নয়
প্রমথ জ্ঞানবাবুর বাড়ি যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন।
বড়পোল পেরিয়ে বাজার, যার নাম লিচুতলা। তার উত্তরে বিরাট এলাকার সবটাই আদি মোহনপুর। পুবে লোকোশেড আর রেললাইন, পশ্চিমে ক্যানেল এবং তার ওপারে ইটখোলা, কাঠগোলা, ঘোষেদের ডেয়ারি, নন্দীদের ফার্মিং, ভুতুবাবুর নার্শারি, ব্লক অফিস আর কোয়ার্টার। আদি মোহনপুরে ঢুকলে মনে হবে উত্তর কলকাতারই কোনো এলাকা। গলিঘুঁজি রাস্তা, দোতলা—তিনতলা পুরনো আমলের বাড়ি। সংকীর্ণ রাস্তাগুলো কদাচিৎ রোদ পায়। এমনকি কাশীর গলির মতো ষাঁড়ও ঘুরে বেড়ায়। এই বনেদি বসতি সেই নবাবি আমলের। মাড়ওয়ারের জৈনরা সতেরো শতক থেকে বাংলা মুলুকে ঢুকে ছিলেন। তখন ভাগীরথী মোহনপুরেরই ধার ঘেঁষে বইত। জেলার ইতিহাস তাই বলে। রেললাইনের ওধারে পুবের নিচু মাঠটা যে এক সময় খাত ছিল, এখনও বোঝা যায়!
প্রমথ যে পাড়ায় ঢুকলেন, তার নাম ছিল পাটোয়ারিপাড়া। পাটোয়ারিরাও জৈন। তাঁদের প্রায় সকলেই কলকাতা চলে গেছেন। আর সব মাড়োয়ারিরাও চলে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ক্রমে ক্রমে তাঁদের বংশের লোকেরা কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। ব্যবসা—বাণিজ্যের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে এতদিনে। অনেক নতুন মাড়োয়ারিও এসে জায়গা কিনে হালফ্যাসানি বাড়ি করেছেন। বাজারে দোকান দিয়েছেন। কিন্তু পাটোয়ারিপাড়ায় ফাঁক পেয়ে এলাকায় গ্রামগুলো থেকে কম করে সত্তর—আশি বছর ধরে ধনী এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা নানান গ্রাম থেকে এসে ঢুকে পড়েন। এখানে পুরনো আমল থেকেই শহুরে জীবনের আদল খানিকটা ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেল কোম্পানি রেললাইন পেতে স্টেশন করল। লোকো শেডও হল। স্বাধীনতার যুগে হল রেলইয়ার্ড, রেলকলোনি, নিজস্ব হাসপাতাল এবং স্কুল। এর পর ক্রমশ পাটোয়ারিপাড়ার নাম হয়ে গেছে অনেকগুলো। বাবুপাড়া, স্যাঁকরাপাড়া, বেনেপাড়া এই সব। বেনেদের রবরবা বেড়েছে। স্যাঁকরারা ক্ষয়ে টিমটিম করছে কোনোরকমে। বাবুপাড়ায় যাকে বলে পোলারাইজেশান ঘটে গেছে। কয়েক ঘর বিরাট ধনী, বাদবাকি ছোট ও মাঝারি চাকুরে এবং অগণতি বেকার ফ্যামিলি। এই সব বাড়ির ছেলেদের আলাদা দল আছে। তারা হেমাঙ্গ বা প্রমথবাবুদের নয়া বসত এলাকায় সুখী এবং মডার্ন ফ্যামিলির ছেলেদের দুচোখে দেখতে পারে না। এ পাড়ার মেয়েরা স্কুলকলেজে যাবার পথে ওদের প্যাঁক খায়। সে নিয়ে অনেকবার ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে। মজার কথা, মুসহরবস্তি এবং বাজারের মাঝামাঝি জায়গায় পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু কলোনি—সেখানকার ছেলেরা বাবুপাড়ার ছেলেদের ‘অপোজিট গ্যাং’। এরা ‘আউটসাইডার’ এবং ‘মডার্ন’দের ‘সাপোর্ট’ করে। হাঙ্গামা বাধলে বাবুপাড়ায় ঠেলে কোণঠাসা করে আসে ওদের। ওদিকে রেল কলোনির ছেলেরা ‘নিউট্র্যাল’। হরসুন্দর চাওলার কাছে এই সব তথ্য পাওয়া যাবে। এ হল মোহনপুরের নানামুখী স্রোতের খবর। কিন্তু তলার স্রোত বা ‘আন্ডারকারেন্ট’ তো থাকবেই। সেটা স্রোতের নিয়ম। এই আন্ডারকারেন্টের নমুনা ডনের গ্যাং। তার গ্যাংয়ে পাড়াভেদ ছিল না। বাজারপাড়া, বাবুপাড়া থেকে শুরু করে রেল—কলোনি, উদ্বাস্তু আর হাউসিং কলোনি জুড়ে ওর দলের রিক্রুট। অবশ্য, ভেল্টুবাবুরও একটা আলাদা গ্যাং আছে। কিন্তু সবাই জানে ভেল্টুবাবু আর ডনের গ্যাং কাজের বেলায় আলাদা নয়। ওদের সব শেয়ালের এক রব। ভেল্টুবাবু ও ডন পরস্পরকে খাতির করে চলেছে।
মোহনপুর যত নিজেকে ছড়িয়েছে বা ছড়াচ্ছে, তত তার জটিলতা বাড়ছে। প্রমথের নিজের জীবনেই যা দেখলেন, অবাক হয়ে যান। কয়েক বছরের মধ্যেই কত অচেনা মুখে ভরে গেছে মোহনপুর। আগে বাজারেই আসুন, আর কোনো পাড়াতেই ঢুকুন—অজস্র লোক বলে উঠত, ওভারসিয়ার বাবু যে! ভালো আছেন? কেউ বলত—বোসবাবু। কেউ বোসদা। আজকাল সেই ডাক কমই শোনেন।
এর আরেকটা কারণ থাকতেও পারে। তাঁর ভাইপো ডনের ওপর তো ভেতরে ভেতরে অনেকেই নৈতিক কারণে চটে গেছে। তার সঙ্গে প্রমথেরও কিছু ত্রুটি ঘটেছে। নিজেও বোঝেন। ডনকে শুধু লাই দিয়েছেন, তাই নয়—ছুতোনাতায় লোককে ডনের নাম করে শাসিয়েছেন। সম্প্রতি মনে হচ্ছে, খুব ভুল করেছেন। ডনের মতো বুনো ঘোড়াকে সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তার জন্যে তাঁর দেমাক দেখানো ঠিক হয়নি। এখন বরং ভয় হচ্ছে, ডনের অভাবে এবার তাঁকে পাঁকেপড়া হাতির মতো বিস্তর চামচিকের লাথি খেতে হবে!
