অ্যার ট্রাভেল

অ্যার ট্রাভেল

পঁচিশ বৎসর পূর্বে প্রথম অ্যারোপ্লেন চড়েছিলুম। দশ টাকা দিয়ে কলকাতা শহরের উপর পাঁচ মিনিটের জন্য খুশ-সোওয়ারি বা ‘জয় রাইড’ নয়, রীতিমত দু শ মাইল রাস্তা– পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে, নদীনালা পেরিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহর যেতে হয়েছিল। তখনকার দিনে এদেশে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস ছিল না, কাজেই আমার অভিজ্ঞতাটা গড়পড়তা ভারতীয়দের পক্ষে একরকম অভূতপূর্বই হয়েছিল বলতে হবে।

তার পর ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের বহু জায়গায় প্লেনে গিয়েছি এবং যাচ্ছি। একদিন হয়তো পুরথে করেই স্বর্গে যাব, অর্থাৎ প্লেন ক্র্যাশে অক্কালাভ করব–তাতে আমি আশ্চর্য হব না, কারণ এ তো জানা কথা, ‘ডানপিটের মরণ গাছের ডগায়’। সে কথা থাক।

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে প্রতিবারই লক্ষ করি, পঁচিশ বৎসর পূর্বে প্লেনে যে সুখ-সুবিধে ছিল আজও প্রায় তাই। ভুল বলা হল, ‘সুখ-সুবিধে’ না বলে ‘অসুখ-অসুবিধেই’ বলা উচিত ছিল, কারণ প্লেনে সফর করার চেয়ে পীড়াদায়ক এবং বর্বরতর পদ্ধতি মানুষ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি। আমার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যারা প্লেনে চড়েন তারা ওকিবহাল, তাঁদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। উপস্থিত তাই তাঁদেরই উদ্দেশে নিবেদন, প্লেনে চড়ার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যাদের এ যাবৎ হয়নি।

রেলে কোথাও যেতে হলে আপনি চলে যান সোজা হাওড়া। সেখানে টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসুন–ব্যস, হয়ে গেল। অবশ্য আপনি যদি বার্থ রিজার্ভ করতে চান তবে অন্য কথা, কিন্তু তবু একথা বলব, হঠাৎ খেয়াল হলে আপনি শেষ মুহূর্তেও হাওড়া গিয়ে টিকিট এবং বার্থের জন্য একটা চেষ্টা দিতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত কোনও গতিকে একটা বার্থ কিংবা নিদেনপক্ষে একটা সিট জুটে যায়ই।

প্লেনে সেটি হবার জো নেই। আপনাকে তিন দিন, পাঁচ দিন, কিংবা সাত দিন পূর্বে যেতে হবে ‘অ্যার আপিসে’। আপনাকে সব জায়গার টিকিট দেয় না– কেউ দেবে ঢাকা, কেউ দেবে আসাম, মাদ্রাজ অঞ্চল, কেউ দেবে দিল্লির।

এবং এসব অ্যার আপিস ছড়ানো রয়েছে বিরাট কলকাতার নানা কোণে, নানা গহ্বরে। এবং বেশিরভাগ ট্রাম-লাইন, বাস-লাইনের উপর নয়। হাওড়া যান ট্রামে, দিব্য মা-গঙ্গার হাওয়া খেয়ে; ‘অ্যার আপিসে’ যেতে হলে প্রথমেই ট্যাক্সির ধাক্কা।

অ্যার আপিসে ঢুকেই আপনার মনে হবে, ভুল করে বুঝি জঙ্গি দফতরে এসে পড়েছেন। পাইলট, রেডিও-অফিসার তো উর্দি পরে আছেনই, এমনকি টিকিটবাবু পর্যন্ত শার্টের ঘাড়ে লাগিয়েছেন নীল সোনালির ব্যাজ-ঝিল্লা-বিরণ-পট্টি, যা-খুশি বলতে পারেন। রেলের মাস্টারবাবু গার্ড সাহেবরাও উর্দি পরেন, কিন্তু সে উর্দি জঙ্গি কিংবা লস্করি উর্দি থেকে স্বতন্ত্র, অ্যার আপিসে কিন্তু এমনি উর্দি পরা হয়– খুব সম্ভব ইচ্ছে করেই– যে আমার মতো কুনো বাঙালি সেটাকে মিলিটারি কিংবা নেভির য়ুনিফর্মের সঙ্গে গুবলেট পাকিয়ে আপন অজানাতে দুম করে একটা স্যালুট করে ফেলে।

