উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

অষ্টম। রাজশ্রী

অষ্টম। রাজশ্রী

হর্ষবর্ধনের সামনে রয়েছে এখন দুটি প্রধান কর্তব্য। ভ্রাতৃহন্তা বঙ্গেশ্বর শশাঙ্ককে শাস্তি দেওয়া এবং নিরুদ্দিষ্টা ভগিনী রাজশ্রীকে উদ্ধার করা।

কিন্তু সর্বাগ্রে রাজশ্রীর সন্ধান না নিলে চলবে না। রাজশ্রী হর্ষের চেয়ে আট-দশ বৎসরের বড় ছিলেন। শৈশবে তিনি দিদির কোলে চড়েছেন, তাঁর কাছে কত আবদার করেছেন! দিদিকে তিনি কেবল ভালোবাসতেন না। তাঁকে দেখতেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার চক্ষে। কারণ রাজশ্রী ছিলেন একাধারে বিদ্যাবতী ও বুদ্ধিমতী। হর্ষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, রাজ্যশ্রী যদি পুরুষ হতেন তাহলে তিনি থাকতে থানেশ্বরের সিংহাসনে বসবার যোগ্যতা হত না আর কারুর।

সেনাপতি সিংহনাদ নিবেদন করলেন, ‘দেব, রাজশ্রীদেবীকে আগে উদ্ধার করতে গেলে নরাধম গৌড়াধিপতি যদি পালিয়ে যায়? বঙ্গ হচ্ছে দুর্গম দেশ, সেখানকার লোকদের আশ্রয় কেবল স্থলপথ নয়, জলপথও। একবার সে পলায়নের সুযোগ পেলে আর কি আমরা তাকে ধরতে পারব?’

হর্ষ বললেন, ‘হয়তো পারব না, তবু উপায় নেই। রাজশ্রীদেবীর ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের পবিত্র রক্ত। তার উপরে আমি পিতা-মাতাকে হারিয়েছি, একমাত্র ভ্রাতাকেও হারিয়েছি, পৃথিবীতে এখন দিদি ছাড়া আমার আর আপনজন নেই। আমার দিদির সঙ্গে একশত শশাঙ্ক তুল্যমূল্য নয়। আগে দিদিকে ফিরিয়ে আনি, তারপর অন্য কথা।’

‘আমার প্রতি আপনার কী আদেশ।’

‘আপনি এখন থেকেই নতুন সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করুন। ইতিমধ্যে আমি এক হাজার লোক নিয়ে দিদির সন্ধানে যাত্রা করব। ফিরে এসে যেন সেনাদলকে প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পাই।

হর্ষের কবি-বন্ধু বানভট্ট সাবধান করে দিলেন, ‘দেখবেন রাজপুত্র, রাজশ্রীদেবীকে উদ্ধার করতে যেন বিলম্ব না হয়! নিজের প্রতিজ্ঞার কথা সর্বদাই স্মরণ রাখবেন। বাঙালি-পাখি শশাঙ্ক যদি উড়ে পালায়, তাহলে সারা জীবনই আপনাকে নোংরা বাম হাত দিয়ে অন্নগ্রহণ করতে হবে।’

সে কথার উত্তর না দিয়ে সিংহনাদের দিকে ফিরে হর্ষ বললেন, ‘প্রধান সেনাপতি স্কন্দগুপ্ত এখন কোথায়?’

সিংহনাদ বললেন, ‘তাঁকে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছিলুম বটে, কিন্তু এখন তিনি জীবিত কী মৃত বলতে পারি না।’

বাণভট্ট বললেন, ‘রাজপুত্র, আপনি কি সেই স্কন্দগুপ্তের কথা জিজ্ঞাসা করছেন, যাঁর মহা নাসিকা আপনার সম্ভ্রান্ত পূর্বপুরুষদের নামের তালিকার চেয়েও বেশি দীর্ঘ?’

‘কবি, তোমার এই উপমাটি বেশ রুচিসম্মত হল না! যাক সেকথা। হ্যাঁ, আমি সেই স্কন্দগুপ্তের কথাই জিজ্ঞাসা করছি। তুমি কি তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানো?’

