সাত
প্রমথ তাঁর ছেলে জনকে আটকাবার চেষ্টা করছিলেন। জনের হাতে একটা কঞ্চি। কঞ্চির ডগায় খানিকটা নোংরা মাখানো। ওটা সে পল্টুর পাতে গুঁজে না দিয়ে ছাড়বে না। পল্টু বেচারা কিচেনের বারান্দার এক কোনায় খেতে বসেছিল। এখন থালা তুলে নিয়ে কুয়োতলার আড়ালে চলে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। কিন্তু মাথায় আগুন জ্বলছে। বাগে পেলেই ওই ক্ষুদে শয়তানটাকে টুপ করে তুলে কুয়োয় ফেলে দেবেই।
প্রমথ অনেক কষ্টে জনকে তুলে নিয়েছেন কোলে। কিন্তু সে বাবার গলা কামড়াবার চেষ্টা করছে। বাড়িসুদ্ধু মেয়েরা হাসছে। অবশেষে সুলোচনা এসে বাঁহাতে কঞ্চিটা কেড়ে নিয়ে ফেলতে গেলেন। তারপর জন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।
প্রমথ দোদুল্যমান পুত্রকে নিয়ে বেরুলেন। রোয়াকে বসে হাঁক দিলেন—ইলু, জনের ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে আয় তো! আমরা খেলব।
এমন সময় হেমাঙ্গকে দেখা যায় লনের ওদিকে রাস্তায়, গেটের সামনাসামনি। প্রমথর দৃষ্টি যেতেই জনকে ছেড়ে ফের ডাকেন, কে হে? হেমা নাকি?
হ্যাঁ, জ্যাঠামশাই!
বিস্তর দিন তোমাকে দেখিনি। ছিলে না নাকি?
জন হেমাঙ্গকে দেখে ছুটে গিয়েছিল গেটে। তার হেমাঙ্গকে কেন যেন ভালো লাগে। হেমাঙ্গ এ বাড়ি এলে শান্ত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। অবশ্য হেমাঙ্গ ছাড়া আরেকজন তার লক্ষ্যের মানুষ—সে জামসেদপুরের ডাবু। উলটে ডাবু তাকে জ্বালাতনের একশেষ করে। কিন্তু জন প্রতিশোধ নেয় না। এর পর রইল ডন। ডনের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রভু ও ভৃত্যের। তার দিদিরা তাকে ডনের চাকর বলে তামাশা করে। ডন তাকে যেখানে যেতে বলবে, সে রাজি। তাই বলে বাড়ির এলাকার বাইরে তাকে যেতে বলে না ডন। বড়জোর বাড়ির ভেতরের টুকিটাকি ফরমাস খাটায়।
হেমাঙ্গের দিকে গেটের ওপার থেকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল জন। হেমাঙ্গ হাসিমুখে বলে—হ্যাল্লো জন!
জন গেটের ওপর দিকের আংটা তোলার চেষ্টা করতে থাকে। ওর ছোট্ট হাত অত উঁচুতে পৌঁছয় না। হেমাঙ্গ নিজে খুলে ভেতরে ঢোকে। ওর প্রকাণ্ড মাথাটা একটু নেড়ে দেয়।
প্রমথ বলেন, ভালো করে আটকে দিয়ো হেমা। ও বেরিয়ে পড়বে। জন! চলে আয়। ব্যাট খেলি।
হেমাঙ্গ রোয়াকে ছায়ায় বসে বলে, শরীর ভালো ছিল না। তাই আসা হয়নি।
সিজন চেঞ্জের সময় যে! প্রমথ বলেন। শেষ রাতে তো কনকনে শীত পড়ে। সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম সারাদিন। পক্সের মরশুম। টিকেফিকে নিয়েছ তো?
হেমাঙ্গ মাথা দোলায়।
টিকে একটা একটা নোংরা ব্যাপার। না নেওয়াই ভালো। হোমিয়োপ্যাথিতে ভালো ওষুধ আছে। খেয়ে যাও। টিকের অলটারনেটিভ ভদ্র সভ্য ব্যবস্থা।—বলে প্রমথ জনকে খোঁজেন। জন বাগানে দাঁড়িয়ে এখন প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করছে।
এই সময় ইলু এসে ব্যাট—বল রাখে বাবার পাশে। হেমাঙ্গের দিকে তাকায়। হেমাঙ্গ চোখ এড়িয়ে বলে, ভৌতিক ক্রিয়াকলাপ কেমন চলছে ইলু? চড় খাবার ভয়ে জানতে সাহস পাইনে।
ইলু হাসতে হাসতে বলে, সৈকা পালিয়ে গেছে জানেন না?
বলো কী!
শংকরা খ্যাপার তাড়া খেয়ে।
প্রমথ হো—হো করে হেসে ওঠেন। তারপর বলেন, মাকে গিয়ে বল ইলু, হেমাদা এসেছে।
ইলু চলে গেলে হেমাঙ্গ সতর্কভাবে জিগ্যেস করে, জ্যাঠামশাই ডনের খবর পেয়েছেন?
প্রমথ নড়ে ওঠে। চাপা গলায় ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, কিছু শুনেছ নাকি?
না। আমি তো—মানে, অসুস্থই ছিলুম বলতে গেলে। বেরোইনি বিশেষ।
প্রমথ মুখ তুলে গাছপালা দেখতে দেখতে ভারী গলায় বলেন, আমার কেমন যেন ধারণা—পুলিশ ওকে গুলি করে মেরে ফেলে রটাচ্ছে, হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে। পায়ে যদি গুলি লেগে থাকে, কীভাবে পালাবে বলো? আমি তো যতটা করার, ছুটোছুটি করে তা করলুমও। জ্ঞানবাবু এম.এল.এ.—কে ধরলুম। বললেন, অ্যাসেমব্লিতে কথা তুলব। রোজ তো কাগজ দেখছি। কই! তবে জানো হেমা, এ আমি জানতুম। বুঝলে? ডনকে হাজার বার বলেছি, কানে নেয়নি। আসলে ছেলেটার মধ্যে একটা ব্লাইন্ড—ফোর্স কাজ করছিল। জাস্ট লাইক এ ম্যাড হর্স!
