প্রথম পরিচ্ছেদ । অদ্ভুত জন্তু
সকালবেলায় উঠানের ধারে বসে কুমার তার বন্দুকটা সাফ করছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে, হাসিমুখে বিমল আসছে।
কুমার বিস্মিত স্বরে বললে, ‘এ কি, বিমল যে! তুমি কবে ফিরলে হে?’
‘আজকেই।’
‘তোমার তো এত তাড়াতাড়ি ফেরবার কথা ছিল না।’
‘ছিল না। কিন্তু ফিরতে হল। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এসেছি।’
কুমার অধিকতর বিস্ময়ে বললে, ‘আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে! ব্যাপার কী?’
‘গুরুতর। আবার এক ভীষণ নাটকের সূচনা!’
কুমার উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘তাহলে এ নাটকে তুমি কি আমাকেও অভিনয় করবার জন্যে ডাকতে এসেছ?’
‘তাছাড়া আর কী?’
‘সাধু, সাধু! আমি প্রস্তুত! যাত্রা শুরু কবে?’
‘কালই।’
‘কিন্তু তার আগে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে কি?’
‘তা বলব বইকী! শোনো। তুমি জানো, সুন্দরবনে আমি শিকার করতে গিয়েছিলুম। যে—জায়গাটা ছিলুম, তার নাম হচ্ছে মোহনপুর। কিন্তু সেখানে গিয়ে শিকারের বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারি না। একটিমাত্র বাঘ পেয়েছিলুম, কিন্তু সেও আমার বুলেট হজম করে হয়তো খোশমেজাজে বহাল—তবিয়তেই তার বাসায় চলে গিয়েছে।
স্থলচরেরা আমাকে ”বয়কট” করেছে দেখে শেষটা জলচরের দিকে নজর দিলুম। আমার সুনজরে পড়ে একটা কুমির আর একটা ঘড়িয়াল তাদের পশু—জীবন থেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মুক্তিলাভ করলে! তারপর তারাও আর আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হল না। মনটা রীতিমতো তিক্ত বিরক্ত হয়ে উঠল। ভাবলুম, কাজ নেই বনেজঙ্গলে ঘুরে, ঘরের ছেলে আবার ঘরেই ফেরা যাক!
ঠিক এমনি সময়ে এক অদ্ভুত খবর পাওয়া গেল। মোহনপুর থেকে মাইল—পনেরো তফাতে আছে রাইপুর গ্রাম। রাইপুরের একজন লোক এসে হঠাৎ খবর দিলে, সেখানকার জঙ্গলে নাকি কি একটা আশ্চর্য জীব এসে হাজির হয়েছে! সে জীবটাকে কেউ বলে বাঘ, কেউ বলে গন্ডার, কেউ—বা বলে অন্য—কিছু। যদিও তাকে ভালো করে দেখবার অবসর কেউ পায়নি, তবু এক বিষয়ে সকলেই একমত। আকারে সে নাকি প্রকাণ্ড—যে—কোনও মোষের চেয়েও বড়। তার ভয়ে রাইপুরের লোকেরা রাত্রে ঘুম ভুলে গিয়েছে।’
কুমার শুধলো, ‘কেন? সে জীবটা মানুষ—টানুষ বধ করেছে নাকি?’
‘না। সে এখনও মানুষ—টানুষ বধ করতে পারেনি বটে, তবে রাইপুর থেকে প্রতি রাত্রেই অনেক হাঁস, মুরগি, ছাগল আর কুকুর অদৃশ্য হয়েছে। এর মধ্যে আর একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সেই অজানা জীবটার কবলে পড়ে রাইপুরের অনেক বেড়াল ভবলীলা সাঙ্গ করেছে বটে, কিন্তু বেড়ালগুলোর দেহ সে ভক্ষণ করেনি।’
কুমার বললে, ‘কেন, এর মধ্যে তুমি উল্লেখযোগ্য কী দেখলে?’
বিমল বললে, ‘উল্লেখযোগ্য নয়? হাঁস, মুরগি, ছাগল আর কুকুরগুলোর দেহ পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রত্যেক বেড়ালেরই মৃতদেহ পাওয়া যায় কেন? সেই অজানা জীবটা আর সব পশুর মাংস খায়, কিন্তু বেড়ালের মাংস খায় না কেন? আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার শোনো। দু—তিনজন মানুষও তার সামনে পড়েছিল। তারা তার গর্জন শুনেই পালিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের আক্রমণ করবার জন্যে সে পিছনে—পিছনে তেড়ে আসেনি।’
কুমার কৌতূহল—ভরে বললে, ‘তারপর?’
বিমল বললে, ‘তারপর আর কী, এমন একটা কথা শুনে আর কি স্থির হয়ে বসে থাকা যায়! আমিও মোটমাট বেঁধে নিয়ে রাইপুরে যাত্রা করলুম—’
কুমার বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে নিশ্চয়ই তুমি সে জীবটাকে দেখে এসেছ?’
‘হ্যাঁ। বনেজঙ্গলে দুই রাত্রি বাস করবার পর তৃতীয় রাত্রে তার সাক্ষাৎ পেলুম। আমি একটা গাছের ওপরে বন্দুক হাতে নিয়ে বসে—বসে ঢুলছিলুম। রাত তখন বারোটা হবে। আকাশে খুব অল্প চাঁদের আলো ছিল, অন্ধকারে ভালো নজর চলে না। চারিদিকের নীরবতার মাঝখানে একটা গাছের তলায় হঠাৎ শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ কানে এল। শব্দটা হয়েই থেমে গেল। সেইদিকে তাকিয়ে দেখি, অন্ধকারের ভেতরে ভোঁটার মতন বড়—বড় দুটো আগুন—চোখ জেগে উঠেছে! সে চোখদুটো আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখদুটো কোন জানোয়ারের আমি বোঝবার চেষ্টা করলুম না, তারপরেই বন্দুকে লক্ষ্য স্থির করে ঘোড়া টিপে দিলুম। সঙ্গে—সঙ্গে বিষম এক আর্তনাদ ও ছটফটানির শব্দ! সে আর্তনাদ বাঘ—ভাল্লুকের ডাকের মতন নয়, আমার মনে হল যেন এক দানব—বেড়াল আহত হয়ে ভীষণ চিৎকার করছে!’
খানিক পরে আর্তনাদ ও ছটফটানির শব্দ ধীরে—ধীরে থেমে এল। কিন্তু আমি সেই রাতের অন্ধকারে গাছের ওপর থেকে আর নামলুম না। গাছের ডালেই হেলান দিয়ে কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে দিলুম। সকালবেলায় চারদিকে লোকজনের সাড়া পেয়ে বুঝলুম, রাত্রে আমার বন্দুকের শব্দ আর এই অজানা জন্তুটার চিৎকার শুনেই এত ভোরে সবাই এখানে ছুটে এসেছে। আস্তে—আস্তে নীচে নেমে পাশের ঝোপের ভেতরে গিয়েই দেখতে পেলুম, একটা আশ্চর্য ও প্রকাণ্ড জীব সেখানে মরে পড়ে রয়েছে। জন্তুটা যে—কোনও বাঘের চেয়ে বড়। তাকে দেখতে বাঘের মতন হলেও সে মোটেই বাঘ নয়। তার গায়ের রং ধবধবে সাদা, কিন্তু মুখটা কালো। আসলে তাকে একটা অসম্ভবরকম প্রকাণ্ড বেড়াল ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।’
কুমার সবিস্ময়ে বললে, ‘তুমি বল কি হে বিমল, বাঘের চেয়েও বড় বেড়াল? এও কি সম্ভব?’
