দশম পরিচ্ছেদ। মানুষ—’মনুমেন্ট’
সেই রুগ্ন চাঁদের হলদে মুখ! মিটমিটে আলোতে পৃথিবীর কিছুই ভালো করে নজরে পড়ে না! বিমল বোটের তলায় উঁকিঝুঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে কিন্তু কিছুই দেখতে পেলে না। বোটের তলায় রয়েছে কেবলই অন্ধকার—কষ্টিপাথরের মতো কালো আর নিরেট!
বোটের ভেতরে আর সবাই তখন নির্বাক ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বসে আছে, বোধহয় তাদের মাথার ভেতরে তখনও বিমলের সেই অসম্ভব কথাগুলোই বারংবার ঘোরাফেরা করছে—’সেই কুম্ভকর্ণই বোটশুদ্ধ আমাদের মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে!’
বোটের নীচের দিকটা দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বিমল আবার বললে, ‘না, আর কোনও সন্দেহ নেই! কুম্ভকর্ণই আজ ঝাঁকামুটে হয়েছে! তার ঝাঁকা হয়েছে এই বোট, আর বোটের মধ্যে আছি আমরা!’
বিনয়বাবুর মুখে অস্ফুট স্বরে শোনা গেল, ‘অসম্ভব!’
বিমল শুকনো হাসি হেসে বললে, ‘হ্যাঁ, অসম্ভবই বটে! কিন্তু অসম্ভবের দেশে অসম্ভবও সম্ভব হয়। জলে সাঁতার কাটা যার একমাত্র কর্তব্য, সেই বোট পাখিও নয়, এরোপ্লেনও নয় যে শূন্য দিয়ে উড়ে যাবে! বিনয়বাবু, চেয়ে দেখুন—নদীর জল এখন কত দূরে!’
সকলে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখলে, নদীর জলে আলোর ঝিকিমিকি বহু দূরে সরে গিয়েছে এবং ক্রমে আরও দূরে সরে যাচ্ছে! জলতরঙ্গের কলকল্লোলও আর শোনা যায় না!
বিমল বললে, ‘আমাদের মাথায় নিয়ে কালাপাহাড় এখন জমির ওপর দিয়ে হাঁটছে!’
বিনয়বাবু উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছে সে?’
‘এর উত্তর সেইই জানে। কলকাতায় ঝাঁকায় চড়ে রামপাখিরা আসে আমাদের জন্যে। এখানে ঝাঁকায় চড়ে আমরা যাচ্ছি হয়তো ধরণীর বাসায়!’
এতক্ষণে রামহরির হুঁশ হল। সে হাউমাউ করে বলে উঠল, ‘ও খোকাবাবু! ওই ধরণী কি পিশাচ? আমাদের কেটে খানা খাবে নাকি?’
কুমার বলে উঠল, ‘বন্দুক নাও বিমল! বোটের তলার দিকে গুলি—বৃষ্টি করো!’
বোটের তলায় কে আছে, ভগবানই জানেন! কিন্তু যে—জীবই থাকুক, সে যে কুমারের কথা শুনতে পেলে ও বুঝতে পারলে, তৎক্ষণাৎ তার প্রমাণ পাওয়া গেল। কারণ কুমারের মুখের কথা শেষ হতে—না—হতেই বোটখানা ধরে কে এমন ঘনঘন বিষম ঝাঁকুনি দিতে লাগল যে সকলেই তার ভেতরে চারিদিকে ছিটকে পড়ল! সে ভয়ানক ঝাঁকুনি আর থামে না—সকলেরই অবস্থা হল কুলোর মধ্যে ফুটকড়াইয়ের মতো, গতর গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার জোগাড় আর কি! ঝাঁকুনি যখন থামল, বোটের ভেতরে সবাই তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে!
…………. ………….. ……………….. ………………
একে—একে যখন তাদের আবার জ্ঞান হল, তখন রাত কি দিন প্রথেমে তা বোঝা গেল না! চারিদিকে না—আলো না—অন্ধকার,—সন্ধ্যার মুখেই পৃথিবীকে দেখতে হয় এইরকম আবছায়া মায়া—মাখা রহস্যময়!
সামনেই দেখা যাচ্ছে একটা দরজার মতো, বিমলের চোখ সেই ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে বাইরে বেরিযে গেল—কিন্তু সেখানেও আলো খুব স্পষ্ট নয়।
বিমল ওঠবার চেষ্টা করলে, পারলে না! তার সর্বাঙ্গ দড়ি দিয়ে বাঁধা!
কুমার বললে, ‘বন্ধু, আমরা বন্দি!’
বিমল বললে, ‘হুঁ। কিন্তু কার বন্দি—ধরণীর না কুম্ভকর্ণের!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘বোধহয় ধরণীর। বিমল, ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারবে,আমরা একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি হয়ে আছি। এর দরজাটা সাধারণ মানুষ ঢোকবারই উপযোগী, এর ভেতর দিয়ে তোমাদের ওই কুম্ভকর্ণ কিছুতেই দেহ গলাতে পারবে না। সুতরাং যে আমাদের এ ঘরে এনে রেখেছে তার দেহ তোমার—আমার চেয়ে বড় হতে পারে না।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু আমরা কোথায় আছি? বাহির থেকে গাছপালার আওয়াজ আসছে—একটা কাকও কা—কা করছে! মনে হচ্ছে এখন দিনের বেলা! কিন্তু আলো এত কম কেন?’
কমল বললে, ‘বাইরে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানে আলো আসছে যেন ওপর থেকেই, আমরা বোধহয় কোনও উঠানওয়ালা বাড়ির একতলার ঘরে বন্দি হয়ে আছি।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু দ্বীপে এমন কোনও উঁচু বাড়ি থাকলে কালকেই আমাদের নজরে পড়ত। বিনয়বাবু, আমরা বোধহয় জমির নীচে কোনও পাতালপুরীতে বন্দি হয়েছি!’
হঠাৎ রামহরি আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘ওই! আবার সেই শব্দভূত!’
সকলে কান পেতে শুনলে, বাইরে আবার কোথায় সেই পরিচিত কিচিরমিচির কিচিরমিচির শব্দ হচ্ছে—সঙ্গে—সঙ্গে ডাল—পাতা নড়ে ওঠারও শব্দ, কে যেন গাছের এ—ডাল থেকে ও—ডালে লাফালাফি করছে।
তারপরেই সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে শোনা গেল—
‘নেইকো হেথায় রম্ভা—টম্ভা—
আছে অষ্টরম্ভা,
লম্বা লম্বা লম্ফ মেরে
জলদি দে রে লম্বা!
হুমড়োমুখো ধুমড়ো বিড়াল,
আকাশমুখো শৈত্য!
মুখ বাড়িয়ে কুত্তা ধরে
বটের ডালের পক্ষী,
পালাও ভায়া! কেমন করে
সইবে এ—সব ঝক্কি !’
বিমল অভিভূত স্বরে বললে, ‘সেই কণ্ঠস্বর! আবার আমাদের সাবধান করে দিচ্ছে!’
কুমার বললে, ‘অতিকায় বিড়াল, কুকুর, দৈত্য—সকলকার কথাই ও বলছে! কে ও বিমল, অমন করে লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে—সঙ্গে থাকে কেন, বিপদের আগেই সাবধান করে দেয় কেন, আর কবিতাতেই বা কথা কয় কেন?’
বিমল বললে, ‘আর একটা কণ্ঠস্বরও আমরা শুনেছি—নদীর জলে সেই ভীষণ অমানুষিক কণ্ঠস্বর! এখানে জল নেই বলেই বোধহয় সে গলার আওয়াজটা আর শোনা যাচ্ছে না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘চুপ—চুপ, ওই শোনো!’