‘জানি বইকি রাজপুত্র। শশাঙ্ক-পক্ষীর চঞ্চু-তাড়নায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লম্বা দিয়ে তিনি এমন ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়েছেন যে, নিজের বাড়ির অন্দর-মহলে রমণীর মতো ঘোমটায় বদন ঢেকে অবস্থান করছেন।’

‘এখন পরিহাস রাখো কবি। একবার প্রধান সেনাপতির কাছে যাও, তাঁকে বলে এসো—যুদ্ধে জয় পরাজয় দুই-ই থাকে, প্রকৃত বীরকে কোনওদিন স্পর্শ করতে পারে না পরাজয়ের গ্লানি। তিনি যদি প্রতিশোধ নিতে চান তাহলে শশাঙ্কের সঙ্গে আবার দেখা করবার জন্যে যেন প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আমি চললুম।’

হর্ষ প্রস্থান করলে পর বাণভট্ট বললেন, ‘ওহে বাপু সিংহনাদ, স্কন্দগুপ্তের কেবল অতিদীর্ঘ নাসা নয়, তাঁর কেশও অতিপক্ক। রাজপুত্র শ্রীহর্ষ তাঁকে যে কথাগুলি বলতে বললেন তা শুনলে তিনি কী মনে করবেন বলো দেখি?’

‘কী মনে করবেন?’

‘মনে করবেন, ছেলেটি গোঁফ না গজাতেই জ্যাঠামহাশয় হওয়ার চেষ্টা করছে।’

সিংহনাদ কোনও রকম নাদসৃষ্টি না করে মুখ টিপে একটুখানি হাসবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু স্পষ্টাস্পষ্টি হাসলেন না।

বিন্ধ্য পর্বতমালার পাদদেশে জঙ্গলাকীর্ণ প্রদেশ! এমন ঘন জঙ্গল যে পাঁচ হাত অগ্রসর হলেই দৃষ্টি হয় বন্ধ। সেখানে বাঘ, ভালুক, অজগর ও বিষাক্ত সর্পাদি তো আছেই, তার উপরে যে সময়ের কথা বলছি তখন সেখানে পশুরাজ সিংহেরও প্রতাপ বড় কম ছিল না।

সেখানে বাস করত মানুষও। কিন্তু তারা সভ্য মানুষ নয়, অসভ্য ভিল। এক সময়ে তাদেরই পূর্বপুরুষরা ছিল ভারতের আদিম বাসিন্দা। কিন্তু বিদেশি আর্য জাতির দ্বারা যখন উত্তরাপথ অধিকৃত হল, তখন তারা এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এমনই সব দুর্গম গহন বনে বা পর্বতের অন্তরালে। তাদের আত্মরক্ষার সম্বল ছিল কেবল মাত্র বল্লম বা তিরধনুক। তারই সাহায্যে তারা করত দুর্দান্ত সিংহ-ব্যাঘ্রদেরও প্রাণে ভীতির সঞ্চার করেছিল। শিকারই ছিল তাদের প্রাণধারণের প্রধান উপায়, কিন্তু শিকার না জুটলেও তাদের খাদ্যের অভাব হত না কোনওদিন। অসংখ্য বৃক্ষদেবতা হাজার হাজার পত্রশ্যামল শাখা-বাহু বিস্তার করে তাদের সামনে ধরত অফুরন্ত ও সুমিষ্ট অমৃত ফল এবং তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করবার জন্যে নাচতে নাচতে ছুটে আসত সাগ্রহে সংগীতমুখরা ও সুধাময়ী নির্ঝরিনী আর তটিনীরা। ছিল না কোনও অভাব, ছিল না সংকীর্ণ সমাজের বাঁধন। নাগরিক এবং পরম শত্রু আর্যদের কার্য বা অকার্য নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না একটুও, বনে বনে বা পাহাড়ের শিখরে শিখরে আগলভাঙা উদ্দাম পুলকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করত প্রকৃতির একান্ত প্রাণের দুলালের মতো।

স্থানীয় ভিলদের এক সরদার ছিল, নাম তার লটনা। বয়স পঞ্চাশের ওপারে, কিন্তু জোয়ান সে তিরিশ বৎসরের যুবকের মতো। তার সেই সাত ফুট লম্বা দেহ ও পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি চওড়া বুকের পাটা দেখলে চমকে ওঠে দুর্দান্ত সিংহদেরও চক্ষু!

