ভাগ্যের জন্যে। (কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকই এই আত্মহত্যা চেষ্টার কথা বিশ্বাস করেন না এবং তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে।)
নেপোলিয়নের ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী চলে গেলেন বাপের বাড়িতে, অস্ট্রিয়ার রাজপ্রাসাদে। নেপোলিয়ন জীবনে আর স্ত্রী-পুত্রের মুখ দেখেননি।
ফ্রান্স থেকে বিদায় নেওয়ার দিন এল। রাজপ্রাসাদের সোপানশ্রেণির উপরে নেপোলিয়ন, প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করছে প্রাচীন রক্ষী ফৌজের রণপ্রবীণ সৈনিকগণ—তাঁর সঙ্গে যারা শত শত যুদ্ধ জয় করেছে।
নেপোলিয়ন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলেন, সৈনিকরা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সমস্বরে বলে উঠল, ‘সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!’
নেপোলিয়ন সৈন্যদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অভিভূত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার প্রাচীন রক্ষী বাহিনীর সৈনিকগণ! আজ বিশ বৎসর ধরে দেখছি, সর্বদাই তোমরা বিচরণ করেছ যশ ও গৌরবের পথে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তোমরা হয়েছ নির্ভীকতা ও বিশ্বস্ততার আদর্শ—আমার সৌভাগ্যের দিনেও তোমরা যা ছিলে।…ফ্রান্সে ঘরোয়া যুদ্ধের সম্ভাবনা হয়েছিল। সেইজন্যেই দেশের মুখ চেয়ে আমি নিজের সমস্ত স্বার্থকে বলি দিলুম। আমি বিদায় নিচ্ছি।…বন্ধুগণ, তোমরা ফ্রান্সের সেবা করো। তোমাদের সঙ্গে রইল আমার শুভ-ইচ্ছা। আমার অদৃষ্টের জন্যে অশ্রু ফেলো না। তোমাদের যশোগৌরব বাড়াবার জন্যেই আমি বেঁচে রইলুম। আমরা সকলে মিলে যে মহান কীর্তি স্থাপনা করেছি, তারই কাহিনি রচনা করব আমি। সন্তানগণ, বিদায়! তোমাদের সকলকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলে আমি খুশি হতুম। অন্তত তোমাদের পতাকা দাও—আমি চুম্বন করব।’
পতাকাবাহী পতাকা নামালে। নেপোলিয়ন তাকে আলিঙ্গন ও পতাকাকে চুম্বন করলেন এবং বললেন, ‘সঙ্গীগণ, বিদায়।’
তিনি দ্রুতপদে শকটের ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন। আবার উচ্চরব উঠল—’সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!’ শকট চলে গেল।
যুদ্ধকঠিন প্রাচীন সৈনিকরা সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিশুর মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। যেন তারা আজ পিতৃহারা!
দৃশ্যপট বদলে গেল।…পল্লিপথ দিয়ে নির্বাসিতের শকট ছুটছে। এখান দিয়ে যেতে যেতে নেপোলিয়ন আর এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। এখানে সৈনিকদের অশ্রুজল নেই, শিক্ষিত নাগরিকদের মৌখিক সভ্যতার মুখোশও নেই। এখানে পথের দুধারে গ্রাম্য ইতরের জনতা! উলঙ্গ হৃদয়! যাদের ভাই-ছেলে-বাপ-স্বামী যুদ্ধ ক্ষেত্রের রক্তসাগরে অতলে তলিয়ে গেছে, তারা অপেক্ষা করছে আজ নেপোলিয়নকে অভ্যর্থনা করতে! নেপোলিয়নের গাড়ি দেখা যায় আর গগনভেদী চিৎকার ওঠে—’অত্যাচারীকে উচ্ছন্নে দাও!’ ‘হত্যাকারীকে হত্যা করো!’ নর-নারীরা পাগলের মতন গাড়ির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ইট ছোড়ে, গালাগালি দেয় অকথ্য ভাষায়!
ফ্রান্সের মানসপুত্র নেপোলিয়ন! আজ তাঁকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হল! কী উত্থান! কী পতন!