আবার শব্দ হতে লাগল—কিচিরমিচির! আবার গাছের ডালে—ডালে লাফালাফির শব্দ! কিচিরমিচির শব্দ আরও কাছে এগিয়ে এল। তারপর শোনা গেল, অত্যন্ত দুঃখে যাতনায় যেন ভেঙে পড়ে কাঁদতে—কাঁদতে কে বলছে—
অনেক দিনের রূপকথা ভাই,
বহুকালের গল্প,—
ছিলাম যেন মাটির মানুষ,
সুখ ছিল না অল্প!
রাঙা—রাঙা খোকা—খুকি
খেলত আমার বক্ষে,
টুকটুকে মোর বউটি সদাই
হাসত মুখে—চক্ষে!
আজ অদৃষ্ট শক্ত করে
আমায় যখন বাঁধছে—
হায়রে তারা কোথায় বসে
আমার তরেই কাঁদছে!’
হঠাৎ একটা নতুন কণ্ঠে উচ্চস্বরে শোনা গেল, ‘হা হা, হা, হা! কি হে কবি, এখনও কবিতা ভোলোনি! হা—হা—হা—হা!’ এ ধরণীর হাসি!
কবিতা আর শোনা গেল না! খালি গাছের ডাল—পাতার শব্দ হল! তারপরেই আর এক শব্দ! কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে! বিমল ও কুমার পরস্পরের মুখের পানে তাকিয়ে দেখলে। দরজার কাছটা অন্ধকার করে একটা মূর্তি এসে দাঁড়াল—ধরণী!
খানিকক্ষণ সেইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ধরণী ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে। তারপর সহাস্যে বললে, ‘এই যে বন্ধুগণ! ধরণীর শ্রেষ্ঠ শয্যা ভূমিশয্যায় শুয়ে আছ, আশা করি বিশেষ কোনও কষ্ট হচ্ছে না?’ কেউ কোনও জবাব দিলে না। ধরণী তেমনি হাসতে—হাসতে বললে, ‘হাতির মতো বড় ডালকুত্তা দেখতে চেয়েছিলে, শীঘ্রই তাকে দেখতে পাবে! আর বাঘের মতো বড় বিড়ালকে তো তোমরা নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছ! আর তালগাছের মতন উঁচু মানুষকে কাল অন্ধকারে তোমরা ভালো করে দেখতে পাওনি—নয়?’
বিমল বললে, ‘কে সে?’
ধরণী বললে, ‘দেখছি এখনও তোমার কৌতূহল দূর হয়নি! সে কে জানো, আমার চাকর হরিদাসকে কাল দেখেছ তো? সে তার ছোট ভাই রামদাস—তোমরা যার নাম রেখেছ কুম্ভকর্ণ!’
বিমল সবিস্ময়ে থেমে—থেমে বললে, ‘হরিদাসের ছোট ভাই রামদাস!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুম্ভকর্ণ নয়, আর কেউ নয়, হরিদাসের ছোট ভাই রামদাস! ভাবছ, কেমন করে রামদাস এত বড় হল? হা, হা, হা, হা!’ তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে অত্যন্ত কঠোর ও গম্ভীর স্বরে ধরণী বললে, ‘কেন তোমরা আমাকে জ্বালাতন করবার জন্যে এখানে এসেছ? মূর্খ মানুষদের মুখ বন্ধ রাখবার জন্যে আমি এতদূরে পৃথিবীর একপ্রান্তে এসে অজ্ঞাতবাস করছি, কিন্তু এখানেও তোমাদের মূর্খতা আর অন্যায় কৌতূহল থেকে মুক্তি নেই? যত—সব তুচ্ছ জীব, কতটুকু শক্তি তোমাদের? এসেছ আমার সাধনায় বাধা দিতে? জানো, আমি একটা আঙুল নাড়লে তোমরা এখনি ধুলোয় মিশিয়ে যাবে?’—ধরণী জ্বলন্ত চক্ষে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল অতিশয় উত্তেজিত ভাবে!
বিনয়বাবু শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ধরণীবাবু, আমাদের আপনার শত্রু বলেই বা ধরে নিচ্ছেন কেন? আমরা তো আপনার সঙ্গে শত্রুতা করবার জন্যে এখানে আসিনি, আমরা এসেছি শুধু এখানকার অদ্ভুত ঘটনাগুলো স্বচক্ষে দেখবার জন্যে!’
ধরণী আরও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে আরও বেশি চেঁচিয়ে বললে, ‘দেখবার জন্যে, না মরবার জন্যে? তোমরা আমার বিড়ালকে হত্যা করেছ, তোমাদের আমি ক্ষমা করব না!’
বিমল বললে, ‘আপনার বিড়ালকে মেরেছি একলা আমি! আমার অপরাধে ওঁরা কেন শাস্তি পাবেন? ওঁদের ছেড়ে দিন!’
‘ছেড়ে দেব? হা—হা—হা—হা! ছেড়ে দেবই বটে! ওদের ছেড়ে দি, আর ওরা দেশে গিয়ে সারা পৃথিবীর লোককে নিয়ে আবার এখানে ফিরে আসুক! সবাই আমার গুপ্তকথা জানুক! জানো বাপু, যে আমার গুপ্তকথা জেনেছে তার আর মুক্তি নেই!’
‘আপনার কি গুপ্তকথা আমরা জানতে পেরেছি?’
‘কিছু—কিছু জানতে পেরেছ বইকী! আসল কথা এখনও জানতে পারোনি বটে, তবে তোমাদের কাছে তা বলতে এখন আমার আর আপত্তিও নেই! তোমরা তো আর দেশে ফিরে যাবে না।’
ঘরের কোণে একটা টুল ছিল, ধরণী তার ওপরে গিয়ে বসল! তারপর বলতে লাগল, ‘এই নির্জনে একলা বসে আমি সাধনা করি। কি সাধনা করি জানো! পুরাতন পৃথিবীকে নতুন রূপ, নতুন শক্তি দেওয়ার সাধনা! মানুষ বড় ছোট্ট, বড় দুর্বল জীব। তার মস্তিষ্ক অন্য সব জীবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু দেহ হিসাবে তার চেয়ে বৃহৎ আর বলবান প্রাণী আছে অনেক। কাজেই মানুষকে কি করে আরও বড় ও শক্তিমান করে তোলা যায় প্রথমে সেইটেই হল আমার ধ্যান—ধারণা। কেমন করে সে ধ্যান—ধারণা সফল হল, তোমাদের কাছে সে—কথা খুঁটিয়ে—খুঁটিয়ে বলে লাভ নেই। কারণ সাধারণ মানুষের গোবর—ভরা মাথায় তা ঢুকবে না! তবে সামান্য দু—একটা ইঙ্গিত দিচ্ছি শোনো। Glands বা গ্রন্থিদের নাম শুনেছ তো? এই গ্রন্থিদের রসেই মানুষের দেহ টিকে থাকে। গুটি—পাঁচেক গ্রন্থি দেহের ভেতরে রস—সঞ্চার করে; আর তাদের মধ্যে প্রধান তিনটি গ্রন্থির নাম হচ্ছে Thyroid, Adrenal ও Pituitary। প্রথমটির অবস্থান মানুষের কণ্ঠে, দ্বিতীয়টির মূত্রাশয়ে আর তৃতীয়টির মস্তিষ্কে। এইসব গ্রন্থির হের—ফেরে মানুষের দেহের অদল—বদল হয়। ধরো Thyroid গ্রন্থির কথা। যে—শিশুর দেহে এই গ্রন্থি বিকৃত অবস্থায় থাকে—’
বিনয়বাবু ধরণীর মুখের কথা কেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তার মস্তিষ্ক আর কঙ্কালের বাড় বন্ধ হয়ে যায়। ত্রিশ বছর বয়সেও তার দেহ আর বুদ্ধি হয় খোকারই মতন। আমি এ সব জানি ধরণীবাবু! আবার Pituitary গ্রন্থি অতিরিক্ত রস ঢাললে মানুষের দেহের বাড়ও অতিরিক্ত রকম হয়ে ওঠে—কেউ হয় আশ্চর্য রকম মোটা; আবার কেউ বা হয় আট—দশ ফুট লম্বা! গ্রন্থি নিয়ে মিছিমিছি লেকচার না দিয়ে আপনি কাজের কথা বলুন,—যতটা ভাবছেন আমরা ততটা মূর্খ নই!’
