উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

অষ্টম। মস্কো

অষ্টম। মস্কো

নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে জলজ গাছপালা; পায়ের তলায় শৈবালদলের পিচ্ছিল স্পর্শ কিংবা সঙ্কটময় জলাভূমি; কোথাও শৈলপৃষ্ঠে আশ্রয় নিয়েছে রক্তবর্ণ লতা। এ হচ্ছে স্তব্ধতার স্বদেশ। বৃক্ষমালার উপর দিয়ে উড়ে যায় বাজ পাখিরা; কিন্তু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় না গীতকারী পাখিদের কণ্ঠস্বর; আকাশের নীলিমা অম্লান নয়, ময়লা; দূরে দূরে কুয়াশা ভেদ করে দেখা যায় পৃথিবীর গায়ে আবের মতন মাটির স্তূপ—সেগুলো হচ্ছে চিরমৌন মানুষের সমাধি।

ভ্রমণকারী ইবন বতুতা লিখেছেন; ‘এ হচ্ছে ছায়াচরের মুল্লুক। এখানে যারা বাস করে, কেউ তাদের দেখা পায় না। এখানে গ্রীষ্মের দিন এবং শীতের রাত্রি হচ্ছে সুদীর্ঘ।’

তৈমুরের সেনাদল মনে করলে, তারা এমন কোনও দেশে এসে পড়েছে যেখানে মানুষের বসতি নেই। এ মরুভূমি নয় বটে, কিন্তু মানুষের চিহ্নহীন এ দেশ হচ্ছে মরুর চেয়ে ভয়াবহ। গুপ্তচররা ছুটে গেল, কিন্তু একজন মাত্র মানুষকে আবিষ্কার করতে পারলে না কোথাও!

তৈমুর তাঁর পুত্র ওমর শেখকে ডেকে বললেন, ‘বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তুমি এগিয়ে যাও। যেমন করে পারো, হৈম সংঘের খবর আনো।’

দিন-কয় পরে খবর এল, সুদূরের বৃক্ষহীন প্রান্তরের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সত্তরটি ভস্ম-স্তূপ পাওয়া গেছে। দুই-এক দিনের ভিতরে অনেক লোক সেখানে যেন ছাউনি ফেলে আগুন জ্বেলে রান্নাবান্না করেছিল!

এই সামান্য সূত্রকেই তৈমুর মনে করলেন অসামান্য! ছোট্ট আর একদল সৈন্য নিয়ে তখনই তিনি ছুটলেন সেই দিকে। পথে পড়ল সুমেরুগামী টোবল নদী। তৈমুর সাঁতরে নদী পার হয়ে ছেলের সঙ্গে যোগ দিলেন।

তারপর তৈমুরের চরেরা দৈবগতিকে হঠাৎ একদিন প্রধান দল থেকে বিচ্ছিন্ন দশজন শত্রু-সৈন্যকে গ্রেপ্তার করে ফেললে। বন্দিদের মুখ থেকে খবর পাওয়া গেল, তোক্তামিস সসৈন্যে যাত্রা করেছেন পশ্চিম দিকে।

আরও কিছুদিন একই লুকোচুরি খেলা চলল। তৈমুর বুঝলেন, এ বড় সহজ শত্রু নয়। এরা দেখা দেয় না, কিন্তু লুকিয়ে সব লক্ষ করে।

এরা পিছিয়ে যায়, কিন্তু যে-কোনও অসতর্ক মুহূর্তে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতন ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়তে পারে। দরকার হলে এরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক দিনে একশো মাইল পার হয়ে যায়।

তবু তিনি দমলেন না, থামলেন না। তোক্তামিসকে হাঁপ ছাড়বার ছুটি না দিয়ে ঝড়ের মতন এগিয়ে চললেন—একেবারে উরাল নদীর ওপারে।

তোক্তামিস দেখলেন, নাছোড়বান্দা তৈমুরের হাত ছাড়ানো অসম্ভব। জনহীন খাদ্যহীন দিগবিদিকহারা মরু-প্রান্তর, বেগবতী নদীর পর নদী, তুষারের ঝটিকা, বর্ষার প্রবল ধারা,—তবু তৈমুর আসছেন তাঁর পিছনে পিছনে। অবশেষে হতাশ হয়ে তোক্তামিস সসৈন্যে ফিরে দাঁড়ালেন।

তৈমুর তো তাই চান। এত কষ্টের পর তাঁর আঠারো সপ্তাহ ধরে আঠারো শত মাইল ব্যাপী পথ চলার শেষ হল! আজ এসপার কি ওসপার! হয় জয়, নয় মৃত্যু!

নিজের দলের দিকে ফিরে তৈমুর হুকুম দিলেন, ‘সৈন্যগণ, ঘোড়া থেকে নেমে পড়ো! বাকি যা খাবার আছে, সব খেয়ে শেষ করো ফ্যালো! তারপর অস্ত্র ধরো, যুদ্ধ করো!’

