অশরীরী ঝড় – ৫

পাঁচ

 মোটমাট তিনটে টাকা খরচ করে হেমাঙ্গ যেন রহস্য সিরিজের একটা বই কিনে ফেলেছে। পড়েছে এবং নেশা ধরে গেছে। মনের মধ্যে সারাক্ষণ ওই রহস্যের ছমছমানি। কিন্তু আতঙ্কও কম নয়।

সকালে বাজারে দেখা গেল প্রমথবাবুর সঙ্গে। কাঁধে হাত রেখে বলেন, কী হে! একদিন দেখা দিয়েই ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে যে? আসছ না কেন? তারপর গলা একটু চেপে জিজ্ঞেস করেন, ডন কিছু বলে—টলেনি তো?

 হেমাঙ্গ অপ্রস্তুত হেসে বলে, না না। ডনের সঙ্গে আমার আর দেখাই হয়নি। অমি কেমন আছে জ্যাঠামশাই?

প্রমথ কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে দু’হাত সামনে চিতিয়ে বলেন, ওর আর কি! হিস্টিরিয়া পেসেন্ট যেমন থাকে! এই ভালো, এই ফিট। ইদানীং আর ফিট ভাঙছে তো জিভ ওপরের তালুতে সেঁটে থাকছিল। খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অবিনাশ একটা ওষুধ দিল। জিভে দিলে চট করে শব্দ হয়। ছেড়ে যায়। তার সঙ্গে আরেক উপসর্গ শুনলুম আজ। মাথার ভেতর জ্বালা করছে বলল।

ভিড় থেকে একটু তফাতে নিয়ে যান হেমাঙ্গকে, ফের বলেন, আমি এক সময় একটু—আধটু হোমিয়োপ্যাথির চর্চা করতুম, বুঝলে? জাস্ট শখ। ফের বইপত্তর বের করে পড়া শুরু করেছি। দেখলুম প্রথম অবস্থায় ইগ্নেশিয়া মোক্ষম। এইমাত্র একডোজ থাউজেন্ড এক্স দিয়ে এসেছি। দেখা যাক। তবে কী জানো, হিস্টিরিয়া স্রেফ মানসিক ব্যাধি।

হেমাঙ্গ বলে, মনে হয়।

মনে হয় না দ্যাটস দা ট্রুথ। প্রমথ জোর দিয়ে বলেন, অনেক দিন ধরে দুঃখকষ্ট চেপে রাখলে এই রোগটা হয়। নিছক মেয়েলি রোগ। অমিকে অবশ্য আমরা বাবা—মার দুঃখ জানতে দিইনি। কিন্তু আফটার অল তাতে কি মন ভরে হে? ভরে না। প্রমথ মাথা দোলান।

হেমাঙ্গ বলে, কিন্তু সৈকার মতো কথা বলছে কেন?

প্রমথ একটু হাসেন। এটা তলিয়ে ভাবলেই বুঝবে। সম্ভবত সৈকার ডেড বডি দেখেছিল। খুব আতঙ্ক হয়েছিল। আতঙ্কটাও চাপা থেকে থেকে এতদিনে এক্সপ্লোড করেছে। তুম তো ভালোই জানো, ইয়ে মানে, দেখেছ তো বটে! ভীষণ চাপা মেয়ে বরাবর। তাই না?

হেমাঙ্গ মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ। তবে কথাও তো বলে প্রচুর। একেবারে চাপা বলা যায় না অমিকে।

প্রমথ মাথা দুলিয়ে বলেন, উঁহু! আমি ডিফার করব। আজ অব্দি মন খুলে কথা বলেছে অমি, এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। জাস্ট মিলু—ইলুদের সঙ্গে কম্পেয়ার কর। তাহলেই বুঝবে। তাছাড়া তুমি হয়তো জানো না, ও প্রায় লুকিয়ে—লুকিয়ে কান্নাকাটি করত ইদানীং। ইলু দেখেছে। ওর জেঠিমা সাধাসাধি করত। ডন বকেছে নাকি! বলত, কাঁদিনি তো। ইলু মিথ্যে বলেছে। অথচ আমি নিজে….

প্রমথ হঠাৎ থেমে যান। তুমি ও—বেলা এসো। বলব সব কথা। এসো কিন্তু!

হেমাঙ্গ ঘাড় নাড়ে। প্রমথ ভিড়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত হন। হেমাঙ্গ কিনতে ঢোকে। মুনাপিসি পোস্ত আনতে বলেছে। নিবারণ মুদির দোকানে যায় সে।

অমি লুকিয়ে কাঁদত কেন? জগদীশের জন্যেই তো! হেমাঙ্গর মনে একটা অসহায় ক্ষোভ গরগর করে উঠেই চাপা পড়ে। অমি তাহলে হেমাঙ্গর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে এসেছে এতকাল। অমিকে তার ঘৃণা করা উচিত।