ধরণী একটু থতোমতো খেয়ে অল্পক্ষণ বিনয়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, ‘তাহলে তোমাদের ঘটে একটু—আধটু বুদ্ধি আছে দেখছি! তবে আমার পরীক্ষার আসল পদ্ধতিটা তোমাদের কাছে আর খুলে বলা হবে না! যদিও ওই দেহ নিয়ে তোমরা আর এ—ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, তবু সাবধানের মার নেই!’
কুমার বললে, ‘দেহ নিয়ে বাইরে বেরুতে পারব না! তার মানে?’
ধরণী হেসে উঠে বললে, ‘মানে? মানে নিশ্চয়ই একটা আছে! হ্যাঁ, শীঘ্রই তোমাদের চেতনা থাকবে বটে, কিন্তু তোমাদের দেহগুলো পঞ্চভূতে মিশিয়ে যাবে!’
সকলে মহা বিস্ময়ে এই ধোঁধার কথা ভাবতে লাগল! চেতনা থাকবে, কিন্তু দেহ থাকবে না? আশ্চর্য! ভয়ানকও বটে!
ধরণী বললে, ‘তারপর শোনো। আমার পরীক্ষা—পদ্ধতির কথা আর বলব না বটে, কিন্তু পরীক্ষার ফলের কথা তোমাদের কাছে বলতে ক্ষতি নেই। আমি এমন সব বিশেষ ঔষধ বা খাবার আবিষ্কার করেছি, দ্রব্যগুণে যা গ্রন্থিদের রস উৎপাদনের ক্ষমতা কল্পনাতীতরূপে বাড়িয়ে তোলে। ওই আবিষ্কারের দৌলতে আমি এখন মানব—দানব সৃষ্টি করতে পারি!’
বিমল বললে, ‘যেমন হরিদাসের ভাই রামদাস?’
‘হ্যাঁ। রামদাস জন্মাবার পর থেকেই মানুষ হয়েছে আমার আবিষ্কৃত খাবার খেয়ে। সে যখন তিনমাসের শিশু, তখনি তার দেহ লম্বায় হয়ে উঠেছিল তিন ফুট! তার অতি বাড় দেখে পাড়ার লোক এমন কৌতূহলী হয়ে উঠল যে, আমাকে এই নির্জন দ্বীপে পালিয়ে আসতে হল! কেবল রামদাস নয়, একটা বিড়াল ও একটু কুকুরকেও আমি আমার খাবার খাইয়ে বাঘ আর হাতির মতো বড় করে তুলেছি। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আদিম যুগের হাতি, বাঘ, সিংহ আর ষাঁড়রা এখনকার চেয়ে ঢের বড় হত কেন? কোমোডোর গোসাপরা এখনও বড়—বড় কুমিরেরও চেয়ে মস্ত হয় কেন? কেবল ওই গ্রন্থির অতিরিক্ত রসের মহিমায়! এদিকে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন সুদিনের অপেক্ষায় বসে আছি।’
বিনয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিসের সুদিন?’
ধরণী বিকট উল্লাসে চিৎকার করে বললে, ‘আমি এই ক্ষুদ্র দুর্বল মানুষের পৃথিবী জয় করব! আর বছর—বারো পরে আমার দানব—বাহিনী নিয়ে তোমাদের মতো জ্যান্ত পুতুলের খেলাঘর আক্রমণ করব, ধীরে—ধীরে একালের সমস্ত মানুষ—জাতিকে লুপ্ত করে দিয়ে দুনিয়ার সর্বশক্তিমান সম্রাট হয়ে নতুন এক মহামানবের পৃথিবী গড়ে তুলব! সে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ হবে প্রায় কলকাতার মনুমেন্টের মতন উঁচু, আর প্রত্যেক বাড়ি হবে মিশরের পিরামিডের মতন উঁচু, আর সেখানকার বড়—বড় অট্টালিকা উঁচু হবে দার্জিলিং পাহাড়ের সমান! আমার তৈরি মানুষরা তিন—চারবার পা ফেলে হেঁটেই গঙ্গা আর পদ্মা নদী পার হয়ে যাবে! আমার রামদাস তো এখনও বালক, মাথায় সে আরও কত উঁচু হবে আমিই তা জানি না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘পৃথিবীর মানুষ যত ছোট আর দুর্বলই হোক, আপনার ওই রামদাসের মতন একটিমাত্র দানবকে বধ করবার শক্তি তাদের আছে!’
‘একটিমাত্র দানব? মোটেই নয়, মোটেই নয়! আর এক দ্বীপে আমি আমার শিশু দানবদের লুকিয়ে পালন করেছি! সেই দ্বীপ থেকে এখানে আসবার সময়েই তো আমার বিড়াল—বাচ্চাকে হতভাগা মাঝি—মাল্লারা জলে ফেলে দিয়েছিল! না জানি সে বাচ্চাটা আরও কত বড় হতে পারত! তাকেই তোমরা হত্যা করেছ, তোমাদের ও—অপরাধ আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না।’
বিমল একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, ‘দানব রহস্য তো বুঝলুম, কিন্তু ছড়া কাটে কারা?’
প্রশ্ন শুনেই ধরণী ও—হো—হো—হা—হা—হা করে হেসে যেন গড়িয়ে পড়ল! তারপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললে, ‘ছড়া কাটে কারা? ছড়া কাটে কারা? এখনও তাদের দেখতে পাওনি বুঝি? তারা হচ্ছে বাংলাদেশের মাসিকপত্রের দু’জন কবি!’
বিমল সবিস্ময়ে বললে, ‘কবি!’
‘হ্যাঁ। তারা এমনি যাচ্ছেতাই কবিতা লিখত যে, বাংলা মাসিকপত্রগুলো অপাঠ্য হয়ে উঠেছিল! কত সমালোচক তাদের গালাগাল দিয়েছে, কিন্তু তাদের ভয়ঙ্কর কবিতা লেখার উৎসাহ একটুও কমাতে পারেনি! বাধ্য হয়ে আমি তাদের এখানে এনে ধরে রেখেছি—অবশ্য তাদের দেহকে নয়, তাদের মস্তিষ্ককে!’—
‘সে আবার কী?’
‘তোমরা কি এখনকার ইউরোপীয় অস্ত্র—চিকিৎসকদের বাহাদুরির কথা শোনোনি? বাঁদরের দেহের গ্রন্থি কেটে তারা মানুষের দেহের ভেতরে বসিয়ে দিচ্ছে! একজন মানুষের হৃৎপিণ্ড খারাপ হয়ে গেলে কেটে বাদ দিয়ে, তার জায়গায় কোনও সদ্য মৃত মানুষের হৃৎপিণ্ড তুলে বসিয়ে দিচ্ছে। আমি নিজেও ডাক্তারি পাশ করেছি। তাই এসব বিষয় নিয়েও পরীক্ষা করি। মানুষের মস্তিষ্ক জন্তুর মাথায় চালান করলে কি ব্যাপার হয় সেটা দেখবার জন্যে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। তাই একদিন ওই দুই নাছোড়বান্দা দুষ্ট কবিকে ধরে এনে কি করলুম জানো? করলুম ছোটখাটো একটা অস্ত্রোপচার! একটা কুমির আর একটা হনুমান ধরলুম, তারপর তাদের জানোয়ারি মস্তিষ্ক কেটে বাদ দিয়ে দুই কবির মস্তিষ্ক কেটে নিয়ে বসিয়ে দিলুম! কিন্তু হতভাগা কবির মস্তিষ্ক! কুমির আর হনুমানের দেহে ঢুকেও কবিতা রচনা করতে ভোলে না! করুক তারা এই অরণ্যে রোদন! কিন্তু বাংলা মাসিকের পাঠকরা আজ বেঁচে গিয়েছে।’ (পশুর মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক চালান করবার এই অদ্ভুত কল্পনার জন্যে আমি এক বিলাতি লেখকের কাছে ঋণী। ইতি—লেখক)
এই ভীষণ কথা যারা শুনলে তাদের মনের ভেতরটা তখন কেমন করছিল, তা জানেন কেবল অন্তর্যামীই! ধরণী আবার অট্টহাস্য করে বললে, ‘তোমরাও বেশি ভয় পেও না, তোমাদেরও আমি একেবারে মেরে ফেলব না! তোমাদের দেহগুলো নষ্ট হবে বটে, কিন্তু তোমাদের মস্তিষ্ক বেঁচে থাকবে পশুদের মাথার ভেতরে গিয়ে। তবে কোন পশুকে কার মস্তিষ্ক দান করব, সেটা এখনও স্থির করে উঠতে পারিনি! আজ রাত্রেই একটা কোনও ব্যবস্থা করতে পারব বলে বোধ হচ্ছে! হা—হা—হা—হা!’
