অসম্ভবের দেশে – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ। অমানুষিক কণ্ঠস্বর

বিমল ও কুমার উৎকর্ণ হয়ে মোটরবোটের গর্জন শুনতে লাগল।

কিন্তু খানিক পরেই তারা বুঝতে পারলে, গর্জনটা ধীরে—ধীরে ঝিমিয়ে আসছে।

ক্রমে শব্দ এতটা ক্ষীণ হয়ে এল যে, আর কোনও সন্দেহ রইল না।

কুমার সানন্দে বলে উঠল, ‘যাক বাঁচা গেল! ও বোটখানা এদিকে আসছে না, অন্যদিকে চলে যাচ্ছে!’

বিমল বললে, ‘কিন্তু ওদের মনে সন্দেহ হয়েছিল বলেই যে বোটখানা হঠাৎ এখানে থেমেছিল, সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। এখন আমাদের উচিত হচ্ছে, ও—বোটখানাকে আরও খানিক এগিয়ে যেতে দেওয়া। ততক্ষণে এইখানে বসে—বসে রেঁধেবেড়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া যাক। ইকমিক কুকারে খিচুড়ি চড়িয়ে দাও কুমার! কাসিম মিয়া, আমাদের চুবড়ি থেকে একটি মুরগি বার করে স্বর্গে পাঠাব, না তোমরা দু—একটা মাছ উপহার দিতে পারবে?’

সন্ধ্যার মায়া—আলো মিলিয়ে গেল, আকাশ থেকে নেমে এল অন্ধকারের যবনিকা। বিমলদের মোটরবোট চলছে—চারিদিকে চলচল ছলছল জলের কান্না।

প্রতিপদের চাঁদ উঠল। কিন্তু আজকে আর বন্যজীবনের কোনও ধ্বনি—প্রতিধ্বনি নেই—এমনকী কোনওদিকে বনজঙ্গলের কোনও চিহ্নই নেই,—ওপরে আছে খালি আকাশের অনন্ত চন্দ্রাতপ এবং ডাইনে আর বাঁয়ে, সুমুখে আর পিছনে আছে শুধু সেই চলচল ছলছল জলের কান্না!

চতুর্দিকে সেই অসীমতার অপূর্ব আভাস দেখে কুমার বললে, ‘প্রলয়পয়োধিজলে নারায়ণ যেদিন বটপত্রে ভেসে গিয়েছিলেন, সেদিন তাঁরও অবস্থা হয়েছিল বোধ করি আমাদেরই মতো! এই অকূল জলের জগতে আমাদের বোটখানাকে বটপত্রের চেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছে না!’

বিমল তখন কুমারের কথা মন দিয়ে শুনছিল না, সে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করছিল।

নৌকোর পিছনের হালের কাছে দাঁড়িয়ে কাসিমও সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘ওই সেই দ্বীপ হুজুর!’

বিমল বললে, ‘তুমি ঠিক চিনতে পেরেছ তো কাসিম? কোনও ভুল হয়নি?’

‘না হুজুর, ভুল হতে পারে না। এখানে আর কোনও দ্বীপ নেই।’

বোট এগিয়ে চলল—দ্বীপ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

এখানটা সমুদ্র ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

কুমার বললে, ‘এখানে যদি নৌকো ডোবে, বাঁচবার কোনও উপায়ই নেই!’

বিমল বললে, ‘বাঁচবার একমাত্র উপায় ওই দ্বীপ। কিন্তু ওখানেও আছেন সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধ—যিনি অতিথি পছন্দ করেন না।’

কুমার বললে, ‘কে জানে ওই দ্বীপের কী রহস্য!’

কাসিম বললে, ‘হুজুর, আপনারা কি আজকেই ওখানে গিয়ে নামবেন?’

বিমল বললে, ‘এই রাত্রে? নিশ্চয়ই নয়! আমরা ডাঙার কাছে একটা ঝুপসি জায়গা পেলেই নোঙর করব। ডাঙায় নামব কাল সকালে। ড্রাইভার, তুমি মোটরের ইঞ্জিন থামাও, নইলে ও—শব্দ দ্বীপে গিয়ে পৌঁছবে। কাসিম, এখন বেশ জোয়ারের টান আছে, এইবার তোমার নৌকো আমাদের বোটকে দ্বীপের কাছে টেনে নিয়ে যেতে পারবে?’

কাসিম বললে, ‘পারবে।’ তখনি সেই ব্যবস্থাই হল।

বিমল বললে, ‘সবাই আস্তে—আস্তে দাঁড় ফেলো। সাবধানের মার নেই।’

দ্বীপ খুব কাছে এসে পড়ল। তার বনজঙ্গলে জ্যোৎস্নার ঝালর ঝিকমিক করছে এবং তার সর্বত্র বিরাজ করছে নিস্তব্ধ এক থমথমে বিজনতা।

কুমার বললে, ‘বুড়ো এখন ঘুমিয়ে—ঘুমিয়ে স্বপন দেখছে।’

বিমল বললে, ‘স্বপন দেখতে—দেখতে সে জেগে উঠতেও পারে।’

দ্বীপের ভেতর থেকে জীবনের টুঁ—শব্দটি পর্যন্ত কানে এল না। এখানে যে মানুষ আছে, গাছ—পাতার ফাঁক দিয়ে কোনও কম্পমান আলোক—শিখাও তার ইঙ্গিত দিলে না। এখানে যে প্রবল ও দুর্বল পশু আছে, পূর্ব পরিচিত বন্য নাট্যাভিনয়ের কোনও হুঙ্কার বা আর্তনাদও তার প্রমাণ দিলে না। বিমল ও কুমারের মনে হল গঙ্গাসাগরের লবণাক্ত অশ্রুজলের ওপরে অজানা বিভীষিকার ছায়া নাচিয়ে এই রহস্যময় দ্বীপ যেন পৃথিবীর ভেতরে থেকেও পৃথিবীর ভেতরে নেই।

বিমল চুপি—চুপি জিজ্ঞাসা করলে, ‘কাসিম, বুড়োবাবুকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলে, সেখানটা তুমি চিনতে পারবে?’

কাসিম মাথা নেড়ে বললে, ‘না হুজুর! তিনি বোধহয় কোনও আঘাটায় নেমেছিলেন। এখানে কোনও ঘাট আছে কিনা আমরা জানি না।’

বিমল বললে, ‘তাহলে কাল সকালে আমাদেরও আঘাটাতেই নামতে হবে। আপাতত এক কাজ করো। ওই যেখানে অনেকগুলো বড়—বড় গাছ প্রায় জলের ওপরে হেলে পড়ে চারদিক অন্ধকার করে তুলেছে, ওইখানে গিয়েই নৌকো বাঁধো। এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের দেখতে পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না; এরপর একবার ওই অন্ধকারের ভেতরে গিয়ে ঢুকতে পারলেই আমরা আজকের রাতের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারব।’

কাসিম বললে, ‘কিন্তু ও অন্ধকার তো ভালো নয় হুজুর! মাথার ওপরে গাছপালা—সেখানে অজগর থাকতে পারে। পাশেই ডাঙা—সেখানে বাঘ থাকতে পারে। যদি তাদের কেউ নৌকোয় এসে ওঠে?’

‘আমরা কামরার সব জানলা—দরজা বন্ধ করে ভেতরে শুয়ে থাকব। এখন তো রাতদুপুর, বাকি রাতটুকু কোনওরকমে কাটিয়ে দিতে পারব বোধহয়।’

নৌকো ও মোটরবোট ধীরে—ধীরে অন্ধকারের ভেতরে ঢুকল। সেইখান থেকে তারা দেখতে পেলে, আশপাশের কষ্টিপাথরের মতো কালো ও নিরেট ছায়ার সীমানা ছাড়িয়েই শুরু হয়েছে, মুক্ত আকাশ থেকে নেমে—আসা চাঁদের আলো—লহর—রুপোর জলতরঙ্গে নেচে—নেচে উঠছে আরও চিকন ফেনার মালা! সেই রূপময় তরল ও চঞ্চল অসীমতা নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে যে সুন্দর সংগীত গাইতে—গাইতে, ভাবুকের মন নিয়ে তা শুনলে শান্তি ও আনন্দে প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

সবাই কামরার ভেতরে ঢুকে দরজা—জানলা বন্ধ করে দিলে।

বিছানা পেতে বিমল ও কুমার শুয়ে পড়ল।

এ—কথা সে—কথা কইতে—কইতে তাদের দুজনেরই চোখের পাতা তন্দ্রার আমেজে যখন ভারী হয়ে এসেছে, তখন বাইরের জলকল্লোলের মাঝখানে আচম্বিতে কি—একটা বেসুরো শব্দ জেগে উঠল!

প্রথমে উঠল গাছের পাতার মর্মর শব্দ,—যেন তিন—চারটে বড়—বড় জীব ডাল—পাতার ভেতরে লাফাতে—লাফাতে নৌকোর কাছে এগিয়ে আসছে!

বিমল ধড়মড় করে উঠে বসে বললে, ‘অজগর নাকি?’

তারপর শোনা গেল—’কিচিরমিচির কিচিরমিচির কিচিরমিচির!’

কুমার আবার পাশ ফিরে শুয়ে চোখ মুদে বললে, ‘বাঁদর!’

বিমলও আবার শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে শোনা গেল—”কিচিরমিচির কিচিরমিচির কিচ মিচ কিচ কিচ—

 কচমচে কাঁচা মাথা

 কুচি কুচি কচু—কাটা

 কিছু যদি বোঝো দাদা,

 ফিরে যাও ক্যালকাটা!

হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা—হা।”—সে কী হাসি, যেন থামতেই চায় না।

বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘ওঠো কুমার! বন্দুক নাও। আমি দরজা খুলে টর্চ জ্বেলে চারদিক দেখি, তুমি বন্দুক বাগিয়ে তৈরি হয়ে পাশে থাক! বিপদ দেখলেই বন্দুক ছুড়বে!’

দরজা খুলে টর্চের উজ্জ্বল আলোকে কেবল দেখা গেল, বোটের ঠিক ওপরেই মস্ত বটগাছের দুটো—তিনটে ডাল খুব জোরে নড়ছে, যেন এইমাত্র কেউ সেখান থেকে লাফ মেরে ঘন পাতার আড়ালে সরে গিয়েছে।

কুমার বললে, ‘প্রথমে বাঁদরের কিচিরমিচির, তারপরেই মানুষের গান আর হাসি!’

বিমল বললে, ‘বাঁদরের কিচিরমিচির ঠিকই শুনেছি বটে! কিন্তু যে গান আর যে হাসি শুনলুম, ও কি মানুষের? অমন অস্বাভাবিক আওয়াজ কোনও মানুষের গলায় কেউ কি কখনও শুনেছে?’

কুমার আর একবার চারদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, ‘কিন্তু কোনও গাছে বাঁদরও নেই! তবে কি আমরা কোনও অশরীরীর সাড়া পেলুম?’

বিমল হতভম্বের মতো বললে, ‘এতদিন পরে শেষটা কী ভূত—প্রেতে বিশ্বাস করতে হবে?’