তার পর সেই উর্দি-পরা ভদ্রলোকটি আপনার সঙ্গে কথা কইবেন ইংরেজিতে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন আপনি ধুতি কুর্তা-পরা নিরীহ বাঙালি, তবু ইংরেজি বলা চাই। আপনি না হয় সামলে নিলেন, বি.এ. এম.এ পাস করেছেন কিন্তু আমি মশাই পড়ি মহা বিপদে। তিনি আমার ইংরেজি বোঝেন না, আমি তাঁর ইংরেজি বুঝতে পারিনে– কী জ্বালা! এখন অবশ্য অনেক পোড় খাওয়ার পর শিখে গিয়েছি যে জোর করে বাংলা চালানোই প্রশস্ততম পন্থা। অন্তত তিনি বক্তব্যটা বুঝতে পারেন।

তখখুনি যদি রোক্কা টাকা ঢেলে দিয়ে টিকিট কাটেন তবে তো ল্যাঠা চুকে গেল, কিন্তু যদি শুধু ‘বুক’ করান তবে আপনাকে আবার আসতে হবে টাকা দিতে। নগদা টাকা ঢেলে দেওয়াতে অসুবিধা এই যে, পরে যদি মন বদলান তবে রিফান্ড পেতে অনেক হ্যাপা পোয়াতে হয়। সে না হয় হল, রেলের বেলাও হয়।

কিন্তু প্লেনের বেলা আরেকটা বিদকুটে নিয়ম আছে। মনে করুন, আপনি ঠিক সময় দমদম উপস্থিত না হতে পারায় প্লেন মিস করলেন। রেলের বেলায় তখুনি টিকিট ফেরত দিলে শতকরা দশ টাকার খেসারতির আক্কেলসেলামি দিয়ে ভাড়ার পয়সা ফেরত পাবেন। প্লেনের বেলা সেটি হচ্ছে না। অথচ আপনি পাকা খবর পেলেন, প্লেনে আপনার সিট ফাঁকা যায়নি, আর এক বিপদগ্রস্ত ভদ্রলোক পুরো ভাড়া দিয়ে আপনার সিটে ট্রাভেল করেছেন, অ্যার কোম্পানিও স্বীকার করল, কিন্তু তবু আপনি একটি কড়িও ফেরত পাবেন না। অ্যার কোম্পানির ডবল লাভ। এ নিয়ে দেওয়ানি মোকদ্দমা লাগালে কী হবে বলতে পারিনে, কারণ আমি আদালতকে ডরাই অ্যার কোম্পানির চেয়েও বেশি।

টিকিট কেটে তো বাড়ি ফিরলেন। তার পর সেই মহা মূল্যবান ‘মূল্যপত্রিকা’খানি পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে প্লেন দমদম থেকে ছাড়বে দশটার সময়, আপনাকে কিন্তু অ্যার আপিসে হাজিরা দিতে হবে আটটার সময়? বলে কী? নিতান্ত থাচ্ছো কেলাসে যেতে হলেও তো আমরা এক ঘণ্টার পূর্বে হাওড়া যাইনে–কাছাকাছির সফর হলে তো আধ ঘণ্টা পূর্বে গেলেই যথেষ্ট, আর যদি ফাস্ট কিংবা সেকেন্ডের (প্লেনে আপনি ভাড়া দিচ্ছেন ফাস্টের চেয়েও বেশি– অনেক সময় ফার্স্টের দেড়া) বার্থ রিজার্ভ থাকে তবে তো আধ মিনিট পূর্বে পৌঁছলেই হয়।

আপনি হয়তো প্লেনে থাকবেন পৌনে দু ঘণ্টা, অথচ আপনাকে অ্যার আপিসে যেতে হচ্ছে পাকা দু ঘণ্টা পূর্বে (মোকামে পৌঁছে সেখানে আরও কত সময় যাবে সেকথা পরে হবে)।

এইবারে মাল নিয়ে শিরঃপীড়া। আপনি চুয়াল্লিশ (কিংবা বিয়াল্লিশ) পাউন্ড লগেজ ফ্রি পাবেন। অতএব

“সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই চারিখান
গুড়ের পাটালি কিছু ঝুনা নারিকেল
দই ভাণ্ড ভালো রাই সরিষার তেল
আমসত্ত্ব আমচুর—”

 ইত্যাদি মাথায় থাকুন, বিছানাটি যে নিয়ে যাবেন তারও উপায় নেই। অথচ আপনি গৌহাটি নেমে হয়তো ট্রেনে যাবেন লামডিং, সেখানে উঠবেন ডাকবাংলোয়। বিছানা বিশেষ করে মশারি-বিনা কী করে পোয়াবেন দিনরাতিয়া?

বিছানাটা নিলেন কি? না। তার ভেতর যে ভারি জিনিস কিছু কিছু লুকোবেন ভেবেছিলেন সেটিও তা হলে হল না। অবশ্য লুকিয়ে কোনও লাভ হত না, কারণ জিনিসটিকে ওজন তো করা হতই মালে আপনি ফাঁকি দিতে পারতেন না।

অ্যার ট্র্যাভেল করবেন– মাত্র চুয়াল্লিশ পাউন্ড ফ্রি লগেজ– অতএব আপনি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের মতো একটি পিচবোর্ডের কিংবা ফাইবারের সুটকেসে মালপত্র পুরে– সেটার অবস্থা কী হবে মোকামে পৌঁছলে পরে বলব–রওনা দিলেন অ্যার আপিসের দিকে, ছাতা বরষাতি অ্যাটাচি হাতে, তার জন্যে ফালতো ভাড়া দিতে হবে না (থ্যাঙ্ক ইউ!)।

ট্যাক্সি যখন নিতেই হবে তখন সঙ্গে চললেন দু একজন বন্ধু-বান্ধব। যদিস্যাৎ দৈবাৎ প্লেন মিস করেন তবে একটি কড়িও ফেরত পাবেন না বলে দু দশ মিনিট আগেই রওনা দিলেন আর অ্যার আপিসে পৌঁছলেন বাকি সোয়া দু ঘন্টা পূর্বে– আমার জাতভাই বাঙালরা যেরকম ইস্টিশানে গাড়ি ছাড়ার তিন ঘণ্টা পূর্বে যায়।

অ্যার আপিসের লোক হন্তদন্ত হয়ে ট্যাক্সি থেকে আপনার মাল নামাবে। যে লোকটা কুলি-চাপরাশি সমন্বয়– তা হোক গে– কিন্তু তার বাই সে ‘হিন্দিতে’– রাষ্ট্রভাষাতে– অর্থাৎ তার অউন, অরিজিন্যাল হিন্দিতে কথা বলবেই– যেরকম তার বসের ইংরেজি বলার বাই অথচ উভয়পক্ষই বাঙালি।

আমাদের বঙ্কিম, আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলতে আমরা অজ্ঞাত, কিন্তু এই বাঙলা দেশের মহানগরী, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথের লীলাভূমিতেই আপিস আদালতে, রাস্তাঘাটে ‘আ মরি বাংলাভাষার’ কী কদর, কী সোহাগ!

কলকাতা বাঙালি শহর। বাঙালি বলতে আপনি আমি মধ্যবিত্ত বাঙালিই বুঝি, তাই আমাদের অ্যার আপিসগুলোর অবস্থা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মতো। অর্থাৎ মাসের পয়লা তিন দিন ইলিশ মুরগি তার পর আলুভাতে আর মশুর ডাল।

ঢাক-ঢোল শাঁক-করতাল বাজিয়ে যখন প্রথম আমাদের সাথে আপিসগুলো খোলা হয় তখন সায়েবি কায়দায় বড় বড় কৌচ, বিরাট বিরাট সোফা, এন্তার ফ্যান, হ্যাট-স্ট্যান্ড, গ্লাস-টপ টেবিল–তার উপরে থাকত মাসিক, দৈনিক, অ্যাশট্রে আরও কত কী! সাহস হত না বসতে, পাছে জামাকাপড়ের ঘষায় সোফার চামড়া নোংরা হয়ে যায়– চাপরাশিগুলোর উর্দিই তো আমার পোশাকের চেয়ে ঢের বেশি ধোপদুরস্ত ছিমছাম।

