অষ্টম পরিচ্ছেদ । আবার ইতিহাস
আলেকজান্ডার কী উপায়ে উত্তরভারতের পশ্চিম অংশ জয় করেছিলেন, সে ইতিহাস এখানে সবিস্তারে বলবার দরকার নেই। ইস্কুলের প্রত্যেক ছেলেই সে কাহিনির সঙ্গে পরিচিত। আমরা কেবল এখানে গুটিকয় ইঙ্গিত দিতে চাই।
পূর্ব পরিচ্ছেদে চন্দ্রগুপ্তের যে ভবিষ্যদ্বাণী বলা হয়েছে, তাই-ই সত্য হল! যুদ্ধরীতিতে পরিপক্ক আলেকজান্ডার মহারাজা পৌরব বা পুরু আগমনের আগেই হস্তীকে আক্রমণ করলেন। ছোট রাজ্যের রাজা হস্তী, সৈন্যবল তাঁর সামান্য, বিপুল গ্রিক-বাহিনীর অগ্রগতিতে বাধা দেবেন কেমন করে? তবু তিনি অসম্ভবও সম্ভব করেছিলেন, বালির বাঁধে সমুদ্রকে ঠেকিয়ে রাখার মতো সুদীর্ঘ একমাসকাল গ্রিকদের এগুতে দেননি ভারতের বুকের ভিতরে!
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এর মধ্যে মহারাজ পুরু প্রস্তুত হতে পারলেন না।
কেবল স্বদেশপ্রীতি ও বীরত্বের দ্বারা যুদ্ধজয় করা যায় না, অসংখ্য শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্যে চাই প্রচুর সৈন্যবল—মহারাজ হস্তীর যা ছিল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল, মহাসাগরে মিলিয়ে গেল ক্ষুদ্র নদী,—গ্রিকদের সম্মিলিত কণ্ঠের জয়নাদে ভারত প্রান্তের আকাশ-বাতাস, পাহাড়, নগর, অরণ্য কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। এর পর মহাবীর হস্তীর পরিণাম কী হল ইতিহাস সে সম্বন্ধে নীরব। খুব সম্ভব, যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তাক্ত তরবারি নাচিয়ে তিনি বীরের কাম্য মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।
হতভাগ্য দেশ ভারতবর্ষ! এমন এক ঐতিহাসিক বীরের নির্ভীক নিঃস্বার্থ আত্মদানের কাহিনি আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। রাজা হস্তী অন্য দেশে জন্মালে যুগে যুগে শত শত কবি ও ঔপন্যাসিকের কল্পনা তার অমর নাম নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। কোথায় দিগবিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সর্বজয়ী বিরাট বাহিনী, আর কোথায় এক ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজা হস্তীর মুষ্টিমেয় সৈন্যদল! পতঙ্গ যেন মাতঙ্গকে একমাস শক্তিহীন করে রেখেছিল। এই আশ্চর্য বীরত্বগাথা আমরা শুনতে পেয়েছি কেবল গ্রিক ঐতিহাসিকের মুখেই। কিন্তু ভারতের কেউ তাঁর নাম মনে রাখেনি, অথচ ভারতের নির্ভরযোগ্য সত্যিকার ঐতিহাসিক যুগে সর্বপ্রথম বীর হচ্ছেন মহারাজা হস্তী! তাঁর আগে পঞ্চপাণ্ডব, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ প্রভৃতি বীরের কথা আমরা শুনি বটে, কিন্তু তাঁরা ঐতিহাসিক যুগের কেউ নন। কবির কল্পনা বলে কেউ তাঁদের উড়িয়ে দিলে জোর করে প্রতিবাদ করবার উপায় নেই।
অভিসারের মহারাজাও পুরুর সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে সৈন্য সংগ্রহ করছিলেন, কিন্তু মহারাজা হস্তীর পরিণাম দেখে ভয়ে ভয়ে তিনি আলেকজান্ডারের সঙ্গে সন্ধি করে ফেললেন।
