অষ্টম পরিচ্ছেদ । এ অঞ্চলের জানোয়ার
যে মুল্লুকের মানুষ-জানোয়ারের কথা নিয়ে এত আলোচনা করছি, সেখানে জলে-স্থলে আসল জানোয়ারও আছে অনেক রকম। মাঝখানে একটুখানি হাঁপ ছাড়বার জন্যে তাদের কারুর কারুর কথা এখানে কিছু বলতে চাই।
এখানে স্থলে থাকে অজগর, জাগুয়ার, পুমা, বানর, টেপির, প্রবাল সাপ, অন্ধ সাপ, আর্মাডিলো, ভ্যাম্পায়ার বাদুড় প্রভৃতি এবং জলে থাকে কুমির, হাঙর, লণ্ঠন মাছ, ব্যাঙ মাছ, কাছিম, শুশুক, অক্টোপাস, খুনে তিমি, স্কুইড, উকো মাছ, ছিপধারী মাছ, পাইপ মাছ, সিল, উড়ন্ত মাছ, ফিতে মাছ, এবং অন্যান্য তিমি জাতীয় মাছ প্রভৃতি,—সব জীবজন্তুর ফর্দও এখানে দেওয়া অসম্ভব। এদের মধ্যে অনেক জন্তুই খোশমেজাজে ও বোম্বেটেদের চেয়ে কম হিংসুটে নয়, একটু সুবিধা পেলেই মানুষকে ফলার করবার জন্যে তারা হাঁ-করে ছুটে আসে!
দু-একটা জন্তুর ভীষণ প্রকৃতির কথা এখানে বলব।
এখানে যে জাতের কুমির পাওয়া যায়, তাদের ‘কেম্যান’ বলে ডাকা হয়। ভারতীয় কুমিরের সঙ্গে তাদের চেহারা ও প্রকৃতি ঠিক মেলে না। বোম্বেটেরা এইসব কুমিরের ভয়ে সর্বদাই তটস্থ হয়ে থাকত। একজন বোম্বেটে এই ‘কেম্যান’ সম্বন্ধে যা বলছে তা হচ্ছে এই।
‘এই সব কেম্যান ভয়ংকর জীব। সময়ে সময়ে এক-একটা সত্তর ফুট লম্বা কেম্যানও দেখা গিয়েছে। নদীর ধার ঘেঁষে এমন নিশ্চেষ্ট হয়ে তারা ভাসতে থাকে যে দেখলেই মনে হয়, যেন একটা পুরোনো গাছ পড়ে গিয়ে জলে ভাসছে। সেই সময়ে কোনও গরু কি মানুষ নদীর ধারে এলে আর তার বাঁচোয়া নেই!
এদের দুষ্টুবুদ্ধিও বড় কম নয়। শিকার ধরবার আগে তিন-চারদিন ধরে এরা উপোস করে। সেই সময়ে ডুব মেরে নদীর তলায় গিয়ে কয়েক মণ পাথর বা নুড়ি গিলে ফেলে এরা নিজেদের দেহ আরও বেশি ভারী করে তোলে। ফলে তাদের স্বাভাবিক শক্তি অধিকতর বেড়ে ওঠে।
কেম্যানরা শিকার ধরে টাটকা মাংস খায় না। আধপচা না হওয়া পর্যন্ত তাদের জলের তলায় ডুবিয়ে রাখে। তাদের আরও অদ্ভুত রুচি আছে। এখানকার লোকেরা নদীর কাছাকাছি জায়গায় যদি মরা জন্তুর চামড়া শুকোবার জন্যে রেখে দেয়, তাহলে কেম্যানরা প্রায়ই ডাঙায় উঠে সেগুলো চুরি, করে নিয়ে পালায়। সেই চামড়াগুলো কিছুদিন জলে ভিজলেই তাদের লোমগুলো ঝরে পড়ে যায়। তখন তারা সেগুলো খেয়ে ফেলে।
একদিন একজন লোক নদীর জলে তার তাঁবু কাচছিল। হঠাৎ একটা কেম্যান এসে সেই তাঁবু কামড়ে ধরে জলে ডুব মারবার চেষ্টা করলে। সে ব্যক্তি অত সহজে তাঁবু খোয়াতে নারাজ হল—তাঁবুর একদিক ধরে প্রাণপণে টানাটানি করতে লাগল। বাধা পেয়ে কেম্যানের মেজাজ গেল চটে। সে এক ডিগবাজি খেয়ে জল থেকে ডাঙায় উঠে তাঁবুর অধিকারীকেও নিয়ে নদীর মধ্যে ডুব মারবার ফিকির করলে।
ভাগ্যে লোকটির কাছে একখানা বড় কসাই-ছুরি ছিল এবং ভাগ্যে সে কেম্যানের দেহের ঠিক জায়গায় ছুরিখানা দৈবগতিকে বসিয়ে দিতে পারলে, তাই লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে সেই জলদানব তখনই খাবি খেতে বাধ্য হল! তার পেট ফেঁড়ে পাওয়া গেল রাশি রাশি বড় বড় নোড়ানুড়ি!