কুমার গর্জন করে বললে, ‘পিশাচ! দুরাত্মা! মনে করছিস আমাদের হত্যা করে তুই নিস্তার পাবি? ইস্টিমারে আমাদের বন্ধুরা আছে তারা তোকে ক্ষমা করবে না!’
বিমল শান্তভাবেই বললে,’ধরণীবাবু, এখনও আমাদের ছেড়ে দিন, নইলে আপনাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে!’
অট্টহাসি হাসতে—হাসতে ধরণী বললে, ‘তোমরা হাসালে দেখছি! আমরা এখন কোথায় আছি জানো? পাতালে! এই পাতালে ঢোকবার পথ এমন গভীর জঙ্গলে ঢাকা আছে, আজ সারাদিন ধরে খুঁজলেও ইস্টিমারের লোকেরা কোনও সন্ধান পাবে না! আজ রাত্রেও যদি ইস্টিমার দ্বীপের কাছে থাকে, তাহলে অন্ধকারে গা ঢেকে রামদাস গিয়ে সেখানাকে জলে ডুবিয়ে দিয়ে আসবে! সুতরাং, বুঝতেই পারছ, মনুষ্য—দেহ ত্যাগ করবার জন্যে তোমরা এখন প্রস্তুত হও! হা—হা—হা!’ হাসতে—হাসতেই ধরণী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল!
রামহরি হঠাৎ গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল! বিমল হেসে বললে, ‘থামো রামহরি, থামো! অমন শেয়ালের মতো চ্যাঁচালে ধরণী এখনি এসে তোমার মগজ কেটে নিয়ে হয়তো শেয়ালেরই মাথায় ঢুকিয়ে দেবে!’
বিনয়বাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘না, ঠাট্টা নয় বিমল! যা শুনলুম তা আমাদের পক্ষেও ভয়াবহ, সমস্ত মানুষ—জাতির পক্ষেও ভয়াবহ! এখন কিসে প্রাণ বাঁচে, ভালো করে সেটা ভেবে দেখা দরকার!’
বিমল অবহেলা—ভরে বললে, ‘আর মিথ্যা ভাবনা! আছি পাতালপুরীতে—বাইরে রামদাসের পাহারা! আমাদের হাত—পা এমন ভাবে বাঁধা যে, নড়বার ক্ষমতাও নেই! বিনয়বাবু, বাঁচবার ভাবনা মিথ্যা!’
একাদশ পরিচ্ছেদ। বাঘা কি করলে
খানিকক্ষণ কেউই কথা কইবার ভাষা খুঁজে পেলে না।
পাতালপুরীর গর্ভে যেটুকু রোদ এসে পড়েছিল, সেও যেন ভয়ে—ভয়ে ধীরে—ধীরে সরে যাচ্ছে—ঘরের ভেতরে দিনের বেলাতেই সন্ধ্যার আভাস ফুটে উঠছে!
বাহির থেকে মাঝে—মাঝে গাছপালার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনও শব্দই ভেসে আসছে না!
কুমার বললে, ‘পৃথিবী আর মঙ্গল গ্রহ জয় করেও শেষটা কি তাহলে ওই বুড়ো ধরণীর হাতে আমাদের হার মানতে হবে?’
বিমল বললে, ‘উপায় কী? মরতে তো হবেই একদিন। আজ না—হয় ধরণীই হবে আমাদের যমদূত! জীবনের প্রবল আনন্দ আমরা দুই হাতে লুণ্ঠন করে নিয়েছি—সাধারণ মানুষের দশ জন্মের যৌবন আমাদের এক জন্মের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, তোমার আর কি অভিযোগ থাকতে পারে কুমার? এই অতিরিক্ত জীবনের বন্যা আমার যৌবনকে শ্রান্ত করে তুলেছে, আমি এখন ঘুমোতে পেলে দুঃখিত হব না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু এ তো চিরনিদ্রা নয় বিমল, এ যে জীবন্ত মৃত্যু! আমাদের মস্তিষ্ক নিয়ে ধরণী কি করতে চায় শুনলে তো!’
বিমল চিন্তিত মুখে বললে, ‘হ্যাঁ, ওই কথা ভেবেই মাঝে—মাঝে মন আমার বিদ্রোহী হয়ে উঠছে! মানুষের দেহ থাকবে না, কিন্তু মানুষের প্রাণ থাকবে—কিন্তু সে প্রাণের মূল্য কী? কারণ এক হিসাবে মস্তিষ্কই হচ্ছে মানুষের প্রাণ! কিন্তু বিনয়বাবু, এও কি সম্ভব?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আজীবন বিজ্ঞানচর্চা করছি, কিন্তু এমন উদ্ভট কল্পনার কথা কখনও মনেও আসেনি! এ কল্পনায় যুক্তি আছে বটে, কিন্তু সে যেন রূপকথার যুক্তি!’
কমল বললে, ‘আমাদের মধ্যে বাঘাই সুখী! রামদাস আমাদের বোট ঘাড়ে করতে—না—করতেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে গেছে!’
রামহরি কাঁদো—কাঁদো গলায় বললে, ‘আহা, সে কি আর বেঁচে আছে?’
কুমার বললে, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। শত বিপদেও বাঘা কখনও আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি। বেঁচে থাকলে নিশ্চয় সে রামদাসের পিছনে পিছনেই আসত।’
………. ………. ………. ……….
………. ……….
বাঘার কি হল সেটা আমাদের দেখা দরকার। বিমল ও কুমারের সমস্ত ইতিহাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই জানেন, বাঘা সাধারণ কুকুর নয়। পশুর মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে ধরণী নতুন পরীক্ষা করতে চায়, কিন্তু পশুর মস্তিষ্কে যে খানিকটা মানুষি বুদ্ধি থাকতে পারে, অনেক কুকুরই অনেকবার তার জ্বলন্ত প্রমাণ দিয়েছে। বাঘাও হচ্ছে সেই জাতীয় কুকুর।
হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই বাঘা যখন দেখলে, জলের নৌকো আকাশে উড়ছে, তখন তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এমন অস্বাভাবিক কাণ্ড কোন কুকুর কবে দেখেছে? ভয়ে তার আর দিগবিদিক জ্ঞান রইল না, বিকট চিৎকার করে এক লাফে সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
জলে পড়ে সাঁতার কাটতে—কাটতে সে দেখলে খানিক তফাতেই একটা তালগাছ সমান উঁচু ছায়ামূর্তি কোমর—জল ভেঙে ডাঙার দিকে অগ্রসর হচ্ছে!