বিমল বললে, ‘কী যে সম্ভব আর কী যে অসম্ভব তা আমি জানি না। আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি তাই বলছি। কিন্তু এখনও সবকথা শেষ হয়নি।’
কুমার বললে, ‘এর ওপরেও তোমার কিছু বলবার আছে নাকি? আচ্ছা, শুনি।’
বিমল বললে, ‘বেড়ালটার দেহ পরীক্ষা করতে—করতে আর—একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। তার গলায় ছিল একটা ইস্পাতের বগলস আর—একটা ছোড়া শিকল। দেখেই বোঝা গেল, এ—বেড়ালটাকে কেউ বেঁধে রেখে দিয়েছিল, কোনগতিকে শিকল ছিঁড়ে এ পালিয়ে এসেছে! কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন একটা বিচিত্র বেড়াল এ—অঞ্চলে যদি কারুর বাড়িতে বাঁধা থাকত তাহলে সকলে তার কথা নিশ্চয়ই জানতে পারত। কিন্তু কেউ এই বেড়াল ও তার মালিক সম্বন্ধে কোনও কথাই বলতে পারলে না। এই বেড়ালের কথা লোকের মুখে—মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। নানা গ্রাম থেকে দলে—দলে লোক এসে তাকে দেখতে লাগল। এমন একটা অসম্ভব জীব দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে গেল।’
কুমার বললে, ‘এইখানেই তাহলে তোমার কথা ফুরুল?’
বিমল বললে, ‘মোটেই নয়। এইখানেই যদি আমার কথা ফুরিয়ে যেত, তাহলে তোমায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি আবার কলকাতায় ফিরে আসতুম না।’
কুমার উৎসাহিত ভাবে বললে, ‘বটে—বটে, তাই নাকি?’
বিমল বললে, ‘বিকেলবেলায় দূর গ্রাম থেকে রাইপুরে একটা লোক এল, ওই বেড়ালটাকে দেখবার জন্যে। এমনভাবে সে বেড়ালটাকে দেখতে লাগল যাতে করে আমার মনে সন্দেহ হল যে, এই লোকটার এ—সম্বন্ধে কিছু জানা আছে। তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে বললে, সে হচ্ছে মাঝি, নৌকো চালানোই তার জীবিকা। আমি জানতে চাইলুম, এই বেড়ালটাকে সে আগে কখনও দেখেছে কিনা? খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ও কিছু ইতস্তত করে সে বললে, ‘বাবু, এই রাক্ষুসে বেড়ালটাকে আমি আগে কখনও দেখিনি বটে, কিন্তু বোধহয় এর ডাক আমি শুনেছি।’ তার কথা শুনে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল। তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব কথা জানতে চাইলুম। সে যা বললে তা হচ্ছে এই :
‘দিন—পনেরো আগে একটি বুড়ো ভদ্রলোক আমার নৌকো ভাড়া করতে আসেন। সে—বাবুকে আমি আগে কখনো দেখিনি। তাঁর মুখেই শুনলুম, তিনি অন্য একখানা নৌকো করে এখানে এসেছেন, সেই নৌকোর মাঝির সঙ্গে ঝগড়া হওয়াতে সে তাঁকে আমাদের গ্রামে নামিয়ে দিয়েছিল।
‘তিনি গঙ্গাসাগরের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গায় যেতে চান। যে তাঁকে নিয়ে যাবে তাকে তিনি রীতিমতো বকশিশ দিয়ে খুশি করবেন, এমন কথাও আমাকে জানালেন। সঙ্গে—সঙ্গে একখানা দশ টাকার নোটও আগাম ভাড়া বলে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। আগাম এতগুলো টাকা পেয়ে আমি তখনই তাঁকে নিয়ে যেতে রাজি হলুম। তাঁর সঙ্গে ছিল মস্তবড় একটা সিন্দুক, এত বড় সিন্দুক আমি আর কখনও দেখিনি। আমরা সকলে মিলে ধরাধরি করে সেই সিন্দুকটাকে নৌকোর ওপরে নিয়ে গিয়ে তুললুম। তোলবার সময় শুনতে পেলুম, সিন্দুকের ভেতর থেকে কি—একটা জানোয়ার বিকট গর্জন করছে!
‘আমরা ভয় পাচ্ছি দেখে বাবুটি বললেন, ‘তোমাদের কোনও ভয় নেই, ওর ভেতরে একটা খুব বড়—জাতের বনবেড়াল আছে!’ সে যে—কোন জাতের বন—বেড়াল তা বলতে পারি না, বনবেড়াল যতই বড় হোক তার চিৎকার এমন ভয়ানক হয়, আমি তা জানতুম না! আমি বললুম, ‘বাবু, এ যদি সিন্দুক থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের কোনও বিপদ হবে না তো?’ তিনি হেসে বললেন, ‘না, সিন্দুকের ভেতরে ও—বেড়ালটা শিকলে বাঁধা আছে।’
কিন্তু নৌকো নিয়ে আমাদের বেশিদূর যেতে হল না। সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমরা হঠাৎ এক ঝড়ের মুখে পড়লুম। ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে নৌকো বাঁচানোই দায়! দাঁড়িরা সব বেঁকে বসল, বললে—’ওই ভারী সিন্দুকটা নৌকো থেকে নামিয়ে না দিলে কারুকেই আজ প্রাণে বাঁচতে হবে না!’
কিন্তু তাদের কথায় সেই বুড়ো ভদ্রলোকটি প্রথমটায় কিছুতেই সায় দিতে চাইলেন না। শেষটা দাঁড়িরা যখন নিতান্তই রুখে উঠল, তখন তিনি নাচার হয়ে বললেন, ‘তোমাদের যা খুশি করো, আমি আর কিছু জানি না!’
সকলে মিলে সেই বিষম ভারী সিন্দুকটা তখনি জলে ফেলে দেওয়ার জোগাড় করলে। কেবল আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘ওর ভেতরে যে বনবেড়ালটা আছে, তার কি হবে?’ দাঁড়িরা বললে, ‘বনবেড়ালটাকে বাইরে বার করলে আমাদের কামড়ে দেবে, তার চেয়ে ওর জলে ডুবে মরাই ভালো!’
ভদ্রলোকও ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘না, না, ওকে বাইরে বার করতে হবে না, সিন্দুক শুদ্ধই ওকে জলে ফেলে দাও!’