জ্ঞানবাবু প্রখ্যাত নেতা নলিনাক্ষের ভাইপো। নলিনাক্ষ বাঁড়ুয্যে ব্রিটিশ যুগে মন্ত্রী ছিলেন কয়েক বছর। জেলার লোকের কাছে গর্বের ব্যাপার। উত্তরবঙ্গে জমিদারি ছিল। চা—বাগান ছিল। বিহারে কয়েকটা খনিও ছিল। নিঃসন্তান নলিনাক্ষের ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাঁড়ুয্যের দীক্ষা জ্যাঠার হাতে। তবে জেল খাটার সুযোগ পাননি। তাঁর জ্যাঠামশাইও তা পাননি। কিন্তু জেল না খাটলে কি দেশসেবা করা যায় না, নাকি নেতা বলে না লোকে? জ্ঞানবাবু জনপ্রিয় এম.এল.এ.।
তাঁর মতো লোকের কাছে ডনের কথা তোলাটাই ধৃষ্টতা হত। কিন্তু যে—কোনো কারণে হোক, ডনকে জ্ঞানবাবুর বাড়ির মেয়েরাও স্নেহ করেন বরাবর। ডনের অনেক গুণও তো ছিল। পরের জন্যে প্রাণ দিয়ে খাটতে তার মতো ছেলে একটিও নেই মোহনপুরে। তাছাড়া গুণ্ডামি মারামারি যা কিছু করুক, ডনকে অন্তত মেয়েদের ব্যাপারে কেউ কখনও ফক্কুরি পর্যন্ত করতে দেখেনি। বরং মেয়েদের সম্পর্কে তার শালীনতাবোধ ভারি অদ্ভুত। মেয়েদের সম্মান দিতে জানে সে। জ্ঞানবাবুর বাড়ির মেয়েরা ফাংশান হলে ডনের হেফাজতে গেছেন এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। ওবাড়ি বাইরের কোনো ছেলের পক্ষে অগম্য। অথচ ডনের ছিল যেন নিজেরই বাড়ি। সোজা ভেতরে চলে গেছে। ঘরে ঘরে ঘুরেছে।
প্রতিবার ইলেকশানে ডনের ভূমিকা ছিল দেখার মতো। নাওয়া নেই খাওয়া নেই, সারাদিন গাঁয়ে—গাঁয়ে ঘুরেছে দল নিয়ে। গত ইলেকশান অব্দি তার গুন্ডা বলে যত বদনাম থাক, চোর—ডাকাতের বদনামটা ছিল না। এই তিনটে বছরে ডন আস্তে আস্তে অন্য রাস্তায় পা বাড়িয়েছিল। প্রমথ সব জেনেও কিছু বলেননি। ওদিকে জ্ঞানবাবুর ছায়া থেকেও নাকি ডন দূরে চলে গিয়েছিল। জ্ঞানবাবুই সেকথা বলেছেন।
কিছুদিন আগে জ্ঞানবাবুর কাছে গিয়েছিলেন প্রমথ। জ্ঞানবাবু খুব উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। ডনের সঙ্গে তাঁর অনেককাল যোগাযোগই নাকি নেই। তার সম্পর্কে নানান কথা ওঁর কানে এসেছে। ডনকে ডেকে পাঠিয়েছেন, ডন যায়নি দেখা করতে। যাবে কোন মুখে?
জ্ঞানবাবু বলেছিলেন, ওকে আমি ছেলের বেশি স্নেহ করতুম। কতবার বলেছি, চাকরির ব্যবস্থা করে দিই। এড়িয়ে গেছে। আমার কী গরজ বলুন? তাছাড়া এখন আর তো প্রশ্নই ওঠে না। ও অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্টদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। আমার পক্ষে ওর হয়ে কিছু করা সম্ভবই নয়। আর, এই প্রথম হলে কথা ছিল। এর আগেও বেশ কয়েকবার ওকে ইনডিরেক্টলি আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি। ও সেজন্যে কৃতজ্ঞতাটুকুও প্রকাশ করতে আসেনি—কী বলব?
প্রমথ একটু হেসে বলেছিলেন, তবু সবাই তো বলছে, ডন আপনারই লোক! আপনার অপোজিট পার্টি তো মোহনপুর জুড়ে রব ছুটিয়েছে, আপনি নাকি ওকে ছাড়িয়ে নার্সিংহোমে রেখেছেন!
জ্ঞানবাবু রেগে আগুন। বলছে নাকি? কার কাছে শুনলেন?
প্রমথ অবশ্য মিথ্যা বলেননি। তাই রটেছে। বলেছিলেন, ভেঁটু ভটচাযরা বলছে শুনলুম।
জ্ঞানবাবু গুম হয়ে গিয়েছিলেন। প্রমথ বুঝতে পেরেছিলেন, ওষুধ ধরেছে। এরপর আরও নানান কথা হয়েছিল। শেষঅব্দি জ্ঞানবাবু বলেছিলেন, একটা কাজ আমি করতে পারি। অ্যারেস্টেড পার্সন উন্ডেড হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল, কেমন তো? তারপর সে হসপিটাল থেকে নিখোঁজ হয়েছে। তাই না?
প্রমথবাবু বলেছিলেন, হ্যাঁ। লোকাল থানা অফিসার শুধু এটুকুই জানালেন আমাকে।
কোন এরিয়ায় অ্যারেস্ট হয়েছিল? কলকাতায় তো?
মুচিপাড়া।
ঠিক আছে। দেখব অ্যাসেমব্লি সেশন এখন মুলতুবি আছে। পরশু শুরু হচ্ছে আবার। আমি কথা তুলব। পুলিশ ডনকে মেরে ফেলে নিখোঁজ বলে রটাতেও পারে। দিস ইজ দা পয়েন্ট।
জ্ঞানবাবু আরও বলেছিলেন, তবে ডনের এই লাস্ট চান্স। যদি হতভাগার বরাতে তেমন কিছু—ভগবান না করেন, ঘটে না থাকে, তো ওকে যাতে খুঁজে বের করে ছাড়িয়ে নেওয়া যায়, সে চেষ্টা আমি করব। একটু মিথ্যে বলতে হবে আর কী! বলতে হবে, পলিটিকাল ওয়ার্কার আমাদের দলের। মিথ্যে ওকে জড়ানো হয়েছে। ব্যাপারটা ইমিডিয়েটলি তদন্ত করা হোক। কেমন তো?