কেবল বড় বড় জীব নয়, কেম্যানরা পুঁচকে মাছি পেলেও টপ করে খেয়ে ফেলতে ছাড়ে না।
কেম্যানরা ডাঙায় উঠে ডিম ছাড়ে এবং ডিমগুলোর উপরে পা দিয়ে বালি ছড়িয়ে দেয়। রোদের আঁচে ডিম ফোটে, এবং বাচ্চাগুলো ডিম ছেড়ে বেরিয়েই জলের ভিতরে চলে যায়। পাখিরা অনেক সময়ে ডিম নষ্ট করে। মা কেম্যান সেদিকেও নজর রাখতে ভোলে না। পাখির ঝাঁক আসবার সম্ভাবনা দেখলে প্রায়ই তারা নিজেদের ডিম আবার কোঁৎ কোঁৎ করে গিলে ফেলে! তারপর বিপদ কেটে গেলে ডিমগুলোকে ফের হড়াৎ করে উগরে বার করে দেয়!
ডিম ফুটলে মা কেম্যান তার বাচ্চাদের নিয়ে জলে খেলা করে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, খেলা করতে করতে বাচ্চা কেম্যানরা তাদের মায়ের মুখের ভিতর দিয়ে পেটের ভিতরে গিয়ে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে আসছে!
নদীপ্রধান জায়গায় আড্ডা গাড়তে হলে এই কেম্যানদের ভয়ে সব সময়েই আমরা ব্যস্ত থাকতুম। রাত্রে কারুকে পাহারায় না রেখে ঘুমোতে পারতুম না।
আমাদের দলের একজন লোক একবার তার কাফ্রি চাকরের সঙ্গে বনের ভিতরে ঢুকেছিল। কোথায় কোন ঝোপে একটা পাজি কেম্যান ঘুপটি মেরে ছিল, হঠাৎ সে বেরিয়ে এসে লোকটির একখানা পা কামড়ে ধরে মাটিতে পেড়ে ফেললে। তাই না দেখেই কাফ্রি চাকরটা—সাহায্য করা দূরে থাক—টেনে লম্বা দিলে।
আমাদের বন্ধু ভীরু ছিল না, বিপদে পড়ে ভেবড়ে গেল না। তার গায়ে জোরও ছিল যথেষ্ট, যদিও সে-জোর কেম্যানের পাল্লায় পড়ে বেশি কাজে লাগল না। কিন্তু সে তার লম্বা ছুরিখানা নিয়ে কেম্যানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। এ যুদ্ধ ডাঙায় হচ্ছিল বলেই রক্ষা, তাই খানিকক্ষণ যোঝাযুঝির পরে অনেকগুলো ছুরির ঘা খেয়ে কেম্যানটা ছটফট করতে করতে মারা পড়ল। আমাদের বন্ধুর সর্বাঙ্গ তখন ক্ষতবিক্ষত। রক্তপাতে নেহাত দুর্বল হয়ে সেইখানেই মড়ার মতো পড়ে রইল।
এতক্ষণ পরে কাফ্রিবীরের মনে হল, তার মনিবের অবস্থাটা কীরকম, একবার উঁকি মেরে দেখে আসা উচিত! তার মনিবের দেহ কেম্যানের উদরে অদৃশ্য হয়ে যায়নি দেখে সে আশ্বস্ত হয়ে তাকে পিঠে তুলে নিয়ে প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে আমাদের কাছে এসে হাজির হল। আমরা তখনই তাকে জাহাজে নিয়ে এলুম।
এই বদমাইশ কেম্যানরা প্রায়ই আমাদের জাহাজের কাছে আসত এবং জাহাজের গায়ে আঁচড়া-আঁচড়ি করত। একদিন দড়িতে লোহার হুক লাগিয়ে আমরা একটা মস্ত কেম্যান ধরলুম। ধরা পড়ে সে কিন্তু জলের দিকে গেল না, উলটে জাহাজের মই বেয়ে উপর দিকেই উঠতে লাগল! তখন আমরা ব্যস্ত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার দফা একেবারে রফা করে দিলুম!’