সভ্য মানুষদের নির্দয় অসভ্যতার কবল থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে এই লটনা-সরদারেরই কাছে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন থানেশ্বরের রাজকন্যা ও কান্যকুব্জের সিংহাসনচ্যুতা মহারানি রাজশ্রীদেবী।

বয়স তাঁর চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না, কিন্তু এখনও তাঁকে দেখলে মনে হয় পনেরো-ষোলো বছরের বালিকার মতো। বর্ণ তাঁর হস্তীদন্তশুভ্র নয়, পক্ক আপেলের মতন রঙিন। সুডৌল তনু, পরিপুষ্ট বাহু, কোমলতা-মাখানো মুখখানি দেখলে কঠোর পাথরও বুঝি তরল হয়ে যায়! আর সেই দুটি আয়ত নয়ন, তাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে যেন আত্মসমাহিত দিব্যদৃষ্টি।

আলুলিত কেশ, বিধবার শুভ্র বেশ। দেখলেই মনে হয়, যেন মূর্তিধারণ করেছে সুপবিত্র এক অচঞ্চল হোমাগ্নিশিখা!

সেদিন সকালে স্তম্ভিত লটনা-সর্দার দাঁড়িয়েছিল চিত্রার্পিতের মতো। তারই সামনে ভূমিতলে নতনেত্রে উপবিষ্টা রাজকন্যা, রাজমহিষী রাজশ্রী। কিছু দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরদারের অনুচররা।

অবশেষে মূক লটনা খুঁজে পেলে যেন তার আড়ষ্ট কণ্ঠস্বর। সসম্ভ্রমে হেঁট হয়ে বললে, ‘লেড়কি, তাহলে সত্যিই কি তুই আমাদের ফাঁকি দিবি?’

রাজশ্রী ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘বাছা, এখনও কি তুমি আমার মনের ব্যথা বুঝতে পারছ না?’

লটনা অত্যন্ত দুঃখিতভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘বুঝতে পারছি বেটি, বুঝতে পারছি। যার সোয়ামি নেই, তার কেউ থাকে না বটে! কিন্তু মায়ি, আমরা—-তোর বেটারা এখনও তো তোর সামনেই দাঁড়িয়ে! তুই আগে ছিলি শহরের রানি, কিন্তু আমরা যে আজ তোকে বনের রানি করে রাখতে চাই! তোদের শহরের চেয়ে কি আমাদের বন ভালো ঠাঁই নয়?’

রাজশ্রী বললেন, ‘বাবা, শহর ভালো কি বন ভালো, তা নিয়ে কোনও কথা হচ্ছে না। কিন্তু আমার পক্ষে আর বেঁচে থাকবার কোনও কারণ নেই! আমার স্বামী পরলোকে গিয়েছেন, আমি হিন্দু নারী—আমারও উচিত সহগমন করা। তুমি বোধহয় শুনেছ, আমার মা ছিলেন থানেশ্বরের মহারানি। আমার মৃত্যুশয্যাশায়ী বাবা শেষ-নিশ্বাস ফেলবার আগেই মা করেছিলে জ্বলন্ত চিতায় আত্মদান। সেই পরম সতী-জননীর কন্যা আমি, বিধবা হয়েও তবু এই তুচ্ছ জীবন আঁকড়ে আছি। কিন্তু কেন জানো? ভেবেছিলুম আমার স্বামীর হত্যাকারীর উপযুক্ত শাস্তি না দেখে মরব না। কিন্তু সে আশা আজ স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। দেবগুপ্তের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি বটে, কিন্তু সেই দুরাচার হয়তো আজও আমার স্বামীর সিংহাসন অধিকার করে আছে। এখানে আসবার আগে কেবল এইটুকু খবর পেয়েছিলুম যে, দেবগুপ্তকে আক্রমণ আর আমাকে উদ্ধার করবার জন্যে আমার ভাই মহারাজা রাজ্যবর্ধন করেছেন যুদ্ধযাত্রা। এখন আমার কী ধারণা জানো? যুদ্ধে নিশ্চয়ই আমার ভ্রাতার পরাজয় হয়েছে! কারণ তিনি জয়ী হলে এতদিনে নিশ্চয়ই আমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করতেন। কে জানে, আমার ভাই জীবিত আছেন কি না! বাবা, দেবগুপ্ত যদি আবার আমার সন্ধান পায়, তাহলে আবার আমাকে বন্দি আর অপমান করতে পারে। আমার আর কোনও আশাই নেই। এখন আমার বিধবা হয়েও বেঁচে থাকা হচ্ছে মহাপাপ। সরদার, আমার প্রতি যদি তোমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে, তাহলে আর আমাকে বাধা দিয়ো না, আমার জন্যে এখনই চিতাশয্যা রচনা করো!’