সিন্দুকটাকে আমরা তখন জলের ভেতরে ফেলে দিলুম। তার একটু পরেই জলের ভেতর থেকে কি—একটা মস্ত জানোয়ার ভেসে উঠল। সেটা যে কী জানোয়ার, দূর থেকে আমারা ভালো করে বুঝতে পারলুম না—বোঝবার সময়ও ছিল না, কারণ আমরা সবাই তখন নৌকো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছি।
ঝড়ের মুখ থেকে অনেক কষ্টে নৌকোকে বাঁচিয়ে, সন্ধ্যার সময় আমরা সমুদ্রের মুখে মাতলা নদীর মোহনায় গিয়ে পড়লুম। দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, আঙুল দিয়ে সেইটে দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমাকে তোমরা ওইখানে নামিয়ে দাও।’ আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘এই অসময়ে ওই দ্বীপে নেমে আপনি কোথায় যাবেন?’
ভদ্রলোক একটু বিরক্ত ভাবেই বললেন, ‘সে কথায় তোমাদের দরকার নেই, যা বলছি শোনো।’ আমরা আর কিছু না বলে নৌকো বেয়ে দ্বীপের কাছে গিয়ে পড়লুম। তখন বেশ অন্ধকার হয়েছে—দ্বীপের বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে আর নজর চলে না।
এ—দ্বীপে আমরা কখনও আসিনি, এখানে যে—কোনও মানুষ থাকতে পারে তাও আমাদের বিশ্বাস হয় না। কিন্তু বুড়ো ভদ্রলোকটি অনায়াসেই নৌকো থেকে নেমে সেই অন্ধকারের ভেতরে কোথায় মিলিয়ে গেলেন।
তখন ভাটা আরম্ভ হয়েছে। নৌকো নিয়ে আর ফেরবার চেষ্টা না করে সে—রাতটা আমরা সেইখানেই থাকব স্থির করলুম। নৌকো বাঁধবার চেষ্টা করছি, এমন সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে সেই ভদ্রলোকের গলায় শুনলুম—’তোমরা এখানে নৌকো বেঁধো না, শিগগির পালিয়ে যাও, নইলে বিপদে পড়বে!’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘এখানে থাকলে বিপদ হবে কেন বাবু?’
ভদ্রলোক খুব কড়া গলায় বললেন, ‘আমার কথা যদি না শোনো, তাহলে তোমরা কেউ আর প্রাণে বাঁচবে না।’
তবুও আমি বললুম, ‘বাবু, সারাদিন খাটুনির পর এই ভাটা ঠেলে আমরা নৌকো বেয়ে যাই কি করে? এখানে কিসের ভয়, বলুন না আপনি? বুনো জন্তুর, না ডাকাতের?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘জন্তুও নয়, ডাকাতও নয়, এ—দ্বীপে যারা আছে তাদের দেখলেই ভয়ে তোমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবে! শিগগির সরে পড়।’ আমি আর একবার জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তবে এমন ভয়ানক জায়গায় আপনি নামলেন কেন?’
ভদ্রলোক ‘হা—হা—হা—হা’ করে হেসেই চুপ করলেন, তারপর তাঁর আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। আমাদেরও মনে কেমন একটা ভয় জেগে উঠল, সেখান থেকে তখুনি নৌকো চালিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলুম।
বাবু, আমার বিশ্বাস, আপনি এই যে রাক্ষুসে বেড়ালটাকে মেরেছেন, সেই সিন্দুকের ভেতরে এইটেই ছিল।’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। নূতনত্ব কী?
বিমলের গল্প শেষ হলে পর কুমার খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর ধীরে—ধীরে বললে, ‘সেই বুড়ো লোকটি যে কে, সে—কথা তুমি জানতে পেরেছ কি?’
‘তাই জানবার জন্যেই তো আমার এত আগ্রহ! তবে মাঝির মুখে শুনেছি, লোকটি নাকি বাঙালি, আর বুড়ো হলেও তিনি খুব লম্বাচওড়া জোয়ান। আর তাঁর মেজাজ বড় কড়া।’
‘কিন্তু বিমল, সে দ্বীপে এমন কী থাকতে পারে? বৃদ্ধ কি মিছামিছি ভয় দেখিয়েছেন? দ্বীপে ভয়ের কিছু থাকলে তিনি একলা সেখানে নামবেন কেন?’
‘কুমার, তুমি আমায় যে প্রশ্নগুলি করলে, আমারও মনে ঠিক ওইসব প্রশ্নই জাগছে! ওইসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়ার জন্যেই আমরা সেই দ্বীপের দিকে যাত্রা করব।’
‘কিন্তু আগে থাকতে তবু কিছু ভেবে দেখা দরকার তো? বৃদ্ধ বলেছেন, সে দ্বীপে যারা আছে তারা জন্তু নয়, ডাকাতও নয়। তবে তারা কে? মানুষ তাদের দেখলে ভয় পেতে পারে। তবে কি তারা ভূত? তাই বা বিশ্বাস করি কেমন করে? ভূত—প্রেত তো কবির কল্পনা, খোকা—খুকিদের ভয় দেখিয়ে শান্ত করবার উপায়।’
‘না কুমার, ভূত—টুত আমিও মানি না, আর বৃদ্ধ যে ভূতের ভয় দেখিয়েছেন তাও আমার মনে হয় না।’
‘তবে?’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না। অবশ্য সেই দ্বীপে যদি এইরকম দানব—বেড়ালের আত্মীয়রা থাকে তাহলে সেটা বিশেষ ভয়ের কথা হবে বটে। কিন্তু বৃদ্ধ জন্তুর ভয় দেখাননি।’
কুমার কিছুক্ষণ ভেবে বললে, ‘দ্যাখো, আমার বোধ হয় সেই বৃদ্ধ মিথ্যা কথাই বলেছেন। দ্বীপের ভেতর হয়তো কোনও অজানা রহস্য আছে। অন্য কেউ সে কথা টের পায়, হয়তো বৃদ্ধ তা পছন্দ করেন না। হয়তো সেইজন্যেই তিনি দাঁড়ি—মাঝিদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু সে রহস্যটা কী? যে দ্বীপে এমন দানব—বেড়াল পাওয়া যায় সে দ্বীপ যে রহস্যময় তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে এমন অসম্ভব বেড়ালের চেয়েও অসম্ভব আরও কোনও রহস্য আছে কি না সেইটেই আমি জানতে চাই।’
কুমার বললে, ‘মঙ্গলগ্রহে, ময়নামতীর মায়াকাননে, আসাম আর আফ্রিকার বনেজঙ্গলে, সুন্দরবনে অমাবস্যার রাতে আর হিমালয়ের দানবপুরীতে অনেক অসম্ভব রহস্যই আমরা দেখলুম! তার চেয়েও বেশি অসম্ভব কোনও রহস্য যে আর ত্রিজগতে থাকতে পারে এ—কথা আমার বিশ্বাস হয় না। প্রেতলোক যদি সম্ভবপর হত, তাহলেও বরং নতুন কিছু দেখবার সম্ভাবনা ছিল! কিন্তু প্রেত যখন মানি না তখন নতুন কিছু দেখবার আশাও রাখি না।’
বিমল মাথা নেড়ে বললে, ‘না কুমার, ত্রিজগতে নূতনত্বের অভাব কোনওদিনই হয়নি। ধরো ওই চন্দ্রলোক! ওর আগাগোড়াই তুষারে ঢাকা, ওকে তুষারের এক বিরাট মরুভূমি বললেও অত্যুক্তি হয় না! অথচ পণ্ডিতেরা বলেন ওর ভেতরেও নাকি জীবের অস্তিত্ব আছে। তাঁদের মতে সে—সব জীব মোটেই মানুষের মতো দেখতে নয়, তাদের দেখলে হয়তো আমরা নতুন কোনও জন্তু বলেই মনে করব, যদিও মস্তিষ্কের শক্তিতে হয়তো মানুষেরও চেয়ে তারা উন্নত। হয়তো তারা বাস করে তুষার মরুভূমির পাতালের তলায়, যেখানে গেলে আমাদেরও তারা নতুন কোনও জন্তু বলেই সন্দেহ করবে! তুমি কি বলতে চাও কুমার, সেখানে গেলে তুমি এক নতুন জগৎ দেখবার সুযোগ পাবে না?