খানিক তফাত থেকে আবার আর একরকম আওয়াজ জেগে উঠল—’ঘট—ঘট’ ঘ্যাট—ঘ্যাট ঘট—ঘট ঘ্যাট—ঘ্যাট।’

কুমার চমকে বলে উঠল, ‘ও আবার কী?’

বিমল বললে, ‘ওই শোনো!’

 ‘ঘট—ঘট ঘ্যাট—ঘ্যাট ঘট—ঘট ঘ্যাট—ঘ্যাট—
 ঘুটঘুটে আন্ধি
 একলাটি কান্দি,
 রেখে গেছে বান্ধি
 সমুদ্রে!
 মোটরের পান্ডা!
 জল খুব ঠান্ডা,
 মোরগের আন্ডা
 দে ক্ষুদ্রে!
 দাও যদি ঝম্প,
 মোর মুখে লম্ফ—
 নিবে যাবে লম্প
 চক্ষের!
 কেন শ্রম—যত্ন?
 মোরা দুঃস্বপ্ন,
 হেথা নেই রত্ন
 যক্ষের!’

বিমল তাড়াতাড়ি জলের ওপরে টর্চের আলো নিক্ষেপ করলে—কিন্তু বৃথা, কোথাও জনপ্রাণী নেই, কেবল এক—জায়গায় জল অত্যন্ত তোলপাড় করছে—যেন কেউ সেখানে সবে ডুব দিয়েছে।

বিমল বোকার মতন কুমারের মুখের পানে তাকালে। কিন্তু কুমার বলে উঠল, ‘বুঝেছি, বুঝেছি। এ—সব হচ্ছে ওই দ্বীপের বুড়োর চালাকি! নিশ্চয়ই সে ভেনট্রিলোকুজম জানে! লুকিয়ে—লুকিয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে!’

বিমল বললে, ‘অসম্ভব নয়। কিন্তু গাছের ডাল কেন হঠাৎ দোল খায়, জল কেন হঠাৎ তোলপাড়! করে?’

কুমার যুতসই কোনও জবাব না দিতে পেরে বললে, ‘বুড়ো হয়তো ম্যাজিকেরও নানান কল—কৌশল জানে।’

বিমল বললে, ‘ও—সব বাজে কথা ভাববার সময় এখন নয়। ওপরে গাছে, নীচে ডালে ভিন্ন—ভিন্ন গলায় কারা অমন অদ্ভুতরকম শব্দ করে, পদ্যে কথা কয়, হা হা করে হাসে, আমাদের ভয় দেখায়, আবার সাবধান করেও দেয়? তারা আমাদের দেখে কিন্তু নিজেরা দ্যাখা দেয় না। তারা স্পষ্টই বলছে—এ বড় মারাত্মক জায়গা, এখানে ধনরত্ন কিছুই নেই, ভালোয়—ভালোয় তোমরা প্রাণ নিয়ে কলকাতায় ফিরে যাও! কে তারা? তারা শত্রু বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু তারা কি আমাদের বন্ধু?’

হঠাৎ কোনওরকম পূর্বাভাস না দিয়েই সারা দ্বীপ যেন সশব্দে সজাগ হয়ে উঠল!

সমুদ্রে প্রবল বন্যার দূরন্ত গর্জনের মতো, আগ্নেয়গিরির অগ্নিহুঙ্কারের মতো, কল্পনাতীত কি এক ভয়াবহ ধ্বনি—প্রতিধ্বনি যেন ক্রুদ্ধ আবেগে আকাশ—বাতাস পরিপূর্ণ করে তুললে! এবং তারই মাঝে মাঝে আবার শোনা যেতে লাগল—কিচিরমিচির কিচিরমিচির কিচ মিচ কিচ! ঘ্যাট—ঘ্যাট ঘট—ঘট ঘ্যাট—ঘ্যাট! বানর ও আর একটা কোনও পশুর ভীত আর্তনাদ!

কুমার বিহ্বলের মতো বললে, ‘দ্বীপে ও কাদের চিৎকার? হুড়মুড় করে গাছ ভেঙে পড়ছে—চিৎকারও যেন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে!’

ওদিকে পানসি থেকে কাসিমও সভয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘হুজুর! আমার লোকজনরা ভয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠেছে! বলছে, তারা এই শয়তানের দ্বীপের কাছে আর একদণ্ড থাকবে না! আমরা পানসি নিয়ে চলে যেতে চাই!’

বিমল ফাঁপরে পড়ে বললে, ‘সে কী কাসিম—মিয়া, তোমরা কি আমাদের এখানে ফেলেই পালাতে চাও?’

‘কী করব হুজুর, ভূতের সঙ্গে কে লড়াই করবে? আমরা গরিব মানুষ, ঘরে মা—বউ—বেটা আমাদের পথ চেয়ে দিন গোনে, আমরা কি ভূতের হাতে প্রাণ দিতে পারি?’

বিমল বললে, ‘শোনো কাসিম, আরও বকশিশ চাও তো বল!’

কাসিম মাথা নেড়ে বললে, ‘মাপ করবেন হুজুর! প্রাণ গেলে বকশিশ নেবে কে? ভাই সব! বোট থেকে আমাদের নৌকোর দড়ি খুলে নাও!’

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ। বিপদ জলে—স্থলে

কিন্তু সামুদ্রিক বন্যার গর্জনের মতো, আগ্নেয়গিরির হুঙ্কারের মতো, কালবৈশাখীর বজ্র—কণ্ঠের চিৎকারের মতো ও—সব কিসের ধ্বনি—প্রতিধ্বনি দ্বীপের ভেতর থেকে ক্রমেই জলের দিকে এগিয়ে আর এগিয়ে আসছে? ও—সব সৃষ্টিছাড়া আওয়াজ তো কোনও প্রাকৃতিক বিপ্লবের নয়, ওদের উৎপত্তি যেন জ্যান্ত জীবজন্তুর কণ্ঠ থেকেই! পৃথিবীতে এমন কোনও জীবজন্তু আছে, যারা এমন সব ভয়ানক অপার্থিব চিৎকার করতে পারে?

সেই আশ্চর্য চিৎকার একেবারে দ্বীপের প্রান্তে নদীর ধারে এসে পড়ল। বিমল অবাক হয়ে দেখলে, একটা বনের অনেকখানি অংশ যেন হেলে বেঁকে একবার দুমড়ে পড়ছে এবং আর্তনাদ করে আবার শূন্যে ঠিকরে উঠছে,—তার ভেতরে যারা আজ এসে ঢুকেছে, বনস্পতিরা তাদের যেন কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না! সেই অসহনীয় অত্যাচারী কল্পনাতীত দুরন্তদের ভৈরব হুঙ্কার বনস্পতিদের আর্ত মর্মনাদকেও ডুবিয়ে দিলে।

কুমার হঠাৎ বিমলের কাঁধ চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো, দেখো!’

বিমল আগেই দেখেছিল। চাঁদ তখন পশ্চিমদিকে গিয়ে একটা তালকুঞ্জের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে! আচম্বিতে সেই কুঞ্জের তালগাছগুলো চারিদিকে ঠিকরে পড়ল এবং তার মধ্যে বিকট দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠল সুদীর্ঘ ও বিরাট একটা ছায়ামূর্তি—চকিতের জন্যে! পরমুহূর্তে সেই মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তালগাছগুলোও আবার খাড়া হয়ে উঠে যেন বিষম যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।

ওই মুহূর্তের মধ্যেই বিমল দেখে নিলে, সেই বিরাট দানবের দেহ প্রায় তালগাছগুলোরই মতো উঁচু!

কাসিম কাঁপতে—কাঁপতে বললে, ‘হুজুর, আমার নৌকো খুলে দিয়েছি। আপনারা কী করবেন?’

বিমল বললে, ‘আমরাও যাব। ড্রাইভার, মোটরের ‘স্টার্ট’ দাও। কাসিম, তোমাদের পানসি আমাদের বোটের পিছনে বেঁধে নাও।’

হঠাৎ অন্ধকার জলের ভেতর থেকে আরও—অন্ধকার মস্ত একটা কুৎসিত মুখ জেগে উঠল—তার চোখদুটো জ্বলন্ত কয়লার টুকরোর মতো।

পানসির লোকেরা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কুমির, কুমির!’

কুমিরটা আবার ডুব মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

গাছের একটা বড় ডাল হঠাৎ দোল খেলে—সেখানেও দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে! সেটা বানর, না মানুষ, না অন্য কোনও জীব তা বোঝা গেল না বটে, কিন্তু সে যে অত্যন্ত আগ্রহভরে নৌকোর লোকদের গতিবিধি লক্ষ করছে, এটুকু ভালো করেই বুঝতে পারা গেল।

দ্বীপের বনজঙ্গলের ভেতর থেকে এতক্ষণ যে ভীষণ হট্টগোল উঠে চতুর্দিক শব্দময় করে তুলেছিল, আচম্বিতে তা থেমে গেল। অরণ্যের ছটফটানিও বন্ধ হয়ে গেল। বিমল ও কুমারের মনে হল, যেন বিরাট এক নিস্তব্ধ বিভীষিকা দম বন্ধ করে ওত পেতে তাদের ওপরে হঠাৎ লাফিয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে।

মোটরবোটের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল কে একজন হা—হা—হা—হা করে অট্টহাস্য করছে।

কুমার তাড়াতাড়ি টর্চের আলোটা সেইদিকে নিক্ষেপ করলে।

একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় এক দীর্ঘদেহ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সে মূর্তির কাছ পর্যন্ত টর্চের আলোকরেখা ভালো করে পৌঁছল না বলে তাকে স্পষ্ট করে দেখা গেল না; কিন্তু এটা বোঝা গেল, তার ধবধবে সাদা দীর্ঘ চুল, দাড়ি ও গায়ের জামাকাপড় লটপট করে হু—হু বাতাসে উড়ছে।

কাসিম বললে, ‘ওই সেই বুড়ো ভদ্রলোক!’

বিমল তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললে, ‘নমস্কার মশাই নমস্কার! এ—যাত্রা আর আপনার সঙ্গে আলাপ করা হল না।’

সে মূর্তি যেন পাথরের মূর্তি। একটু নড়লও না, আর কোনও সাড়াও দিলে না।

মোটরবোট ক্রমেই দ্বীপ থেকে দূরে গিয়ে পড়ছে, দ্বীপ ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বিমল ও কুমার একদৃষ্টিতে সেই রহস্য—রাজ্যের দিকে তাকিয়ে গুম হয়ে বসে রইল।

তারপর দ্বীপটা যখন একেবারে চোখের আড়ালে চলে গেল, কুমার তখন একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, ‘আমরা খালি সুন্দরবনের কাদা ঘেঁটেই ফিরে চললুম।’

বিমল বললে, ‘এত সহজে হাল ছাড়বার ছেলে আমি নই। আমরা আবার আসব, আর রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই আসব। ও দ্বীপের কিছুই আমি জানতুম না বলে এবারে ব্যর্থ হতে হল, কিন্তু এর পরের বারের ইতিহাস হবে অন্যরকম।’

কুমার বললে, ‘কলকাতা থেকে আমরা আশি মাইলের বেশি দূরে এসেছি বলে মনে হচ্ছে না; মনে হয় আমরা যেন অন্য কোনও পৃথিবীতে এসে হাজির হয়েছি। যা দেখলুম, আর যা শুনলুম, তা স্বপ্ন না চোখ আর কানের ভ্রম?’