আপনি ঠিকই বলেছেন জ্যাঠামশাই। হেমাঙ্গ সায় দেয়। তারপর ফের বলে, ওর জন্যে আপনাকেও যথেষ্ট হয়রান হতে হল আর কী!
তা তো হলই। যখন তখন আই.বি. এসেছে। জেরা করেছে। একবার বাড়ি সার্চও করে গেল। তুমি আমাদের ঘরের ছেলে। তোমাকে লুকিয়ে লাভ কী? প্রমথের মুখে তীব্র ক্ষোভ ফুটে ওঠে। তেতো মুখ করে আলগোছে একটু দূরে একচিলতে থুথু ফেলেন। তারপর বলেন, ওদিকে ভাইয়ের ওই অবস্থা। এদিকে বোনের এই উদ্ভট অসুখ। বাড়িতে সুখ নেই হে!
হেমাঙ্গ নেহাত কথার ছলে বলে, অমির অসুখ কেমন এখন?
প্রমথের মুখের বিকৃতি চলে যায়। বলেন, হোমিয়োপ্যাথি ইগ্নেশিয়া থাউজেন্ড এক্স মিরাকল করেছে বলতে পারো। আর কই, বিশেষ ফিটটিট হয় না। তবে মাথা ঘোরা আর মাথার মধ্যে জ্বালাকরা ভাবটা আছে। ওটাও চলে যাবে। তবে ডনের ব্যাপারটা আবার নিশ্চয় জোরালো শক দিয়েছে।
অমি কান্নাকাটি করছে বুঝি?
না, না। জোরে মাথা দোলান প্রমথ। তুমি তো বরাবর দেখছ ওকে। ভেতরে যাই হোক, যত ঝড় জল তাণ্ডব চলুক, মুখ দেখে কিস্যু বোঝার উপায় নেই। টিপিক্যাল ইগ্নেশিয়া ক্যারেক্টার।
এই সময় সুলোচনা এলেন বারান্দায়। কী হেমা! পথ ভুলে নাকি বাবা? হ্যাঁ! ছেলের যে আর পাত্তাই নেই। আজ সকালেই জিগ্যেস করছিলুম পল্টেকে। বলল, বাজারে দেখেছে।
হেমাঙ্গ কাঁচুমাচু মুখে বলে, অসুখ করেছিল জেঠিমা। আপনি ভালো আছেন?
সুলোচনা হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বাগানে নেমে গেলেন—এই বাঁদর! ও কী করছিস? দেখছ—দেখছ গাছটা কেমন করে ওপড়াচ্ছে?
প্রমথ হাই তুললেন। দুপুরে খেয়েটেয়ে একটুখানি গড়াই। আজ কী যে হল। শুলুম বটে, কেমন একটা অস্থিরতা! হঠাৎ ডনের জন্যে মনটা কেমন করে উঠল। আফটার অল সেই অ্যাট্টুকুন বেলা থেকে মানুষ করেছি ভাইবোনকে। সুমু—ওদের বাবা সুমথকে তোমার মনে পড়বে না। সুমু কিন্তু অত্যন্ত জেন্টলম্যান ছিল। ওদের মা অবশ্যি একটু জেদি একরোখা টাইপের মেয়ে ছিল। তাহলেও মনটা ছিল ভারী নরম। আমাকে বাবার মতো ভক্তি করত। একবার কী ঝগড়াঝাঁটি করে তিন দিন খায়নি। সুমু টেলিগ্রাম করল। পেয়ে তক্ষুনি চলে গেলুম। আমাকে দেখেই পা জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! কাছে বসিয়ে খাওয়ালুম। তুমি কল্পনা করতে পারবে না হেমা। তখন ওরা থাকত মনিহারি— ঘাটে। ডনের বয়স মোটে বছরখানেক হয়েছে।
প্রমথ এরপর ডনের বাল্যজীবন নিয়ে পড়লেন।
হেমাঙ্গের কান অন্যদিকে, মনও অন্যখানে। অমি অভিসার বন্ধ করে দিয়ে হঠাৎ। দু—একদিন অন্তর বাঁজাডাঙার চটানে, কোনোদিন রেলইয়ার্ড পেরিয়ে ক্যানেলের পাড় ধরে এগিয়ে পূর্বের মাঠে স্লুইস গেটে, এবং একদিন লোকোশেডের ওদিকে রেলের ফুটবল খেলার মাঠে গেছে দুজনে। রাত আটটা—নটা অব্দি কাটিয়েছে। তারপর হঠাৎ অমির আর দেখা নেই। হেমাঙ্গ অস্থির।
প্রমথ বলেন, তারপর লালুর কথাই ধরো। ও তো তোমার বুজমফ্রেন্ড ছিল। না কী?