আলেকজান্ডার সীমান্তের কোনও রাজাকেই অন্য রাজাদের সঙ্গে মিলে শক্তিবৃদ্ধি করতে দিলেন না, নিজের বৃহত্তর বাহিনী নিয়ে একে একে তাদের প্রত্যেককেই পরাস্ত করলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকরা এই সব হিন্দু রাজা ও রাজ্যের নাম করেছেন বটে, কিন্তু বিদেশি ভাষার কবলে পড়ে ওই সব নাম এতটা বিকৃত হয়েছে যে, সেগুলিকে ভারতীয় নাম বলে চেনার কোনও উপায়ই নেই। বড় বড় পণ্ডিতও এ-কাজে হার মেনেছেন।
তবে অসংখ্য সৈন্যের অধিকারী হয়েও আলেকজান্ডারের ভারতীয় যুদ্ধযাত্রা মোটেই নিরাপদ হয়নি। তিনবার তাঁকে আহত হতে হয়েছিল। প্রথম দুইবার ভারতের উত্তর সীমান্তে এবং শেষবার মূলতানে—যখন তিনি ভারতজয়ের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে স্বদেশে প্রস্থান করেছিলেন। শেষবারের আঘাত এমন সাংঘাতিক হয়েছিল যে, আলেকজান্ডারের জীবনের আশাই ছিল না।
এই তিনবারই আলেকজান্ডার হাজার হাজার বন্দিকে হত্যা করে নির্দয় ও অমানুষিক প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বারের হত্যাকাণ্ডের জন্যে গ্রিক ঐতিহাসিকরা পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার সমর্থন করতে পারেননি।
মাসাগা (সম্ভবত আধুনিক মালাকাণ্ড গিরিসঙ্কটের উত্তরে) নগরে সাতহাজার পেশাদার ভারতীয় সৈন্য ছিল। তারা চাকরির খাতিরে সেখানে গিয়েছিল ভারতের সমতল প্রদেশ থেকে। মাসাগা নগরের পতনের পর তারা যখন আত্মসমর্পণ করে, আলেকজান্ডার তাদের আশ্রয় দিয়ে গ্রিক ফৌজে গ্রহণ করতে চান। কিন্তু সেই সাতহাজার হিন্দু বীর একবাক্যে বললে, ‘আমরা পেশাদার সেপাই বটে, কিন্তু বিদেশির অধীনে চাকরি নিয়ে স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পারব না। আমরা দেশে ফিরে যাব।’
আলেকজান্ডার তখন তাদের কিছু বললেন না। কিন্তু রাত্রে তারা যখন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে নিশ্চিন্ত অচেতন হয়ে আছে, তখন হঠাৎ সৈন্য নিয়ে গোপনে তাদের আক্রমণ করলেন। ঘুম ভাঙবার আগেই তাদের অনেকে বিশ্বাসঘাতকের তরবারির আঘাতে অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত হল। বাকি সবাই বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে পরিবারবর্গকে ঘিরে দাঁড়াল তরবারি হস্তে, সগর্বে! দৃঢ়স্বরে তারা বললে, ‘প্রাণ দেব, তবু দেশের শত্রুর অধীনে চাকরি করব না!’ সেই সাত হাজার হিন্দু বীর সেদিন একে একে লড়তে লড়তে প্রাণ দিয়েছিল—গ্রিক রক্তে ভারতের মাটি রাঙা করে! বলতে আজও আমার বুক ফুলে উঠছে যে, অতীতের সেই গৌরবময় দিনে হিন্দু বীরবালারাও গ্রিক সৈন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্রচালনা করেছিলেন। এ উপন্যাসের কথা নয়, গ্রিক ঐতিহাসিকের কথা!
সীমান্তের পথ হল নিষ্কণ্টক!