বিমল বললে, ‘আমাদের সামনে এখন অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, ওই বুড়ো কে? কেন সে এমন অদ্ভুত জায়গায় বাস করে? দ্বিতীয়ত, জল আর গাছের ওপর থেকে কারা ছড়া কেটে আমাদের সাবধান করে দিচ্ছিল? কেনই বা তারা এখানে থাকে আর কেনই বা দেখা দেয় না? তৃতীয়ত, দ্বীপের বনজঙ্গলের ভেতরে কারা অমন হট্টগোল আর হুড়োহুড়ি করছিল? চতুর্থত, তালগাছগুলো ঠেলে যে অসম্ভব বিরাট ছায়ামূর্তিটা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল, সেটা কী? পঞ্চমত, সেই বাঘের মতন বড় বিড়ালটা কি এই দ্বীপেই বাস করত? সে—রকম বিড়াল কি এখানে আরও আছে?’

কুমার বললে, ‘দ্বীপের ব্যাপার যা দেখলুম তাতে মনে হচ্ছে, বেশ একটি বড় দলবল না নিয়ে এলে আমরা ওখানে নামতেই পারব না।’

বিমল বললে, ‘হ্যাঁ। কেবল দলবল নয়, দলে বাছা—বাছা লোক নিতে হবে। কাসিমদের মতো ভীতু লোক নিয়ে কোনও কাজ হবে না। এবারে যখন আসব, তখন আমাদের দলে বিনয়বাবু, কমল আর রামহরি তো থাকবেই, তার ওপরে জনকয়েক বন্দুকধারী পুলিশের লোক যাতে পাওয়া যায়, সে চেষ্টাও করতে হবে; নইলে এবারে এসেও হয়তো দ্বীপে গিয়ে নামতে পারব না। দ্বীপে যারা আছে তারা বাধা দেবেই।’

কুমার বললে, ‘আর আমাদের বাঘা? সে কার কাছে থাকবে?’

বিমল বললে, ‘বাঘার মতন চালাক কুকুর অনেক মানুষের চেয়েও ভালো! এখানে তাকেও হয়তো দরকার হবে। সেও আমাদের দলে থাকবে।’

পানসি থেকে কাসিম শুধোলে, ‘হুজুর, আপনারা কোনদিকে যাবেন?’

বিমল বললে, ‘আমরা পোর্ট ক্যানিংয়ে গিয়ে নামব।’

‘তাহলে হুজুর আমাদের রাইপুরের কাছে ছেড়ে দেবেন।’

‘আচ্ছা। চলো কুমার, শেষ রাতে আমরা একটু ঘুমিয়ে নি।’

বিমলের কথা শেষ হবা—মাত্রই হঠাৎ চারিদিকের নিস্তব্ধতাকে তলিয়ে দিয়ে একটা আর্তনাদ জেগে উঠল—’রক্ষা করো, রক্ষা করো!’

বিমল ও কুমার বিস্মিতভাবে চারিদিকে তাকাতে লাগল। এই জনমানবহীন জলের দেশে সাহায্য চায় কে!

তখন একটা ছোট্ট চরের পাশ দিয়ে বোট যাচ্ছিল। তারা চাঁদের নির্বাণোন্মুখ ম্লান জ্যোৎস্নায় দেখলে চরের ওপরে সাদা মতো চলন্ত কি একটা দেখা যাচ্ছে।

আবার আর্তনাদ শোনা গেল—’রক্ষা করো! আমাকে এখানে ফেলে যেও না!’

বিমল বললে, ‘ড্রাইভার, বোট চরে ভেড়াও!’

কাসিম ভীত স্বরে বললে, ‘হুজুর, এও ভূতের কারসাজি! এখানে মানুষ থাকে না।’

বিমল তার কথায় কর্ণপাত করলে না।

বোট চরে গিয়ে ঠেকল। ‘টর্চ’ জ্বেলে দেখা গেল, একটা লোক পাগলের মতো নৌকোর দিকে ছুটে আসছে—তার জামাকাপড় ছেঁড়া, চুল উশকোখুশকো, দৃষ্টি উদভ্রান্ত!

লোকটা কাতর স্বরে বললে, ‘আজ তিনদিন অনাহারে এখানে পড়ে আছি। আমাকে বাঁচান।’

বিমল তাকে নৌকোর ওপরে উঠতে বললে।

নৌকোয় উঠেই সে বললে, ‘আগে আমাকে কিছু খেতে দিন।’

কুমার তখনি একখানা পাঁউরুটি, কিছু মাখন ও খানিকটা জেলি এনে দিলে। লোকটা গোগ্রাসে তা খেয়ে ফেললে।

সে একটু ঠান্ডা হলে পর বিমল জিজ্ঞাসা করলে, ‘তুমি কেমন করে এখানে এলে?’

সে বললে, ‘গ্রহের ফেরে। আমি হচ্ছি কাঠের ব্যাপারী। নৌকো করে লোকজনের সঙ্গে এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলুম। পথে একটা দ্বীপ পেয়ে ভাবলুম, ওখানে নেমে দেখব ভালো কাঠের গাছ পাওয়া যায় কি না! সেই কুবুদ্ধিই হল আমার কাল। দ্বীপে গিয়ে নামবামাত্র চারিদিকে যেন দৈত্যদানবরা চিৎকার করতে লাগল আর ভূমিকম্প হতে লাগল। আমার দলের লোকদের কি হল জানি না, কিন্তু আমি দেখলুম, হাতির মতো কি একটা জানোয়ার তিরের মতো আমার দিকে তেড়ে আসছে!’

বিমল বললে, ‘সে জানোয়ারটাকে কি মস্ত একটা বিড়ালের মতো দেখতে?’

‘বিড়াল? না, তাকে দেখতে হাতির মতো বড় যেন একটা ডালকুত্তা!’

‘তারপর?’

‘আমি তখন জলের কাছে ছিলুম। প্রাণের ভয়ে তখনি জলে ঝাঁপ দিলুম—সঙ্গে—সঙ্গে আমার খুব কাছেই প্রকাণ্ড একটা কুমির ভেসে উঠল! ডাঙায় প্রকাণ্ড অদ্ভুত জানোয়ার আর জলে কুমির দেখে আমার যে কি অবস্থা হল, সেটা বুঝতেই পারছেন! যদিও প্রাণের আশা আর রইল না, তবু দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলুম,—কারণ আমি শুনেছিলুম, মানুষ যখন সাঁতার কাটে কুমির তখন তাকে ধরতে পারে না। এ কথা সত্যি কিনা জানি না, কিন্তু সেই কুমিরটা নাছোড়বান্দার মতো আমার সঙ্গে—সঙ্গে অনেকদূর এল বটে, তবু আমাকে ধরবার কোনও চেষ্টাই করলে না! তারপর সে ডুব মারলে। আমার ভয় আরও বেড়ে উঠল, ভাবলুম জলের ভেতর থেকে এইবারে সে আমাকে কামড়ে ধরবে! ক্রমাগত পা ছুড়তে লাগলুম! সেইভাবে ভাসতে—ভাসতে যখন এই চরে এসে উঠলুম, তখন আমি আধমরা। এই চরেই আজ তিনদিন তিনরাত কেটে গেছে। আজ আপনাদের নৌকো এ—পথে না এলে আমি অনাহারেই মারা পড়তুম।’

সপ্তম পরিচ্ছেদ। কুম্ভকর্ণের বংশধর

বিনয়বাবু তাঁর পরীক্ষাগারে বসে একমনে আকাশের গ্রহ তারা দেখবার বড় দূরবিনটা সাফ করছিলেন, এমন সময়ে একখানা খবরের কাগজ হাতে করে কমল সেই ঘরে প্রবেশ করল।

কমলের পায়ের শব্দ বিনয়বাবু চিনতেন, কাজেই দূরবিন থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ‘এসো কমল!’

কমল উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, ‘বিনয়বাবু, আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?’

‘না। তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে, নতুন কোনও খবর আছে!’

‘কেবল নতুন নয়, আশ্চর্য খবর!’

বিনয়বাবু দূরবিন থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘আমরা মঙ্গলগ্রহে গিয়েছি, ময়নামতীর মায়াকাননে গিয়েছি, হিমালয়ের ভয়ঙ্করের দেশে গিয়েছি। আমাদের কাছে কি কোনও খবরই আর আশ্চর্য বলে মনে হবে?’

কমল বললে, ‘আচ্ছা, আগে আপনি খবরটা শুনুন।’ এই বলে সে কাগজখানা খুলে পড়তে লাগল :

‘গঙ্গাসাগরে কুম্ভকর্ণ’

‘গঙ্গাসাগরের নিকটে এক অদ্ভুত রহস্যের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।

সাগরদ্বীপের নিকটস্থ নদ—নদীতে যাহারা নৌকো লইয়া আনাগোনা করে, সম্প্রতি তাহাদের ভেতরে অত্যন্ত বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছে।

কয়েকখানি নৌকোর এবং তাহাদের মাঝি—মাল্লার ও লোকজনের কোনও খবর পাওয়া যাইতেছে না। তাহারা যেখান হইতে যাত্রা করিয়াছিল সেখানেও ফিরিয়া আসে নাই, অথবা গন্তব্যস্থলেও গিয়া উপস্থিত হয় নাই। যদি মনে করা যায় কোনওরকম দুর্ঘটনায় হঠাৎ নৌকাডুবি হইয়াছে, তবে এইকথা জিজ্ঞাস্য হওয়া স্বাভাবিক যে, দুর্ঘটনা কি এমন নিয়মিত ভাবে ঘটিতে পারে? ঝড়—বাদল বা বন্যা নাই, অথচ পরে—পরে কয়েকখানা নৌকো আরোহীদের সহিত একেবারে অদৃশ্য হইয়া গেল, একজন লোকেরও প্রাণরক্ষা হইল না? এটা কি যারপরনাই অস্বাভাবিক নহে?

