ছয়
তারপর কদিন ধরে মোহনপুরে ডনের ব্যাপারটা নিয়ে চাপা তুলকালাম চলতে থাকে। অসংখ্য গুজব ছড়ায়। প্রয়াত দেশনেতা নলিনাক্ষের ভাইপো এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যিনি ইদানীং সুগার মিল স্থাপনের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছেন—তিনিই নাকি ডনকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে কলকাতার নার্সিংহোমে রেখেছেন। এর সত্যি মিথ্যে জানা কঠিন। বোসবাড়ি মুখে কুলুপ এঁটেছে। প্রমথ অভ্যাসমতো বাজারে আসেন। কিন্তু হাঁড়িপানা মুখ দেখে কেউ কথা তোলার ভরসা পায় না।
বোসবাড়ি সার্চ করার ব্যাপারটাও হয়তো গুজব। মোহনপুরে পুলিশের তেমন কোনো সন্দেহজনক গতিবধি কারও চোখে পড়ছে না।
তারপর দেখা গেল মুসহরদের ঝেণ্টু তার প্রচুর আয়না ও বাতি—বসানো সুদৃশ্য সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হরসুন্দরের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। ইদ্রিসও এল কয়েকটা দিন পরে। নলিনাক্ষের আবক্ষ মূর্তির গোল রেলিংঘেরা দ্বীপে বিকেলের তাসের আসর ফের জমিয়ে তুলল।
শুধু হুলো ছোঁড়াটার পাত্তা নেই।
গুলাই হোটেলওয়ালা মাঝে মাঝে একে—ওকে জিজ্ঞেস করে মাত্র। কেউ জানে না। ঝেণ্টু বা ইদ্রিসরাও না। ওরা রসিকতা করে বলে—বাপমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।
এদিকে হেমাঙ্গ একে ভীতু, তার মুনাপিসির হঠাৎ পরাক্রম বেড়ে গিয়েছিল। সে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলেছিল—ঘর ছেড়ে বেরুলে তোর একদিন কী আমার। ফিরে এসে আমার মরামুখ দেখবি।
ডাবু ফিরে গিয়েই চিঠি দিয়েছে। যেখানে—যেখানে যেতে বলে গিয়েছিল, হেমাঙ্গ ইতিমধ্যে গেছে কিনা তারই তাগিদ। হেমাঙ্গকে বেরুতে দিলে তো? বেশিরভাগ সময় তার শুয়ে কাটছে। বেরুলে বড় জোর খালের ধার ও রেল ইয়ার্ডের সীমানা অব্দি, তারপর শংকরার আখড়া। অদ্ভুত ব্যাপার, শংকরাও কয়েকটা দিন বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে মুনাপিসিকে পটিয়ে ভাত খেয়ে গেছে। যেই না ডনের কথা তুলেছে, মুনাপিসি বঁটি দেখিয়ে বলল—সাবধান! শংকরা কী বুঝল কে জানে। হাসতে হাসতে বলল—আচ্ছা, আচ্ছা!
বেশ কয়েকটা দিন হেমাঙ্গ এভাবেই আইন—মানা নিরীহ মানুষের মতো কাটাল। তারপর এক বিকেলে অভ্যাসমতো খালের ধার ও রেলইয়াডের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে শংকরার আখড়ায় গেল। শংকরা নেই। হেমাঙ্গ চুপচাপ আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। বেদীর ওপর মড়ার খুলিটা দেখছে। ওটা কি সত্যি জগদীশের—নাকি শংকরা গুল দিয়েছে? রোদ কমতে কমতে বেলাটা ধূসর হয়ে উঠেছিল। সেই ধূসরতার মধ্যে হেমাঙ্গ খুলিটার দিকে তাকিয়ে জগদীশকে কল্পনা করছিল।
তারপর সে টের পায়, রাগে দুঃখে তার ভেতরটা গরম হয়ে গেছে। একটা নচ্ছার গুণ্ডা ডাকুর প্রেমে পড়েছিল অমির মতো মেয়ে—এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে। বুধনী বহরী কি সত্যি কথা বলছিল? এই খুলিটা জগার না হতেও পারে। শংকরাকে অবিশ্বাস করা সোজা। কিন্তু বুধনীকে কোন যুক্তিতে অবিশ্বাস করবে সে?
হেমাঙ্গ সিদ্ধান্ত নেয়, সোজা অমিকে চার্জ করবে। ব্যাপারটা ফোঁড়ার মতো গজিয়ে গেছে মগজে। ফোঁড়াটা টনটন করছে। সে নিজেকে খুব অসহায় টের পায়। নিজের অস্তিত্বেরই অপরাংশ নিজের বেবশে হয়ে থাকে, সে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। অমি তার সেই অপরাংশকে গ্রাস করে আছে। এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। অমির হাত থেকে মুক্তি না পেলে জীবনে কিছু করতে পারবে না সে।
অমির কাছে সে শুধু জানতে চাইবে—ব্যাপারটা সত্যি, না মিথ্যে। অমি যদি বলে—সত্যি তাহলে তো ভালোই বরং। মিথ্যে বললেই মুশকিল। অনেক জিনিস মাথায় একবার ঢুকে গেলে বের করে দেওয়া যায় না। সারাজীবন মাংসের ভেতর চোট খেয়ে ফাটল ধরা হাড়ের মতো ব্যথা থেকে যায়। কেন বুধনীর কাছে হটকারিতায় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে গিয়েছিল সে?