অথচ ঘৃণা করারও যে শক্তি থাকা দরকার, তা তার নেই। বাড়ি ফেরার পথে মনে শেষ অব্দি নরম সুরে বাজে। বেচারা বোকা মেয়ে! লেখাপড়া শিখলেও অনেকে যেন কিছু প্রিমিটিভ ব্যাপার মন থেকে নষ্ট করতে পারে না। যেমন পারেনি জগদীশ। অমিও পারেনি। মনের মধ্যে যেন একটা অন্ধ বুনো ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে। শিক্ষা সহবত সভ্যতার ওপর লাথি মারতে মারতে সেই ঘোড়া তাকে বিদিশ করে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। খাদে গিয়ে পড়ে কোনো এক সময়। পড়বেই।…

বাড়ি ফিরে হেমাঙ্গ অবাক হয়। হুলো এসে মুনাপিসির সঙ্গে জাঁকিয়ে গল্প করছে। হুলোকে মুনাপিসি ভয়ে একটু বেশি বেশি খাতির করে ফেলে। হুলো একটা কিছু খেয়েছে মনে হচ্ছে। পাশে বাটি পড়ে আছে। মুনাপিসির মুখে হাসি, কিন্তু চাহনিতে অস্বস্তি স্পষ্ট। হেমাঙ্গ বলে, কী রে?

হুলো তাকে দেখে একগাল হেসে বলে, বাজারে ছিলে হেমাদা! আমি কত খুঁজলুম। তারপর চলে এলুম।

হেমাঙ্গ বাজারের থলে মুনাপিসিকে দিয়ে বলে, পোস্ত আমি খাব না কিন্তু।

দেখা যাবে। লাল ঝরলে দেব মুখে জল ছড়িয়ে। বলে মুনাপিসি রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখান থেকে ফের বলে, হুলো কী বলছে শোন না বাবা। কতক্ষণ এসে বসে আছে!

কী বলছিস রে হুলো?

হুলো বলে, সৈকার ভূতের গল্প শোনাচ্ছিলুম হেমাদা। পিসিমা মাইরি ঠকঠক করে কাঁপছিল। দেখবে আজ সন্ধেবেলা আর ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। মুনাপিসি রান্নাঘর থেকে নোড়া তুলে বলে, দাঁত ভেঙে দেব হুলো।

হেমাঙ্গ ডাকে, আয়। কী বলছিস শুনি।

হেমাঙ্গ বাইরের ঘরেই নিয়ে যায় তাকে। মনে তীব্র কৌতূহল। হুলো কী বলতে এসেছে কে জানে। ছেলেটার এই এক ব্যাপার, দূতের কাজও করতে ওস্তাদ। শুধু ছিঁচকেমি এবং হাতসাফাইটা না থাকত ওর! এবং যদি ডনদের সংসর্গ ছেড়ে দিত! এমনিতে খুব বাধ্য অনুগত ছেলে। কাজের ভার দিলে তা না করে ছাড়বে না।

ঘরে ঢুকে হুলো পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বলে, অমিদি দিল। বলল, চুপি চুপি দিবি। আমি চুপি চুপি দিলাম। এবার চলি। টা টা করে দাও।

কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলতে খুলতে হেমাঙ্গ বলে, না। একটু দাঁড়া।

দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় হেমাঙ্গ। তার হাত কাঁপে চিঠিটা পড়তে। ঊরু অবশ হয়ে যায়। অমি জীবনে তাকে একবারও চিঠি লেখেনি। লেখার দরকারই বা কী ছিল! এই তার প্রথম চিঠি। হেমাঙ্গ টের পায়, সে আসলে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।

‘…হেমাদা, আজ বিকেলে একবার আসবে দয়া করে? আমি আমার ঘরে শুয়ে থাকব। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। তুমি বাড়ি ঢুকে বলবে, অমি কেমন আছে এবং সোজা ওপরে চলে আসবে। অসুবিধে হবে না। এসো কিন্তু। প্রণাম নিয়ো।—অমি।’

প্রণাম শব্দটার দিকে হেমাঙ্গ তাকিয়ে থাকে। তারপর হুলো তাকে লক্ষ্য করছে টের পেয়ে চিঠিটা দ্রুত ভাঁজ করে বলে, অমি দিল?

আবার কে দেবে? অমিদির চিঠি না?

হুঁ। ডন কোথায় রে?

ডনদা নেই। রাতের ট্রেনে কলকাতা গেছে।

সত্যি কলকাতা, না অন্য কোথাও?

না গো, কলকাতা! এক শালা পার্টি এসেছিল। নিয়ে গেছে।

একা গেছে?

তাই যায়? ঝেণ্টু গেছে। ইদ্রিস গেছে। মনু গেছে। আরও কে কে যেন গেছে।

কী ব্যাপার রে? খুব জমজমাট কারবার মনে হচ্ছে!

হুলো নির্বিকার মুখে বলে, হুঁউ। কাজ খুব বড়।

তুই গেলিনে যে?

বাইরে আমাকে নিয়ে যায়? আমি যাবই বা কেন?

হুঁ, যাসনে। তা কবে ফিরবে ওরা?

আজ রাতে দশটা ছত্রিশে ফিরতে পারে নয়তো কাল রাত একটার আপে। আমাকে থাকতে বলেছে। থাকব। আমার কী?…হঠাই হুলো দেয়ালের তাকে একটা ছোট্ট হাতুড়ি দেখিয়ে বলে, তখন থেকে দেখছি, আর ভাবছি হেমাদা টিপস পেলে কোথায়। পেলে যদি, ওখানে অমন করে রাখলেই বা কেন?