নদীর কেবল এক নির্দিষ্ট অংশের মধ্যেই নৌকাগুলি অদৃশ্য হইয়াছে। সাগরদ্বীপের পরে ফ্রেজারগঞ্জ। তাহার পর জামিরা নদী। তাহার পর বুলছড়ি দ্বীপ। তাহার পর মাতলা নদী। জামিরা নদীর জল যেখানে সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকিয়া মাতলা নদীর সঙ্গে মিশিয়াছে, সেইখানেই কোনও এক জায়গায় গিয়া প্রত্যেক নৌকাই হঠাৎ অদৃশ্য হইয়াছে।

পুলিশের লোকেরা তদন্তে গিয়া আর এক বিস্ময়কর ব্যাপার আবিষ্কার করিয়াছে।

পুলিশের নৌকা একটা অজানা দ্বীপের নিকটে নোঙর ফেলিয়াছিল। শুক্লপক্ষের শুভ্র রজনী। নৌকার ওপরে বসিয়া একজন চৌকিদার পাহারা দিতেছিল।

দ্বীপের ওপরে হঠাৎ সে এক অদ্ভুত দৃশ্য দর্শন করিল! প্রায় তালগাছ সমান উচ্চ ভয়াবহ এক মূর্তি স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে! দূর হইতে যদিও তাহার মুখ—চক্ষু দেখা যাইতেছিল না, তবে সেটা যে কোনও দানব মনুষ্য—মূর্তি, সে—বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নাই।

চৌকিদারের ভীত চিৎকারে নৌকার অনান্য লোক বাহিরে আসে এবং তাহারাও সেই বিরাট মূর্তিকে দেখিতে পায়! সকলে তখন নৌকো লইয়া সভয়ে পলায়ন করে।

যেসব নৌকা অদৃশ্য হইয়াছে, তাহার সহিত উক্ত অমানুষিক মূর্তির কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, পুলিশ এখন এই কথা লইয়াই মাথা ঘামাইতেছে।

প্রকাশ, শীঘ্রই বৃহৎ এক পুলিশ—বাহিনী ওই অজানা দ্বীপের দিকে যাত্রা করিবে।

স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস এই—লঙ্কাদ্বীপের কোনও অজ্ঞাত অংশ হইতে কুম্ভকর্ণের বংশধরগণ সন্তরণ দিয়া সমুদ্র পার হইয়া গঙ্গাসাগরের নিকটস্থ ওই দ্বীপের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। অদৃশ্য নৌকাগুলির আরোহীরা গিয়াছে তাহাদেরই বিপুল উদরের মধ্যে!

অবশ্য এরকম কুসংস্কারে আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু ব্যাপরটা যে ভালো করিয়া তদন্ত করা উচিত, সে বিষয়ে দ্বিমত থাকিতে পারে না। নহিলে সুন্দরবনের ও—অঞ্চলে নৌকা চলাচল একেবারেই বন্ধ হইয়া যাইবে!’

বিনয়বাবু তাঁর মাথার কাঁচাপাকা চুল ক’গাছির ভেতরে আঙুল চালাতে—চালাতে একমনে সমস্ত কথা শ্রবণ করলেন। তারপর ধীরে—ধীরে বললেন, ‘পৃথিবীতে কি আবার পুরাকাল ফিরে এল? এখানে দানবের অত্যাচার যেন ক্রমেই বেড়ে উঠছে! আমরা মৃণুকে উদ্ধার করতে গিয়ে হিমালয়ের যে—সব ভয়ঙ্করকে দেখে এসেছি, এতদিন অনেকে তাদের কথা বিশ্বাস করত না। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের এভারেস্ট অভিযানের লোকেরা হিমালয়ের টঙে যে বিরাট পদচিহ্ন দেখেছিল, সেটা তখন একটা মজার গল্প বলেই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সে গল্প যে সত্য, আমরা তা প্রমাণিত করবার চেষ্টা করি। আমাদের চেষ্টা বেশি বুদ্ধিমানদের কাছে সফল হয়নি। তারপর গেল বছরে যখন খবরের কাগজে বেরুল যে, দার্জিলিংয়ের আরও নীচে আর বাংলাদেশের নানাস্থানে দানবের মতো বৃহৎ মানুষ দেখা গেছে, তখন আমাদের কাহিনির ওপরে লোকের শ্রদ্ধা হল। বিমল বলে, হিমালয়ের ভয়ঙ্কররা তাদের দেবী অর্থাৎ আমাদের মৃণুকে সারাদেশে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং একদিন তারা মৃণুকে আবার খুঁজে বার করবেই করবে! গেল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর তারিখের ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে দেখেছি, মি. সিপটন নামে এক ভদ্রলোক হিমলায়ের ১৬,০০০ ফুট ওপরে বরফের গায়ে আবার দানবের পদচিহ্ন আবিষ্কার করেছেন। বিমলের মত যদি ঠিক হয়, তবে কে বলতে পারে, মৃণুকে খুঁজতে—খুঁজতে দু—একটা দানব গঙ্গাসাগরের কাছে গিয়ে হাজির হয়নি?’

কমল বললে, ‘বিমলবাবু আর কুমারবাবু যে গঙ্গাসাগরের কাছাকাছি কোনও একটা দ্বীপে দানব—বিড়ালের খোঁজে গিয়েছেন, সে কথাটাও মনে রাখবেন। দানবদের দেশে গিয়ে আমরা কিন্তু বাঘের মতো বড় কোনও বিড়াল—টিড়াল দেখতে পাইনি। সেখানকার কুকুর দেখেছি, সাধারণ কুকুরের চেয়ে সে বড় নয়। গঙ্গাসাগরের কাছে কি তাহলে দানব—জীবদের অজানা কোনও আস্তানা আছে?’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কেমন করে তা বলব? তবে এইটুকু জানি যে, বিলাতেও দানব—মানুষের কাহিনি কেবল গালিভারের গল্পে বা ছেলেভুলানো রূপকথায় পাওয়া যায় না। বিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষরাও তাদের চর্মচক্ষে দেখতে পেয়েছে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হচ্ছে ”বেল মাকবুই”। সে পাহাড়টি আছে হাইল্যান্ডারদের দেশে। যখন বরফ পড়ে তখন স্থানীয় লোকেরা কিছুতেই সেই পাহাড়ের ওপরে উঠতে রাজি হয় না। কারণ তারা বলে, বরফ পড়লেই সেখানে ‘Lang mon’-রা বেড়াতে আসে, তারা সাধারণ মানুষকে সুনজরে দেখে না! ‘Lang mon’ হচ্ছে ‘Long man’—এরই রূপান্তর—অর্থাৎ ‘লম্বা মানুষ’। সকলেই এই লম্বা মানুষদের অলীক কল্পনা বলেই মনে করত। কিন্তু কিছুদিন আগে Alpine Club-এর ভূতপূর্ব সভাপতি আর এভারেস্ট অভিযানেরই এক সাহেব স্বচক্ষে একজন লম্বা মানুষকে দেখতে পেয়েছেন। মাথায় সে উঁচু ছিল প্রায় ১২ ফুট! এই দুজন নির্ভরযোগ্য, বিখ্যাত আর শিক্ষিত দর্শকের কথা আজ আর কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না।’

কমল বললে, ‘কিন্তু গঙ্গাসাগরের এই দানব—মানুষ নাকি প্রায় তালগাছের সমান উঁচু। হিমালয়ের ভয়ঙ্কররাও এদের চেয়ে ঢের ছোট ছিল।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘উঁচু দানবের কথা যখন তুললে তখন আর—একটা সত্য কাহিনি বলি শোনো। এরও ঘটনাস্থল হচ্ছে বিলাতে, ডিভনসায়ারে। ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময়ে, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ফেব্রুয়ারির সকালবেলায় ডিভনসায়ারের অনেকগুলো শহরের বাসিন্দারা সবিস্ময়ে দেখলে যে, বরফের ওপরে অদ্ভুত সব খুরের চিহ্ন সারি—সারি এগিয়ে গেছে! এ—ঘোড়া বা গাধা বা অন্য কোনও চতুষ্পদ পশুর খুরের দাগ নয়—এ দাগ হচ্ছে কোনও দু—পেয়ে জীবের। পৃথিবীতে এমন কোনও দু—পেয়ে জীব নেই যার পায়ে খুর আছে। প্রায় একশো মাইল পর্যন্ত চলে গেছে ওই আশ্চর্য পদচিহ্ন! যে সারারাত ধরে অশ্রান্তভাবে পথ চলেছে এবং একরাতে যে একশো মাইল পথ চলে, সে কীরকম জীব তা বুঝে দেখো! যেতে—যেতে একটা এক মাইল চওড়া নদীও (River Exe) সে অনায়াসে পার হয়ে গেছে—কারণ, তার পদচিহ্ন নদীর এপারে জলের ধারে শেষ হয়ে গিয়ে আবার ওপার থেকে আরম্ভ হয়েছে! পথে অনেক ছোট—বড় বাড়ি পড়েছিল, কিন্তু সেই রহস্যময় জীবটা কোনও বাড়ির ভেতরেই ঢোকেনি। অনেক বাড়ির ছাদের ওপরেও পদচিহ্ন পাওয়া যায়, আবার পদচিহ্ন অনেক বাড়ির এপাশে শেষ হয়ে গিয়ে ফের ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে, তাদের ছাদের ওপরে কোনও দাগই নেই—যেন সে অনায়াসেই গোটা বাড়িটাই ডিঙিয়ে চলে গেছে! এখন ভাববার চেষ্টা করো, এ কোন জীব? এরকম পদচিহ্ন ডিভনসায়ারে তার আগে বা পরে আর কখনও দেখা যায়নি। তার খুরওয়ালা দুখানা পা, সে একমাইল চওড়া নদী পার হয়, অম্লানবদনে একরাতে একশো মাইল হাঁটে। বাড়ির ছাদে উঠে নেমে যায় বা বিনাকষ্টেই বাড়িকে—বাড়ি লঙ্ঘন করে অগ্রসর হয়! স্থানীয় লোকেরা ধরে নিলে, গত রাত্রের তুষার—বৃষ্টির সময়ে শয়তান ডিভনসায়ারে বেড়াতে এসেছিল—কারণ প্রচলিত মতে, শয়তানের দুই পায়ে খুর আছে। এই ঘটনার পরে অনেক দিন পর্যন্ত ডিভনসায়ারের বাসিন্দারা সন্ধ্যার আগেই যে যার বাড়ির ভেতরে পালিয়ে এসে ভয়ে দরজা—জানলা বন্ধ করে বসে থাকত!’

কমল বললে, ‘তবু লোকে বলে পৃথিবীতে এখন আর অসম্ভব ঘটনা ঘটে না!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘আপাতত ও—সব কথা থাক। কমল, বিমল আর কুমার কি সুন্দরবন থেকে কোনও খবর পাঠিয়েছে? তারা তো এই দানবের খবর পাওয়ার আগেই গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে, এর জন্যে প্রস্তুত হয়েও যায়নি,—যদি তারা কোনওরকম বিপদে পড়ে?’

এমন সময়ে একতলা থেকে শোনা গেল, একটা কুকুর পরিচিত গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠল—’ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’

কমল উৎসাহভরে লাফিয়ে উঠে বললে, ‘ওই বাঘা আমাদের ডাকছে! বাঘা যখন আসছে, তখন ওইসঙ্গে বিমলবাবুদেরও দেখা নিশ্চয় পাওয়া যাবে!’

বলতে—বলতে ঘরের দরজাটা দুম করে খুলে গেল এবং বিমল ও কুমারের আগে—আগে বাঘা ভেতরে ঢুকে বিনয়বাবুর কাছে গিয়ে দু—পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের পা দিয়ে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের প্রাণের আনন্দ জ্ঞাপন করলে। তারপর কমলকেও সেইভাবে আদর করে বিপুল বেগে পটপট রবে ল্যাজ নাড়তে লাগল!

বিনয়বাবু বললেন, ‘এই যে! তোমরা যে এরি মধ্যে ফিরে এলে?’

বিমল বললে, ‘আমরা ফিরে এলুম না বিনয়বাবু, পালিয়ে এলুম!’

‘দানব—মানুষের ভয়ে?’

‘এই যে, আপনিও খবর পেয়েছেন দেখছি! হ্যাঁ, দানবের ভয়েই বটে! কিন্তু পালিয়ে এসেছি আটঘাট বেঁধে পুনরাক্রমণ করব বলে।’

‘আবার তোমরা যাচ্ছ?’

