অশরীরী ঝড় – ৩

তিন

ডনের জ্যাঠা প্রথম মোহনপুর ব্লক আপিসের ওভারশিয়ার ছিলেন। বছর তিনেক আগে রিটায়ার করেছেন। ওভারশিয়ার থাকার, বিশেষ করে পাঁচশালা যোজনার যুগে এবং ব্লক আপিসে অনেক সুযোগ সুবিধে। বুদ্ধিমান যিনি, তিনি সেগুলো সোনার হাঁস করে ফেলতে পারেন জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। প্রথম বোস পারেননি। তাঁর না পারার কারণ ধর্ম বা বিবেকবোধ নয়, অল্পে সুখ। একডজন মুরগির ডিম দিয়েই হাবুল মিয়া ঠিকেদার কত সাঁকো কিংবা ইরিগেশন স্লুইস তৈরির কমপ্লিশন সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিয়েছেন। প্রমথের মতে, এ কি লাখ লাখ টাকার প্রজেক্ট যে হাজার হাজার টাকা ফাঁকাবে হাবুল? বড় জোর দু—চারশোর এদিক—ওদিক। আহা, ওটুকু যদি না করবে, তবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লম্ফঝম্ফের কারণ কী? হাবুলের চেহারার হাল দেখলেই বোঝা যায়।

তথ্যভিজ্ঞ মহল জানে প্রমথবাবুর মতটা ভুলে ভরা। হাবুল মিয়ার চারখানা ট্রাক, তিন রুটে তিনখানা বাস, একখানা পেট্রোল পাম্প ও গ্যারেজ এবং দোতলা প্রাসাদ বানিয়েছেন। এক ছেলে রাজনীতির পাণ্ডা, এক ছেলে ডাক্তারি পড়ে, এক ছেলে সদর কোর্টের জুনিয়র উকিল, এর ওপর প্রচুর ধানি জমির তিনি জোতদার। স্বাধীনতার এই পঁচিশ বছরে এমন কীর্তি।

যাই হোক, প্রমথর ওই অল্পে সুখী হওয়ার মনোভাবই তার চরিত্রের মাপকাঠি। তার ফলে ভীরুতা আজন্ম তাঁর পিছনে ঘোরে। পৈতৃক একতলার মাথায় ভাইপো ডন, যাকে এখনও চোখ বুজে ন্যাংটা দেখতে পান, যখন দোতলা তোলার প্ল্যান নিয়েছিল, প্রমথবাবু কেঁপে সারা। তাঁর স্ত্রী সুলোচনা উলটো প্রকৃতির মহিলা। ডনের একান্ত সমঝদার। বরং দেওরের এই দুর্ধর্ষ পুত্রটি নাকি তাঁর লাই পেয়েই বখে গিয়েছিল।

কিন্তু বখে যাওয়ার মানে যদি একতলাকে দোতলা করার মর্মার্থ হয় এবং একে ওকে হুট করতেই পেটানোর ক্ষমতা হয়, সুলোচনা তা পুরুষত্বের ও বীর্যবত্তার প্রতীক বলে মাথায় ঠেকাতে রাজি। প্রমথ সব সময় ‘এই এল পুলিশ—বাড়িসুদ্ধ ঠেঙাল’ বলে চুপি চুপি স্ত্রীকে শাসালে এইসা ধমক খেতেন যে লেজ তুলে পালাতে হত। বিশেষ করে ভাইপো ডনকে যমের মতো ভয় পান।

তবে শেষ অব্দি ডন দিব্যি মাথা বাঁচিয়ে চলেছে, পুলিশ বোসবাড়ির আনাচে—কানাচে কখনও আসেনি, এর ফলে প্রমথ দোতালার প্ল্যান এস্টিমেট নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং নিজের ওভারশিয়ারি বিদ্যেবুদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন। প্রসাদজীর ইটখোলার ইট, চৌধুরী হার্ডওয়ার স্টোর্সের লোহালক্কড় সিমেন্ট প্রমথ নিজে এনেছিলেন। সবাইকে শুনিয়ে বলতেন, টুলুর মা অ্যাদ্দিনে বাপের পয়সাকড়ির হিস্যেটুকু পেল। তো কী আর করা! বরাবর দোতলার সাধ। মানে ছেলেবেলা থেকে ওপরতলায় মানুষ হয়েছে কি না।

কথাটা মিথ্যে না। সুলোচনার বাবা ছিলেন কলকাতার এক সওদাগরি কোম্পানির কর্মচারী। ভালো মাইনেকড়ি পেতেন। থাকতেন পাঁচতলার ফ্ল্যাটে। এই দূর মফসসলে একতলায় আর গাছতলার মধ্যে সুলোচনার দম নাকি আটকে যেত প্রথম প্রথম। এখানকার শাকসবজি আর ফুল ফলের বাগানে সুলোচনারই সাধ এবং হাতের ছাপ আছে। এর মধ্যে সুলোচনার চরিত্রের পরিচয় মিলবে। পরিবেশকে ইচ্ছেমতো বদলে নিয়ে সুসহ করার ক্ষমতা ওঁর আছে। তাছাড়া তিনি ভূত ও ভগবানে গভীরভাবে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস তাঁকে মনোবল, সাহস এবং পাপ খণ্ডনের পুণ্য জুগিয়েছে। ডনের টাকাকড়িকে তিনি লীলাময় ভগবানেরই দান বলে মনে করেন। নিজের এই লীলাবাদী ভগবান সংক্রান্ত ফিলজফির প্রচার করেন রাবণ ও কংসরাজার গল্পচ্ছলে।

সে রাতে আচমকা অমির ওই নাটুকে অসুস্থতা অর্থাৎ ভূতুড়ে ব্যাপার নিয়ে স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে পুরনো চাপা পড়ে যাওয়া মতান্তর আবার চাগিয়ে উঠেছে।

