আজব বাঘের আজগুবি – শৈলেন ঘোষ
০১.
আমি আগে কখনো মানুষ দেখিনি। বলতে কী, মানুষের নামগন্ধও শুনিনি। প্রথম মানুষের নাম শুনে কেমন যেন একটা অদ্ভুত মজা লেগেছিল আমার। এমন মজা তোমার যদি লাগত, তুমি নিশ্চয়ই হেসে ফেলতে। কিন্তু আমি বাঘ। আমায় কেউ হাসতে শেখায়নি। এমনকী, আমার ঠাকমাকেও আমি কোনোদিন হাসতে দেখিনি।
এখন আমার ঠাকমা বুড়ি হয়ে গেছে। তা হলেও, এখনও যদি হাঁক পাড়ে, বন থরহরি। ইচ্ছে করলে এখনও এক থাবায় ইয়া পেল্লাই বুনো-মোষের ঘাড় লটকে দিতে পারে। বুনো-মোষকে পিঠে নিয়ে বন ডিঙিয়ে লাফ মেরে পালাতে পারে।
ঠাকমার যে অনেক বয়েস, তুমি অবশ্য তা দেখলে বুঝতে পারবে না। কারণ, এখনও একটিও দাঁত পড়েনি। চোখের তেজ একটুসুও কমেনি। থাবার নখ এতটুকু ভোঁতা হয়নি। আমি হলফ করে বলতে পারি, তুমি দেখলে ভয় পেয়ে যাবে। আমি নিজেও তো দেখেছি, একটা বড়ো হরিণ ধরে এনে থাবার নখ তার গায়ের ওপর একবার শুধু আলতো করে বুলিয়ে দিল, অমনি হরিণের গায়ের চামড়া দু-ফাঁক হয়ে ঝুলে পড়ল। কিন্তু আমি যদি ঠাকমার পাশে এসে দাঁড়াই, তখনই তোমার মনে হবে, ঠাকমার বয়েস হয়েছে। ঠাকমার পাশে আমাকে দেখলে তুমি ভাববে, বয়েসে আমি নেহাতই নাবালক।
আসলে তাই। আমার কী আর এমন বয়েস! তা হলেও কিন্তু ঠাকমার চেয়ে আমি অনেক বেশি লাফালাফি করতে পারি। ঠাকমা তো একটু বেশি ছোটাছুটি করলে হাঁপিয়ে পড়ে। আমার ওসব নেই। চুপচাপ বসে থাকতে আমার ধাতে সয় না। তা ছাড়া আমার নিজের চেহারার দিকে আমি যখনই তাকাই, আমার তখনই বুক ফুলিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে। আমার গায়ে রঙের বাহার কী! ডোরা ডোরা দাগগুলো ঝকঝক করছে। থাবার নখগুলো চকচক করছে। আমার নিজেরই নিজেকে এত ভালো লাগে!
আমি আমার ঠাকমার কাছেই প্রথম মানুষের কথা শুনি। আমার ঠাকমা অনেকবার মানুষ দেখেছে। আমি শুনেছি, আমাদের মতো মানুষের চারটে পা নয়। পায়ে থাবাও নেই। মানুষের দুটো হাত আর দুটো পা। দু পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে হাঁটা-ছোটা, চলাফেরা করতে মানুষের কোনো অসুবিধেই হয় না। একথা শুনে আমার খুব অবাক লেগেছিল। আমি নিজেও যে দুপায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটাচলা করতে চেষ্টা করিনি, তা নয়। কিন্তু একেবারে অসম্ভব! তবে আমাদের এখানে ভাল্লুকগুলো পারে। বাচ্চা ছেলেকে বুকে নিয়ে মা-ভাল্লুক যখন হাঁটে, তখন বেড়ে দেখতে লাগে! ভালুকের অমন হাঁটা দেখেই আমি মানুষেরও একটা মোটামুটি চেহারা ধারণা করে নিয়েছিলুম। অবশ্য মানুষের গায়ে যে ভাল্লুক অথবা আমাদের মতো লোম নেই, সেটা ঠাকমা আমায় আগেই বলেছিল। ঠাকমার ধারণা মানুষের মাথাটা দেহের একেবারে ওপরে বলে ওদের বুদ্ধি খুব। তবে সাহস নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। কেউ বলে, মানুষ ভীষণ সাহসী, আবার কেউ কেউ বলে, ফুঃ! ওদের হাতে বন্দুক থাকে বলে ওদের এত সাহস। একা-একা লড়ে যাক! তবে ঠাকমা বলে, বাঘকে মানুষ যমের মতো ভয় করে। বাঘের সামনে বন্দুক ছাড়া এক পা এগোতে পারে না। কিন্তু ভাল্লুক বলো, কী হাতি বলল, মানুষ ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে সহজেই পোষ মানায়। শুনেছি রাস্তায় রাস্তায় ভাল্লুকের নাচ দেখিয়ে বেড়ায়।
সত্যি বলছি, প্রথম যেদিন নাচের কথা শুনি, মানে ভাল্লুক নাচে এই কথাটা শুনলাম, সেদিন আমি এক্কেবারে থ। প্রথমত নাচ ব্যাপারটা কী, নাচলে সাপের পাঁচ পা দেখা যায় কি না, কিম্বা নাচ জিনিসটা চোখে দেখার অথবা পেটে খাওয়ার, তা আমি একদমই জানতুম না। তারপর মশাই, নাচের মানেটা যখন আমার মাথায় ঢুকল, যখন জানলুম, নাচ মানে পা। ঠুকে ঠুকে ধেই ধেই করা আর ধেই ধেই করে কোমর বেঁকিয়ে ঘাড় দুলিয়ে লাফ মারা, তখন সত্যিই আমি তাজ্জব বনে গিয়েছিলুম। কারণ, ভাল্লুকের চেহারাটা এমন বিদঘুটে। হোক্কাই চমচমের মতো যে, সে কোমর বেঁকিয়ে নাচবে, এ আমি ভাবতেই পারি না। আমি ভাবতে পারি চাই নাই পারি, ভাল্লুক নাচে, নাচছে, নাচবে!
সুতরাং, একদিন আমার মনে হল, ভাল্লুক যদি নাচতে পারে তা হলে আমিও পারি। আর তাই একদিন নিজঝুম চাঁদনি রাতে আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছিল। জানো তো, আমি বাঘ বলে আমার ফ্যাচাং-এর ঠেলা কত! নাচতে হলে আমায় লুকিয়ে-ছাপিয়ে নাচতে হবে। কেন না, কেউ দেখে ফেললে বদনামের একশেষ! বাঘ আবার চ্যাংড়ার মতো নাচবে কী! যার হুংকারে বনের পিলে ফাটবার গোত্তর, সে ধেই ধেই করে নাচছে, এটা কারো নজরে পড়লে মুখ দেখাবার যো থাকবে! কাজেই আমার নাচ আমি ছাড়া আর যাতে কেউ না দেখতে পায়, সেইজন্যে বনের যেদিকটা সবচেয়ে নিরিবিলি সেইখানেই চার-পা তুলে ধাঁই ধপাধপ শুরু করে দিলুম। সুখের কথা, আমার নাচ দেখবার জন্যে টিকিট নিয়ে মারামারি কাটাকাটি লেগে যায়নি। কারণ, কেউ জানতেই পারেনি আমি এখানে নাচের আসর বসিয়েছি। কিন্তু দুঃখের কথা, চাঁদনি রাতে আকাশ উপচে সেদিন জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়লেও, নাচ ব্যাপারটা আমার নিজের কাছে নেহাৎ-ই একটা ফালতু ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, এ-সব উদ্ভুট্টি কাণ্ডকারখানা ভাল্লুক-টালুকদেরই সাজে! ওসব কম্ম বাঘের জন্যে নয়। ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! বাঘ কোমর বেঁকিয়ে নাচবে কী! বাঘ কি যাত্রাপার্টির সঙ!