‘নিশ্চয়! কিন্তু এবারে কেবল আমরা দুজনই নই, আপনি যাবেন কমল যাবে রামহরি যাবে—এমনকী বাঘাও পড়ে থাকবে না! নিন! উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত! আমরা প্রস্তুত, আপনারাও দ্বিগুণ উৎসাহে মোটমাট বেঁধে তৈরি হয়ে নিন! আমরা কালকে সকালেই যাত্রা করব!’

বিনয়বাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, ‘তার মানে?’

‘তার মানে, কাল সকালেই আমরা আপনাদের নিয়ে সম্ভবের মুল্লুক থেকে অসম্ভবের দেশে যাত্রা করব! তালগাছের মতো উঁচু মানুষ! হাতির মতো বড় ডালকুত্তা! বাঘের মতো মস্ত বিড়াল! পুলিশের লঞ্চ আর বন্দুকধারী সেপাই আমাদের সাহায্য করবার জন্যে এতক্ষণে প্রস্তুত হয়েছে, আমাকে ‘ডানপিটে’ বলে গালাগাল দিতে—দিতে আর রাগে গর—গর করতে—করতে বুড়ো রামহরি পর্যন্ত সমস্ত তল্লিতল্পা বেঁধে নিয়েছে, আর আপনারা এখনও অলস হয়ে এখানে বসে আছেন? ছিঃ বিনয়বাবু! ছিঃ কমল!’

বিনয়বাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আমরা কেমন করে জানব যে—’

বাধা দিয়ে বিমল বললে, ‘ব্যস, ব্যস, আর কথা নয়! এখন জেনেছেন তো? কাল সকালে আমরা সুন্দরবনে যাত্রা করব, আপনার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিন! আমাদের হাতে এখনও অনেক কাজ রয়েছে—চলো কুমার, আয় বাঘা!’

বাঘা বিনয়বাবুর দিকে ফিরে আবার বললে—’ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ’—কুক্কুর—ভাষায় তার অর্থ বোধহয়—’কর্তা, এখন আসি!’

বিমল ও কুমার দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, বিনয়বাবু হতাশভাবে ধপাস করে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘না, আমার অপঘাত—মৃত্যু না ঘটিয়ে বিমল বোধহয় ছাড়বে না! ওরা এল আর গেল যেন কালবোশেখির মতো,—এখন সামলাও ধাক্কা!’

খিলখিল করে হেসে উঠে কমল বললে, ‘আমার কিন্তু ভারী মজা লাগছে!’

বিনয়বাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘তা তো লাগবেই, সব গাধারই যে এক বুলি! কিন্তু আমার বয়স যে পঞ্চাশ পার হয়েছে, আমার কি এ—সব পোষায়, না শোভা পায়?’

দুষ্টু কমল বললে, ‘শাস্ত্রে বলে পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যেতে। আপনি তো সুন্দরবনেই যাচ্ছেন বিনয়বাবু! যে—সে বন নয়, পরমসুন্দর বন!’

বিনয়বাবু আরও রেগে বললেন, ‘থামো, থামো! আর জ্যাঠামি করতে হবে না!’

অষ্টম পরিচ্ছেদ। অমানুষিক কণ্ঠস্বর

আবার সেই সুন্দরবন! নির্জন বনভূমির মধ্যে আবার সেই নদীর ‘জলতরঙ্গ’ বাজনা! সে যেন নিস্তব্ধতার বীণায় কার মূর্চ্ছা ভাঙাবার অশ্রান্ত সুর!

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ আজ দেরি করে মুখ দেখাবে। জ্যোৎস্নার যে কুহকস্বপ্ন নিয়ে বিমল ও কুমার গেলবারে ফিরে গিয়েছিল, এবার তারা সেই মাধুর্যের অভাব অনুভব করতে লাগল অত্যন্ত। আকশে একটিমাত্র চাঁদকে দেখা না গেলে বনবাসী রাত্রির চেহারা যে কি—রকম বদলে যায়, যারা তা দেখেনি তারা কিছুতেই বুঝতে পারবে না। আকাশে কোটি—কোটি তারকার নির্নিমেষ নেত্রে যেটুকু আলোর বোবা ভাষা ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে কিছুমাত্র সান্ত্বনার আভাস নেই। বাতাসে—বাতাসে কি যেন একটা বুকচাপা স্বপ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে! কে যেন ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে গিয়ে আতঙ্কে কাঁদতে পারছে না! অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার! পায়ের তলা থেকে নদী সাড়া দিচ্ছে, দু—পাশ থেকে বিরাট অরণ্যের শিউরে—ওঠা মর্মর আর্তরব শোনা যাচ্ছে এবং তার জঠর থেকে ভেসে—ভেসে আসছে লক্ষ লক্ষ নিশাচর জীবের জীবন—যুদ্ধের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি! কারুকেই দেখবার যো নেই, কেবল শব্দ—কেবল শব্দ! অন্ধকারের বিভীষিকা সমস্ত ধ্বনি—প্রতিধ্বনিকে করে তুলেছে ভয়াবহ! যে—দেশে তারা সবাই আজ যাত্রা করেছে, পথের এই অন্ধকারময় বিভীষিকা তারই স্বরূপের আভাস দেওয়ার চেষ্টা করছে!

গভীর আঁধার—সাগরে যেন ভেসে চলেছে দুটি ছোট—বড় আলোক—দ্বীপ—বিমলদের মোটরবোট ও পুলিশের ইস্টিমার!

বোটের কামরার ভেতরে বসে রামহরি ”ইকমিক কুকারে” রান্না চড়িয়ে দিচ্ছে এবং এখনও আহারের যথেষ্ট বিলম্ব দেখে বাঘা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করছে। অত্যন্ত উজ্জ্বল পেট্রোলের লণ্ঠনের আলোকে কমল একখানা গল্পের বই পড়ছে এবং বিনয়বাবু, বিমল ও কুমার কথাবার্তা কইছে।

বিমল বলছিল, ‘না বিনয়বাবু, এই দ্বীপে হিমালয়ের সেই ভয়ঙ্কর দানবেরা এসে যে আস্তানা গেড়েছে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। হিমালয়ের ভয়ঙ্করদের কাহিনি যে আমাদের কল্পনার দুঃস্বপ্ন নয়, বাংলাদেশে এখন এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলে আমি খুবই খুশি হয়েছি, কিন্তু সেদিন দ্বীপের ওপরে যে দানবমূর্তির আভাসমাত্র দেখেছি, হিমালয়ের ভয়ঙ্কররাও হাত বাড়িয়ে তার মাথার নাগাল পাবে বলে মনে হয় না! সে এক নতুন আর অসম্ভব দানব!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তুমি আভাসমাত্র দেখেছ? তোমার চোখের ভ্রম হতেও তো পারে?’

‘আমাদের চোখের ভ্রম যদি হয়ে থাকে, তাহলেই মঙ্গলের কথা। কারণ, ওই দ্বীপে অমন সৃষ্টিছাড়া দানব যদি আরও গোটাকয়েক থাকে, তাহলে এই যাত্রাই আমাদের শেষযাত্রা হতেও পারে!’

রামহরি প্রায় কাঁদো—কাঁদো মুখে বলে উঠল, ‘খোকাবাবু, এই বুড়োবয়সে ভূতুড়ে রাক্ষসের খোরাক হওয়ার জন্যেই কি তোমরা আমাকে ধরে আনলে?’

কুমার হেসে ফেলে বললে, ‘ভয় কি রামহরি, গঙ্গাসাগরে মরলে রাক্ষসের পেটের ভেতর থেকে আবার বেরিয়ে তুমি সোজাসুজি স্বর্গে গিয়ে হাজির হতে পারবে! সকলে তখন মহা—পুণ্যবান বলে তোমাকে হিংসা করবে!’

রামহরি তেলে—বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, ‘থামো—থামো, আর কথায় ফোড়ন দিতে হবে না, ঢের হয়েছে! রাক্ষসের পেটেই যদি হজম হই, তাহলে স্বর্গে যাবে কে?’

কুমার বললে, ‘এইবারে রামহরি, তুমি নিরেট বোকার মতো কথা কইলে! রাক্ষসের ভুঁড়ি বড়জোর তোমার দেহকেই হজম করতে পারে, কিন্তু তোমার আত্মাকে হজম করে এমন সাধ্য কার আছে? মানুষের দেহ তো স্বর্গে যায় না, স্বর্গে যায় তার আত্মাই!’

রামহরি বললে, ‘অমন স্বর্গে যাওয়ার পায়ে আমি গড় করি,—অমন করে আমি স্বর্গেও যেতে চাই না!’

কমল বই থেকে মুখ তুলে বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনি ভাবছেন বিমলবাবুদের চোখের ভ্রম হয়েছে। কিন্তু আপনি খবরের কাগজের রিপোর্ট ভুলে যাচ্ছেন কেন? তাতেও তো এখানকার একটা দ্বীপে তালগাছ—সমান উঁচু এক দানবের কথা আছে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কি জানি বাপু, এখানকার ব্যাপারটা আমার মনে কেমন একটা অমঙ্গলের ভাব জাগিয়ে তুলছে! মনে হচ্ছে এদিকে না আসাই যেন উচিত ছিল!’

কুমার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললে, ‘এতক্ষণে চাঁদ উঠল! কিন্তু চাঁদের আজ জেল্লা নেই!’

বিনয়বাবু একটা অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নাই বা রইল জেল্লা! চাঁদ যে উঠেছে, এই অন্ধ—করা অন্ধকারে সেইটেই হচ্ছে বড় কথা। এতক্ষণ আমার তো মনে হচ্ছিল, চাঁদের বুঝি মৃত্যু হয়েছে, আলো আর ফুটবে না!’

কমল বললে, ‘কিন্তু ও চাঁদ যেন অন্ধকারকেই ভালো করে দেখাবার চেষ্টা করছে! গাছের তলায় নড়ন্ত ছায়াগুলোকে দেখে সন্দেহ হয়, ওরা যেন বিরাটদেহ প্রেতমূর্তি, আমাদের ঘাড় ভাঙতে পারলে আর ছেড়ে কথা কইবে না!’

রামহরি কাজ করতে—করতে মুখ তুলে ভয়ে—ভয়ে বনজঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘সন্দেহ আবার কি, সত্যিকথাই! নিশ্চয় ওখানে ভূত—প্রেত আছে!’

বিমল বললে, ‘পৃথিবীর শৈশবে আদিম মানুষরা গিরিগুহার ভেতর থেকে বাইরের আলো—আঁধারিতে চোখের ভ্রমে অমনি সব কত বিভীষিকাই দেখতে পেত। সেই সময় থেকেই ভূত—প্রেতের মিথ্যা ভয়ের সৃষ্টি। সে ভয় আজও আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে, জ্ঞানে—বিজ্ঞানে পণ্ডিত হয়েও মানুষ তাই তাকে আর ভুলতে পারে না।’

হঠাৎ বাঘা একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে কানদুটো খাড়া করে কি শুনতে লাগল!