প্রমথর মতে, অমির হিস্টিরিয়া হয়েছে। সুলোচনার মতে, অমিকে বুধনী বহরীর ছাগলচরানি ও অপঘাতে নিহত মেয়েটার আত্মা এসে ধরেছে।

দু’জনের পুত্রকন্যার সংখ্যা পাঁচ। চার মেয়ে এক ছেলে। বলার দরকার ছিল না যে ছেলেই বয়সে ছোট। বড় মেয়ে টুলু অমিরও দু’বছরের বড়। তার প্রায় পঁচিশ এখন। বিয়ে হয়েছিল বহরমপুরে। তিন বছর আগে বিধবা হয়ে ফিরেছে। ভাগ্যিস ছেলেপুলে হয়নি। মেজ বুলুর বিয়ে হয়েছে নলহাটিতে। জামাই রেলের অফিসার। কোয়ার্টারে থাকে। সেজ মিলু কলেজে পড়ছে এখানেই। পরের বোন ইলু স্কুলের ছাত্রী। ছোটর বয়েস এখন বছর সাতেক। ঢাকের মতো মাথা, ধড়টা কাঠির মতো। ডন তাই ঢাকু বলে ডাকে। বাবা মা ডাকেন জন বা জনি বলে। ডনের সঙ্গে মিলিয়েই যেন বা। ওইটুকু ছেলে এখনই মহা বিচ্ছু। বাগান ঢুঁড়ে কাঠিতে নোংরা নিয়ে এসে পাতে গুঁজে দেবে। তাই খেতে বসলে নজর রাখতে হয়।

ডাবু এসে বরাবর এ বাড়ির আরেক ছেলে হয়ে ওঠে। বোঝার উপায় নেই যে এদের সঙ্গে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক এতটুকু নেই। প্রমথ সুলোচনা ধরে নিয়েছেন ডাবু ওঁদের সেজ জামাই হবে। ডাবুর বাবা—মায়ের সঙ্গে কবে থেকে বলা—কওয়া আছে। ওঁরা রাজি হয়ে বসে আছেন। অপেক্ষা শুধু ডাবুর।

আর একটু অপেক্ষা মিলুর ফাইনাল পরীক্ষার। জামাই গ্রাজুয়েট। মেয়েরও গ্রাজুয়েট হওয়া ভালো না কি?

ডাবু বরাবর এসে বাড়ি জমিয়ে রাখে। বাড়ি নিজে থেকে জমে ওঠার জন্যে তৈরিও বটে। এবার ডাবু এসে যতটা জমিয়ে দিয়েছিল, অমির ভূত তাকে তুঙ্গে তুলে দিয়েছে। অন্যরকম অসুখবিসুখ হলে স্বভাবত সংসার ম্রিয়মাণ করে ফেলে। ভূতে ধরার বেলায় অন্যরকম। তাতে ডাবু এখন উপস্থিত।

এই অবস্থার সঙ্গে প্রমথ ও সুলোচনার জোর তর্কাতর্কি জমে উঠেছে। দিন পাঁচেক হল মেজ বুলুও সপুত্র এসে গেছে বাপের বাড়ি। জামাই আসব আসব হয়ে আছে। এসে নিয়ে যাবে ওদের।

কাজেই বাড়ি ভর্তি লোকজন। হইহল্লা দু’বেলা। টুলুর গান—বাজনার চর্চা আছে। তার ঘরে হারমোনিয়াম, তানপুরা, ডুগিতবলা আছে। অমির ভূতে পাওয়ার রাতে দশটা অব্দি তুমুল গান—বাজনা হয়েছিল। অমিও একখানা রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিল। ওর গলাটা একটু চাপা, ঈষৎ চিড় খাওয়া, কেমন ঘুম ঘুম আচ্ছন্নতা এনে দেয়। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ শুনে ডাবু অনবদ্য ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ভাঙুক না! জ্যাঠামশাই আছেন ভেবো না।

শুনে সবাই এত জোরে হেসে উঠল যে পাশের ঘরে বুলুর ছেলের ঘুম ভেঙে সে কী বিকট কান্না! তা নিয়েও খানিক রসিকতা হল ডাবুর।

এর পরে মধ্যরাতে অমির একক আসর। মুসহরবুলিতে তার ডিলিরিয়াম চলেছে অনর্গল, আর ডাবু প্রথম হকচকানি সামলে নিয়ে চাপা রসিকতার ফোড়ন দিচ্ছে। ডনের মতো গম্ভীর ছেলেও হেসে ফেলছে। প্রমথর উদ্বিগ্ন গলার ধমকেও কাজ হচ্ছে না। সুলোচনাও নিজের ভূতবিশ্বাস থেকে আশকারা দিয়ে বলেছেন, হাসুক, সবাই হাসুক! হারামজাদি অজাত কুজাত ছোটলোকের মেয়ের সাহস! ভদ্রলোকের বাড়ি এসে গলাবাজি করছে! এর পর চাবকাব না?

পরে অবিনাশ ডাক্তার এসে বলেছিলেন, না বোসদা, দিস ইজ দি রাইট কোর্স অফ অ্যাকশান। হিস্টিরিয়ার সময় কক্ষনো ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্রয় দিতে নেই। হাসি—তামাশা করে উড়িয়ে দিতে হয়, যেন ও কিছু না। প্রশ্রয় পেলে আর ছাড়তে চাইবে না। জাস্ট নেগলেক্ট দি পেস্যান্ট।

কিন্তু মনে মনে ভয় পায়নি, এমন কেউ নেই এ বাড়িতে।

পরের দিন ভোরবেলা থেকে সুলোচনার তৎপরতা দেখার মতো। প্রমথর সঙ্গে তর্কাতর্কির ফাঁকে হাড়িভাঙা নামক একটি গ্রামে লোক পাঠিয়েছেন। ওখানে এক ভূতের ওঝা আছে। তার নাম পরিমল হাড়ি অর্থাৎ হাড়ি বংশজাত পরিমল।