হেমাঙ্গ বলে, হ্যাঁ।
লালুও কেমন ভদ্র শান্ত ছেলে তুমিতো দেখেইছ। কিছুটা বোকাও ছিল যেন। কলকারখানার মধ্যে আনমনে ঘুরতে আছে? অকালে নিজের জীবনটা হারাল।
এবার এল টলু। বারান্দার থামে পিঠ রেখে হেলান দিয়ে হেমাঙ্গের দিকে চেয়ে হাসল। প্রমথ কথায় ডুবে আছেন। হেমাঙ্গ টলুর হাসির জবাব হাসিতে দিল। টলুর স্বাস্থ্য এমন উজ্জ্বল কীভাবে হচ্ছে, হেমাঙ্গ বুঝতে পারে না। হঠাৎ খানিকটা মুটিয়ে গেছে যেন। সচরাচর বিধবাদের চেহারায় একটা ঘষা খাওয়া পাংশুটে ভাব থাকে—টলুরও ছিল, কিন্তু এখন তা নেই। ওর গড়ন এমনিতেই খানিকটা পুরুষালি। হাত পায়ের হাড় মোটা। মুখেও কঠোরতার ছাপ আছে। টলুকে বাঙালি মেয়েদের মোটামুটি সৌন্দর্যর স্ট্যান্ডার্ডে ফেলা যাবে না। বরং যেন পাঞ্জাবি মেয়েদের মতো খানিকটা। শালোয়ার কুর্তা পরিয়ে দিলে বাঙালি বলে চেনা কঠিন।
হেমাঙ্গ ইদানীং নিজের গুরুতর পরিবর্তন টের পাচ্ছে। আগে মেয়েদের দেখামাত্র সেক্সটেক্স মাথায় আসত না। এখন এই কদর্য অনুষঙ্গ—শরীর তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। টলুকে সে বস্তুত উলঙ্গ দেখেই দ্রুত আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। শুধু টলু কেন, যে—কোনো যুবতীই তার চোখে আজকাল উলঙ্গ হয়ে ধরা পড়ে। মেয়েদের শারীরিক গঠন, প্রত্যঙ্গ, ভাঁজ এবং টুকরো টুকরো ভাবে বুক, নাভিদেশ, ঊরু, নিতম্ব, গ্রীবা ও ঠোঁট—এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসের গন্ধ সমেত তাকে বিব্রত করে। আসলে মানুষের শরীরে কত কী তীব্র আনন্দদায়ক ব্যাপার আছে, জানা হয়ে গেলে হয়তো এইরকম হ্যাংলামি প্রথম প্রথম পেয়ে বসে।
টলুকে সে টলুদি বলে। অমির কত বড় সে। অমি বলেছিল, টলুদি সত্যি লেসবিয়ান মেয়ে। হেমাঙ্গ সেই সব ভাবে। আবার এও টের পায়, তার এই ভাবনা খুবই অশালীন এবং তার লালিত—পালিত কিছু মূল্যবোধ হঠকারী ধাক্কায় ভেঙেচুরে গেছে। সে কি লম্পট হয়ে পড়ছে ক্রমশ? অথচ অমির ওই শরীর! অমি শরীর দিয়ে তাকে কবজা করে ফেলেছে। টেনে নিয়ে চলেছে আরও তীব্র, অসহনীয় এবং জ্বালা—ধরানো চেতনার দিকে। হেমাঙ্গ মাঝে মাঝে ভয়ও পায়।
টলু কি তার চাহনিতে কিছু আঁচ করছিল? মেয়েদের নাকি সেক্সের ব্যাপারে একটা জোরালো ইনটুইশান আছে। সত্য হতেও পারে। টলু পেটের কাছটা আলতো হাতে কাপড় টেনে ঢাকল।
ক্লান্ত প্রমথ বললেন, এবার চা খাওয়ার সময় হয়েছে নিশ্চয়। কী বলো হেমা?
কোনো—কোনো মানুষের ছোটখাটো তুচ্ছ কোনো ব্যাপারে শৌখিনতা থাকে। আনন্দ থাকে। প্রমথের আনন্দ এবং শৌখিনতা এই রোয়াকে দুই পা তুলে বসে তারিয়ে তারিয়ে চা খাওয়া। সময়টা বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে হওয়া চাই। তখন এদিকটায় পুরো ছায়া। বাগানে পাখিরা ডাকাডাকি করে। বর্ণাঢ্য ফুলে ওড়ে প্রজাপতি। সুলোচনা একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে দিয়েছেন নিজের পরিবারের জন্য। অথচ সাপ থাকার মতো এমন পরিবেশে ডন থাকে। অমি…
না। অমি সত্যি সাপের উপমায় পড়ে না। অমি হৃদয়বতী মেয়ে। প্রেম বোঝে। আবেগ দিয়ে এবং কামনা দিয়ে জীবনকে আড়ালে নিঙড়ে নিতে চায়। অমিকে উপমায় ধরা যাবে না। ওর মধ্যে বাঘিনীর কঠিন সাহস এবং হরিণীর কোমল ভীরুতা দুই—ই আছে।
সুলোচনা ততক্ষণে জনকে বাগান ঘুরিয়ে দক্ষিণ হয়ে বাড়ি ঢুকেছেন। টলু ফের হেমাঙ্গের দিকে নিঃশব্দে কেমন হেসে চায়ের কথা বলতে গেল। প্রমথ হেমাঙ্গের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল, যাক গে। অনেক বকবক করা গেল। কথা বলার তো মানুষ পাইনে মোহনপুরে। তোমার সঙ্গেই যা মন খুলে কথা বলি। ব্যাপারটা কী হয়েছে জানো? আমি সবার চোখে দানো হয়ে আছি। ভাবে, প্রমথ বোস মাস্তান গুণ্ডাদের মাইনে দিয়ে পোষে। ও শুধু ডনের জন্যে হে, বুঝেছ? খালি ডনের জন্যে। অথচ মোহনপুরে যারা মাস্তান গুণ্ডা সত্যি সত্যি মাইনে দিয়ে পুষছে, তাদের মুখোমুখি গিয়ে বল না তোরা, দেখি কেমন বুকের পাটা?
