অষ্টম অধ্যায় । পথের নেশা
এখনও দরায়ুস পলাতক! তাঁকে বন্দি ও বশীভূত করতে না পারলে আলেকজান্ডারের শান্তি নেই। বিষধর পালিয়ে গেলেই নির্বিষ হয় না।
কিন্তু দরায়ুস যাবেন কোথায়? তিনি যত এগিয়ে যান, আলেকজান্ডার তাঁর পিছনে লেগে থাকেন কায়ার পিছনে ছায়ার মতো।
এই অনুসরণ করতে করতে আলেকজান্ডারকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল বারংবার। তিনি এক প্রদেশ পার হয়ে অন্য প্রদেশে গিয়ে পড়লেই তাঁর পশ্চাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নব নব শত্রু। তাঁকে ফিরে এসে শত্রু দমন করে তবেই আবার অগ্রসর হতে হয়। এইসব কারণে দরায়ুসের পলায়নের সুবিধা হতে লাগল যথেষ্ট।
আলেকজান্ডার ও তাঁর যুগে আর কেউ সন্দেহ করেনি, যে গ্রিক ও পারসিরা আজ মৃত্যু সংগ্রামে নিযুক্ত, মূলত তারা একই জাতি। আলেকজান্ডার পরে পাঞ্জাবে গিয়েও বুঝতে পারেননি যে, ওখানকার ভারতীয়রাও তাঁর জাতভাই। স্মরণাতীত কাল আগে মধ্য এশিয়া থেকে যে মূল আর্যজাতি দক্ষিণ দিকে অভিযান আরম্ভ করে, উত্তর ভারতীয় হিন্দু, ইরানের পারসি ও গ্রিসের গ্রিকগণ হচ্ছে তারই তিনটি শাখা। বহুযুগের এপারে এসে পড়ে তারা নিজেদের পূর্ব-কাহিনি ভুলে গিয়েছে, তাই পরস্পরকে ‘বর্বর’ বা ‘যবন’ বা অন্য কিছু বলে গালাগালি দেয় এবং ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি করে।
দরায়ুসের মন্দ ভাগ্য! আলেকজান্ডারের হাতে আত্মসমর্পণ করলেই ভালো করতেন, কিন্তু তা না করে তিনি পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন অভিশপ্ত ভবঘুরের মতো। শেষটা তিনি গিয়ে পড়লেন তপ্ত তৈল থেকে জ্বলন্ত আগুনে।
দরায়ুস পালালেন ইরানের উত্তর দিকে, আলেকজান্ডারও ছুটলেন উত্তর দিকে। এগুতে এগুতে হঠাৎ একদিন দেখা গেল, পথের উপরে পড়ে রয়েছে ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর’ উপাধিধারী পারসি সম্রাট তৃতীয় দরায়ুসের মৃতদেহ! তাঁর দেহের সর্বত্র ছোরার আঘাত (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দ)! সাম্রাজ্য স্থাপক, মহামহিমময় দিগবিজয়ী কুরুষ (Cyrus) থেকে যে রাজবংশের আরম্ভ, দরায়ুস তার শেষ বংশধর। আজকের পারস্যের রাজাও ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর’ উপাধিটির উপরে দাবি করেন বটে, কিন্তু সে যেন বিষম ঠাট্টার মতন শোনায়!
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দরায়ুসকে হত্যা করেছেন তাঁরই এক জ্ঞাতি, নাম—বেসাস। লোকটি ছিল ব্যাকট্রিয়ার ক্ষত্রপ বা শাসনকর্তা।
আলেকজান্ডার রাগে জ্বলে উঠে বললেন, ‘সম্রাট হত্যা! ছুটে চলো হত্যাকারীর পিছনে! যেখানে থাক, খুঁজে বার করো তাকে!’