কুমার বললে, ‘কিন্তু আপাতত চন্দ্রলোকের কথা তো হচ্ছে না, আমরা থাকব এই পায়ে—চলা মাটির পৃথিবীতেই! সুন্দরবনের প্রান্তে, গঙ্গাসাগরের কাছে ছোট্ট এক দ্বীপ, কলকাতা থেকে সে আর কত দূরই বা হবে? সেখানে যে বিশেষ কোনও নতুনত্ব আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে আমি তা বিশ্বাস করি না।’
বিমল মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললে, ‘দ্যাখো কুমার, একসার পিঁপড়ে খাবার মুখে করে কোথায় যাচ্ছে!’
কুমার বললে, ‘ওই যে, চৌকাঠের তলায় ওই গর্তের ভেতরে দিয়ে ওরা ঢুকছে।’
‘হুঁ। এটা তোমার নিজের বাড়ি, এখানকার প্রতি ধূলিকণাটিকেও তুমি চেনো। কিন্তু তোমারই ঘরের দরজার তলায় পিঁপড়েদের যে উপনিবেশ আছে, তার কথা তুমি কিছু বলতে পারো?’
‘তুচ্ছ প্রাণী পিঁপড়ে, তার সন্ধান আবার রাখব কি?’
‘তুচ্ছ প্রাণী পিঁপড়ে, কিন্তু এবার থেকে তাদেরও সন্ধান রাখবার চেষ্টা কোরো। মানুষের তুলনায় তাদের মস্তিষ্ক হয়তো ওজনে বেশি হবে না; কিন্তু সন্ধান রাখলে জানতে পারবে, মানুষের সমাজের চেয়ে পিঁপড়ের সমাজ অনেক বিষয়েই উন্নত। পৃথিবীতে কর্তব্যে অবহেলা করে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু লক্ষ—লক্ষ পিঁপড়ের ভেতরে এমন একটি পিঁপড়েও তুমি পাবে না, নিজের কর্তব্যে যার মন নেই। যার যা করবার নিজের ইচ্ছাতেই সে তা অশ্রান্তভাবে করে যাচ্ছে। পিঁপড়েদের দেশে অবাধ্য ছেলেমেয়ে একটিও নেই। তাদের যে রানি সেও এক মুহূর্ত অলস হয়ে বসে থাকে না, অষ্টপ্রহরই ডিমপ্রসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে। একদল পিঁপড়ে সর্বদাই করছে রানির সেবা—যত্ন, একদল করছে একমনে ডিম আর বাচ্চাদের পরিচর্যা, আর একটা বৃহৎ দলের কাজ খালি বাহির থেকে রসদ বহন করে আনা। এদের উপনিবেশের ভেতরটা পরীক্ষা করার সুযোগ পেলে অতি বড় বুদ্ধিমান মানুষও অবাক হয়ে যাবে। তার ভেতরে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা আছে, রসদখানা আছে, ডিম রাখবার আলাদা মহল আছে, এমনকী পিঁপড়েদের উপযোগী সবজি বাগান পর্যন্ত আছে। কুমার, তুমি বোধহয় জানো না যে, পিঁপড়েরাও গাভী পালন করে। অবশ্য সে গাভীকে, দেখতে আমাদের গাভীর মতো নয়, কিন্তু তারা ‘দুগ্ধ’দান করবে বলেই তাদের পালন করা হয়।’
কুমার সবিস্ময়ে বললে, ‘বলো কী বিমল, এ—সব কথা যে আমার কাছে একেবারে নতুন বলে মনে হচ্ছে!’
‘অথচ এই পিঁপড়েদের উপনিবেশ তোমার ঠিক পায়ের তলাতেই! পৃথিবীতে তুমি নতুনত্বের অভাব বোধ করছ, কিন্তু নিজের পায়ের তলায় কি আছে তার খবর তুমি রাখ না! কেবল তুমি নও, অধিকাংশ মানুষেরই স্বভাব হচ্ছে এইরকম। যাদের জানবার আগ্রহ আছে, জ্ঞানলাভের প্রবৃত্তি আছে, আর দেখবার মতো চোখ আছে, জীবনে তাদের কোনওদিনই নতুনত্বের অভাব হয় না।’
কুমার অপ্রতিভ ভাবে বললে, ‘মাফ করো ভাই বিমল, আমারই ভ্রম হয়েছে। কিন্তু এখন আসল কথাই হোক। নতুনত্ব খুঁজে পাই আর না পাই, তোমার সঙ্গে থাকার চেয়ে আনন্দ আমার আর কিছুই নেই। তাহলে কবে আমরা যাত্রা করব?’
বিমল বললে, ‘যে মাঝির কাছে থেকে সেই দ্বীপ আর সেই দ্বীপবাসীর খবর পেয়েছি, আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সেই—ই। আমার যে মোটরবোট আছে, তাইতে চড়েই আমরা কলকাতা থেকে যাত্রা করব। রাইপুর থেকে মাঝি তার নৌকো নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে। সে প্রথমটা কিছুতেই রাজি হয়নি, টাকার লোভ দেখিয়ে অনেক কষ্টে শেষটা তাকে আমি রাজি করাতে পেরেছি। মাঝি তার নৌকো আর লোকজন নিয়ে রাইপুরেই প্রস্তুত হয়ে আছে, তোমার যদি অসুবিধে না হয়, তাহলে কালকেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।’
কুমার বললে, ‘আমার আবার অসুবিধে কি? কালকেই আমি যেতে পারি।’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ। পুনরাবির্ভাব
মাঝির নাম ছিল কাসিম মিয়া। রাইপুরের ঘাটে মোটরবোট ভিড়িয়ে বিমল ও কুমার তার দেখা পেল।
বিমলকে মোটরবোট ছেড়ে ডাঙায় নামতে দেখে সেও তাড়াতাড়ি জাল—বোনা রেখে নিজের নৌকো থেকে নেমে এল।
বিমল তাকে দেখে শুধোলে, ‘কি মিয়া সায়েব, তোমরা সব তৈরি আছ তো?’
কাসিম সেলাম ঠুকে বললে, ‘হ্যাঁ হুজুর, আমরা সবাই তৈরি। আজকে বলেন, আজকেই যেতে পারি।’
‘তোমার সঙ্গে ক—জন লোক নিয়েছ?’