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, বলিস কি! টিপস মানে?

হাতের আঙুলে রিভলবারের নল বানিয়ে ট্রিগার টেপার ভঙ্গি করে হুলো। এসব সময় সে একেবারে বাচ্চা। হি হি করে হাসে। তারপর বলে, ডনদারটা সাদা চকচকে। এত্তো বড়। ছ’টা গুলি থাকে। চীনে টিপস নাকি। হেমাদা, তুমি একটা টিপস রাখো না কেন গো?

ধুর বোকা! আমি ওসব কী করব?

আজকাল কতজনের কাছে আছে।…হুলো গলা চেপে ফের বলে, ভেল্টুবাবুর বাড়িতে পাইপগান আছে একগাদা। কাউকে বললে আমার গলা কেটে দেবে। যাই!

হেমাঙ্গ ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, শোন একটা কথা। তুই এমন করে যার তার সামনে এসব কথা বলে বেড়াসনে কিন্তু। তোকে ওরা বিশ্বাস করে। যদি টের পায় যে তুই কাকেও বলেছিস এবং তাতে ওরা বিপদে পড়েছে, তোর প্রাণ যাবে। বুঝলি তো?

হুলো হাসে।—মাথা খারাপ হেমাদা? তুমি আর অমিদির কথা আলাদা। তোমরা সাপোট্টার। তোমাদের বললে ক্ষতি নেই। চলি গো হেমাদা!

হুলো ঠিক হুলো বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে চলে যায়। হেমাঙ্গর মাথায় ওর সাপোর্টার শব্দটা কতক্ষণ খোঁচা মারে। হুলো আসেলে ধুরন্ধর। সে হেমাঙ্গকে বুঝতে পেরেছে, কিংবা অমির সঙ্গে হেমাদার সম্পর্ক আছে দেখেই তাকে ডনদের সাপোর্টার ভাবে।

 হেমাঙ্গ আনমনে চিঠিটা আবার খোলে। বিছানায় শুয়ে আবার পড়ে। বারবার পড়ে। ‘দুর্জনের ছলের অভাব হয় না’, কিন্তু দুর্জন কে? নিশ্চয় অমি তাকে দুর্জন বলেনি, বলেছে হয়তো নিজেকেই। তাহলেও দুর্জন শব্দটা ওর মাথায় এল কেন? চিঠির মধ্যে এই লাইনটা আচমকা কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে যেন। অমির স্নায়ুকেন্দ্রে কিছু একটা ঘটেছে। তারই প্রমাণ।

প্রায় আধঘণ্টার বেশি কাটিয়ে দেয় হেমাঙ্গ। এলোমেলো ভেবে মন খারাপের একশেষ করে। তারপর অমির ‘প্রণাম’ তাকে শান্ত করে দেয়। ঘুমপাড়ানি গানের মতো। অমি তাকে কোনোদিন প্রণাম করেনি। অমির মতো মেয়েকে সে প্রণত ভাবতে গিয়ে দৃশ্যটা অবিকল দেখতে পায় এবং গভীর তৃপ্তিতে একটা নিশ্বাস ফেলে। ঝড় থেমে যায়।

বিকেলে হেমাঙ্গ যখন বেরুবে বলে তৈরি হচ্ছে, বাইরে শংকরার গর্জন শোনা গেল। জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে হেমাঙ্গ দেখল, শংকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে কটমট করে। ঠোঁট কাঁপছে। বিড়বিড় করে কিছু বলছে। এ সময় এক আপদ বটে।

হেমাঙ্গ চুপচাপ ভেতরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মুনাপিসিকে ওঠায়। সে তার ঘরে শুয়ে পুরনো বাঁধানো পত্রিকা পড়ছিল। শংকরার নাম শুনে বিরক্ত হলেও শেষ অব্দি পত্রিকা রেখে বেরুল আর হেমাঙ্গ কেটে পড়ল খিড়কি দিয়ে।

ঝোপঝাড় ভেঙে অনেকটা ঘুরে হেমাঙ্গ রাস্তায় পৌঁছয়। তারপর ধীরেসুস্থে হাঁটতে থাকে। অমি তাকে কী বলবে না বলবে তাই নিয়ে আর এতটুকু ভাবে না। উদ্বেগ বোধ করে না। শুধু হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, কথা বলতে বলতে যদি হুট করে সৈকা জেগে উঠে তাকে আবার চড় মারে, তাহলে কী করবে। হুঁ, তৈরি থাকবে সারাক্ষণ। নজর রাখবে অমির চেহারায় কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না। এবং কাছাকাছি বসবে না।

একটু দূর থেকে বোসবাড়ির রোয়াকে প্রমথকে দেখামাত্র তার মনে পড়ে, সকালে বাজারে প্রমথও তাকে আসতে বলেছিলেন। এ একটা মুশকিলের কথা বটে!