তবে একটা বিশ্বাস তার আছে—অমি সম্ভবত মিথ্যা বলবে না। অমি একরোখা মরিয়া স্বভাবের মেয়ে। সে কাকেও ভয় করে চলে না। অতি স্পষ্টভাষিণী, দুর্বিনীতা। ডনের জোরে তার জোর নয়, তার নিজের অনেক জোর আছে। হেমাঙ্গ দেখে আসছে আজীবন।
মনের ছন্নছাড়া তিতিবিরক্ত অবস্থার ঘোরে হঠাৎ হেমাঙ্গ এগিয়ে গিয়ে খুলিটাকে লাথি মেরে বেদি থেকে ফেলে দেয়। তারপরও তার ঝোঁক থাকে না। ফুটবল খেলার মতো কিক করে—করে শ্মশানবটের তলার আগাছার মধ্যে দিয়ে খালের ধারে নিয়ে যায়। তারপর শেষ আলতো কিকে গোলে বল ঢোকানোর ভঙ্গিতে জলে ফেলে দেয়। টবাং করে শব্দ হয় খালের জলে। তারপর খুলির ফুটোয় জল ঢুকে বজবজ করে বুজকুড়ি তুলতে তুলতে ওটা ডুবে যায়।
কতক্ষণ বুজকুড়ি ওঠে তার পরও। হেমাঙ্গ দাঁড়িয়ে—দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর ঘোরে। টের পায় চৈত্রের দিন শেষের জোরালো হাওয়া তার গায়ের ঘাম শুকোতে পারছে না। গেঞ্জি চবচব করছে। সে কাঁপা হাতে সিগারেট বের করে ধরায়। তারপর হনহন করে এগিয়ে যায় সামনের বাঁজা—ভাঙ্গাটার দিকে। ওখানেই নন্দীরা বোনমিল করতে চেয়েছিলেন। কালেকটারির সেরেস্তায় ওটা খাস জমি। কেয়া ফণিমনসা শেয়াকুল কাঁটার ঝোপঝাড়ে ঢাকা কচ্ছপের খোলের মতো কয়েক একর মাটি। একটা বাজপড়া ন্যাড়া তালগাছ মধ্যিখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে এখন শেষবেলার লালচে জ্যোতি ফুটেছে। ওপাশটায় রুক্ষু চটান জুড়ে একচিলতে ঘাসও গজায় না। বৃষ্টির দিনে গয়লাদের গোরুর পাল ওখানে দাঁড়িয়ে মুখ নীচু করে ভেজে। হেমাঙ্গ দেখেছে।
এখন সেখানটায় জনমানুষ নেই। কিন্তু অনেক সময় হাড়—কুড়োনো কোনো মুসহর বা সাঁওতাল কাঁধে ভার এবং দুধারে ঝুলন্ত ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হাতে থাকে একটা ছড়ির মতো জিনিস। ওই দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে হাড় কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখে। কোঙা ঝোপের ওপর সাপের খোলস দেখা যায়। কারণ ওপাশের আবাদি মাঠ থেকে শীতের ধান কুড়িয়ে এনে রাজ্যের ইঁদুর এখানে গর্তে সঞ্চয় করে। ঝোপের গোড়ায় ঝুরোঝুরো মাটির স্তূপ। সাপের উৎপাত স্বাভাবিক। আবার ইঁদুরের ধান লুঠতে মানুষও কম তৎপর নয়। গর্তের আশেপাশে কুপিয়ে রেখেছে। ঢ্যামনা সাপ পেলে মজাই। ভাত এবং মাংসের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
হেমাঙ্গ সাবধানে পা ফেলে হাঁটছিল। চটানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে পশ্চিমের দিগন্ত দেখতে তার ভালোই লাগে। প্রসারিত মাঠে গোধূলিও দেখার মতো জিনিস।
হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারে না।
চটানের শেষ দিকটায় পাতলা খয়েরি ঘাসের আস্তরণ, সেখানে অমি বসে আছে একা। মুখটা পশ্চিমে ঘুরে আছে। মুহূর্তে হেমাঙ্গের মনে ঝড় উঠল। জগদীশের ব্যাপারটা একেবারে ভুলে গেল। তার মাথার ভেতর দিকে একটা নড়াচড়া চলতে থাকল। সে উত্তেজনায় আবেগে চঞ্চল হয়ে ডাকে, অমি!
অমির চমকে ওঠার কথা। কিন্তু চমকায় না। ঘুরে দেখে একটু হাসে। কেমন পাগলাটে হাসি যেন। হেমাঙ্গ একটু অস্বস্তিত্বে পড়ে। মাথার গোলমাল হয়ে যায়নি তো অমির? এভাবে এমন জায়গায় সন্ধ্যাবেলা একা এসে বসে আছে কেন ও? রেলইয়ার্ডে তার ঘোরাঘুরি দেখলে অবাক লাগত না। কিন্তু এখানে সে কেন?
বিচলিত হেমাঙ্গ লম্বা পায়ে ওর কাছে এগিয়ে যায় এবং চঞ্চল চোখে চারদিকটা দেখে নিতেও ভোলে না। গিয়ে সামনে ধূপ করে বসে সে বলে, কী ব্যাপার? তুমি এখানে কী করছ?
অমির যে হাসিটা পাগলাটে মনে হয়েছিল, কাছে বসে হেমাঙ্গ দেখল, সেটা অমির স্বাভাবিক হাসি। তাতে রুগণতার ছাপ আছে।
এমনি! এখানে?
বাড়িতে ভালো লাগে না। তাই চলে এলুম।
হেমাঙ্গ কী বলবে ভেবে পায় না। একটু পরে বলে, তোমার শরীর কেমন এখন?
এই তো দেখছ! দারুণ ভালো আছি!