আর পাঠিয়েছেন দুলেপাড়ার পল্টু নামে ভৃত্যকে জটাবাবা নামে এক পীরের থানে। সে সেই লোকোশেডের ওদিকে একটা জঙ্গুলে জায়গা। মাদুলি ও জলপড়া আনবে কাসেম ফকিরের কাছ থেকে। এই ফকির পীরস্থানের সেবায়েত। শিশিতে ভূত পুরে উদ্ধারণপুরের ভাগীরথীতে ফেলে আসে সে।

তারপর নিজে গেছেন সুলোচনা ধর্মরাজের মন্দিরে এবং সেখান থেকে সেই শ্মশান বটতলায় শংকরা সাধুর কাছে।

ওই শ্মশানের ধারে খাল চলেছে রেললাইনের সমান্তরালে। তার ঘুরে রেল পেরিয়ে মাঠে নেমেছে। এ আসলে ইরিগেশান ক্যানাল। এতে তাঁর স্বামীরও হাতের স্পর্শ আছে। খালের কাছে এলে সে কথাটা মনে পড়ে যায় এবং চুপিচুপি গর্ব জেগে ওঠে বইকি।

কিন্তু শংকরা ওঁকে দেখে চোখ পাকিয়ে বলেছিল যা, যা! এখন আমি মড়া পোড়াব না।

সুলোচনা হেসে বলেছিলেন, না রে বাবা, না। তোকে মড়া পোড়াতে বলিনি। ও—বেলা একমুঠো খেয়ে আসিস। নেমন্তন্ন করতে এসেছি। বুঝলি?

শংকরা জটা দুলিয়ে হেসে বলেছে, যাব। মাছের মুড়ো খাব। পাঁঠার মুড়ো খাব। সব একসঙ্গে খাব। দেবে তো?

তাই দেব বাবা! যাস কিন্তু!

তা আর বলতে? শংকরা খায় না তো খায় না, অনেক সময় দেখা যায় শুকনো মাটি কড়মড় করে চিবুচ্ছে। আবার কেউ খেতে ডাকলে দু’হাত তুলে ধেই ধেই করে নাচে।

এ শ্মশান কিন্তু মুসহরদের। মাইল পাঁচেক দূরে ভাগীরথী বলে মোহনপুরের সব লাশ সেদিকেই যায়। মুসহররা এক সময় অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। গঙ্গা ভাগীরথী বুঝত না। তাই বটতলাতেই মড়া নিয়ে যেত। প্রথম প্রথম পুঁতে ফেলত। তারপর লোকের আপত্তিতে কাঠ—কুটো কুড়িয়ে পোড়াতে শুরু করেছিল। তারপর দিনে দিনে ওরা প্রায় হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। সামর্থে কুলোলে ভাগীরথীতে নিয়ে যাচ্ছে মড়া। না পারলে অগত্যা এই শ্মশান তো আছেই। বুধনী বহরীর মেয়ে সৈকা এ শ্মশানেই পুড়েছিল। ভালো পোড়েনি। আধপোড়া কিছু হাড়—মাংস কুকুরেরা ছড়িয়ে দিয়েছিল এখানে ওখানে। রেললাইনে নিয়ে গিয়েছিল একটুকরো পা, খাল পেরিয়ে। পরে সেটুকু বুধনী বহরী কুড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানে পুঁতে আসে। তা নিয়ে গুজব ছড়ায়। শংকরা নাকি তুলে খেয়ে ফেলেছে।

খাবেই খাবে। ছেলেটা আগের জন্মে মহাতান্ত্রিক কোনো সাধু ছিল, যে মড়া খেত এবং মড়ার বুকে বসে তপজপ করত। সুলোচনা মনেপ্রাণে এটা বিশ্বাস করেন। তাঁর যুক্তি : তাই যদি না হবে, শংকর তো খাঁটি ভদ্রলোকের ছেলে, কুলীন বামুন ঘরে জন্ম, তার মাথায় জটা গজাবে কেন, কেনই বা ছেলেবেলা থেকে সাধুদের পিছনে লোটাকম্বল বয়ে ঘুরে বেড়াবে তীর্থে তীর্থে? শংকরা ডনের দাদা লালু আর হেমাদের ক্লাসফ্রেন্ডও ছিল স্কুলে। সেই ছেলে ক্লাস নাইনে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ওর বাবা ছিলেন রেলের লোকোশেডের কর্মী। খাতাকলমের কাজ করতেন অর্থাৎ ক্লার্ক ছিলেন ভদ্রলোক। ছেলের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। পরে বদলি হয়ে যান নৈহাটিতে। আরও ভাইবোন ছিল শংকরার। মোহনপুরের কেউ ওঁদের আর খোঁজ রাখে না। এদিকে শংকরা জটা নিয়ে খাঁটি সাধুর বেশে ফিরে এসেছে মোহনপুরে, এত কাল বাদে। প্রথম ক’দিন খুব ভক্তি সম্মান পেয়েছিল বাড়ি বাড়ি। তারপর হয়তো ঔদাসীন্য দেখা গেল। শংকরা মুসহরদের শ্মশানে গিয়ে মুসহরদের মতোই এটা ওটা কুড়িয়ে ঝোপড়ি বানিয়েছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, রেলইয়ার্ড থেকে নীল ও কালিঝুলি মাখা উর্দিপরা ড্রাইভার ফায়ারম্যান এবং গ্যাংয়ের লোকেরাও গিয়ে বসে থাকে ওর সামনে।

ইদানীং মোহনপুরের লোক ‘শংকরা সাধু’ আর বলে না। বলে—শংকরা খ্যাপা। আসলে অলৌকিক কিছু কীর্তি একটু—আধটু না দেখাতে পারলে লোকে সাধু বলে মানবে কেন?

