অশরীরী ঝড় – ৪

চার

সেই সন্ধ্যার ব্যাপারটা হেমাঙ্গর মাথার মধ্যিখানে ঢুকে গেছে। ভূত—প্রেতে বিশ্বাস তার এতটুকু ছিল না। তবে অন্ধকারে একলা হলে কল্পিত অশরীরীর স্বাভাবিক আতঙ্ক তাকে চেপে ধরত বটে। কিন্তু সেই কল্পিত অশরীরী যেন বোসবাড়ির শিউলিতলায় শরীরী হয়ে তার গালে চড় মেরেছিল। চোয়ালের ব্যথা যেতে দেরি হয়েছিল। আর বাঁ কান তো ঝিম ধরে থেকেছে পরদিন অব্দি। কিছু শুনতে পাচ্ছিল না।

খাবলা—খাবলা জ্যোৎস্নায় এলিয়ে পড়া চুল আর চোখের নীলচে জ্যোতি, তার সঙ্গে হি হি হি হি হাসি! অলৌকিকের সঙ্গে হেমাঙ্গর সত্যি সত্যি পরিচয় হয়ে গেছে। যখনই দৃশ্যটা মনে পড়ে, গা ছমছম করে হেমাঙ্গর। সূর্য ডুবলে কয়েকটা দিন আর বেরুতেই পারেনি ঘর থেকে।

 সেদিন অমিকে বুধনী বহরীর মেয়ে শিগগির রেহাই দিয়েছিল শঙ্করার ভয়ে। দুপুরে নাকি শংকরার খাওয়ার কথা ছিল বোসবাড়ি। কাজকর্ম ছিল, তাই যেতে পারেনি। ডাবু অমিকে ধরতে গেছে, অমি টিউবওয়েলের পাশে পড়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত। বারান্দায় তোলা হল। বাড়ি চুপ হঠাৎ। হেমাঙ্গ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় শঙ্করার হাঁকডাক শোনা গিয়েছিল সদর দরজায়। প্রথমে বিকট নাদ—ঔং তারাত্তারাত্তারাত্তারা…ঔং ঔং ঔং! সুলোচনার ধমক খেয়ে ঘণ্টার মা দরজা খুলে ছিটকে পাশে দাঁড়িয়েছে আর গুলবাঘের মতো বেঁটে জটাজুটধারী লাল কৌপিন পরা শঙ্করা খ্যাপা ঝাঁপিয়ে পড়েছে উঠোনে। সুলোচনা ব্যস্তসমস্ত হয়ে দেখাচ্ছেন, এলি তো, ঠিক সময়েই এলি বাবা! ওই দ্যাখ মেয়েটার কী অবস্থা হচ্ছে!

শংকরা সেজেগুজেই এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। কৌপিন, গলায় ইয়ামোটা রুদ্রাক্ষের মালা, দড়ির মতো মোটা পৈতে, কপালে কয়লা ঘষে আঁকা ত্রিপুণ্ডক ইত্যাদি। আর এক হাতে ওর ছোট্ট ত্রিশূলটাও ছিল। সেটা অমির মাথায় ঠেকিয়ে দাঁত কড়মড় করে আবার বার তিনেক ঔং হাঁকার পর একটা তাক লাগানো কাজ করল। কেউ লক্ষ করেনি, ওর কোমরের কাছে এক টুকরো হাড় লাল সুতোয় বাঁধা ছিল। পট করে সুতো ছিঁড়ে হাড়টা যেই অমির মুখের কাছে নিয়ে গেছে, অমি নড়ে উঠল এবং তাকাল। জোরে ফোঁস করে নিশ্বাস পড়ল তার। হেমাঙ্গ দেখছিল, পেটটা ফুলে উঠেছিল, এতক্ষণ কাঁপছিল। যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। হাড়ের ম্যাজিকে ফুসফুস স্বাভাবিক হয়ে গেল। তখন শংকরা ফের বারতিনেক ঔং নাদে বাড়ি কাঁপিয়ে এবং বাড়িসুদ্ধ লোককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখে জল চাইল এক ঘটি।

ঘটির জলে কী মন্ত্র পড়ে যেই অমির মুখে ছিটিয়েছে, অমনি অমি ধুড়মুড় করে উঠে বসল। শংকরা হা হা হা হা করে হাসতে লাগল।—অল ক্লিয়ার!

ডাবুরও মুখ বন্ধ, চোখ নিষ্পলক। সুলোচনা তার কানে কানে বলছিলেন, হাড়টা কীসের বুঝলে তো? তখন ডাবু ঘাড় নেড়েছিল। বুঝেছে। সৈকার সেই হাঁটুর হাড়।

 সমস্ত দৃশ্যটা হেমাঙ্গর চোখে যত ভয় জাগানো, তত অশালীন। প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার—স্যাপার কীভাবে যে এখনও এসে ঢুকে পড়ছে, ভাবতেও অবাক লাগে। কিন্তু যা চোখে দেখল, তা উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হেমাঙ্গর তখন ছিল না। মনে হয়েছিল, তাহলে সত্যি সত্যি ভূত আছে!