প্রমথ খুশি হয়ে বলেছিলেন, যথেষ্ট, যথেষ্ট।…
তারপর থেকে রোজ খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়েছেন প্রমথ। বিধানসভার অধিবেশন শুরু হয়েছে। কিন্তু আজকাল কাগজগুলোর কী যে হয়েছে, ডিটেলস কিচ্ছু থাকে না আগের মতো। আগে প্রশ্নোত্তরগুলো সবটাই থাকত। ভারী উপভোগ্য ছিল। আজকাল একেবারে শর্টকাট। খুব গুরুত্ব না থাকলে কিছু দেয় না। জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের এলাকার ব্যাপার—স্যাপার নিয়ে কে কী বলছেন, কিচ্ছু জানা যায় না।
এভাবে অনেকগুলো দিন চলে গেছে। তারপর হঠাৎ প্রমথ সেদিন অমির কাছে ডনের খবর পেয়েছেন। অমির কাণ্ড শুনেও বিরক্ত হয়েছেন। বাড়াবাড়ির সীমা ছাড়িয়ে গেছে অমি। একবার না হয় গিয়ে ভাইটাকে দেখে এলি—দিদির মন! কিন্তু পরের দিন আবার ওইভাবে জলকাদা মেখে রাতবিরেতে না গেলেই চলত না? শরীরের ওই অবস্থা! তার চেয়েও বড় কথা, বাড়ির খিড়কির দরজা ওভাবে বাইরে থেকে ভেজিয়ে রেখে যাওয়া! এখন আর বাড়িতে ডন নেই, সবাই জানে। বাড়ির নিরাপত্তাই নেই আর। চারদিকে যা চুরি—ডাকাতি চলছে!
কদিন থেকে অমিকে সুলোচনা নজরবন্দি রেখেছেন। এদিকে হিস্ট্রিরিয়াটা কমে গিয়েছিল ইগ্নেশিয়া থাউজ্যান্ডে। আবার রিভাইভ করেছে। করবেই তো! মানসিক উত্তেজনা বা অশান্তি হলেই করবে। এবার আর চড়া পাওয়ার নয়, সিক্স এক্স থেকে শুরু করেছেন। সাতদিন এই ডোজ চলার পর আরেকটা ওষুধ দেবেন। ফসফরাস থার্টি এক্স। আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলোকে খতম করতে হবে। একটু আগে পাশে বসে খুঁটিয়ে সিম্পটমগুলো নোট করে নিয়েছেন। মেয়েটার চেহারা দেখে কষ্ট হচ্ছে প্রমথের। খুব মোটাসোটা না হলেও গায়ে জোর ছিল খুবই। মুখখানা সব সময় খুশিতে ঢলঢল করত। আর কথায়—কথায় হাসি—তামাশা! অবশ্য একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবও ছিল। আচমকা যা—তা বলে বসত লোককে। নিজের মেয়েদের মধ্যে বুলুর খানিকটা ওই স্বভাব আছে। জামাইবাবাজীকে সব সময় তটস্থ রাখে দেখে প্রমথ মনে মনে হাসেন। অমির বিয়ে হলে অমিও হয়তো তাই করবে।
প্রমথ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলেন। অমির বিয়ে! আর কে ওকে বিয়ে করতে চাইবে? সতীশ মোক্তারের ভাইপোর মতিগতি দেখে মাঝে মাঝে আশা জাগে, আবার নিরাশ হতে হয়। সতীশের বউ মানদাসুন্দরী একানড়ে মেয়ে বরাবর। মেলামেশা বিশেষ করেই না কারও সঙ্গে। সে বেঁচে থাকতে কি ভাইপো হেমাঙ্গকে ওই মেয়ে নিতে দেবে? তার ওপর কায়েতের মেয়ে! এক ভরসা ছিল, হেমাঙ্গটা স্বাধীনচেতা ছেলে। নম্র, একটু ভীতুও বটে—কিন্তু স্বাধীনচেতা ছেলেরা হঠকারী হয়, এই হচ্ছে প্রমথের বিশ্বাস। এখন শুধু একটুখানি ক্ষীণ আশা, হাবুর সঙ্গে ওকে ভিড়িয়ে যদি এখানে কন্ট্রাক্টরিতে লাগানো যায়—নিজের জোরে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে। ততদিনে আমিও কি সেরে উঠবে না? অমির সঙ্গে হেমাঙ্গের ভাবভালোবাসা আছে, কে না জানে!
প্রমথ চাইছেন একঢিলে দুই পাখি মারতে। ডাবুর সঙ্গে মিলুর বিয়ের কথাটা এমাসে প্রচুর এগিয়েছে। ডাবুর বাবা—মায়ের কোনো আপত্তি নেই। ডাবুরও নেই বলে মনে হচ্ছে। ঠাকুর কৃপা করলে জ্যৈষ্ঠ মাসেই শুভ কাজ চুকিয়ে ফেলা যাবে। মিলুর পরীক্ষা আছে সামনে। পরীক্ষাটা হয়েও যাবে ততদিনে।
প্রমথ আজ যে জ্ঞানবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন, তার উদ্দেশ্য ডন নয়, ডাবু। ছোকরা বি.ডি.ও.—র সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। মোহনপুরে কমিউনিটি সেন্টার হবে। প্রজেক্ট রেডি। টেন্ডার শিগগির ডাকা হচ্ছে। ডাবু আজকালের মধ্যে এসে পড়বে। তার আগে জ্ঞানবাবুকে একটু ধরা দরকার।
সেকেলে বিরাট হলঘরে আরও অনেকে অপেক্ষা করছে জ্ঞানবাবুর জন্যে। জ্ঞানবাবু এখনও ওপর থেকে নামেননি। ওঁর পি.এস. আকবর প্রমথকে দেখে এগিয়ে আসে। বোসদা যে!
নাতির বয়সি ছোকরা দাদা বলে। আগে ক্ষুব্ধ হতেন। এখন মেনে নিয়েছেন। আকবরের বাবা পাশের গ্রামের ধনী গৃহস্থ—যাদের বলা হয় জোতদার। অথচ আকবর জ্ঞানবাবুর প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি নিয়েছে, শখের চাকরি নিয়েছে, শখের চাকরিই বলা যায়। বি.এ. পাশ করে চাষবাস নিয়ে থাকতে যাবে কেন? তবে ছেলেটি বড্ড বেশি স্মার্ট। সবজান্তার মতো কথা বলে। জ্ঞানবাবু নাকি ওঁর কথাতে ওঠেন বসেন।
তাই বলে ডনের ব্যাপারে আকবরের থ্রু দিয়ে যাননি প্রমথ। জ্ঞানবাবুর সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পর্ক আছে ডনের সুবাদেই। গম্ভীর মুখে সোফায় বসে বলেন, হ্যাঁ হে আকবর, কখন নামবেন জ্ঞানবাবু?