সৌভাগ্যই বলো আর দুর্ভাগ্যই বলল, আমি আগে বন্দুক জিনিসটা কী, জানতুমই না। বন্দুক নাকি একটা সাংঘাতিক যন্তর। ঠাকমা বলে, বন্দুকের গুলি গায়ে লাগলে রক্ষে নেই। অজান্তে বন্দুকের সামনাসামনি পড়লে নির্ঘাত মরণ! আমার মাকে নাকি আমি সেই বন্দুকের গুলিতেই হারিয়েছি! শুনি, আমার মা ছিল মানুষখেকো!
আমি তখন খুব ছোটো। জ্ঞানগম্যি বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। তাই মা যখন আমায় ছেড়ে চলে গেল, তখনকার কথা আমার আবছা আবছা মনে আছে। আমি মায়ের যেটুকু আদর। পেয়েছি, তা-ও আমার স্পষ্ট মনে নেই। ঠাকমাই আমাকে বড়ো করে তুলেছে।
মানুষখেকো কথাটা শুনলেই আমার কেমন গা ঘিনঘিন করে। সত্যি বলতে কী, বাঘে মানুষ খায়, এ-কথাটা আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী আসে যায়। মা পঞ্চাশটার ওপর মানুষ মেরেছিল। মেরে মেরে মানুষের রক্ত খেয়েছিল। দুর্দান্ত সাহস ছিল আমার মায়ের। মারাত্তিরবেলা বন ডিঙিয়ে মানুষ-পাড়ায় চলে যেত। মানুষের ঘর থেকে চুপিসাড়ে ষণ্ডা ষণ্ডা মানুষ ধরে নিয়ে আসত। শুনেছি, মানুষ শিকার করা নাকি সবচেয়ে সোজা। অবশ্য আমার ঠাকমা মাকে অনেকবার বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘বেশি বাহাদুরি করা ঠিক না।’ কিন্তু আমার ঠাকমার কথা মা শোনেইনি। তা ছাড়া শুনেছি নাকি, মানুষের রক্ত পেটে পড়লে তার লোভ ছাড়া দায়! মানুষের রক্ত নাকি খুব মিষ্টি! একবার স্বাদ পেলে আর রক্ষে নেই! নেশা ধরে যায়!
মা সাধ করে মানুষখেকো হয়নি। মানুষের ওপর মায়ের ছিল ভীষণ রাগ। অবশ্য এর জন্যে আমি মাকে খুব দোষ দিই না। দোষ যদি দিতে হয়, মানুষকেই দেব। যদি বলো কেন, তাহলে বলি, আমার বাবাকে মানুষ ধরে নিয়ে গেছে! নিশ্চয়ই জানো, বাঘ ধরা ব্যাপারটা অত সহজ নয়। কিন্তু ওই যে বলেছি, ঠাকমা বলে, মানুষ দারুণ চালাক।
বুদ্ধিতে বাবাও কম যেত না। কিন্তু আমার অমন বুদ্ধিমান বাবাকেও যে মানুষগুলো এমন। বোকা বানিয়ে দেবে এ-কথাটা বাবা কেন, কেউই ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেনি।
বাবার ছিল দারুণ স্বাস্থ্য, নিটোল। আর খুব চমৎকার গড়ন। গর্জন করতে করতে বন। কাঁপিয়ে বাবা যখন হাঁটত, তখন দেখলে মনে হত, সত্যিই বাবা বনের রাজা। বাবা কাউকে কেয়ারই করত না। কেয়ার করার দরকারই ছিল না। কারণ, বাবার মূর্তি দেখলে ধারে কাছে ঘেঁষে এমন সাধ্যি কার!
কিন্তু এই কেয়ার না করাটাই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে, আগেভাগে সেকথা আর কে জানতে পারবে? কে বুঝবে, বনের রাজাকে ধরবার জন্যে বনের আনাচে ফন্দি এঁটে মানুষ ঘাপটি মেরে বসে আছে! সত্যিই সেদিন এক মস্ত হার হয়ে গেল আমাদের। বাবা মানুষের হাতে বন্দি হয়ে গেল।
বাবার সেই বন্দি হয়ে যাওয়ার কথাটাই তোমাদের আগে বলি।
রোজই তো বাবা সন্ধের ঝোঁকে শিকার করতে বেরোয়। সেদিনও বেরিয়েছিল। সেদিন হয়তো বাবার ইচ্ছে ছিল হরিণ ধরবে। কিন্তু তোমরা হয়তো জান না, হরিণ ধরা খুব শক্ত। নজরে পড়লে এমন ছুটবে, শত চেষ্টাতেও তাদের ধরা যাবে না। এক যদি ওই লম্বা শিংগুলো লতাপাতায় আটকে না যায়। কিন্তু হরিণ ধরতে গিয়ে বনের অন্ধকারে বাবা যে আচমকা একটি নধরকান্তি ভেড়া দেখতে পাবে, এ-কথা কে জানবে! সেটি যে মানুষই। চালাকি করে ছেড়ে রেখেছিল, তা বাবা একদম বুঝতে পারেনি। তাই ভেড়াটিকে দেখতে পেয়েই বাবা টিপ করে মেরেছে লাফ। অমনি সঙ্গে সঙ্গে, দুম দুম! আওয়াজটা বন্দুকের নয়, বোমার। প্রচণ্ড আওয়াজ। বাবা হকচকিয়ে সাংঘাতিক চমকে উঠেছে। ভেড়াটাকে। ছেড়ে মার ছুট! ছুটবে কোন দিকে? যেদিকে ছুটবে সেদিক থেকেই অমনি শয়ে শয়ে মানুষ ক্যানেস্তারা, ঘন্টা পিটিয়ে খেদা লাগাল। বাবার তো চক্ষু চড়কগাছ। সামনে ছুটতে গিয়ে। থমকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েই, পেছনে ছুটতে গেল। অমনি পেছন থেকেও শয়ে শয়ে মানুষ চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠে বাবাকে তেড়ে এল। বাবা আকাশ-পাতাল কিছু ভেবে না পেয়ে, চোখ-কান বুজে মারল লাফ। ব্যস! বাবা যে একটা শুকনো পাতা চাপা দেওয়া। গর্তের মধ্যে লাফ মেরে পড়বে, সে কথা আর কে জানত? সত্যি, একেবারে হুমড়ি খেয়ে একটা গর্তের মধ্যে মুখ গুজরে বাবা পড়ে গেল! কী গভীর গর্তটা! সেখান থেকে শত লাফালাফি করেও বাবা উঠতে পারল না। আকাশ ফাটিয়ে তর্জন-গর্জন করেও কোনো লাভ হল না। বাবা এখন মানুষের ফাঁদে পড়েছে। বাবাকে ধরবে বলে মানুষ গর্ত কেটে, তার ভেতরে একটি লোহার খাঁচার ফাঁদ তৈরি করে রেখেছিল। তারা জানত, আমার বাবা শিকার ধরতে এদিকেই আসবে। তারপর শুকনো পাতা দিয়ে সাজানো এই ফাঁদে পড়ে বন্দি হবে।
বাবা বন্দি হয়েছিল। ওই লোহার খাঁচায় বন্দি করে বাবাকে মানুষের দল ধরে নিয়ে গেল। তারপর যে বাবার কী হল, কেউ জানে না।
আর এইতেই আমার মায়ের মাথা গেল বিগড়ে। যাবারই কথা। বাবার জন্যে আমার মা এমন মুষড়ে পড়ল যে, মনে হল মা বুঝি আর বাঁচবেইনা। কিচ্ছু খেত না, কোথাও যেত না। শুধু পড়ে পড়ে গুমরাতো। আর ঠাকমারও মনে ভীষণ লেগেছিল। ঠাকমা অত দুঃখেও ভেঙে পড়েনি। মাকে বলত, ‘বউ, ওঠ। খেয়ে নে। অমন উপোষ করে থাকলে মরবি যে। নিজের কী দশা হয়েছে, একবার চেয়ে দেখেছিস? ছেলেটাকে তোবাঁচিয়ে রাখতে হবে!’