কিন্তু সুলোচনা যে তাকে মানলেন, তার একমাত্র কারণ অমির ভূতটা সৈকা ছুঁড়ির। মুসহর ছুঁড়ির ভূত তাড়ানোর ক্ষমতার সঙ্গে তিনি তার হাঁটুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা জুড়ে দিয়েছিলেন। শংকরা সৈকার মাংস খেয়েছে যখন, তখন সে সৈকাকে অমির শরীর থেকে তাড়ালেও তাড়াতে পারে।

স্ত্রীর এত জোগাড় জাগাড়ে প্রমথ বিরক্ত হয়েছিলেন! ভেবেছিলেন, ডনকে বলে ওঁকে রোখা যাক। ডাক্তারি চিকিৎসা চলছে, এই তো যথেষ্ট। কিন্তু ডন আমল দেয়নি জ্যাঠাকে। কানে শুনেছে এইমাত্র। তারপর যথারীতি বেরিয়েছে তো বেরিয়েছে। বিকেলে প্রমথ বাজারে খবর পেয়েছেন, ডন আর ঝেণ্টু কাটোয়া না কোথায় গেছে। হুলোর খোঁজ নিলেন। হুলোও নেই। হুলোই সঠিক খবর দিতে পারত।

ওদিকে যাকে নিয়ে এত দুর্ভাবনা, সেই অমি দিব্যি আগের মতো স্বাভাবিক। একটু দুর্বল দেখাচ্ছিল সকালের দিকে। বিকেলে সেটা কাটিয়ে উঠেছে। আগের মতো হাসিখুশি মুখ। বুলুর ছেলেকে নিয়ে একশো আদর। বুলুর তো আতঙ্কে চোখ বড় হয়ে যাচ্ছিল। এই বুঝি আছাড় মেরে বসবে তার পুটুন সোনাকে।

এই দেখে আড়ালে সুলোচনা স্বামীকে বলেছিলেন, দেখছ তো? স্বচক্ষে দ্যাখো এবার। কিছু যে মানো না—এবার হাতে—নাতে দ্যাখো।

প্রমথ তেতো মুখে বলেন, দেখবটা কী? হিস্টিরিয়ার ব্যাপারই এই। এই হাসছে, বেড়াচ্ছে আবার এই ফিট হচ্ছে, কাঁদছে, কত রকম করছে।

সুলোচনা বাঁকা হেসে বলে, একবার তোমাকে পেত মুসহর পাড়ার কেউ, দেখতুম!

না। আমাকে পাবে না। প্রমথ গরম মেজাজেই বলেন, তোমাকেই পাবে। পাবে কী, পেয়েছে!

গতিক বুঝে সুলোচনা যুক্তিবাদীর ভূমিকা নেন। বলেন, আচ্ছা, মাথা ঠান্ডা করে বিচার করো তো দেখি। সকাল অব্দি মেয়ে কী ছিল, আর যেই পল্টে জটাবাবার জলপড়া এনে দিল, খাওয়ালুম, তারপর চেঞ্জটা লক্ষ্য করোনি?

কিন্তু তাই বলে যা খাওয়াবে খাইয়ো, ওই ওঝা—টোজা দিয়ে কেলেংকারি কোর না। মুখ থাকবে না বাইরে। ছিঃ! ভদ্রলোকের বাড়ি ওঝা ঢুকবে কী? তুমি এমন বেআক্কেলে উজবুকের মতো কাণ্ড করবে? প্রমথ মোক্ষম যুক্তি দেখান এবার, এরপর ও মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে বুঝতে পারছ না? আর কোনো সম্বন্ধ করা সম্ভব হবে? বরং নেহাৎ নার্ভের অসুখ হয়েছিল, এই বললে পার পাওয়া যাবে। দরকার হলে অবিনাশকে সামনে দাঁড় করাতে পারব।

এ যুক্তিটা সুলোচনাকে কিছু দমিয়ে দেয়। বলেন, না, মানে খুব প্রাইভেটলি করা যায়।

ওঝার চিকিৎসা প্রাইভেটলি? দেখেছ কখনও ওঝারা কী করে? কী কাণ্ড হয় দেখেছ?

না। তা অবশ্য দেখেননি সুলোচনা। তিনি কলকাতার মেয়ে। কিন্তু এখানে এসে অব্দি শুনেছেন। এক সময় মোহনপুরে অসংখ্য ভূতের উপদ্রব ছিল। পাশের বাড়ির বউ—ঝিকেও ভূতে ধরত শুনেছেন। ভয়ে পারতপক্ষে দেখতে যেতেন না। শুনতেন রাতে পরিমল হাড়ি এসে নাকি সারিয়ে দিয়ে গেছে।

সুলোচনা বলেন, ধরো অনেক রাতে ওপাশের ঘরে…..

কথা থামিয়ে প্রমথ বলেন, তুমি জানো না! ওঝা ওকে আসন করিয়ে বসাবে! জোরে চেঁচিয়ে তন্তর—মন্তর আওড়াবে! ধুঁয়ো দেবে। খ্যাংরা ঝাঁটা দিয়ে বেদম পেটাবে। তারপর প্রাণের দায়ে হিস্টিরিয়ার রুগি ভূতের নাম বলতে বাধ্য হবে। সব বানিয়ে বলবে। উপায় কী? আর কত অত্যাচার সইতে পারে? তখন ওঝা ব্যাটা বলবে, চেঁচিয়ে স্পষ্ট করে নাম বল। সবাইকে শুনিয়ে বল। তারপর বলবে, এই জলভরা ঘড়াটা দাঁতে কামড়ে যেখানে ওকে ধরেছিলি, সেখানে অব্দি নিয়ে যা!…..