ডাবুর থাকার কথা ছিল দু—তিনটে দিন। পরের দিনটা কোনোরকমে কাটিয়ে সে জামসেদপুরে চলে গেছে। ভূতের ভয়ে নয়, ব্যাপারটা খারাপ লেগেছে। হেমাঙ্গকে বলে গেছে সে কথা। অমি যেন এতকালের হাসিখুশি গর্বিত উদ্ধত এবং বেপরোয়া বাড়িটাকে মিইয়ে দিয়েছে হঠাৎ। মুখগুলো গম্ভীর। চলাফেরা আড়ষ্ট। ওদিকে প্রমথরা স্বামী স্ত্রী মিলে সারাক্ষণ ফিসফিস কী দুর্বোধ্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর ডন যেন নির্লিপ্ত। আগেও নির্লিপ্ততা দেখা গেছে তার, কিন্তু এতখানি নয়। হঠাৎ আসে, হঠাৎ চলে যায়। বাইরেই খায় বেশি সময়। অনেক রাতে ফিরলে ওপরে তার ঘরে বসে খায়। খাবার ঢাকা থাকে।

অমি যদিও বা হাসিখুশি থাকতে চাইছিল, আবহাওয়া গুমোট দেখে সে ঝিম মেরে গেছে। চুপচাপ ডনের ঘরে শুয়ে থাকে। ডন ফিরলে ইলু—মিলুর ঘরে যায়। ডাবুর সবচেয়ে খারাপ লেগেছে, অমিকে তার জেঠিমা আর ইলুদের খাটে শুতে দেননি। বিলু নাকি শোবে।

দেননি, মানে মুখে বলার ক্ষমতা নেই। প্রকারান্তরে অমির আলাদা শোওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ওপরে ডনের ঘরের পাশে একটা ছোট্ট ঘর আছে, যেটা পরে সাজিয়ে গুজিয়ে সুলোচনার ঠাকুর ঘর করার কথা। সেই ঘরে আপাতত কয়েকটা বাক্স—প্যাঁটরা আছে। ডাবু বলে গেছে, আন্দাজ আট ফুট বাই দশ ফুট। মেঝেয় শুচ্ছে অমি। একা। খুব খারাপ লাগল রে ভাই! আফটার অল মা—বাবা হারা মেয়ে। ভাইটা তো মহা মস্তান। মনের অবস্থা কী হচ্ছে বুঝে দ্যাখ তো। জিগ্যেস করছিলুম, ভয় করে নাকি? ওকে তো জানিস, কী গোঁ ধরা মেয়ে। বলল, কীসের ভয়?…

ডাবু চলে যাওয়ার আগে নিজের কন্ট্রাক্টারির প্ল্যানটা আবার শুনিয়ে ছেড়েছে হেমাঙ্গকে। জুনের মধ্যে এসে পড়বে সে। কয়েকটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেছে হেমাঙ্গকে। হেমাঙ্গ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে যেন। দিনের আলো ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটা গা ছম ছম ভাব তাকে পেয়ে বসে। দিনের আলো ফিরে না আসা অব্দি সেটা কাটতে চায় না। রাতে জৈব তাগিদে বেরুনোর সাহস থাকে না তার। ভাবে, মুনাপিসিকে আগের মতো ডেকে ওঠাবে। কিন্তু লজ্জায় পারে না। এখন সে রীতিমতো আঠাশ বছরের যুবক।

তিন চারদিন পরে অবশ্য এই ছমছমানিটা কেটে যায়। হেমাঙ্গ আগের মতো সন্ধ্যায় স্টেশনের ওভারব্রিজে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। খালের ছোট পোল পেরিয়ে পোড়ো জমি আর আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে বাড়ি ফেরে। বারবার পিছু ফিরে এদিক—ওদিক দেখে নিজে ভোলে না যদিও। একটু শব্দেই চমকে ওঠে। কিন্তু এ তার একটা লড়াই। ভয়ের সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়াই। ভূত থাকা সম্ভব কি না যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। বিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে মাথা ঘামায়। অবিনাশ ডাক্তারের হিস্টিরিয়া সংক্রান্ত মতামত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়। কিন্তু যেমনি শ্মশানতলার ওদিকের মাঠে সূর্যাস্ত হয়, অমনি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে আসা অন্ধকারের সঙ্গে সেই প্রাগৈতিহাসিক অলৌকিক পা বাড়ায় তার দিকে। তখন মনে হয়, বিজ্ঞান কতটুকুই বা জেনেছে এখন অব্দি? থাকলেও তো থাকতে পারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো সত্তা!

এই সময় একদিন মাথায় ঝোঁক চাপে। দুপুরবেলা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘুমোবার চেষ্টা করার পর হেমাঙ্গ হঠাৎ ঝোঁকের বশে সোজা খালের ছোট পোল পেরিয়ে মুসহর বস্তিতে গেল।

বিশাল ঘোড়ানিমের গাছ আছে একটা। তার নীচে বসে এক মুসহর যুবতী কয়লাগুঁড়ো আর গোবর মিশিয়ে গুল বানাচ্ছে। হেমাঙ্গ একটু ইতস্তত করে। এ পাড়ার বদনাম আছে। তাকে এখানে কেউ দেখলে লজ্জায় পড়ে যাবে।

যুবতীটি হেসে বলে, বাবু, আপনি মোক্তারবাবুর ভাতিজা আছেন তো?

ঠিক চিনেছে। হেমাঙ্গ বলে, হ্যাঁ। ইয়ে—বুধনী কোথায় থাকে?

বহরী! উ তো ভিখ মাঙতে গেসলে!…বলে সে মুখ ঘুরিয়ে কিছু দেখে নেয়। ঠারিয়ে বাবু! এ কিসমতিয়া রী! কিসমতিয়া!