‘চারজন দাঁড়ি নিয়েছি হুজুর!’
‘কিন্তু এ—যাত্রা দাঁড় বোধহয় তাদের কারুকেই টানতে হবে না! আমাদের বোটই তোমাদের পানসিকে টেনে নিয়ে যাবে। তোমরা খাবে—দাবে আর মজা করে ঘুমোবে।’
কাসিম একটুখানি হাসবার চেষ্টা করে বললে, ‘ঘুমোতে কি আর পারব হুজুর? আমার লোকেরা ভারী ভয় পেয়েছে।’
বিমল আশ্চর্য স্বরে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ভয় পেয়েছে? কেন?’
কাসিম কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বললে, ‘তাদের বিশ্বাস, যেখানে আমরা যচ্ছি সেখানে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না! অছিমুদ্দি মাঝির মুখে তারা শুনেছে, ও—দ্বীপে নাকি ভূত—প্রেত দৈত্য—দানোরা বাস করে। সেই দ্বীপের কাছে গিয়ে তিন—চারখানা নৌকো নাকি আর ফিরে আসেনি। নৌকোয় যারা ছিল তারা কোথায় গেল, তাও কেউ জানে না। জল—ঝড় নেই, অথচ মাঝে—মাঝে ওখানে নাকি অনেকবার নৌকোডুবি হয়েছে! পেটের দায়ে নৌকো চালিয়ে খাই, আপনি ডবল ভাড়া আর তার ওপরে বখশিশের লোভ দেখালেন বলেই আপনাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছি। কিন্তু আগে অছিমুদ্দির কথা শুনলে আমরা এ কাজে বোধহয় হাত দিতুম না।’
বিমল তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাসতে—হাসতে বললে, ‘তুমি এমন জোয়ান—মদ্দ কাসিম মিয়া, তুমিই শেষটা ভয় পেয়ে গেলে নাকি?’
কাসিম বললে, ‘একেবারে ভয় পাইনি বললে মিথ্যে বলা হয় হুজুর। দ্বীপের সেই বুড়োবাবুটিও তো আমাদের ভয় দেখাতে কসুর করেননি! কেন তিনি আমাদের সেখানে রাত কাটাতে মানা করলেন? কেন তিনি বললেন, সেখানে জন্তুর ভয় নয়, ডাকাতের ভয় নয়, অন্য—কিছুর ভয় আছে? অন্য কিসের ভয় থাকতে পারে? আমরা ভেবেচিন্তে কোনও হদিশ খুঁজে পাচ্ছি না!’
বিমল বললে, ‘অত হদিশ খোঁজবার দরকার কী মিয়া সায়েব? একটা কথাই খালি ভেবে দেখো না? সেই বুড়োবাবুটি তো মানুষ, সেখানে যদি অন্য—কিছুর ভয় থাকত, তাহলে কি তিনি নিজে সেই দ্বীপে নামতে সাহস করতেন? অত বাজে ভাবনা ভেব না, সেই দ্বীপে হয়তো এমন কিছু আছে, বুড়োবাবুটি যা অন্য লোককে জানতে দিতে রাজি নন। তাই তিনি, তোমাদের মিথ্যে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন!’
কাসিম বললে, ‘সেখানে অন্য কিছু কি আর থাকতে পারে?’
‘ধরো, হয়তো সেই দ্বীপে গুপ্তধন আছে, আর বুড়োবাবুটি কোনওরকমে তা জানতে পেরেছেন।’
গুপ্তধনের নামেই কাসিমের সারা মুখ সাগ্রহ কৌতূহলে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল! কিন্তু তার পরেই সে আবার নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে বললে, ‘আপনি যা বলছেন তা অসম্ভব নয় বটে! কিন্তু রাক্ষুসে বেড়ালের মতো দেখতে সেই ভূতুড়ে জানোয়ারটার কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন? সেই জানোয়ারটা কোত্থেকে এল? সেই দ্বীপ থেকেই তো?’
বিমল বললে, ‘জানোয়ারটা যে সেই দ্বীপ থেকেই এসেছে এমন কথা জোর করে কিছুতেই বলা যায় না! তোমার নৌকোর সিন্দুকের ভেতরে যে সেই জানোয়ারটাই ছিল এটা তো তুমি আর স্বচক্ষে দেখোনি, আন্দাজ করছ মাত্র! তারপর ধরো, জানোয়ারটা না হয় সেই সিন্দুকের ভেতরেই ছিল! কিন্তু বুড়োবাবুটি তাকে নিয়ে হয়তো সেই দ্বীপ থেকে আসছিলেন না, দ্বীপের দিকেই যাচ্ছিলেন! হয়তো তিনি অন্য কোনও জায়গা থেকে সেই জানোয়ারটাকে ধরে এনেছিলেন। এত—বড় এই সুন্দরবন, এর ভেতরে কোথায় কত অজানা জানোয়ার আছে, তার খোঁজ কি তোমরা রাখো?’
কাসিম যেন অনেকটা আশ্বস্ত হল। সে বললে, ‘আর একটা নতুন খবর আছে হুজুর! সেই বুড়োবাবুটি আবার এখানে এসেছিলেন!’
বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, ‘তাই নাকি! তারপর?’
‘আপনি যেদিন মোহনপুর থেকে চলে যান, ঠিক তার পরের দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই তিনি চিনতে পারলেন। তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে বললেন, ‘কাসিম, তোমাদের এ অঞ্চলে নাকি কী একটা আশ্চর্য জানোয়ার এসে উৎপাত করছে?’ আমি বললুম, ‘হ্যাঁ হুজুর, একটা জানোয়ার এসে এখানে উৎপাত করছিল, বটে, কিন্তু কলকাতার এক বাবু এসে বন্দুক ছুড়ে তার লীলাখেলা সাঙ্গ করে দিয়েছেন!’ শুনেই রাগে তাঁর সারা মুখখানা রাঙা হয়ে উঠল, আর কোনও কথা না বলে হনহন করে তিনি একদিকে চলে গেলেন।’
বিমল বাস্তভাবে বললে, ‘কাসিম, আমরা যে সেই দ্বীপে যাব সে কথা তাঁকে তুমি বলোনি তো?’
কাসিম বললে, ‘আজ্ঞে না হুজুর, বলবার সময়ই পাইনি!’
বিমল হাঁপ ছেড়ে বললে, ‘সেই বাবুটি এখনও এখানে আছেন নাকি?
কাসিম বললে, ‘বোধহয় নেই। কোথায় যে তিনি গেলেন, তারপর থেকে আমরা কেউ আর তাঁকে দেখতে পাইনি।’
বিমল জিজ্ঞাসা করলে, ‘বাবুটিকে কেমন দেখতে বলো দেখি?’
কাসিম বললে, ‘বলেছি তো, খুব লম্বাচওড়া জোয়ান লোক। তাঁর বয়েস ষাট বছরের কম হবে না, কিন্তু তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় এখনও তাঁর গায়ে অসুরের মতো জোর আছে। তাঁর রং শ্যামলা, মাথায় লম্বা সাদা চুল আর মুখে লম্বা—লম্বা সাদা দাড়ি। নাকে ধোঁয়া—রঙের চশমা, সেই চশমার ভেতর থেকে মাঝে—মাঝে মনে হয় তাঁর চোখদুটো যেন দপদপ করে জ্বলছে!’