প্রমথ গাছপালার ফাঁকে হেমাঙ্গকে দেখতে পেয়ে নড়েচড়ে বসেছেন। হেমাঙ্গ বাগানের গেট খুলে দেখল ইলু আর মিলু ফুলগাছে জল দিচ্ছে। ওদের বাড়ির ঝি—মেয়েটি বালতি করে জল আনছে। হেমাঙ্গকে দেখে দুই বোন হেসে অস্থির। ইলু ইশারায় ওপরের দিকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলে, সাবধান হেমাদা, সৈকা ইজ রেডি। মিলু বলে, ভেবোনা আমরা তোমাকে গার্ড দেব।

প্রমথ নিঃশব্দে হাসছিলেন। একটু সরে বসে রোয়াকে থাপ্পড় মেরে বলেন, এসো হে, বসো।

হেমাঙ্গ প্রায় চোখ বুজে বলে, আসছি জ্যাঠামশাই। অমিকে একবার দেখে আসি আগে।

হ্যাঁ। তাই দেখে এসো বরং। প্রমথ তখুনি অনুমতি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন। আজ অমি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। ইগ্নেশিয়া থাউজেন্ডে কাজ হয়েছে, বুঝলে? তবে মাথা ঘোরা আর মাথার মধ্যে জ্বালা করাটা যাচ্ছে না। দেরি হবে। হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসা লংটার্ম প্রসেস তো। হুঁ, যাও। ঘুরে এসো। ও ওপরে শুয়ে আছে। চুপচাপ শুয়ে থাকতে বলেছি। তুমি যাও। ফিরে এলে দুজনে এখানে বসে চা খাব।

 হেমাঙ্গ ড্রয়িংরুম দিয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। টুলুর ঘরের দরজা বন্ধ। বাড়ি ফাঁকা। সুলোচনা নেই মনে হচ্ছে। হেমাঙ্গ ঝটপট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে। ডন আর ইলুদের ঘরের মাঝের সেই ছোট্ট ঘরের দরজায় অমি তার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি নেই। হেমাঙ্গ হাসলেও সে হাসে না। দরজা ছেড়ে ভেতরে যায়। হেমাঙ্গ ঢুকতে গিয়ে টের পায় সে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে।

বস। বলে অমি জানালার কাছে যায়। মেঝেয় বিছানা পাতা। কোণার দিকে জানালার কপাটে হেলান দিয়ে হাঁটু দুটো ভাঁজ করে সে বসে। দুটো হাত হাঁটু বেড় দিয়ে আঙুলে আঙুল আটকে বলে, সিগ্রেট খেতে পারো। ওই যে অ্যাসট্রে।

এ বাড়ির কর্ত্রী সিগারেটের ছাই দেখলে চটে যান হেমাঙ্গ জানে। কিন্তু সে খুশি হয়, অমি তার জন্যে ডনের সুদৃশ্য অ্যাসট্রেটা এনে রেখেছে দেখে। সে বলে, বুলু চলে গেছে নাকি? কাকেও দেখলাম না নীচে।

অমি জবাব দেয়, জামাইবাবু এসেছিল কাল। নিয়ে গেছে।

তোমার জেঠিমাও তো নেই। টুলুদির ঘর বন্ধ।

মা—মেয়ে মাণিকজোড়ের মতো বেরিয়েছে। রিকশোয় গেল বলে মনে হচ্ছিল। শুয়ে ছিলুম। কানে এল।

খুব দুর্বল বোধ করছ মনে হচ্ছে?

অমি মাথা একটু দোলায়।—বিশ্রী মাথা ঘোরে হঠাৎ। এখন ঘুরছে না।

আমার কথা থাক। তুমি কেমন আছ?

 হেমাঙ্গ সিগারেট ধরায়। একটু হেসে বলে, ভীষণ ভালো। তারপর মুখ নামিয়ে খুব যত্নে ছাই ফেলার চেষ্টা করে অ্যাসট্রেতে।

এই, শোন।

হেমাঙ্গ প্রচণ্ড চমকায় সঙ্গে সঙ্গে। সে রাতে ঠিক এমনি করে ডেকেছিল অমি। তারপর সৈকার আবির্ভাব ঘটেছিল। সে মনে মনে আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হয়ে তাকায়। দেখে অমি কেমন ছলছল নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটোর দৃষ্টিতে কারুণ্য আছে।

অমি বলে, তোমাকে নাকি চড় মেরেছিলুম?

হেমাঙ্গ বলে যাঃ! ও কিছু না।

জেদের ভঙ্গিতে অমি বলে, না। সবাই বলেছে, আমি তোমাকে চড় মেরেছিলুম। আর তুমি পড়ে গিয়েছিলে। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না হেমাদা? আমি তো কিছু জানিনে। আমার … আমার কিচ্ছু…

তাকে হাঁফাতে দেখে হেমাঙ্গ বলে, কেন ও নিয়ে তুমি ভাবছ? খামোকা এক্সাইটেড হচ্ছই বা কেন?

বলো, তুমি ক্ষমা করছ আমাকে?

অমি তার পা ছুঁতে হাত বাড়িয়ে একটু সরে আসে। হেমাঙ্গ তার হাতটা ধরে ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলে, বৎস, সব ক্ষমা করে দিলুম। তারপর সে দেরি না করে হাত ছেড়ে দেয়। হাসে।

অমি হাত সরিয়ে নিয়ে আগের ভঙ্গিতে বসে থাকে। কিছুক্ষণ কথা বলে না। ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবে। হেমাঙ্গ এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝতে পারে, অমির শরীর সত্যি ভীষণ দুর্বল এবং ওর চেহারায় তার ছাপ পড়েছে প্রচণ্ড রকমের। মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। হেমাঙ্গ আস্তে বলে, কেন ডেকেছিলে?