হেমাঙ্গের দৃষ্টি গেছে গেটের দিকে। অমি ঢুকছে।
এতক্ষণ তাহলে বাইরে ছিল অমি! কোথায় গিয়েছিল? কেন? এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে হেমাঙ্গ তাকিয়ে থাকে। অমির মুখে তাকে দেখে কোনো পরিবর্তন নেই। সে হন হন করে এগিয়ে আসে। হেমাঙ্গ নিজের অজান্তে নিষ্পলক চোখে তাকে লক্ষ্য করে।
প্রমথ বলেন, অমি! গিয়েছিলি নাকি ওখানে? দেখা পেলি?
অমি জবাব দেয়, হ্যাঁ।
প্রমথ হেমাঙ্গের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলেন, কী বলল? হেমাও আছে যখন, ওর সঙ্গে কনসাল্ট করা যাক।
অমি বারান্দায় উঠে তারপর থামে। ঘুরে বলে, ভেল্টুবাবুর কাছে আমাকে আর যেতে বলবেন না। এখন একেবারে উলটো হয়ে গেছেন ভদ্রলোক। ইনসাল্টিং টোনে কথা বললেন।
সে কী? কাল সন্ধেবেলা ভেল্টুর সঙ্গে আমার কথা হল!
কী কথা হয়েছে, আপনি জানেন। এরপর ইচ্ছে করলে আপনি যাবেন। বলে অমি ঘোরে এবং পা বাড়ায়।
প্রমথ বলেন, আঃ! কী বলল বলবি তো?
বললেন, রিস্ক নিতে পারবেন না। এসবের মধ্যে উনি আর নেই। জ্ঞানবাবুকে গিয়ে ধরো।
অমি চলে গেল। হেমাঙ্গ অপমান বোধ করবে কিনা ভেবে অস্থির। প্রমথ রাগ দেখিয়ে বলেন, এই হয় রে নেমকহারাম! ঠিক আছে। জ্ঞান তো আছেই। ফিরুক ও কলকাতা থেকে। অ্যাসেমব্লি সেশন চলছে তাই।
হেমাঙ্গের মন অমিকে অনুসরণ করেছে। অমি তার দিকে তাকিয়েছে, অথচ কোনো কথা ছিল না দৃষ্টিতে। কোনো সম্ভাষণ না। হেমাঙ্গ যেন গাছ, না পাথর। কেন এমন করে অমি? মাঝে মাঝে কাছে চলে আসে, এবার তো বড্ড বেশি কাছে এসেছিল, তারপর দূরে ছিটকে যায়। বরাবর এই ওর স্বভাব। যেন লুকোচুরি খেলে।
প্রমথ চাপাস্বরে বলেন, বুঝলে হেমা? ডনের খোঁজখবরের জন্যে ভেল্টু আমাকে কথা দিয়েছিল। ওর সোর্স আছে ওপরে। হঠাৎ নাকি উলটো গাইছে। মানুষ কী এলিমেন্ট বুঝতে পারছ? ডন থাকতে ব্যাটা সেলাম ঠুকত।
হেমাঙ্গ উঠে দাঁড়ায়। আজ চলি জ্যাঠামশাই।
প্রমথ ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেন। চা আসছে। বসো। এতক্ষণ তো খালি নিজেদের কথাই বললুম। তোমার কথা শোনা যাক। ডাবুর ব্যাপারটা কতদূর এগোলো হে? সেদিন চিঠি এসেছে ওর। লিখেছে, হেমা আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ। প্রমথ হা হা করে হাসেন।…ভালো। ভালো। তুমি তো চুপচাপ বসেই আছো। তবে ডাবু এনার্জেটিক ছেলে। ও যা গোঁ ধরে, তাই করে। দেখবে কবে হুট করে এসে কাজে নেমে গেল। আমিও ওর সঙ্গে থাকছি, জানো তো? বলেনি ডাবু?
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, না তো?
জাস্ট কনসালট্যান্ট আর কী! প্রমথ হাসতে থাকেন।
তাহলে তো ভালোই হবে। আপনি এসব ব্যাপারে এক্সপিরিয়েন্সড!
এই সময় ট্রে সাজিয়ে ইলু চা আনল। গরম—গরম কচুরীও আছে। প্রমথ খুশি হয়ে বলেন, খাও হে! এই একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। খাওয়া পেলে কিছুতেই ছাড়তে নেই। বিশেষ করে তুমি বামুনের ছেলে!
হেমাঙ্গের সব তেতো লাগে। বিকেলের ছায়াভরা বাগানে বসন্তকাল আপন খেয়ালে চনমন করে বেড়াচ্ছে। কতরকম মিঠে ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসে। কত শব্দ। এমন একটা সময়ে অমির মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা বুকে জোর বাজে। এখনও অমির চুলের গন্ধ সব ছাপিয়ে তার স্নায়ুকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। খুব অসহায় মনে হয় নিজেকে। সংশয় কুটকুট করে জ্বালা দেয়। তাহলে কী শরীরের বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠা ঠিক হয়নি?
অমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকলে তার কাছে যাওয়া যেত। প্রমথই যেতে বলতেন। অমিকে ছেড়ে সৈকার ভূত কেন যে পালিয়ে গেল।
হেমাঙ্গ ওঠে। প্রমথ বলেন, শিগগির এসো আবার। তোমাকে দেখলে খুব ভালো লাগে বাবা!