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, ‘কাসিম, আমার মোটগুলো বোট থেকে নামিয়ে তোমাদের পানসিতে তুলে নাও। আজ বিকালেই আমরা নৌকো ছাড়ব।’
চতুর্থ পরিচ্ছেদ। জ্যোৎস্নাময় জঙ্গলে
পূর্ণিমা রাত। নির্মেঘ নীল আকাশে তারাদের সভা বসেছে আর তারই ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে ভরা জোছনার জোয়ার।
পৃথিবীতেও দুই ধারে যেন পরির হাতে সাজানো নীলবনের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কানায়—কানায় ভরা নদীর জোয়ারের জল। সে—জলস্রোতকে মনে হচ্ছে রুপোলি জোছনার স্রোত।
নির্জনতা যে কত সুন্দর মায়াময় হতে পারে শহরে বসে কেউ তা অনুভব করতে পারে না।
বনে—বনে গাছের ডালে—ডালে সবুজ পাতা—শিশুরা খেলা করছে আলো—ছায়ার ঝিলিমিলি দুলিয়ে—দুলিয়ে এবং নদীর বুকে—বুকে ঢেউ—শিশুরা খেলা করছে হিরে ধারার জাল বুনতে—বুনতে।
এক—একবার ঠান্ডা বাতাসের উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে—আর সঙ্গে—সঙ্গে ঢেউ—শিশু আর পাতা—শিশুরা খুশির হাসিতে চারিদিকের নীরবতা অস্ফুট, অপূর্ব শব্দময় করে তুলছে!
কিন্তু এই বনভূমির মৌনব্রত ভঙ্গ করেছে অনেক ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি। চাঁদের আলোর যে একটি নিজস্ব শান্ত সুর আছে, যা এই নির্জন বনভূমিকে মোহনীয় করে তুলেছে, ওইসব ধ্বনি—প্রতিধ্বনি তার অনেকখানি সৌন্দর্যই নষ্ট করে দিচ্ছে।
বিমলদের মোটরবোটের যন্ত্রের গর্জন এই নিরালায় কী কর্কশ শোনায়!
সেই গর্জন শুনে মাঝে—মাঝে চরের ওপর থেকে জীবন্ত ও ভয়াবহ গাছের গুঁড়ির মতো কি—কতকগুলো জলের ওপর সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে চারিদিক তোলপাড় করে তোলে।
কাসিম বলে ওঠে, ‘হুজুর, কুমির!’
বিমল ও কুমার তা জানে। জলবাসী ওই করাল মৃত্যুর শব্দ তারা আরও অনেকবার শুনেছে।
এক জায়গায় চার—পাঁচটি হরিণ জলপান করছে। কাছেই অরণ্যের অন্তঃপুরে বাঘের ঘন—ঘন হুঙ্কার জেগে উঠল, সঙ্গে—সঙ্গে থেমে গেল ভীত মৃগদের জলপান করার শব্দ।
অরণ্যের মধ্যে দিনে যারা ঘুমায়, সদলবলে জেগে উঠেছে তারা আজ রাত্রে! লক্ষ—লক্ষ কীটপতঙ্গ। জ্যোৎস্নার মুখে কালো অভিশাপের মতো দলে—দলে বাদুড় ও কালো পেচক! কোথাও গাছের ভেতর থেকে ভীরু পাখির দল আর্তনাদ করে উঠল, হয়তো তাদের বাসার ভেতরে এসেছে বিপদজনক কোনও অতিথি।
থেকে—থেকে অদ্ভুত ভূতুড়ে স্বরে ডেকে উঠছে তক্ষকের দল। কোনও গাছের টঙ থেকে যেন একদল অশরীরী ও অমানুষ নরশিশু ককিয়ে কেঁদে উঠল, তারা হচ্ছে বকের ছানা! মাঝে—মাঝে অস্বাভাবিক স্বরে ব্যাং চিৎকার করে উঠছে—এ আর কিছু নয়, সর্পের কবলগত হয়ে হতভাগ্যের প্রবল অথচ ব্যর্থ প্রতিবাদ!
এই চন্দ্রকিরণের রাজ্য দিয়ে, এই বনস্পতিদের তপোবন দিয়ে, এই ধ্বনি—প্রতিধ্বনির জগৎ দিয়ে, জলের বুকে ফেনার আলপনা কাটতে—কাটতে তীব্র গতির বেগে উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে বিমলদের মোটরবোট।
চারিদিকের দৃশ্য দেখতে—দেখতে, চারিদিকের শব্দ শুনতে—শুনতে বিমল হঠাৎ বলে উঠল, ‘শোনো কুমার, কান পেতে শোনো! মহাকাল এই নির্জন অরণ্যে একলা বসে জীবন—সংগ্রামের অনন্ত ইতিহাস নিজের মনেই উচ্চস্বরে পাঠ করে যাচ্ছেন! কবিরা বনে এসে বিজনতা আর নীরবতার সন্ধান পান। কিন্তু এই মিষ্ট চাঁদের আলোয়, এই অরণ্যের অন্তঃপুরে এসে, তুমি কি মৃত্যুর নিষ্ঠুর রথচক্রের ধ্বনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছ না? এ বন নির্জন বটে, কিন্তু এখানকার অন্ধকারের অন্তরালে বসে কত কোটি কোটি কীটপতঙ্গ আর জীবজন্তু জীবনযুদ্ধের চিরন্তন নিষ্ঠুরতায় অশ্রান্ত আর্তনাদ করছে—কত দুর্বল কত সবলের কবলে পড়ে অত্যাচারিত হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে কত সহস্র জীবনের প্রাণ নষ্ট হচ্ছে! আমরা মানুষ, আমরা হচ্ছি নগরবাসী সামাজিক জীব, প্রতিপদে আমাদেরও আত্মরক্ষা করতে হয় বটে,—কিন্তু সে হচ্ছে অন্য নানান কারণে। জীবনের ভয় যে সেখানে নেই এমন কথা বলি না, কিন্তু এখানকার তুলনায় সেখানকার নীতি হচ্চেচ স্বর্গীয় নীতি। সেখানেও বিপদ আছে বটে, কিন্তু সে বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে আমরা প্রায়ই সাবধান হতে পারি। আর এখানকার নীতি কী? এখানকার একমাত্র নীতি হচ্ছে—হয় মরো, নয় মারো! জীবন আর মৃত্যু নিয়ে এখানে চিরদিনের এক নির্দয় খেলা চলছে। যে অপরকে মারতে পারবে না, এখানে তাকে অপরের হাতে মরতেই হবে! এ অরণ্য হচ্ছে এক মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র—যে যুদ্ধে কোনওদিন সন্ধি নেই, শান্তি নেই। চারিদিকে ওই যে ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি জেগে রয়েছে, ওর ভেতর থেকে আমি খালি এক কঠিন বাণীই শুনতে পাচ্ছি—হয় মরো, নয় মারো! এখানকার আকাশের নীলিমার মধুরিমা, চাঁদের আলোর ঝরনা, সবুজ পাতার গান আর নদীর কলতান যার মনে স্বপ্ন আর কবিত্ব সঞ্চার করবে সে নিরাপদ থাকতে পারবে না এক মুহূর্তও! বুঝেছ কুমার, এখানে এসে আমাদেরও সজাগ হয়ে সর্বদা এই মন্ত্রই জপ করতে হবে—হয় মরো, নয় মারো! কবিরা বনের নিষ্ঠুর ধর্ম ভালো করে জানেন না, কবিতার অরণ্যে তাই আমরা কেবল মাধুর্যকেই দেখতে পাই।’
কুমার হাসতে—হাসতে বললে, ‘আমার বন্দুক তৈরি আছে বন্ধু! বলো, কাকে মারতে হবে? ওই চন্দ্রকিরণকে, না কাসিম মিয়াকে?’