ক্ষমা চাইতে। আমি তো জানি না যে তোমাকে চড় মেরেছিলুম!

হেমাঙ্গ একটু দমে যায়, মনে মনে বলে, ধুর! ওসব কোনো ব্যাপারই না। এর জন্যে নিশ্চয় তুমি প্রচুর মন খারাপ করেছ। একটা কথা বলি, শোন অমি। আমার ধারণা এখন তোমার মনে স্ফূর্তি থাকা দরকার। এসব অসুখে ….

কথা কেড়ে অমি বলে, কীসব অসুখে?

মানে এই হিস্টিরিয়া না কি। জ্যাঠামশাই বলছিলেন। ডাক্তারবাবু বলেছেন।

এবার অমি একটু হাসে।—আমাকে নাকি সৈকার ভূতে ধরেছে! শুনেছ তো?

হুঁ, শুনেছি। ওটা জাস্ট তোমার অসুখের এটা সিম্পটম। সাবকনসাসে সৈকার ব্যাপারটা ঢুকে বসে আছে। তারই কমপ্লেক্স।… হেমাঙ্গ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে এসব কথা বলে।

অমি একটু নড়ে বসে। ঘোরে এদিকে।—আচ্ছা, শোন। আমি নাকি সৈকাদের ভাষায় কথা বলি। তুমি শুনেছ?

হেমাঙ্গ সমস্যায় পড়ে যায়। ভাবে, অমি অন্যের কাছে এটা শুনে নিশ্চয় বিশ্বাস করেনি। সে বললে বিশ্বাস করবে। তার ফলটা আরও খারাপ হতে পারে। তাই ভেবেচিন্তে সে মাথাটা জোরে দোলায়। বলে, নাঃ! তোমাকে নিয়ে ওরা ঠাট্টা—তামাশা করে। তুমি ওদের ভাষা তো জানো না।

অমি জেদ ধরে বলে, আমি ওদের ভাষা জানি। তোমাকে বলিনি কখনো?

না তো। কোনোদিন বলোনি।

আমি সৈকার কাছে শুনে শুনে শিখে নিয়েছিলুম।

তাই বুঝি?… হৈমাঙ্গ সৈকার সঙ্গে তুমি খুব মেলামেশা করতে বুঝি?

অমি মাথা দুলিয়ে বলে, ভীষণ।

বলো কী!

ওকে আমার খুব ভালো লাগত, জানো? খুব সরল মনের মেয়ে, অথচ ইন্টেলিজেন্ট। শার্প। ও যদি মুসহর বস্তিতে না জন্মাত, দেখতে কী হত!

 হেমাঙ্গ তামাশা করে বলে, ফিল্মস্টার তো নিশ্চয় হত। দেখতে খুব সুন্দর ছিল মনে পড়ছে।

অমি চোখ বুজে যেন শারীরিক কিছু অবস্থা সামলে নেয় কয়েক সেকেন্ড। হেমাঙ্গ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকায়। কিন্তু আবার চোখ খোলে অমি। তাকে স্বাভাবিক দেখায়। হেমাঙ্গ বলে, কী? অসুস্থ বোধ করছ নাকি? তাহলে শুয়ে পড়।

নাঃ। হঠাৎ—হঠাৎ মাথাটা ঘুরে ওঠে।

তাহলে শোও।

মাথা নাড়ে অমি।—ভ্যাট। সারাদিন শুয়ে থাকা! ভাল্লাগে না। অথচ হাঁটাচলা করতে গেলেই মাথা ঘোরে। তাছাড়া জানো, মাথার ভেতরটা একেক সময় মনে হয় ফুটবল গ্রাউন্ড হয়ে গেছে।… আবার ম্লান হাসে সে। খালি মনে হয় একটা ফুটবল কিক করে নিয়ে বেড়াচ্ছে কে।

হেমাঙ্গ হেসে বলে, তাও রক্ষে। বাইশ জনের দুটো টিম নয়। রীতিমতো ম্যাচ খেললে কী হত, ভেবেছ?

তুমি ভাবছ মিথ্যে বলছি?

হেমাঙ্গ দ্রুত অবস্থা সামলানোর ভঙ্গিতে বলে, নাঃ জাস্ট এ জোক করলুম।

সত্যি, আমার মাথার মধ্যে একটা গোল জিনিস, অবিকল ফুটবল ছোটাছুটি করে। তার পিছন পিছন ঠিক কোনো প্লেয়ার দৌড়নোর শব্দ। অমি শান্ত দুঃখিত স্বরে বলতে থাকে।… কখনও মনে হয় কী জানো? বলটা মাথা থেকে নেমে গলার কাছে আটকে গেছে। কী বিশ্রী লাগে তখন। তারপর বলটা বুকে নেমে যায়। তখন নিশ্বাস আটকে যায়। পেট ফুলে ওঠে।

তুমি ডাক্তারকে বলেছ এসব কথা?

না। বলে কী হবে? আমি জানি, আর বাঁচব না।

অমি!