হনহন করে সে গেট পেরিয়ে চলে যায়। রাস্তায় নেমে একবারও ঘোরে না। ঘুরলে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দোতালায় জানলার কাছে অমিকে দেখতে পাওয়ার চান্স ছিল।
বাজারের দিকে চলতে থাকে সে। তরুণ সংঘে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছে করে। কতদিন যাওয়া হয়নি। অথচ সে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। এখন যেতে যেতে মনে হয়, মন নিয়ে ক্লাব—টলাবের কাজে লেগে যাবে।
হেমাঙ্গ চলে যাওয়ার একটু পরে সুলোচনা সময় পেয়ে রোয়াকে এলেন। এসে হেমাঙ্গর খোঁজ করলেন।
প্রমথ বললেন, হেমা এই মাত্র গেল। ইলুদের বলো না গো, দুটো বেতের চেয়ার এনে দিক। বাগানে একটু বসি। আজ পঞ্চুমী না?
সুলোচনা একটু হাসেন। চাঁদের আলো দেখবে?
দেখিই না। কতকাল কিছু দেখি না।
হঠাৎ এ ভাবের উদয় কেন? উঁ? বলে সুলোচনা মেয়েদের ডাকেন। কয়েকটি সন্তান থাকলে এ গোলমাল সবারই হয়। ইলু বলতে মিলু, বুলু বা টলু হুটপাট করে মুখ দিয়ে বেরুতে থাকে। শেষে হেসে দুঃছাই বলেন। শেষে টুলু আসে। হুকুম সেই পালন করে।
এখনও অবশ্য সূর্যাস্ত হয়নি। এলাকায় প্রচুর গাছপালার জন্যে মনে হচ্ছে দিনটা ফুরিয়ে গেল বুঝি। বাগানের দক্ষিণে উঁচু গাছ নেই। ফুলবাগিচা ওটা। পল্টু মালির কাজ করে মাঝে মাঝে। ঘাসছাঁটা মস্তো কাঁচি চালিয়ে জল ছড়িয়ে সবুজ চিকন ভাব জাগিয়ে রেখেছে। ওখানে পশ্চিমের উঁচু শিরিষ আর অর্জুনের ছায়া এসে পড়েছে। ব্রিটিশ আমলে ওই দিকটায় মিলিটারি ছাউনি ছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তারও আগে কোন যুগে ছিল সাহেবদের রেশমকুঠি। গাছগুলো সেই আমলের। এখন ভাঙাচোরা কিছু ঘর, মোটা মোটা থাম দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ঘর সারিয়ে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা কেউ কেউ বাস করছে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁচু পোড়ো জলের ট্যাঙ্কটা দেখতে পাওয়া যায়। শোনা যাচ্ছে, ওখানেই নাকি সুগার মিল হবে।
ফুলবাগিচার লনে কেয়ারি করা ঘাসের ওপর বেতের চেয়ার আধুনিক জীবনযাপনের ভঙ্গি হলেও প্রমথ তাঁর চিরাচরিত ঢঙে ঠ্যাঙ তুলে বসবেন। কাপড়ের ফাঁকে হাত গলিয়ে চুলকোনোর অভ্যাসও আছে। টলুকে দেখে সংযত হলেন। টলু বসবি তো আরেকটা চেয়ার নিয়ে আয়। বলে প্রমথ সুগার মিলের কথা তুললেন।
মধ্যে অনেকদিন ডনের ব্যাপার নিয়ে মানসিক অশান্তি গেছে। কী হয় কী হয় আতঙ্ক ছিল সারাক্ষণ। তাই এভাবে পারিবারিক আড্ডা জমেনি। এখন অবস্থা থিতিয়ে এল। তাছাড়া শেষ চৈত্রে চাঁদনি রাতে এখানে বসে থাকতে এ বাড়ির ছোটবড় সবারই ভালো লাগে। শুধু এ বাড়ি কেন, আশেপাশে সব বাড়ির লোকেরাই তাই করে।
টলুর দেখাদেখি জন এল হেলতে দুলতে। বুকের ওপর তার ছোট্ট রঙিন মোড়া চেপে ধরে এল এবং গম্ভীর মুখে বসল। তারপর দেখা গেল ইলুও আসছে। সে ঘাসে হাঁটু দুমড়ে বসল এবং ফ্রকের ঘের দিয়ে পায়ের অনেকটা সতর্কভাবে ঢেকে রাখল।
সুলোচনা বলেন, মিলু এল না?
টলু ডাকে, মিলু! ও মিলু? মা ডাকছে। এখানে আয়।
অমির কথা যেন কারুর মনে নেই। মিলু আসার পর প্রমথ চাপা হেসে বলেন, টলু, ঘণ্টার মা রেবোয় না যেন, বেরুলেই ধরবি।
সবাই হাসে, এ কথায়। এমনকি জনও খিটখিট করে হেসে ওঠে। তবে পল্টু ও ঘণ্টার মা এ বাড়িতে চুরির ব্যাপারে অদ্ভুত ব্যালান্স। দুজনে নাকি কড়া শত্তুর পরস্পরের এবং উভয়ে উভয়ের দিকে লক্ষ্য রাখে, কে কাকে বমালসুদ্ধু ধরিয়ে হেনস্থার চূড়ান্ত ঘটিয়ে তাড়াবে, সেই সুযোগ খোঁজে।
এই পারিবারিক সম্মেলনে হাজারটা প্রসঙ্গ ওঠে। পৃথিবীর এবং মোহনপুরের তাবৎ ব্যাপার—স্যাপারকে তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য করা হয়। প্রমথ আজ পড়েছেন সুগার মিলের সূত্রে দ্বারিক গোঁসাইকে নিয়ে। দ্বারিক গোঁসাই মোহনপুরের ডাক্তার, জননেতা, আবার নতুন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান জ্ঞানবাবু এম.এল.এ.—র ডান হাত। কিন্তু সুগার মিলের পেছনে বাগড়া দিচ্ছেন দ্বারিকই, জ্ঞানবাবু সেটা বুঝতেই পারছেন না। ওঁকে বোঝালে খাপ্পা হয়ে যাবেন। এই হল প্রমথের মত। প্রমথ সিরিয়াস আলোচনা করলে তাঁর পরিবার গম্ভীর হয়ে শুধু শোনে মাঝে মাঝে সুলোচনাই যা ফুট কাটেন।
ইতিমধ্যে সূর্যাস্ত হয়েছে। সুলোচনা টের পেয়ে উঠে যান টলুকে নিয়ে। প্রমথ আবার চায়ের ফরমাস করতে ভোলেন না। একটু পরে শাঁখ বেজে ওঠে বাড়িতে। আলো জ্বলে।
এতক্ষণে প্রমথের মনে পড়ে অমির কথা। বলেন, অমি এল না যে? ইলু, অমি কী করছে রে?
