১
গত বছর ডিসেম্বর মাসে যখন কলকাতায় গেছি, পত্রিকায় পড়লাম শান্তিনিকেতনবাসী বিজ্ঞানী রুদ্রপ্রসাদ রায় রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। খ্যাতনামা একজন লোকের মৃত্যু, বীরভূমের এসপি স্থানীয় পুলিশের ওপর ভরসা করতে পারলেন না। গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন অফিসার একেনবাবু কলকাতায় এসেছেন শুনে তাঁর সাহায্য চাইলেন। একেনবাবু কাজটা না নেবার চেষ্টা করেছিলেন, “শান্তিনিকেতন জায়গাটাকেই ভালো করে চিনি না স্যার, বহু বছর আগে এক বার গিয়েছিলাম।” কিন্তু এসপি সাহেব শুনলেন না। একেনবাবুরই এক জুনিয়র, দীপক দত্ত কিছুদিন হল বোলপুর সার্কেলে বদলি হয়ে এসেছেন। তিনি সবরকম সাহায্য করবেন বলে একেনবাবুর সম্মতি আদায় করে ছাড়লেন।
দেশের পুলিশের ব্যাপার, সেখানে আমি নাক গলাই কী করে! আমি অন্য প্ল্যান করছিলাম। কিন্তু তার কি উপায় আছে? একেনবাবু সোজা বললেন, “আপনারা না থাকলে স্যার আমি নেই, চলুন।”
শান্তিনিকেতনে যেতে আমার ভালো লাগে। এমনিতে শীতকালে কলকাতায় এলে দিন কয়েকের জন্য শান্তিনিকেতনে যাই। পূর্বপল্লিতে প্রমথর মাসির বাড়ি থাকাতে একটা আস্তানা জুটে যায়। তাও ইতস্তত করছিলাম, একেনবাবু ছাড়লেন না। প্রমথও আসবে জানতাম, কিন্তু তাও একটা খোঁচা দিল, “ও আপনি যাচ্ছেন নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে, আর আমাদের ল্যাংবোট করে নিয়ে যেতে চান!”
“আপনি না স্যার, সত্যি! জানেনই তো আপনারা পাশে থাকলে বুকে কতটা বল পাই।”
“বেশ, কিন্তু তিন দিনের মধ্যে ফিরে আসছি, এর মধ্যে আপনার কেস সলভ হোক বা না হোক।”
“দেখছেন স্যার,” আমার দিকে করুণভাবে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “এরকম চাপের মধ্যে কি কিছু করা যায়!”
“ওর কথা ছাড়ুন,” আমি অভয় দিলাম।
প্রমথকে চিনি, খুনি ধরা না পড়া পর্যন্ত শান্তিনিকেতন থেকে নড়বে না।
.
পরের দিন সকালে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে বোলপুর। দীপক দত্ত গাড়ি নিয়ে স্টেশনেই অপেক্ষা করছিলেন। একেনবাবু নিশ্চয় আমাদের পরিচয় বেশ ফলাও করেই দিয়ে রেখেছিলেন। এমন সম্মান দিয়ে প্রফেসর দে আর ডঃ সমাদ্দার বলে সম্বোধন করছিলেন, দু-জনেরই অস্বস্তি লাগছিল।
গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কথা হল। দীপকবাবু এর মধ্যেই রুদ্রপ্রসাদ রায় সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করে ফেলেছেন। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। কিন্তু অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে একটা ‘নলেজ’ কোম্পানি খুলেছিলেন।
“সেটা আবার কী?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।
“তা তো বলতে পারব না স্যার, তবে সেটাই শুনেছি।” একেনবাবু দেখলাম দীপকবাবুকে ‘স্যার’ বলছেন না, উলটে দীপকবাবুই স্যার বলছেন! মজাই লাগল।
একেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরটা প্রমথ দিল। “নলেজ কোম্পানিতে কিছু বানানো
হয় না, শুধু কনসেপ্ট আর আইডিয়া পেটেন্ট করা হয়।”
“তাতে লাভ কী স্যার?”
“বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো বহু টাকা দিয়ে সেই পেটেন্টগুলো কেনে। অর্থাৎ এই কোম্পানিতে ব্রেইন পাওয়ার ছাড়া ইনভেস্টমেন্ট খুব অল্পই, শুধু ইনকাম।”
“বাঃ, গ্রেট আইডিয়া তো!”
দীপক দত্তও মাথা নেড়ে বললেন, “সিদ্ধার্থবাবু বলছিলেন বটে, ডঃ রায়ের প্রচুর টাকা আর ওঁর আর্ট কালেকশনও দেখার মতো। শুনে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কী করে।”
“সিদ্ধার্থবাবু কে?”
“ডঃ রায়ের ছেলেবেলার বন্ধু। এককালে বিশ্বভারতীতে পড়াতেন, এখন রিটায়ার্ড। দু-জনে প্রায়ই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। ওঁর কাছেই শুনেছি, ডঃ রায় বিপত্নীক, ছেলেপুলেও নেই। এক ভাইপো আর ভাগ্নে শান্তিনিকেতনে আছে বলে বাকি জীবনটা এখানে কাটাতে এসেছিলেন।”
“শান্তিনিকেতনে কোথায় থাকতেন ডঃ রায়?”
“ঠিক শান্তিনিকেতনে নয় স্যার। আসলে যতটা জমি খুঁজছিলেন, শান্তিনিকেতনে পাননি। তবে খুব দূরে নয়। আপনারা আগে লাঞ্চটা সেরে নিন। তারপর গিয়ে বাড়িটা দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনি ভালো করে বাড়িটা পরীক্ষা না করা পর্যন্ত কেউ ওখানে ঢুকবে না, ইনস্ট্রাকশন দেওয়া আছে।”