বিমল একটা হাই তুলে মুখের কাছে তুড়ি দিতে—দিতে বললে, ‘তুমি তৈরি আছ শুনে সুখী হলুম। থাক, আজকের মতো চাঁদের আলো আর কাসিম মিয়াকে অব্যাহতি দাও, এসো, এখন বিছানা পেতে ফেলে হাত—পা ছড়ানো যাক।’
পরদিন সকালে বোটের কামরায় বসে স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে বিমল চা—পানের আয়োজন করছিল।
কুমার বাইরে বসে দুই ধারের দৃশ্য দেখছিল।
দৃশ্যের কিছুই পরিবর্তন হয়নি, কেবল চাঁদের আলোর বদলে সূর্য এসে এখন দিকে—দিকে কাঁচা সোনার জল ছড়িয়ে দিচ্ছে। নদীর দুই তীরে সবুজ বন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার ভেতর থেকে রাত্রের সেই ভয়ানক ধ্বনি—প্রতিধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। বোট একদিকের তীর ঘেঁষে যাচ্ছিল, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই বনের ভেতরে গাছপালারা এমন নিবিড় ভাবে পরস্পরের সঙ্গে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে, বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই নজরে আসে না। মাঝে—মাঝে যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানটাকে দেখাচ্ছে ঠিক জলাভূমির মতো। সেখান দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে গেলে এক কোমর কর্দমাক্ত জল ভেঙে অগ্রসর হতে হয়। সেই কর্দমাক্ত জলের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে নলখাগড়ার দল। দূরে—দূরে বনের শিয়রে—শিয়রে দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মতো বাষ্পের মেঘ।
এক জায়গায় দেখা গেল, কুৎসিত দেহের আধখানা ডাঙার ওপরে তুলে প্রকাণ্ড একটা কুমির স্থিরভাবে রোদ পোয়াচ্ছে। এত—বড় কুমির, কুমার আর কোনওদিন দেখেনি। তার বন্দুকটা পাশেই ছিল, সে আস্তে—আস্তে সেটা তুলে নিয়ে কুমিরের দিকে নিজের লক্ষ্য স্থির করলে।
বিমল তখন দুটো চায়ের পেয়ালা হাতে করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, কুমারের অবস্থা দেখে সেও কুমিরের দিকে দৃষ্টি ফেরালে। তারপর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘থামো কুমার, বন্দুক ছুড়ো না!’
কুমার একটু আশ্চর্য হয়ে বন্দুক নামিয়ে বললে, ‘কেন?’
বিমল বললে, ‘কুমিরের ঠিক ওপরে গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে দেখো। এখন রাত নেই, কিন্তু জীবন—যুদ্ধের জের এখনও চলেছে।’
কুমার সেইদিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে দেখলে, একটা প্রকাণ্ড গাছের ডাল জড়িয়ে মস্ত এক অজগর সাপ স্থিরভাবে কুমিরকে লক্ষ করছে। হঠাৎ তার মাথাটা ডাল থেকে একটুখানি নীচে নেমে পড়ল, তারপর দু—একবার এদিকে—ওদিকে দুলতে লাগল—এবং তার পরেই ঠিক বিদ্যুতের ঝড়ের মতো তার দেহটা একেবারে কুমিরের ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ল! তারপর সমস্ত জল তোলপাড় করে যে দৃশ্য শুরু হল ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না! কুমির চায় তার বলিষ্ঠ লাঙ্গুলের প্রচণ্ড ঝাপটা মেরে অজগরকে কাবু করে জলে ডুব দিতে, আর অজগর চায় পাকে—পাকে কুমিরকে ক্রমেই বেশি করে জড়িয়ে ডাঙার ওপরে টেনে তুলতে।
এই বন্য নাটকের শেষ দৃশ্য দেখবার আগেই বোটখানা নদীর একটা মোড় ফিরে আড়ালে গিয়ে পড়ল।
কুমার বললে, ‘কুমিরটাকে আমি মারতে পারতুম, অজগরটাকেও পারতুম! কিন্তু বিমল, প্রকৃতির অভিশাপ যাদের ওপরে এসে পড়েছে, তাদের কারুকে মারতে আমার হাত উঠল না। ওরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা পূরণ করুক।’
বিমল বললে, ‘এখন বন্দুক রেখে চা খাও! তারপর এসো, কাসিম মিয়ার সঙ্গে একটু কথা কওয়া যাক। ওরা আজ সকাল থেকে মাছ ধরতে বসেছে দেখছি।’
পানসি থেকে বিমলের কথা শুনতে পেয়ে কাসিম বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হুজুর, হাতে কোনও কাজ নেই, কী আর করি বলুন?’
বিমল বললে, ‘মাছটাছ কিছু ধরতে পেরেছ নাকি কাসিম?’
‘ধরেছি হুজুর! দুটো মাছ ধরেছি।’
‘বেশ, বেশ, আমাদের দু—একটা উপহার দিও। কিন্তু বলতে পারো কাসিম, সে দ্বীপে গিয়ে পৌঁছতে আমাদের আরও কত দেরি লাগবে?’
কাসিম বললে, ‘আমাদের পানসিতে দাঁড় টেনে গেলে সেখানে পৌঁছতে হয়তো আরও দু—দিন লাগত। কিন্তু আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওই বিলিতি বোট, বোধহয় আজ রাতেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাব।’
দুপুর গেল, বিকাল গেল, সন্ধ্যার পর আবার রাত এল। আকাশ থেকে আবার প্রতিপদের চাঁদের সাজি চারিদিকে আলোর ফুল ছড়াতে লাগল, অরণ্যের মর্মরধ্বনি ও নদীর জলকল্লোল আবার স্পষ্টতর হয়ে উঠল, বনভূমির ভেতর থেকে আবার স্ফুট ও অস্ফুট বিচিত্র সব ধ্বনি—প্রতিধ্বনি শোনা যেতে লাগল—চারিদিকে আবার অন্ধকারের আবছায়ায় নানা বিভীষিকার সাড়া পাওয়া গেল।
নদী ক্রমেই চওড়া হয়ে উঠছে, দুই তীরের বন—রেখা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।
কাসিম বললে, ‘হুজুর, আমরা সুমুদ্দুরের কাছেই এসে পড়েছি।’
আরও ঘণ্টাখানেক পরে নদীর দুই তীর এত দূরে সরে গেল যে, বনের ভেতরকার শব্দ আর বড় কানে আসে না। সেখানে শোনা যায় চারদিক—আচ্ছন্ন করা কেবল নদীর অশ্রান্ত কোলাহল। এ যেন নদী—কল্লোলের পৃথিবী!