বিমলও বাইরের দিকে তাকালে। বোট তীরের একদিক ঘেঁষে যাচ্ছিল—দেখা গেল কেবল খানিক—কালো আর খানিক—আলোমাখা গাছপালা। সেখানে কোনও জীবজন্তুর সাড়া পর্যন্ত নেই।

আচম্বিতে শোনা গেল—

‘ঘোঁ—ঘটঘট ঘোঁ ঘটঘট ঘোঁ—ঘটঘট ঘটঘট! ঘণ্টা বাজে যমালয়ে, কে যাবি আয় চটপট!’

কুমারের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল এবং বাঘাও বোটের ধারে গিয়ে জলের ধারে ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করতে লাগল!

বিমল লাফিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় হু—হু করে জলস্রোত ছুটে চলেছে, তা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না!

রামহরি ঠক—ঠক করে কাঁপতে—কাঁপতে বললে, ‘কোথাও জনপ্রাণী নেই, তবে এমন হেঁড়ে গলায় ভয়ানক চেঁচিয়ে কে কথা কইলে খোকাবাবু?’

সত্যসত্যই সে এমন উচ্চ কণ্ঠস্বর যে, পিছনের ইস্টিমারে পুলিশের লোকেরাও তা শুনতে পেয়েছিল, ইস্টিমারের ‘সার্চলাইট’ তখনি নদীর বুকের ওপরে তীব্রোজ্জ্বল আলোক—সেতুর মতন গিয়ে পড়ল, তারপর সে অরণ্যের বক্ষভেদ করেও খুঁজে দেখলে, কিন্তু কোথাও জ্যান্ত কোনও কিছুর সন্ধান পাওয়া গেল না!

বিনয়বাবু হতভম্বের মতো বললেন, ‘এ কী ব্যাপার, কুমার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

কুমার বললে, ‘এ কণ্ঠস্বর গেল—বারেও আমরা দ্বীপের কাছে এসে শুনেছি! কিন্তু কে যে—কথা কয়, কিছুতেই দেখতে পাইনি!’

কমল বললে, ‘মানুষের কথা শুনলুম বটে, কিন্তু এমন বিকট স্বরে কোনও মানুষ কি কথা কইতে পারে?’

বিমল বললে, ‘দ্বীপটা এখনও মাইল দশ—বারো দূরে আছে বোধহয়! কিন্তু গেল— বারে কেউ তো দ্বীপ থেকে এত দূরে এসে এমন স্বরে কথা কয়নি!’

কুমার বললে, ‘তাহলে আমরা যে আবার আসছি, এর মধ্যেই কি দ্বীপে সে—খবর পৌঁছে গেছে?’

বিমল জবাব দেওয়ার আগেই অনেকদূর থেকে আবার সেই উৎকট ভৈরব আওয়াজ জেগে উঠল—

‘ঘোঁ—ঘটঘট ঘোঁ—ঘটঘট ঘটঘট ঘটঘট!’

বিমল বললে, ‘এ ভালো লক্ষণ নয়! শব্দটা দ্বীপের দিকেই চলে যাচ্ছে।’

রামহরি বলে উঠল, ‘রাম রাম রাম রাম! অনেক ভূতের কথা শুনেছি, কিন্তু শব্দ—ভূতের কথা তো কখনও শুনিনি!’

বিমল বললে, ‘কুমার, বাঘার গলায় শিকল দাও! ও পাগলের মতো হয়ে উঠেছে—জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু ওর পশু—চোখ বোধ হয় জলের ভেতরেই কোনও বিপদকে আবিষ্কার করেছে।’

বিমল ‘টর্চ’ নিয়ে আবার নদীর ভেতরটা দেখতে লাগল—ঝাপসা চাঁদের আলো আর আবছায়া নিয়ে লোফালুফি করতে—করতে ও পাক খেতে—খেতে প্রবল জলের স্রোত ছুটছে এবং চিৎকার করে যেন নিকটস্থ সমুদ্রকে ডাকের পর ডাক দিচ্ছে! জলচর কুমির ও হাঙর ছাড়া সেখানে কোনও মানুষের পক্ষে এতক্ষণ ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব!

ইস্টিমার থেকে ‘মেগাফোনে’ মুখ দিয়ে ইনস্পেক্টর জিজ্ঞাসা করলে, ‘এখানে কোনও লোক ভয়ানক চেঁচিয়ে কথা কয়েছে! আপনারা কেউ দেখতে পেয়েছেন?’

বিমল বললে, ‘না!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমার মতে, আজ রাতে দ্বীপের কাছে না যাওয়াই ভালো। আজ এইখানেই নোঙর ফেলে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাক, কাল সকালে আলোয়—আলোয় দ্বীপের কাছে গিয়ে হাজির হব।’

বিমল বললে, ‘আমারও সেই মত।’

পরদিন পূর্ব—আকাশে প্রভাত এসে যখন রঙিন আলোর লাইন টানছিল, বিনয়বাবু তখন বোটের ভেতর থেকে বাইরে এসে বসলেন।

কাল সারারাত তাঁর অশান্তিতে কেটেছে, একবারও ঘুম আসেনি, কারণ জলধারার একটানা ঐকতানের মাঝে—মাঝে সেই অমানুষিক মানুষের চিৎকার আরও কয়েকবার জেগে উঠেছে—অনেক দূর থেকে।

কার এই কণ্ঠস্বর! এ যদি কোনও দানবের কণ্ঠস্বর হয় তাহলে কোথায় সে? সে দানবের আকার যদি আশ্চর্য রকম প্রকাণ্ড হয়, তবে তাকে তো আরও সহজেই দেখতে পাওয়ার কথা! আর, এই গভীর নদীর গর্ভে কোনও নরদেহী দানবের এতক্ষণ ধরে থাকবার ঠাঁইই বা কোথায়?

এই—সব উত্তরহীন প্রশ্ন নিয়েই বিনয়বাবুর রাত কেটে গেছে, এখন ভোরের আলো দেখে বাইরে এসে বসে তিনি অনেকটা আরামবোধ করলেন। রামহরি তাঁর আগেই উঠে তখন চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসে গেছে—’স্টোভে’ চায়ের জল গরম হচ্ছে এবং আর একটা ‘স্টোভ’ জ্বালিয়ে ‘অমলেট’ ভাজবার উদ্যোগ চলছে! রামহরি সকলকে রেঁধে খাওয়াতে ভারী ভালোবাসত, বিষম সব বিপদ—আপদের মাঝখানেও এ—বিভাগের কর্তব্যপালনের জন্যে সে সাধ্যমতো চেষ্টা করত। তাই পৃথিবীর ভেতরে ও বাইরে অনেক সৃষ্টিছাড়া দেশে গিয়েও বিমল ও কুমার প্রভৃতিকে কখনও কোনও কষ্টবোধ করতে হয়নি।

রাত্রের বিভীষিকা রোদের সোনার—জলের ধারায় কুয়াশার মতোই ধুয়ে—মুছে গিয়েছে, নদীর কলধ্বনি শুনে মনে হচ্ছে যেন ছোট্ট শিশুর খুশিভরা হাসির শব্দ! দূরে বনে—বনে গায়ক পাখির দলও জেগে উঠে চারিদিক সরগরম করে তুলেছে এবং বাতাসের উচ্ছ্বাসে ভেসে আসছে যেন কোনও চন্দনস্নিগ্ধ পুলকস্পর্শ!

বিমল, কুমার ও কমল বাইরে এসে বসতে—না—বসতেই রামহরি সকলের সামনে চায়ের পিয়ালা এবং ‘প্লেটে’ করে গরম ‘টোস্ট’ ও ‘অমলেট’ সাজিয়ে দিয়ে গেল।

বাঘাও যথাসময়ে অত্যন্ত সভ্য—ভব্যের মতো সকলের মাঝখানে এসে বসে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে রামহরির গতিবিধি লক্ষ করছিল। তার জন্যেও এল কতকগুলো কুকুর—বিস্কুট।

বিমল আগে বোট ও ইস্টিমার চালাবার হুকুম দিলে, তারপর এক ‘স্লাইশ’ রুটি তুলে নিয়ে বললে, ‘বিনয়বাবু’ আর ঘণ্টাদুয়েক পরেই আমরা সেই দ্বীপের কাছে গিয়ে হাজির হতে পারব।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তারপর?’

‘তারপর আমরা একেবারে তীরে গিয়ে নামব।’

‘যদি কেউ বাধা দেয়?’

‘ইস্টিমারে মিলিটারি পুলিশ আছে—এমনকী একটা ‘মেশিনগান’ও আছে। যদি সত্যিই সেখানে কোনও বিপদজনক অতিকায় বিড়াল, কুকুর, বাঘ বা দানব থাকে, তাহলে তাদের মেজাজ ঠান্ডা করবার জন্যে আমরা কোনও আয়োজনেরই ত্রুটি করিনি।’

‘কিন্তু এইসব অদ্ভুত জীবের সঙ্গে সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধের সম্পর্ক কি, সেটা তো আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না! লোকালয়ের বাইরে এমন বিজন জায়গায় নির্বাসিতের মতো বসে দানব—জীবদের নিয়ে তিনি কী করেন? দানবের ভয় তাঁর যখন নেই, তখন এটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে, দানবরাও তাঁর ওপরে কোনও অত্যাচার করে না!’

কুমার বললে, ‘আরও একটা মস্ত জানবার কথা হচ্ছে, এমন এক তুচ্ছ অজানা দ্বীপের বিড়াল আর কুকুর কেমন করে বাঘ আর হাতির মতো প্রকাণ্ড হয়ে উঠল?’

বিনয়বাবু সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু এ—সব কি সত্যি?’

বিমল বললে, ‘কুকুরটাকে আমি দেখিনি বটে, কিন্তু বাঘের মতো বড় একটা বিড়ালকে আমি নিজেই যে গুলি করে মেরেছি সে—কথা তো আপনি শুনেছেন?’

বিনয়বাবু বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার! আর তার চেয়েও আশ্চর্য হচ্ছে এই যে, যেখানেই আশ্চর্য ব্যাপার, সেইখানেই তোমরা? আমাদের এই নিত্য—দেখা একঘেয়ে পৃথিবীটাকে তোমরা ক্রমেই অসাধারণ আর বিচিত্র করে তুলছ!’

বোট ও ইস্টিমার তখন ছুটে চলেছে পুরোদমে—কেবল একদিকেই নদীর বনশ্যামল তটরেখা দেখা যাচ্ছে, অন্য তীর হারিয়ে গেছে প্রায় অসীমতার মধ্যেই!

হঠাৎ কুমার দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘দূরে ওই সেই দ্বীপ দেখা যাচ্ছে!’

আর সকলেও সাগ্রহে দাঁড়িয়ে উঠল। দূরে একটা গাছপালাভরা ভূমি জেগে উঠেছে বটে!

বিমল খানিকক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে বললে, ‘হ্যাঁ, কুমারের চোখ ঠিক দেখেছে!’