ও মুল্লুকে খোলা হাওয়ায় রাত্রে কি ঘুমিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়ার যো আছে? ওখানে রাত্রে পিশাচবাদুড়রা শিকার খোঁজে! তারা এমন চুপিসাড়ে এসে মানুষের গায়ে ক্ষুরধার দাঁত দিয়ে ছ্যাঁদা করে রক্ত টেনে নেয় যে, মানুষের ঘুম প্রায়ই ভাঙে না। আর না ভাঙাই ভালো! কারণ রক্তপানের পর ওই পিশাচবাদুড়েরা লালা দিয়ে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধ করে দিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ বাধা পেয়ে তারা যদি উড়ে যেতে বাধ্য হয়, তাহলে ক্ষতের রক্তপড়া আর সহজে বন্ধ হতে চায় না। পিশাচবাদুড়ের লাল কেবল রক্ত বন্ধ করে না, ক্ষতস্থান বিষিয়ে উঠতেও দেয় না।
এ-দেশে বাঘ জাতীয় জন্তুদের মধ্যে জাগুয়ার আর পুমাই প্রধান। জাগুয়ার পুমার চেয়ে আকারে বড় হয় এবং তার প্রকৃতিও বেশি হিংস্র। তারা প্রায়ই মানুষকে আক্রমণ করতে ছাড়ে না। তাদের আক্রমণ আরও বিপজ্জনক এইজন্যে যে, তারা গাছের ডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকে এবং তাদের কখন যে কার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার বিদঘুটে শখ হবে, আগে থাকতে তা জানতে পারা যায় না।
পুমারাও গাছে চড়তে পারে। ব্রেজিলে তাদের ‘কাউগার’ বলে ডাকা হয়। উত্তর আমেরিকায় তাদের আর একটা নাম—’পেন্টার’। ‘পুমা’ হচ্ছে পেরু দেশীয় নাম—যদিও ওই নামই বেশি চলে। তারা ল্যাজসুদ্ধ লম্বা হয় ছয় থেকে নয়ফুট পর্যন্ত।
পুমারা সবচেয়ে খেতে ভালোবাসে ঘোড়ার মাংস। অভাবে গরু, মোষ, শূকর, হরিণ, ভেড়া, খরগোশ—এমনকী ইঁদুর ও শামুক পর্যন্ত! বানরও তাদের মনের মতো। বানরা এ-গাছ থেকে ও-গাছে লাফিয়েও পার পায় না, কারণ গাছে গাছে লাফালাফি করতে বানরদের চেয়ে পুমারাও কম তৎপর নয়। মাটি থেকে বিশ ফুট উঁচুতে লাফিয়ে পুমারা গাছের ডালে চড়তে পারে! দীর্ঘ লম্ভে তারা প্রায় চল্লিশ ফুট জমি পার হয়ে যায়!
