২
আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে রতনপল্লির একটা গেস্ট হাউসে। সেখানে খেতে খেতে আরও অনেক কথা হল। একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ডঃ রায়ের বাড়ি খুব দূরে নয় বললে, ঠিক কতটা দূরে?”
“প্রায় তেরো কিলোমিটারের মতো।”
“আর কে থাকতেন ওঁর সঙ্গে?”
“একাই থাকতেন স্যার। ড্রাইভার, কুক আর এক জন কাজের লোক থাকত পাশে আউটহাউসে। খুব একটা মিশুকে ছিলেন না- ভাইপো, ভাগ্নে আর সিদ্ধার্থবাবু ছাড়া, শুধু কয়েক জনের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল।”
“একা একা করতেনটা কী? গবেষণা?”
“তা তো বলতে পারব না। তবে প্রচুর বই পড়তেন। এমনিতে ছিল রুটিন- বাঁধা জীবন। সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট, দুপুর একটায় লাঞ্চ, আর রাত সাড়ে ছ’টায় ডিনার। দুপুর বেলায় ঘুমোতেন তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত। মধ্যের সময়টুকু কেউ না এলে বই পড়েই কাটাতেন। রাতে নিতাই, মানে কাজের লোকটি, সোয়া ন’টার সময় দুধ গরম করে ডঃ রায়কে দিত। একটা বই নিয়ে শুতে চলে যেতেন সাড়ে ন’টায়।”
“ওরেব্বাস!” প্রমথ একটু ঠাট্টার সুরেই বলল, “তার মানে পরিচিতরা সব ঘড়ি ধরে আসতেন।”
প্রমথর শ্লেষটা দীপকবাবু কতটা ধরতে পারলেন জানি না। বললেন, “বন্ধুবান্ধবরা যাঁরা আসতেন, সবাই আসতেন হয় সকাল ন’টার পরে অথবা সন্ধে সাতটার পরে— ওঁর ব্রেকফাস্ট বা ডিনার হয়ে গেলে। দেশে কেউ সময় মেনে চলে না বলে বাড়িতে কাউকে খেতে ডাকতেন না। প্রথম দিকে দুয়েক বার ডেকে ওঁর রুটিন ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকে একাই খেতেন। মাঝেমধ্যে ভাইপো- ভাগ্নেদের ডাকতেন, কিন্তু কড়া নির্দেশ ছিল দেরি করতে পারবে না। সেই নির্দেশ সবাই মেনে চলত।”
“ভাগ্যিস উনি গত, তাই আমরা এখন যখন খুশি যেতে পারব… তাই তো?” প্রমথর যদি এতটুকু জ্ঞানগম্যি থাকে!
দীপকবাবু দেখলাম চটলেন না, বরং একটু হেসেই বললেন, “তা পারবেন। …ও বলতে ভুলে গেছি, গেস্টরা কেউই ন’টার পরে থাকতেন না। যাঁরা আসতেন মোটামুটি সবাই এই নিয়মের কথা জানতেন। একমাত্র ভাইপো-ভাগ্নের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটত না। ডঃ রায় ঘুমোতে গেলেও ওঁরা মাঝে মাঝে নীচে বসে গল্প করতেন। তবে সাড়ে দশটা-এগারোটার আগেই সবাই ফিরে যেতেন।”
এ ছাড়া দীপকবাবুর কাছে যেটা জানলাম, সেটা হল, ডঃ রায়ের ডেডবডি আবিষ্কার হয় সকালে নিতাই যখন ব্রেকফাস্ট নিয়ে যায় তখন। শোবার ঘরে উনি ঘুমোচ্ছিলেন। অনেক ডাকাডাকি সত্ত্বেও যখন উঠছেন না, তখন ঘরে ঢুকে নিতাই দেখে ডঃ রায় আর বেঁচে নেই।
“মৃত্যুর কারণ?”
“কার্বন মনোক্সাইড। কেরোসিন স্পেস হিটারে ফল্ট ছিল, আর দরজা- জানলাগুলোও খোলা ছিল না।”
“কোত্থেকে কিনেছিলেন হিটারটা?” একেনবাবুর প্রশ্ন।
“হিটারটা নতুন না, পুরোনো। কোত্থেকে এসেছিল কাজের লোকরা জানে না। শীত পড়লে ডঃ রায় সাধারণত ইলেকট্রিক হিটার ব্যবহার করতেন। সেটা সুইড অফ ছিল, কেরোসিন হিটারটাই জ্বলছিল।”
“ইন্টারেস্টিং। ইলেকট্রিক হিটার কি কাজ করছিল না?”
“না ঠিকই ছিল, আমি চেক করেছি। তা ছাড়া ডঃ রায়ের একটা বিশাল জেনারেটর আছে। ইলেকট্রিসিটি বন্ধ হয়ে গেলে ওটা অটোমেটিকালি চালু হয়। তাই স্পষ্ট নয় কেরোসিন হিটার কেন জ্বালানো হয়েছিল!”
“আচ্ছা দীপক, এই ভাইপো আর ভাগ্নে কী করেন?” একেনবাবুর প্রশ্ন
“ভাইপো অজিত রায় কলাভবন থেকে আর্ট নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। কিন্তু ওঁর রোজগার ছবি এঁকে নয়। আর্ট সাপ্লাই আর পিকচার-ফ্রেমিং-এর দোকান আছে রতনপল্লিতে। ওঁর ফ্রেম মেকিং-এ ট্রেনিং ইংল্যান্ড থেকে। কাকার কাছে প্রায়ই বেড়াতে আসতেন।”
“আর ভাগ্নে?”
“ভাগ্নে রঞ্জন দত্ত, বিনয় ভবনের লেকচারার। রঞ্জনের স্ত্রী অনুরাধাকে ডঃ রায় খুব পছন্দ করতেন। তবে ঘন ঘন ওঁরা আসতে পারতেন না, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনো ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ও বলতে ভুলে গেছি, অজিতবাবু বিয়ে-থা করেননি।”
“ডঃ রায়ের কোনো উইল আছে?”
“আছে। রঞ্জন দত্তকেই সিংহভাগ দিয়ে গেছেন। বাড়ি আর তিরিশ কোটি টাকা। ভাইপোর জন্যেও লাখ দশেক টাকা রাখা আছে, কাজের লোকদের জন্য এক লাখ করে। বাদবাকি টাকা সব চ্যারিটিতে।”
“এঁদের সবার সঙ্গেই একটু কথা বলা দরকার।”
“সে তো বটেই।”
.
দীপকবাবুও আমাদের সঙ্গে গেস্ট হাউসেই খেলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর আমি আর প্রমথ নিজেদের বিল মেটাতে গেলে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “করছেন কী, আপনারাও তো স্যারের টিমে….. আমাদের গেস্ট।”
“শুধু গেস্ট নন। বাপিবাবু, প্রমথবাবু আর আমি একসঙ্গেই কাজ করি।”
একেনবাবুর এই বিনয় মাঝে মাঝেই আমাকে লজ্জায় ফেলে, আর প্রমথকে চটিয়ে দেয়। আজ অবশ্য প্রমথ দীপকবাবুর উপস্থিতিতে কোনো বাঁকা মন্তব্য করল না।