অমির চোখ ছলছল করছে। হেমাঙ্গর ইচ্ছে করে মুছিয়ে দেয়। সাহস হয় না। যদি হঠাৎ…। হেমাঙ্গ ফের বলে, কেন বাঁচবে না ভাবছ তুমি? হিস্টিরিয়া একটা সামান্য অসুখ। জ্যাঠামশাই বলছিলেন। এ অসুখ নাকি শতকরা পঁচাত্তরটি মেয়ের আছে। নিছক মানসিক কমপ্লেক্স! এক সময় তো আরও বেশি ছিল। মোহনপুরে নাকি ঘরে ঘরে ছিল। লোকেরা ভাবত ভূত—প্রেত। খুব অত্যাচার করা হত পেসেন্টদের ওপর।

হেমাঙ্গ একটু হেসে চাপা গলায় ফের বলে, জানো? বেশিরভাগ কেসের পিছনে থাকে সাপ্রেসড সেক্স, কিংবা ডিসকনটেন্টেড সেক্স। তোমার কেসটা নিশ্চয় তাই নয়।

সে খিকখিক করে হাসে। হাসতে হাসতে সিগারেট অ্যাসট্রেতে ঘষটে নেভায়। তারপর মুখ তুলে দেখে অমির ঠোঁটের কোণায় হাসি। ওর রুগণ ফ্যাকাসে গালে একটু রক্তের ছোপও এসেছে। মুখ অন্য দিকে ঘোরানো। এই ভঙ্গিটা খুব চেনা হেমাঙ্গর।

তারপর অমি বলে, ভ্যাট! তুমি কি সাইকোলজি পড়তে শুরু করেছ?

এখন না। এক সময় খুব পড়তুম। সেক্স সাইকোলজি দারুণ ইন্টারেস্টিং, জানো?

অমি কপট রাগ দেখিয়ে বলে, আমাকে একা পেয়ে খুব সেক্স শোনাচ্ছ?

হেমাঙ্গ দ্রুত বলে, তোমাকে অসংখ্যবার একা পেয়েছি। শোনাইনি।

অমি স্বাভাবিক হাসে।—এই! একবার বড়দিকে শুনিয়ো না? দেখবে কী হয়।

টুলুদিকে! ওরে বাবা! হেমাঙ্গ আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে।

অমি ফিসফিস করে বলে, বড়দি আজকাল কী করছে জানো? পোস্টমাস্টারের মেয়ে রুবিকে চেনো তো?

অল্প চিনি।

রুবির সঙ্গে খুব ভাব করে নিয়েছে। আজকাল প্রায়ই দেখি…

কথায় বাধা পড়ল। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে। দুজনে ঘুরে তাকায়। ইলু দরজায় উঁকি মেরে বলে, হেমাদা! বাবা বললেন, চা জুড়িয়ে যাচ্ছে। এসো।

অমি চোখ পাকিয়ে বলে, বাবাকে বলগে, হেমাদা এখানে বসে চা খাবে।

হেমাঙ্গ জিভ কেটে বলে, এই! না, না। ছিঃ! ইলু, চল রে। যাচ্ছি।

ইলু চলে গেলে অমি বলে, তুমি বুড়োদের সঙ্গে অত মেশো কেন? এড়িয়ে থাকতে পারো না?

আমি বুড়োদের সঙ্গে মিশি?

হ্যাঁ। বরাবর দেখেছি, যত রাজ্যের বুড়োবুড়ির সঙ্গে তোমার ভাব। আমার ধারণা, তোমার মধ্যে একজন ওল্ডম্যান আছে।

তাই নাকি? হেমাঙ্গ অবাক হবার ভান করে। ফের বলে, মধ্যে কেন, বাইরে অলরেডি চলে এসেছে সে। সেদিন দেখলুম, একটু চুল পেকে আছে।

অমি নিজের চুলে হাত রেখে বলে, সে আমার বেলায়। চিরুনির ফাঁকে সাদা চুল দেখতে পাই। আমি জানি, আমি খুব শিগগির বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। মেয়েরা তো কুড়িতেই বুড়ি। আর আমি এখন পঞ্চাশের কোঠায়। জবুথবু অবস্থা।

 হেমাঙ্গ হাসে—বয়স দ্বিগুণ করাও একটা মারাত্মক রোগ, জানো তো?

ভ্যাট! আমাকে তুমি বরাবর খুকি ভাবো, দেখেছি। কত উপদেশ যে দাও, মাঝে মাঝে মনে পড়ে আর রাগ হয়। হাসি।

সত্যি, আমি ভেবেই পাইনে, কোনো কোনো মেয়ে যৌবনে যোগিনী হয় কেন?

আবার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। তারপর মিলু এসে ঢোকে। হাতে চায়ের কাপ—প্লেট। মেঝেয় হেমাঙ্গর সামনে রেখে বলে, ছোড়দি, তোর দুধটা ঠান্ডা করতে দিয়েছে। এনে দেবে ঘণ্টার মা।

হেমাঙ্গ বলে অমি চা ছেড়ে দিয়েছ নাকি?

অমি বলে, কবে ধরলুম যে ছেড়ে দেব! তুমি খালি আমার সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা করতে পারো। বরাবর। কখনও চা খেতে দেখেছ আমাকে?

