অশরীরী ঝড় – ২

দুই

হেমাঙ্গর মনে মায়ের কোনো স্মৃতি নেই। তার দেড়বছর বয়সে মা মারা যায়। তার বাবা বরদাপ্রসন্ন রেলের টিকিট চেকার ছিলেন। বড় উচ্ছৃঙ্খল মানুষ ছিলেন তিনি। মদ্যপান করতেন। আরও নানারকম দোষ ছিল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর রেলেরই এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গার্ডের বিধবাকে বিয়ে করেন। সে ভদ্রমহিলা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাই বরদা দ্বিতীয় স্ত্রীকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি কখনও নিয়ে যেতে পারেননি। হেমাঙ্গ অবশ্য সৎমায়ের স্নেহ পেয়েছিল। ওঁর কোনো ছেলেপুলে ছিল না। হবারও সম্ভাবনা নাকি ছিল না। ছ—সাত বছর বয়সে কী ভেবে বরদা হেমাঙ্গকে তার আপন মামাবাড়িতে রেখে আসেন। কাটোয়ায়। সেখানে হেমাঙ্গ প্রাইমারি অব্দি পড়াশোনা করেছিল। খেয়ালি বরদা আবার কী ভেবে তাকে মোহনপুরে দূর সম্পর্কের এই দিদির বাড়ি রেখে যান। সতীশ মোক্তারেরও ছেলেপুলে ছিল না। হেমাঙ্গ আদর খেয়ে বড় হতে থাকে মুনাপিসির কাছে। এখানে হাইস্কুল আছে। পরে কলেজও হয়েছিল। হেমাঙ্গর পড়াশোনার খরচ বরদাই জোগাতেন। হেমাঙ্গ যখন ক্লাশ টেনে পড়ছে, বরদা স্যুইসাইড করেন। রেলের লোক বলে রেলে মরেননি, সাইনাইড খেয়েছিলেন কফির সঙ্গে। গুজব আছে, হেমাঙ্গর সৎমাই নাকি বিষ খাইয়ে মেরেছিলেন। পুলিশ কেসও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা বলে ব্যাপারটা চাপা পড়ে। আর সেই আদিবাসী মহিলা, মিসেস উর্মিলা ব্যানার্জি। প্রাক্তন উর্মিলা জেভিয়ার নিকে করেন এক দক্ষিণ ভারতীয় রেল অফিসারকে। হেমাঙ্গ যতদূর জানে ওঁরা এখন নাকি খড়্গপুরে থাকেন। শৈশবের ‘মাম্মি’কে একটু—আধটু মনে পড়ে তার। মনটা কেমন করে ওঠে। কতদিন স্বপ্নেও দেখতে পায়। ঘুম ভেঙে কতক্ষণ মন খারাপ করে।

হেমাঙ্গর ইংরেজি উচ্চারণের প্রশংসা স্কুল—কলেজে প্রচুর ছিল। সে তো তার ছোটমায়ের দৌলতেই। তার ওই অল্প বয়সে মাথায় কিছু ঢুকে গেলে স্থায়ী থেকে যায় বুঝি। হেমাঙ্গর ইংরেজিটা ভালোই আসে।

মোহনপুরে হাইস্কুলে অন্তত মাস্টারিটা পেতে পারত সেই তারই জোরে। কিন্তু রাজনীতি অতি বিষম বস্তু। বি—এ পাশ করে পাঁচটা বছর বসে আছে। কত চেষ্টাচরিত্র করেও কিছু হল না। প্রথম টের প্রায় আর্টস পড়াটাই ভুল হয়েছিল। সায়েন্স কিংবা কমার্স পড়লে কিছু হয়তো জুটে যেত। কিন্তু অঙ্কের প্রতি তার বরাবর আতঙ্ক।

দু—একটা চান্স একেবারে না পেয়েছিল, এমন নয়। কিন্তু সে বড্ড দূরে এবং কাজও খুব বাজে রকমের। মুনাপিসি তার চাকরিতে উৎসাহ দেখায় না। বলে—কী দরকার বাবা? বেশ তো আছিস। বরং মোহনপুরে আজকাল বাড়বাড়ন্ত ব্যবস্থা। ব্যবসা কর কিছু। পুঁজি অল্পস্বল্প জোগাতে পারব। বাকিটা দ্যাখ না, ব্যাংক থেকে লোন পাস নাকি?

