অশরীরী ঝড় – ৮

আট

সে—রাতে হেমাঙ্গ ঘুমোবার প্রচণ্ড চেষ্টা করছে, পারছে না। বাইরে রাতের প্রতিটি সূক্ষ্ম শব্দ খুব বড়ো হয়ে তার অনুভূতিতে ধাক্কা দিচ্ছে। রেলইয়ার্ডেও কাল রাতে কী যেন গণ্ডগোল ঘটেছে। ইঞ্জিনগুলো খেপে শেড থেকে যেন বেরিয়ে পড়েছে। ওয়াগন এবং বগির পাল মাটি কাঁপিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মুসহর বস্তিতে কুকুরগুলো ভয় পেয়ে প্রচণ্ড চেঁচামেচি জুড়েছে। এত বেশি আওয়াজ!

অথচ মোহনপুরের এদিকটা নিঝুমই থাকে। কেন এমন হচ্ছে ভাবতে গিয়ে হেমাঙ্গ টের পাচ্ছিল, আসলে ঘুম ও স্বপ্নের মাঝামাঝি একটা নোম্যান্সল্যান্ডে সে আটকে গিয়েছিল।

এ ঘরে ফ্যান নেই। কারণ পিসেমশায়ের আমলে এ পাড়ায় বিদ্যুৎ আসেনি। গরমের ঋতুতে জানলা খোলা রাখলে প্রচুর হাওয়া ঢোকে, তাই ফ্যানের গরজ দেখা দেয়নি এখনও। বরং আজকাল শেষ রাতে কষ্ট করে উঠে জানলা বন্ধ করে দিতে হয়। বেশ শীত পড়ে। হেমাঙ্গের কোনো—কোনো রাতে উঠতে ইচ্ছে করে না বলে সকালে টের পায়, গলা ব্যথা করছে। বুকের মধ্যে শ্লেষ্মা জমে গেছে। তখন নুনজলের জন্যে মুনাপিসিকে ফরমাস করতে হয়। মুনাপিসি সেজন্যেই রোজ শোওয়ার সময় ওর মাফলারটা বালিশের পাশে রেখে যায় এবং পইপই করে মনে করিয়ে দেয়।

এমনিতেই হেমাঙ্গের সুনিদ্রা হয় না। তাই অসংখ্য সিগারেট খায়। অ্যাসট্রের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।

সকালে সেটা খাটের তলায় ঢুকিয়ে অর্থাৎ লুকিয়ে তারপর দরজা খোলে সে। মুনাপিসি জানে, হেমাঙ্গ সিগারেট খায়। অনেক সময় পেছনে জ্বলন্ত সিগারেট লুকিয়ে রেখেও সে পিসিমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে। তবু এখনও সামনাসামনি সিগারেট খেতে বাধে।

হেমাঙ্গ দেখল, ঘুম যখন হবেই না একটা কিছু করা যাক। সে উঠল এবং টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে সে ডাবুর পাঠানো প্যাডটা টেনে নিল। ডটপেন দিয়ে পাশে তাকানো নানারকম মুখ, পাখি, হাতি, মোটরগাড়ি আঁকতে থাকল। কুকুর আঁকতে সে পারে না। ছাগল হয়ে যায়। ঘোড়া আঁকতে গেলে মোষ হয়ে ওঠে। হঠাৎ তার মাথায় অশ্লীল ইচ্ছে সুড়সুড় করে উঠল। ঠোঁটে হাসি রেখে সে নগ্ন পুরুষ এবং স্ত্রীলোক আঁকতে বসল। গোপন প্রত্যঙ্গ পর্যন্ত। তারপর ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিল। মুনাপিসি সকালে ঘর সাফ করতে এসে পাছে দেখে ফেলে, টুকরোগুলো যতটুকু পারা যায় কুচি করে ফেলল। তারপর অমির নাম লিখতে শুরু করল। কয়েকটা নাম লেখার পর কারুকার্যে শিল্পমণ্ডিত করে তুলল সেগুলোকে।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে ছিঁড়ে ফেলল পাতাটা। কুচোকুচো করে দুমড়ে টেবিলের তলায় ফেলে দিল। তারপর ভাবল, অমিকে একটা চিঠি লিখবে। খুব লম্বা চিঠিই হবে। সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার চরম নোটিশ। এটা খুব জরুরি মনে হল হেমাঙ্গের।

গুরুগম্ভীর শব্দ ভেবে নিয়ে সে সবে জোরালো হরফে অমি লিখে কমা দিয়েছে, পেছনে রাস্তার দিকের জানলায় খুটখুট আওয়াজ হল।

হেমাঙ্গ চমকে ঘুরে বসল। জানলার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় শালকাঠের খুঁটিতে বালব আছে। কিন্তু কদিন থেকে জ্বলছে না। এ বাড়িটা একেবারে শেষপ্রান্তে। জ্বললেও সামনের রাস্তা অব্দি আলো খুব সামান্যই আসে।

ঘরের টেবিল—বাতির বালবটা পনেরো ওয়াটের। শেড আছে। তার পেছনে জানলা অব্দি এর ফিকে ছটা ময়লা কাঁচের মতো ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু হেমাঙ্গের চিনতে ভুল হয় না। একঝলক রক্ত শিসিয়ে ওঠে তার হৃৎপিণ্ডে। ঊরু ভারি লাগে। শরীর কেঁপে ওঠে।

তারপরই তার সব ক্ষোভ দুঃখ অভিমান ঘুচে যায়। সে উঠে গিয়ে সাবধানে দরজা খোলে। অমি ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে বলে, আলোটা নেভাও আগে।

হেমাঙ্গ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে অবশ হাতে টেবিল ল্যাম্পটা নিবিয়ে দেয়। অমি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছে। হেমাঙ্গ নিঃশব্দে বসে তার পাশে। এখনও বুঝতে পারছে না এটা স্বপ্ন কি না।

অমি ফিসফিস করে, ভীষণ দরকার তোমাকে। আমার সঙ্গে এখুনি বেরুতে হবে। যেতে পারবে?

কোথায়?

বাইরে গিয়ে বলব। পারবে যেতে?

হেমাঙ্গ বাড়ির ভেতরদিকে মুনাপিসিকে অনুভব করে নিয়ে বলে, হুঁউ। কিন্তু একটু বসো।

না। দেরি করা যাবে না। শিগগির ফিরতে হবে।

হেমাঙ্গ তার একটা হাত অন্ধকারে নিয়ে বলে, কোথায় যাবে? কী ব্যাপার?

পরে শুনবে। চলোই না।

হেমাঙ্গ নিজের শরীরের আবেগ দমন করতে কষ্ট পায়। বলে, কিন্তু একটা শর্ত।

কী?

ফিরে এসে কিছুক্ষণ থাকবে আমার কাছে।

চেষ্টা করব।

চেষ্টা না। বলো, থাকবে কিছুক্ষণ!

থাকব। ওঠো! বলে অমি উঠে দাঁড়ায়। ফের বলে, টর্চ আছে তোমার কাছে?

আছে। ব্যাটারি কমে গেছে। দেখছি। বলে হেমাঙ্গ তাক খুঁজে টর্চটা নেয়। পাঞ্জাবিটা পরে। তারপর অমির কাঁধে হাত রেখে বলে, চলো। এবং পায়ে স্লিপারটা গলিয়ে নেয়।

বাইরে বারান্দায় গিয়ে সে দূর অব্দি রাস্তাটা দেখে নেয়। অন্ধকারে গাছপালা শনশন করছে। সামান্য দূরে একটা বাড়ির মাথায় মিটমিটে একটা বালব জ্বলছে। কেউ নেই। সে বলে কিন্তু দরজাটা?