হেমাঙ্গ ঘাড় চুলকে কাঁচুমাচু মুখে বলে, ঠিক ঠিক। দেখিনি। তবে একদিন আমাদের বাড়িতে…

সে তোমার মুনাপিসির রিকোয়েস্টে। সত্যি, ভদ্রমহিলা কী যে মানুষ, ভাবা যায় না। হেমাদা, তুমি ভাগ্যবান। মিলু, আজ আমি একটু চা খাব রে।

আর নেই যে! দাঁড়াও, করে আনি।

হেমাঙ্গ বলে, থাক। আর কষ্ট করতে হবে না। এটাই ভাগ করে খাই। একটা কাপ আনো। আমিও তেমন চা ভক্ত নই। জাস্ট খাই এইমাত্র।

অমি বলে, ঠিক আছে! হেমাদারটাই কেড়ে খাই। মিলু, কাপ আন রে। ডনের ঘরে আছে নাকি দ্যাখ।

মিলু ডনের ঘর থেকে কাপ এনে দেয়। খুব দামি কাপ। হেমাঙ্গ কাপটা দেখেছে দেখে অমি বলে, ডন আজকাল আরও শৌখিন হয়েছে, জানো হেমাদা? ঘরখানা কী সাজিয়েছে, দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। ভেতর ভেতর প্রেম—ট্রেম করছে কি না কে জানে!

মিলু বলে, দাঁড়াও ছোড়দি! ডনদা এলে বলে দিচ্ছি।

বলিস না। তোর ডনদা আমাকে কত ভয় পায়, মনে রেখে বলিস।

মিলু চলে যায় হাসতে হাসতে। হেমাঙ্গ আদ্ধেক চা ঢেলে অমিকে দেয়। অমি সত্যি বলেছে, ডন তার দিদিকে ভয় পায়। সামনা—সামনি কোনো কথার প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারে না। এটাই অদ্ভুত যে, যে—মানুষ পরাক্রান্ত খুনি গুণ্ডা, সে তার কোনো কোনো আপনজনের কাছে স্নেহ—প্রত্যাশী এবং ভীতু। অতি বড় খুনিও হাতের রক্ত মুছে সন্তানকে কোলে তুলে নেয়, কিংবা প্রেমিককে আলিঙ্গন করে। মানুষ এত জটিল খেই পাওয়া কঠিন।

হেমাদা! কী ভাবছ?

নাঃ। তোমাদের বাড়িতে কে চা করে বলো তো? বরাবর একই টেস্ট। একই চা।

ডন তোমাকে শাসিয়েছিল। আমিও পালটা তোমাকে শাসিয়েছিলুম।

হঠাৎ কী কথা! হেমাঙ্গ বিব্রত বোধ করে। বলে, ওসব কথা থাক অমি। অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। নষ্ট করো না ক্লাইমেটটা।

অমি গ্রাহ্য করে না। চাপা হেসে বলে, তোমাকেও শাসিয়েছিলুম। তারপর শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা জানলার একপাশে রাখে। জানালার তলাটা মেঝে থেকে মোটে ইঞ্চি তিনেক উঁচু। জোর হাওয়া আসছে। বাইরে বিকেল কখন ফুরিয়ে গেছে। ধূসরতা ঘনিয়েছে। ঘরে অবশ্য দিনের আলোর রেশ রয়েছে। কারণ পশ্চিমে বারান্দার দিকে আকাশটা খোলা। সেদিকে সূর্যাস্তের নীলচে রঙ সারা আকাশ জুড়ে। অমি ফের বলে, আমি দেখতে রোগা কিন্তু আমাকে সবাই ভয় পায়। এখন তো আরও বেশি করে পাচ্ছে। সৈকার ভূতের জন্যে।

হেমাঙ্গ হাসে।—হ্যাঁ, ভূতের কথা বল বরং। জমবে। তবে দোহাই তোমার, আচমকা ভূতটাকে এ আসরে হাজির করে দিয়ো না?

হঠাৎ অমি দু’হাঁটুর ফাঁকে মাথা নামিয়ে দেয়। তারপর ওর পিঠটা কাঁপতে থাকে। চুলগুলো পিঠে ঝুপ করে খুলে পড়ে। বিশাল চুল অমির। হেমাঙ্গর বুক কেঁপে ওঠে। এই রে! সে ডাকে, অমি! অমি!

অমি মুখ তোলে। না, ভূত আসেনি। ভীষণ কান্নার চাপ এসেছে। গাল ভেসে যাচ্ছে। হেমাঙ্গ সাবধানে কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলে, হঠাৎ কী হল অমি? ছেলেমানুষের মতো কান্নাকাটি কেন বল তো?

অমি চাপা কান্নাজড়ানো স্বরে বলে, কেন আমার এমন অসুখ হল হেমাদা? কেন ওরা আমাকে ওসব কথা বলছে?

কী বলছে? বলুক না। তুমি মনে জোর আনো। ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কেন সৈকার মতো কথা বলি? কেন?…অমি আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা দু’হাঁটুর ফাঁকে নামায়।

হেমাঙ্গ পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, প্লীজ অমি, কাঁদে না। দুর্বল হয়ে পড়বে।

পিঠটা ভীষণ কাঁপতে থাকে। তারপর হেমাঙ্গ লক্ষ করে অমি পড়ে যাচ্ছে তার গায়ে। সে কয়েকবার ডাকাডাকি করে। নীচে প্রমথর গলা শোনা যায়, কী হল হেমা? আবার ফিট হয়েছে নাকি?