এই পর্যন্ত শুনেই মুসড়ে পড়েন সুলোচনা। আহা, কী সুন্দর দাঁতগুলো অমির! মুক্তো মতো দাঁত যাকে বলে।

তার চেয়ে সাংঘাতিক কথা, অমি রাতদুপুরে দাঁতে কলসি কামড়ে নিয়ে সেই ডিস্ট্যান্ট সিগন্যাল অব্দি দৌঁড়ুচ্ছে ভাবতেই হিম হয়ে ওঠেন সুলোচনা। ঠোঁট কামড়ে বলেন, যাক গে। অত সব না করে বরং এসে পরীক্ষা করে যাক না লোকটা। আসতে বলে পাঠিয়েছি যখন।

বাগে পেয়ে প্রমথ বলেন, খুব অন্যায় করেছ। অমি যদি নিজের মেয়ে হত, নিশ্চয় ওসব ছোটলোকমি করতে যেতে না!

অমনি জ্বলে ওঠেন সুলোচনা। মুখ ভেংচে বলেন, থাক, আর নিজের পরের বলে জাঁক দেখিয়ো না! এত যদি আপন ভাবো, টুলু—বুলুর আগেই ওর একটা গতি করতে! লজ্জাহীন! হিপোক্রিট কোথাকার!

পালটা ঘায়ে প্রমথ পর্যুদস্ত। বলেন, আহা! অমি নিজেই তো জেদ করে আছে। যতবার এগিয়েছি, ও কী করেছে ভুলে গেলে? সতুমোক্তারের শ্যালক—পুত্র আসলে ওকে চাঁদ দেখিয়ে রেখেছে জানো না? এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ। বাঃ! বাঃ রে! বাঃ! পর পর গোটাকতক বাঃ ধ্বনিতে প্রমথ নিজের বিস্ময়াভিভূত অবস্থা প্রকাশ করে আরও ফিসফিসিয়ে বলেন, কেন? তুমিও তো মনে মনে বরাবর ধরে বসে আছো, হেমা তোমার বাড়ির জামাই হবে। মানে অমির কথাই বলছি। ধরে নেই তুমি?

সুলোচনা মুখ ফিরিয়ে রুষ্ট চোখে জানালার বাইরে বুগেনভিলিয়া দেখতে দেখতে বলেন, অমন ধরে সবাই থাকে। ডাবুকেও তো ধরে আছো তুমি। দেখো, শেষে কী হয়!

ঠিক এই সময় টুলুর ঘরে গানের আসর বসেছে শোনা গেল। অনেক দিন পরে টুলু গাইছে। ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। বসন্তের এ মাতাল সমীরণে….’ তারপর ডাবু কী একটা রসিকতা করেছে এবং খুব হাসছে ওরা।

তারপর কে বলে উঠল, আহা, ডিসটার্ব কোরো না। গাইতে দাও বড়দিকে।

স্বামী—স্ত্রী পরস্পরের দিকে দ্রুত তাকাল। তারপর প্রমথ ঘুরে বসে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলেন, হেমা মনে হল—

সুলোচনা গম্ভীর মুখে বলেন, হেমা প্রায় দু’মাসের ওপর এ বাড়ি আসেনি। ডন নাকি শাসিয়েছিল। ডনকে নিয়ে আর পারা যায় না!

সুলোচনা বেরিয়ে যাচ্ছেন, প্রমথ ডেকে বলেন, শোন। ইয়ে—হেমার সঙ্গে আমরা তো কোনোদিন কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি! দেখ, যেন আগের মতো ট্রিটমেন্ট পায়—এসেছে যখন। আর…

সুলোচনা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিপাত করেন।

আর ইয়ে, ডন এলে দেখো, যেন হেমাকে কিছু বলে—টলে না। ডন অবশ্য ওদের আসরে ঢুকবে না। কখনও তো ঢোকে না। তুমি ওকে বরং আসামাত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। কথা আছে বলো। আমি ম্যানেজ করব ওকে।

সুলোচনা সায় দিয়ে বেরিয়ে যান। হেমাঙ্গকে পুনর্মিলনের আনন্দই জানাবেন।

যে বাড়ির কোনো লোক গুন্ডার খ্যাতি কুড়িয়েছে, সে বাড়ির আন্ডাবাচ্চাদেরও এক ধরনের সাহস গর্ব আর ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়। মানুষ শিক্ষাদীক্ষা, বিদ্যাবুদ্ধির দোহাই দিয়ে আসুরিক শক্তির যত নিন্দামন্দই করুক, সে বাস্তবে অসুরেরই ভক্ত। মনে মনে অসুরের পরাক্রম কে না পেতে চায়! ‘দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’। এই গ্রাম্য প্রবাদ নেহাৎ বিবেককে একটু সান্ত্বনা দেওয়া। হেমাঙ্গকে প্রায় গয়লাপাড়া যেতে হয় বলেই সে জানে, দুষ্ট গোরুর মালিকের মনে কতটা গর্ব আছে ওই দুষ্টুমি নিয়ে। গোরুটা শুধু বাঁজা না হলেই হল।

কথাটা ডন প্রসঙ্গে। বোসবাড়ির মেয়েগুলো ডনের জন্যে গর্বিত টের পেয়ে তার খারাপ লাগত। ডনের জ্যাঠা ও জেঠিমার তো কথাই নেই। বাইরের লোককে সমঝে না দিয়ে ছাড়েন না যে বাড়িতে অসুর বাঁধা, সাবধান।