একটু রিস্ক নাও না।

হেমাঙ্গ দরজার কপাট বাইরে থেকে টেনে ভেজিয়ে রাখে। অমি রাস্তায় নেমেছে তখন। হেমাঙ্গ রাস্তায় নামলে সে হাঁটতে থাকে। এদিকে শ্মশানবট অব্দি পৌঁছেছে রাস্তাটা। দু’ধারে টুকরো খেত আর আগাছার জঙ্গল। বাঁদিকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে খাল। খালের ওপারে মুসহর বস্তি এবং রেলইয়ার্ড। রেলইয়ার্ডের বেশি রকম উঁচু পোস্টগুলো থেকে দুধের মতো সাদা ল্যাম্প থেকে অনেক দূর অব্দি আলো ছড়িয়ে রয়েছে। তাই আত্মগোপনের সুযোগ নেই। হনহন করে কিছুটা এগিয়ে বাঁয়ে ঘোরে অমি। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে খালের ধারে পৌঁছায়। হেমাঙ্গ এবার অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? খুব সংশয়ে পড়ে যায় সে। অমিকে বিশ্বাস করবে, না করবে না— কারণ এভাবেই অনেক সময় খুন—খারাপি হয়ে থাকে, হেমাঙ্গ সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে হঠাৎ থেমে বলে—কী ব্যাপার আগে বলো? এভাবে জঙ্গল ভেঙে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

খালের ধারে সরু পায়ে চলা পথ আছে। দু’পাশ থেকে ঘাস আর ঝোপ উপচে এসেছে। সাপের ভয় আছে। হেমাঙ্গ পায়ের কাছে টর্চ জ্বেলে ফের বলে, অমি!

অমি বলে, শোনো। এখানটায় বেশি জল নেই। একটু কাদা হতে পারে। ধুয়ে নেওয়া যাবে পরে।

সে পায়ের স্লিপার খুলে হাতে নেয় এবং হাঁটু অব্দি কাপড় তুলে জলে নামে। হেমাঙ্গের পরনে লুঙ্গি। সেও স্লিপার খুলে তার পেছনে পেছনে খাল পেরোতে থাকে।

খালের পারেই রেলের কাঁটাতারের বেড়া। জঙ্গল গজিয়ে আছে। স্লিপার হাতে নিয়ে দুজনে বেড়ার ধার ঘেঁষে কিছুটা যাওয়ার পর যেখানে বেড়া অনেকটা ফাঁক হয়ে আছে, সেখান দিয়ে গলিয়ে রেলইয়ার্ডে ঢোকে। ওয়াগনের দঙ্গল এদিকটায়। হেমাঙ্গ বলে, সেন্ট্রিদের চোখে পড়তে পারে। তুমি কী করছ, বুঝতে পারছি নে।

অমি বলে, আহা! এসো না।

হেমাঙ্গের মনে হয়, এসব জায়গা অমির মুখস্থ। কিছুটা এগিয়ে যাবার পর রেলইয়ার্ড শেষ হয়েছে। ডেডস্টপের ঘাসে ঢাকা একটা ঢিপির পাশ কাটিয়ে ফের বেড়ার মস্তো ফাঁক গলিয়ে দুজনে চলতে থাকে। বাঁয়ে রেললাইন, ডাইনে পোড়ো জমি এবং খাল। খাল ঘুরেছে যেখানে, সেখানে রেলব্রিজ। দুজনে ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে খালের পাড়ে পায়ে চলা রাস্তায় ওঠে। খাল এখানে পূর্বে ঘুরে মাঠের দিকে চলেছে। কিছুটা দূরে একটা স্লুইস গেট আছে।

স্লুইস গেটের কাছাকাছি গিয়ে হেমাঙ্গ বলে, সিগারেট ধরাব এবার। অসহ্য লাগছে।

হ্যাঁ। ধরাও।

এখানে ফাঁকা মাঠ। খালের দুধারে ধান চাষ হয়েছে। উত্তরে কিছুটা দূরে রেলইয়ার্ডের আলো জুগজুগ করছে। হুহু করে বাতাস বইছে। অনেক কষ্টে সিগারেট ধরায় হেমাঙ্গ। তারপর পা বাড়িয়ে বলে, কোথায় যাচ্ছি এবার বলো!

আকাশ জুড়ে নক্ষত্র। ক্যানেলের উঁচু পাড়ে সরু পায়ে চলা রাস্তাটা ধবধবে সাদা দেখাচ্ছে। আর টর্চ না জ্বাললেও চলে। অমি পিছিয়ে হেমাঙ্গের বাঁ কনুইয়ের ওপরটা ধরে এবং গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকে। তারপর বলে, তোমার ভীষণ ভয় করছিল, জানি।

না, ভয় ঠিক নয়। হেমাঙ্গ হাসবার চেষ্টা করে। তোমার কাণ্ড দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল।

তোমাকে ফাঁদে ফেলতে ডাকিনি।

কীসের ফাঁদ? যাঃ! আমি তা ভাবব কেন?

অমি তার বাহুতে গাল রেখে হাঁটে। বলে, তুমি না এলে তোমার সঙ্গে রিলেশন শেষ হয়ে যেত, জানো?

বলো কী! বলে হেমাঙ্গ বাঁহাতে অমির কাঁধ ঘিরে রাখে।

অমি বলে, তুমি ছাড়া এখন আর তো কেউ আমার নেই!

ভনিতা রেখে, এবার বলো না কোথায় যাচ্ছি?

ডনের কাছে।

হেমাঙ্গ থমকে দাঁড়ায়। চাপা স্বরে বলে, ডনের কাছে? কোথায় আছে সে?

ওই গ্রামে।

তাই বলো। বলে হেমাঙ্গ পা বাড়ায় ফের। অমি আবেগ দিয়ে বলে, জানো? আমার ভীষণ অস্বস্তি ছিল! যদি তুমি দরজা না খোলো! যদি এভাবে আসতে না চাও! আমি তোমার কথা রাখিনি। এমনকী, আজ তুমি জেঠুর কাছে বসে ছিলে, তোমার সঙ্গে কথা বলিনি! আমার তখন মনের অবস্থা ভালো ছিল না। তুমি নিশ্চয় খুব রেগে গিয়েছিলে!

একটু—একটু।

কথা না রাখার কারণ সে রাতে ঝেণ্টুর কাছে ডনের খবর পেয়েছিলুম। কিন্তু ঝেণ্টু কিছুতেই ডন কোথায় আছে বলেনি। বলেছিল, আগে ডনকে জিগ্যেস করবে। যদি আমাকে তার ঠিকানা জানাতে বলে ডন, তবে সে জানাবে। এই করতে—করতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। রোজ ঝেণ্টুকে জিগ্যেস করি। বলে, ডন ভাবছে। কী অদ্ভুত ছেলে! শেষ অব্দি গতকাল ঝেণ্টু বলল, ডন যেতে বলেছে আমাকে।

তুমি গেলে?

গেলুম। অনেকটা রাতে যেতে বলেছিল। কেন, তা বুঝতেই পারছ।

বাড়িতে নিশ্চয় এসব জানাওনি?