একটি ঝোপড়ি থেকে এক কিশোরী উঁকি মেরে সাড়া দেয়—ক্যা গে!

বহরীমোসি আলে রী?

হ্যাঁ। আভি আলে।

মোক্তারবাবুকা ভাতিজা পুছে। বোল রী জেরা, হাঁ!

ছায়ায় দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ দরদর করে ঘামে। জোরালো হাওয়া আছে। আকাশে গনগনে রোদ আছে। সে রুমাল বের করে ঘাম মোছে। সামনে রেলইয়ার্ডে আজ অনেকগুলো ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। একটা এঞ্জিন কোথায় ফুঁসছে, দেখা যায় না। হেমাঙ্গ সিগারেট ধরায়। যুবতীটি কেন কে জানে মুখ টিপে হাসছে আর গুল বানাচ্ছে আপন মনে। হাতের প্রচুর চুড়ি ঝমঝম করে বাজছে সারাক্ষণ। খালের দিকে একপাল শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গায়ে পাঁক। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করছে ওদের। ওটা খেলা।

তারপর বুধনী বহরীকে লাঠি হাতে আসতে দেখল সে।

কাছে এসে বুড়ি বলে, কৌন গে?

এ দেখ না! মোক্তারবাবুর ভাতিজা।

হেমাঙ্গ বলে, এসো মাসি। তোমার কাছে এলাম। কথা আছে।

বুড়ি একটু সোজা হবার চেষ্টা করে ওর মাথা থেকে পা অব্দি দেখে নেয়। তারপর হাসে।—অ, হেমাংবাবু। বামুনদিদির ভাতিজা। মোখতারবাবু বহুত ভদ্দরলোক ছিল। তেরা পিসা।

হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা আছে। হেমাঙ্গ চেঁচিয়ে একটু ঝুঁকে বলে।

বুড়ি কানে শোনে না, এই এক জ্বালা। যুবতীটি হাসতে হাসতে বলে, বাবু খুব আস্তেসে বাত বলুন, শুনবে।

হেমাঙ্গ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে বলে, তোমার সঙ্গে কথা আছে মাসি।

কোথা আছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

হামার সাথে?

হ্যাঁ। ওখানে চল, বলছি।… বলে হেমাঙ্গ পা বাড়ায়।

বুধনী বহরী তাকে অনুসরণ করে। পিছনে যুবতীটি হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বুধনী নির্বিকার। কিছুটা এগিয়ে খালের ধারে উঁচু গাছের জটলা। রেললাইন অব্দি ছায়া পড়েছে। কয়লাগুঁড়ো পাথরকুচি ভরা মাটির ওপর ঘাস গজিয়েছে। সেই ছায়ায় রেললাইনের ওপর হেমাঙ্গ বসতে গেলে বুড়ি হাত নেড়ে বারণ করে। তাই হেমাঙ্গ সরে এসে ঘাসেই বসে। বুড়ি হাঁটু দুমড়ে সামনে বসে—দু’পায়ের ফাঁকে লাঠিটা।

হেমাঙ্গ বুঝতে পেরেছে, গলার স্বর কতটা খাদে নামালে বুড়ি শুনতে পাবে। সে বলে, তোমার মেয়ের কথা শুনতে চাই, মাসি।

ক্যাঁ?

তোমার মেয়ে সৈকার কথা।

 সৈকিয়া?

হ্যাঁ মাসি।

কাহে? কেন?

 হেমাঙ্গ একটু অপ্রস্তুত হয়। বুড়ি ঘোলাটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গলার হাড়টা নড়ছে। হেমাঙ্গ পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে। বুড়ি টাকার দিকে তাকায়। তারপর ফের হেমাঙ্গর দিকে তাকিয়ে থাকে। হেমাঙ্গ বলে, নাও মাসি। তুমি আমাকে তোমার সৈকার কথা বলো।

এবার বুড়ি টাকাটা কাঁপা কাঁপা হাতে নেয়। দুমড়ে ধরে থাকে এবং কেঁদে ফেলে। তারপর চোখ মুছে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় হেমাঙ্গর দিকে। হেমাঙ্গ বলে, বলো মাসি!

বুড়ি ধরা গলায় এবার সৈকার কথা শুরু করে। ওর কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা না গেলেও হেমাঙ্গর অসুবিধে হয় না বুঝতে। ক্রমশ বুড়ি অনর্গল ও দ্রুত কথা বলে চলে। মুহুর্মুহু ওর মুখের ভঙ্গি বদলে যায়, কখনও উত্তেজিত, কখনও করুণ, কখনও মৃদু হাসি ফোটে এবং কখনও রাগে খেপে অশ্লীল গাল দিয়ে বসে।

হ্যাঁ, হেমাঙ্গ শুনেছিল, বুধনী বহরী সৈকার কাহিনী বলতে ঠিক এরকমই নাকি করে। সে নিজে কখনও শোনেনি। কিন্তু অনেকে বলেছে বুধনী কী শোনায় ইনিয়ে বিনিয়ে। সৈকার মৃত্যুর পর নাকি যাকে পেত, ধরে ধরে শুনিয়ে ছাড়ত। এখনও ভিক্ষেয় গিয়ে লোককে শোনাতে চায়। প্রথম প্রথম সবাই শোনার চেষ্টা করত। এখন নাকি বিরক্ত হয়। বুধনী বিরস মুখে উঠে আসে। রাস্তায় যেতে যেতে গাছকে শুনিয়েও সৈকার কাহিনী বলা অভ্যেস। এ সবই হেমাঙ্গ নানাজনের কাছে শুনেছে। সে নিজের কানে এবং মুখোমুখি এই প্রথম শুনছে।