কিন্তু সেই দানবমূর্তি দেখেও বাঘা বিশেষ বিস্মিত হল না। কারণ বিমল ও কুমারের সঙ্গে গিয়ে ‘হিমালয়ের ভয়ঙ্কর’—দেরও সে দেখে এসেছে, তার চক্ষে দানব—মূর্তি এখন আর অস্বাভাবিক নয়! সে খালি এইটুকুই বুঝে নিলে যে, ওই দানবের কাছ থেকে যত তফাতে থাকা যায় ততই ভালো।
এমন সময়ে আর একদিকে তার নজর পড়ল। জলের ওপরে আবছা আলোর ভেতরে যেন খানিকটা নিরেট অন্ধকার জমাট হয়ে আছে! খালি তাই নয়, অন্ধকারের এক জায়গায় যেন দু—টুকরো আগুনের মতো কি জ্বল—জ্বল করছে।
সে অন্ধকার আর কিছুই নয়, মস্ত—বড় একটা কুমির।
এই জলচর জীবটিও বাঘার চোখে নতুন নয়! জলে এর সঙ্গে লড়াই হলে তারই যে সমধিক বিপদের সম্ভাবনা এটাও সে বুঝতে পারলে।
কুমির হঠাৎ বললে, ঘোঁ—ঘট—ঘট ঘোঁ—ঘট—ঘট, ঘোঁ—ঘট—ঘট! দে চম্পট দে চম্পট দে চম্পট!
হতভম্ব বাঘার দুই কান খাড়া হয়ে উঠল! সে মানুষের ভাষায় কথা কইতে পারে না বটে, কিন্তু শুনলে মানুষের ভাষা বুঝতে পারে। এই কুমিরটার কথা যে মানুষের কথার মতন শোনাচ্ছে!
কিন্তু এ—সব কথা নিয়ে এখন সময় নষ্ট করবার সময় নেই। সে নিজের দেহ দিয়ে কোনও ক্ষুধার্ত জলচরের উপবাসভঙ্গ করতে মোটেই রাজি নয়! অতএব বাঘা তাড়াতাড়ি সাঁতার কেটে অনেক দূরে চলে গেল।
কিন্তু কুমিরটা তাকে একবারও আক্রমণ করবার চেষ্টা করলে না।
বাঘা তখন আবার ডাঙার দিকে ফিরল। তখন আবার সেই ছায়া—দানবের কথা তার মনে পড়ল। কিন্তু কোথায় গেল সে? কোনওদিকেই তাকিয়ে বাঘা তাকে আবিষ্কার করতে পারলে না।
বোট যে কেন আকাশে উড়েছিল, সে এখন তা বুঝতে পেরেছে। দানবের মাথায় বোটের ভেতরেই যে তার মনিবরা আছেন, এও সে জানে। এখন সে অনায়াসেই পুলিশের ইস্টিমারে উঠে নিজে নিরাপদ হতে পারত, কিন্তু সে কথা একবারও তার মনে হল না। বাঘা যে—জাতের জীব, সে—জাত প্রাণের চেয়েও বড় মনে করে মনিবকে। অতএব সে সাঁতার কেটে ডাঙায় গিয়ে উঠল—কারণ তার দৃঢ়বিশ্বাস হল যে, মনিবরা দানবের মাথায় চড়ে ওই দ্বীপেই গিয়েছেন!
কিন্তু দ্বীপে উঠে হল আর এক মুশকিল। দানবটা কোনদিকে গিয়েছে? চারদিকেই গভীর জঙ্গল, কোনদিকে যাওয়া উচিত?
মানুষ হলে বাঘাকে এখন হতাশ হতে হত। কিন্তু সে হচ্ছে কুকুর, তার তীক্ষ্ন ঘ্রাণশক্তি আছে, তাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। রামদাস যখন বোট শূন্যে তুলেছিল, তখনি তার গায়ের বিশেষ গন্ধ বাঘার নাকে এসেছিল। সে এখন চারিদিকের মাটি শুঁকে—শুঁকে রামদাসের গায়ের গন্ধ আবিষ্কারের চেষ্টায় লেগে গেল।
ভোর হল। সূর্য উঠল। গাছের মাথায়—মাথায় রোদের আলপনা। বাঘা তখনও ব্যস্ত হয়ে মাটি শুঁকে—শুঁকে বেড়াচ্ছে!
আরও কতক্ষণ পরে এক জায়গায় বড়—বড় কয়েকটা পায়ের দাগ দেখা গেল। সেইখানে নাক বাড়িয়েই বাঘা আনন্দে অস্ফুটকণ্ঠে ডেকে উঠল! এতক্ষণে সেই গন্ধ পাওয়া গেছে!
আর কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না! মহা খুশি হয়ে ল্যাজ নাড়তে—নাড়তে বাঘা মাটিতে নাক রেখে অগ্রসর হল।
কখনও খোলা জমির ওপর দিয়ে এবং কখনও ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অনেকক্ষণ পথ চলে বাঘা শেষটা এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে একটা শুকনো গাছের গুঁড়ির পাশে তাদের সেই মোটরবোটখানা কাত হয়ে পড়ে আছে!
বাঘা দৌড়ে গিয়ে বোটে উঠল। কামরার ভেতরে ঢুকল। সেখানে তার মনিবদের জিনিসপত্তর ও বন্দুকগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তার মনিবরা কোথায়?
কামরা থেকে বেরিয়ে এসে বাঘা দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে ভাবছে, এমন সময়ে হঠাৎ একটা দাড়িওয়ালা লোক ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে ওপরে উঠে এল!
এ—লোকটাকে বাঘা আগেও দেখেছে এবং তার কুকুর—বুদ্ধি বললে, এ তাদের বন্ধুলোক নয়। সে চটপট আবার কামরার ভেতরে গা—ঢাকা দিলে।
খানিক পরে সাবধানে মুখ বাড়িয়ে দেখলে, সেই সন্দেহজনক লোকটা অদৃশ্য হয়েছে।
তখন অমন—হঠাৎ লোকটা কেমন করে আবির্ভূত হল তার তদারক করবার জন্যে কৌতূহলী বাঘা খুব সন্তর্পণে এগিয়ে গেল।
ঝোপের মধ্যে কতকগুলো ডালপাতা রাশিকৃত হয়ে রয়েছে এবং তারই ফাঁক দিয়ে একসার সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে! ঝোপের বাহির থেকে এ—সব কিছুই দেখা যায় না এবং ঝোপের ভেতরে এসে দাঁড়ালেও সহজে সেই সিঁড়ির সার আবিষ্কার করা যায় না।
বাঘা সেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল! তারপরেই তার কানে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর! বাঘার খুশি—ল্যাজ তখনি বেজায় ব্যস্ত হয়ে উঠল!
আনন্দে বিহ্বল হয়ে বাঘা সর্বপ্রথমে কুমারের ভূতলশায়ী দেহের ওপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আদর করে তার গা চেটে দিতে লাগল।
রামহরি বিষাদ—ভরা গলায় বললে, ‘কেন বাঘা মরতে এলি এখানে? আমরা মরব, তুইও মরবি!’
বিমল কিন্তু বিপুল উৎসাহে বলে উঠল, ‘না, না! আমরাও বাঁচব, বাঘাও বাঁচবে! ভগবান এখনও বোধহয় আমাদের স্বর্গের টিকিট দিতে রাজি নন! বাঘা সেই খবরই নিয়ে এসেছে।’
বিনয়বাবু ম্লান মুখেই বললেন, ‘বিমল, হঠাৎ তোমার এতটা খুশি হওয়ার কারণ বুঝলুম না!’
‘বুঝলেন না? কিন্তু আমি বুঝছি বাঘা যখন এসেছে, তখন ধরণীর ছুরি থেকে নিশ্চয়ই আমাদের মাথা বাঁচাতে পারব! মরি তো একেবারেই মরব, কিন্তু মাসিকপত্রের ওই দুই কবির মতো কুমির কি হনুমান হয়ে থাকব না!’
কমল বললে, ‘আমাদের হাত—পা দুইই বাঁধা, ধরণী আমাদের নিয়ে যা—খুশি তাই করতে পারে!’
কুমার বললে, ‘না, তা আর পারে না! বিমল কি বলছে আমি বুঝেছি। বাঘা!’—বলেই সে বাঘার মুখের কাছে নিজের বাঁধা হাতদুটো কোনওরকমে এগিয়ে দিলে।
বাঘা প্রথমটা থতোমতো খেয়ে গেল।
কুমার তখন বাঘার মুখের ওপরে নিজের হাতদুটো ঘষতে—ঘষতে বললে, ‘ওকি রে বাঘা, তুই আমার ইশারা বুঝতে পারছিস না? নে, নে, দড়ি কাট!’