না। ডনের নিষেধ ছিল। জেঠুকে তো তুমি জানো না! এর—ওর কাছে গিয়ে সাধাসাধি এমনিতেই করছিলেন। এবার ঝোঁকের মাথায় আরও হইচই বাধিয়ে বসতেন। ডন তো এখন অ্যাবস্কান্ডার! ওর নামে হুলিয়া বেরিয়েছে।

হেমাঙ্গ টর্চ জ্বেলে পায়ের কাছটা দেখে নিয়ে বলে, তুমি কীভাবে গেলে? কেউ টের পেল না?

না। ঝণ্টু অপেক্ষা করছিল। আজ যেভাবে এলুম, সেভাবেই তোমার ঘরের পাশ দিয়ে গেছি।

আমি সারারাত জেগে ছিলুম। হেমাঙ্গ সিগারেট পায়ের তলায় ফেলে ঘষটে নিভিয়ে বলে। তারপর?

ওই গ্রামে পৌঁছলুম, তখন রাত প্রায় একটা। তারপর…

হঠাৎ হেমাঙ্গ বলে, একা ঝেণ্টুর সঙ্গে, না আর কেউ ছিল?

অমি একটু চুপচাপ থাকার পর বলে, আর কেউ ছিল না। তারপর কী বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।

কী?

থাক। পরে বলব। আমার একটু ভুল হয়েছিল।—অমি চলার গতি হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলে, ডন একটা মাটির কোঠা বাড়িতে ওপরের ঘরে আছে দেখলুম। পায়ে ব্যান্ডেজ এখনও আছে। তবে হাঁটতে পারে। ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শিগগির বাইরে চলে যাবে কোথায়। আধঘণ্টাটাক থেকে আমি চলে এলুম। ও তোমার কথাও জিগ্যেস করছিল।

হেমাঙ্গ সঙ্গ পেতে হাঁফিয়ে উঠছিল। অন্ধকারে এভাবে যেখানে সেখানে পা ফেলো না। টর্চ তুমিই নাও বরং!

অমি আপত্তি করে। উঁহু। আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। এই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

তাহলে আস্তে চলো। আমি হাঁফিয়ে পড়েছি। হেমাঙ্গ একটু হাসে। তুমি এতসব পারো, আমার ধারণা ছিল না। অবশ্য, ছেলেবেলায় তুমি সোকল্ড গেছো মেয়ে ছিলে।

অমি একপা পিছিয়ে তার পাশে—পাশে হাঁটে আগের মতো। তার একটা বাহুও ধরে থাকে। হেমাঙ্গের এটা ভালো লাগে। কিছুক্ষণ চুপচাপ চলে ওরা। তারপর হঠাৎ হেমাঙ্গের মনে হয়, এইসব সময় অমি এত সহজ আর স্বাভাবিক। অথচ এখনই অতর্কিতভাবে ওর অসুখটা অর্থাৎ সৈকার ভূত এসে গেলে হেমাঙ্গ খুবই মুশকিলে পড়ে যাবে।

এবং একথা ভাবতে ভাবতে সে জিগ্যেস করে, তুমি একটুও ক্লান্ত বোধ করছ না তো! আশ্চর্য!

করি নে আবার? এই যে যাচ্ছি, ভাবছ খুব গায়ের জোর হয়েছে বুঝি! অমি আগের মতো তার বাহুতে গাল ছুঁইয়ে বলে। সত্যি, আমার এতটুকু স্ট্রেন্থ নেই শরীরে। তবু যাচ্ছি, দৌড়চ্ছি—জাস্ট একটা ঝোঁকে। তারপর তো মড়ার মতো হয়ে পড়ব। কাল ফিরে গিয়ে যখন শুয়ে পড়লুম, মনে হচ্ছিল আর পৃথিবীর মুখ দেখা শেষ। ভীষণ জলতেষ্টা—অথচ জল গড়িয়ে খাওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই।

হেমাঙ্গ হাঁটতে হাঁটতে যতটা পারে ভালোবাসায় বা স্নেহে আদর দিয়ে চলে। এবং বলে, এভাবে ছোটাছুটি না করলে কি চলত না? অবশ্য, ডন তোমার ভাই। চুপ করে থাকা কঠিন! কিন্তু তুমিও এমন একটা সাংঘাতিক অসুখে ভুগেছ।

অমি ধীর গতিতে বলে, আমি আর বাঁচব না, সে তো জানি। তাই যতক্ষণ বেঁচে আছি…

হেমাঙ্গ ওর মুখে হাত চেপে বলে, চুপ।

হাত আলগোছে সরিয়ে দিয়ে অমি বলে, খুব আস্তে যাচ্ছি আমরা। ফিরতে ভোর হয়ে যাবে না তো?

দেখা যাবে। বলে হেমাঙ্গ আরও একটু গতিও বাড়ায়। তারপর ফের বলে, তুমি কী সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েছ বুঝতে পারছ না ঝোঁকের মাথায়। আমি খালি ভাবছি, হঠাৎ মাথাটাথা ঘুরে….

অমি হাসে। বাধা দিয়ে বলে, কিচ্ছু হবে না। আর যদি কিছু হয়, ধরো ফিট হয়ে যাই কিংবা তেমন গোলমেলে কিছু করি, তুমি ফেলে রেখে চলে যেয়ো।

পাগল? আমাকে তুমি তাই ভাবছ?

অমি নিশ্বাস ফেলে বলে, না। ভাবিনি।

আবছা দেখা যাচ্ছিল, সামনে আবার একটা স্লুইস গেট আছে। হেমাঙ্গ এই ক্যানেলের ধারে—ধারে কতবার বেড়াতে এসেছে। কিন্তু এতদূর অব্দি আসেনি। মাঠটা রেললাইন থেকে লম্বালম্বি সামনের গ্রামঅব্দি এগোলে দু—আড়াই কিলোমিটারেরও বেশি হতে পারে। একেবারে সমতল এদিকের মাঠ। সামনের গ্রামের ওপারে কোথায় ভাগীরথী বয়ে যাচ্ছে। হেমাঙ্গের মনে পড়ে, এই ক্যানেলটা আসলে ছিল একটা ছোট্ট মজা নদী—যেটা ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছিল। যেখানে মিশেছিল, সেখানে একটা বিরাট বিল আছে। মোহনপুরের বন্দুকওয়ালারা সেই বিলে পাখি মারতে যেত। এখনও হয়তো যায়। বছর সাত—আট আগে মজা খাতটা সংস্কার করে ক্যানেল তৈরি হয়েছে। ডনের জ্যাঠামশাই নাকি এই ক্যানেলের মাটি খোঁড়ার সময় মাপ—জোপের চার্জে ছিলেন। আবছা অনেক কথা মনে পড়ে হেমাঙ্গের। হাজার হাজার মানুষকে সে মাটি কাটতে দেখেছিল। দূর থেকে দেখে ভারি অদ্ভুত লেগেছিল, কেন কে জানে!

স্লুইস গেটের ব্রিজে এসে অমি বলে, এখানে একটু দাঁড়াও। আর বেশি দূরে নয়। তুমি কখনও আসোনি এদিকে?

না। তুমিও নিশ্চয় আসোনি?

উঁহু। কাল রাতে প্রথম।

ধন্য তোমার সেলফ—কনফিডেন্ট!

কেন?

এসেছ অন্ধকারে। অথচ ধরে নিচ্ছ, ঠিক জায়গায় যাচ্ছি। তোমার ভুল হচ্ছে না, কীসে বুঝছ? এমনও হতে পারে, হেঁটে হেঁটে রাত পুইয়ে যাবে!