 সৈকার কাহিনী মানে এক লম্বা চওড়া জীবনবৃত্তান্ত। তার জন্ম, জন্মের সময় কীসব খারাপ—খারাপ নৈসর্গিক ইশারা পাওয়া গিয়েছিল, সৈকার বাবার কীর্তি, এসব থেকে শুরু করে সৈকার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত মস্ত একটা আখ্যায়িকা। অন্য সময় হলে হেমাঙ্গর কান ব্যথা হয়ে যেত। এখন সে খুঁটিয়ে শুনছে এবং প্রশ্নও করছে। বুধনীর অবাক ভাবটা আর নেই। প্রচণ্ড উৎসাহে মহাভারত খুলে ধরেছে।…

…একটা ভুল হয়েছিল বুধনীর, বিষম ভুল। মেয়েকে ঠিক ঠিক বয়সে জামাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু টাকার লোভ বড় লোভ। ওই লোভই খেল বধুনীকে। সে তার সুন্দর মেয়ের দাম বছর বছর হেঁকে বাড়াতে থাকল। মুসহর বস্তিতে তাকে কিনবে কোন বাপের বেটা? ঝেণ্টুর বাবা এসেছিল। ঝেণ্টু ভি নিজে একদিন এসেছিল। বধুনী বলেছিল, দোশো টাকা ঔর উনিশ ভরি চাঁদি দে। দিয়ে সৈকিয়াকে লিয়ে যা। ঝেণ্টু তাতে খুব রাগ দেখাল। বলল, বেটিকে তাহলে দিবি না বুঢ়িয়া? মালুম হচ্ছে কি, কেয়ারা খাটাবি! সেই টাকায় মহল বানাবি? আচ্ছা, আচ্ছা। দেখব, কোন হারামী সৈকার সঙ্গে পীরিত করতে আসে। চাক্কু চালিয়ে কলজে ফেড়ে ফেলব।… তো হেমাংবাবু মরা বেটির নামে কিরিয়া করে বলছি, সে মতলব মাথায় আদপে ছিল না। আরে হারামী লেড়কা! আমি কি তোদের ঝাড় বংশে আছি? তোর বহিনটা রোজ রাতে ওই রেলের কামরার মধ্যে গিয়ে অফসরদের সঙ্গে পীরিত করে। টাকা কামায়। সাজপোশাক করে কত রকম ছো ছো! আরে ছোকড়া! তোর মা কি ছিল? হরি ড্রাইভারজীর সাথে ভেগে ভি গিয়েছিল। তো হামি বুধনী আছি। হামার ধরম আলাদা। মিলিটারি পল্টনলোক বহত ঝামেলা করেছে। লোভ দেখিয়েছে। বুধনী তখন প্রচণ্ড যুবতী। পালিয়ে গিয়ে কাটোয়ায় মাগঙ্গার ধারে এক বছর বাস করে এসেছে। টৌনের সাফাই কাম করেছে সৈকার বাবা! বুধনী ভি করেছে। জাত খোয়াইনি অন্যদের মতো।

… তো সৈকা জওয়ানি হল। কত ছোকরা পিছনে লাগল। সৈকা সব সময় হাতে ঘাস কাটা কাটারি নিয়ে ঘুরেছে। একদিন খরার মাসে দুপুর বেলা ওই খালে নেমে গা ধুচ্ছে। স্টেশনের এক খালাসী রামধন গিয়ে হামলা করেছিল। রামধনের হাত জখম করেছিল সৈকা। সৈকা ধরম জানত। তার কোনো লোভ ছিল না। কত সাদাসিধে থাকত।

…একবার বাজারে কোন বাবু সৈকাকে খারাপ কথা বলেছিল। সৈকা চেঁচিয়ে হুলুস্থুল করে ফেলেছিল। সৈকাকে মনোহারি দোকানের কত বাবু সাবুন হিমানি পাউডারভি দিয়েছে। বলেছে, এমনি দিলুম। লিয়ে যা না রী! সৈকা ঘাড় বাঁকা করে ভুরু কুঁচকে বলেছে, কাহে গে! হ্যাঁ, সৈকা ধরমবাজ ছোকড়ি ছিল।

… তো হেমাংবাবু, তুমি মোক্তারবাবুর ভাতিজা আছ। তোমার পিসিভি খুব ভালো। তুমি ভি ভালো। বহৎ ধরমবাজ। তোমাকে কখনও দেখিনি এ তল্লাটে। সৈকা তোমার খুব নাম করত। আজ তুমি সৈকার বাত পুছ করতে এসেছ, হামার কত ভালো লাগছে বেটা!

বুধনী হু হু করে কাঁদে। সূর্য চলেছে ততক্ষণে। ছায়া কয়েক জোড়া লাইন পেরিয়ে গেছে। হেমাঙ্গ বলে, হুঁ, তারপর?

বুড়ি চোখ মুছে ফের শুরু করে। কিন্তু গলার স্বর চাপা হয়ে যায়।

…ঝেণ্টুয়ার সাথে ওবেসিবাবুর ভাইপো ডন মুসহর বস্তিতে হামেশা আসে। খারাপ ছোকরা সব। মালগাড়ির মাল লুঠত ওরা। রেলের কোনো কোনো লোকেরও সাট ছিল ওদের সঙ্গে। কোনো কোনো রাত হাঙ্গামা ভি হত। বোমা বন্দুক হাল্লাবাজি। সব কিন্তু ভড়ং। পাহারাদাররা খামোকা গুলি ছুড়ত। হল্লা করত। তো ডনের চোখ পড়েছিল সৈকার দিকে।

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, ডনের? বল কী!