আর আজ? চেয়ারগুলোর উপর যা ময়লা জমেছে তাতে বসতে ঘেন্না করে। ফ্যানগুলো–ক্যাঁচক্যাঁচ করে ছুটির জন্য আবেদন জানাচ্ছে, দেয়ালে চুনকাম করা হয়নি সেই অন্নপ্রাশনের দিন থেকে– সমস্তটা নোংরা এলোপাতাড়ি আর আবহাওয়াটা ইংরেজিতে যাকে বলে ড্রেয়ারি ডিসমেল।

একটা অ্যার আপিসে দেখেছি– ভেতরে যাবার দরজায় যেখানে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে হয় সেখানে যা ময়লা জমেছে তার তুলনায় আমাদের রান্নাঘরের তেলচিটে-কালি-মাখা দরজাও পরিষ্কার। আপনি সহজে বিশ্বাস করবেন না। আসুন একদিন আমার সঙ্গে, দেখিয়ে দেব।

এইবারে একটু আনন্দের সন্ধান পাবেন। দশাসই যখন ওজন করা হবে তখন আড়নয়নে ওজনের কাঁটাটার দিকে নজর রাখবেন। ১৬০ থেকে তামাশা আরম্ভ হয়, তার পর ডবল সেঞ্চুরি পেরিয়ে কেউ কেউ মুস্তাক আলির মতো ট্রিপলের কাছাকাছি পৌঁছে যান। আমার বন্ধু ‘—মুখুজ্যে’ যখন একবার ওজন নিতে উঠেছিল তখন কাঁটাটা বো-বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে শেষটায় থপ করে শূন্যেতে এসে ভিরমি গিয়েছিল। মুখুজ্যে আমাকে হেসে বলেছিল, ‘কিন্তু ভাড়া তুমি যা দাও আমিও তাই।’

কী অন্যায়!

 তার পর আবার সেই একটানা একঘেয়ে অপেক্ষা।

তিন কোয়ার্টার পরে খবর আসবে মালপত্র সব বাসে ভোলা হয়ে গিয়েছে। আপনারা গা-তুলুন?

রবি ঠাকুর কী একটা গান রচেছেন না?

“আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে
তোমার সুরে সুর মেলাতে–”

অ্যার কোম্পানির বাসগুলো কিন্তু আপিসগুলোর সঙ্গে দিব্য সুর মিলিয়ে বসে আছে। লড়াইয়ের বাজারে যখন বিলেত থেকে নতুন মোটর আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন কচুবন থেকে কুড়িয়ে আনা যেসব বাস গ্রামাঞ্চলে চড়েছিলুম, আমাদের অ্যার কোম্পানির বাস প্রায় সেইরকম। ওদেরই আপিসের মতো নোংরা, নড়বড়ে আর সিটগুলোর স্প্রিং অনেকটা আরবিস্তানের উটের পিঠের মতো। ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ হওয়ার শখ যদি আপনার হয়, আরব দেশ না গিয়ে, তবে এই বাসের যে কোনও একটায় দু দণ্ডের তরে চড়ে নিন। আপনার মনে আর খেদ থাকবে না।

মধ্য কলকাতা থেকে দমদম কমাইল রাস্তা সে-খবর বের করা বোধ হয় খুব কঠিন নয়; কিন্তু সেই বাসে চড়ে আপনার মনে হবে–

‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ!’

মোটর, ট্যাক্সি, স্টেটবাস, বে-সরকারি বাস এমনকি দু চারখানা সাইকেল রিকশাও আপনাকে পেরিয়ে চলে যাবে। ত্রিশ না চল্লিশ যাত্রীকে এক খেপে দমদম দিয়ে যাবার জন্যে তৈরি এই ঢাউস বাস–প্রতি পদে সে জাম হয়ে যায়, ড্রাইভার করবে কী, আপনিই বা বলবেন কী?