বাঘার আর কোনও সন্দেহ রইল না। সে তখনি নিজের ধারালো দাঁত দিয়ে কুমারের হাতের দড়ি চেপে ধরলে। দেখতে—দেখতে তার হাতের দড়ি খ’সে পড়ল। কুমার তখন আগে নিজেই নিজের পায়ের বাঁধন খুলে ফেললে! এবং তারপর একে—একে সকলেরই বন্ধনদশা ঘুচতে আর দেরি লাগল না!
বিমল বাঘাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললে, ‘ওরে বাঘা, বাঘা রে! গেল—জন্মে তুই আমাদের কে ছিলি রে বাঘা?’ বাঘাও সুখে যেন গলে গিয়ে বিমলের কোলের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে দিলে!
বিনয়বাবু বললেন, ‘ওঠো বিমল, পরে বাঘাকে ধন্যবাদ দেওয়ার অনেক সময় পাবে!’
বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘ঠিক বলেছেন! আগে এই পাতালপুরী থেকে বেরুতে না পারলে নিস্তার নেই! এসো সবাই! কিন্তু খুব ধীরে আর খুব হুঁশিয়ার হয়ে!’
একে—একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলে যেখানটাকে তারা এতক্ষণ উঠান বলে মনে করছিল, সেখানে রয়েছে মস্ত বড় একটা জলের ইঁদারা!
বিমল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললে, ‘বিনয়বাবু, এই পাতালপুরীটা কিরকম তা বুঝেছেন? লখনউ—এর নবাবরা গরমের সময়ে মাটির নীচে ঘর তৈরি করে বাস করতেন। সেই আদর্শেই এটা তৈরি হয়েছে। বর্ধমানেও এইরকম পাতালপুরী আছে। বিপদের সময়ে লুকোবার জন্যেই ধরণী এটা বোধহয় তৈরি করেছে!’
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে—সঙ্গেই হো—হো—হো—হো করে একটা বিষম অট্টহাসি সেই পাতালপুরীর ভেতরে প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তুললে। বিমল সচমকে মুখ তুলে দেখলে, সিঁড়ির ওপরকার ধাপে দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে হাসছে ধরণী!
ধরণী হঠাৎ হাসি থামিয়ে নিষ্ঠুর স্বরে বললে, ‘এই যে, দড়িটড়ি সব বুঝি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে?’
বিমল দুই পা এগিয়ে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ! আমরা মানুষ, দড়ি বাঁধা থাকতে ভালো লাগল না!’
ধরণী দুই পা পিছিয়ে ব্যঙ্গের স্বরে বললে, ‘ও! এখনও তোমরা মানুষই বটে! কিন্তু ভয় নেই, তোমাদের মনুষ্যদেহ আর বেশিক্ষণ থাকবে না!’
বিমল সিঁড়ির ওপরে এক ধাপ উঠে বললে, ‘আজ্ঞে না, এখনও আমাদের নরদেহ ত্যাগ করবার ইচ্ছা হয়নি।’
ধরণী গর্জে উঠে বললে, ‘খবরদার! আর এক পা এগিয়ো না! ভাবছ এখান থেকে বেরুতে পারলেই বাঁচবে? জানো, বাইরে কে পাহারা দিচ্ছে?’
‘রামদাস।’
‘হ্যাঁ, এখান থেকে এক পা বেরুলেই সে তোমাদের পায়ের কড়ে আঙুলে টিপে বধ করবে!’
‘বেশ, সেইটেই একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক’—বলেই বিমল দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল এবং তার পিছনে—পিছনে আর সকলেও!
বিমলের ইচ্ছা ছিল, ধরণীকে গ্রেপ্তার করে! কিন্তু তার অভিপ্রায় বুঝে ধরণী এক মুহূর্তেই তিন লাফ মেরে বাইরে বেরিয়ে গেল!
তারাও তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে দেখলে ধরণী তিরবেগে ছুটছে এবং প্রাণপণে চেঁচিয়ে ডাকছে—’রামদাস! রামদাস! রামদাস!’
ঝাঁপের বাইরে একটুখানি ঘাসজমি এবং তারপরেই নিবিড় অরণ্য যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধরণী সেই অরণ্যের ভেতরে মিলিয়ে গেল।
বিনয়বাবু ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এখন আমরা কোনদিকে যাব?’
কুমার বললে, ‘আমাদের আর কোনও দিকে যেতে হবে না। ওই দেখুন!’
অরণ্যের এক অংশ আচম্বিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছে—মড়মড় করে বড়—বড় ডালপালা ভেঙে—পড়ার এবং মাটির ওপর ধুপ—ধুপ করে আশ্চর্য পায়ের শব্দ!
তারপরেই এক অতি ক্রুদ্ধ উচ্চ কণ্ঠস্বর, ‘রামদাস, রামদাস! ওই পোকাগুলোকে পায়ে থেঁতলে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দাও!’
বিমল মৃদু হেসে বললে, ‘এইবারে রামদাসকে আমরা স্বচক্ষে দেখব!’
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ। কবির আবির্ভাব
রামদাসে—ছোট্ট হরিদাসের মস্ত ভাই রামদাস, ধরণীর সৃষ্টিছাড়া পরীক্ষার জ্যান্ত ফল রামদাস,—যার পায়ের তলে পৃথিবী টলে, যার হাতের জোরে মানুষ—ভরা মোটরবোট জল ছেড়ে শূন্যে ওড়ে, যার মাথা দোলে বুড়ো তালগাছের মাথার সমান উঁচু হয়ে ঝড়ের হুহুঙ্কারে!
সেই রামদাস আসছে আজ বিমলদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে, ধরণীর নিষ্ঠুর হুকুম পালন করবার জন্যে, এক—এক বিরাট পায়ের চাপে পাঁচ—পাঁচটি ক্ষুদ্র মানুষের দেহ ঠুনকো কাচের পেয়ালার মতো চূর্ণ করবার জন্যে!
সকলে অত্যন্ত অসহায়ের মতো এদিকে—ওদিকে তাকাতে লাগল,—কিন্তু কোথায় পালাবার পথ? সামনে খোলা জমি, তারপরেই দুর্ভেদ্য বন, যার ভেতর দিয়ে মড়মড় করে বড়—বড় ডালপালা ভাঙতে—ভাঙতে আসছে স্বয়ং রামদাস, বামপাশে ও ডানপাশেও নিবিড় অরণ্য যেন নিরেট প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে—হয়তো তার ভেতরেও তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেই হাতির মতো ডালকুত্তা এবং সেখানে গিয়ে পথ খোঁজবারও সময় নেই!
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, আমাদের আবার সেই পাতালপুরীতেই ফিরে গিয়ে বন্দি হতে হবে—রামদাস তার ভেতরে ঢুকতে পারবে না!’
দাঁতে দাঁত চেপে বিমল বললে, ‘সেখানে গিয়ে ধরণীর ছুরিতে মস্তিষ্ক দান করব?প্রাণ থাকতে নয়!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু এখানেই প্রাণ আর থাকছে কই?’
কুমার বললে, ‘রামদাসের সঙ্গে লড়তে—লড়তে আমি প্রাণ দিতেও রাজি আছি, কিন্তু ধরণীর ছুরিতে মস্তিষ্ক দিয়ে মরেও বেঁচে থাকতে পারব না!’
কমল বললে, ‘আমারও ওই মত!’
রামহরি কেবল কাঁদতে লাগল।
কিন্তু বাঘা চ্যাঁচাচ্ছে শুধু ঘেউ—ঘেউ করে—সে বোধহয় রামদাসকে শুনিয়ে—শুনিয়ে কুকুর—ভাষায় সব—চেয়ে খারাপ গালাগালিগুলো বর্ষণ করছে!