অন্যদের মতো ছোটবাবু বলেন না প্রমথ। আকবর ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে, সময় হয়েছে।
প্রমথ দ্রুত বলেন, আমি বাপু স্লিপটিপ দেব না। তুমি আমার নাম বোলো।
আকবর হাসে। বোসদার কারবারই আলাদা।
দরজায় আবার কোনো দর্শনার্থী এসেছে। আকবর তাকে খাতির করতে এগিয়ে যায়। প্রমথ টের পান, ভুল সময়ে এসেছেন। এখন লোকের ভীড় হয়। সন্ধ্যার পর এলেই ভালো হত সেদিনকার মতো।
কিন্তু এসে যখন পড়েছেন, আর কী করা! জ্ঞানবাবু নামবেন তো ওই সিঁড়ি দিয়ে। দেখতে পেলেই এগিয়ে যাবেন, হলঘর থেকে ঘোরালো কাঠের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। কার্পেট পাতা সিঁড়ি। খুব পুরনো বেরঙা কার্পেট। সিঁড়ির ধারে এখানে ওখানে ছোট্ট থামে ভাস্কর্য আছে। জমিদারি কারবার আর কী! বাড়ির ভেতরে কখনো যাবার সুযোগ পাননি প্রমথ। ডনের কাছে গল্প শুনেছেন। এখন মনে হচ্ছে ডন থাকলে কত ভালো না হত! তাঁকে সাধতে আসতে হতই না। ডনই সব করে দিত। এবং দিতই।
এ মুহূর্তে ডনের অভাব তীব্র হয়ে বুকে ধাক্কা মারে প্রমথের। ডনের মতো ছেলেরা কত প্রয়োজনীয় এ যুগে ভাবা যায় না! এই যে আকবর ডাঁট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, ডনকে দেখলে লেজ নাড়ত না কি? ডন তো সোজা ওপরে চলে যেত। সটান জ্ঞানবাবুর ঘরে ঢুকে ডাকত—জ্ঞানদা।
এই সময় সিঁড়ির মাথায় জ্ঞানবাবুর ধবধবে ফর্সা চেহারাটি দেখা গেল। হলঘরের সবাই উঠে দাঁড়াল। প্রমথও উঠলেন। তবে সম্মান জানাবার জন্যে নয়। সিঁড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। জ্ঞানবাবু হাসিমুখে নমস্কার করতে করতে নামছেন। প্রমথকে দেখে বলেন—আরে! প্রমথবাবু যে? ভালো?
প্রমথ ব্যাকুল স্বরে বলেন, আমি সবার আগে কথা সেরে নেব। আমার ঘরে মরণাপন্ন পেসেন্ট। খুব সঙ্কটের মধ্যে আছি। এক্ষুনি ফিরতে হবে।
কার অসুখ করল আবার?
ডনের দিদির। মানে অমির।
অমির? ওঃ হো! শুনেছিলুম বটে কী যেন সব… জ্ঞানবাবু হাসেন একটু। ভূতুড়ে ব্যাপার না কী যেন?
হিস্টিরিয়া। উৎকট হিস্টিরিয়া। একেবারে লাস্ট স্টেজে পৌঁছেছে।
আচ্ছা! তাহলে তো মুশকিল। কলকাতায় কোনো হসপিটালে ব্যবস্থা করে দিতে হবে?
প্রমথ দমে যান। বলছি সব। ঘরে বসুন, বলছি।
প্রমথ পেছন পেছন ঢুকে পড়েন পাশের একটা ঘরে। বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল আছে। জ্ঞানবাবু বসে টেবিলের কাগজগুলো দেখতে দেখতে বলেন, হুঁ, তারপর?
প্রমথ সামনের চেয়ারে বসে বলেন, তারপর আর কী? আমি নিজেই তো একটু—আধটু হোমিয়োপ্যাথির চর্চা করি—টরি। আমিই ওষুধপত্র দিচ্ছি।
হুঁ! জ্ঞানবাবু স্লিপগুলো দেখতে ব্যস্ত।
এই সময় আকবর ঢোকে। দাদা, কাপাসীর একদল লোক এসেছে। ওদের সেই ইরিগেশন প্রজেক্টের ব্যাপার। সব্বাই দেখা করতে চায়। বললুম, দুজন এসো। শুনছে না।
আসুক না। সবাই আসুক।
প্রমথ বলেন, তাহলে আমি প্রাইভেটলি কথাটা আগে সেরে নিই ছোটবাবু।
হ্যাঁ, বলুন।
আকবর প্রমথের দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে। প্রমথ মনে মনে বিরক্ত। বলেন, একটু কনফিডেন্সিয়াল, ছোটবাবু।
ও। আকবর, ওদের দুমিনিট বসতে বলো না ভাই। এক্ষুনি ডাকছি।
আকবর বেরিয়ে যায়। প্রমথ একটু কেসে বলেন, ডনের ব্যাপারটা…
জ্ঞানবাবু বলেন, আরে, সে তো অ্যাসেমব্লিতে তুলেছিলুম। এনকোয়ারিও হয়ে গেছে। ডন নিজেই পালিয়েছে! বাড়ি আসেনি বুঝি?
প্রমথ মাথা দোলান। না তো!
জ্ঞানবাবু বলেন, ও তো এখন অ্যাবস্কন্ডার! ধরা না পড়া অব্দি আমার কিচ্ছু করার নেই। তাছাড়া ওর বিরুদ্ধে সিরিয়াস কেস আছে। বউবাজারে একটা জুয়েলারি দোকানে ডাকাতি করতে ঢুকেছিল নাকি। কী যে বলব হতচ্ছাড়া ছেলেটাকে! অত ভালোবাসতুম ওকে। আমার স্ত্রী, আমার মেয়েরাও ওকে বাড়ির ছেলের মতো ভাবত! এখন যা অবস্থা, ভেরি ডেলিকেট ব্যাপার। আমার মানসম্মানের প্রশ্ন আছে। কী যে করতে পারব, জানি না। শুধু এটুকু অ্যাসিওরেন্স আপনাকে দিচ্ছি, ও ধরা দিক—কিংবা ধরা পড়ুক, তখন আমাকে জানাবেন। আমি দেখব, কী করতে পারি। কেমন?