অমির শরীরটা একটু কুঁকড়ে এবং সিঁটিয়ে গেছে। দু’হাতে তাকে সাহসে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয় হেমাঙ্গ। পা দুটো টেনে সোজা করে দেয়। পায়ের আঙুল বেঁকে আছে। সোজা করা যায় না। হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে রয়েছে। বুকটা কাঁপছে। চোখ বন্ধ। হেমাঙ্গ ডাকে, মিলু! মিলু!

আজ সৈকা বিশেষ জ্বালাল না। জলের ঝাপটা দিলেই হাত পা এবং শরীর বেঁকে যাচ্ছে। মিলু স্মেলিং সল্ট শোঁকাল। ফিট ছাড়ল না। প্রমথ বললেন, থাক। আর শোঁকাসনে। ওকে ছেড়ে আয় সব। হেমা, নীচে যাই চলো। যত ইন্টারেস্ট দেখাবে, আরও বাড়বে।

প্রমথর টানে হেমাঙ্গকে চলে যেতে হল। ও একা ওভাবে পড়ে থাকবে? বুকের ভেতর কান্নার ভাব ঠেলে ওঠে হেমাঙ্গর।

সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে বাজার হয়ে এল হেমাঙ্গ। তখন রাত প্রায় আটটা। অমির ফিট ছাড়ার পর এসেছে। আর ওপরে যায়নি। ইলুর মা এং টুলুকে ফিরতে দেখেছে। রক্ষাকালীর মন্দির থেকে ফুল বেলপাতা এনেছেন। তাই ছোঁয়াতেই নাকি ফিট ছেড়েছে।

 স্টেশনবাজারের চৌমাথায় হরির দোকানে সিগারেট কেনে হেমাঙ্গ। বাকিতে কেনে। তারপর কী ভেবে হরসুন্দরের চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে আসে। ভিতরে হুলো বসে ছিল। তাকে দেখে সে চেঁচিয়ে ডাকে, হেমাদা! হেমাদা!

হেমাঙ্গ দাঁড়ায়। হুলো বেরিয়ে এসে বলে, কোথায় যাচ্ছ?

হুলোর চেহারায় একটু হুলুস্থুল ভাব। ঝড় খাওয়া গাছের মতো। হেমাঙ্গ বলে, কোথাও না। বাড়ি ফিরছি। তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন রে?

হুলো চাপা স্বরে বলে, চলো, যেতে যেতে বলছি। এক্ষুনি ভাবছিলুম তোমার কথা। দেখা না হলে যেতুম।

কেন, কী ব্যাপার?

চলো তো বলছি।

দুজনে বড়পোল পেরিয়ে যায়। কিছুটা যাওয়ার পর বাঁদিকে সরু রাস্তায় মোড় নেয়। দু’ধারে গাছপালা আর টুকরো সবজিখেত, ফুলবাগিচার মধ্যে একটা করে একেলে গড়নের বাড়ি। এ রাস্তায় আলোর থামগুলো খুব দূরে দূরে। আবছা অন্ধকার সারারাস্তা।

হুলো বলে, ডনদাদের ধরেছে। ঝেণ্টু একা পালিয়ে এসেছে। আমাকে বলে গেল, বোসবাড়িতে খবর দিতে। সার্চ—ফার্চ হতেও পারে। তা আমি ভেবেই পাচ্ছিলুম না, কী করব।

হেমাঙ্গ হকচকিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল সঙ্গে সঙ্গে।— বলিস কি!

হ্যাঁ। আমিও ভাবছি, গা ঢাকা দেব। তুমি বোসবাড়িতে খবরটা দাও না গো! আমার ভীষণ ভয় করছে।

হেমাঙ্গ কাঁপা গলায় বলে, তুই একটা বুদ্ধু! ঝেণ্টু কখন খবর দিল তোকে?

এই তো খানিক আগে। ট্রাকে করে এল।

কোথায় ধরেছে ডনকে?

কলকাতায়। পায়ে একটা গুলি করেছিল পুলিশ। তা নইলে ওকে ধরতে পারত না।

আমি যাই হেমাদা। আমার কেমন করছে!

বলেই হুলো প্রায় দৌড়ে যায়। ছেলেটা ছিটগ্রস্ত, তাতে কোনো ভুল নেই। হয়তো ওর জন্যে গুলাই হোটেলওয়ালাও বিপদে পড়বে। হেমাঙ্গ ফের বোসবাড়ির দিকে চলতে থাকে। বোঝা যায়, ডন এবার এতদিনে ক্ষমতার বাইরে গিয়েই বিপদে পড়েছে। এভাবেই তো গুণ্ডাদের পতন ঘটে।

কিন্তু অমির কোনো বিপদ হবে না তো? সে ডনের দিদি।

প্রমথ বারান্দায় আলো নিভিয়ে বসে আছেন। ভারী গলায় বলেন, কে রে?

হেমাঙ্গ বলে, আমি জ্যাঠামশাই।

কী ব্যাপার হে?

হেমাঙ্গ হাঁফাতে—হাঁফাতে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়।