অমি আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, গোলমেলে জায়গা হলে আসব কেন? সোজা এই ক্যানেল ধরে এগিয়ে বাঁপাশে উঁচু জমিতে একটা বাড়ি। প্রথম বাড়িটাই। তাছাড়া বাড়িতে একটা কুকুর আছে। সে ভীষণ চ্যাঁচামেচি করবে।

হেমাঙ্গ হাসতে হাসতে বলে, তুমি পলিটিকসে নামলে তাক লাগিয়ে দিতে। ধরো কোনো ব্যানড পলিটিকাল পার্টিতে। আন্ডারগ্রাউন্ড রেভলোউশানারিদের দলে। বাপস!

অমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ঘুরে বলে, চুপ। দেখ তো, আলো জ্বলল একবার। কারা আসছে যেন!

হেমাঙ্গ তীক্ষ্নদৃষ্টে তাকাল। সে চমকে উঠেছিল। যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে দূরে একবার আলোর ঝলক, তারপর নিভল। টর্চের আলো ছাড়া কিছু নয়। আবার আলো জ্বলল। নিভে গেল। আলোটা সাবধানী মনে হচ্ছে। মাটির ওপর খানিকটা জায়গায় পড়ছে এবং নিভে যাচ্ছে। কে বা কারা রাস্তা দেখে পা ফেলছে।

অমি ফিসফিস করে বলে, ওপারে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসা যাক কোথাও। শিগগির!

হেমাঙ্গ তার পিছু পিছু এগোয়। স্লুইস গেটের এই ব্রিজটা মাত্র হাত দুই চওড়া। পা ফসকালে খালে পড়তে হবে। তবে একধারে রেলিংমতো আছে। অমিকে সে বারবার সতর্ক করে দেয়। তারপর ব্রিজটা পেরিয়ে দুজনে নামতে গিয়ে পা হড়কে গড়াতে—গড়াতে পাড়ের নীচে পড়ে যায়। জল নেই। পাঁক আছে সামান্য। ধানের চারাগুলো সব মাথা তুলেছে। তার মধ্যে পাঁকে দুজনে আছাড় খেয়েছে। আশ্চর্য লাগে হেমাঙ্গের, অমি চাপা হাসছে। প্রচণ্ড রকম হাসি। হেমাঙ্গ বলে, এই! কী হচ্ছে? চুপ!

দুজনে জমিটা থেকে, জামাকাপড়ে যথেষ্ট কাদা নিয়ে ওঠে। ঢালু পাড়ের নীচের দিকে পা রাখার মতো জায়গা আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ ফিসফিস করে বলে ওঠে, অমি! পুলিশ! তারপর সে গুঁড়ি মেরে বসে। অমিও বসে পড়ে। চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছে কয়েকজোড়া জুতোর। হেমাঙ্গের বুক কাঁপতে থাকে। প্রায় দম আটকে সে বসে থাকে।

পুলিশের দলটা ছোট বলেই মনে হচ্ছে। কোনো কথা বলছে না ওরা। বললে শোনা যেত। হেমাঙ্গের মনে হয়, দলটা জুতোসুদ্ধ পা ফেলে ওর বুকের ওপর দিয়ে চলে গেল।

শব্দ একটু দূরে সরে গেলে অমি একটু উঁচু হয়ে দেখল। হেমাঙ্গ তাকে টেনে বসিয়ে দেয়। তারপর প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ভাগ্যিস তোমার চোখে পড়েছিল!

অমিকে উত্তেজিত দেখায়। সে শ্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে বলে, সবাই পুলিশ—নাকি সঙ্গে অন্য কাকেও দেখলে?

ঠিক বোঝা গেল না। তবে জনা চার পাঁচ ছিল ওরা। সম্ভবত রোঁদে বা অন ডিউটি কোনো গ্রামে গিয়েছিল!

অমি একটু চুপ করে থেকে বলে, ডনের খোঁজ পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে! হয়তো ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল!

হেমাঙ্গ জোর দিয়ে বলে, না। তাহলে টের পেতুম। ডনের পায়ে তো ব্যান্ডেজ বলেছ?

হ্যাঁ। কিন্তু… জানো, আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটেছে।

হেমাঙ্গ এবার উঠে দাঁড়ায়। বলে, তাহলে কী করবে? যাবে ওখানে?

অমিও ওঠে। কী করি বলো তো?

আজ কি ডন তোমাকে বিশেষ কোনো ব্যাপারে যেতে বলেছিল?

হ্যাঁ। ভীষণ জরুরি। বলে অমি একটু ইতস্তত করে যেন। তারপর সে ব্লাউসের ভেতর থেকে কী একটা বের করে।

হেমাঙ্গ স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা—কাঁপা স্বরে বলে, কী ওটা?

ডনের ঘরে এই রিভলবারটা ছিল। এটা পৌঁছে দিতে বলেছিল।

অদ্ভুত তো! ঝেণ্টুর হাতে দিলেই পারতে!

ডন নিষেধ করেছিল। ঝেণ্টুর হাতে পড়লে তাকে দেবে কি না।

তাহলে ডন নিজে চুপি—চুপি বাড়ি ফিরে নিয়ে যেতে পারত!

অমি ঝাঁঝালো স্বরে বলে, তুমি বুঝতে পারছ না—মোহনপুরে ওর ঢোকা এখন খুব রিস্কি। তাছাড়া ও তো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না এখনও। দৈবাৎ পুলিশ টের পেলে দৌড়ে পালাতে পারবে না যে!

হেমাঙ্গ ভারী নিশ্বাস ফেলে বলে, ওটাতে গুলি পোরা আছে কি না জানো? এভাবে রেখেছিলে!

অমি ছোট্ট রিভলবারটা ব্লাউসের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে রেখে বলে, না। গুলি পোরা নেই।

নেই, কীভাবে জানলে?

অমি বিরক্ত হয়ে বলে, ডন বলেছিল। যাক গে, শোনো। চলো, ব্রিজে যাই। তারপর একটা কিছু ঠিক করে ফেলি।

ঢালু পাড়ে মাটি আঁকড়ে দুজনে ওপরে ওঠে। ব্রিজে পৌঁছে চারদিকটা সতর্কভাবে দেখে নেয়। পুলিশ দলের আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না। হেমাঙ্গ বলে, আমি বলি বরং…

কী?

আজ আর রিস্ক না নিয়ে চলো ফিরে যাই।

তারপর?

কাল সকালে ঝেণ্টুদের কাছে খোঁজ নাও। যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তাহলে বরং আমি দিনেই কোনো একসময় ওটা পৌঁছে দিয়ে আসব ডনকে। বললে, ক্যানেলের ধারে বাঁদিকে গ্রামের প্রথম বাড়ি। উঁচু মাটির বাড়ি। বাড়িতে কুকুর আছে। এই তো?

অমি চুপচাপ ভাবতে থাকে।

অমি কথা বলছে না দেখে হেমাঙ্গ বলে, আমি তোমাকে এতক্ষণ নিঃশব্দে ফলো করেছি, কোনো বাধা দিইনি। কিন্তু তুমি খুব বোকার মতো ছুটোছুটি করছ কাল রাত থেকে। তুমি কেন বুঝতে পারোনি। এটা কত সাংঘাতিক রিস্ক! তুমি বিপদে পড়তে পারতে, সেটার চেয়ে আরও ডেঞ্জারাস ব্যাপার—ডনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে। শোনো অমি। আমি ডনের কোনো কিছু সমর্থন তো করিই নে, বরং আমি ওকে অপছন্দ করি। এবং সে তো ভালোই জানো।

অমি মুখ খোলে। আমিও করি!