প্রমথ গতিক বুঝে একটু ইতস্তত করে আমতা হাসেন। তারপর দুম করে বলে ফেলেন, ইয়ে—ছোটবাবু, আমার আর একটা ছোট্ট আর্জি ছিল। বলতে গেলে, হারামজাদা ডনের জন্যে আর তত মাথাব্যথা নেই। এটুকুর জন্যে আসা!
বেশ তো, বলুন।
প্রমথ করুণ মুখে বলেন, আমার চার মেয়ে। বড়র বিয়ে দিয়েছিলাম বহরমপুরে। এখন কপাল ভেঙে আমার কাছে ফিরে এসেছে।
কী? ডিভোর্স নয় তো? আজকাল যা হচ্ছে! জ্ঞানবাবু হাসেন।
না, বিধবা হয়েছে। এক বছরের মধ্যেই।
স্যরি। মনে পড়ছে, শুনেছিলুম যেন। তারপর?
মেজোর বিয়ে দিয়েছি সিউড়িতে। প্রমথ সংক্ষিপ্ত করেন কথা। এখন বাকি দুই মেয়ের মধ্যে বড়টি বিয়ের যুগ্যি হয়েছে। এবারে বি.এসসি. ফাইনাল দিচ্ছে। এদিকে আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। ফতুর হয়ে আছি। এদিকে বয়সও হয়ে গেল। কখন চোখ বুজি ঠিক নেই। তা—
হ্যাঁ, বলুন।
একটি ভালো ছেলে সম্প্রতি পেয়েছি। ওদের আপত্তি নেই। আপনি ওদের চিনবেন।—বলে প্রমথ ডাবুর কথা পাড়লেন। জ্ঞানবাবু চেনেন ডাবুকে। তাই আরও উৎসাহে মূল কথায় চলে এলেন।—ছোটবাবু, কমিউনিটি সেন্টারের প্রজেক্টটা যদি ডাবু পায়—ও ইতিমধ্যে খুব নাম করেছে টাটানগর এরিয়ায়। ওর ফার্মের হাতে অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে। সব কাগজপত্র দেখাতে পারি—যদি সময় করে দেখতে চান। অবশ্য সে সাবকন্ট্রাক্টর। তাহলেও এক্সপিরিয়েন্স তো হয়েছে। ভেরি এনার্জেটিক অ্যান্ড এফিসিয়েন্ট ছেলে। এখানে কাজটাজ পেলে চলে আসবে, এবং—
জ্ঞানবাবু হাসিমুখে বলেন, আপনার কন্যাদায় উদ্ধার হবে। কেমন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই বড় ভরসা। দয়া করে আমায় নিরাশ করবেন না, ছোটবাবু!
কিন্তু ও তো ব্লক অফিসের ব্যাপার। ওঁরা টেন্ডার ডাকবেন।
আপনি তো অ্যাডভাইজারি কমিটির চেয়ারম্যান। আপনি বললেই হবে।
জ্ঞানবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনার উপকার হলে আমার আপত্তি কী? কিন্তু ব্যাপারটা ইললিগ্যাল। আপনি তো এসব লাইনে পাকা লোক। প্রসিডিওর আইন—কানুন সবই জানেন। ভেঁটুবাবুরা এখন সব সময় ওৎ পেতে বেড়াচ্ছে।
এই সময় আকবর আবার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারে। প্রমথ হাত তুলে বলেন, আর এক সেকেন্ড ভাই। হয়েছে!
জ্ঞানবাবু ঘড়ি দেখে বলেন, এখনই কথা দেওয়া মুশকিল। ওবেলা কমিটির মিটিং আছে। টেন্ডার কল করা হবে। আপনি ওকে বলুন, টেন্ডার সাবমিট করুক। তারপর দেখছি কী করা যায়। আর ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতেও বলুন। ঠিক আছে?
প্রমথ উঠে দাঁড়ান। করজোড়ে বলেন, এতকাল কোনোকিছু চাইনি ছোটবাবু। প্রার্থনাটা মনে রাখবেন দয়া করে। বৃদ্ধের কন্যাদায় উদ্ধার করলে ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন।
জ্ঞানবাবু হাসতে হাসতে বলেন, পাত্র যদি কাজ পেয়ে আপনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায়?
প্রমথ শশব্যস্তে বলেন, না না। ওদের সঙ্গে আমাদের দু’পুরুষের সম্পর্ক! ডাবু তো প্রায়ই আসে। আমার বাড়িতে থেকেই একরকম মানুষ বলতে পারেন।
অলরাইট প্রমথবাবু!
প্রমথ হাসিমুখে বেরিয়ে যান। দু’মিনিটের জায়গায় পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছেন। সেই গর্বে হনহন করে বেরিয়ে যান কারুর দিকে তাকান না।
তাকালে দেখতে পেতেন, দর্শনার্থীদের মধ্যে সতীশ মোক্তারের বিধবা স্ত্রী মানদাসুন্দরীও বসে আছে কোণার দিকে।
এবং প্রমথকে দেখে কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছিল সে। কিন্তু প্রমথ সোজা বেরিয়ে গেলেন।
হেমাঙ্গ অভ্যাসমতো দক্ষিণের জানালায় বসে বাসি খবরের কাগজ পড়ছিল। সেদিনের কাগজ আসতে সেই বারোটা। অবশ্য স্টেশনে গেলে সকালের মধ্যেই কাগজ পাওয়া যায়। কিন্তু তার কাগজ আসে লোকাল এজেন্ট অধীরবাবুর কাছ থেকে। অধীরবাবুর লোক সাইকেল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিলি করে। হেমাঙ্গের এখানে তার শেষ কাগজ বিলি।
তবে এটা মন্দ না। দুপুরের খাওয়ার পর শুয়ে কাগজ পড়তে ভালো লাগে হেমাঙ্গের।
এখন এভাবে বসে বাসি কাগজ পড়ার মানে সময় কাটানো। মুনাপিসি বেরিয়ে গেছে কোথায়। বলে গেছে, বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবিনে। হেমাঙ্গকে একটা রিকশা ডাকতেও হয়েছে। এ পাড়ার রাস্তার যা অবস্থা, রিকশো আসতে চায় না। সেই বড় পোলের কাছ থেকে অনেক খোসামুদি করে আনতে হয়েছে। কিন্তু পিসিমার গন্তব্যস্থল হেমাঙ্গ জানে না। শেষ অব্দি সতীশ মোক্তারের খাতির।
মুনাপিসির এই যাওয়াটা রহস্যজনক। হেমাঙ্গ জিগ্যেস করেছিল থানায় যাচ্ছ না তো?