মিলু বলল, ডনের ঘরে শুয়ে আছে।
ডনের ঘরে? ও ঘরে তো তালা আটকে দিয়েছিলুম। চাবি কোথায় পেল?
প্রমথকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। এ তো রীতিমতো রহস্য। ডনের ঘরের তালাটা অবশ্য পুরনো। ডনের কাছে একটা চাবি থাকত। মাঝে মাঝে তাকে তালা আটকাতে দেখা যেত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তালা নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ডনের চাবিটা অমি কেমন করে পাবে?
ইলু বলল, আজ সকালেই তো ছোড়দিকে দেখলুম ডনদার ঘরের দরজা খুলতে।
জিগ্যেস করিসনি ওকে?
ভ্যাট! আমি কেন জিগ্যেস করতে যাব?
প্রমথ চাঞ্চল্য চেপে বসে রইলেন। মিলু বলল, আয় জন। মাস্টারমশাই এসে যাবেন।
জন বড়দের ভঙ্গিতে হাই তুলে বলল, ঘুম পাচ্ছে!
মিলু বলল, ও ইলু! আচায্যিদের খোকনের মতো আজ পল্টেকে বসিয়ে দিচ্ছি মাস্টারমশায়ের কাছে।
অন্যমনস্ক প্রমথ বলেন, সে কেমন?
বাবা, জানো? খোকন নাকি স্কুলে গিয়ে ওদের চাকরকে ক্লাস করতে ঢোকায়। নিজে বাইরে খেলা করে। প্রক্সি!
প্রমথ শুকনো হাসলেন। এরা দুই বোনে হাসাহাসি করল। সেই সময় সুলোচনা এলেন। মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর। পূর্বে বাড়ির সামনে রোয়াকের মাথায় আলোটা জ্বলছে। তার ছটা টেরচা এসে পড়েছে মুখে। নিজের চেয়ারটাতে বসে বলেন, জন, ঢুলছিস কেন? মিলু, ওকে নিয়ে যা তো। প্রতিদিন সন্ধেবেলা ঘুম পায়। যাও, এক্ষুনি মাস্টার এসে যাবে।
মিলু জনকে মোড়াসুদ্ধ তুলে নিয়ে গেলে জন আপত্তি করে না, তারপর সুলোচনা বলেন, ইলু আর কী? পড়তে বসো গে।
ইলু চলে যাবার তালেই ছিল। সে গেলে প্রমথ বলেন, অদ্ভুত ব্যাপার তো। অমি নাকি ডনের ঘরে শুয়ে আছে। ইলু সকালেও কখন ডনের ঘরের তালা খুলে ঢুকতে দেখেছিল ওকে। চাবি কোথায় পেল? চাবি তো আমার ড্রয়ারে ছিল।
সুলোচনা গলা চেপে বলেন, হতভাগী মেয়ের পেটে এত কথা চাপা থাকে! আশ্চর্য, আশ্চর্য! আমি তো থ হয়ে গেলুম। আজ দুপুরে তোমাকে বলে গেল, ভেলটুবাবুর কাছে যাচ্ছে।
আহা, সে তো আমিই পাঠালুম!
ফিরে এসে কী বলেছিল তোমাকে?
বলল, ভেলটুবাবু ইনসালটিং টোনে কথা বলেছে। ও নাকি কিছু করবে—টরবে না।
আশ্চর্য! অথচ…
অথচ কী? আহা, বলো না কী ব্যাপার?
কী মিথ্যাবাদী মেয়ে দেখছ? ঢঙ দেখিয়ে ভেলটুর কাছে গেল। এদিকে গত রাত্রে ডনের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে। দেখা যদি হয়েছে, তো বললে কী হত তোর? এদিকে ভেবে ভেবে আমাদের রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ! প্রমথ হতভম্ব হয়ে চেয়ার থেকে ঠ্যাং নামিয়ে সোজা হন। কোথায় দেখা হল? কীভাবে দেখা হল? অমি কি কাল সন্ধ্যার পর বেরিয়েছিল?
একটু চুপ করে থাকার পর সুলোচনা বলেন, গিয়ে দেখি ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। প্রথমে অতটা লক্ষ্য করিনি, টলুই বলল, দেখ মা, ডনের ঘরে আলো জ্বালাল কে? তখন উঠে গেলুম। গিয়ে দেখি, চুপচাপ শুয়ে কাঁদছে! আমাকে দেখে কান্না লুকোবার চেষ্টা করল। তো আমি জিজ্ঞেস করলুম, জেঠুর কাছে চাবি এনেছিস নাকি? বেশ করেছিস। আজ থেকে এ ঘরেই শো। পুব—দক্ষিণ খোলা। বিছানাটাও ভালো। আরামে ঘুমোতে পারবি। তখন হতচ্ছাড়ী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, জেঠিমা, ডন মোহনপুরে এসেছে।
সুলোচনা আরও গলা চেপে ফিসফিস করে বলেন, কাল বিকেলে কোথায় ঝেণ্টু ছোকরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ঝেণ্টু ওকে জানায় ব্যাপারটা। ডনের পায়ে ব্যান্ডেজ আছে। এই অবস্থায় কার ট্রাকে চলে এসেছে।
বিরক্ত প্রমথ বলেন, আহা! আছে কোথায় সে?