সেই কোলাহলের ভেতরে দূর থেকে আর একটা শব্দ বিমল ও কুমারের কানে ভেসে এল।
সে শব্দ কাসিমও শুনেছিল। সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল, ‘হুজুর, ও আবার কিসের আওয়াজ?’
বিমলও কান পেতে শুনতে লাগল। শব্দটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে,—তার মানে শব্দটা ক্রমেই তাদের কাছে এগিয়ে আসছে!
বিমল গম্ভীর স্বরে বললে, ‘কাসিম, আমাদের মতো আর একখানা মোটরবোট এই দিকে আসছে। ও তারই শব্দ!’
কুমার বললে, ‘ওটা যে মোটরবোটের শব্দ তাতে আর কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন অসময়ে এখানে কার ও মোটরবোট? হ্যাঁ কাসিম, এখান দিয়ে প্রায়ই কি এইরকম নৌকো আর মোটরবোট আনাগোনা করে?’
কাসিম বললে, ‘না হুজুর, এখান দিয়ে নৌকো আনাগোনা করে না। সেই বুড়ো বাবুটি পথ দেখিয়ে নিয়ে না এলে আমরা কোনওদিনই এদিকে আসতুম না।’
বিমল বললে, ‘কাসিম, তাহলে ওই মোটরবোটে চড়ে আসছেন তোমাদেরই সেই বুড়োবাবুটি!’
কাসিম বললে, ‘হতে পারে হুজুর, আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলুম, সেই বুড়োবাবুটি আবার রাইপুরে গিয়েছেন। হয়তো তিনিই ফিরে আসছেন।’
বিমল বললে, ‘তোমাদের সেই বুড়োবাবু রোজ এদিকে ফিরে আসুন, আমাদের তাতে কোনওই আপত্তি নেই! কিন্তু আজ তিনি আমাদের যাতে এইখানে দেখতে না পান, এখনি এমন কোনও ব্যবস্থা করতে হবে।’
কুমার বললে, ‘কিন্তু এই খোলা নদীতে লুকোতে গেলে নৌকোশুদ্ধ পাতালপ্রবেশ ছাড়া আমাদের তো আর কোনও উপায় নেই!’
বিমল বললে, ‘উপায় বোধহয় আছে কুমার! মাইলখানেক তফাতে ছোট একটা চরের মতো কী যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না?’ মোটাবোট যে চালাচ্ছিল তার দিকে ফিরে সে বললে, ‘ওহে, জোরে চালাও, খুব জোরে!’
বোটের গতি তখন দ্বিগুণ বেড়ে উঠল এবং মিনিট কয়েক পরেই তারা একটা চরের কাছে এসে পড়ল।
গঙ্গাসাগরের কাছে সুন্দরবনের অসংখ্য নদীর ভেতরে এই রকম সব ছোট—ছোট চর দেখা যায়। বছরের অন্যান্য সময়ে এই চরগুলো জলের ওপরে জেগে থাকে, তার বুকে ঝোপঝাপ ও জঙ্গলের আবির্ভাব হয় এবং দূর থেকে তাদের দেখায় এক একটা ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো। কিন্তু বর্ষার সময়ে নদীর জল যখন বেড়ে ওঠে তখন এইসব চরের কোনও চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
তাদের বোট এইরকম একটা চরের কাছেই এসে পড়েছিল। এখানে ঝোপঝাপ ও বনজঙ্গলের কোনও অভাব ছিল না।
বিমল বললে, ‘আরও এগিয়ে মোড় ফিরে বোটখানাকে চরের ওপাশে নিয়ে চলো। ঝোপের আড়ালে গিয়ে পড়লে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না।’
বোটের চালক বিমলের কথামতোই কাজ করলে।
বিমলদের বোট দ্বিগুণ বেগে এগিয়ে এসেছিল বলে পিছনের বোটের ইঞ্জিনের আওয়াজ তখন আর শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু খানিক পরেই সেই শব্দটা ধীরে—ধীরে আবার জেগে উঠল।
কুমার বললে, ‘বিমল, আমরা যখন ও—বোটের শব্দ শুনতে পেয়েছি, তখন ওরাও যে আমাদের শব্দ শুনতে পায়নি এমন কথা বলা যায় না।’
বিমল চিন্তিত ভাবে বললে, ‘তা যদি পেয়ে থাকে তাহলে ভাবনার কথা।’
কুমার বললে, ‘ভাবনা কিসের?’
‘তুমি তো শুনেছ কুমার, দ্বীপের ওই ভদ্রলোক চান না যে আর কেউ তাঁর ওখানে গিয়ে ওঠে। আমরা এসেছি শুনলে তিনি খুশি হবেন বলে মনে হচ্ছে না।’
পিছনের মোটরবোটের শব্দ তখন খুব কাছেই এসে পড়েছে। কিন্তু চরের কাছে এসেই শব্দটা থেমে গেল।
বিমল মৃদুস্বরে বললে, ‘কুমার, তোমার সন্দেহই সত্য। ওরা আমাদের বোটের শব্দ নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে। তাই ওরা বোট থামিয়ে লক্ষ করছে, আমরা কোথায় মিলিয়ে গেলুম।’
কুমার বললে, ‘ওরা যদি এদিকে আমাদের খুঁজতে আসে?’
‘খুঁজতে যদি আসে তাহলে উপায় কী? তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ করতেই হবে।’
‘তুমি কি কোনওরকম বিপদের ভয় করছ বিমল?’
‘বিপদ? বিপদের ভয় আছে কিনা ঠিক বলতে পারি না, তবে এখানে আমাদের দেখতে পেলে ওই বোটের লোকেরা হয়তো আমাদের নতুন জামাই বলে ভ্রম করবে না। কুমার, সকলের চোখের আড়ালে যারা লুকিয়ে এমন জায়গায় বাস করে, তারা খুব ভালোমানুষ বলে মনে হয় না।’
কুমার আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি নিজের বন্দুকটা টেনে নিলে।
বিমল বললে, ‘আমারও বন্দুকটা এগিয়ে দাও,—সাবধানের মার নেই।’
কাসিম ভীত স্বরে বললে, ‘হুজুর, আমরা কী করব?’
বিমল বললে, ‘তোমরা আপাতত চুপ করে নৌকোর ভেতরে বসে থাক। দরকার হলে আমি তোমাদের ডাকব।’
সেই অজানা মোটরবোটের শব্দ আবার জেগে উঠল।
কুমার বন্দুকটা পরীক্ষা করতে—করতে চুপিচুপি বললে, ‘বিমল, বোধহয় ওরা এইদিকেই খুঁজতে আসছে।’
বিমল বললে, ‘খুব সম্ভব তাই—’