দিল্লি থেকে কলকাতা আসবার সময়ে একবার দেখেছিলুম, যে যাত্রী প্লেনের দোলাতে কাতর হয়নি এই বাসের ঝাঁকুনিতে বমি করেছিল।

দমদম পৌঁছলেন। এবারে প্লেন না-ছাড়া পর্যন্ত একটানা প্রতীক্ষা। সে-ও প্রায় তিন কোয়ার্টারের ধাক্কা।

তবে সময়টা অত মন্দ কাটবে না। জায়গাটা সাফ-সুরতো, বইয়ের স্টল আছে, দমদম আন্তর্জাতিক অ্যার পোর্ট বলে জাত-বেজাতের লোক ঘোরাঘুরি করছে, ফুটফুটে ফরাসি মেম থেকে কারও-বোরকায়-সর্বাঙ্গটাকা পর্দানশিনী হজ-যাত্রিনী সবকিছুই চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে।

তবে একথাও ঠিক, হাওড়ার প্লাটফর্মের তুলনায় এখানে উত্তেজনা এবং চাঞ্চল্য কম।

প্লেনে যখন মাল আর আপনার জায়গা হবেই আর হুড়োহুড়ি করার কী প্রয়োজন?

তবু ভারতবর্ষ তাজ্জব দেশ। দিন কয়েক পূর্বে দমদম অ্যার পোর্ট রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক গ্লাস জল চাইলুম। দেখি জলের রঙ ফিকে হলদে। শুধালুম, শরবত কি ফ্রি বিলানো হচ্ছে?

বয় বললে, জলের টাঁকি সাফ করা হয়েছে, তাই জল ঘোলা, এবং মৃদুস্বরে উপদেশ দিল, ও জল না খাওয়াই ভালো।

শুনেছি ইয়োরোপের কোনও কোনও দেশে নরনারী এমনকি কাচ্চা-বাচ্চারাও নাকি জল খায় না। দমদমাতে যদি কিছুদিন ধরে নিত্যি নিত্যি টাকি সাফ করা হয় তবে আমরা সবাই সায়েব হয়ে যাব।

শুধু কি তাই, জলের জন্য উদ্বাস্তুরা উদ্ব্যস্ত করে তুলবে না, কলকাতা কর্পোরেশনকে। আমরা সবাই এখন রুটির বদলে কেক খাব। সেকথা থাক।

কিন্তু দমদম অ্যার পোর্টের সত্যিকার জলুস খোলে যেদিন ভোরে কুয়াশা জমে। কাণ্ডটা আমি এই শীতেই দু বার দেখেছি। ভোর থেকে যেসব প্লেনের দমদম ছাড়ার কথা ছিল তার একটাও ছাড়তে পারেনি। তার প্যাসেঞ্জার সব বসে আছে আর পোর্টে।

আরও যাত্রী আসছে দলে দলে, তাদের প্লেন ছাড়তে পারছে না, করে করে প্রায় দশটা বেজে গেল। একদিক থেকে যাত্রীরা চলে যাচ্ছে, অন্যদিক থেকে আসছে; এই স্রোত বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তখন দমদমাতে যে যাত্রীর বন্যা জাগে, তাদের উৎকণ্ঠা, আহারাদির সন্ধান, খবরের জন্য অ্যার কোম্পানির কর্মচারীদের বারবার একই প্রশ্ন শোধানো, ‘ড্যাম ক্যালকাটা ওয়েদার’ ইত্যাদি কটুবাক্য, নানা রকমের গুজব– কোথায় নাকি কোন প্লেন ক্র্যাশ করেছে, কেউ জানে না যেসব বন্ধুরা ‘সি অফ’ করতে এসেছিলেন তাঁদের আপিসের সময় হয়ে গেল অথচ চলে গেলে খারাপ দেখাবে বলে কষ্টে আত্মসংবরণ, প্লেন ‘টেক অফ করতে পারছে না ওদিকে ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গিয়েছে বলে যাত্রীদের ফ্রি খাওয়ানো হচ্ছে, কঞ্জুস কোম্পানিরা গড়িমসি করছে বলে তাদের যাত্রীদের অভিসম্পাত আরও কত কী!

লাউডস্পিকার ভোর ছটা থেকে রা কাড়েনি। খবর দেবেই-বা কী?