ছেলেটা মানে, আমি। আগেই তো বলেছি, আমি তখন একদম ছোটো। আর সেইজন্যেই বাবার কী হল না হল, সে-সব নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার কথা নয়। আমি নিজের। খেয়ালেই মত্ত। ছুটি, লাফাই, খেলা করি। বাবাকে দেখতে না পেয়ে, হঠাৎ হঠাৎ যখন বাবার কথা আমার মনে পড়ে যায়, জিজ্ঞেস করলেই ঠাকমা বলে, ‘তোর বাবা বে-বাড়ি গেছে নেমন্তন্ন খেতে।’ আমি শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তর দিতুম, ‘ও।’ কিন্তু দেখতুম, আমার কথা শুনে আর আমার মুখের দিকে চেয়ে, মায়ের চোখ ছলছল করছে। আমি ভাবতুম, মায়ের বোধ হয় ব্যামো হয়েছে। পেট কামড়াচ্ছে, তাই কাঁদছে। পেট কামড়ালে আমিও কাঁদি। সে তো এক-একদিন। কিন্তু মা তো রোজই পড়ে পড়ে কাঁদে। তাহলে কী মায়ের ভারি অসুখ করল!
.
০২.
অনেকদিন কেটে গেল। সত্যিই আর বাবা ফিরে এল না। ফিরে যে আসবে না, এ-তো জানা কথা। তবু তো বলা যায় না। অঘটন ঘটেও তো যেতে পারে। কিন্তু না, কিছুই ঘটল না। এটা ভাবাও তো মিথ্যে যে, লোহার খাঁচা ভেঙে বাবা পালিয়ে আসবে! এ-তো সবাই জানে, মানুষের খপ্পর থেকে নিস্তার পাওয়া মানে, যমের দুয়ার থেকে ফিরে আসা। অত সোজা! সোজা নয় ঠিকই, কিন্তু কেউ আশা কি ছাড়ে?
মায়ের আশা যখন সত্যি সত্যি ভেঙে গেল, বাবা যখন সত্যিই ফিরল না, সেই তখন থেকেই আমার মা মানুষের ওপর খেপে গেল ভয়ংকর রকম। মানুষ দেখলেই তাকে মারো। তার টুটি টিপে রক্ত শুষে খেয়ে ফেলো, এই হল মায়ের গোঁ! আর এই করতে করতেই মা হয়ে উঠেছিল পাকা মানুষখেকো। মানুষ মারার জন্যে মা জঙ্গল ডিঙিয়ে। চুপিসাড়ে পাড়ি দিয়েছে লোকালয়ে। যাকে পেরেছে খতম করেছে। নিজের গায়ের জ্বালা মিটিয়েছে। শেষে এমন স্বভাব হয়ে গেল, যেন মানুষ মারাটা কিছুই নয়। হাতের টুসকি।
বেশি গোঁয়ারতুমি করাটা যে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়, এ-কথা মাকে কে বোঝাবে? মার খেতে খেতে মানুষও যে চুপটি করে হাত গুটিয়ে হরিনাম জপছে না, এ তো আর মা জানত না। তাকে মারবার জন্যে মানুষও যে মতলব আঁটতে পারে, এটা মগজে ঢোকেইনি মায়ের। তাই মায়ের সাহস যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেল। শেষে একদিন দিনদুপুরেই এক ভয়ানক কাণ্ড করে বসল মা।
আমাদের বনটা পেরোলেই যে বস্তিটা নজরে পড়ে, সেখানে যে অনেক লোকজন, তা নয়। দু-চার ঘর। তা হলেও, আমি বলব, দিনের বেলা সেখানে বাঘ-ভাল্লুকের যাওয়া মোটেই উচিত নয়। আমার মা কিন্তু তাই করে বসল। হুট করে ভরদুপুরেই সেখানে হাজির হল। জায়গাটা মোটেই খোলামেলা নয়। কারণ, বস্তিটা বনের একেবারে কোলে। এদিকে বনটা অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে বটে, কিন্তু গাছগাছালি, ঝোপঝাড় যথেষ্ট আছে। দেখলে মনে হবে, ঘন জঙ্গলের গায়ে গা ঠেকিয়ে বস্তিটা দাঁড়িয়ে আছে। তখন কাঠফাটা রোদ্দুর। একটা ছোটো ছেলে এই নির্জন দুপুরে ঘোড়াকে খাওয়াবে বলে, বনের ধারে ঘাস কাটতে এসেছিল। ছেলেটা নাকি রোজই আসে। রোজই নাকি তার সঙ্গে কেউ না কেউ সঙ্গী থাকে। মা ক-দিন ধরেই লক্ষ করেছে। কিন্তু শিকার করার তেমন জুতসই সুযোগ আসেনি। এ কথাটা তো ঠিক, রাগ দেখিয়ে হুট করে কিছু করতে গেলে বিপদ সবারই হতে পারে। সুতরাং, মা ঝোপের আড়ালে ওঁত পেতে বসে থাকে আর সুযোগ খোঁজে।
আজ সুযোগ মিলে গেল। কে জানে কেন, ছেলেটার সঙ্গে আজ কোনো সঙ্গী ছিল না। আজ ছেলেটা একাই এসেছে। মা যেদিক থেকে ছেলেটাকে লক্ষ করছিল, সেদিকে পেছন করেই ছেলেটা ঘাস কাটছে। সেই তক্কে মা ছেলেটার ঘাড়ে মেরেছে এক লাফ! লাফ মেরেই থাবার বাড়ি এক ঝটকা। ছেলেটার মুখ দিয়ে রা পর্যন্ত বেরোল না। সেখানেই লুটিয়ে পড়ল। মা সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে মুখ দিয়ে চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা। ঝোপের মধ্যে। সেখানে লুকিয়ে রাখল। কারণ, মা জানে এখন এটাকে খাওয়া যাবে না। এক্ষুনি চারিদিকে হইচই পড়ে যাবে। ছেলেটার খোঁজ করতে দলে দলে লোক এসে পড়বে। এখন এখানে থাকলে বিপদও হতে পারে। অন্ধকার রাত্তির হচ্ছে সবচেয়ে ভালো সময়। তাই রাত্তিরে আসার মতলব এঁটে মা ছেলেটাকে লুকিয়ে রেখে ওখান থেকে সরে পড়ল। মা নিশ্চিত জানত, যে-জায়গায় তার শিকার লুকিয়ে রেখেছে, সে-জায়গার হদিশ আর কাউকে পেতে হচ্ছে না।
কিন্তু চালে ভুল করে বসল মা। মানুষের সঙ্গে চালাকি করতে গিয়ে অজানতে নিজের ফাঁদ নিজেই ফেঁদে বসল। অন্য-অন্যবার মা কাউকে শিকার করে সঙ্গে সঙ্গে শিকারটাকে ঘাড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। তাই মাটিতে কোনো চিহ্ন থাকে না। এবার কিন্তু মা তার শিকারকে। ঘাড়ে করে নিয়ে গেল না। এখন দিনদুপুর! এই দিনদুপুরে কেউ পাছে দেখে ফেলে, তাই মা তড়িঘড়ি ছেলেটাকে মাটিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে গেল। তার ফলে হল কী, টানা হ্যাঁচড়ার দাগ আর রক্ত সারাটা পথে ছড়িয়ে রইল। এটা কিন্তু মা জানতেই পারল না। তাই নিশুতি রাতে মা যখন ছেলেটাকে খাবে বলে সেখানে হাজির হয়েছে, তখন একদম টের পায়নি, ওই হ্যাঁচড়ানি আর রক্তের দাগের হদিশ পেয়ে তাকে মারবার জন্যে গাছের ওপর একটা মানুষ বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছে। মা কী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল, তার দিন শেষ হয়ে এসেছে! তাই হুমড়ি খেয়ে বসে বসে নিশ্চিন্তে তার শিকারের মাংস খাচ্ছিল। তারপর– গুড়ুম।