শুধু অমি, যে ডনের সহোদর দিদি, একটু অন্যরকম। তার মধ্যেও ঔদ্ধত্য আছে। সাহস আছে মাত্রাছাড়া। কিন্তু হেমাঙ্গ জানে, এর কারণ ডন নয়। বরং ডনকে মনে মনে ঘৃণাই করে অমি। ডন সম্পর্কে হেমাঙ্গর সঙ্গে কত আলোচনা করেছে। হেমাঙ্গ বুঝতে পেরেছে, ডনের জন্য আসলে অমির সব সময় অস্বস্তি থাকে। বিশেষ করে ডনের মেয়েদের ব্যাপারে সেই অদ্ভুত নীতিবোধ! বরাবর অমি বাইরে বাইরে ঘুরতে অভ্যস্ত। সারা মোহনপুরে ওর বন্ধু এবং আলাপের মানুষ। যদি ডনের অস্তিত্ব না থাকত, বোসবাড়িতে বিরাট ভিড় জমত। ডনের দিদি বলে প্রকাশ্য কৌতূহল দেখাতে অমির বন্ধু ও আলাপের মানুষরা ভয় পেয়েছে। তাছাড়া এমনিতেই বোসবাড়ির মেয়েরা কম আসে। টুলু বুলুরা একটু দেমাকী ছিল ছেলেবেলা থেকে—পরে ডনের জন্যে যেন দেমাক একশো গুণ বেড়েছে।

দু’মাস পরে বোসবাড়ি ঢুকল হেমাঙ্গ। ডাবু টানতে টানতে নিয়ে এল। সকালে ডনের কথায় হেমাঙ্গ ছাড়পত্রের আভাস পেয়েছিল। কিন্তু তার সংশয় ছিল, অমি কীভাবে নেবে তার আসাটাকে।

হেমাঙ্গ বুঝল না, টুলু বিলু মিলু ইলু কেন আজ তাকে দেখামাত্র খাতির জুড়ে দিল। ডাবুর খাতিরে খাতির? মনে হল না হেমাঙ্গর। উত্তর—পশ্চিম কোণায় একতলাতে টুলুর ঘর। কোণে ঠাকুরের ছবি এবং পুজো—আচ্চার ব্যবস্থা আছে। সেটা টুলুর নিজের ভক্তিতে কিংবা তার মায়ের তাগিদে, হেমাঙ্গ জানে না। এই ঘরেই বরাবর গানের আসর বসে। পুরনো অসচ্ছল আমলের দুটো বড় তক্তপোষ জুড়ে বিছানা পাতা। বিলু একা এলে এ ঘরে দিদির কাছে থাকে। কখনও সুলোচনা জনকে নিয়েও বিধবা মেয়ের পাশে শোন। তাছাড়া গানের আসরের সুবিধে আছে প্রকাণ্ড এই বিছানাটাতে। হেমাঙ্গ ভেবেছে, যে রাতে বেচারা টুলুদি একা এত বড় বিছানায় শোয়, সে রাতে তার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? এ যেন না জেনে ওকে শাস্তি দেওয়া। তার বদলে ছোট্ট একচিলতে বিছানায় টুলুদির শোওয়া কি ভালো ছিল না?

পরে ভেবেছে, হয়তো বুদ্ধিমতী সুলোচনা মেয়ের চির—একাকিত্ব নষ্ট করার জন্যেই অত বড় বিছানায় শুতে দেন। গড়িয়ে ছড়িয়ে শোবে। অন্তত কল্পনার অবকাশ পাবে যে, আরেকজন যেন একটু তফাতে শুয়ে আছে। স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে রাগরাগি হলে তো দু’জনের মাঝখানে নদী বয়ে যায়।

ছোট্ট বিছানায় ঠেসাঠেসি শুয়েই বরং নিঃসঙ্গতার বোধ চেপে ধরার আশঙ্কা আছে। নয় কি? কল্পনা বাধা পেতে বাধ্য, কারণ ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী’।

এ সব কথা নিছক মনে মনে নয়, হেমাঙ্গ অমির সঙ্গে আলোচনাও করেছে। তাই বলে, আমি প্রাণ গেলেও টুলুদির কাছে শোব না। বলেছিল—কী বিচ্ছিরি অভ্যেস জানো না। মুখে বলা যায় না। মেয়ে বলেই মনে হবে না তোমার। আস্ত পুরুষ মানুষ টুলুদি।

হেমাঙ্গ হাসি চেপে বলেছিল, তাই বল। লেসবিয়ান।

যাঃ! বলে অমি হেমাঙ্গর কান টেনে দিয়েছিল।

অমির সঙ্গে হেমাঙ্গ অবশ্য সেক্স নিয়ে কথা বলতে ভয় পেত। তাই যত তীব্র কৌতূহল জেগে উঠুক টুলুদি সম্পর্কে, হেমাঙ্গ আর এগোতে পারেনি।

বিকেলে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের ওখানে অমিকে ভূতে ধরার জায়গাটা ডাবু আর হেমাঙ্গ সকৌতুকে ঘোরাঘুরি করে তারপর এসেছে বোস বাড়ি। এসেই দেখল, গানের আসর। সেজেগুজে বসে গেল। টুলুদি মাকে খুঁজে না পেয়ে নিজেই কুকার জ্বেলে কেটলি বসিয়ে এল। ঘণ্টার মা উনুনে কয়লা সাজাচ্ছে। জল ফুটলে খবর দিতে বলে এল।

হেমাঙ্গ আড়চোখে অমিকে দেখছিল। এ কী চেহারা হয়েছে অমির! হলুদ রক্তশূন্য মুখ! চোখের তলায় কালি। গালটা চিমসে হয়ে গেছে। কত রোগা দেখাচ্ছে ওকে! হেমাঙ্গর মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু অমি তার উপস্থিতি গ্রাহ্য করছে না যেন, কথা বলা তো দূরের কথা। তাই হেমাঙ্গ ওর সঙ্গে কথা বলল না। এদিকে গানের আসরের ঝোঁকে এই ছোটখাট ব্যাপার লক্ষ্য করার মন নেই কারও। ডাবু পা মুড়ে বসে ডুগিতবলায় পাউডার মাখাচ্ছে। ইলু হই হই করে বলল, দিলে তো কৌটো ফিনিশ করে। সেজদি রে, তুই কিছু বলছিস নে, তোরও শেয়ার আছে। মাইন্ড দ্যাট।

হেমাঙ্গ বলল, শেয়ার আছে মানে?