এভাবে আসাটা উচিত হয়নি কিন্তু। হঠাৎ মাথা ঘুরে…
অমি বাধা দিয়ে বলে, উঁহু, ঘুরবে না।
হেমাঙ্গ হাসে। তুমি বরাবর একগুঁয়ে! যাক গে, অনেক জিজ্ঞাসা আছে। কদিন থেকে তোমাদের বাড়ি যাবার কথা ভাবছি। সময়ই পাচ্ছি না। ডাবুটা রাজ্যের কাজ চাপিয়ে গেছে, জানো তো?
অমি মাথা দোলায়। উঁহু! ভয়ে যাওনি। কাজেই থাকো, আর অজুহাত দেখিয়ো না।
হেমাঙ্গ ধাক্কা খেয়ে অগত্যা শুকনো এবং জোরালো হাসি দিয়ে সামলাবার চেষ্টা করে। তারপর বলে, আমার কীসের ভয়? যাক গে। ডনের খবর বলো!
একথায় অমির মুখের ভাব বদলে যায়। তাকে গম্ভীর দেখায়। সে মুখ নীচু করে শুকনো ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে—ডনের খবর কেউ আমাকে দেখায়নি। খবর আমি জানতেও চাইনি কারুর কাছে। ও মরুক। তুমি অন্য কথা বলো হেমাদা।
হেমাঙ্গ পা দুটো কিছু ছড়িয়ে বাঁহাত ঘাসে ভর করে একটু চিতিয়ে বসে। অমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আলোর ধূসর রঙটা ক্রমশ কালচে হয়ে উঠেছে। ওর মুখের খাঁজে অন্ধকার জমেছে। ঠোঁট শুকনো দেখাচ্ছে। চুলটা আলগোছে বাঁধা, বিস্রস্ত খোঁপা ডান কাঁধে ভর দিয়ে আছে। অমি এবার মুখ সামান্য ঘোরালেই খোঁপাটা ভেঙে ঝরঝর করে চুলের ধারা গড়িয়ে পড়বে শুকনো ঘাসে। হেমাঙ্গের দৃষ্টি পড়ল তার গলার নীচে বুকের ওপর অংশে। কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়েছে। অসাবধানে বুকের একপাশ থেকে শাড়ি সরে গেছে এবং হেমাঙ্গের মনে হল, অমি তার শরীরের তুলনায় স্তনবতী, এটা তার অনেক আগে লক্ষ্য করা উচিত ছিল।
অমি চোখের কোনা দিয়ে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে হেমাঙ্গর দৃষ্টিটা কোথায় আটকে আছে। কিন্তু সে শাড়িটা ঠিকঠাক করে নেয় না। বলে, কিছু বলছ না যে?
কী বলব? বরং তুমি বলো।
যাঃ! আমার কথা বলতে ইচ্ছেই করে না আজকাল। শুনতে ইচ্ছে করে।
তাই বুঝি? হেমাঙ্গ হাসে। কিন্তু কী শোনাতে পারি আমি? নিশ্চয় রূপকথা শুনতে চাইছ না!
যা কিছু। রূপকথা, ভূতের গল্প, কিংবা…. কিংবা ন্যাকামি।
ন্যাকামি? তার মানে?
হ্যাঁ। সেই যে একসময় ন্যাকা—ন্যাকা গলায় বলার চেষ্টা করতে। ভালোবাসা—টাসা কীসব যেন?
হেমাঙ্গের গলা একটু কেঁপে যায়। আমার মুখে ভালোবাসা—টাসা শুনলে তো তোমার খারাপ লাগবে অমি। লাগবে না? কারণ, তুমি তো জানোই ন্যাকা—নাকা কথায় ভালোবাসা—টাসা না বলে কেউ কেউ জোরালোভাবে বলতেও পারে।
পারে বইকি।
হেমাঙ্গ দুম করে বলে ওঠে, যেমন জগদীশ।
অমি দ্রুত মুখ তোলে। তার দিকে তীব্রদৃষ্টে তাকায়। নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়। সে বলে, জগদীশ?
হ্যাঁ। জগদীশ। বলেই প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয় হেমাঙ্গ। কারণ সঙ্গে সঙ্গে তার নিজেরই খারাপ লেগেছে। এই সুন্দর অবস্থাটা ঘুলিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। অমিকে অনেকদিন পরে এমন একটা জায়গায় এমন একটা উল্লেখযোগ্য সময়ে মুখোমুখি পাওয়া এক বহুমূল্য জিনিস। সাপ না মরে এবং লাঠিও না ভাঙে, এমন কৌশলে সে চলতে চায়। ফের বলে সিরিয়াসলি নিয়ো না তাই বলে। জাস্ট এ জোক।
অমি হিসহিস করে বলে, জগদীশের কথা কে তোমাকে বলল?
অগত্যা হেমাঙ্গ বলে দেয়, বুধনী বহরীর ব্যাপার তো জানো! যখনই বাগে পাবে, ওর মেয়ে সৈকার কথা শুনিয়ে ছাড়বে। বুড়িই সেদিন বলছিল, কবে যেন জগদীশের সঙ্গে তুমি রেলইয়ার্ডে ঘোরাঘুরি করতে! সৈকার কাছে শোনা কথা অবশ্য। থাক। ওকথা ছাড়ো।
অমি ভারী একটা নিশ্বাস ফেলে। যেন নিজের উত্তেজনা সামলে নেয়। তারপর একটু হাসে। অমি ভূতে পাওয়া রুগি। সাবধান কিন্তু। হঠাৎ ভূতটা এসে গেলেই মুশকিলে পড়ে যাবে।
হেমাঙ্গ অবস্থা আরও হালকা করতে চেয়ে বলে কিছু মুশকিল নয়। আমি বরং তোমার ভৌতিক ক্রিয়াকলাপ দেখে খুব আনন্দ পাব।
যদি গলা টিপে ধরি?