একেবারে মায়ের মাথার ভেতর বন্দুকের গুলি ঢুকে গেল। মা গর্জন করতে পেরেছিল একবারটি। তারপর ছিটকে পড়ল ক-হাত দূরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল। আর একবার গুলি ছুটল, মায়ের ছটফটানি নিস্তেজ হয়ে গেল। তারপর যে কী হল কেউ জানে না।
এ-সব তো আমি বড়ো হয়ে ঠাকমার কাছে শুনেছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি, মা যখন আমায় ছেড়ে চলে যায়, তখন আমি খুব ছোটো। তাই সেই ছোটোবেলায়, সেদিন মাকে ফিরতে না দেখে আমি ভেবেছি, মা-ও বুঝি বাবার মতো বে-বাড়ি গেছে। নেমন্তন্ন খেতে।
সে যাই হোক, মা-ও বাবার মতো আর কোনোদিন ফেরেনি। তখন আমি মনে মনে অবাক। হয়ে ভেবেছিলুম, বে-বাড়ি সে কেমন বাড়ি যে, সেখানে কেউ একবার গেলে আর ফেরে না। বে-বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়ার ব্যাপারটা যে কী, সেটি জানার জন্যে তাই আমার মনটা সব সময়েই ছুকচুক করত। যখনই ফাঁক পেতাম ব্যাপারটা জানার জন্যে তখনই ঠাকমাকে ঘ্যানঘ্যান করে জ্বালাতন করতুম। ঠাকমা কিন্তু কিছুতেই বলত না। আমিও ছাড়তুম না। শেষে একদিন আমার জ্বালায় তিতিবিরক্ত হয়ে, এইসা ধমক দিয়েছিল যে, সেইদিন থেকে বে-বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়ার ব্যাপারটা আমার মগজ থেকে একদম হাওয়া। আমি অবশ্য বড় হয়ে, অনেকদিন পরে, বে-বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়ার মানেটা বুঝেছিলুম। বুঝেছিলুম ছোটোবেলায় আমাকে ভোলাবার জন্যেই ঠাকমা ওই কথাটি পেড়েছিল।
বয়েস হলে সকলের অনেক জ্ঞান বাড়ে। অনেক কিছু জানতে পারে। আমার ঠাকমাও তাই। বাঘ হলে কী হবে, ঠাকমার মানুষের ঘরের নাড়ি-নক্ষত্র সব জানা ছিল। ঠাকমা জানত, মানুষ যেমন গাঁয়ে-গঞ্জে থাকে, তেমনি থাকে শহরপাড়ায়। গাঁয়ে যেমন মাটির বাড়ি, শহরে তেমনি কোঠাবাড়ি। গাঁয়ে লোকজন নামমাত্র, শহরে অগুনতি, অসংখ্য। এ সব কথা কতদিন আমায় ঠাকমা গল্প করেছে। ঠাকমার মুখেই শুনেছি, মানুষের বিয়ে হয় খুব ধুমধাম করে। বর টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করতে আসে কনেকে। অনেক সব মন্তর টন্তর পড়া হয়। শাঁখ বাজে। মেয়েরা মুখে হুলু-হুঁলু করে কী রকম ডাক দেয়। বিস্তর লোক জমায়েত হয়ে লুচি, মাংস, রসগোল্লা সব খায়। এইটাকেই নেমন্তন্ন খাওয়া বলে। আমি অবশ্য কাঁচা মাংস অনেক খেয়েছি, কিন্তু রান্না করা মাংস কখনো খাইনি। তাই ওর স্বাদ গন্ধ আমার জানা নেই। শুনেছি লুচির তেমন কোনো স্বাদ নেই। কিন্তু রসগোল্লার স্বাদ নাকি সাংঘাতিক। রস ভরতি বড়ো বড়ো গামলায় যখন রসগোল্লা ভাসে, বসে দেখলে নোলার জল সামলানো দায়!
.
০৩.
শেষমেষ বাবা-মা দুজনকেই যখন আমি হারালুম, তখন ঠাকমার যে কী হল, আমাকে একদম কাছছাড়া হতে দিত না। সব সময় নজরে নজরে রাখত। আমাকে আরও বেশি। করে আদর করত। কারণ, বাপ-মা-মরা ছেলে তো! ভালো ভালো শিকার ধরে এনে ঠাকমা আমায় খাওয়াতো। কোনোদিন হরিণ, কোনোদিন মোষের গর্দান আবার কোনোদিন ভাল্লুকছানা। একদিন একটা বুনোশুয়োর এনেছিল। বেড়ে খেতে কিন্তু!
কিন্তু তাই বলে তো চিরটাকাল ছোট্ট সেজে আমি থাকতে পারি না। ঠাকমা আমায় শিকার ধরে এনে আমার মুখে তুলে দেবে, আর আমি খাব, এ কেমন কথা! সুতরাং আমিও যখন একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠলুম, আমারও তখন মনে মনে ইচ্ছে হত, আমি নিজে নিজে শিকার ধরব। পরের মুখ চেয়ে থাকতে তখন কেমন যেন বাধোবাধো ঠেকত! লজ্জাও। করত! ঠাকমাও জানত, ছেলেটাকে চিরদিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ালে অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। কুটোটি নেড়ে কিছু করতে চাইবে না। কুঁড়ের মতো শুয়ে-বসে ঝিমুবে। তাই ঠাকমা একদিন আমায় বলল, ‘চ, শিকার করতে শিখবি চ।’ সত্যি বলছি, কথাটা শুনে আমার পা। থেকে মাথা অবধি আনন্দে শিউরে উঠল। আকাশ থেকে চাঁদটি পেড়ে এনে কে যেন আমার হাতে তুলে দিল। এখন আমার বয়েসটা এমন যে, সব সময় মনে হয় একটা কিছু করি। এমন একটা কিছু, যাতে বেশ মারামারি আছে। বেশ সাহস দেখানো যায়। কিংবা বুক কাঁপানো উত্তেজনা। তাই ঠাকমার কথায় রাজি তো হলুমই, এমনকী ঠাকমার কথা মুখ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে মারলুম লাফ। ঠাকমা চেঁচাল, ‘একা একা যাসনি।’ কিন্তু কে শুনছে কার কথা!