নারে বাবা না। তুই চুপ করে বসে থাক তো।
হেমাঙ্গ ভেবেই পায় না, কোথায় যেতে পারে মুনাপিসি রিকশো চেপে? সচরাচর তো যায় না। কতকটা একানড়ে মতো থাকে। গেলে বড়জোর রিফিউজি কলোনিতে। এ ছাড়া মাসের গোড়ায় আগে যেত পোস্টাপিসে টাকা তুলতে,—আজকাল ব্যাঙ্ক হয়েছে, ব্যাঙ্কেই যায়। মুনাপিসি এভাবে চুপচাপ কেমন করে সময় কাটায় সে ভেবে পায় না।
সেদিনের একটু রাগারাগি বা অভিমান কাটতে বেশি দেরি হয়নি। হেমাঙ্গের নিজের পায়ে দাঁড়াবার যে জেদটা চড়েছিল, আবার মিইয়ে গেছে। আলস্যের অভ্যেস দানা বেঁধে গেলে তাকে কাটানো ভারী কঠিন। আবার দিন কাটছে, রাত কাটছে এলোমেলো চিন্তায়, কল্পনায়—অর্থাৎ তার চিরাচরিত দিবাস্বপ্নে। সেই দিবাস্বপ্নে আমি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য, যৌবন ও সৌন্দর্যের প্রতীক, এবং হেমাঙ্গও এক বলিষ্ঠ যৌবনসম্পন্ন পুরুষ। মাঝে মাঝে সেই দিবাস্বপ্নে তীব্র যৌনতা এসে তাকে উত্তপ্ত করে তোলে। বুঝতে পারে শরীরের খেলায় প্রাণীদের মতো জড়িয়ে পড়ার ফলে মানুষের ভালোবাসা ভীষণ কষ্টদায়ক এবং সমস্যাসংকুল হয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সে চুপি চুপি বালিশ শুঁকেছে অমির চুলের গন্ধ পাবে বলে। অমি সে রাতে কিছুক্ষণ শুয়েছিল এই বিছানায়। ইতিমধ্যে বালিশের ওয়াড় বদল হয়েছে। বিছানার চাদরও গেছে পালটে। অথচ গন্ধটা এখনও যেন পায়। হয়তো স্মৃতির গন্ধ।
সেদিন ইলুর কাছে অমির কথা জানার পর থেকে অমির জন্যে সে সারাক্ষণ ছটফট করেছে। নিজের ভীরুতায় তার নিজের ওপর ঘৃণা হয়েছে। অন্তত বোসবাড়ি গিয়ে অবস্থাটা দেখে আসতে পারত। অমির পাশে বসে সান্ত্বনা দিতেও পারত।
মনে মনে তৈরি হয়নি, তাও নয়। কিন্তু শংকরা তাকে কেমন ভয় ধরিয়ে দিল। হেমাঙ্গের খুলির কথা বলল। জগার খুলিটা দেখেছে হেমাঙ্গ। তার নিজেরও যে একটা খুলি আছে, শংকরা তাকে টের পাইয়ে দিল।
অমিকে দেখতে যাবার ইচ্ছেটা তখনকার মতো দমে গেল হেমাঙ্গের। তারপর, ও কিছুই নয়—শংকরা তাকে নিছক তামাশা করে ভয় দেখিয়েছে, এই ভেবে হেমাঙ্গ আবার তৈরি হচ্ছিল মনে মনে। হঠাৎ কাল বিকেলে এক ভদ্রলোক এলেন।
মাথায় উঁচু, রোগাটে গড়ন, তামাটে রঙের লোক। মুখে পোড়খাওয়া ভাব। গোঁফদাড়ি সম্ভবত দু’দিন কামানো হয়নি। লম্বাটে নাক, কিন্তু চোখ দুটো গোল, কুতকুতে চাউনি। গায়ে সাদা হাতগুটানো শার্ট, পরনে যেমন তেমন করে পরা ধুতি, পায়ে গাবদা পাম্পসু। বুকপকেটে নোটবই আর কাগজ ঠাসা ছিল। দুটো কলমও।
লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার, তাঁর মুখের নির্বিকার ভাব। কোনো এক্সপ্রেশন নেই। ঠোঁট ফাঁক হয় এবং দাঁতও একটু দেখা যায়—অর্থাৎ হাসি, কিন্তু সে—হাসিও ঠিক হাসি নয়। এমনি একজন ভদ্রলোক ধীরেসুস্থে রাস্তা থেকে উঠে বারান্দায় এলেন। হেমাঙ্গ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল তখন। কিছু জিজ্ঞেস না করে ওভাবে উঠে আসায় হেমাঙ্গ অবাক হয়েছিল।
আপনি হেমাঙ্গ ব্যানার্জি? এই তাঁর প্রথম প্রশ্ন।
হেমাঙ্গ ঘাড় নেড়েছিল। হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। একটু বসতে চাই।
হেমাঙ্গ ইতস্তত করে বলেছিল, কোত্থেকে আসছেন আপনি?
থানা থেকে।
থানা থেকে মানে? হেমাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে অবশ কয়েক মুহূর্ত। ঊরু ভারী। চোয়াল আঁটো।
আমি আই.বি. সাব—ইন্সপেক্টার।
সামলে নিয়ে হেমাঙ্গ জ্বলে ওঠার মতো চার্জ করেছিল, আমার কাছে কী?
ভদ্রলোক সেই নির্বিকার হেসে বলেছিলেন, বলব বলেই তো এসেছি ভাই।
হেমাঙ্গের স্বভাবে ভীরুতা আছে। কিন্তু সে কোনো কোনো সময় উলটো মেরুতেও চলে যেতে পারে। সম্ভবত সব ভীরু মানুষের বেলায় এটা হয়। একটা মুহূর্ত আসে, যখন সে মরিয়া। শুধু মানুষ কেন, এমন প্রাণীও তো আছে। খেঁকি নেড়ি কুকুরও হঠাৎ খ্যাঁক করে কামড়ে দিতে পারে। হেমাঙ্গ বলেছিল, কিন্তু আপনি যে আই.বি. অফিসার, কেমন করে বুঝব?
তখন ভদ্রলোক পকেট থেকে আইডেন্টি কার্ড বের করে সামনে ধরলেন। হেমাঙ্গের বুক ধুক ধুক করছিল। সে ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখে বলেছিল, আচ্ছা, ভেতরে আসুন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে চেয়ারে বসলেন। হেমাঙ্গ বলেছিল, চা বলি?