অমি সত্যি সত্যি হাত দুটো বাড়ালে গা শিরশির করে ওঠে। কিন্তু সে মাথাটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলে, বেশ তো। ধরবে! এখনই ধরতে পারো!
অমির বাড়ানো দুটো হাত সে নিজের গলার কাছে টেনেও নেয়। অমি আগে বালা পরত। আজকাল পরে না। শূন্য হাত দুটো রুগণ এবং ক্ষীণ মনে করে বলে, তোমার ভীষণ সাহস হয়েছে আজকাল। দেখে ভালো লাগছে। নাও, এখন কী গল্প শোনাবে, শোনাও। আমাকে তুমি খালি বকাচ্ছ। কথা বললে হাঁফ ধরে যায়!
হেমাঙ্গ হাত দুটো ছাড়ে না। দুই ঊরুর মধ্যিখানে রেখে খেলা করতে তাকে হাত দুটো নিয়ে। এবং তার মধ্যে হঠকারী আবেগের জোয়ার আবার ফিরে এসেছে বুঝতে পারে! সে প্রেমিকের গলায় বলে, তোমার জন্যে সত্যি আমার বড্ড কষ্ট হয় অমি। বিশ্বাস করো! না—তোমার এই অসুখের জন্যেই শুধু নয়, অন্য কারণে। ধরো, স্মৃতি কিংবা সংসর্গ। কতকাল…কতকাল এভাবে কাটাচ্ছি আমরা! কতকাল খালি আত্মনিগ্রহ! নিজের বোকামি আর ভীরুতার সঙ্গে রাতের পর রাত লড়াই! তোমাকে যদি বুকের ভেতরটা দেখাতে পারতুম, অবাক হয়ে যেতে।
অমি অস্ফুটস্বরে বলে, যাঃ! এসব কী কথা?
মুশকিল হয়েছে কী জানো? তোমার ওপর যেন আমার একটা প্রচণ্ড অধিকারবোধ জন্মে গেছে কবে। কিছুতেই ভাবতে পারিনে তুমি আমার কেউ নও। এ যেন প্রপার্টির অধিকার। কিংবা … কিংবা… হেমাঙ্গ কথা হাতড়িয়ে ফের বলতে থাকে, তুমি আমার একটা নিজস্ব ঘরের মতো। তোমার মধ্যে আমার বসতে শুতে বিশ্রাম নিতে ঘুমোতে ইচ্ছে করে। তুমি কেন এসব বোঝো না, ভেবে দুঃখ হয়। রাগ হয়! নাকি ইচ্ছে করেই তুমি আমাকে আঘাত দিতে চাও!
এবার হঠকারিতায় হেমাঙ্গ তাকে আকর্ষণ করে। সন্ধ্যার আবছায়ায় অমির মুখের ভাব স্পষ্ট নয়। কিন্তু সে অবশ যেন। হেমাঙ্গ তাকে নিজের দুই ঊরুর ওপর স্থাপন করে। অমি মুখ চিতিয়ে চুপচাপ আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে থাকে। তারপর শ্বাসপ্রশ্বাস জড়ানো স্বরে বলে—আমাকে তুমি বাঁচাতে পারবে?
হেমাঙ্গ মুখ নামিয়ে তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলে—কেন? কী হয়েছে তোমার অমি?
কে জানে! বোঝাতে পারব না। খালি মনে হয় কেউ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
হেমাঙ্গ আদর করতে থাকে তাকে। তার গলার নীচে, গ্রীবায়, বুকের মাংসে হেমাঙ্গের আবেগপ্রবণ ঠোঁট ঘুরে ঘুরে খুনসুটি করে। অমির শরীর চুপচাপ আদর খায়। প্রথম নক্ষত্রের আলোয় তার চোখ দুটো বুজে থাকতে দেখে হেমাঙ্গ। তারপর আস্তে আস্তে অমির শরীরে কী এক জাগরণ শুরু হয়। সে হেমাঙ্গের ঠোঁট কামড়ে ধরে। শ্বাস—প্রশ্বাসের মধ্যে বলে, হয় তুমি আমায় বাঁচাও, নয়তো মেরে ফেলো। আমার অসহ্য লাগছে।
তারপর হেমাঙ্গ টের পায় অমির শরীর জুড়ে ছটফটানি চলেছে। সৈকার ভূতটা এসে পড়ল ভেবে সে ঈষৎ আতঙ্কে ও দ্বিধায় অমিকে দুহাতে ধরে রাখে এবং আবছা অন্ধকারে তার চোখের দৃষ্টির সেই অলৌকিকতা খোঁজে। আর অমির দুই হাত ততক্ষণে তার পিঠে চলে গেছে এবং হিংস্রতায় জামা ছিঁড়ে ফেলার মতো নখের আঁচড় কাটছে সে। প্রচণ্ড শারীরিক উদ্দীপনার মধ্যে হেমাঙ্গের যেন মনে হয়, এ অমি কিছুতেই আজীবন দেখা সেই অমি নয়। এ বুধি মুসহর যুবতী সৈকাই! সৈকা তাকে নখের আঁচড়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। তার ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে চেটে নিচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে ফিস—ফিস করে জড়ানো কীসব এলোমেলো কথাও বলছে।
হেমাঙ্গ ইতস্তত করছিল। হয়তো শেষ মুহূর্তে কী করে বসত বলা যায় না। সে স্বভাবভীরু। কিন্তু অমির শরীর থেকে অশরীরী সৈকা তার দুটো হাত টেনে নিজের দিকে নিয়ে গেল। এরপর যা কিছু ঘটল, তা শরীরে—শরীর উত্তর—প্রত্যুত্তর। অজস্র শারীরিক কথা উচ্চারিত হল শরীরেরই স্পন্দনে। অমির শরীরবাসিনী সশরীরী সৈকার প্রচণ্ড কামনার ঝড়ে অসহায় হেমাঙ্গ উড়ে চলল ছেঁড়া পাতার মতো।
কিছুক্ষণ পরে অমি নিস্পন্দ হয়ে যায়। হেমাঙ্গ ডাকে, অমি! অমি!