তেরা কিরিয়া বেটা! বুড়ি হাত বাড়িয়ে ওর হাঁটু ছোঁয়।

হেমাঙ্গ বলে, তোমার এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছি না মাসি। ডনকে আমি চিনি।

বুড়ি প্রায় গর্জন করে ওঠে, তোমরা বাবুরা একজাত আছিস। ও তো বলবি, হামি জানি। লেকিন, ওই হারামী কুত্তা হামার সৈকার পিছে লেগেছিল।

বল কি!

হামি আপনা আঁখসে দেখেছে, আগলা টেরেনের কামরার কাছে ডন খাড়া আছে, ঔর সৈকাকে ডাকছে। বুদ্ধ ছোকড়ী আনাড়ি বোকা। হাসছে। হাত ভি নেড়ে দিচ্ছে।

তাহলে বল, সৈকারও মত ছিল।

ক্যা?

মানে, সৈকার ডনের সঙ্গে ভাব ছিল।

বুধনী জোরে মাথা দোলায়। তারপর অশ্লীল গাল দেয় ডনকে। তারপর বলে, ওবেসিবাবুর কাছে নালিশ করতুম। সৈকা মানা করল। বলল, বস্তিমে আগ জ্বালা দেগা। চুপ থাক মা। তো একরোজ ডনের দিদি এল। তখন ওকে সব বাত বললুম। বলল, ঠিক আছে।

হেমাঙ্গ চমকে ওঠে।—ডনের দিদি? কোথায় এল?

এর জবাবে বুড়ি ফিসফিসিয়ে যা জানাল, হেমাঙ্গ শুনে থ। সে ভাবতেও পারেনি। অমির সঙ্গে সৈকার নাকি খুবই ভাব ছিল। অমি প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে এই বস্তিতে আসত ডনকে খোঁজার নাম করে। তারপর সৈকাকে ডেকে নিয়ে যেত তফাতে। কীসব বাত বলত। পরে বুধনীর চাপে সৈকা ব্যাপারটা জানিয়েছিল।

 তো ভাতিজাবাবু, তুই জোগদিশবাবুকে পছানিস কি? হাঁ, বড়া টিশনবাবুর সাড়ু জোগদিশবাবু। জগা গে, জগা। মালুম পড়ছে না?

পড়ছে। মোহনপুর স্টেশনের প্রাক্তন এস এম নীলাম্বরবাবুর শ্যালক জগদীশকে হেমাঙ্গ বেশিরকম চিনত। কলেজ অব্দি একসঙ্গে পড়েছে। ফিজিকাল কালচারের আখড়া খুলেছিল নীলাম্বরবাবুর কোয়ার্টারের পিছনে। পরে নীলাম্বরবাবু রিটায়ার করে এখানেই বাড়ি করেন। জগদীশ কেন কে জানে, ওঁর কাছে থেকে গেল। আখড়াও করল। মুগুর বৈঠক ডন, বারের এক্সারসাইজ, তার সঙ্গে পুরোদমে বক্সিং চলত। ডন থেকে গুরু বলত। ডনের সত্যিকার গুরু জগদীশ। পরে পুলিশের চাপেই নাকি আখড়া ভেঙে যায়। ওয়াগন ব্রেকিং আর ছোটোখাটো রেল ডাকাতির পিছনে জগদীশেরই হাত ছিল। এর পর দেখা গেল জগদীশের নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। সে বেপাত্তা হয়ে গেল। নীলাম্বরবাবুর ফ্যামিলির ওপর জুলুম হল অকথ্য। কিন্তু আশ্চর্য, ডন এবং আরও কয়েকজনের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগল না। দেখা গেল, ডনটা জুটেছে, রাজনীতির এলাকায়। তখন বিধানসভার নির্বাচনী প্রচার চলছিল। হেমাঙ্গর মনে আছে, ডন নেতাদের জিপে ঘুরত সারাদিন। ভোটে তার মুরুব্বি জিতে গিয়েছিল। তারপর ডনের গায়ে হাত দেয় কে! সে নিজেই ওই বয়সে গুরু হয়ে উঠেছিল।

জগদীশের নাম পরে জগা মস্তান হয়ে যায়। মোটামুটি পাস করতে পারার মতো মুখস্থশক্তি ছিল। সেই জগা নাকি স্টেনগান নিয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়ত। একবার ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে তাকে স্টেশনে হামলা করতে দেখেছিল হেমাঙ্গ। দৃশ্যটা এত অবাস্তব লেগেছিল। সেই জগদীশের এ কী চেহারা! গুজব শোনা যেত, অজস্র বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র নাকি জগার কাছে আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় কীভাবে এনেছে। হেমাঙ্গদের সঙ্গে আর তার দেখা হত না বললেই চলে। দেখতে পেলেও হেমাঙ্গ এড়িয়ে যেত। তার জানতে ইচ্ছে করত, সত্যি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জগদীশ কি যোগ দিয়েছিল? না সবটাই হিরো বনবার ফিকির? অবশ্য কথায় কথায় অমি একদিন বলেছিল, জগাদারা কুষ্ঠিয়ার ওদিকে ফাইট করতে গেছে। ডনকে ডেকেছিল। যায়নি। অমিই যেতে দিইনি।

হেমাঙ্গ জানত, অমির এটা স্রেফ মিথ্যে। ডন তার কথা শোনার পাত্র নয়। কিন্তু অমির মুখে জগাদা শুনে কী যে খারাপ লেগেছিল।…

তো জোগদিশবাবুর নামে হুলিয়া হয়েছিল। ই ভি মালুম পড়বে, বেটা?