অবশ্য ঠাকমা আমায় একা যেতে দিল না। দু-লাফে আমায় ধরে ফেলল। রেগে ভীষণ ধমক দিল। বলল, ‘অমন করলে আর কোনোদিন আনবো না। বিপদে পড়লে তখন দেখবে কে?’
আসলে, বিপদেই তো আমি পড়তে চাই। বিপদে না পড়লে মজা কী? কিন্তু এটাও তো ঠিক, মজা পেতে গিয়ে প্রাণও যেতে পারে। মিথ্যে বলব না, গা-ছমছম জঙ্গলে ঢুকে একটু একটু ভয়ও পাচ্ছে। যতই হোক প্রথম দিন তো! তাই আমি আর অবাধ্যের মতো বেশি হুটোপাটি না করে, শান্তশিষ্টের মতো ঝোপঝাড়ের আড়াল ডিঙিয়ে ঠাকমার সঙ্গে শিকার খুঁজতে লাগলুম।
একটা নির্জন জায়গার কাছে এসে ঠাকমা দাঁড়াল। আমায় ইশারা করল, আমিও দাঁড়িয়ে পড়লুম। আমি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘দাঁড়ালে কেন?’
ঠাকমা চাপা-গলায় বলল, ‘এখানে চুপটি করে বসে থাক!’
আমি গলার স্বর আরও নীচু করে, ঠাকমার গায়ে গা ঘেঁষিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘বসব কেন?’
ঠাকমা উত্তর দিল, ‘এক্ষুনি শিকার আসবে।’
কথাটা শুনে আমার চোখ দুটো যদিও তক্ষুনি চনমন করে চমকে সামনে তাকিয়েছিল, কিন্তু শিকারের কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। কে জানে, ঠাকমা কেমন করে বুঝল শিকার আসবে! সে যাই হোক, ঠাকমার কথা শুনে আমি বসে পড়লুম ঝোপের মধ্যে। ঠাকমাও উপুড় হয়ে আমার পাশে বসে পড়ল।
বুনো-গাছের ডালপালা দিয়ে এ-জায়গাটা এমন ঘেরা যে, শত চেষ্টা করেও কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। কিন্তু আমরা ঝোপের মধ্যে দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে সব ঠাওর করতে পারছি। আমার সামনে একটা নালা। নালাটা দিয়ে তিরতির করে জল বয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে, দু-একটা মাছও জলে ভাসছে। আমার মাথার ওপর একটা মস্ত বড়ো ঝাঁকড়া-গাছ। কী গাছ, জানি না। ওপর দিকে চাইতেই দেখি, একটা গিরগিটি গাল ফুলিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ টকাস টকাস করে এমন ডেকে উঠল, মনে হল আমায় যেন ভ্যাংচাচ্ছে! ভেতরে ভেতরে আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল! কিন্তু রাগ দেখিয়ে তো কোনো লাভ নেই। কেননা, গিরগিটি ধরা আমার সাধ্যি নয়। ধরতে গেলেই ভড়কি দিয়ে কোন ফোকরে যে সেঁধিয়ে পড়বে, দেখতেই পাব না। তার চেয়ে ওকে ডাকতে দাও। ডাকতে ডাকতে মুখ ব্যথা হয়ে গেলে আপনিই চুপ মেরে যাবে।
এই দেখো, ঠাকমা ফুস! ঘুমিয়ে পড়েছে। বয়েস হয়ে গেলে এই এক জ্বালা। একটু ঠান্ডা জিরোন জায়গা পেলেই গা এলিয়ে নাক ডাকাবে। থাক, ঘুমুক। ঠাকমাকে দেখে বড় দুঃখ হয়। ছেলে-বউ সব ছিল। সবাইকে হারিয়ে মনের মধ্যে দুঃখু নিয়ে বেঁচে আছে। এখন বড্ড একা। বুড়ো বয়েসে অমন দু-দুটো আঘাত পেয়ে আরও বুড়িয়ে গেছে ঠাকমা। আমিই এক ভরসা, এই যা।
যেন কী একটা নড়ে উঠল! চকিতে আমার চোখ দুটো সামনে চেয়ে স্থির হয়ে গেল। একটা হনুমান। মাটির ওপর তিড়িং তিড়িং লাফ মেরে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে নালাটার সামনে এসে মুখ ঠেকিয়ে জল খাচ্ছে। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। আমিও নিঃসাড়ে ঝোপের জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে এলুম। এখান থেকে দুটো লাফ মারলেই আমি হনুমানটার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। আর তর সইল না। আমি মারলুম লাফ। কিন্তু সব গড়বড় হয়ে গেল। আমি নিশানা ঠিক করতে পারিনি, না, হনুমানটা বুঝতে পেরে একটু সরে গেল, তা আমি জানি না। তাই আমি হনুমানটার ঘাড়ে না পড়ে সিধে ওই নালাটার জলের ভেতর ঝপাং করে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম। ততক্ষণে হনুমানটা এক লাফে গাছের ওপর। গাছের ওপর উঠে, এমন বিচ্ছিরি ক্যাঁচ-ম্যাঁচ করে চিৎকার শুরু করে দিল যে, আমি বুঝতে পারলুম না, সে আমার এই দুর্দশা দেখে ঠাট্টা করে হাসছে, না ভয় পেয়েছে। আমি হুড়মুড়িয়ে জল থেকে উঠে পড়েছি। উঠে দেখি, হনুমানের হল্লা শুনে ঠাকমাও ছুটে এসেছে! আমার কাণ্ডকারখানা দেখে ঠাকমা আমায় একটুও বকাবকি করল না। উলটে যে-গাছটায় হনুমানটা লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করছিল, সেই গাছের দিকে লাফ মারল। ধরা শক্ত। কারণ, অত ওপরে লাফ মেরে কি ওঠা যায়! গাছে ওঠবার জন্যেই যে ঠাকমা লাফ দিচ্ছিল, তা নয়। যতদূর মনে হচ্ছে, ওকে ভয় দেখাবার জন্যে। ঠাকমার মাথার মধ্যে কী ছিল আমি জানি না। কিন্তু ঠাকমাকে লাফাতে দেখে হনুমানটা যে ভীষণ ভয় পেয়েছে, সেটা আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। ঠাকমা শেষবার যখন গলায় বিকট গর্জন করে লাফ মারল, আমি তাজ্জব বনে গেলুম দেখে, হনুমানটা গাছ ফসকে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল! আর দেখতে নেই, আমি ঝড়ের মতো লাফিয়ে উঠে হনুমানের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ওঃ! আনন্দে আমার শরীর-মন শিউরে উঠেছে! আমার জীবনে আমি সর্বপ্রথম নিজের মুখে শিকার ধরলুম। যদিও হনুমান, শিকার তো!
তারপরও দু-চারবার আমি ঠাকমার সঙ্গেই শিকারে গেছি। ক্রমে একটু একটু করে আমার সাহস বাড়তে লাগল। তারপর আমি একদিন একাই শিকার ধরে আনলুম।
একা-একা শিকার ধরতে এখন আমার কোনো ভয়ই হয় না। যতই একা-একা শিকার ধরছি, ততই সাহসে আমার বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। মনে হচ্ছে আমার সামনে এখন কে দাঁড়াবে! এই জঙ্গলটা এখন আমার কথায় উঠবে বসবে। এখন আমি এই জঙ্গলের রাজা। আমার সামনে সব মুড়ি-মুড়কি!