তুমিও করো, জানি। তবু যেহেতু তোমার ছোট ভাই, তোমার…

অমি ধমকের সুরে বলে থামো তো! অত জ্ঞান দিয়ো না। কী করা উচিত, বলো।

আমার কথা শুনবে? আমি তো বললুম।

তুমি রিস্ক নেবে কেন?

তোমাকে রিস্ক নিতে দেব না বলেই!

হেমাঙ্গ তার কাঁধে হাত রেখে একটু টানে। ফের বলে, দেখো—পড়ে যেয়ো না। সাবধানে এসো। আমাকে ধরে থাকো।

সঙ্কীর্ণ ব্রিজটা আবার পেরিয়ে ক্যানেলের অন্য পাড়ে সেই পায়ে চলা রাস্তায় পৌঁছায় ওরা। তারপর অমি বলে, ডনকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি। ছোটভাই হলে কী হবে? কিন্তু কিছু দিন থেকে আমি মাকে স্বপ্ন দেখতুম জানো? মা, ডন, আমি—আর দাদা। ঘুম ভেঙে কত কী কথা মনে পড়ত। ডনের জন্যে বুক ফেটে যেত। মা ছোট্ট ডনকে আদর করে বলতেন…

প্লিজ অমি!

অমি কান্নাজড়ানো স্বরে বলে, তবে ডনের কাছে আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত! ডন আমাকে সাংঘাতিক একটা ব্যাপার থেকে বাঁচিয়েছিল।

জগদীশ?

হ্যাঁ। আমি না জেনে ওর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছিলুম। ডন ঠিক সময়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল।

অমি শাড়ির আঁচলে নাক এবং চোখ দুটো মোছে। হেমাঙ্গ বলে, এদিকটা আমার ভালো চেনা নেই। সোজা ধানখেত দিয়ে স্টেশনে পৌঁছানো গেলে ভালো হত!

না। খুব জলকাদা আছে ওদিকে। যে পথে এসেছি, সে পথেই ফিরে যাই চলো।

চলো!

দুজনে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে থাকে মোহনপুরের দিকে। সিগারেট খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে সত্ত্বেও হেমাঙ্গ সিগারেট খেতে ভয় পাচ্ছে এখন। বুঝতে পারছে, এমন হঠকারী মেয়ের পাল্লায় পড়ে ওর কথা নিঃশব্দে মেনে চলাটা সাংঘাতিক রিস্কের ব্যাপার। এমন করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। বরং আগে জেদ ধরে সবটা শুনে নিয়ে পরামর্শ দিতে পারত সে। অবশ্য অমি তার কথায় কান দিত বলে মনে হয় না।

যেতে যেতে এবার সে লক্ষ্য করে, অমি যেন আর চলতে পারছে না। ধুঁকছে এবং টলতে টলতে পা ফেলছে। সে বলে, বিশ্রাম নিতে নিতে চলো। তুমি টায়ার্ড হয়ে পড়েছ।

নাঃ। চলো।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলে, আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারি।

এ কথায় অমিও একটু হাসে। বেশ তো নেতিয়ে পড়ে যাব যখন তখন তাই করো।

পরদিন সকালে হেমাঙ্গ সমস্যায় পড়েছিল। পাঞ্জাবি লুঙ্গিতে ধানখেতের কাদা মাখামাখি। গুটিয়ে খবরের কাগজে মুড়ে রেখেছিল খাটের তলায়। লন্ড্রিতে দিয়ে আসবে।

কিন্তু মুনাপিসি রোজকার মতো ফুলঝাড়ু দিয়ে এ ঘরের মেঝে সাফ করতে এসে খাটের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল এবং মোড়কটা টেনে বের করল। হেমাঙ্গ তখন দক্ষিণের জানালার ধারে পা ঝুলিয়ে বসে চা খাচ্ছে। আঁতকে উঠল।

মুনাপিসি সচরাচর হেমাঙ্গের কোনো জিনিস হাতড়ায় না। কিন্তু এই মোড়কটা খাটের তলায় কেন, এতে তোর কৌতূহল স্বাভাবিক। হেমাঙ্গ লক্ষ্য করছিল, কতদূর এগোয়। মোড়কের ফাঁকে মুনাপিসি আঙুল ঢুকিয়ে দিলে—সে হাঁ—হাঁ করে তেড়ে এল। আরে! ওটা ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।

ছোঁয়াছুঁয়ির খুব একটা বাতিক নেই। তা হলেও হেমাঙ্গের তাড়ায় আঙুল সরিয়ে নিয়ে বলল, কাপড়চোপড় নাকি রে? এমন করে রেখেছিস কেন?

হেমাঙ্গ অগত্যা জবাব দেয়, কাল খালের ওখানে পা শ্লিপ করে পড়ে গিয়েছিলুম। কাদা লেগেছে। লন্ড্রিতে দেব।

সন্দিগ্ধ মুখে মুনাপিসি বলে, তা এমন করে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?

লুকিয়ে রাখলুম কোথায়? ফেলে রেখেছিলুম। গড়িয়ে ঢুকে গেছে ভেতরে।

পা গজিয়েছিল রে! সত্যি কথাটা বললে যেন আমি শূলে চড়াব! বাঁদর কোথাকার!

হেমাঙ্গ হেসে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। মোড়কটা ছেড়ে মুনাপিসি মেঝে ঝাঁট দিচ্ছে। একটু পরে কোনার দিকে কাদামাখা স্লিপার এবং এখানে ওখানে হলুদ কাদার টুকরো আবিষ্কার করে সে। তারপর হেমাঙ্গের দিকে ঘোরে। রাতে কোথাও বেরিয়েছিল। তাই না।

ভ্যাট! কোথায় বেরুব?

হেমা, তুই হাসছিস আর আমার ইচ্ছে করছে তোকে ঝাঁটাপেটা করি!

হেমাঙ্গ মুখে দুষ্টুমির হাসি রেখে পা নাচাতে নাচাতে বলে, করো না যদি হাত সুড়সুড় করে!

মুনাপিসি গুম হয়ে ঝাড়ু বোলায় কিছুক্ষণ—কাদার টুকরোগুলো বাইরের দরজার কাছে নিয়ে যায়। তারপর আপন মনে বলে তোমার মরণপাখা গজিয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। তুমি আবার বোস বাড়ির মেয়েটার পাল্লায় পড়েছ। তোমার মতিগতি আবার আগের মতো দেখতে পাচ্ছি।

হেমাঙ্গ চটে যায়। কীসব বলছ আবোলতাবোল?

মুনাপিসি ঘুরে চোখ পাকিয়ে বলে তোর লজ্জা করে না? একবার প্রমথ বোস তোকে বাড়ি ডেকে নিয়ে অপমান করেছিল। ওর ভাইপো ছোঁড়া তোকে কবে স্টেশনের ওখানে মারতে গিয়েছিল, তাও শুনেছি। আবার তুই অমির সঙ্গে মেলামেশা করছিস?