হেমাঙ্গ মাথা নাড়ে। ভেতরে তীব্র কৌতূহল চনমন করছে। জগদীশের আজ তিন বছর কোনো পাত্তা নেই। তার কথা লোকে ভুলে বসেছে।

বুধনী বহরী এদিক—ওদিক দেখে ফিসফিস করে বলে, জোগদিশবাবু হামাদের বস্তিমে কভি কভি আনাযানা করত। সাঁঝমে, কভি রাতমে। সৈকার মালুম ছিল। বলত, আ রী মা! আভি জোগদিশবাবু আসলো। ঝোণ্টুয়ার সাথে হুঁয়া পর শ্মশানমে বাত করলো। হামি বলত, সাচ বেটি!…হাঁ রী মা! তেরা কিরিয়া। ঠাকুরবাবা কী কিরিয়া।

তারপর একরাতে সৈকা তার মাকে জানায়, ডনবাবুর দিদির সঙ্গে জোগদীশবাবু এইখানে, ঠিক এই খালের ধারে এই জঙ্গলের মধ্যে বসে বাত করছিল। সৈকা পাহারা দিচ্ছিল। তারপর…

বলে বুধনী বহরী হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। অই, অই করে ওঠে! তার মানে, কী কাজ বাকি রেখে এসেছিল। এতক্ষণে মনে পড়ে গেছে। নড়বড় করে সে প্রায় দৌড়য়। চিলচ্যাঁচানি চেঁচিয়ে বলে, আ রী কিসমতিয়া—আ—আ! কিসমতিয়া রী—ই—ই—ই।

বিকেলের রঙ ঘন হয়েছে। হেমাঙ্গ ওঠে! মাথার ভিতরটা ভোঁ ভোঁ করে। বুধনী বহরী তার আধচেনা এবং এড়িয়ে থাকা মোহনপুরের অন্য একটা জীবন টের পাইয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে অমির যেন সম্পর্ক ছিল। অমিকে নতুন এবং একটু কুশ্রী লাগছে। অমিকে কি সে দেবী ভেবেছিল এতকাল? তাও তো নয়! কিন্তু অমি ডনেরই দিদি। হেমাঙ্গ এই সত্যি কথাটা এমন করে ভুলে ছিল কীভাবে?

 হেমাঙ্গ সিগারেট ধরায়। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের দিকে চলে। তারপর সৈকার দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে অমিকে তার ভূতে পাওয়ার কথা। অদ্ভুত ভয়ে কেমন একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। বেলা পড়ে আসছে। আলো যত কমছে, অশরীরী সৈকার যেন আসার সময় হচ্ছে। হেমাঙ্গ সিগন্যাল পোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে নিজের ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে। মনে মনে বলে, ও কিছু না। কিছু না। সব মনের ভুল। অন্ধ বিশ্বাস। ভূত—টুত কিচ্ছু নেই। সায়েন্স যা বলছে, তাই ঠিক। এই রেললাইন বানাবার শক্তিকে বিশ্বাস করব, না সৈকার অপশক্তিকে? সামনের সত্যিটাকে, না আড়ালের অনুমানটাকে?

তারপর হেমাঙ্গ নিজের যুক্তিহীন ছেলেমানুষি টের পেয়ে মনে মনে হাসে।

হেমা রে! অ্যাই হেমা—আ—আ!

বাজখাঁই গলার ডাক শুনে চমকে ডানদিকে, পশ্চিমে ঘোরে হেমাঙ্গ। খালের এ ধারে উঁচু গাছ নেই। শুধু ঝোপঝাড়। তার পারে বটতলার শ্মশান। একটা ঢিবিমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে শংকরা তাকে ডাকছে। দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে। খুব হেসে হেসে ডাকছে ছেলেবেলার মতো।

তাকে ঘুরতে দেখে শংকরা হাত নেড়ে হেসে হেসে ডাকে এখানে আয় রে হেমা! পালিয়ে আয় না শালা! সৈকা ঘাড় মটকে দেবে—হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা…

জটাজুটধারী শংকরা দু’হাতে তালি দিয়ে নেচে নেচে অট্টহাসি হাসে। হেমাঙ্গর মনে হয় এই হাসিটা শিখতে শংকরাকে নিশ্চয়ই অনেক তান্ত্রিকের পিছনে ঘুরতে হয়েছে।

হেমাঙ্গ হন হন করে যে পথে এসেছিল, সেই পথে এগোয়। মুসহর বস্তির ঘোড়ানিমের গাছের পাশটা ঘুরে কাঠের সাঁকো পেরোয়। তারপর খালের ধারে ধারে দক্ষিণে শ্মশানের দিকে হাঁটতে থাকে।