বেসাস প্রমাদ গুণে ব্যাকট্রিয়ায় চম্পট দিলে। ব্যাকট্রিয়া হচ্ছে আফগানিস্তানের উত্তরে। বেসাস ভেবেছিল, আলেকজান্ডার দেশ ছেড়ে কখনওই এত উত্তরে আসতে সাহস করবেন না।
আলেকজান্ডার খবর পেলেন। আরও শুনলেন যে, পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরে যেসব শাসনকর্তা দরায়ুসকে হত্যা করবার জন্যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তারা বেসাসকেই বসাতে চায় ‘সর্বশক্তিমানে’র সিংহাসনে। বেসাস নিজেও রাজ নাম গ্রহণ করেছে।
আলেকজান্ডার ঝড়ের মতন ছুটলেন এই নতুন ‘সর্বশক্তিমানে’র সর্বশক্তি খর্ব করতে। বেসাস রক্ষা পেলে না, সে ধরা পড়ল এবং রাজহত্যার শাস্তিস্বরূপ তাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হল।
তারপর নানা খণ্ডযুদ্ধ, কষ্টস্বীকার ও গিরি-নদী-প্রান্তর অতিক্রম করবার পর আলেকজান্ডার তুর্কিস্থান পর্যন্ত দখল করে ফেললেন। এখানে সেসব কথা না বললেও চলবে। কারণ, আলেকজান্ডারকে বাধা দিতে পারে, এ অঞ্চলে এমন কোনও শত্রু ছিল না।
কিন্তু একদিনের কাহিনি উল্লেখযোগ্য।
তপনতপ্ত এশিয়ার এক মরু-প্রান্তর। আকাশের দিকে তাকানো যায় না, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে গায়ে এসে লাগে যেন প্রখর অগ্নিবাণ, শুকনো ধু-ধু প্রান্তরে কোথাও নেই জলবিন্দু। গ্রিক সৈন্যরা ধুঁকতে ধুঁকতে পথ চলতে গিয়ে এলিয়ে পড়ছে—দারুণ তৃষ্ণায় তাদের জিভ গেছে শুকিয়ে, প্রাণ করছে টা টা। নেই লোকালয়, নেই যেন পথের শেষ।
জনকয় সৈনিক অপূর্ব ও অভাবিত এক আবিষ্কার করলে। মাটির ভিতরে একটি গর্ত, তার ভিতরে একটুখানি জল!
একজন সৈনিক লোহার শিরস্ত্রাণ খুলে জলটুকু সংগ্রহ করলে। হাজার হাজার সৈনিক সেই জলের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলে। কারণ, সেটুকু জলে তৃষ্ণানিবারণ হতে পারে মাত্র একজনের!
সৈনিক ভাবলে, রাজার দাবি সকলের আগে। সে জলটুকু এনে ধরলে আলেকজান্ডারের সামনে।
রাজাও কম তৃষিত নন। তাঁরও ছাতি তখন যেন ফেটে যেতে চাইছে। তিনি বিপুল আগ্রহে সেই জলপূর্ণ শিরস্ত্রাণ টেনে নিয়ে নিজের ঠোঁটের কাছে তুললেন। তারপরেই দেখতে পেলেন, তৃষ্ণা-কাতর শতশত চোখের আকুল দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে শিরস্ত্রাণের দিকেই।
শিরস্ত্রাণসুদ্ধ দুই হাত ঠোঁটের কাছ থেকে নামিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, ‘একজনের মতো জল, অথচ সবাই চায় তেষ্টা মেটাতে! সকলের আগে রাজার দাবি বলে আমি তো এ জল পান করতে পারি না।’
তিনি শিরস্ত্রাণ উপুড় করে ধরলেন—তৃষিত মাটির খানিকটা স্নিগ্ধ হল, ক্ষণিকের জন্যে।
কী স্বার্থত্যাগ, কী মহত্ব! হাজার হাজার সৈনিক তৃষ্ণার জ্বালা ভুলে আলেকজান্ডারের নামে করলে জয়ধ্বনি!
ইতিহাসে যেসব সেনাপতি নাম কিনেছেন, তাঁদের অনেকেই এমনিভাবে সাধারণ সৈনিকদের সুখ-দুঃখ নিজের বলে মনে করে সেনাদলের কাছে হয়েছেন আদরের দেবতার মতন!