ব্যবসা হেমাঙ্গর ধাতে নেই। তবে মধ্যে একবার ঝোঁক চেপেছিল কলকাতায় ডিম সাপ্লাই করবে। কাজে না নামতেই তাকে আন্ডা—ওয়ালা বলে ঠাট্টা শুরু হল। হেমাঙ্গ অমনি ও লাইন এড়িয়ে তফাতে এল। একবার পোলট্রি করার ঝোঁক চেপেছিল। ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার আশ্বাসও পেয়েছিল। কিন্তু মুনাপিসির আপত্তিতে হল না। পিসিমার বিধবার চালচলন নেই। সাহসী একগুঁয়ে মহিলা বরাবর। আমিষ খায়। ধর্মের বাতিক তত কিছু নেই। নেহাৎ মন গেল তো একাদশীটা মাঝে মাঝে করল। ব্যস, ওটুকুই। আসলে হেমাঙ্গ বোঝে, পিসেমশাই সতীশ মোক্তার কম্যুনিস্ট সমর্থক ছিলেন। কথায় কথায় মার্কস লেনিন আওড়াতেন। মুনাপিসির স্বামী—ভক্তির প্রাবল্য হেমাঙ্গা দেখেছে। তাকে পিসেমশাই গিলে খেয়ে গেছেন!

না, মুনাপিসি রাজনীতির কিছু বোঝে না। খবরের কাগজ কদাচিৎ পড়ে। তবে সতীশ মোক্তার সম্ভবত স্ত্রীর সত্তার গভীরে কোথাও একটা স্বাভাবিক বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে করতে পেরেছিলেন হয়তো। হেমাঙ্গর তাই অবাক লাগছে, যে—মুনাপিসি ভগবান নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, সে—ই আবার ভূতে কী গভীরভাবে বিশ্বাস করে! সম্ভ্রমে ‘ওনারা’ বলে ভূতগুলোকে।

মুনাপিসির পোলট্রিতে আপত্তির কারণ, ওই গৃহপালিত পাখিগুলোর মাংস যত সুস্বাদুই হোক ওরা প্রচণ্ড নোংরা। নোংরা ঘাঁটা সইতে পারে না সে। ঘরবাড়ি জিনিসপত্র কী সাজানো—গোছানো ঝকঝকে করে রাখে সারাক্ষণ। নিজেও খুব পরিচ্ছন্ন থাকে।

মুনাপিসির আরেকটি কারবারে প্রবল আপত্তি। জুতোর কারবার। একবার হেমাঙ্গ একজনের পরামর্শে প্রখ্যাত একটা জুতো কোম্পানির রিজেক্টেড মাল এনে কারবার ফাঁদতে যাচ্ছিল। লাভ নাকি অঢেলই হত। গাঁ—গেরামের বিশাল এলাকায় এই একটা নতুন ক্রমবর্ধমান ও উন্নতিশীল রেলওয়ে টাউনশিপ। অসংখ্য খদ্দের দিনরাত মোহনপুর আনাগোনা করে। ব্যবসায়ীরা লাল হয়ে গেল। অনেকের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হল।

কিন্তু মুনাপিসি নাক সিঁটকে বলেছিল—ছ্যাঁঃ! জুতো? লোকের পায়ে হাত দেওয়া কারবার? দোহাই বাবা হেমা, অন্য কিছু কর। এই তো পুজো আসছে, ছেলেমেয়েদের জামা প্যান্ট ফ্রক…..

হেমাঙ্গ এই অব্দি শুনে বলেছিল, ধুর!

ভাগ্যিস মোক্তার পিসে সরকারি কাগজে টাকা জমিয়ে গিয়েছিলেন। মাসে মাসে সুদের টাকা আসছে। চলে যাচ্ছে মোটামুটি স্বচ্ছলভাবেই। মুনাপিসি খরচে মানুষ নয়। কিন্তু রুচি এবং নজর উঁচুদরের, তাই বলে ডাঁট দেখাবারও পক্ষপাতী নয়। যতখানি ভদ্রভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব, তাই মেনে চলে। হেমাঙ্গকেও সেইভাবে চালায়। হেমাঙ্গর তাই খাওয়া—পরার ভাবনাচিন্তাটা নেই। শুধু একটা কেমন—লাগার ব্যাপার আছে তার মধ্যে। এভাবে নিরোজগেরে হয়ে জীবন কাটানোর মানে হয়? পুরুষত্বে ছ্যাঁকা লাগে যেন।

তাই ভেতর ভেতর দরখাস্ত তাকে লিখতেই হয়। ইন্টারভিউ পায় শয়ে একটা বড় জোর। কলকাতায় গিয়ে যে ইন্টারভিউটা দিয়ে এল, সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। নেহাৎ কেরানিগিরির পরীক্ষা। কবে রেজাল্ট বেরুবে। তারপর পাশ করলে প্যানেলে নাম উঠবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট যদি কোনোদিন পায়, তো তখন হয়তো চুল পেকে সারা। বয়সসীমা পেরিয়ে গেছে।

ধুর! হেমাঙ্গ তেতো হয়ে ভাবে এসব কথা। কিন্তু এ যেন অভ্যাসের বাঁধা রাস্তায় চলা। রোজ খবরের কাগজের জন্যে হা—পিত্যেশ, প্রথমেই বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়া, তারপর ফুলস্কেপ কাগজে দরখাস্ত লেখা, টাইপ করাতে সাবরেজেস্ট্রি অফিসের সেই আটচালায় ধরনা দেওয়া—যেখানে কোনো কোনো মুহুরিবাবু দলিল লেখার ফাঁকে ফাঁকে টাইপ রাইটারও চালায়…এ এক বদ অভ্যাসে পেয়ে বসেছে তাকে।

হ্যাঁ, তারপর পোস্টাপিসে লাইন দেওয়া? আজকাল যা ভিড়!