পাশের গ্রামে, কী যেন হাঁড়িভাঙা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। হাড়িভাঙা। সে তো চাষাভুষোর গ্রাম।
ডন ওখানে কার বাড়িতে আছে। কিন্তু হারামজাদি মেয়ে আমাদের তো বলবি। না বলে কখন রাতে চুপিচুপি বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। আমরা কেউ টের পাইনি। ঝেণ্টু ওকে নিয়ে গেছে সেখানে। ডনের সঙ্গে দেখা করে কখন বাড়ি ঢুকেছে, তাও আমরা এতটুকু টের পাইনি। কেন? এই লুকোচুরির দরকারটা কী ছিল, অ্যাঁ? আমরা আজ পর হয়ে গেলুম রাতারাতি? বলো তুমি, কী মানে হয় এর?
সুলোচনা আবেগ চাপতে পারলেন না। সাবধানে চুপি চুপি কেঁদে ফেললেন। প্রমথ বললেন, সত্যি বড় অদ্ভুত ব্যাপার অমির। তাছাড়া, ও ওভাবে মুসহর ছোকরার কথা বিশ্বাস করে গেলই বা কোন আক্কেলে? ছোকরা তো একের নম্বর মাস্তান। লম্পটের হদ্দ। স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
কান্না জড়ানো স্বরে সুলোচনা বলেন, যদি কথাটা মিথ্যা হত? যদি ওই গুন্ডার সঙ্গে অমন করে গিয়ে বিপদেই পড়তিস! একে তো তোর ওই মারাত্মক রোগ। সেই কোথায় ক্যানেলের ধারে ধারে এতখানি পথ গেছে গুন্ডাটার সঙ্গে। ভাবতে আমার গা কাঁপছে!
তুমি বকলে না? কী বলছে ও?
পা ছুঁয়ে কান্নাকাটি করল। হঠাৎ ডনের খবর পেয়ে মাথার নাকি ঠিক ছিল না। তাছাড়া ডন নাকি আমাদের কানে তুলতে নিষেধ করেছিল।
ডন নিষেধ করেছিল? অসম্ভব। সে জানে না, আমাদের মনের অবস্থাটা কী? ভীষণ মিথ্যাবাদী মেয়ে।
কে জানে! তাই তো বলল। তুমি বরং ওর কাছে পুরো ব্যাপারটা জেনে নাও। আমি তো শুনে থরথর করে খালি কেঁপেছি। মানে, অমির কাণ্ড শুনে। কী সাহস, কী সাহস! ছি, ছি! তুই এডুকেটেড মেয়ে, তোর বাবা জ্যাঠার মান—সম্মান আছে দেশে। দৈবাৎ যদি পুলিশের পাল্লায় পড়তিস, তাহলে কী হত? ছি ছি ছি! ছিঃ!
প্রমথ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকার পর বলেন, এতে অবশ্য আমি অবাক হচ্ছিনে। তুমিই বা কেন অবাক হচ্ছ, ভেবেই পাইনে। ও কি তোমার টলু, না বুলু, না ইলু—মিলু? ও তো বরাবরই ওইরকম! একাদোকা যেখানে খুশি যখন খুশি ঘুরে বেড়ায়। বুধনী বহরীর কাছেই শুনেছি, ওর মেয়ের সঙ্গে অমির ভাব ছিল নাকি। রেলইয়ার্ডের দিকটায় ঘুরে বেড়াত। কিন্তু ডন…ডনটা এ কী করল?
প্রমথ বিচলিতভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তারপর একই সুরে বলেন, চা করছে টলু?
তরুণ সংঘের দিকে যেতে যেতে হেমাঙ্গ ঘুরেছিল। এ এমন একটা সময়, ভালো লাগবার নয়। আরও একা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সে বাজার এড়িয়ে উলটো দিকে ঘুরে হাইওয়েতে পৌঁছেছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে প্রসাদজীর ইট ও টালিভাটা ছাড়িয়ে কাঠগোলার কাছাকাছি যেতেই দেখল, গুলাই হোটেলওয়ালা আসছে।
গুলাইয়ের কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। পায়ে হেঁটে কোত্থেকে আসছে সে? হেমাঙ্গ বলে, কী গুলাইদা, কেমন আছো?
গুলাই তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছে। কাঠখোট্টা শুকনো শরীর। তামাটে রঙ। ওর দাঁতগুলো দেখার মতো, সুন্দর সরু সরু দাঁত, নিখুঁত ঠোঁট। হাসলে লোকটাকে অমায়িক দেখায়। পরনে ঢোল খাঁকি পাতলুন, হাতগুটোনো সাদা শার্ট, পায়ে এবড়োখেবড়ো চপ্পল। ঠুনঠুন শব্দ হয়।
গুলাইকে ছেলেবেলা থেকে একই রকম দেখছে হেমাঙ্গ। সেই পাতলা লালচে চুল, মাঝখানে সিঁথি। রোগাটে গড়ন। চোখের তারা পিঙ্গল। সচরাচর এমন চোখ যাদের তারা নাকি ধূর্ত হয়। গুলাইকেও অন্তত একটা কারণে ধূর্ত বলা যায়। হোটেলের আড়ালে তার নাকি চেলাই মদ, গাঁজা আফিং চরসের কারবার আছে। মজার ব্যাপার, ওর হোটেলের নাম ‘শুকতারা’। কে এমন দারুণ নামটা রেখেছে, জানতে ইচ্ছে করেছে হেমাঙ্গের। জিগ্যেসই করা হয় না।
গুলাই বলে, হেমাংবাবু যে! বেড়াতে বেরিয়েছেন?