সত্য অনেক সময় অসহ্য। হেমাঙ্গ জানালার ধার থেকে নেমে গম্ভীর মুখে কাপ—প্লেট রাখতে যায় ভেতরের বারান্দায়। তারপর ফিরে এসে বলে, তুমি আসলে আজকাল আমাকে সহ্য করতে পারছ না পিসিমা! হ্যাঁ, তোমার আচরণে সেটা বেশ বুঝতে পারি।

মুনাপিসি কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে যায়। ঝাড়ু চৌকাঠে ঠেকে থাকে। হাতের মুঠো কাঁপে। তারপর বলে, তুই যদি ছেলেমানুষ থাকতিস, তোকে আমি আজ বেঁধে ঝাঁটাপেটা করতুম। তুই এখন বড় হয়েছিস। তোর গায়ে হাত তুলতে পারব না। বলে সে মুখ ঘুরিয়ে ময়লাগুলো আবার চৌকাঠের বাইরে বারান্দায় ফেলতে থাকে। তারপর বারান্দায় যায় চৌকাঠ ডিঙিয়ে। বারান্দায় ঝাড়ুর জোরালো ও দ্রুত শব্দ হতে থাকে।

হেমাঙ্গ টের পেয়েছে, মুনাপিসির চোখে জল এসে গেছে। কিন্তু তার এটা ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা। লজ্জা ঢাকতে সে যে নকল—রাগের পিছু নিয়েছিল, সেই নকল রাগ এখন আসলে হয়ে উঠেছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে রেগে গেছে।

মোড়কটা তুলে নিয়ে মুনাপিসির পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। উঁচু বারান্দা থেকে রাস্তায় শব্দ করেই নামে।

যেতে যেতে নিজের রাগের যৌক্তিকতা খোঁজে সে। পিসিমা তো অন্তর্যামী নয়। সে জামাকাপড়ে কাদার সঙ্গে অমির সম্পর্ক জুড়ে দিচ্ছে কোন যুক্তিতে? খালের ধারে বেড়াতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে যেতে পারে না সে?

তা ছাড়া আজকাল আর কীরকম হয়েছে তার চালচলন? সে তো সন্দেহজনক কিছু করছে না। বরাবর একই রকম ভঙ্গিতে বাড়ি ঢোকে। কথা বলে। খায়—দায়। শোয়।

এবং প্রমথবাবুর অপমান করা বা স্টেশনে ডনের মারতে আসার কথা যদি পিসিমা শুনেছিল, এতকাল চেপে রেখেছিল কেন? সে তাকে কোনো কথা গোপন করে না বলেই বিশ্বাস ছিল হেমাঙ্গের। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পিসিমাকে বরাবর যত সরল এবং স্পষ্টভাষী সে ভেবে আসছে, ততটা মোটেও নয়।

হেমাঙ্গ আরও চটে যায়। বাজারে ঢুকে সে জয় মা তারা লন্ড্রিতে লুঙ্গি আর জামাটা কাচতে দেয়। তারপর যায় হরসুন্দরের চায়ের দোকানে। সেখানে ঝেণ্টুকে পাবে ভেবেছিল। ঝেণ্টু নেই। আজকাল ডনের সঙ্গীদের কথা জিগ্যেস করা নিরাপদ নয়, হেমাঙ্গ জানে।

হরসুন্দর বলে, কী হেমাংবাবু? মোহনপুরে ছিলে না নাকি? অনেক দিন দেখিনি।

ছিলুম। আসা হয় না।

হেমাঙ্গ ভাবে, একটু অপেক্ষা করবে নাকি। এইমাত্র চা খেয়েছে। বাড়ির চা খাওয়ার পর এই চা বিশ্রী লাগার কথা। খুব বেশি চা খাওয়ার অভ্যাসও তার নেই। সে এদিক—ওদিক তাকায়।

হরসুন্দর বলে, রোদে দাঁড়িয়ে কেন হেমাংবাবু? ভেতরে এসো।

প্রায় ন’টা বাজছে। গ্রীষ্মের হাবভাব স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। আবহাওয়ায়। আকাশের চৈতালি মেঘলা অবস্থা আর নেই। দিনভোর উজ্জ্বল গরম রোদ। তবে বাতাস আছে জোরালো। দেশনেতা নলিনাক্ষের প্রতিমূর্তির ওখানে ওপাশের বিশাল আকাশিয়ার ছায়া এখনও খানিকটা পড়ে আছে। সেই পাগলটা কোথায় গেল? একদঙ্গল ভিখিরি কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে বসে শুকনো রুটি চিবুচ্ছে। কারোর হাতে টিনের মগ। তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছে। ডনের সাঙ্গোপাঙ্গদের আডার জায়গা পুরো বেদখল।

হেমাঙ্গ ভেতরে ঢুকে বলে, চা একটু পরে দিয়ো হরদা।

অচেনা দুজন লোক বসে মামলেট খাচ্ছে। চেনাদের মধ্যে পোস্টমাস্টারবাবুর ভাই, প্রাণগোপালবাবু, সাব—রেজেস্ট্রি অফিসের মুহুরী চিত্তবাবু আর ছকা পাণ্ডা বসে আছেন। কারোর চা খাওয়া শেষ, কেউ খাচ্ছেন। কেউ সিগারেট এবং বিড়ি টানছেন। চাপাগলায় দেশের হালচাল নিয়ে কথা হচ্ছে। ছকা পাণ্ডার হাতে সাজি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সিংহবাহিনী দেবীর প্রসাদী ফুল বেলপাতা ও গঙ্গাজল বিলিয়ে হরসুন্দরকে ঝেড়েমুছে বিলোতে এসেছিল। পয়সা এবং চা দুই—ই জোটে। হেমাঙ্গকে দেখে সে শুধু একটু হাসে।

লোকেদের কথায় এটাই মোহনপুরের সেন্টার জায়গা। মধ্যিখানে ওই গোলপার্ক, চারদিক ঘুরে রাস্তা। দোকানপসারে ঠাসা। বাস রিকশা লরি টেম্পো গোরুমোষের গাড়ি এবং এলাকার গ্রামগুলো থেকে নানান কাজে আসা মানুষের ভীড়ে গমগম করে সারাক্ষণ। একটা লক্ষ্য করার ব্যাপার—আজকাল অজস্র ফলের দোকান হয়েছে। কাঁদি কাঁদি পাকা কলা আর রাশিকৃত আপেল সাজানো আছে। হেমাঙ্গের মনে পড়ে, এত বেশি আপেল এখানে কোথাও দেখা যেত না। দু’চারটে শুকনো পোকাধরা আপেল নিয়ে বসে থাকত ষষ্ঠি নামে একটা লোক। এখন শুধু আপেল কেন নাসপাতি, পীচফল, মোসাম্বি, সফেদা, পেয়ারার পাহাড় জমে থাকে। দেশের মাটির ফলন বেড়ে গেছে বছরে বছরে। স্টেশনের প্লাটফর্মে তরিতরকারির স্তূপ দেখলেও অবাক লাগে। কলকাতায় চালান যাচ্ছে। ছানা আর দুধের তো কথাই নেই। বড় বড় ড্রামভর্তি দুধ ট্রাকেও চালান যায়। একসঙ্গে এত বেশি দুধ মোহনপুরে আগে কেউ দেখেনি।

হেমাঙ্গের মনে মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে চারপাশের জমকালো এবং বিবিধ জিনিস তার মাথায় ঢুকে পড়ে। তাকে উদ্দীপ্ত করে। কারণ, ভালো লাগে এইসব সমৃদ্ধি, ফুলে ফেঁপে ওঠা, এইসব পড়ি—কী মরি করে ছোটাছুটি। অথচ যখনই মনে পড়ে যায়, বস্তুত সে এসবের বাইরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তার কিছু করার নেই, এবং ক্রমাগত লোভের ধাক্কায় হতচকিত, অথচ বিশেষ কিছু কেনাকাটার কোনো ক্ষমতাই তার নেই, তখন তার কেমন একটা অভিমান জাগে। নিজেকে অসহায় মনে হয়। তখন সে নিজেকে দ্রুত আরও তফাতে সরিয়ে নিয়ে যায়। নির্লিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রকৃতি ও প্রেমের সহজলভ্য সুখে মুখ ডুবিয়ে থাকতে চায়। অন্তত এই ব্যাপারে তার বরাতটা তো ভালোই। ভাবতে গিয়ে অমির প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। অমি না থাকলে তার বেঁচে থাকাটা খুব বিশ্রী রকমেরই হত।

পোস্টমাস্টারের ভাই প্রাণগোপাল উঠলেন। এতক্ষণে যেন দেখতে পান হেমাঙ্গকে। কে হে? হেমাং নাকি? কেমন আছো?