আমার ঠাকমা ধীরে ধীরে বয়েসের ভারে নুয়ে পড়ছে। ঠাকমা এখন আর তেমন খাটতে পারে না। তেমন লাফাতে পারে না। সারাদিন ঘুমের ঘোরে ঢুলুনি দেবে। ভারি কষ্ট লাগে। আমি নিজেও আর চাই না, ঠাকমা আমার জন্যে কষ্ট করুক। এখন তো আমি ছোট্টটি নই যে, সব সময় পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করব! কিংবা ঠাকমার কোলে বসে আদর খাব! আমি চাই, ঠাকমা এখন চুপচাপ শুয়ে থাকুক। যে ঠাকমা একদিন শিকার ধরে এনে আমায় খাওয়াত, আজ সেই ঠাকমাকে আমি শিকার ধরে এনে খাওয়াই। আমার যে কী আনন্দ লাগে! আমার বাবা-মা আমার জন্যে কতটুকু করতে পেরেছে! কিছু করার আগেই তো তারা হারিয়ে গেল। যা কিছু করেছে সে তো আমার ঠাকমাই। তাই ঠাকমার জন্যে কিছু করতে পারলে আনন্দ হবে না?
একদিন ঠাকমা আমায় বলল, ‘এখন তো আমি বুড়ো হয়ে গেলুম। আমি তো এবার মরব। আমি মরে গেলে তুই একা থাকতে পারবি তো?’
আমি উত্তর দিয়েছিলুম, ‘তুমি মরবে কী ঠাকমা! আমি তোমায় মরতে দেব না। আমি যতদিন বাঁচব, তোমায় ততদিন বাঁচিয়ে রাখব।’
ঠাকমা বলেছিল, ‘তোর তো এখন উঠতি বয়েস, তাই বয়েস বাড়লে বেঁচে থাকার যে কী জ্বালা, তুই তা বুঝবি না।’
ঠাকমার কথা শুনে আমার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। ঠাকমাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমার জ্বালা কীসের ঠাকমা? আমি কি তোমায় কষ্ট দিচ্ছি?’
ঠাকমা উত্তর দিল, ‘না রে। এতদিন তোকে নিয়ে আমার বুক ভরে ছিল। তোকে চোখে চোখে রাখতুম, খাওয়াতুম, সাধ-আহ্লাদ করতুম। তাতে যে আমার কী আনন্দ ছিল, সে কথা তোকে আমি বোঝাতে পারব না। আজ তুই বড়ো হয়েছিস। নিজে নিজে সব পারিস। আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আমার দিনও শেষ হয়ে এসেছে। তাই দিন-রাত তোর মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকি।’
আমি বললুম, ‘ঠাকমা, একদিন যে আমিও তোমার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকতুম?’
ঠাকমা উত্তর দিল, ‘দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে রে, বাছা।‘
‘কী তফাৎ ঠাকমা?’
ঠাকমা বলল, ‘আমি কষ্ট করেছি তোকে বড়ো করে তোলবার জন্যে। আর তুই কষ্ট করছিস যার জন্যে, সে তো আর বেশিদিন বাঁচবে না। এখন আর আমার দাম কী বল? আমার জন্যে তোর কষ্ট করে লাভ কী?’
আমি বললুম, ‘একী কথা বলছ ঠাকমা? তুমি না থাকলে আমায় এত আদর-যত্নে কে বড়ো করে তুলত? তোমার জন্যে কষ্ট করতে আমার ভালো লাগে।’
আমার কথা শুনে ঠাকমার চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠেছিল। আমার মনের ভেতরটাও কেমন দুঃখে ভার হয়ে গেছিল।
.
০৪.
আমাদের এখানে একপাল হাতি এসেছে। খবর পেয়েছি, পালে কটা হাতির বাচ্চাও আছে। নিজেদের চেহারাগুলো অমনি বিরাট বিরাট বলে, হাতিগুলো যেন কারোর তোয়াক্কাই করে না। ওদের দাপটে সবাই জুজু। খবরটা কানে আসা অবধি আমার পা থেকে মাথা অবধি রাগে জ্বলছে। আস্পর্ধা তো কম নয়! আমি থাকতে হাতির দল বনে দেমাক দেখিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর আমাকে তা সহ্য করতে হবে। সুতরাং আমি মনে মনে ঠিক করলুম, হাতিগুলোকে শায়েস্তা করতে হবে।
কথাটা বলা সহজ, কিন্তু করাটা সহজ নয়। কারণ, গায়ের জোরে হাতিও কম যায় না। তবে হাতির চেহারাটা যেমন গদাই-লস্করের মতো, বুদ্ধিটাও যদি তেমনি হত, তাহলে রক্ষে ছিল না। কিন্তু এ কথাও বলি না, ওদের বুদ্ধি একেবারে নেই। এমন বুদ্ধি, দল বেঁধে যখন হাঁটবে, তখন বাচ্চাগুলোকে মাঝখানে আগলে নিয়ে হাঁটবে। মতলবটা হচ্ছে, বাচ্চাকে বাঘে না ছোঁ মেরে নিয়ে পালায়। সত্যি কথা বলতে, একটা পুরুষ্ট হাতিকে পিঠে নিয়ে পালাবার ক্ষমতা বাঘের নেই। তবে চেষ্টা করলে একটা বাচ্চাকে পিঠে ফেলে পালানো যায়।
আমায় অবশ্য ঠাকমা বলেছিল, ‘হাতির সঙ্গে কখনো একা লাগতে যাস নে। ওদের গায়ে ভীষণ জোর। একবার যদি শুড় দিয়ে ধরে ফেলে তাহলে নির্ঘাত পায়ে টিপে মেরে ফেলবে।’
অতই সোজা! আমাকে খুঁড়ে ধরে টিপে মারবে! আমি বাঘের ব্যাটা! তাই আমি যখন প্রথম ওদের নজর করি, তখন ইচ্ছে করেই গা ঢাকা দিয়ে, একটা ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ওদের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছিলুম। মনের সুখে যত পারে করে নিক নাচন-কোঁদন। একটু পরেই তো বাছাদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আমার ধান্ধা ছিল, ওরা একটু অন্যমনস্ক হলে প্রথমেই একটা বাচ্চার পিঠে লাফিয়ে পড়ব! কিন্তু তারপরেই কথাটা ভালো করে ভেবে দেখতেই, নিজেকে এমন ছোটো বলে মনে হল। ছিঃ! ছিঃ! বাঘের মনে এ-রকম কাপুরুষের মতো ভাবনা! আমার বাবা না বনের রাজা ছিল, আমি না তার ছেলে! না, না, চোরের মতো নয়। লড়তে যদি হয়, মরদের মতো সামনাসামনি লড়ব। বাচ্চা মেরে হাতে গন্ধ করার মধ্যে কোনোই বাহাদুরি নেই!