দমদম নর্থ-পোল হলে কী হত জানিনে। শেষটায় কুয়াশা কাটল। হঠাৎ শুনি লাউড স্পিকারটা কুয়াশায়-জমা গলার কাশি বার কয়েক সাফ করে জানালে, ‘অমুক জায়গায় প্যাসেঞ্জাররা অমুক প্লেনে (ডি বি জি, হি বি জি, হিজিবিজি কী নম্বর বলল বোঝা গেল না। করে রওনা দিন।

আমি না হয় ইংরেজি বুঝিনে, আমার কথা বাদ দিন, কিন্তু লক্ষ করলুম, আরও অনেকে বুঝতে পারেননি। গোবেচারিরা ফ্যাল ফ্যাল করে ডাইনে বাঁয়ে তাকালে, অপেক্ষাকৃত চালাকেরা অ্যার আপিসে খবর নিলে, শেষটায় যে প্লেন ছাড়বে তার কোম্পানির লোক আমাদের ডেকে-ডুকে জড়ো করে প্লেনের দিকে রওনা করে দিল– পাণ্ডারা যেরকম গাইয়া তীর্থযাত্রীদের ধাক্কাধাক্কি দিয়ে ঠিক-গাড়িতে তুলে দেয়।

আমার সঙ্গে পাশাপাশি বসে যাচ্ছিলেন এক মারোয়াড়ি ভদ্রলোক। আমাকে বললেন, ‘আজকাল তো অনেক ইংরেজি না-জাননেওয়ালা যাত্রী-ভি প্লেনে চড়ছে। তব বাঙালি জবান মে প্লেনকা খবর বলে কাহে?’

ওই বুঝলেই তো পাগল সারে।

দেবরাজকে সাহায্য করে রাজা দুষ্মন্ত যখন পুষ্পক রথে চড়ে পৃথিবীতে ফিরছিলেন, তখন যেমন যেমন তিনি পৃথিবীর নিকটবর্তী হতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় পর্বত, গৃহ অট্টালিকা অতিশয় দ্রুত গতিতে তার চক্ষুর সম্মুখে বৃহৎ আকার ধারণ করতে লাগল। যতদূর মনে পড়ছে, রাজা দুষ্মন্ত তখনই তাই নিয়ে রথীর কাছে আপন বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

পুনরায় জনৈক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তারই উল্লেখ করে আমার কাছে সপ্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন যে, দুষ্মন্তের যুগ পর্যন্ত ভারতীয়েরা নিশ্চয়ই খ-পোত নির্মাণ করতে পারতেন, না হলে রাজা ক্রমাসন্ন পৃথিবীর এহেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন কী প্রকারে?

তার বহু বৎসর পরে একদা রমণ মহর্ষি একটানা ঘটনা বিশদভাবে পরিস্ফুট করার জন্য তুলনা দিয়ে বলেন, উপরের থেকে নিচের দিকে দ্রুতগতিতে আসার সময় পৃথিবীর ছোট ছোট জিনিস যেরকম হঠাৎ বৃহৎ অবয়ব নিতে আরম্ভ করে, ঠিক সেইরকম ইত্যাদি, ইত্যাদি।

মহর্ষির এক প্রাচীন ভক্ত আমার কাছে বসেছিলেন। আমাকে কানে কানে বললেন, ‘এখন তো তোমার বিশ্বাস হল যে, মহর্ষি যোগবলে উডডীয়মান হতে পারেন।’ আমায় একথাটা তার বিশেষভাবে বলার কারণ এই যে, আমি একদিন অলৌকিক ঘটনার আলোচনা প্রসঙ্গে একটি ফার্সি প্রবাদবাক্য উল্লেখ করে বলেছিলুম :

“পিরহা নমিপরন্দ
শাগিরদান উন্থরা মিপরানন্দ।”

 অর্থাৎ ‘পির (মুরশিদ) ওড়েন না, তাঁদের চেলারা ওঁদের ওড়ান (cause them fly)’।

তার কিছুদিন পরে আমি রমণ মহর্ষির পীঠস্থল তিরু আন্নামালাই (শ্রীআন্নামালাই) গ্রামের নিকটবর্তী অরুণাচল পর্বত আরোহণ করি। মহর্ষি এই পর্বতে প্রায় চল্লিশ বৎসর নির্জনে সাধনা করার পর তিরু আন্নামালাই গ্রামে অবতরণ করেন– সাধনার ভাষায় অবতীর্ণ হন।

পাহাড়ের উপর থেকে রমণাশ্রম দ্রৌপদী-মন্দির সবকিছু খুব ছোট দেখাচ্ছিল। তার পর নামবার সময় পাহাড়ের সানুদেশে এক জায়গায় খুব সোজা এবং বেশ ঢালু পথ পাওয়ায় আমি ছুটে সেই পথ দিয়ে নামতে আরম্ভ করলুম এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলুম, আশ্রম, দ্রৌপদী-মন্দির কীরকম অদ্ভুত দ্রুতগতিতে বৃহৎ আকার ধারণ করতে লাগল।