ভালো। আপনি ভালো আছেন?

হ্যাঁ হে হেমাং, বোসদের ডাবু নাকি কনট্রাক্টারি করতে আসবে এখানে? আমাদের সুলোক বলছিল। তুমিও নাকি আছো—টাছো ওর সঙ্গে?

হেমাঙ্গ একটু হাসে। ইচ্ছে আছে।

আমার কনিষ্ঠ পুত্রটিকে একটা কাজকম্মো দিয়ো না বাবা! অ্যানি ড্যাম জব। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বসে আছে।

কে, দুলাল?

হ্যাঁ। দেখ না বাবা। গরিব মানুষ। বড্ড বেঁচে যাই!

দেখব।

প্রাণগোপাল আশ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, হেমাঙ্গ মনে মনে হাসে। তার নিজেরই একই অবস্থা। মুনাপিসির মাথায় বসে আছে। আর তার কাছে চাকরির প্রার্থনা? সত্যি বলতে কী, ডাবুর কথার ততখানি গুরুত্ব সে এখনও দেয়নি। ডাবু তাকে লেটারহেড পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্লক আপিসে এবং লোকাল পলিটিক্যাল দলের এক কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। হেমাঙ্গ আজও যায়নি। তবে সে আঁচ করেছে, প্রমথ বোস ভাবী জামাইয়ের জন্যে নিশ্চয় তদ্বির—তদারক শুরু করেছেন।

প্রাণগোপাল চলে যাওয়ার পর সে একটু উত্তেজনা বোধ করে। মুনাপিসির গলগ্রহ হয়ে থাকার কোনো মানে হয় না আর। আজ যদি সে স্বাধীনভাবে থাকতে পারত, থাকত নিজস্ব একটা ঘরবাড়ি, তাহলে অমির সঙ্গে তার যোগাযোগটা নিরাপদ এবং নিবিড়তর হত না কি?

হেমাঙ্গ ঠিক করে, আজই হাত লাগাবে ডাবুর কাজে। ডাবু তাকে রীতিমতো নিজের জামসেদপুরের ফার্মের নামে প্রতিনিধি হিসেবে একটা পরিচিতিপত্রও দিয়েছে। ওপরে লেখা ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন।’ হয়তো হঠাৎ এসে হাজির হবে একদিন। এপ্রিলের আজ দশ তারিখ না?

চা খেয়ে হেমাঙ্গ উঠতে যাচ্ছে, ইদ্রিস এল। হ্যাল্লো হেমাংদা!

কী খবর ইদ্রিস?

চলে যাচ্ছে।

হেমাঙ্গ কাছে গিয়ে চাপাগলায় বলে, ডনের খবর জানো?

ইদ্রিস মাথা দোলায়। মুখটা নির্বিকার।—না দাদা! শুনেছিলাম কলকাতায়—

হেমাঙ্গ বাধা দিয়ে বলে, সে তো আগের কথা। পরে শুনেছি, পালিয়ে—টালিয়ে গেছে নাকি হাসপাতাল থেকে।

তাই নাকি? আমি শুনিনি।—বলে সে তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে। হরদা, পুঁটে আসেনি গো?

হরসুন্দর বলে, এসেছিল? কিছুক্ষণ আগে গেল। তোমার কথা জিগ্যেস করছিল।

দেখছ শালার কাণ্ড? ইদ্রিস বেঞ্চে বসে টেবিলে থুতনি রাখে। মাথা কাত করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে থাকে।

হেমাঙ্গ পা বাড়ায়। কাল রাতের ব্যাপারটা জানার জন্যে অস্থির এখন। সোজা বোস বাড়ি গিয়ে অমির কাছে খোঁজ নিতেও পারে। কিন্তু অমি কীভাবে বাড়ি ঢুকেছে, কিছু জানাজানি হয়েছে কিনা—যতক্ষণ না জানতে পারছে, ওবাড়ি যাওয়া ঠিক নয়।

এইসব সময় হুলোর কথা তীব্র হয়ে মনে পড়ে যায়। হুলো থাকলে তার সব কৌতূহলের আশকারা হত। হুলো কেন কে জানে, তাকে খুব শ্রদ্ধাভক্তি করত। তার কাছে কত গোপন কথা খুলে বলত।

আর মোহনপুরের কত সব গোপন ব্যাপার ঘটছে, ছেলেটা কীভাবে টেরও পেয়ে যেত। আসলে ওকে ডনেদের চর বলে ভেতরে সন্দেহ এবং ঘৃণা করলেও মোহনপুরের সবাই যেন পুরনো অভ্যাসেই ভালো না বেসে পারত না। বিশেষ করে মেয়েরা। ভদ্রলোকের ফ্যামিলি হোক, কিংবা তথাকথিত ‘ছোটলোকের’—সব বাড়ির মেয়েরা হুলোকে পেলে জমে উঠত। হুলো ছিল তাদের কাছে তামাশার কেন্দ্র। হুলোকে নিয়ে সেই এতটুকু থেকে মজা করতে ছাড়ে না কেউ। তবে সেটা খুব স্নেহময় এবং নিরপরাধ মজা করা। হুলোও মজা পেয়েছে এতে। সে যথার্থ ভাঁড়ের ভূমিকা নিয়েছে। এবং এসব সময় তার ধূর্ততা, খচরামি কিংবা গুপ্তচরবৃত্তির কোনো ছাপ তার মুখে ফুটে ওঠেনি। একরাশ সারল্য, বোকামি এবং অসংখ্য হাসি তার ভাঁড়ামিকে ভরিয়ে তুলেছে।

এসবের ফলেই হুলোর সর্বচর হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল। তাকে রাতবিরেতে কোথাও দেখলে কেউ চমকাত না। তাড়া করত না। আমি হুলো গো, হুলো? চোখের মাথা খেয়েছ? এই বললেই হাসতে হয়েছে। হুলো? তাই বল। তা এখানে কী করছিস ব্যাটাচ্ছেলে?

সিঁদ দিতে এসেছি। হুলোর এই গম্ভীর জবাব শুনে আরও হাসি পাবে।

অথচ এতদিন হুলো নেই, তার কথা যেন মোহনপুরের লোকেরা ভুলেই গেছে। শুধু হেমাঙ্গের মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় তার কথা। মনটা কেমন করে ওঠে। ছেলেটা খুবই ভয় পেয়ে গেছে। কেন এত ভয় পেল সে? থানার অফিসাররাও তো ওকে ভালোবাসেন, হেমাঙ্গ দেখেছে। হুলো কতবার বলেছে, আজ বড়বাবুর বাড়ি খাব। ওনার জামাই এসেছে, হেমাদা! মাইরি দাদা, পুলিশের জামাই কখনও দেখিনি। তুমি দেখেছ তো হেমাদা?