ডনদা এনে দিয়েছে দু’জনকে। দিশি পাউডার ভেবেছ নাকি?

এই শুনে ডাবু কৌটোটা তুলে দেখে নিয়ে বলল, উরেব্বাস! মেড ইন প্যারিস। তাই এত রোয়াব ছোটাচ্ছে! বলে সে বাতাস শুঁকে নিল অদ্ভুত ভঙ্গিতে।

আবার হাসির ধুম পড়ল আসরে। টুলুদি বলল, ডনের কারবার ভাই। নামেও সায়েব, কাজেও তাই।

ডাবু তবলায় চাঁটি দিতে দিতে অমির দিকে চোখের ঝিলিক মেরে বলল, অমি, সাবধান! দেখ বাবা সেন্টের লোভে ভূত—পেরেত নাকি হানা দ্যায়। তোমার ভূতটাকে সামলে রেখো।

অমি রুগণ হাসল শুধু। বিছানার কোণায় পা ঝুলিয়ে বসে ঊরুর ওপর বিলুর ছেলেকে রেখেছে। ছেলেটার রবারের রঙিন বল দু’হাতে ধরে কামড়াবার চেষ্টা করছে। ঘরে দিনের আলো কমে গেছে। সতর্ক বিলু সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর অমির পাশে বসল।

টুলুদি, জ্যোৎস্না রাতে গানটা! ডাবু ফরমাস করল।

টুলু সেকেলে প্রকাণ্ড হারমোনিয়ামের ফোল্ডিং বেলো খুলে ঝুঁকে পড়েছে খাতার দিকে। তারপর ঠোঁট খুলেছে।

ডাবু বলে উঠল, বনে নয়, ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালে যাব। অমি যেখানে গিয়েছিল।

আবার হাসির ঝড়। অমিও কেমন টেনে টেনে হাসছে, রুগণ, কষ্টের হাসি। তাই হেমাঙ্গ বলে উঠল, আহা, ডিসটার্ব কোরো না! গাইতে দাও বড়দিকে।

টুলু শুরু করার পর এতক্ষণে হন্তদন্ত সুলোচনা এলেন। সবাই তাকিয়েছে ওঁর দিকে, এই রে! দিলেন হয়তো আসরটা ভেঙে। কিন্তু সুলোচনার চোখে—মুখে সায় ছিল। ঠোঁটে সুন্দর হাসিও।

হেমাঙ্গর কাছে এসে চাপা গলায় বলেন, কী ছেলে রে বাবা! পথ ভুলে গেছ! তারপর এগিয়ে অমির কোল থেকে নাতিকে নিয়ে নাচতে নাচতে মেয়ের সুরে সুর মেলান। সবাই জানে সুলোচনা যৌবনে ভালোই গাইতে—টাইতে পারতেন। সুরে সুর মেলাতে লজ্জাসংকোচ করেন না। তিনি যে কলকাতার মেয়ে, তাই এখানকার মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট, শিক্ষিতা, এবং রুচিবতী, তার প্রমাণ দেখাতে কসুর করেন না এই প্রৌঢ় বয়সেও।

গান জমে উঠেছে সুলোচনার লাই পেয়ে! টুলু থামলে তিনি বলেন, অমি, তুই গা তো মা! ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। ওঠ।

অমি মাথা নাড়ে।—একা দমে কুলোবে না! বড়দি গাক। সঙ্গে সবাই গাইছি।

বেশ তো, তাই।

সবাই গাইছে। সুলোচনা এবং ডাবুও। হেমাঙ্গ চুপ। ইলু বলে ওঠে, ও মা! হেমাদা গাইছে না।

সুলোচনা বলেন, হেমা! অনেক দিন থাপ্পড় খাওনি?

তখন হেমাঙ্গও গলা মেলায়।

বারান্দায় প্রমথ এসে দাঁড়িয়েছেন। খুশি হয়ে ভাবেন, রাইট কোর্স অফ অ্যাকশান। অবিনাশ ডাক্তার ঠিক ঠিক এরকমই বলেছে। তারপর বারান্দার আলোটা জ্বেলে দেন।

সেই আলোয় প্রকাণ্ড উঠোনের ওপাশে সদর দরজার কাছে কাকে আবছা নজরে পড়ে। কে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। সদর দরজা সব সময় খোলাই থাকে। ডনের বাড়ি এটা।

তক্ষুনি রেগে আগুন হয়ে প্রমথ নেমে যান। গম্ভীর স্বরে বলেন, কে রে তুই? ভূতের মতো এখানে চুপচাপ ঢুকে বসে আছিস, কে তুই? কোন সাহসে না ডেকে বাড়ি ঢুকেছিস?

লোকটা আবছা আলোয় দাঁত বের করে বলে, স্যার আমি পিরিমল ওস্তাদ। হাড়িভাঙা থেকে এসেছি। গিন্নিমা খবর পাঠিয়ে ছিলেন।

প্রমথ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে ওর জামার কলার খামচে দরজার বাইরে নিয়ে যান। তারপর চাপা গর্জে বলেন, মেরে তক্তা বানাব উল্লুককে! গেট আউট! আর কখনো যদি আসবি এদিকে ক্যানেলে চুবিয়ে মারব। আস্পর্ধা দেখেছ? দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছে!

পরিমল ওস্তাদ ডনকে চেনে। বাইরে গাছপালা প্রচুর। অন্ধকার রাস্তায় তার কালো মূর্তি পলকে মিলিয়ে যায়।

প্রমথর এখন ভাবনা, বাড়ির কেউ টের পেল নাকি! ঢুকে দরজা এঁটে ঘণ্টার মাকে ডাকেন, ওরে বুড়ি! কল টেপ দিকিনি। হাত ধোব।

ঘণ্টার মা টিউবওয়েলের কাছে এসে ফিক করে হেসে ফিসফিসিয়ে বলে, তাইড়ে দিলেন ওস্তাদকে?