হঠাৎ কমল বলে উঠল, ‘বিমলবাবু, দেখুন—দেখুন!’
সকলে মুখ ফিরিয়ে দেখলে, ডানদিকের একটা বড় গাছের ওপর থেকে তাড়াতাড়ি নেমে আসছে মস্ত একটা হনুমান! নীচের ডাল থেকে সে এক লাফে ভূতলে অবতীর্ণ হল এবং তারপর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে ব্যস্তভাবে সবাইকে ডাকতে লাগল!
বিনয়বাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘ও কী ব্যাপার?’
বিমল বললে, ‘বোধহয় সেই হনুমান—যার মাথায় বেঁচে আছে মানুষের মগজ!’
কুমার বললে, ‘ও যে আমাদের ডাকছে!’
বনের ডালপালা ভাঙার শব্দ তখন খুব কাছে এসে পড়েছে—রামদাসের দেখা পেতে বোধহয় আর আধ মিনিটও দেরি লাগবে না!
বিমল বললে, ‘ধরণীর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে ওই পশুদেহের ভেতরে আছে মানুষেরই মন! চলো সবাই, প্রাণ তো গিয়েছেই, এখন ওর কথা শুনে কি হয় সেইটেই দেখা যাক!’
বাঘা গরর—গরর করে এগিয়ে যাচ্ছিল হনুমানজিকে নিজের বীরত্ব দেখিয়ে বাহাদুরি নেওয়ার জন্যে; কিন্তু কুমারের কাছ থেকে এক চড় খেয়ে সে ল্যাজ গুটিয়ে সকলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু বুঝতে পারলে না যে, হনুমানের মতো একটা জানোয়ারকে কামড়াতে যাওয়াটা আজ হঠাৎ অপরাধ হয়ে দাঁড়াল কেন?
তারা সবাই হনুমানের দিকে অগ্রসর হল, হনুমানও গিয়ে দাঁড়াল একেবারে অরণ্যের ধার ঘেঁষে একটা ঝোপের পাশে। তারপর কি আশ্চর্য, সে ঠিক মানুষেরই মতো ঝোপের দিকে হাত তুলে আঙুল দিয়ে কী ইঙ্গিত করলে!
কিন্তু বিমলদের তখন অসম্ভব ব্যাপার দেখে বিস্মিত হওয়ার অবকাশ ছিল না, তারা তাড়াতাড়ি যখন সেই ঝোপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, হনুমান তখন লাফ মেরে একটা গাছে উঠে আবার কোথায় অদৃশ্য হয়েছে!
ঝোপের পিছনেই প্রায়—নিরেট বনের তলায় একটা অন্ধকার—মাখা পায়ে—চলা সরু পথ!
বিমল মহাখুশি হয়ে বলে উঠল, ‘হনুমান আমাদের পথ দেখিয়ে দিলে! জয় হনুমান!’
সকলে সেই পথ ধরে যখন বনের ভেতরে প্রবেশ করলে তখন তাদের মনে হল, যেন পৃথিবীর সমস্ত আলো চোখের সুমুখে ‘সুইচ’ টিপে কে নিবিয়ে দিলে! সে—অরণ্য এমনি নিবিড় যে, তার ভেতরে রোদ বা জ্যোৎস্না কোনওদিন বেড়াতে আসতে পারেনি!
অন্ধকার যখন একটু চোখ—সওয়া হয়ে এল, তখন তারা চারিদিক হাতড়াতে—হাতড়াতে কোনওগতিকে গুড়ি মেরে আস্তে—আস্তে এগুতে লাগল।
সেই সময়ে পিছন থেকে ভেসে এল যেন গম্ভীর মেঘগর্জন!
বিনয়বাবু বললেন, ‘আমাদের দেখতে না পেয়ে রামদাস বোধহয় খাপ্পা হয়ে গর্জন করছে!’
সকলে সেই অবস্থাতে যথাসম্ভব পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলে! সৌভাগ্যের বিষয়, এই চির—অন্ধকারের রাজ্য দিয়ে তাদের আর বেশিক্ষণ যেতে হল না, অরণ্যের নিবিড়তা ধীরে—ধীরে কমে আসতে লাগল এবং আলোকের আভাসে বনের ভেতরটা ক্রমেই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে অরণ্য শেষ হয়ে গেল, তারা আবার একটা বড় মাঠের ওপরে এসে দাঁড়াল।
সারা আকাশ তখন প্রখর রৌদ্রে সমুজ্জ্বল, ময়দানের নীলিমার ওপর দিয়ে সোনালির স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
বিমল একটি সুদীর্ঘ ‘আঃ’ উচ্চারণ করে যেন সেই নির্মল আলোক আর প্রমুক্ত বাতাসকে দৃষ্টি আর নিশ্বাস দিয়ে নিজের বুকের ভেতরে টেনে নিতে লাগল!
কুমার বললে, ‘এখনও আঃ বলে নিশ্চিন্তে আরাম করবার সময় হয়নি বিমল! রামদাস গোটাকয় লাফ মারলেই এখানে এসে হাজির হতে পারবে!’
বিমল বললে, ‘ঠিক! খোলা মাঠ পেয়েছি, চলো এইবার আমরা দৌড়ই!’
কমল বললে, ‘কিন্তু কোনদিকে যাব?’
কুমার বললে, ‘কোনদিকে আবার! আমরা এসেছি পূর্বদিক থেকে, আমাদের যেতেও হবে পূর্বদিকে!’
সবাই পূর্বদিকে ছুটতে শুরু করলে। ছুটাছুটিতে বাঘার ভারী আমোদ! সে ভাবলে এইবারে খেলার পালা শুরু হল! তখনি সে ভালো করেই দেখিয়ে দিলে যে ছুটাছুটি খেলায় তাকে হারিয়ে কেউ ‘ফার্স্ট প্রাইজ’ নিতে পারবে না।
ময়দানের ওপারে আবার একটা বনের আরম্ভ,—এ বন তেমন ঘন নয়।
কিন্তু সকলে এখানে এসেই সভয়ে শুনলে, বনের ভেতর দিয়ে কারা তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে!
শত্রুরা কি তাদের ইস্টিমারে যাওয়ার পথ বন্ধ করে আক্রমণ করতে আসছে?
পিছনে আছে রামদাস, আর এদিকে আছে কে! সশস্ত্র ধরণী, হরিদাস—আর সেই হাতির মতো ডালকুত্তা?
তাহলে উপায়? তারা নিরস্ত্র, বাধা দেওয়ার কোনও উপায়ই নেই! এক উপায়, পালানো। কিন্তু এবারে তারা কোনদিকে পালাবে?
কুমার হঠাৎ প্রচণ্ড উৎসাহে বলে উঠল, ‘পুলিশ! পুলিশ! মিলিটারি পুলিশ!’
বিমল চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখলে, বনের ভেতর থেকে সার বেঁধে সমতালে পা ফেলে মিলিটারি পুলিশের লোক বেরিয়ে আসছে!
সে সানন্দে বললে, ‘আর আমাদের কোনও ভয় নেই! বিনয়বাবু, ওই দেখুন বন্দুকধারী পুলিশ ফৌজ, ওই দেখুন ‘মেশিনগান’! আসুক এখন রামদাস, আসুক এখন ধরণী আর আসুক তার হাতি—কুকুর!’
ইনস্পেকটর তাদের দেখে দৌড়ে এসে বললেন, ‘বিমলবাবু, ব্যাপার কী? মোটরবোট—শুদ্ধ কোথায় উধাও হয়েছিলেন?’
বিমল বললে, ‘আমরা যমালয়—ফেরত মানুষ!’
‘তার মানে?’
‘তার মানে তালগাছের মতন উঁচু দৈত্য মোটরবোটশুদ্ধ আমাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল!’
‘কী যে আপনি বলেন!’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনুন।’
বিমল তাড়াতাড়ি খুব অল্প কথায় মোটামুটি সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলে।
ইনস্পেকটর সব শুনে খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এ যে গাঁজাখুরি কথার মতো শোনাচ্ছে।’
‘বিশ্বাস করুন মশায়, বিশ্বাস করুন! গাঁজার ধোঁয়া যেমন সভ্য, আমাদের কথাও তেমনি সত্য!’