বাহাদুরি তো নেই, কিন্তু এদিকে ওদের দেখে তো এই বাহাদুর বাঘের চক্ষু স্থির। লড়াই করব কী! ওরা এমনভাবে দল বেঁধে আছে, লড়াই তো দূরের কথা, কাছেই ঘেঁষা যাবে না। হ্যাঁ, হতে পারে, আচমকা যদি একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। তাতেও এক বিপদ। কারণ, একটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর দশটা একসঙ্গে তেড়ে আসবে। তখন। সাংঘাতিক বিপদ। তাই ভাবলুম, দলটাকে তছনছ করে দিই। এই ভেবে, আমি ঝোপের আড়াল থেকে ভয়ংকর হুংকার ছাড়লুম। কিন্তু বলব কী, আমার হুংকার শুনে ওই হাতির পাল এতটুকু ভয় পেল না, ছুটেও পালাল না। উলটে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর শুঁড় উঁচিয়ে ডাক ছাড়ল। যেন বলতে চাইল, ‘আয় একবার দেখি!’
বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে এখন হুট করে এখন থেকে বেরিয়ে না পড়া। আমি আবার প্রচণ্ড গর্জন করে উঠলুম। ওই হাতির পালের যেটা সর্দার ছিল, সে ঘুরে দাঁড়াল। কুতকুঁতে চোখ দুটো এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে খুঁজতে লাগল। তারপর ক-পা এগিয়ে এল। মজা কী, সর্দার এগিয়ে এল বটে, কিন্তু সর্দারের সঙ্গে আর কেউ এল না। আর সকলে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়েদের আগলে দাঁড়িয়ে রইল। আমি মনে মনে চাইছি সর্দার আরও একটু। এগিয়ে আসুক। ওর চলার বহর আর হাবভাব দেখে বেশ বুঝতে পারছি, আমি কোথায় লুকিয়ে আছি, ও তার হদিশই করতে পারছে না। তাই আলটপকা ও যখন আমার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, আমি মেরেছি লাফ। একেবারে সর্দার হাতিটার সামনে। আমায় দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে এতটুকু ভড়কে গেল না হাতিটা। ওই বিরাট দেহটা নিয়ে হাতি আমার দিকে তিরের মতো তেড়ে এল। তার গলা দিয়ে বিকট চিৎকার বেরিয়ে আসছে। আমিও গর্জে উঠলুম। বন কেঁপে উঠল। আমি লাফিয়ে ক-পা পিছিয়ে আসতেই, হাতিটা ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে-পিষে আমার দিকে গোঁৎ মারল। আমি হাতির পেছন দিকে লাফ মেরে পালালুম। হাতিটা চোখের নিমেষে গা ছলকে দেহটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেবেছিলুম, এই পেছন দিক থেকে সর্দার হাতির পিঠের ওপর লাফিয়ে পড়ব। কিন্তু একদম বেআক্কেলের মতো কাণ্ড করে বসেছি। অর্থাৎ লাফ মেরে ভুল করেছি। হঠাৎ দেখি, হাতির দু-নম্বর সর্দারটা কোত্থেকে ছুটে এসে একেবারে আমার। সামনে। আমার মনে হল, ওরা আমায় ঘিরে ফেলছে। এখন যদি আর দুটো হাতি ছুটে এসে ডাইনে-বাঁয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, তাহলে তো নির্ঘাত মরণ! কিন্তু আমি বাঘ। আমার ভয় পেলে তো চলবে না। মুখখানা বিচ্ছিরিরকম খিকিয়ে উঠে, এক ধমক মেরেছি আমি দু-নম্বর সর্দারকে। নম্বর যখন দুই, তখন বুঝতেই পারছ বয়েস কম। একটু বেশি দুর্দান্ত। আমার। ধমক ও গ্রাহ্যি করবে কেন? আমার দিকে গোঁ গোঁৎ করে তেড়ে এল। মুখের গুঁড়টা লকলক করে উঠছে-নামছে। দাঁত দুটো সাদা ঝকঝকে ছুঁচোলো। একবার পেটে ঘুষিয়ে দিলেই শেষ। আমি আগুপিছু কিছু না-ভেবে দু-নম্বর সর্দারের মাথার ওপর মেরেছি এক লাফ। ডান কানটা খাবলে নিয়ে, মাথায় দিয়েছি টেনে থাবার এক ঝটকা। আমি দেখতে। পেলুম দু-নম্বর সর্দারের মাথাটা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। আমিও বন কাঁপিয়ে হাঁক দিচ্ছি, হাতিও চিল্লাচ্ছে। শুড়টা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবার জন্যে আঁকপাঁক করছে। আমি জানতুম, আর একবার যদি ওর মাথার খুলির ওপর আর একটা থাবা মারতে পারি, তবে হাতির কম্ম শেষ। কিন্তু সর্দার হাতিটা আমায় তা করতে দিল না। নিমেষের মধ্যে ছুটে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকে ওঠার মতো আচমকা শুড় দিয়ে খপাত করে আমায় চেপে ধরেছে। আমি বুঝে নিলুম এবার আমার শেষ। কী প্রচণ্ড শক্তি এই গুঁড়টার। আমায় যখন টিপে ধরল, মনে হল, আমার বুকের পাঁজরাগুলো মড়মড় করে গুঁড়িয়ে বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমারও শক্তি বা কীসে কম! যখন সর্দার হাতিটা শুড় দিয়ে চেপে ধরে আমায় নীচে নামাচ্ছে আমায় পা দিয়ে টিপে মারবে বলে, সে তখন জানত না, তার গুঁড়টাকে আমি কামড়ে ধরবার চেষ্টা করছি। ও যদি আমার গলাটা শুড় দিয়ে চেপে ধরত, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি দম ফেটে মরতুম। কিন্তু হুড়োমুড়িতে সে আমার বুক আর পিঠটা জড়িয়ে ধরেছে। আমার মুখের নাগালে আমি ওর গুঁড়টা পেয়ে গেছি। আমার দাঁতে যত জোর ছিল, সব জোর দিয়ে দিয়েছি কামড়ে। আমি জানি না, আমার কামড়ের জোরে ওর গুঁড়টা ছিঁড়ে পড়ে গেল কি না। কিন্তু সর্দারটা প্রচণ্ড চিৎকার করে আমায় ছেড়ে দিল। আমি আর সেখানে দাঁড়ালুম না। বুকের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিয়ে আমি লাফ দিলুম। তারপর আর কিছু জানি না। গভীর জঙ্গলের মধ্যে যন্ত্রণা ছটফটিয়ে কাতরাতে লাগলুম। ঠাকমার কাছে যখন ফিরলুম, দেখলুম তখনও ঠাকমা ঘুমোয়নি। আমার জন্যে বসে আছে। আমি কাতরাতে কাতরাতে ঠাকমার কোলের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। ঠাকমা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে রে?’
আমি কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে উত্তর দিলুম, ‘হাতির সঙ্গে লড়াই।’
.
০৫.
ক-দিন পরে শরীরটা যখন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল, যখন মনে হল, নতুন করে হাতির সঙ্গে আমি আবার লড়াই করতে পারি, তখন আমি আবার বনের রাজার মতো গর্জন করতে করতে বন কাঁপিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। কিন্তু হাতির সঙ্গে লড়াই করার পর ব্যাপারটা চারিদিকে যে হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে, এ-কথা আমি জানতেই পারিনি। এমনকী মানুষের কানেও পৌঁছে গেছে। আর সেই নিয়ে মানুষের কাছে এটা একটা মস্ত খবর। বনে জঙ্গলে বাঘের সঙ্গে হাতির লড়াই হবে, এ আর এমনকী নতুন কথা! বাঘ, সিংগি, গন্ডার। নানান জন্তুর সঙ্গে খুটখাট হামেশাই লেগে আছে। আর এইটাই তো জঙ্গলের জীবন। তা না হলে তো জন্তুরা জঙ্গল ছেড়ে কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকের মতো ঘোড়ার গাড়ি চেপে শহর ঘুরতে বেরোত!