লটনা সাশ্রু নেত্রে দুই হাতজোড় করে বললে, ‘কিন্তু মায়ি—’

এইবারে রাজশ্রীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ! তীক্ষ্ণ চক্ষে ও তীব্র কণ্ঠে বাধা দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘এখনও ‘কিন্তু’? সরদার, সরদার! এখনও তুমি যদি আমার অনুরোধ রক্ষা না করো, তাহলে আমি অন্য যে কোনও উপায়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হব!’

‘মা, আমার একটি নিবেদন শোনো—’

‘না, না, আমি আর কোনও কথাই শুনতে চাই না। এই পৃথিবীর প্রত্যেক মুহূর্ত আমার পক্ষে এখন বিষাক্ত। এখনই চিতার কাষ্ঠ আনাও, করো সেই কাষ্ঠে অগ্নিসংযোগ। যে নিজে মরতে চায়, তাকে তোমরা বাঁচাবে কেমন করে?’

রাজশ্রীর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মূর্তি দেখে লটনা আর কোনও কথাই বলতে সাহস করলে না। অত্যন্ত বিমর্ষের মতো ধীরে ধীরে নিজের অনুচরদের কাছে গিয়ে অনুচ্চ স্বরে কী বললে, রাজশ্রী তা শুনতে পেলেন না।

দাউ-দাউ জ্বলন্ত চিতা! ঊর্ধ্বে উঠে শূণ্যকে দংশন করবার চেষ্টা করছে শত শত রক্তাক্ত লকলকে অগ্নিসর্প! আরও ঊর্ধ্বে তাদেরই দৃশ্যমান নিশ্বাসের মতো উঠে যাচ্ছে পুঞ্জ-পুঞ্জ ধূম্রকুণ্ডলী!

রাজশ্রী প্রস্তুত। ভয়শূন্য মুখে দৃঢ়পদে এগিয়ে গেলেন চিতার দিকে।

আচম্বিতে খানিক দূরে জাগ্রত হল ঘন ঘন আকাশ কাঁপানো দামামা ধ্বনি।

রাজশ্রী বেগে চিতার দিকে অগ্রসর হতে হতে সচকিত কণ্ঠে বললেন, ‘সরদার, সরদার, দুরাত্মা দেবগুপ্ত নিশ্চয় আবার আমাকে বন্দি করতে আসছে।’

অধিকতর বেগে ছুটে গিয়ে লটনা দাঁড়াল রাজশ্রীর পথরোধ করে। বললে, ‘একটু অপেক্ষা করো মা। এ নিশ্চয় শত্রুর দামামা নয়। কাউকে গোপনে বন্দি করতে হলে কেউ কখনও দামামা বাজিয়ে নিজের আগমন সংবাদ দেয় না।’

—’শত্রু নয়, বন্ধু? এই পৃথিবীতে আর আমার বন্ধু বলতে কে আছে সরদার?’

উত্তর পেতে বিলম্ব হল না। ঘন জঙ্গলের সবুজ প্রাচীর ভেদ করে আবির্ভূত হল এক অশ্বারোহী মূর্তি! উচ্চ স্বরে সে বলে উঠল, ‘রাজপুত্র হর্ষবর্ধন! থানেশ্বরের রাজপুত্র হর্ষবর্ধন এসেছেন তাঁর সহোদরা রাজশ্রীদেবীকে সানন্দ সম্ভাষণ করতে!’