দিলুম। খবরদার, জনের মাকে বলবিনে, এসেছিল।

না গো না। বলব না। আপনি হাত ধোন তো।

তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে বারান্দায় ওঠেন প্রমথ। ঘণ্টার মা নিরিবিলি জল টিপে দিয়েছে জানলেও বিপদ। ঝি—মেয়েটিকে চোখে চোখে রাখেন। প্রমথর নিজেকে পঁয়ষট্টি বছরের কামক্ষমতাহীন বুড়ো মানুষ বলাটাই নাকি চালাকি। চাকরি জীবনে কতবার নাক নাড়া না খেতে হয়েছে—ব্লক আপিসের ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েগুলোকে ছেড়ে আসতে কি মন চায়? রোজ বাবুর সন্ধে সাতটা বাজবে না কেন? সুলোচনাকে বোঝানো কঠিন, ওভারশিয়ারের কাজ দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টার। কদমপুর রোডের কালভার্ট মেরামত হচ্ছে। হাবুল মিয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট না নিয়ে ছাড়বেন না। তাই মুখ চেয়ে অপেক্ষা করতে হল।…

ডাবু ততক্ষণে বিরক্ত। ঢিমেতালে বাজিয়ে হাতের সুখ মিটছে না। এক সময় বলে ওঠে, বাঙালি মেয়ে মানেই রবিঠাকুর! হ্যাত্তেরি! ঠুংরি—ফুংরি, নয়তো হিন্দি ফিল্ম চালাও না বাবা!

সে কার্ফার দ্রুততালে যেন হাতের খেল দেখাতে থাকে। তখন ছোট ইলুর কাঁধে দায়টা পড়ে। সে হিন্দি ফিল্ম আর পপ গানের ভক্ত। হিট গানগুলো মুখস্থ। এবার ডাবু বলে, বহুত আচ্ছা ইয়ার!

অমি বাইরে যায়। টুলু সাবধানী গলায় একবার জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছিস রে?

জবাব দেয় না অমি। টুলু ঠোঁট বাঁকা করে একটা ভঙ্গি করে। তবলা বাজাতে বাজাতে ডাবু মুসহরভাষার ঢঙে অমির উদ্দেশে বলে, ছাগলঠো কা গেইলে দেখগে ছোকড়িয়া।

গানের মধ্যে হাসি ছড়ায়। হেমাঙ্গ সিগারেট বের করে অ্যাসট্রে দেওয়ার ইশারা করে মিলুকে। মিলু একটা কাপ এগিয়ে দেয়। তখন বিলু বলে, ওপরের ঘর থেকে ডনের অ্যাসট্রেটা এনে দে না। কাপটা নোংরা করে কী লাভ?

অগত্যা মিলু বেরিয়ে যায়। কিন্তু গিয়েই ফিরে এসে কাঁচুমাচু মুখে বলে, আমি একা ওপরে যেতে পারব না। কেউ আসুক আমার সঙ্গে।

বাড়িতে ভূতের ভয় কাল রাত থেকে জাঁকিয়ে বসেছে বোঝা যায়। ডাবু ফের অমির উদ্দেশে বলে, আগে সৈকা! অ্যাসট্রেঠো লাকে দে না গে উপ্পরসে!

হেমাঙ্গ উঠে দাঁড়ায়। বলে, দরকার নেই বাবা। বাইরে গিয়ে খেয়ে আসছি।

ডাবু বলে, সৈকা পাকড় লেগা বে! মাৎ যা।

বারান্দায় গিয়ে থামের পাশে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ সিগারেট ধরায়। টুলুর ঘরে আবার একটা হিট গান গাইছে ইলু! ডাবুও গলা মিলিয়ে বাজাচ্ছে। ওপাশে রান্নাঘর থেকে সুলোচনা ডাকছিলেন, মিলু ইলু! এদিকে আয় তো!

হেমাঙ্গ দরজার কাছে গিয়ে মিলুকে জানিয়ে দেয় খবর। মিলু চলে যায় রান্নাঘরে। লুচিভাজার গন্ধ ছুটছে বাড়িতে। প্রমথর সাড়া নেই। হয়তো বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। হেমাঙ্গ অমিকে খোঁজে। বারান্দার আলোটা উঠোনের আদ্ধেকটা পর্যন্ত ছড়িয়েছে।

অমি উঠোনে টিউবওয়েলের ওপাশে শিউলিতলায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ পড়তেই বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে হেমাঙ্গর। ওখানে একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে কী করছে? বাড়ির পুবদিকে গাছপালার মাথায় চাঁদ উঠেছে। বিকেল থেকে আকাশ ফাঁকা হয়ে গেছে। দোতলা ডিঙিয়ে এক খাবলা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে শিউলি গাছটায়। হেমাঙ্গ ডাকে অমি, ওখানে কী করছ?

অমির জবাব এল আস্তে।—মাথা ধরেছে!

ট্যাবলেট খেয়ে নাও তাহলে। ওখানে….

এই! শোন।

হেমাঙ্গ চমকায়। কিন্তু দ্বিধা ও ভয় মাড়িয়ে ওখানেই লাফ দিয়ে নেমে কাছে যেতে দেরি করে না। কাছে গিয়ে সে বলে, কী হয়েছে তোমার অমি?

অমি চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, ভোঁসড়িবালে কাঁহেকা! তারপর জোরে চড় মাড়ে হেমাঙ্গর গালে। তারপর হাসতে থাকে হি হি হি হি….এবং হেমাঙ্গ ছিটকে সরে এসে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে, ডাবু! ডাবু! টুলুদি!