আমার এ অভিজ্ঞতা থেকে এটা কিন্তু সপ্রমাণ হয় না যে, পুষ্পক রথ কল্পনার সৃষ্টি কিংবা রমণ মহর্ষি যোগবলে আকাশে উড্ডীয়মান হননি, কিন্তু আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, দ্রুতগতিতে অবতরণ করার সময় ভূপৃষ্ঠ কীরকম বৃহৎ আকার ধারণ করতে থাকে।

কিন্তু এর উল্টোটা করা কঠিন, কঠিন কেন, অসম্ভব। অর্থাৎ দ্রুতগতিতে উপরের দিকে যাচ্ছি আর দেখছি পৃথিবীর তাবৎ বস্তু ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে– এ জিনিস অসম্ভব, কারণ দৌড় দিয়ে উপরের দিকে যাওয়া যায় না।

সেটা সম্ভব হয় অ্যারোপ্লেন চড়ে।

মাটির উপর দিয়ে প্লেন চলছিল মারাত্মক বেগে, সেটা ঠাহর হচ্ছিল অ্যারোড্রামের দ্রুত পলায়মান বাড়িঘর, হ্যাঙ্গার, ল্যাম্পপোস্ট থেকে; কিন্তু সেই প্লেন যখন শ পাঁচেক ফুট উপরে উঠে গেল, তখন মনে হল আর যেন তেমন জোর গতিতে সামনের দিকে যাচ্ছিনে।

উপরের থেকে নিচের দিকে তাকাচ্ছি বলে খাড়া নারকেল গাছ, টেলিগ্রাফের খুঁটি, তিনতলা বাড়ি তো ছোট দেখাচ্ছিলই, কিন্তু সবকিছু যে কতখানি ছোট হয়ে গিয়েছে, সেটা মালুম হল পুকুর, ধানক্ষেত আর রেল-লাইন দেখে। ঠিক পাখির মতো প্লেনও একবার গা-ঝাড়া দিয়ে এক এক ধাক্কায় উঠে যাচ্ছিল বলে নিচের জিনিস ছোট হয়ে যাচ্ছিল এক এক ঝটকায়।

জয় মা-গঙ্গা! অপরাধ নিও না মা, তোমাকে পবননন্দন পদ্ধতিতে ডিঙিয়ে যাচ্ছি বলে কিন্তু মা, তুমি যে সত্যি মা, সেটা তো এই আজ বুঝলুম তোমার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময়। তোমার বুকের উপর কৃষ্ণাম্বরী শাড়ি, আর তার উপর শুয়ে আছে অগুনতি খুদে খুদে মানওয়ারি জাহাজ, মহাজনি নৌকা– আর পানসি-ডিঙির তো লেখাজোখা নেই। এতদিন এদের পাড় থেকে অন্য পরিপ্রেক্ষিতে দেখছি বলে হামেশাই মনে হয়েছে জাহাজ নৌকা এরা তেমন কিছু ছোট নয়, আর তুমিও তেমন কিছু বিরাট নও, কিন্তু ‘আজ কী এ দেখি, দেখি, দেখি, আজ কী দেখি–’ এই যে ছোট ছোট আণ্ডা-বাচ্চারা তোমার বুকের উপর নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছে, তারা তোমার বুকের তুলনায় কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য! এদের মতো হাজার হাজার সন্তান-সন্ততিকে তুমি অনায়াসে তোমার বুকের আঁচলে আশ্রয় দিতে পার।

প্লেন একটুখানি মোড় নিতেই হঠাৎ সর্বব্ৰহ্মাণ্ডের সূর্যরশ্মি এসে পড়ল মা-গঙ্গার উপর। সঙ্গে সঙ্গে যেন এপার ওপার জুড়ে আগুন জ্বলে উঠল, কিন্তু এ আগুন যেন শুদ্র মল্লিকার পাপড়ি দিয়ে ইস্পাত বানিয়ে।