হুঁ। তুমি কোত্থেকে আসছ এভাবে?
গাঁয়ে গিয়েছিলুম। মাছ বলতে। গুলাই পকেট থেকে চারমিনার বের করে বলে, খান হেমাংবাবু। গরিবের সিগারেট।
অগত্যা হেমাঙ্গ একটা সিগারেট নেয়। গুলাই দেশলাই যত্ন করে জ্বেলে দিয়ে ফের বলে, মাছ সাপ্লাই নিয়ে যা প্রোবলেম হচ্ছে! রেগুলার সাপ্লাই দ্যায় না। কাঁহাতক আর ঝামেলা করি। এদিকে টাকাও দিচ্ছি অ্যাডভান্স। শেষ আরেক জায়গা গিয়েছিলুম। দেখা যাক।
ডেলি কত মাছ লাগে গুলাইদা? হেমাঙ্গ এমনি জানতে চায়।
গুলাই বলে, গড়ে ডেলি বারো কিলো এখন লাগে। পুজোর আগে থেকে এটা বাড়ে। ষোলো, কোনোদিন কুড়ি অব্দি। মার্চ অব্দি এমন। ফেলাকচুয়েট করে, হেমাংবাবু।
ফ্লাকচুয়েট করার কারণ কী?
লোক সমাগম যখন যেমন। খরার সময়টা মোহনপুরে লোক আসে কম। তবে বছরে বছরে লোক আসা বাড়ছে। আমার নেহাত ছোট্ট হোটেল। দশ জন একসঙ্গে ঢুকলেই টেকল করা কঠিন।
আচ্ছা গুলাইদা, হুলো কোথায়? তাকে তো অনেক দিন দেখছিনে।
ওর নাম আর করবেন না হেমাংবাবু। হাড়ে বাতাস খাচ্ছি এখন। গুলাই তেতো মুখে বলে।
একটা ট্রাক চলে যায় ধুলো উড়িয়ে। সুজনে সরে ঘাসে গিয়ে দাঁড়ায়। হেমাঙ্গ বলে, পালিয়েছে তাহলে?
কে জানে! ওর খবর আমি রাখিনে। নেহাত মায়া বসেছিল, রহমান সাহেব মারা যাওয়ার পর ছোঁড়াটা এখানে ওখানে কাটায় দেখে কষ্ট বাজল মনে। এক বর্ষার রাত খুব বৃষ্টি হচ্ছে। কী খেয়াল হল, জানলা খুলে টর্চ জ্বাললুম। তার মধ্যে দেখি জানলার নীচে কুঁকড়ে শুয়ে আছে একহাত জায়গায়। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগছে, ডেকে ঘরে ঢোকালুম। গুলাই ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে দূরের আকাশ দেখতে থাকে।
হেমাঙ্গ বলে, চলি গুলাইদা!
আচ্ছা! হোটেলে মাঝে মাঝে যাবেন দয়া করে।
আন্ডা—পরোটা খাওয়াবে তো? আর কাবাব!
গুলাই হাসে। সে আর বলতে? নতুন বাবুর্চি এনেছি শোনেননি!
হেমাঙ্গ পা বাড়ায়। ডাবু, লালু আর সে গোপনে ‘শুকতারায়’ ঢুকে কাবাব খেয়ে আসত। দেখতে দেখতে কত বছর কেটে গেল। সব চোখের ওপর স্পষ্ট হয়ে ভাসে। লালু জামসেদপুরে যাওয়ার পর হেমাঙ্গ অন্য কাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। সে আঁতকে উঠেছে। মুসলমানের হোটেলে গিয়ে খাওয়ার কথা মোহনপুরে দশ বছর আগেও ভাবা যেত না। আজকাল প্রকাশ্যে খায় অনেকে। এমনকী, দুপুরের দিকে স্কুল—কলেজের মেয়েরাও কাবাব খেয়ে আসে। শুকতারার সাইনবোর্ডে লেখা আছে : নো বিফ। সামান্য দূরে রঞ্জিতলাল জৈন অস্থায়ী সিনেমা হল বানিয়েছিলেন, টিনের শেড। ইটের দেয়ালে মসলা ছিল কাঁচা। অর্থাৎ কাদার। হঠাৎ গত বর্ষায় নাইটশো চলার সময় আচমকা দেয়াল ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। জনা কুড়ি সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে। অজস্র জখম হয়। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বেশিরভাগই আশেপাশের গ্রামের লোক।
তবে মার্চ নাগাদ রঞ্জিতজী সব সামলে নিয়েছিলেন। পুরোদস্তুর কংক্রিট কাঠামো উঠছে সিনেমা হলের। সামনে পুজোয় ওপেনিং।
বিচিত্র তামাশা! হেমাঙ্গের দুঃখ হচ্ছে, হুলোটা গুলাইয়ের বশমতো চললে রাজা হয়ে যেত। ডনই তো তার মাথাটা খেয়েছে। ডন যেন এই উঠতি শহরটাকে ইম্মরাল করে বেড়াচ্ছে। জগদীশ যা শুরু করেছিল, ডন তা শেষ করে আনছিল প্রায়। এখন ডন বেপাত্তা। কিন্তু তার সঙ্গীরা তো আছে।
হেমাঙ্গ কাঠগোলা ছাড়িয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছল। একটা ব্রিজে বসে সূর্যাস্ত দেখতে থাকল।