এই অঞ্চলে আলেকজান্ডার সৈনিকদের নিয়ে বৎসরখানেক ধরে বিশ্রাম করেন। (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০-২৯ অব্দ) এবং এর মধ্যে কতকগুলি ছোট-বড় এমন ঘটনা ঘটে, যার দ্বারা ধরা পড়ে তাঁর চরিত্রের বিশেষত্ব।
তিনি আলেকজেন্দ্রিয়ার মতন নিজের নামে অনেকগুলি নতুন নগর প্রতিষ্ঠা করেন। এইরকম নিজের নামে নূতন নগর-প্রতিষ্ঠার ঝোঁক শেষটা তাঁকে নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। আর কোনও দিগবিজয়ী এমন অহমিকা প্রকাশ করেননি।
শকরাজ অক্সিয়ার্তেজকে পরাজিত করে তিনি তাঁর কন্যা রোক্সানাকে বিবাহ করেন। আলেকজান্ডারের ভাবপ্রবণ চিত্ত কি এখানেও তাঁরপর পরিকল্পনার প্রথম প্রকাশ দেখাবার চেষ্টা করেছিল? এই ঘটনায় তাঁর সঙ্গী গ্রিকগণ বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, কারণ, তাদের পক্ষে এটা ছিল ধারণাতীত! সাম্রাজ্যস্রষ্টা অভিজাত গ্রিকবীর হয়ে বর্বর ও অসভ্য রাজার মেয়েকে বিবাহ! কিন্তু তারা জানত না, এর পর এমন কত ঘটনা তাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে!
আলেকজান্ডার যখন ভারতে জয়পতাকা উড়িয়ে পারস্যের সুসা শহরে প্রত্যাগত, তখন তিনি দরায়ুসের মেয়ে স্তাতিরাকেও করেছিলেন নিজের অঙ্কলক্ষ্মী। সেই সময়ে সেখানে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়।
আলেকজান্ডারের দেখাদেখি তাঁর কয়েক শত সেনাধ্যক্ষও এক-একটি ইরানি সুন্দরীর পাণিপীড়ন করেন। আবার এইসব দেখে সাধারণ গ্রিক সৈনিকের সঙ্গে হয় দশ হাজারেরও বেশি পারসি কন্যার বিবাহ! ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার এমন বিবাহবন্ধনের কথা ইতিহাসে আর কখনও লেখা হয়নি!
আলেকজান্ডার নিজেই তাঁর সৈনিকগণকে উৎসাহ দিতে ছাড়েননি। বহু সৈনিক পারস্যে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আলেকজান্ডার নিজের তহবিল থেকে টাকা দিয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করে বলেন, ‘এইবারে তোমাদের প্রত্যেককে পারসি মেয়ে বিয়ে করতে হবে!’
সেইখানেই আলেকজান্ডার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি চান, ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক—দুই মহাদেশের সর্বজাতি সম্মেলন! পিতৃকৃত্য পালনের জন্যে প্রথমে তিনি এশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন বটে, কিন্তু তারপরেই তাঁর শত্রুভাব লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন, এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের মিলন ঘটাতে পারলে তার ফল হবে অত্যন্ত শুভ। তিনি যে কেবল এশিয়ার কন্যাদের গ্রহণ করেই এই মিলনস্বপ্নকে সফল করতে চেয়েছিলেন, তা নয়; পরে আমরা দেখাব, রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি অবলম্বন করেছিলেন ওই এক পন্থাই।
বর্বর ও অসভ্য রাজকন্যা হলেও রোক্সানা হচ্ছে প্রাচ্যেরই মেয়ে এবং প্রাচ্য দেশ বলতে আলেকজান্ডার কেবল পারস্যদেশই বোঝেননি।
আলেকজান্ডার যখন সমরখন্দে, তখন বিশেষ একটি অন্যায় কাজ করেছিলেন।
ছয় বছর আগে গ্রানিকাস ক্ষেত্রে ক্লিটাস তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলেন, একথা বলা হয়েছে যথাসময়েই।
সমরখন্দের এক ভোজসভায় একদিন আলেকজান্ডারের সঙ্গে তাঁর বন্ধু ক্লিটাসের ঝগড়া হল। দুজনেই সমান ক্রুদ্ধ!