সেদিকে চোখ ফিরে তাকাই তার কী সাধ্য? মনে হল স্বয়ং সূর্যদেবের– রুদ্রের মুখের দিকে তাকাচ্ছি; তিনি যেন শুধু স্বচ্ছ রজত-যবনিকা দিয়ে বদন আচ্ছাদন করে দিয়েছেন। এ কী মহিমা, এ কী দৃশ্য! কিন্তু এ আমি সইব কী করে? তোমার দক্ষিণ মুখ দেখাও, রুদ্র। হে পূষণ, আমি উপনিষদের জ্যোদ্রিষ্টা ঋষি নই, যে বলব

‘হে পূষণ, সংহরণ
করিয়াছ তব রশ্মিজাল
এবার প্রকাশ করো
তোমার কল্যাণতম রূপ,
দেখি তারে যে-পুরুষ
তোমার আমার মাঝে এক।’

 আমি বলি, তব রশ্মিজাল তুমি সংহরণ কর, তুমি আমাকে দেখা দাও, তোমার মধুর রূপে, তোমার রুদ্র রূপে নয়। তোমার বদন যবনিকা ঘনতর করে দাও।

তাই হল–হয়তো প্লেন তাঁরই আদেশে পরিপ্রেক্ষিত বদলিয়েছে, এবার দেখি গঙ্গাবক্ষে স্নিগ্ধ রজত-আচ্ছাদন, আর তার উপর লক্ষ কোটি অলস সুরসুন্দরীরা শুধু তাদের নূপুর দৃশ্যমান করে নৃত্য আরম্ভ করেছেন। কিন্তু এ নৃত্য দেখবার অধিকার আমার আছে কি? রুদ্র না হয় অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু তার চেলা নন্দীভঙ্গীরা তো রয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সমঝে চলতেন, যদিও ওদিকে পূষণের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল, তাই বলেছেন :

‘ভৈরব, সেদিন তব প্রেতসঙ্গী দল
রক্ত-আঁখি!’

 অস্ট্রিচ পাখি যেরকম ভয় পেয়ে বালুতে মাথা গুঁজে ভাবে, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না, আমিও ঠিক তেমনি পকেট থেকে কালো চশমা বের করে পরলুম- এইবারে নূপুর-নৃত্য দেখতে আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

শুনি, ‘স্যার, স্যার!’ এ কী জ্বালা। চেয়ে দেখি প্লেনের স্টুয়ার্ড ট্রেতে করে সামনে লজেঞ্জুস ধরেছে। বিশ্বাস করবেন না, সত্যি লজেঞ্জুস! লাল, নীল, ধলা, হরেক রঙের। লোকটা মস্করা করছে নাকি–আমি ছোঁড়ার বাপের বয়সী–আমাকে দেখাচ্ছে লজেঞ্জুস! তার পর কি ঝুমঝুমি দিয়ে বলবে, ‘বাপধন, এইটে দোলাও দেখিনি, ডাইনে বাঁয়ে, ডাইন-আর-বাঁয়ে।’

এদিকে প্রকৃতির রসরঙ্গ, ওদিকে লজেঞ্জুসের রস। আমি মহাবিরক্তির সঙ্গে বললুম, “থ্যাঙ্ক ইউ।’

লোকটা আচ্ছা গবেট তো! শুধালে ‘থ্যাঙ্ক ইউ, ইয়েস, অর থ্যাঙ্ক ইউ, নো।’ মনে মনে বললুম, ‘তোমার মাথায় গোবর।’ বাইরে বললুম, ‘নো।’ কিন্তু এবারে আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বললুম না।

কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, মশাইরা, বেশিরভাগ ধেড়েরাই লজেঞ্জুস নিল এবং চুষলে।

তবে কি হাওয়ায় চড়ে ওদের গলা শুকিয়ে গিয়েছে, আর ওই বাচ্চাদের মাল নিয়ে গলা ভেজাচ্ছে? আল্লায় মালুম।

ও মা, ততক্ষণে দেখি সামনে আবার গঙ্গা। কাটোয়ার বাঁক।

 প্লেন আবার গঙ্গা ডিঙল। ওকে তো আর খেয়ার পয়সা দিতে হয় না। কে বলেছে :

‘ভাগ্যিস আছিল নদী জগৎ সংসারে
তাই লোকে কড়ি দিয়ে যেতে পারে
ও-পারে??’