ধন্যবাদ। অসুবিধে না থাকলে আপত্তি নেই।
হেমাঙ্গ ভেতরে গিয়ে মুনাপিসিকে আসল ব্যাপারটা গোপন করে শুধু বলেছিল, এক পরিচিত ভদ্রলোক এসেছেন, পিসিমা। এককাপ চা করে দাও না!
মুনাপিসি বলেছিল, কে রে?
চিনবে না। বলে হেমাঙ্গ ফিরে এসেছিল। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বলেছিল, বলুন!
আপনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন!
হেমাঙ্গ নড়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা…
আপনার ভয় পাওয়ার কারণ নেই, এটা জাস্ট সে—ব্যাপারেই একটা এনকোয়ারি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন তো? তাই বলুন।
দ্যাটস রাইট।
আগে বললেই হত স্যার! হেমাঙ্গ তোয়াজ শুরু করেছিল। কী মুশকিল!
আমি আপনাকে ইনশলটিং টোনে কথা বলেছি! হেমাঙ্গ নির্মল হেসে ব্যাপারটা হালকা করতে চাইছিল।
আই.বি. অফিসার তেমনি নির্বিকার। নোটবই বের করে কীসব দেখে নিয়ে তারপর বলেছিলেন, এর আগে কোনো চাকরিবাকরি করেননি তো?
না। পাইনি। পেলে তো…
এরপর বাবা—মায়ের নাম, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না, বাবা কী চাকরি করতেন… এইসব থেকে শুরু করে হেমাঙ্গের পুরোদস্তুর জীবনচরিত এসে গিয়েছিল। একফাঁকে মুনাপিসি পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে চা দিয়ে গেল। চা খেতে—খেতে গোয়েন্দা হেমাঙ্গের সোস্যাল ওয়ার্ক, খেলাধুলোর ঝোঁক, ইত্যাদি হরেক প্রশ্ন করতে থাকলেন। হেমাঙ্গ খুশিমনে জবাব দিচ্ছিল। বাড়তি কথাও যোগ করছিল। চায়ের কাপ নীচে রেখে গোয়েন্দা তারপর হঠাৎ বলেছিলেন, অমিতা বোস নামে একটি মেয়েকে চেনেন নিশ্চয়?
হেমাঙ্গ চমক খেয়ে জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ। চিনি। কেন বলুনতো?
অমিতার সঙ্গে আপনার কেমন সম্পর্ক?
কেমন সম্পর্ক মানে?
আই মিন, হোয়েদার ইউ হ্যাভ এনি এমোশানাল অ্যাফেয়ার উইথ হার?
হেমাঙ্গ আকাশ থেকে পড়ার মতো বলেছিল, এর সঙ্গে আমার চাকরির ভেরিফিকেশানের সম্পর্ক কী?
আপনার মরাল ক্যারেক্টার সংক্রান্ত। বুঝলেন না? জাস্ট ক্যারেক্টার ভেরিফিকেশন।
হেমাঙ্গ গম্ভীর মুখে বলেছিল, মোহনপুরে অনেকে অনেক কথা রটাতে পারে। কিন্তু অমিতা আমার ভাবী স্ত্রী।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। চাকরি পেলেই বিয়ে করব।
আপনারা তো ব্রাহ্মণ। ওরা কায়স্থ।
আমি ওসব মানি নে। আজকাল কেউ মানে না।
আপনার গার্জেন আপত্তি করবেন না?
সম্ভবত না। হেমাঙ্গ এবার ভীষণ বিরক্ত। কিন্তু চাকরির ব্যাপার বলে তেতো বড়ি গিলতেই হচ্ছিল তাকে।
সম্প্রতি অমিতার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?
একটু দেরি করেই জবাব দিয়েছিল হেমাঙ্গ। না। কেন? সে তো অসুস্থ শুনেছি।
আপনি অমিতার ভাই সুপ্রকাশ ওরফে ডনকে তো চেনেন?
চিনি। কেন?
ডনের সঙ্গে সম্প্রতি নিশ্চয় দেখা হয়েছে আপনার?
না। এবার হেমাঙ্গ ঘামতে শুরু করেছিল।
ডন কোথায় আছে, তার দিদি নিশ্চয় বলেছে আপনাকে?
না। কিন্তু এসব কেন জিগ্যেস করছেন আমাকে?
অন্তত ডন সুস্থ না অসুস্থ, এটুকু নিশ্চয় বলেছে?
হেমাঙ্গ জোরে মাথা নেড়েছিল। ডনের কোনো খবর আমি জানিনে। কেউ বলেনি। আপনি অকারণ আমাকে টিজ করছেন স্যার!
সিক্সথ এপ্রিল রাত্রে আপনি এবং অমিতা কোথায় গিয়েছিলেন?
হেমাঙ্গ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর জবাব দিয়েছিল, কে বলল আপনাকে?
কোথায় গিয়েছিলেন হেমাঙ্গবাবু?
একটু চুপ করে থাকার পর হেমাঙ্গ বলেছিল, আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে বের হই। সবাই জানে।
রাত্রে?
হ্যাঁ। অনেক সময় রাত্রেও গেছি।
সিক্সথ এপ্রিল কোথায় গিয়েছিলেন?
ক্যানেলের স্লুইস গেটের ওখানে। কতবার তো গেছি।
রাত একটা—দেড়টায়?
হেমাঙ্গ একটু ফুঁসে উঠেছিল এবার। আপনি কিন্তু স্যার ইনডিভিজুয়াল লিবার্টিতে হস্তক্ষেপ করছেন। রাতে বেড়ানো নিশ্চয় বেআইনি নয়?
ডিপেন্ডস। আচ্ছা হেমাঙ্গবাবু, আমি উঠি। গোয়েন্দা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর আগের মতো বিকারহীন হেসে ফের বলেছিলেন, শিগগির কোথাও বাইরে যাচ্ছেন না আশা করি!
না। কেন?
প্লিজ টেক ইট অ্যাজ এ ফ্রেন্ডস অ্যাডভাইস, আপাতত কিছুদিন বাইরে যাবেন না। জরুরি কারণে যেতে হলে দয়া করে থানায় একবার জানিয়ে যাবেন। আর, দেখুন হেমাঙ্গবাবু, কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আপনাকে আমার ভালো লাগল বলেই বলছি। মাঝে—মাঝে আমরা কেউ আপনাকে বিরক্ত করতে পারি। কিংবা ধরুন থানা থেকে ডাকা হতেও পারে আপনাকে। নির্ভয়ে যাবেন। আপনি যদি ক্লিন হন, ভগবান আপনাকে রক্ষা করবেন। আরে ব্রাদার, তিনি তো আছেন মাথার ওপর।
শেষ কথাগুলো শুনে হেমাঙ্গের কান গরম হয়ে গিয়েছিল। ভগবান দেখাচ্ছে! নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়েছিল সে। গোয়েন্দাটি ধীরে সুস্থে হেঁটে যাচ্ছেন। এতক্ষণে লক্ষ্য করল, মাথার পেছনে টাক আছে।
সেই সময় মুনাপিসি ভেতর থেকে ছিটকে এসেছিল। তারপর চাপা গলায় বলেছিল, কী রে হেমা, কী? তুই কী করেছিস? ও অত কথা জিগ্যেস করছিল কেন? ও হেমা!