আলেকজান্ডার বললেন, ‘চলো এইবার পঞ্চদের দেশে। রাজা পুরু সেখানে প্রস্তুত হচ্ছে, তার অধীনে আছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার সৈন্য। তাকে মারতে পারলেই সমস্ত ভারত লুটিয়ে পড়বে আমাদের পায়ের তলায়।’
পুরুর সৈন্য সংখ্যা যে পঞ্চাশ হাজারের বেশি ছিল না, এ বিষয়ে মতান্তর নেই। কিন্তু ভারতের গৌরব খর্ব করবার জন্যে কিনা জানি না, আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের সৈন্য সংখ্যা কম ছিল বলে জানাবার চেষ্টা করেন। ভারতের নিজের ইতিহাস—অন্তত আসল ইতিহাস বলতে যা বোঝায় তা নেই, তাই আমরা আধুনিক ইউরোপের কথা অমূলক বলে প্রতিবাদ করতে পারি না।
কিন্তু আধুনিক ইউরোপের এই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন দিগ্বিজয়ী গ্রিকদেরই প্রাচীন লেখক। প্লুটাকের লেখা আলেকজান্ডারের জীবনীতে আমরা অন্য কথা পাই। কারণ তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, একলক্ষ বিশ হাজার পদাতিক ও পনেরো হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন।
তারপর অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন যে, তক্ষশীলার রাজা অম্ভি, অভিসারের রাজা ও অন্যান্য বশীভূত রাজারাও আলেকজান্ডারকে সৈন্য, হস্তী ও অশ্ব দিয়ে সাহায্য করেছিলেন; এবং আলেকজান্ডার নিজেও যে পথে আসতে আসতে পেশাদার সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন, পূর্ব উক্ত মাসাগার হত্যাকাণ্ডেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। মাসাগার সাত হাজার বীরের মৃত্যুর একমাত্র কারণ, তারা গ্রিক ফৌজে যোগ দিতে চায়নি। তাদের মতো স্বদেশভক্ত পৃথিবীর সব দেশেই দুর্লভ। সুতরাং এ-কথা জোর করে বলা যায় যে, ভারতের হাজার হাজার পেশাদার সৈন্যও আলেকজান্ডারের বাহিনীকে করে তুলেছিল বৃহত্তর। আমাদের মতে, আলেকজান্ডার যখন পুরুর সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অগ্রসর হন, তখন তাঁর অধীনে অন্তত দুই লক্ষের কম সৈন্য ছিল না,—বরং এর উপরে আরও পঞ্চাশ হাজার যোগ করলেও অত্যুক্তি হবে না।
পুরুর দুর্ভাগ্য! যথাসময়ে প্রস্তুত হতে পারেননি বলে তাঁকে একাকীই অন্তত চারগুণ বেশি গ্রিক সৈন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হল! বুদ্ধিমান হলে পুরুও অন্যান্য রাজার মতন আলেকজান্ডারের অধীনতা স্বীকার করতে পারতেন। কিন্তু পুরুর বিরাট বক্ষের তলায় ছিল ভীমার্জুনের আত্মা, বিনা যুদ্ধে তিনি স্বদেশকে যবনের হাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না।
পুরু মহাবীর হলেও আমাদের এই কাহিনির নায়ক নন, কাজেই তাঁর কথা সবিস্তারে বলে লাভ নেই! কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে জুলাই মাসের প্রথমে, ঝিলম নদের তীরে আলেকজান্ডারের সঙ্গে যে-যুদ্ধে পুরু পরাজিত হন, ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মত মেনে তাকে আমরা মহাযুদ্ধ বলে স্বীকার করতে পারব না। পরে পানিপথের একাধিক যুদ্ধে সমগ্র ভারতের ভাগ্য যেমন বার বার পরিবর্তিত হয়েছিল, ঝিলমের যুদ্ধের পরে তেমন কিছুই হয়নি, ভারতবর্ষের অধিকাংশই ছিল আলেকজান্ডারের নাগালের বাইরে। তার প্রধান কারণ, পুরু ছিলেন উত্তরভারতের মাত্র এক অংশের রাজা, তাঁর পতনের সঙ্গে সমগ্র ভারতের বিশেষ যোগ ছিল না।
ঝিলমের যুদ্ধে মহাবীর ও অতিকায় পুরু অসম্ভবের বিরুদ্ধেও প্রাণপণে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু শেষটা দেহের নয় স্থানে আহত হয়ে প্রায়—মূর্ছিত অবস্থায় বন্দি হলেন। আলেকজান্ডারের শিবিরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁর সেই সাড়ে ছয়ফুট দীর্ঘ বিপুল দেহের দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করব?’