মানুষ কীভাবে নানান ব্যাপার রপ্ত করে ফেলে ভাবা যায় না। দীনেশ নামে তার এক বন্ধু তুখোড় ফাজিল ছেলে ছিল। এখন হাই স্কুলের শিক্ষক। শিক্ষকের যা সব হাবভাব ভঙ্গি, প্রবণতা, চালচলন, সব কত দ্রুত আয়ত্ত করে নিয়েছে। নানান পেশা, নানারকম জীবন। প্রত্যেকটার নিজস্ব আলাদা ব্যাপার আছে। আলাদা চরিত্র আছে। ফলওয়ালার ভাবভঙ্গি কথা বলা একরকম, মুদির অন্যরকম। হেমাঙ্গ মুদি হলে তাকে মুদির ওই বৈশিষ্ট্যগুলো ভূতে পাওয়ার মতোই পেয়ে বসবে। দীনেশ যদি ব্যাঙ্কের কাউন্টারে ক্লার্ক হয়ে যায়, তার ভাবভঙ্গি বদলে তো যাবেই। ঠিক একই নিয়মে শংকরা একরকম ছিল, এখন অন্যরকম। সাধু—সন্ন্যাসীদের পৃথক বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁটিয়ে রপ্ত করে নিয়েছে। কিংবা ওই ভূতে পাওয়ার মতো সেগুলো পেয়ে বসেছে তাকে!

হয়তো এসব চেষ্টা করে শিখতে হয় না। হেমাঙ্গ সন্ন্যাসী হয়ে গেলে আপনা—আপনি শেখা হয়ে যেত সন্ন্যাসীর হাবভাব, বাকভঙ্গি, হাঁটাচলা। কিংবা চিরকালের বাঁধাধরা সন্ন্যাসী—আদল ভূতের মতো তাকে পেয়ে বসত।

 যেমন করে অমিকে পেয়েছে সৈকা। অমি যখনই সৈকা হয়ে যাচ্ছে, আর এতটুকু অমি থাকছে না। হেমাঙ্গর মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে মানুষের ব্যক্তিগত নিজস্বতা বলতে কিচ্ছু নেই। জলের মতো নিরাকার সে? যে পাত্রে ঢালা হয় তাকে সেই পাত্রের আকার ধারণ করে!

দক্ষিণ—পশ্চিমে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া মাঠের ওপর অবেলায় ঘূর্ণি চলেছে আপন মনে। এতদূর থেকে দেখা যায় খড়কুটো উড়ছে, ঘুরছে অনেকটা উঁচুতে। শ্মশানতলার আশপাশটায় ক্ষয়াখর্বুটে ঝোপঝাড় অজস্র। এখনও চাষবাসের সাহস করেনি কেউ এদিকের পোড়ো জমিগুলোতে। একবার নন্দীবাবুরা কোনো মিলের জন্যে কালেক্টারি থেকে লিজ নেবে বলে ব্যস্ত হয়েছিল। পরে ভেস্তে যায়। স্বপ্নে শাসিয়েছিল দেবতারা। তাছাড়া এই বটগাছে নাকি অনেক ব্রহ্মদৈত্যের বাস। রাতদুপুরে তুমুল ঝগড়া বাধালে কোন এক ভৈরববাবাজী নাকি ঔং হাঁক মেরে চুপ করিয়ে দেন। মুনাপিসি হেসে বলেছিল ওরে, এঞ্জিন। ওটা এঞ্জিনের হুইশেল। যুদ্ধের সময় ইউ এস এ মার্কা ইঞ্জিনগুলো যাতায়াত শুরু করল। রাত—বিরেতে ওইরকম স্টিমারের মতো ভোঁ শুনে লোকে ওসব রটিয়েছিল।

শংকরা রিসিভ করার ভঙ্গিতে এসে হেমাঙ্গকে বলে, আগচ্ছ, আগচ্ছ বৎস। তারপর হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা!

তেমনি বেঁটে হয়ে গেছে। তবে গায়ে অতি অল্পমাত্রায় মাংস লেগেছে। গা তেমনি নোংরা। দাড়িতে কখন খাওয়ার এঁটো লেগে আছে। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি পরেছে এখন। হেমাঙ্গ আগে কোমরে ঝুলন্ত সৈকার হাঁটুর হাড়টা খোঁজে। দেখতে পায় না। হাতে ছোট্ট ত্রিশূলটাও নেই। হেমাঙ্গ বলে, সেদিন ওই গোলমালে তোর সঙ্গে কথা বলা হল না। যা কাণ্ড!

শংকরা বলে, আয় বে শালা! তোকে একটু চুমো খাই!

হেমাঙ্গ আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায়।—থাক বাবা! মুখে বললে এই যথেষ্ট!

ভয় পেয়ে গেছে! হেমা ভয় পেয়ে গেছে!… বলে হাসতে হাসতে শংকরা বটতলায় তার ঝোপড়ির দিকে পা বাড়ায়। ঘুরে দেখেও একবার, হেমাঙ্গ আসছে নাকি। আসছে।

এখনই বটতলায় ছমছম করছে অন্ধকারবর্ণ ছায়া। আজকাল আর তত বেশি পাখি নেই। ঘন সবুজ চিকন কচি পাতা ঝকমক করছে বিশাল গাছটা জুড়ে। বসন্ত শেষ হয়ে এল। দূরে কোথাও ক্ষীণ ও নাকিস্বরে যেন একবার কোকিল ডাকল। হেমাঙ্গ জোপড়ির দিকে তাকায়। ছেঁড়া তেরপল, চট, কোঙাপাতা, এসব দিয়ে চাল বানিয়েছে শংকরা। গাছের ডাল আড়াআড়ি পুঁতে চমৎকার দেয়ালের ফ্রেম করেছে, কোঙাপাতা আর ছেঁড়া লেপ তোষকের দেয়াল। ভেতরটা অন্ধকার ঘুপটি। এর মধ্যে থাকে কীভাবে শংকরা? সে ভেবেই পায় না।