চুপ করো তো বাবা! চাকরির ব্যাপারে ভেরিফিকেশনে এসেছিল।
আই.বি.। তাই না?
হ্যাঁ।
হেমা! এবার হল তো? এবার দেখ, কে তোকে বাঁচাবে! তোর পিসেমশাই থাকলে…
আঃ, চুপ করো না বাবা।
ওরে হেমা! আমি সব শুনলুম যে রে! চাকরি—টাকরির ব্যাপার নয়। প্রমথ বোসের ভাইঝি তোকে ডুবিয়েছে! আমি কতবার তোকে বলেছি, ওই সর্বনাশীর দিকে তাকাসনে হেমা!
হেমাঙ্গ রাগ দেখিয়ে বলেছিল, বাইরে দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট কোরো না তো। ভেতরে এসো।
ভেতরে গিয়ে মুনাপিসি কান্নাকাটি করে অস্থির।
হেমাঙ্গ বুঝতে পেরেছে, এ নিশ্চয় শংকরার কীর্তি। ব্যাটা পাগল সেজে থাকে। ভেতরে—ভেতরে নিশ্চয় পুলিশের চর। সে—রাতে তাদের যাওয়াটা দেখার চান্স একমাত্র শংকরার থাকতে পারে। ব্যাটা ভূতের মতো যেখানে—সেখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়। শংকরাকে কাল সন্ধ্যায় গিয়ে চার্জ করবে ভেবেছিল। কিন্তু শংকরাকে দেখতে পায়নি। হেমাঙ্গ ওর আখড়াটা ভেঙেচুরে তছনছ করে এসেছে। শংকরার দেখা পেলে এখন তাকে মারতেও দ্বিধা হবে না হেমাঙ্গের।
কাল রাতে আরেকটা সাংঘাতিক আতঙ্কের ঝড় উঠেছিল তার মধ্যে। ডনের সেই রিভলবারটা। অমি সে রাতে ওটা তার কাছে রেখে গিয়েছিল। কারণ ওর ধারণা যখন তখন বোসবাড়ি সার্চ হতে পারে। হেমাঙ্গ কাগজে রিভলবারটা জড়িয়ে দেয়াল আলমারিতে বইয়ের পেছনে রেখেছিল। আই.বি. অফিসার যখন কথা বলছিলেন, তখন ওটা সেখানেই। সার্চ করলেই কী বিপদে না পড়ত সে। প্রথম সুযোগেই তাই ওটা সরিয়ে খিড়কির ওধারে সবজিখেতে মাটি ঢাকা দিয়ে এসেছিল। তারপর অনেকরাতে মুনাপিসির ঘরের দরজা বন্ধ হলে সে চুপি—চুপি বেরিয়ে যায়। সকালে সবজিবাগানে ঢোকা মুনাপিসির অভ্যাস, চোখে পড়াটা অসম্ভব নয়। তাই রিভলবারটা ওখান থেকে সরিয়ে সে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়েছিল। অস্ত্রটা খুব ছোট্ট। কিন্তু বেশ ওজন আছে।
সে ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে এবার। কোথায় লুকিয়ে রাখবে? এদিকে অন্ধকারে কোথাও ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে শংকরা তাকে দেখছে কিনা, সেও এক আতঙ্ক। শেষ অব্দি সে ওটা পকেটে নিয়ে বাড়ি ঢুকেছিল এবং উঠোনের কোণায় কবেকার জড়ো করে রাখা সুরকির পাঁজায় ঢুকিয়ে ভাঙা ইটগুলো আগের মতো চাপিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। তারপর হাত ধোওয়ার শব্দে মুনাপিসি জেগে বলেছিল, কে রে? হেমা? কী করছিস?
হ্যাঁ পিসিমা। ল্যাট্রিনে গিয়েছিলুম।
বাইরের আলোটা জ্বালিসনি কেন? অন্ধকারে আছাড় খাবি যে?
না। তুমি ঘুমোও তো বাবা।
সকালে হেমাঙ্গ দেখে নিয়েছে, ইট দিয়ে ঢাকা সুরকির পাঁজাটা নির্দোষ দেখাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই মুশকিল। রিভলবারে নিশ্চয় জং ধরে যাবে। শিগগির একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু কোথায় নিরাপদে রাখবে, এখনও ভেবে পাচ্ছে না। দৈবাৎ ডনের খবর পেয়ে গেলে সে যেভাবে হোক, অমির মুখ চেয়ে সবরকম ঝুঁকি নিয়েও ওটা তাকে ফেরত দেবে।
ঘণ্টা দুই পরে মুনাপিসির সাড়া পাওয়া গেল বাইরে। রিকশো চেপেই এসেছে। হেমাঙ্গ বেরিয়ে বলে, উদ্দেশ্য সফল তো মুখে তো হাসি দেখতে পাচ্ছি!
মুনাপিসির মুখে হাসি স্পষ্ট। কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে।
হেমাঙ্গ বলে, নিশ্চয় আমার জন্য কনে দেখতে যাওনি?
মুনাপিসি হেমাঙ্গের দিকে চড় তুলে বলে, এই তোর লাস্ট চান্স। ফের যদি কখনও দেখি কিংবা শুনি, তুই ওই হতচ্ছাড়ী মেয়েটার সঙ্গে মিশেছিস, আমার মরা মুখ দেখবি।
এ তো তোমার পেটেন্ট শাসানি! হেমাঙ্গ হাসে। বলো না কোথায় গিয়েছিলে? থানায় বুঝি?
জ্ঞানবাবুর কাছে।
উরে ব্বাস! তুমি মশা মারতে কামান দাগতে গেলে?
চুপ। একেবারে চুপ। আর কথাটি বললে তোকে বঁটিতে চড়াব। মুনাপিসি আঙুল তুলে শাসায়। তারপর ভেতরের বারান্দায় যেতে যেতে বলে, জ্ঞানবাবু তোকে দেখা করতে বললেন। পরশু কলকাতা যাচ্ছেন। তার আগে যেন দেখা করে আসবি।…