উঁ?
ওঠ।
উঁহু। আর একটু থাকো।
এই সময় খালের দিকে শেয়াল ডাকল। দৈবাৎ বেঁচে থাকা কোনো নিঃসঙ্গ শেয়ালই বা। আজকাল মোহনপুরে শেয়ালের ডাক শোনাই যায় না। এ যেন অলীক কোনো ডাক—প্রকৃতিতে কতকাল আগের প্রতিধ্বনি! হেমাঙ্গ বলে, এই অমি! প্লীজ ওঠ। কেউ এসে পড়তে পারে!
এখানে কেউ আসবে না।
হেমাঙ্গ দুহাতে ওকে ওঠায়। অমি কি হাসছে? অন্ধকারে সে বিশৃঙ্খল শাড়ি ও জামা ঠিকঠাক করে নেয়। চুল বাঁধে। হেমাঙ্গ সতর্ক চোখে চারপাশটা দেখছিল। বলে, চলো। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
অমির ওঠার ইচ্ছে নেই। সে হেমাঙ্গের উঁচু হয়ে থাকা ঊরুতে হেলান দিয়ে চাপা স্বরে বলে, শেয়াল ডাকল শুনলে? ভারী অদ্ভুত, তাই না?
হ্যাঁ। কেন?
ওটা শেয়াল নয়। শংকরা। আমি জানি।
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, বলো কী!
শংকরা তোমাকে বলেনি কিছু?
না তো। কী বলবে?
ডন জগদীশদাকে মেরে পুঁতে রেখেছিল বলেনি?
হেমাঙ্গ একটু দেরিতে জবাব দেয়, বলেছিল। বিশ্বাস করিনি।
আমাকেও বলেছিল। কিন্তু আমি সবই জানতুম।
জানতে? সত্যি নাকি? বলে হেমাঙ্গ চুপ করে থাকে। অমিও।
এই সময় শ্মশানতলার দিক থেকে শংকরার চেরা গলার গর্জন ভেসে এল— ওং তারাত্তারাত্তারাত্তারাত্তা! ওং ওং!
যেন বাঘ ডাকল। হেমাঙ্গ বলে, এই! আর নয়। আজ ওঠা যাক।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও অমি ওঠার চেষ্টা করে বলে, আমাকে ওঠাও! তারপর সে দুষ্টুমি করে হেমাঙ্গের দুই কাঁতে হাত রেখে বলে, আমাকে বয়ে নিয়ে চলো!
অগত্যা হেমাঙ্গ তাকে দুহাতে বুকের কাছে তুলে হাঁফাতে হাঁফাতে পা বাড়ায়। অমি হালকা। কিন্তু অনভ্যাস হেমাঙ্গের। চটানের শেষপ্রান্তে তাকে নামিয়ে দিলে বলে, বাপস!
শংকরা আবার ঔং নাদ হাঁকছে। অমি হনহন করে চলতে থাকে হঠাৎ। হেমাঙ্গ তার নাগাল পায় না। কাঁচা—রাস্তায় গিয়ে অমির কাঁধ আঁকড়ে সে বলে—আস্তে চলো! তারপর দুজনে ল্যাম্পপোস্টের আলোর সীমানাঅব্দি এভাবেই ঘনিষ্ঠ হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যায়। এখন দুজনেই খুব অন্যমনস্ক।
জীবনে এই প্রথম যৌনতার অভিজ্ঞতা হেমাঙ্গকে কিন্তু একটু ধাক্কাও দেয়নি। অথচ এতকাল ভেবেছে, সেক্স না জানি কী ভয়াবহ ব্যাপারই হবে, কী হৃদয়বিদারক বিস্ফোরণ এবং আলোড়নকারী ঘটনা হবে!