হেমাঙ্গের হঠাৎ মনে হয়, হুলো সম্ভবত দু’পক্ষেরই অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেছে। ওভাবে শ্যাম ও কুল রাখা একসঙ্গে কারোর পক্ষে তো সহজ নয়। একদিন না একদিন বিপদে পড়তেই হত। সেই বিপদে পড়ে গেছে ছেলেটা। অথচ হেমাঙ্গ তাকে সতর্ক করে দিয়েছে।

হেমাদা! কোথায় যাচ্ছ?

হেমাঙ্গ দাঁড়াল! ইলু স্কুলে যাচ্ছে।—স্কুলে যাচ্ছিস?

হ্যাঁ। তোমার কী হয়েছে গো?

হেমাঙ্গ চমকে ওঠে। কেন? কী হবে?

ইলু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে হাসছে। কেমন দেখাচ্ছে যেন।

হেমাঙ্গ হেসে ফেলে।—তোর অমিদির ভূতটা আমাকে ধরেছে তাহলে। ওকে ছেড়ে আমাকে ধরেছে। বুঝলি তো?

ইলু মাথা দোলায়। উঁহু! ছেড়েছে কোথায়? আজ সকাল থেকে খুব জ্বালাচ্ছে। দেখে এসো না? সৈকার কথা বলছে। আর কী গালাগালি!

হেমাঙ্গ নিষ্পলক চোখে তাকায়। সে কী! ওর অসুখ তো সেরে গিয়েছিল?

ইলু চোখ বড়ো করে একটু চাপাস্বরে বলে, সারবে কী করে? মা ওকে যখন তখন আগের মতো বেরুতে বারণ করে। শোনেই না। জানো? কাল কী করেছে?

বুক কাঁপে হেমাঙ্গের। কী রে?

কাল রাতে ওকে নাকি নিশিতে পেয়েছিল। বাবা বলাবলি করছিল। নিশি কী গো হেমাদা?

ঘুমের ঘোরে বেরিয়ে যাওয়া।

মা জেগে ছিল, জানো? অমিদির কাপড় কাদায় ভর্তি, এলোমেলো চুল, লাল চোখ! মা খুব মেরেছে, বড়দি সকালে বলছিল। বাবা না ধরলে মেরেই ফেলত। বাবা বললেন, নিশিতে পেয়েছিল। তুমি যাবে হেমাদা, অমিদিকে দেখতে?

হেমাঙ্গ নিশ্বাস চেপে বলে, দেখি। তারপর ইলুর উদ্দেশে—আচ্ছা, চলি রে বলে পা বাড়ায়। তার মাথা ঘুরছে যেন। কেমন ক্লান্তি লাগছে। কাঠফাটা রোদ গায়ে নিয়ে সে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যায় ভিড়ের মধ্যে! খালের ব্রিজ পেরিয়ে বারোয়ারি বটতলায় গিয়ে ছায়ায় দাঁড়ায়।

অমিকে দেখতে যাবে, না যাবে না—ঠিক করতে পারে না। আনমনে সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে। অমির জন্যে তার মনে ছটফটানি শুরু হয়েছে। আহা, ওই অবস্থায় সুলোচনা তাকে মেরেছেন! রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে ওঠে হেমাঙ্গ। অতবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারলেন সুলোচনা? এটাই তার বড্ড অবাক লাগছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভারী নিশ্বাসের সঙ্গে শেষ ধোঁয়াগুলো বের করে দিয়ে সে অভ্যাসমতো সিগারেটের টুকরো চটির তলায় ঘষে নেভায়। তারপর অন্য রাস্তায় ঘুরে বাড়ি ফেরে। বোসবাড়ির সামনে দিয়ে গেলে শর্টকাট হত। যেতে ইচ্ছে করছিল না।

কিন্তু বাড়িও ঢোকে না সে। বাড়ি যেন দাঁত বের করে কামড়াতে আসছে। সে শ্মশানতলার দিকে হাঁটতে থাকে।

একটু দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, শ্মশানতলায় শংকরার সামনে কারা বসে আছে।

কিছুটা কাছাকাছি হয়ে দেখল, ওরা গাঁজা খাচ্ছে। শংকরা আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছে। তাকে ঘিরে আছে যারা, সবাই রেলের লোক। নেভি ব্লু উর্দি পরনে। একজনের মুখে সাদা গোঁফদাড়িও আছে। মাথায় রুমাল জড়ানো। ড্রাইভার কিংবা ফায়ারম্যান হতে পারে। হেমাঙ্গ অবাক হল। গাঁজা খেয়ে ইঞ্জিন চালাবে ওরা?

সম্ভবত এখন অফ—ডিউটির সময় রেলইয়ার্ডে অন্য দিনের মতো শানটিং চলেছে। একখানে গ্যাংম্যানরা লাইনের পাথর সরাচ্ছে। ঝোপঝাড় গাছপালার ফাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। দূরে গোডাউনের শেডের সামনে কুলিরা ওয়াগন থেকে কাঠের বাক্স নামাচ্ছে।

হেমাঙ্গ বাঁদিকে রেলইয়ার্ডের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথার ওপর একটা গাবগাছের ঘন ছাউনি। গাবফলের গুটি ধরেছে। একটু পরে ওপর থেকে শব্দ হতেই সে চমকে দেখল, কেউ গাবফল পাড়ছে। হেমাঙ্গ লোকটাকে চিনতে পারে। জেলেপাড়ার লোক। জালে গাবের কষ মাখাবে। গাবফল পড়া শুরু হলে জামায় কষ ছিটকে পড়ার ভয়ে সরে আসে। বিরক্ত হয়। কোথাও একা দাঁড়াবার জো নেই। সে বটতলায় যেতে ইতস্তত করছিল আসলে। সেই সময় দেখল, দলটা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে। শংকরাকে সেলাম ও প্রণাম করে তারা নাক—বরাবর চলে গেল। তারপর খালের হাঁটুজল পেরিয়ে গিয়ে কাদা ধুতে থাকল।

হেমাঙ্গ এগিয়ে গিয়ে ডাকে—কী রে শংকরা?

শংকরা চোখ বুজে বসে ছিল। লাল চোখে তাকিয়ে হেসে বলে, উরে ব্যাস! হেমাং যে রে! আয়রে, আয়। বোস! সে সামনের নগ্ন মাটিতে থাপ্পড় মারে। ধুলো উড়ে যায়।

হেমাঙ্গ বসে না। দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, খুব শিষ্যটিষ্য জুটিয়েছিস শংকরা! কত প্রণামী পেলি?

শংকরা মুখ বাঁকা করে বলে, তোর সঙ্গে কথা বলছি এই তোর ভাগ্যি। শালা! আমায় সেদিন মারতে এলি?

তুই অমন করে উঁকি দিচ্ছিলি কেন? ডেকে ঢুকতে পারতিস!

জিভ কেটে শংকরা বলে, তাই ঢোকা যায়? তুই তখন প্রেম করছিস। আমি বাগড়া দিতে পারি?

হেমাঙ্গ হেসে ফেলে।—ইডিয়েট কোথাকার! তা হ্যাঁরে, তোর সেই খুলিটা কই?

শংকরা খিক—খিক করে হাসে। পালিয়ে গেছে জগা শালা! এত আদর সইল না। যাক না। আবার একটা খুলি পেয়ে যাব! শিগগিরই পাব।

তাই বুঝি? কার খুলি?

তোর।

হেমাঙ্গ হাসতে গিয়ে ভেতরটা শুকিয়ে হৃৎপিণ্ডে খিল ধরে গেছে।