ধীরে—ধীরে দ্বীপটা স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু বাহির থেকে সে দ্বীপের মধ্যে কোনও নতুনত্বই আবিষ্কার করা গেল না—প্রবল হাওয়ায় গাছপালা দুলছে এবং নদীর জলে ঝিলমিল করছে তাদের ছায়া! কালকের রাতের সেই অমানুষিক কণ্ঠস্বর আজ আর কারুকে ভয়াবহ অভ্যর্থনা করলে না এবং বনজঙ্গলের ওপরে তালগাছ—সমান উঁচু দেহ নিয়ে কোনও বিরাট দানবও আবির্ভূত হল না!

বিনয়বাবু একটা দূরবিনের সাহায্যে দ্বীপটা পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ তিনি চমকে উঠে দূরবীক্ষণটা বিমলের হাতে দিয়ে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘দেখো বিমল, দেখো!’

দূরবিনটা তাড়াতাড়ি চোখে লাগিয়ে বিমল দেখলে, দ্বীপের একটা উঁচু জমির ওপরে একটি লোক পাথরে তৈরি মূর্তির মতো স্থির—ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে—যেন সে ইস্টিমারের দিকেই তাকিয়ে আছে নিষ্পলক নেত্রে! আজকেও তার ধবধবে সাদা লম্বা চুল, দাড়ি ও গায়ের জামাকাপড় লটপট করে হু হু বাতাসে উড়ছে!

দূরবিনটা নামিয়ে বিমল বললে, ‘ওই সেই দ্বীপবাসী বৃদ্ধ! এখানে যত রহস্যের সৃষ্টি বোধহয় ওই লোকটির জন্যেই! যাক, সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে যেতে আর বেশি বিলম্ব নেই!’

নবম পরিচ্ছেদ। উড়ো বোট

দ্বীপ ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে।

গেলবারে রাত—আঁধারে আর নানারকম অস্বাভাবিক ধ্বনি—প্রতিধ্বনির বিভীষিকার জন্যে এই অজানা দ্বীপটাকে যেমন রহস্যময় বলে মনে হয়েছিল, আজ তাকে দেখে বিমল ও কুমারের মনে তেমন কোনও ভাবেরই উদয় হল না।

নীল—আকাশের ছায়া—দোলানো নদীর গান—জাগানো চপল জলের কোলে আজ এই সূর্যকরের আলো—আদর—মাখা সবুজ সুন্দর দ্বীপটিকে মনে হতে লাগল ঠিক যেন কোনও ভোরের স্বপ্নে দেখা পরিস্থানের মতো!

গায়ক পাখিরা গাছের এ—ডালে বসে খানিক নেচে আবার ও—ডালে উড়ে গিয়ে বসে নাচ—গানে মেতে উঠছে, ছবিতে আঁকা শকুন্তলার তপোবনের হরিণের মতো দুটি ছোট—ছোট হরিণ এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে একান্ত নির্ভয়ে এবং দ্বীপের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দলে—দলে বকেরা আকাশে দোলন্ত বেলের গোড়ের মতো!

বিনয়বাবু ঘাড় নাড়তে—নাড়তে বললেন, ‘কী চমৎকার দ্বীপটি! যেন মুনি—ঋষির সাধনকুঞ্জ! এখানে ভয়ানক কিছু দেখবার আশাই করা যায় না!’

বিমল বললে, ‘দিনের আলো বড় কপট! ভয়াবহকেও অনেক সময় সুন্দর করে দেখায়।’

কুমার বললে, ‘বাইরের খোলস অনেক সময়ে চোখে ধোঁধা দেয়। সুন্দর মৌমাছিকে দেখলে কে বলবে যে, তার ভেতরে বিষাক্ত হুল আছে?’

এমন সময়ে ইস্টিমার থেকে ‘মেগাফোনে’ ইনস্পেক্টরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—’ইস্টিমার আর এগুতে পারবে না, এখানে জল বেশি নেই।’

বিমল চেঁচিয়ে বললে, ‘বেশ, আর এগিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, এইখানেই নোঙর ফেলা যাক।’

দ্বীপ সেখান থেকে একশো হাতের ভেতরেই।

কমল বললে, ‘ওই ভদ্রলোক কিন্তু এখনও সেইভাবে সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছেন!’

কুমার বললে, ‘বোধহয় আমরা কি করি তাই দেখছেন।’

বিমল বললে, ‘কিংবা কি করে আমাদের তাড়ানো যায় তাই ভাবছেন।’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু ওকে দেখলে তো আমার চেয়ে বিপদজনক বলে মনে হয় না!’

বিমল বললে, ‘হ্যাঁ’ দিনের বেলায় উনি এই দ্বীপের মতোই নিরীহ! কিন্তু রাত্রে বিপরীত মূর্তি ধারণ করেন! এইবার দ্বীপে নামবার ব্যবস্থা করা যাক, কী বলেন? ইস্টিমারের সঙ্গে দু—খানা বোট আছে, তাতে সিপাইরা আর ইনস্পেক্টর থাকবেন। আমরা মোটরবোটেই যাব!’

সবাই যখন দ্বীপের ওপরে গিয়ে উঠল, দুপুরের রোদ তখন অত্যন্ত উজ্জ্বল—অধিকাংশ ঝোপঝাপের ভেতরে পর্যন্ত নজর চলে।

দ্বীপের মধ্যে কোনওরকম নতুনত্ব নেই—চারিদিকে গাছপালা জঙ্গল ঝোপঝাপ, মাঝে—মাঝে আঁকাবাঁকা পায়ে—চলা পথ, মাঝে—মাঝে ছোট—বড় মাঠ।

বিমল বললে, ‘ইনস্পেকটর বাবু, আপনার সেপাইদের বন্দুক তৈরি রাখতে বলুন!’

ইনস্পেকটর বাবু হেসে বললেন, ‘যত সব গাঁজাখোরের কথা শুনে আমরা এসেছি বটে, কিন্তু এখানে তো ভয় পাওয়ার কিছুই দেখছি না! কোথায় মশাই আপনাদের কুম্ভকর্ণ? এখনও ঘুমোচ্ছে নাকি?’

বিমল গম্ভীর স্বরে বলল, ‘হতে পারে। হয়তো শেষ পর্যন্ত আমরা তার টিকিটিও আবিষ্কার করতে পারব না!’

‘তাহলে এখানে এত তোড়জোড় করে এসে কি লাভ হল?’

‘আমরা এসেছি জনরব সত্য কিনা জানবার জন্যে! জনরব যদি মিথ্যে হয়, তবে ফিরে গিয়ে সেই রিপোর্টই দেবেন।’

‘জনরব কি মশাই? কুম্ভকর্ণকে তো আপনারাও দেখেছেন বললেন! তারপর হাতির মতো বড় ডালকুত্তা, বাঘের মতো বড় বিড়াল, কত আজগুবি গল্পই যে শুনলুম!’

‘কাল রাতে নদীর মাঝখানে যে অমানুষিক কণ্ঠস্বর আপনারা শুনেছেন সেটাও তো আমাদের বানানো নয়?’

ইনস্পেকটর একটু যেন শিউরে উঠলেন এবং আর কোনও কথা বললেন না।

যে—পথ ধরে সবাই চলেছে, হঠাৎ তার মোড় ফিরেই দেখা গেল, সামনেই একখানা বাংলোর মতো ছোট একতলা মেটেবাড়ি, ওপরে পাতার ছাউনি।

বারান্দায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেই বুড়ো ভদ্রলোক।

সকলে যখন বাড়ির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল, বুড়ো ভদ্রলোকটি দুই পা এগিয়ে এলেন। একবার সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শান্ত হাসি হাসতে—হাসতে বললেন, ‘এত সেপাই—সান্ত্রী নিয়ে আপনারা কোন রাজ্য জয় করতে যাচ্ছেন?’

বিমল এগিয়ে গিয়ে বললে, ‘আমরা দিগ্বিজয়ে বেরুইনি। খালি এই দ্বীপটা খুঁজতে এসেছি।’

‘কেন?’

‘এখানে এমন কিছু দেখেছি যা অন্য কোথাও দেখা যায় না।’

‘বলেন কী মশাই? আমি এখানে বাস করি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই তো দেখিনি!’

এমন সময়ে ইনস্পেকটর তাঁর সুমুখে গিয়ে বললেন, ‘আপনার নাম কী?’

‘ধরণীকুমার মজুমদার।’

‘এই নির্জন দ্বীপে আপনি কি করেন?’

‘আমি সন্ন্যাসী নই বটে, কিন্তু সংসার ত্যাগ করেছি। এখানে বসে পরকালের চিন্তা করি।’

‘আপনার সঙ্গে আর কে আছে?’

‘একজন পুরোনো চাকর।’

‘কোথায় সে?’

ধরণী মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন, ‘হরিদাস!’

ঘরের ভেতর থেকে আর একটি অতিশয় নিরীহের মতো দেখতে প্রাচীন লোক বেরিয়ে এল।

ইনস্পেকটর তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বললেন, ‘ধরণীবাবু, আপনার বাড়ির ভেতরটা আমরা একবার দেখব।’

‘স্বচ্ছন্দে।’

কিন্তু সেখানেও নতুন কিছু আবিষ্কার করা গেল না। আসবাবপত্তর খুবই কম।

বিমল শুধোলে, ‘আপনার একখানা মোটর—বোট আছে না?’

ধরণী বললেন, ‘আছে। দেখতে চান তো ওইদিকে নদীর ধারে গেলেই দেখতে পাবেন।’

বিমল বললে, ‘না। আজ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। কাল আমরা সারা দ্বীপটা একবার ভালো করে ঘুরে দেখব, আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন?’

‘নিশ্চয়ই করব। কিন্তু আগে থাকতেই বলে রাখছি, এখানে বনজAগল ছাড়া দেখবার কিছুই নেই।’

বিমল তাঁর কাছে গিয়ে খুব চুপিচুপি শুধোলে, ‘বনজAগলের ভেতরে গিয়ে দু—একটা হাতির মতো বড় ডালকুত্তা আর বাঘের মতো বড় বিড়ালও খুঁজে পাওয়া যাবে না?’

ধরণী যেন কিছুই বুঝতে না পেরে বিমলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন!

‘আর তালগাছ সমান উঁচু মানুষ?’

‘আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?’ বলেই ধরণী হা—হা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন। সে অট্টহাস্য বিমল ও কুমার আগেই শুনেছিল—গেলবারে দ্বীপের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে!

 ………. ……….. ……….. ……….

কমল সেদিন রামহরিকে ধরে বসেছিল, তাকে একটা নতুন রান্না খাওয়াতে হবে!

রামহরি যত বলে, ‘সুমুদ্দুরের জলে ডোঙায় বসে কি নতুন রান্না খাওয়ানো চলে ভাই?’

কমল ততই বলে, ‘পাকা রাঁধিয়ে আকাশে উড়েও হাতের বাহাদুরি দেখাতে পারে! রামহরি, তুমি তাহলে কোনও কর্মের নও!’

তার রন্ধন নিপুণতার ওপরে কেউ কৌতুকছলে ঠাট্টা করলেও রামহরি সহ্য করতে পারত না। অতএব সবাই যখন গিয়েছিল দ্বীপে বেড়াতে, রামহরি তখন ছিল নৌকায় বসে মাছ ধরতে ব্যস্ত!

এবং আজ রাত্রে সে যে নতুন রান্না কমল ও আর সবাইকে খাওয়ালে, তার নাম রেখেছিল সে ‘মুখবন্ধ’!