আর তার চেয়ে সাংঘাতিক কিছু অমির সঙ্গে শারীরিক এধরনের সম্পর্ক স্থাপন। হেমাঙ্গের তো গায়ে ত্রাসের শিহরন ঘটে যেত ভাবতে। তার কল্পনা চিড় খেত খানিকটা এগিয়েই।
তবু তো ওর শরীরটা যেন দীর্ঘ সংসর্গে অসচেতন অভ্যাসে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সে তো জানতই, অমির বুকে বা ঊরুতে কোথায় তিল আছে। ওর জন্মদাগ। পাঁচড়া বা ফোঁড়ার স্থায়ী ক্ষতচিহ্নও। চোখ বুজে সে বলতে পারত কোথায় কী আছে।
অবশ্য সত্যি সত্যি সে তত কিছু খুঁটিয়ে দেখেনি অমির বালিকা শরীরকে। অনেকটাই তার ধারণা এবং আরোপিত সিদ্ধান্ত। কেমন করে দেখবে? সে ছিল লাজুক ধরনের ছেলে। কিছুটা অন্তর্মুখী বরাবরই। অথচ ভেতরে—ভেতরে যেন হ্যাংলা। অনেকখানি লোভী।
এসবের ফলেই হয়তো দীর্ঘ সময়—জ্বালা ধরানো, বিরক্তিকর, পিত্তিচটকানো, তেতো অজস্র বছর কাটাতে হয়েছে তাকে। এই হুট করে এসে পড়া আকস্মিকতা তবু কেন যেন তাকে খুব জোরে নাড়া দিতে পারল না। বরং নিজের প্রীত যৌনতার বশে অভিভূত হয়ে রইল স্বাভাবিক ওমে।
সে রাতে তার কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ার উপায় ছিল না। শুধু খাওয়ার পরিমাণ কম হল এই যা। মুনাপিসির তীক্ষ্ন নজর দিব্যি এড়িয়ে যেতে পারল। পরের দিন সকালে অবশ্য মুনাপিসি তাকে চমকে দিয়ে বলেছিল—জামা ছিঁড়লি কীসে রে? হেমাঙ্গ টের পেয়েছিল, তাঁতের ফিকে শ্যাওলারঙা পাঞ্জাবিটা পিঠের দিকে কয়েক জায়গায় ফেড়ে আছে। পুরনো পাঞ্জাবি। সুতোর আঁশ দুর্বল হয়ে গেছে। হেমাঙ্গ বলেছিল, কাঁটাতারের বেড়ায় ছিঁড়েছে তাহলে। রেলইয়ার্ডে সিধে ঢুকতে গিয়েছিলুম। শটকাট করতে গিয়ে।
তবে সারাটা রাত গায়ে অমির গায়ের গন্ধ ছিল। চুলের গন্ধ ছিল। মুনাপিসি শুঁকলে ধরা পড়ে যেত। তারপর মাঝরাতে একবার মনে হয়েছিল, অমিও কি তার মতো এই প্রথম—নাকি জগদীশের সঙ্গে…
পরে মনকে বোঝাল, তাতে কী? সে তো অমিকে বউ করে ঘরে তোলার কথা ভাবছে না। ওই ধরনের সামাজিক এবং গতানুগতিক স্থায়িত্ব এই প্রেমকে সে দেবে কিনা, সে—সিদ্ধান্ত নেয়নি। আগে মাঝে মাঝে যদি বা ভাবত বিয়ের কথা, সে যেন ছিল নেহাৎ একটা চিরাচরিত ইচ্ছার ব্যাপার। তীব্র আগ্রহ থাকলে বিয়ের কি কিছু বাধা ছিল। অমির সঙ্গে জগদীশের গোপন সম্পর্ক যত কিছু থাক, অমির কাছে হেমাঙ্গই তো ছিল চরম আশ্রয়। এর অসংখ্য প্রমাণ সে পেয়ে আসছে।
এইসব সাত পাঁচ ভাবনা তার রাতের ঘুমকে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। বারবার জগদীশ সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল। হেমাঙ্গ তাকে মৃত মানুষ বলে বিকেলে শংকরার বেদি থেকে তার খুলিকে লাথি মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে খালের জলে ফেলে দেওয়ার মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। শেষরাতে ঘুমের করুণা হল। গভীর ও প্রগাঢ় ঘুম তার অন্তরাত্মা কিংবা শরীরের তৃপ্তি থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। টেনে নিয়ে গেল নির্জ্ঞানের অন্ধকারে।
সকালে ছেঁড়া জামা নিয়ে কথা ওঠার কিছুক্ষণ পরে হেমাঙ্গ মুনাপিসির সঙ্গে ডাবুর চিঠি নিয়ে আলোচনা করছে, বাড়িটাকে অবাক করে দিয়ে অমির গলা শোনা যায় বাইরের বারান্দায়।—পিসিমা! পিসিমা!
রীতিমতো জোরালো কণ্ঠস্বর। মুনাপিসি ধরতে পারেনি। কিন্তু হকচকিয়ে গেছে হেমাঙ্গ। সে বলে—কে ডাকছে দেখ তো।
কপাটে ধাক্কা দিচ্ছিল অমি। কেমন নির্লজ্জ লাগে হেমাঙ্গর। মনে তীব্র অস্বস্তি জেগে উঠেছে। তার বুকটা গলা শুনেই ধক করে উঠেছিল। চাপা ধুপধুক চলতে থাকে। মুনাপিসি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হেমাঙ্গের দিকে তাকিয়ে বলে—অমির গলা মনে হচ্ছে না?
হেমাঙ্গ বলে, কে জানে! দেখ না গিয়ে কী বলবে!
মুনাপিসি হেমাঙ্গের ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা খুলে বলে—অমি যে! এসো এসো কী হাল করে ফেলেছ শরীরের! চেনাই যায় না যে!
মুনাপিসির স্বভাব এই। আড়ালে যার সম্পর্কে যাই বলুক, সামনাসামনি আকাশপাতাল খাতির না দেখিয়ে ছাড়বে না। অমির চিবুকে হাত দিয়ে আদর করার উপক্রম করতেই অমি হেঁটমুণ্ড হল এবং পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকাল। পুবের বারান্দায় সকালের টাটকা রোদ পড়েছে। প্রণামের সময় হেমাঙ্গ অমির পাঁজরের হাড়গুলো দেখতে পেল।
কাল সন্ধ্যায় সে বুঝতে পারেনি এই জীর্ণতাটা। হয়তো বোঝবারই মনই ছিল না। হেমাঙ্গ এখন ওর দিকে সোজা নিঃসঙ্কোচে তাকাতেই পারছে না। মুনাপিসি অমিকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে ঢোকায়। তারপর টানতে টানতে ভেতরের বারান্দায় নিয়ে যায়। হেমাঙ্গের দিকে অমি তাকায় না।
উঠোনে নেমে গিয়ে চারপাশে ঘুরে দেখতে দেখতে অমি হাসিমুখে বলে, অনেককাল, আসিনি পিসিমা। সত্যি, আপনি বাড়িটা কী সুন্দর করে রেখেছেন।
মুনাপিসি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সস্নেহে বলে, কেন আসোনি মা? তোমার জন্যে কত ভাবি!