ক্লিটাস রাজা বলে আলেকজান্ডারকে সমীহ করলেন না। মুখে যা আসে তাই বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।
শেষটা আলেকজান্ডার আর সহ্য করতে পারলেন না। রাগে অজ্ঞান হয়ে বন্ধুর দেহে বসিয়ে দিলেন তীক্ষ্ণ বর্শা! তৎক্ষণাৎ ক্লিটাসের মৃতদেহ মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল।
রাগের মাথায় এই অসম্ভব কাণ্ড করে ফেলে আলেকজান্ডার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর সহজ অবস্থা ফিরে এল। তারপরেই তিনি দুঃখে পাগলের মতন হয়ে উঠলেন।
বিষম অনুতাপে হঠাৎ তিনি বন্ধুর মৃতদেহে বিদ্ধ বর্শাটা একটানে খুলে নিয়ে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হলেন।
ভাগ্যে সেখানে তাঁর দেহরক্ষী ছিল উপস্থিত। সে তাড়াতাড়ি তাঁর হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিলে।
এই হচ্ছে আলেকজান্ডারের আর এক স্বরূপ। একদিকে তিনি ধীর, স্থির, ভাবুক, কাব্যপ্রিয়, নির্ভীক, উদার ও দয়ালু ‘জনগণমনঅধিনায়ক’; আর একদিকে গোঁয়ার, ক্রোধে উন্মত্ত, অধীর, অহঙ্কারী, নিষ্ঠুর ও হিংস্র।
এমনকী, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন এই সন্দেহে পরে তিনি তাঁর পিতৃবন্ধু ও প্রবীণ সেনাপতি বৃদ্ধ পার্মেনিয়ো এবং তাঁর পুত্র ফিলোটাস এবং আরও অনেক বিখ্যাত সেনারক্ষীকে পর্যন্ত প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতে কুণ্ঠিত হননি! এবং পরে আমরা দেখব, ভারতবর্ষে গিয়েও তিনি তৈমুর লং ও নাদির শাহের মতোই নৃশংস হয়ে করেছিলেন কী দারুণ হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান।
আবার এই লোকই পরম শত্রুকেও ক্ষমা করতে পেরেছিল হাসিমুখে। প্রমাণ, মহারাজ পুরু।
এক জলদস্যু-সম্পর্কীয় বিখ্যাত গল্পেও আলেকজান্ডারের চরিত্রের এমনি মাধুর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ডায়োমেডেস—নামজাদা বোম্বেটে। সমুদ্রের দিকে দিকে জাহাজ ভাসিয়ে নিজের সাংঘাতিক ব্যবসা চালাত। সে কত বাণিজ্য-জাহাজ ডুবিয়েছে, কত পণ্য ও অর্থ হরণ করেছে, কত লোককে প্রাণে মেরেছে তার আর সংখ্যা নেই। শেষটা সে ধরা পড়ল। তাকে আলেকজান্ডারের সম্মুখে এনে হাজির করা হল।
আলেকজান্ডার ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘ওরে ডাকাত, সমুদ্রে সমুদ্রে কোন সাহসে তুই এমন অত্যাচার করে বেড়াস?’
ডায়োমেডেস মৃত্যু নিশ্চিত জেনে নির্ভীক ভাবে বললে, ‘রাজা, তার চেয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, দেশে দেশে কোন সাহসে আপনি এমন অত্যাচার করে বেড়ান? আমি তো একখানি মাত্র বোম্বেটে জাহাজের মালিক, আমি আর কতটুকু অত্যাচার করতে পারি? আর আপনি হচ্ছেন অগণ্য জাহাজের ফৌজের মালিক, জলে স্থলে দেশে দেশে নিয়ে যান ধ্বংস আর যুদ্ধ! তবু আমার উপাধি ‘ডাকাত’, আর আপনার উপাধি ‘রাজা’ ও ‘দিগবিজয়ী’! অদৃষ্টের গতি যদি ফেরে, আমি যদি বেশি সফল হই আর আপনি হন কম সফল, তাহলে আমাদের উপাধি আর অবস্থাও বদলে যেতে কতক্ষণ!’
যুক্তি শুনে আলেকজান্ডার রাগ করলেন না। ডাকাতকে বহু অর্থদান করে বললেন, ‘কিন্তু সাবধান, ভবিষ্যতে আর যেন ডাকাতি কোরো না।’
পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল ভারতবর্ষের সিন্ধুনদ পর্যন্ত। আলেকজান্ডার এইবারে স্থির করলেন, তিনি সাম্রাজ্যের বাকি অংশটুকুকেও রেহাই দেবেন না। উত্তর ভারতে যদি পারস্যের দাবি না থাকত, তাহলে আলেকজান্ডার ভারতের মাটি মাড়াতেন কি না, সে বিষয়ে আমাদের গভীর সন্দেহ আছে।
কিন্তু রণক্ষেত্রে গ্রিকরা যুদ্ধ-ব্যবসায়ী ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে একাধিক বার পরিচিত হবার সুযোগ পেলেও ভারতবর্ষ ছিল তাদের কাছে এক অজানা রহস্যময় অতি দুর্গম দেশ। কোথায় গ্রিস, আর কোথায় ভারতবর্ষ! মাঝে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান! আজকাল ট্রেন, বাষ্পীয় জাহাজ ও এরোপ্লেনের যুগে, গ্রিস থেকে ভারতবর্ষে যেতে কোনও দুশ্চিন্তা হয় না, কিন্তু সে যুগে পায়ে হাঁটা পথে এই দুই দেশে আনাগোনা করার কথা স্বপ্নেও কেউ মনে আনতে পারত না। তার উপরে গ্রিকদের যেতে হবে শত্রু রূপে, পথে কোনও সাহায্য পাবার আশা নেই—আছে পদে পদে শুধু বিপদ ও মৃত্যুর সম্ভাবনা!