কিন্তু মানুষের পক্ষে পুমা মোটেই বিপজ্জনক নয়। কারণ তারা মানুষকে সহজেই কাত করে ফেলতে পারলেও সাধারণত মানুষকে তেড়ে আক্রমণ করে না। এমনকি, অনেক সময়ে মানুষ তাকে আক্রমণ করলেও সে আত্মরক্ষার চেষ্টা পর্যন্ত করে না! অথচ এই পুমা তার চেয়ে বড় ও হিংস্র জীব জাগুয়ারকেও আক্রমণ করে।
মধ্য অমেরিকার এক কাঠুরে একদিন জঙ্গলে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা পুমা ল্যাজ তুলে বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এবং আদুরে বিড়ালের মতো ঘড়র ঘড়র শব্দ করতে করতে সেই কাঠুরের পায়ের ফাঁক দিয়ে খেলাচ্ছলে আনাগোনা করতে লাগল! কিন্তু সেই পুমা বেচারার অদৃষ্ট ছিল নেহাত মন্দ। কারণ কাঠুরে এমন ভয় পেলে যে, তার কুড়ুলের বাড়ি পুমাকে দিলে এক ঘা বসিয়ে! পুমা তখন সেই বদরসিকের কাছ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হল।
হাডসন সাহেব বলেন, ‘আমি একবার একটা পুমাকে বধ করে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলুম। তাকে ধরেছিলুম আমি গলায় ফাঁসকল লাগিয়ে। সে একটা পাথরে ঠেসান দিয়ে চুপ করে বসে রইল। আমি যখন ছোরা তুললুম সে পালাবার চেষ্টা পর্যন্ত করলে না। তাকে দেখে মনে হল, আমি যে তাকে বধ করব সে যেন তা বুঝতে পেরেছে! সে কাঁপতে লাগল, তার দু-চোখে জল ঝরতে লাগল, সে করুণস্বরে আর্তনাদ করতে লাগল। তাকে বধ করার পর আমার মনে হল আমি যেন হত্যাকারী!’
রেড ইন্ডিয়ানরা কিছুতেই পুমাকে মারতে চায় না। তাদের বিশ্বাস, পুমাকে বধ করলে সেই মুহূর্তেই মানুষের মৃত্যু হয়। রেড ইন্ডিয়ানরাই হচ্ছে আমেরিকার আদিম অধিবাসী। তারা পুমাকে মারে না বলেই বোধহয় পুমাও মানুষকে হিংসা করতে অভ্যস্ত হয়নি।
গরিলার মতো বড় জাতের বানর পৃথিবীতে আর নেই বলে শোনা যায়। কিন্তু হালে দক্ষিণ আমেরিকায় টাররা নদীর ধারে অদ্ভুত ও বৃহৎ এক অজানা জাতের বানরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
একদল লোক নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছিল, আচম্বিতে দুটো প্রকাণ্ড বানর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তাদের আক্রমণ করে। একটাকে তারা গুলি করে মেরে ফেললে এবং অন্যটা আবার জঙ্গলের আড়ালে পালিয়ে গেল। যেটা মারা পড়ল সেটা স্ত্রীজাতীয় বানর হলেও তার মাথার উচ্চতা পাঁচফুটেরও বেশি। এর থেকেই বোঝা যায়; এ জাতের নর-বানররা মাথায় আরও বেশি ঢ্যাঙা। এই অদ্ভুত জীব অনেকটা গরিলার মতো দেখতে হলেও গরিলা নয় মোটেই। পণ্ডিতরা বলছেন, এর মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি জীব! এই নতুন আবিষ্কার জীবতত্ববিদদের মধ্যে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। পণ্ডিতরা বহুদিন ধরে মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি জীবের সন্ধান করে আসছেন, হয়তো এরা তাঁদের চিন্তার খোরাক জোগাবে। এদের গায়ের জোর কত, আজও সে পরীক্ষার সুবিধা পাওয়া যায়নি, তবে শক্তিতে হয়তো এরাও গরিলার চেয়ে কম যায় না।