যুদ্ধ আরম্ভ হল। শত্রুরা সংখ্যায় বেশি, কিন্তু তাতাররা তখন মরিয়া। তারা জানে, এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলে তাদের একজনকেও আর দেশে ফিরতে হবে না। মৃত্যুপণ করেই তারা লড়তে লাগল। তারা শত্রুর কাছে দয়াও চাইবে না, শত্রুকে দয়াও করবে না।

বহুক্ষণ যুদ্ধের পর তোক্তামিসের দল সংখ্যাধিক্যের জন্যে যখন প্রবল হয়ে উঠেছে, তৈমুর তখন নিজের রক্ষীদল দিয়ে পর্বত-প্রাচীরের মতন শত্রুদের উপরে ভেঙে পড়লেন। তার বিষম চাপ সহ্য করতে না পেরে তোক্তামিস নিজের ফৌজ ফেলে পলায়ন করলেন। নায়ককে হারিয়ে শত্রুদের সমস্ত শৃঙ্খলা ভেঙে গেল—তাতারদের হাজার হাজার তরবারি করলে রক্তসাগর সৃষ্টি!

সেইদিন হল ইউরোপবিখ্যাত মহা-পরাক্রান্ত হৈম সংঘের পতন! যুদ্ধক্ষেত্রে এক লক্ষ মৃতদেহ ফেলে বাকি মোগলরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলে। তাতাররা ছুটল তাদের পিছনে পিছনে।

তারপর আরম্ভ হল লুন্ঠন। ডন নদীর দুই তীরে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে চলল হত্যা, অত্যাচার ও লুন্ঠনের নিষ্ঠুর লীলা। বাঁদি করবার জন্যে যে কত হাজার নারীকেও বন্দি করা হল তার আর সংখ্যা নেই। তাতাররা গোরু, মেষ ও উট এবং খেতের ফসল কিছুই ছাড়লে না। আর এত সোনা-রুপো হিরে-জহরত নিয়ে এল যে, প্রত্যেক তাতার সৈনিকের পেটের ভাবনা ঘুচে গেল জীবনের মতন!

আট মাস পরে বিজয়ী তৈমুর আবার নিজের রাজধানী সমরখন্দে ফিরে এলেন।

কিন্তু এর পরেও তোক্তামিসের জ্ঞান হল না। তিন বৎসর যেতে না যেতেই তিনি আবার কাস্পিয়ান সাগরের তটে দস্যুতা শুরু করলেন।

তৈমুর জ্বালাতন হয়ে লিখে পাঠালেন : ‘তোক্তামিস, তোমার বুকের ভিতরে কোনও শয়তান আছে? তুমি নিজের সীমানার মধ্যে শান্ত হয়ে থাকতে পারো না কেন? তুমি কি গত যুদ্ধের কথা ভুলে গিয়েছ? তুমি আমার শত্রুতাও দেখেছ। অতএব স্পষ্ট করে বলে পাঠাও তুমি আমার শত্রু হবে, না বন্ধু হবে?’

তবু তোক্তামিসের হুঁস হল না, আবার এলেন যুদ্ধ করতে। যুদ্ধ হল এবং এবারের যুদ্ধে তৈমুর হেরে যেতে যেতে কোনওক্রমে বেঁচে গেলেন। রণক্ষেত্রের এক চিত্রে দেখতে পাই—কোণঠাসা, রক্তাক্ত তৈমুরের তরবারি ভেঙে গিয়েছে, তাঁর অল্প কয়েকজন সঙ্গী ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়িয়ে চারিপাশ দিয়ে তাঁকে আগলে রেখে লড়াই করছে প্রাণপণে।

অবশেষে সাহায্য এল। তৈমুর আহত সিংহের মতন আবার আক্রমণ করলেন, মোগলরা আবার পালিয়ে গেল। এবং অনেকে তৈমুরের পক্ষে এসেও যোগ দিলে। এর পর থেকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আর তোক্তামিস ও হৈম সংঘের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না।

তৈমুর এবার সাক্ষাৎ যমের মতন রুশিয়ার দিকে ছুটে বেড়াতে লাগলেন,—আগুনের কবলে পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কত শহর, কত গ্রাম এবং আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠল মর্মভেদী মৃত্যু হাহাকারে।

মস্কো নগরে বসে রুশিয়ার গ্র্যান্ড প্রিন্সরা ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে সৈন্যশ্রেণি সাজাতে লাগলেন—তাঁরা জানতেন জয়ের কোনওই আশা নেই, কিন্তু তবু তাঁদের যুদ্ধ করতে হবে!

মস্কোর পথে পথে বেরুল ভীত নর-নারীর মিছিল। খ্রিস্ট জননীর মূর্তি নিয়ে মিছিলের জনতা অগ্রসর হয় এবং পুরুষ ও নারীরা নতজানু হয়ে রাস্তার ধুলোয় বসে পড়ে জোড়হাতে সক্রন্দনে বলে ওঠে—

‘ভগবানের মা, ভগবানের মা, রুশিয়াকে রক্ষা করো!’