যান, যান! খুব ভাবেন! তাই আমার কীর্তিকলাপ দেখতে যাবারও সময় পাননি।
মুনাপিসি অপ্রস্তুত মুখে বলে, লজ্জা দিসনে অমি। সত্যি যেতে পারিনি। তোদের বাড়ি যাওয়া সবার পক্ষে তো সহজ নয়, মা। তুই নিজেও তো বুঝিস!
হ্যাঁ, সে তো বুঝি। বলে অমি যেন এতক্ষণে হেমাঙ্গকে দেখতে পায়। আরে! হেমাদা যে! কেমন আছো তুমি? আমি তো ভেবেছিলুম, কোথায় চাকরি—বাকরি পেয়ে কেটে পড়েছ।
অভিনয় অথবা ডাহা মিথ্যা চালিয়ে যেতে কোনো কোনো সময় মন্দ লাগে না। তাছাড়া হেমাঙ্গ ততক্ষণে খুশি হয়ে উঠেছে। সে একটু হেসে বলে, পাগল! আমার মুনাপিসির চাকরি ছেড়ে যাব? এমন সুখের চাকরি দেবে কে?
মুনাপিসি হাসতে হাসতে বলে, অমি! কাছে এসো। গল্প করি। তারপর সে অমিকে কেন যেন খুব খাতির দেখতে দেয়ালের কাছে রাখা চেয়ারটা সরিয়ে আনে। ফের বলে, এখানে বোসো।
অমি উঠোন থেকে প্রায় ছুটোছুটি করে এসে মুনাপিসিকেই বসিয়ে দেয় চেয়ারটাতে। তারপর তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে বলে, কদিন থেকে শরীরটা ভালো আছে। খালি ভাবছি, আপনাদের বাড়ি গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসি। আবার ভাবছি, কে জানে কীভাবে নেবেন!
মুনাপিসি বলে, কেন রে মেয়ে?
ডনের জন্যে মোহনপুরে সব্বাই কেমন যেন আনইজি ফিল করে বোসবাড়ির মেয়েদের দেখলে। জানেন না?… বলে অমি খিলখিল করে হাসে।
মুনাপিসি এবার ভীতু চোখ তুলে গলা চেপে বলে, হ্যাঁ অমি, ডনের কীসব গণ্ডগোল হয়েছে শুনেছিলাম। কী ব্যাপার বলো তো?
অতি তাচ্ছিল্য করে বলে, আদাড় গাঁয়ের শেয়াল রাজা গিয়েছিল কলকাতায় মস্তানি করতে। পায়ে গুলি লেগেছিল নাকি। তারপর হসপিটালে নিয়ে যায় পুলিশ। এই অব্দি আমি জানি।
তারপর, তারপর?
তারপর আর কিছু জানিনে। না, আর একটুও শুনেছি। হসপিটাল থেকে নাকি নিখোঁজ হয়ে গেছে। আন্ডার অ্যারেস্ট ছিল। পুলিশ এসেছিল। এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মুনাপিসি চাঞ্চল্য চেপে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তাহলে তো তোমার বড্ড কষ্টে যাচ্ছে, মেয়ে! এদিকে নিজের এই অসুখ, ওদিকে ভাইটার ওই অবস্থা। খুব স্যাড ব্যাপার।
অমি হাসে। আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমিও ভাবি না। জ্যাঠামশাই জেঠিমাও ভাবেন না। বোস ফ্যামিলি গ্ল্যাডলি কাটাচ্ছে। হ্যাঁ গো পিসিমা, ওটা সেই জবাগাছটা না? হেমাদা কাটোয়া না বহরমপুর থেকে এনে দিয়েছিল যেন! জানেন? ভুতুবাবু একটা নার্শারি করেছে। যাবেন আমার সঙ্গে? কী সুন্দর না করেছে পুরো এরিয়াটা! কত রকম গাছ, কত অদ্ভুত অদ্ভুত সব ফুল!
অমির একটা জোরালো পরিবর্তন টের পাচ্ছিল হেমাঙ্গ। ততক্ষণে সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে এবং জানলার পর্দাটা একটু ফাঁক করে তাকিয়ে আছে। কান পেতে কথা শুনছে। অমিকে কেন যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না, যদিও মনের কোনায় খুশির একটা হালকা অথচ তীব্র স্রোত বইছে।
মুনাপিসিরও অল্পস্বল্প গাছপালার বাতিক আছে। এই পাড়াটায় কার না আছে? ওইসব নিয়ে কথা বলতে বলতে একসময় দুজনে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটুকরো ম্রিয়মাণ সবজিখেত আছে ওপাশে। প্রায়ই গোরু—ছাগল এসে বেড়া ভেঙে মুড়িয়ে দিয়ে যায়। এদিকটা মোহনপুরের একেবারে শেষ দক্ষিণপ্রান্তে। বাড়ির ওপাশে আগাছার জঙ্গল, পোড়ো জমি আর দু’এক টুকরো বীজধান লাগানো জমির পর ধাপে ধাপে মাঠটা নেমে গেছে দূরের দিকে। সবজিখেতে দাঁড়ালে মনে হয় একেবারে অজ পাড়াগাঁ এদিকটা। অথচ কয়েকপা উলটোদিকে ঘুরলেই রীতিমতো শহর। লাইটপোস্ট, একেলে ধাঁচের ঘর—বাড়ি, ক্রমে বাজার আর ভিড়। রেলকলোনি, সরকারি আপিস, লোকোশেড। সে এক জগাখিচুড়ি ব্যাপার।
হেমাঙ্গ হাই তোলে এবং ফের উঠোনের দিকে বেরোয়। হঠাৎ তার সন্দেহ জাগে, অমি কি কোনো গোপন কথা বলার জন্যে মুনাপিসিকে ফিকির করে ওদিকে ডেকে নিয়ে গেল?