ফোঁকরের সামনে একটা অগ্নিকুণ্ড। নিভে আছে হয়তো। একটা মাটির ঢিবির ওপর ত্রিশূলটা পোঁতা। এবং যথারীতি একটা মড়ার মাথা। সিঁদুর চবচব করছে কপালে। ফোঁকরের মধ্যে একটা পেতলের সরা আর কমণ্ডলু।

শংকরা আসন—পিঁড়ি হয়ে বসে বলে, বস বে হেমা, বস। সিগ্রেট দে, টানি।

হেমাঙ্গ একটু তফাতে শুকনো ঘাসে বসে পড়ে। সিগ্রেট দেয়। শংকরা সিগ্রেট নিয়ে হাত বাড়িয়ে ঝোপড়ির দেয়ালে গোঁজা চিমটে তোলে। অগ্নিকুণ্ডে ফুঁ দিয়ে অঙ্গার বের করে এবং চিমটের সাহায্যে সিগ্রেটটা ধরায়। তারপর একটা প্রচণ্ড টান টেনে ধুঁয়ো ছাড়ে। একটুও কাশে না! চোখ নাচিয়ে বলে, পারবি?

হেমাঙ্গ মাথা দোলায়!—না রে! তুই নিশ্চয় ছিলিম টানিস?

হুঁ, হুঁ বাবা। থাম না। তোকেও টানাচ্ছি। আজ লাল্লু মিয়া দারুণ জিনিস দিয়ে গেছে মাইরি!

লাল্লু মিয়া? সে কে রে?

ইঞ্জিনে থাকে। সিটি মারে, উ—উ—উ উক! ভক ভক ভক ভক… শংকরা!

কী রে শালা?

বাড়ির কথা মনে পড়ে না? বাবা মা’র কথা?

শংকরা ওপরে চোখ তুলে বলে ঔং তারাত্তারাত্তারাত্তারা…ঔং ঔং ঔং! তারপর মাথা কাত করে হেমাঙ্গর দিকে তাকিয়ে কেমন হাসে—শুনতে পেলি কিছু?

কী শুনব?

ব্রহ্মাণ্ডের নাভিস্থলে প্রকম্পন উঠল টের পেলিনে? ভূমিকম্প বে, ভূমিকম্প!

অগত্যা হেমাঙ্গ হেসে বলে, হ্যাঁ, মাটি কাঁপছিল বটে।

অমনি শংকরা খুশি।—তোকে ডাকলুম যখন, একটা জিনিস দেখাই।… বলে সিগ্রেটটা ব্যস্তভাবে ঘষে নেভায় সে। জটায় গুঁজে রাখে। তারপর চোখ নাচিয়ে বলে, কাকেও বলিসনে। বললে মারা পড়বি, সাবধান। সে এদিক ওদিক দেখে নেয়। তারপর ফের চাপা গলায় বলে, এই মুণ্ডুটা। দেখছিস?

হ্যাঁ। কোথায় পেলি?

পেয়েছি। মুণ্ডুটা কার জানিস?

কেমন করে জানব? সৈকার নাকি?

হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা হেসে শংকরা চোখে ঝিলিক তুলে বলে, শালা নাবালক রে! মাগি না মিনসে, তাও বোঝে না। কত প্রকাণ্ড দেখছিস না? ব্রহ্মাণ্ডের এক অণ্ড, সহজ কথা নয়।

হেমাঙ্গ কৌতূহলী হয়ে পড়ে। বলে, পুরুষ মানুষের মুণ্ডু? কোথায় পেলি?

তুই আমার পীরিতের নাগর বে! অত বলব না। ইস! এক্ষুনি আমাকে হাতকড়া পরাক!

হেমাঙ্গ চমকে ওঠে তক্ষুনি। বলে, কেন শংকরা? কে তোকে হাতকড়া পরাবে? আহা, বল না বাবা খুলে। এই নে, তোকে ছিলিমের দাম দিচ্ছি।

এক টাকার নোটটার দিকে তাকিয়ে শংকরা বলে, দিলি তো আরেকটা দে। সাগরেদরা আসবে। সবাইকে খাওয়াতে হবে তো? একভরি হবে।

 হেমাঙ্গ পকেট হাতড়ে দু’টাকাই দেয়। সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। দম আটকে যায়, এমন উত্তেজনা কাঁপতে থাকে। সে বলে, বল এবার?

শংকরা ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। চাপা গলায় বলে, জগার। বুঝলি, জগা শালার মুণ্ডু।

হেমাঙ্গ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, ভ্যাট! অসম্ভব!

চো—ওপ শালা! গলা ফেড়ে দেব! শংকরা গর্জায়। তারপর চাপা গলায় বলে, ওখানটার মাটি দেখছিস? ওখানে পুঁতেছিল জগাকে। বুঝলি? ডনরা মেরে পুঁতে রেখেছিল। সাতদিন পরে আমি মুণ্ডুটা তুলে আনলুম। জাগালুম। একটু বোস না, এলি যখন। আঁধার হলেই জগার মুণ্ডু জাগবে দেখবি। জাগ জাগ জাগ জাগর ঘিনা… জাগ জাগ জাগ জাগর ঘিনা…