‘আপনারা স্বপ্ন বা ম্যাজিক দেখেছেন কিনা জানি না, কিন্তু আপনারা যে বিপদে পড়েছেন, এটা আমি আন্দাজ করেছিলুম। তাই তো লোকজন নিয়ে আমি আপনাদের খুঁজতে বেরিয়েছি।’
‘বড় ভালো কাজ করেছেন মশাই, বড় ভালো কাজ করেছেন! আমাদের তো খুঁজে পেয়েছেন, এইবারে চলুন সেই রামদাসের খোঁজে!’
‘নিশ্চয়ই যাব! কিন্তু ওই যে বললেন, আপনাদের এই রামদাসের গল্প গাঁজার ধোঁয়ার মতন সত্য, শেষটা গাঁজার ধোঁয়ার মতোই রামদাস উপে যাবে না তো?’
কুমার বললে, ‘হুঁ! রামদাস উপে যাওয়ারই ছেলে বটে! ওই দেখুন, মাঠের পারের ওই বনে দাঁড়িয়ে রামদাস আমাদেরই দেখছে!’
ইনস্পেক্টর সেইদিকে তাকিয়েই চমকে মস্ত এক লাফ মারলেন!
ময়দানের ওদিককার বনের সারের ওপরে এক মানুষ—তালগাছ স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে সকলকে লক্ষ করছে, দুই হাত দুই কোমরে রেখে! তার অদ্ভুত দেহের তুলনায় বড়—বড় তালগাছগুলোকেও ছোট দেখাচ্ছে! এতদূর থেকে তার মুখের ভাব দেখা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু সেটা যে বিপুলবপু এক নরদৈত্যের মূর্তি, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই!
মিলিটারি পুলিশের দলের ভেতর থেকে একটা বিস্মিত কোলাহল—ধ্বনি উঠল!
বিমল বললে, ‘কিন্তু সেই হাতির মতো ডালকুত্তা! সে এখনও একবারও দেখা দিলে না কেন?’
ইনস্পেকটর বললেন, ‘রক্ষে করুন মশায়, আর আমি তাকে দেখতে চাই না! যা দেখছি, তাতেই পিলে চমকে উঠেছে। এই সেপাই, ফায়ার করো—ফায়ার করো।
বিমল ব্যস্তভাবে বললে, ‘না না! আগে দেখাই যাক, রামদাসকে আমরা জ্যান্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করতে পারি কিনা!’
ইনস্পেক্টর দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতো করে তুলে সবিস্ময়ে বললেন, ‘গ্রেপ্তার! ওকে গ্রেপ্তার করতে চায় কে? ওর কাছে গেলে ও তো পুঁটিমাছের মতো টপ—টপ করে আমাদের মুখে ফেলে দেবে! ওর হাতে পরাবার হাতকড়িই বা কোথায় পাব? ইস্টিমারে ওর দেহ কুলোবে না, নিয়ে যাব কেমন করে! না—না, গ্রেপ্তার—ট্রেপ্তার নয়, ওকে একেবারে বধ করতে হবে!’
বিমল বললে, ‘কিন্তু এত দূর থেকে গুলি ছুড়লে তো ওর গায়ে লাগবে না!’
‘তবু বন্দুক ছুড়ুক! বন্দুকের শব্দে ভয় পেয়ে দৈত্য—বেটা এখান থেকে পালিয়ে যাক। ওকে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছে না! এই সেপাই! বন্দুক ছোড়ো—’মেশিনগান’ ছোড়ো!’
বন্দুক ও কলে কামানের ঘন—ঘন বজ্র—গর্জনে চতুর্দিক ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল! এবং সঙ্গে—সঙ্গে রামদাসের দেহ বনের ভেতরে ডুব মারলে! তাহলে আগ্নেয়াস্ত্রের শক্তি সে জানে!
ইনস্পেকটর উৎসাহভরে বলে উঠলেন, ‘দেখছি দৈত্য—বেটা গাঁয়ারগোবিন্দ নয়! তবে চলো সবাই অগ্রসর হই! কিন্তু খবরদার, বন্দুক—ছোড়া বন্ধ কোরো না! সেই ফাঁকে দৈত্যটা কাছে এসে পড়লে আর রক্ষে নেই!’
সকলে মিলে অগ্রসর হল—যেখানটায় রামদাসকে দেখা গিয়েছিল সেইদিকে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে রামদাসের বদলে পাওয়া গেল ধরণীকে। একটা গাছের তলায় ধরণী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে—বন্দুকের গুলি লেগে তার কপাল বয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে!
বিমল তার বুকে হাত দিয়ে দেখে বললে, ‘ধরণী এ—জীবনে আর আমাদের মগজ নিয়ে পরীক্ষা করতে পারবে না।’
তারপর আবার রামদাসের সন্ধান আরম্ভ হল। কিন্তু দ্বীপের চারিদিক, ছোট—বড় সমস্ত বন খুঁজেও তার কোনওই পাত্তা পাওয়া গেল না।
সবাই যখন দ্বীপের ওপাশে আবার নদীর ধারে এসে পড়ল, বিনয়বাবু তখন একদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
আগেই বলা হয়েছে নদী এখানে প্রায় সমুদ্রের মতন দেখতে! সেই বিশাল জলের রাজ্যে দেখা গেল, বহুদূরে দুটো বড়—বড় জীব সাঁতার কেটে কোথায় ভেসে চলেছে!
বিমল বললে, ‘নিশ্চয়ই ওরা হচ্ছে রামদাস আর সেই বিরাট কুকুর।’
‘কিন্তু রামদাসের দাদা হরিদাসটা গেল কোথায়?’
‘হয়তো রামদাসের চওড়া পিঠে বসে নদী পার হচ্ছে! কি বলেন ইনস্পেকটর মশাই, ইস্টিমারে চড়ে আবার ওদের তাড়া করব নাকি?’
ইনস্পেকটর বললেন, ‘আপদ যখন নিজেই বিদেয় হয়েছে, তখন আর হাঙ্গাম করে দরকার কি? কিসে কি হয় বলা তো যায় না, ও বেটা যদি ডুবসাঁতার দিয়ে এসে ঢুঁ মেরে ইস্টিমারের তলা ফাটিয়ে দেয়?’
সকলে যখন বনের ভেতর দিয়ে আবার ফিরে আসছে, তখন মাথার ওপরকার একটা গাছের ডাল—পাতা হঠাৎ নড়ে উঠল, তারপর শোনা গেল—কিচির কিচির মিচির—কিচির—মিচির কিচকিচ—কিচকিচ!
‘মানুষ আমি নইকো রে ভাই,
আজকে আমি মানুষ নই,
তোমরা সবাই চললে দেশে,
একলা আমি হেথায় রই!
আমার দেশের সবুজ মাঠে
ধানের খেতে সোনার দোল,
বইছে নদীর রুপোর লহর,
শিউলি ঝরা মাটির কোল!
সে করুণ স্বর শুনে সকলেরই মন ব্যথায় ভরে উঠল।
বিনয়বাবু ওপর দিকে মুখ তুলে মমতা—ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘কবি, আজ তোমার চেহারা যেরকমই হোক, তুমি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছ! তুমি গাছ থেকে নেমে এসো, আমাদের সঙ্গে আবার দেশে ফিরে চলো।’
গাছের ওপর থেকে আবার সেই দুঃখমাখা কণ্ঠ শোনা গেল :
‘আমার ঘরের মিষ্টি বধূ
ডাকছে আমায় রাত্রি—দিন,
আমার খোকার, আমার খুকির
কণ্ঠে বাজে স্বপ্ন—বীণ।
কেমন করে ফিরব ঘরে,
আজকে আমি মানুষ নই,
তোমরা সবাই চললে দেশে,
একলা আমি হেথায় রই!
___