রান্নাটি কমলের এতই ভালো লেগেছিল যে, মনের ভাব আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারলে না!

বিনয়বাবু প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে মস্ত এক বক্তৃতা দিয়ে শেষটা বললেন, ‘এটা কোনদেশি রান্না বিমল?’

বিমল বললে, ‘তা আমি জানি না। তবে বিলিতি মতে একে ‘মাছের রোস্ট’ বলেও ডাকা যায়।’

আহারাদির পর যখন শয়নের ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন কুমার বললে, ‘দ্বীপটা স্বচক্ষে দেখে আমি কিন্তু হতাশ হয়েছি। মনে হচ্ছে, আমাদের খালি কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল!’

বিমল বললে, ‘আমি কিন্তু এখনও হতাশ হইনি! আমি কালকের জন্যে অপেক্ষা করছি। হয়তো নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারব!’

বিনয়বাবু সারাদিন দ্বীপের কথা নিয়ে কোনও মত প্রকাশ করেননি। এখন তিনি হঠাৎ সবাইকে বিস্মিত করে বললেন, ‘দ্বীপে গিয়ে আমি কিন্তু একটা আশ্চর্য আবিষ্কার করেছি।’

কুমার বললে, ‘আপনি! কী আবিষ্কার করেছেন?’

‘ধরণীবাবুর বাংলোর পিছনে আছে একটা জলাভূমির মতো জায়গা! সেখানে ভিজে মাটির ওপরে আমি এমন কতকগুলো পায়ের দাগ দেখেছি, যা মানুষের পায়ের দাগের মতোই, কিন্তু মানুষের পায়ের দাগের চেয়ে বারো—তেরো গুণ বেশি বড়!’

কমল সবিস্ময়ে বললে, ‘কিন্তু আপনি এতক্ষণ তো এ কথা বলেননি!’

বিমল হাসতে—হাসতে বললে, ‘বিনয়বাবু বলেননি, আমিও বলিনি। সে পায়ের দাগগুলো আমিও দেখেছি!’—বলেই সে একখানা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল এবং বিনয়বাবুও তার দৃষ্টান্তের অনুকরণ করলেন!

কুমার ও কমল একবার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে, তারপর যে—যার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

ঠিক সেই সময়েই সকলকার কানে এক অদ্ভুত স্বর জেগে উঠল :

 ‘ঘোঁ—ঘট ঘট, ঘোঁ—ঘট, ঘট, ঘোঁ—ঘট ঘট!

 চলো রে চলো, চটপট চলো, দি চম্পট!’

সকলেই সচমকে ধড়মড় করে আবার উঠে বসল। গতকল্য গভীর রাত্রে নদীর বক্ষে এই অমানুষিক কণ্ঠস্বরই শোনা গিয়েছিল!

সকলেই বোটের ধারে ঝুঁকে পড়ে মুখ বাড়ালে! কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, কিছুই দেখা গেল না এবং কিছুই দেখবার উপায় নেই!

বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমরা মঙ্গল গ্রহেও গিয়েছি, কিন্তু সেখানেও এমন আশ্চর্য কণ্ঠস্বর শুনিনি!’

বিমল টর্চের কল টিপে আলো জ্বেলে বললে, ‘নদীর জল এক জায়গায় খুব তোলপাড় হচ্ছে,—যেন কেউ ওখানে বিরাট দেহ নিয়ে সবে ডুব দিয়েছে। কিন্তু আর কিছুই দেখা যায় না!’

এমন সময়ে খানিক তফাতে ওপর থেকে আবার অন্য একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল ঃ

 ‘কিচিরমিচির কিচিরমিচির কচমচ মচ কচমচ—মচ!

 বুকের কাছে করছে কেমন খচমচ খচ খচ—মচখচ!

 মানুষ—ভূতে কালকে পাবে,

 কলকাতা কি শালকে যাবে,

 কাটবে মগজ চালিয়ে ছুরি কচু—কাটা কচ—কচ—কচ!’

টর্চের আলো শূন্যের অন্ধকার ফুঁড়ে খুঁজে পেলে খালি শূন্যতাই!

কমল উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, ‘বিংশ শতাব্দীতেও তাহলে দৈববাণী হয়?’

কুমার একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘কিন্তু এ দৈববাণীর জন্ম বোধহয় ওই গাছগুলোর ভেতর থেকেই!’

সকলে দেখলে, নদীর জলের ওপরে ঘন শাখাপল্লব নিয়ে একটা মস্ত—বড় গাছ ঝুঁকে পড়েছে এবং তারই ডালপাতাগুলো সশব্দে দুলে—দুলে উঠছে—যেন তার ভেতরে কোনও জীব লুকিয়ে এদিকে—ওদিকে আনাগোনা করছে!

রামহরি বন্দুক নিয়ে বললে, ‘খোকাবাবু, আন্দাজে—আন্দাজে একটা গুলি ছুড়ব নাকি?’

বিমল বললে, ‘না রামহরি, কেউ তো এখনও আমাদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা করেনি। আমরাই বা আগে থাকতে অস্ত্র ব্যবহার করব কেন?’

এমন সময়েই ইস্টিমারের ‘সার্চলাইট’ অন্ধকারের ওপর দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল, সঙ্গে—সঙ্গে নদীর জলের তোলপাড় শব্দ এবং গাছের ডালপালার মড়মড়ানি একেবারে থেমে গেল!

কুমার বললে, ‘এখানে যেসব কবি কবিতা শোনায়, তারা সশরীরে দেখা দিতে রাজি নয় দেখছি!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু কে ওরা? আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, না সাবধান করে দিচ্ছে?’

ইস্টিমার থেকে চেঁচিয়ে ইনস্পেকটর বললেন, ‘এসব কী কাণ্ড মশাই!’

বিমল বললে, ‘যা শুনছেন আর দেখছেন, তা কি গাঁজাখোরের কল্পনা বলে মনে হচ্ছে?’

‘কিন্তু কেউ বোধহয় ভয় দেখাবার জন্যে আমাদের ঠাট্টা করছে! এটা তো আর সত্যযুগ নয় যে, জল আর গাছ কথা কইবে!’

‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঠাট্টা করছে কে?’

‘নিশ্চয় সেই বুড়ো জাদুকরটা! আমি কালই ধরণীকে গ্রেপ্তার করব!’

‘কি অপরাধে? সে তো এখনও আমাদের কোনও অনিষ্ট করেনি!’

‘সরকারি লোকদের ভয় দেখানোর মজাটা তাকে টের পাইয়ে দেব।’

দ্বীপের ভেতর থেকে হা—হা—হা—হা করে কে ভীষণ অট্টহাসি হেসে উঠল! এ সেই হাসি,—যে হাসি সবাই আজই ধরণীর কণ্ঠে শুনে এসেছে, কিন্তু এখন তার চেয়ে ঢের—বেশি তীব্র ও ভীতিপ্রদ!

ইনস্পেকটর খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘সেপাই, সেপাই! সবাই বন্দুক নাও! বোট ভাসাও! আজই আমি বুড়োকে গ্রেপ্তার করব!’

বিমল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, আজ আর গোলমালে কাজ নেই। আজ খালি দেখুন, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়! নইলে সব পণ্ড হবে!’

অট্টহাসি থামল না,—কিন্তু ধীরে—ধীরে দূরে চলে যেতে লাগল!

বিনয়বাবু বললেন, ‘ধরণী পাগল নয়তো?’

অনেক দূর থেকে যথাক্রমে নদীর জলে ও গাছের ওপরে উঠছে সেই আশ্চর্য ঘোঁ—ঘটঘট ও কিচিরমিচির শব্দ!

কুমার বললে, ‘ওই হাসি আর শব্দ দুটো যখন একসঙ্গে হচ্ছে, তখন বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে তিনটে আলাদা—আলাদা জীব আছে!’

বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে এই তৃতীয় জীবটি কে? দ্বীপে গিয়ে আমরা তো কেবল ধরণী আর তার চাকর হরিদাসের দেখা পেয়েছি!’

বিমল ভাবতে—ভাবতে বললে, ‘কুমার, তুমি ঠিক ধরেছ! হ্যাঁ বিনয়বাবু, এই তৃতীয় জীবটি কে, এখন সেইটেই আমাদের আবিষ্কার করতে হবে!’

ক্রমে সমস্ত কণ্ঠস্বর থেমে গেল, নির্জনতা সজাগ হয়ে উঠল এবং রাত্রির অন্ধ স্তব্ধতাকে সংগীতময় করে তুলতে লাগল সাগরসঙ্গমে উচ্ছ্বসিত নদীর কলধ্বনি! সে অশ্রান্ত ধ্বনি যে সুদূর অসীমের স্মৃতিকে কানের কাছে ডেকে আনে! সে ধ্বনি যেন নিকটের যা—কিছুকে সুদূর অসীমতায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়!

বিমল বাঘাকে বোটের বাইরে ঠেলে দিয়ে বললে, ‘যা বাঘা, বাইরে যা! আমরা এখন একটু ঘুমোব, তুই পাহারা দে!’

বাঘা যেন বিমলের কথা বুঝতে পারলে! সে বোটের ধারে গিয়ে কান খাড়া করে বসে রইল!

বোটের তলায় নদীর করাঘাতের শব্দ শুনতে—শুনতে সবাই একে—একে ঘুমিয়ে পড়ল!

এমনকী শেষটা বাঘার চোখও ঘুমে ঢুলে পড়ল!

গভীর নিশীথিনীর কালো শাড়ির আঁচল সরিয়ে বেরিয়ে এল যেন রুগ্ন চাঁদের অত্যন্ত হলদে মুখ! তাকে এই বিজনতার মধ্যে দেখলে ভয় হয়, চিতার পাশে খাটে—শোয়ানো মড়ার মুখ মনে পড়ে যায়।

আচম্বিতে বাঘা ভয়ানক জোরে চেঁচিয়ে উঠল এবং কমল জেগে ধড়মড় করে উঠে বসল!

কমলের মনে হল, সে বোটের ভেতরে আছে বটে, কিন্তু বোট যেন আর নদীগর্ভে নেই! কী অদ্ভুত অনুভূতি!

হঠাৎ বাঘা ভয় পেয়ে বোটের ওপর থেকে লাফ মারলে! অনেক উঁচু থেকে জলে লাফিয়ে পড়লে যেরকম শব্দ হয়, সেইরকম একটা শব্দ হল!

ইতিমধ্যে আর সকলেও জেগে উঠল! তাদেরও মনে হল, তারাও যেন কারুর মাথার ওপরে ঝাঁকার ভেতরে মোরগের পালের মতো বসে রয়েছে!

বিমল তাড়াতাড়ি কামরার বাইরে মুখ বাড়িয়ে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে বিস্মিত চোখে দেখলে, তারা দ্বীপের গাছের সারের চেয়েও আরও ওপরে উঠেছে এবং অনেক নীচে আলো—আঁধারির মধ্যে চিকচিক করছে নদীর জল!

একটা নিশ্বাস ফেলে, কঠিন হাস্য করে বিমল বললে, ‘বোধহয় সেই কুম্ভকর্ণই বোটশুদ্ধ আমাদের মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে!’