এবং কত বৎসর আগে গ্রিকরা স্বদেশ, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের পিছনে ফেলে এসেছে! চিরশত্রু পারস্যের পতন হল, এখনও আবার নূতন অভিযানের প্রস্তাব!
গ্রিকরা ভারতবর্ষে যেতে ভয় পেলে এবং তাদের মনও কাঁদতে লাগল দেশের জন্যে।
আলেকজান্ডার নিজের সৈনিকদের মন জানতেন। তারা যে তাঁকে পিতার মতো, দেবতার মতো ভালোবাসে, এ সত্যও তাঁর অজানা ছিল না। তাদের মন ফেরাবার গুপ্ত অস্ত্র তাঁর কাছেই ছিল। অবশেষে তিনি সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করলেন।
বললেন, ‘বেশ, তাই হোক। যদিও আমি জানি এত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে গেলে আমরা পালিয়ে যাচ্ছি ভেবে শত্রুরা আমাদের পিছন থেকে বারংবার আক্রমণ করবে, তবু তোমাদের ইচ্ছায় আমি বাধা দেব না। বেশ, দেশেই যাও! তোমাদের আমি ত্যাগ করলুম!’
আলেকজান্ডার তাদের ত্যাগ করবেন! তাদের বন্ধুর মতো, পিতার মতো, দেবতার মতো আলেকজান্ডার তাদের ত্যাগ করবেন! এতবড় দুর্ভাগ্য তারা ধারণাতেই আনতে পারলে না। না, না, এ হতেই পারে না—অসম্ভব!
সৈনিকেরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘রাজা, রাজা! আমরা দেশে যেতে চাই না, আমরা তোমার সঙ্গে থাকতে চাই! তোমার সঙ্গে আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও যেতে রাজি!’
ভারতবর্ষেই যাওয়া স্থির হল।
এক দেশ থেকে আর এক দেশ, এক সভ্যতা থেকে সভ্যতার অন্তঃপুরে বিজয়ী বীরের মতন প্রবেশ করবার জন্যে আর একবার অগ্রসর হলেন আলেকজান্ডার! ছিলেন মাসিডনের ক্ষুদ্র নরপতি, আজ হয়েছেন বিশ্ববিজয়ী সম্রাট! কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন, ভাগ্যলক্ষ্মীর প্রসাদ পেয়েও এবং শক্তির মদিরা পান করেও কোনও দিন তিনি আত্মহারা হননি। মানুষের তুচ্ছতা অসহায়তা কতখানি সেটা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না।
পারস্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা কুরুষের সমাধিভবন। একদিন আলেকজান্ডার সেখানে গিয়ে উপস্থিত।
তিনি সমাধি প্রস্তরের উপরে লেখা এই কথাগুলি পড়লেন :
‘হে মানুষ, তুমি যেইই হও এবং যেখান থেকেই তোমার আগমন হোক—কারণ আমি জানি তুমি আসবেই—আমার এই কথাগুলি শুনে রাখো : আমি হচ্ছি সেই কুরুষ—পারসিদের জন্যে যে বিপুল সাম্রাজ্য জয় করেছিল : আজ এই যে একমুঠো মাটি হয়েছে আমার আবরণ, এর জন্যে তুমি আমাকে হিংসা কোরো না।’
শোনা যায়, এই লিপি পাঠ করবার পর আলেকজান্ডার মনুষ্য জীবনের নশ্বরতা ও অনিশ্চয়তার কথা স্মরণ করে ভাবের আবেগে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।