পুরু সগর্বে মাথা তুলে বললেন, ‘এক রাজা আর এক রাজার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেন।’
পুরুর বীরত্ব ও পরাক্রম দেখে আলেকজান্ডার এতটা অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি কেবল তাঁকে মুক্তি দিলেন না, তাঁর নিজের রাজ্যের উপরেও আরও অনেক দেশ দান করলেন।
পঞ্চনদের তীরে উড়তে লাগল গ্রিক দিগবিজয়ীর পতাকা! কিন্তু আলেকজান্ডার বুঝলেন, তিনি এখনও বৃহত্তর ভারতসীমান্তেই দাঁড়িয়ে আছেন।
যুদ্ধজয়ের আনন্দোচ্ছ্বাস যখন কমল, আলেকজান্ডার তখন একদিন সেনাপতিদের আহ্বান করে বললেন, ‘সৈন্যদের মধ্যে প্রচার করে দাও, আমি এইবারে মগধের দিকে যাত্রা করব!’
গ্রিক অশ্বারোহী সৈন্যদের নেতা স্পষ্টবক্তা কইনোস সবিস্ময়ে বললেন, ‘সে কী সম্রাট! আজ আট বৎসর হল আমরা স্বদেশ থেকে বেরিয়েছি। এখনও আপনি এগিয়ে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ সেনাপতি! কারণ মগধের রাজাই ভারতের সবচেয়ে বড় রাজা। মগধ জয় করতে না পারলে ভারত জয় করা হবে না।
অন্যান্য সেনাপতিরাও জানালেন, গ্রিক সৈন্যদের অধিকাংশই হত বা আহত হয়েছে। এখন আর আমাদের মগধের দিকে যাওয়ার সাহস নেই। এর মধ্যেই গ্রিক সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ পেয়েছে।
কইনোস বললেন, ‘শুনেছি মগধের নন্দরাজার সৈন্য আছে লক্ষ লক্ষ। মগধ আক্রমণ করলে আমাদের পরাজয় অনিবার্য।’
আলেকজান্ডার আর কোনও কথা না বলে অভিমানভরে চলে গেলেন। দুই দিন আর শিবিরের ভিতর থেকে বেরুলেন না। মাথা ঠান্ডা করে অনেক ভেবে, তৃতীয় দিনে বাইরে এসে বললেন, ‘তাঁবু তোলো! আমরা গ্রিসে ফিরে যাব।’
আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন না বটে, কিন্তু ভারতবর্ষ জয় করতে এসে গ্রিকদের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হচ্ছে পলায়নেরই নামান্তর। জীবনে আর কখনও আলেকজান্ডার এমনভাবে পিছু হটেননি। প্রাচীন ঐতিহাসিক দায়াদরাস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, (মেগাস্থিনিসের ভ্রমণকাহিনির আলোচনা প্রসঙ্গে) ‘মাসিডনের রাজা আলেকজান্ডার সবাইকে হারিয়েও মগধের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সাহসী হননি। মগধের সৈন্যবলের কথা শুনে তিনি ভারতজয়ের ইচ্ছা দমন করেন!’
আলেকজান্ডার তো উত্তরভারতের চতুর্দিকে গ্রিক সৈন্য, সেনাপতি ও শাসনকর্তা রেখে মানে মানে সরে পড়লেন, কিন্তু আমাদের বন্ধু সুবন্ধুর কী হল? এইবারে তার সঙ্গে দেখা করে আবার গল্পের সূত্র ধরব!