খবরটা মানুষের কানে পৌঁছোবার পর থেকে তারা যে আমার পিছু নিয়েছে, আমায় খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছে, এ-কথা আমি আর কেমন করে জানব? কারণ, আমি তো থাকি জঙ্গলে। ওরা ভেতরে ভেতরে গুজগুজ করে কী শলা-পরামর্শ করছে, আমার কানে তো সেই খবর পৌঁছে দেবার কেউ নেই। আমাকে না-দেখেই তারা ভাবছে, আমি একটা দুর্দান্ত বাঘ। তারা হয়তো ভয় পাচ্ছে, এ-বাঘটা হাতির সঙ্গে যখন লড়াই করেছে, তখন হুট করে। কোনোদিন না কোনোদিন মানুষ-পাড়ায় এসে মানুষেরও তো ক্ষতি করতে পারে!
সত্যি বলছি, মানুষের কোনো ক্ষতি করব, এ ভাবনা আমার মাথায় এতদিন পর্যন্ত একদম ঢোকেনি। তবে বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার মা আর বাবার দুর্দশার কথা মাঝে। মাঝে আমার মনটাকে ভীষণ দুঃখে ভরিয়ে তুলত। তখন মনে হত, মানুষকে পাইতো ছিঁড়ে খাই। কিন্তু তখনও পর্যন্ত মানুষকে ছিঁড়ে খাওয়ার কোনো সুযোগ আসেনি। আর আসবে কি না তাও জানি না।
আজ আমার ভাগ্যটা ভালো বলতে হবে। কেননা, দিনদুপুরে হঠাৎ একটা শিকার মিলে গেল। বেশ বড়োসড়ো একটা বুনো-শুয়োর। আপাতত আমার পেটে জায়গা নেই। একদম খিদে পাচ্ছে না। তাই এখন এটাকে মুখে করে তুলে নিয়ে ওই ঝোপটার মধ্যে লুকিয়ে রাখাই ঠিক করলুম। ভাবলুম, সন্ধে নাগাদ যখন খিদে পাবে, তখন রসিয়ে খাওয়া যাবে। ঠাকমার জন্যে কাল একটা হরিণ শিকার করে দিয়েছি। সেটা খেয়ে শেষ করতে পারেনি। আজও চলে যাবে। আমি শুয়োরটাই খাব।
মুশকিল হচ্ছে কী, শিকার মেরে তুমি যদি বনের মধ্যে খোলামেলা ফেলে রেখে যাও, ভেবে থাকো পরে এসে খাবে, তাহলেই ভুল করে বসবে। কারণ, তুমি চোখের আড়াল হলেই, পাঁচ-ভূতে তোমার খাবার সাবড়িয়ে, তোমার জন্যে পেসাদ রেখে যাবে খটখটে হাড় ক খানি। তাই আমি এটাকে একটা ঘুপচি-ঝোপে লুকিয়ে রেখে বড়ো বড়ো শুকনো-পাতা দিয়ে ঢেকে রেখে গেছলুম।
কিন্তু রাত্তিরে শিকারের কাছে ফিরে যে দৃশ্য দেখলুম, তাতে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। দেখি কী, একটি হৃষ্টপুষ্ট ভাল্লুক বেশ বহাল তবিয়তে আমার শিকার দিয়ে পেটপুজো করছে। আমি যে এসেছি, সেটি পর্যন্ত বাছাধন টের পাননি। আর যদি টের পেয়েও থাকেন, তাহলে বলব আমাকে সে গ্রাহ্যই করেনি। আমার মাথা গেল বিগড়ে। রেগেমেগে এমন হুংকার ছেড়েছি যে, বেচারা ভাল্লুকের পিলে বুঝি ফট হয়ে যায়! ও বাবা! ভাল্লুকটাও কম যায় না! আমার দাবড়ি খেলে পালাবে কোথায়, তা না, ডাক ছেড়ে রুখে দাঁড়াল। আচ্ছা একগুয়ে তো! তবে রে! তোর ভাল্লুকের নিকুচি করেছে! আমি ঝাঁপিয়ে পড়লুম ভাল্লুকের ঘাড়ে। ভাল্লুকটাও ছাড়বার পাত্র নয়। ঠ্যাং দিয়ে সে-ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর যা লেগে যা ঝটাপটি! প্রচণ্ড লড়াই! ভাল্লুকও চেঁচায়, আমিও গর্জন করি। ধামসাধামসি, খামচাখামচি, মাটির ওপর গড়াগড়ি।
চিৎকার, গর্জন আর ধামসাধামসির আওয়াজটা এমন সাংঘাতিক হয়েছিল যে, সেই আওয়াজ আমার ঠাকমার কানেও পৌঁছে গেছে। বুড়ি ঠাকমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। সেদিন দেখলুম এই বয়েসেও ঠাকমার কী তেজ! ছুটে এসে, মুখে কোনো কথা না বলে ঠাকমাও ভাল্লুকটার ওপর লাফিয়ে পড়েছে। আমি বলব কী, ঠাকমা যেই লাফিয়েছে অমনি সঙ্গে সঙ্গে–
গুড়ুম, গুড়ুম
গাছের ওপর থেকে মানুষ ঠাকমাকে গুলি করেছে। আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত দশ হাত দূরে আমার ঠাকমা ছিটকে পড়ল। ঠাকমার বুকে গুলি বিঁধেছে! আমি একদম হতভম্ব! কী করব, না করব সেই বুদ্ধিটুকু মাথায় আসতে না আসতেই আবার আওয়াজ–
গুড়ুম।
কী হল জানি না। শুধু মনে হল, আমার গায়ের ওপর কে যেন আগুনের গোলা ছুঁড়ে মারল। আমি ছিটকে গেলুম। প্রচণ্ড গর্জন করে, লাফ মেরে পালাতে গিয়ে ভীষণ জোরে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেলুম। পড়ে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে আবার উঠেছি। আবার গুলির শব্দ–
গুড়ুম।
আমাকেই তাক করে মেরেছে। এবার তাক ফসকে গেল। লাগেনি। লাগল গিয়ে গাছের গায়ে। সেই তক্কে ওখান থেকে আর একটা লাফ মেরে আমি ছুট দিলুম। অন্ধকার রাত্তির তাই রক্ষে!
ছুটতে ছুটতে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো এখনকার মতো আমি বেঁচে আছি। কিন্তু পরে কী হবে, জানি না। কী প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আমার পিঠে। বুঝতে পারছি, গুলিটা পিঠেই এসে লেগেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে পিঠ দিয়ে। গুলি আমার পিঠে লাগল বলে আমি । এখনও ছুটতে পারছি। কিন্তু গুলি ঠাকমার বুকে বিঁধল, তাই ঠাকমা আর উঠতে পারল না। ছিঃ! ছিঃ! শেষ বয়েসে ঠাকমাকেও মানুষের হাতে মরতে হল!
আমার এতো ভয় করছে! মনে হল আর একটু পরে আমিও হয়তো মরে যাব! আমি আর ছুটতে পারছি না। আমার দেহটা কীরকম টলমল করছে। একটু দাঁড়ানো যায় না? দাঁড়ালেই যদি আবার গুলি করে দেয়! না, তাই টলতে টলতেও আমি ছুটতে লাগলুম।