তীব্র আগ্রহ নিয়ে সে উঁচু বারান্দার থামে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। কাল সন্ধ্যায় পিঠে নখের আঁচড় কেটেছিল অমি। এখন আর জ্বালা করছে না। কিন্তু স্নানের সময়টা সাবধানী হতে হবে।
কিন্তু ওদের আর ফেরার নামই নেই। এত কী কথা বলছে? হেমাঙ্গ অস্থির।
কতক্ষণ পরে কথা বলতে বলতে দুটিতে ফিরে আসে! মুনাপিসি বলে, হেমা রে! অমি বলছে, ভুতুবাবুর নার্সারিতে ভালো—ভালো গোলাপ আর বুগানভিলিয়া আছে নাকি। গেটের বুগানভিলিয়াটা তো সেবার সাপের জন্যে কেটে ফেলা হল। ন্যাড়া হয়ে আছে। তুই যাস না বাবা একবার।
অমি বলে, হেমাদা না যায়, আমি এনে দেব পিসিমা। তারপর হেমাঙ্গের দিকে চোখের ঝিলিক ছুড়ে মারে। হেমাঙ্গের বুকের ভেতর বিদ্যুৎ বয়ে যায়।
মুনাপিসি বলে, আয়। আমার কাছে বসবি কিচেনে।
এখনই রান্না চড়াবেন নাকি? অমি ফের হেমাঙ্গের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে। হেমাদার আপিস বুঝি?
মুনাপিসি হাসতে হাসতে বলে, নারে। অনেকদিন পরে এলি, মেয়ে। তোকে কিছু খাইয়ে দিই। ইস! কী করে ফেলেছিস চেহারাখানা! হ্যাঁ রে, বরং জ্যাঠাকে বলে সদরে ভালো কোনো ফিজিশিয়ানকে একবার দেখালি নে কেন?
মুনাপিসির এই স্বভাব। তুমি থেকে তুইয়ে নামতেও দেরি হয় না। অমি বলে, ও হেমাদা! এবার তোমার সঙ্গে গল্প করি। হ্যাঁ গো, তোমার কাছে ডিটেকটিভ উপন্যাস আছে? দাও না!
তারপর সে বারান্দা থেকে বাইরের ঘর অর্থাৎ হেমাঙ্গের ঘরে ঢোকে। মুনাপিসি কিচেনে গিয়ে ঢুকেছে। হেমাঙ্গ বুঝতে পারে, ভদ্রমহিলাকে জল করে দিয়েছে ধূর্ত অমি। সে একটু ইতস্তত করে নিজের ঘরে ফিরে আসে। দেখে, অমি দেয়ালের তাকে রাখা তার ছেলেবেলার একটা ফটোর দিকে তাকিয়ে আছে।
হেমাঙ্গের ঊরু দুটো হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। হাত—পা একটু কাঁপে। আগেও তো অমি এ ঘরে এসেছে, এমন হয়নি তার। দরজায় অবশ্য পর্দা ঝুলছে। অমি তার সাড়া পেয়েও পেছনে ফেরে না। হেমাঙ্গ কাঁপা শরীরে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, কী ব্যাপার?
অমি আলতো হাতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। দৃষ্টি এবং কোঁচকানো ভুরুতে তিরস্কার। মুনাপিসির অবস্থিতি আঁচ করানোর ভঙ্গিতে একটু সরে দাঁড়ায় সে। তারপর হাসে এবং গলা চড়িয়ে বলে, ওটা ডিটেকটিভ উপন্যাস না? হেমাদা, তুমি আর্থার হ্যালির কোনো বই পড়েছ? গোস্বামীদের বাড়ির কৃষ্ণা এসেছে কলকাতা থেকে। রাস্তায় দেখা হল। হাতে একটা ইংরেজি বই। কী ভড়ং জানো? কায়দা করে মেমসায়েবের মতো ইংরিজি বলছিল। আমি মফসসলী মাল!—অমি খিলখিল করে হেসে উঠল।
এত বেশি কথা বলছে কেন অমি? এতকাল পরে কোথায় কোন একটা দরজা হঠাৎ হাট করে খোলা হয়ে গেছে ওর! হেমাঙ্গও গলা চড়িয়ে বলে, কী? আর্থার হ্যালি—না হেলি? তারপর ফের ফিসফিসিয়ে ওঠে, আজ সন্ধ্যায় ওখানে যাবে?
ইস! খুব মজা পেয়ে গেছ!—অমি চাপা গলায় বলে। তারপর দেয়াল আলমারিটার পাল্লা খুলে বই নামাতে শুরু করে। চড়া গলায় বলে, এ তো তোমার পুরনো টেক্সট বুক! এগুলো এখনও যত্ন করে রেখেছ কেন? আমি তো সবই মিলুকে দিয়েছি!
অধীর হেমাঙ্গ ফিসফিসিয়ে ওঠে, সন্ধ্যায় একবার—
অমি দ্রুত মাথা দোলায়। অস্ফুটস্বরে বলে, না।
কেন না?
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অমি কেমন হাসে হঠাৎ। তারপর বইগুলোর দিকে হেঁটমুণ্ডু হয়ে বলে, যাব।
এই সময় হঠাৎ বাইরের জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ পড়ে হেমাঙ্গের। প্রায় ঝাঁপিয়ে যায় সে। পর্দা সরিয়ে বলে ইডিয়ট কোথাকার! মারব এক থাপ্পড়!
ধুপ ধুপ শব্দ করে কেউ পালাল। অমি বলে, নিশ্চয় শংকরা?