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। দরখাস্ত পাঠিয়ে প্রতিদিন পিয়নের অপেক্ষা—মুহূর্ত গোনো। প্রথমে এল অ্যাকনলেজমেন্ট রসিদটা। তারপর অস্থিরতা আর প্রতীক্ষা, কড়া নাড়লেই চমকে ওঠা, ওই বুঝি পিয়ন এল!

এই কদর্য অভ্যাসের মধ্যে থেকেও অমির সঙ্গে কী একটা চলছিল কতদিন থেকে। প্রেম? হয়তো প্রেম। নিছক খেলা? হয়তো খেলা। সেক্সের টান? হেমাঙ্গ চমকায়। অমির গড়নে ভঙ্গিমায় হাসিতে, চোখে আর ঠোঁটে নিশ্চিত সেক্সের ঝিলিক আছে, যা মোহনপুরে কোনো মেয়ের মধ্যে লক্ষ্য করেনি হেমাঙ্গ। কিন্তু অমি যেন নিজেই জানে না, ওর এতসব সেক্স—টেক্স আছে। হেমাঙ্গ তাকে জানিয়ে দিতে পারত। হেমাঙ্গর অতটা সাহস হয়নি কোনোদিন। ইচ্ছেও হয়নি।

আসলে যে মেয়েকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে যার সঙ্গে ক্রমাগত মিশছে তার অত সব মোহ ও সৌন্দর্য সত্ত্বেও একটা অদ্ভুত বাধা সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে সারাক্ষণ। অমি যখন তার সামনে নেই, তখন অমির শরীর নিয়ে হেমাঙ্গ খুঁটিয়ে ভেবেছে চাঞ্চল্যও জেগেছে, এবং লোভও চুপি চুপি পিছনে এসেছে। কিন্তু অমি যতক্ষণ সামনে আছে, ততক্ষণ কী এক নিস্পৃহতা তাকে পেয়ে বসেছে।

সেদিন সারা সকাল অমির কথা ভেবে হেমাঙ্গ সময় কাটাল।

ইদানীং অমিকে কেমন রুগণ দেখাচ্ছিল যেন। হাসলে এই রোগাটে ভাবটা স্পষ্ট হত। ওর লম্বাটে গালের মাংস কিছুটা টান টান মনে হচ্ছিল। কাপড়—চোপড়েও একটা অগোছালো ভাব যেন লক্ষ্য করছিল হেমাঙ্গ। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে দূরের দিকে যেন তাকিয়ে থেকেছে অমি।

শেষ কথা খালের সেই পোলের কাছে। ওখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা হল। আজেবাজে কথা। তারপর অমি একটু ক্লান্তিভরা হাসি হেসে কপালের চুল সরিয়ে (প্রথমে চৈত্রের হাওয়া শুরু হয়েছিল সবে) বলল, চলি। ও বেলা থাকবে?

যাব কোথায়! কেন?

আসব। থেকো। কথা আছে জরুরি।

সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করেও অমি আসেনি। তখন হেমাঙ্গ মন খারাপ হয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজে গিয়েছিল। তারপর ডনের আবির্ভাব এবং শাসিয়ে যাওয়া।

কী কথা ছিল অমির, এখন আঁচ করতে পারছে। বাড়িতে সম্ভবত তাকে নিয়েই কোনো গোলমাল বেধেছিল। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। দুজনের মেলামেশা নিয়ে মোহনপুরে কানাকানি হচ্ছিল অনেক দিন থেকে।

আসলে চেহারায় শহরের পোশাক ও ভাবভঙ্গি থাকলেও মোহনপুরের স্বভাবের আড়ালে সেকেলে গ্রাম্যতার বীজাণু থকথক করছে। এখনও আগের মতো লোকেরা কেলেঙ্কারি খুঁজে তোলপাড় করে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন ধর্মরাজার মন্দিরে গাজনের ধুম হয়। তখন সঙ সেজে ছড়াগান গেয়ে মোহনপুরের কেলেঙ্কারির হাঁড়ি ভাঙাভাঙি চলে। এখনও এ ব্যাপারটা মোহনপুর গাজন উৎসবের প্রধান অঙ্গ। আশ্চর্য, বাজারের মারোয়াড়ি, ইটখোলার উত্তরপ্রদেশবাসী মালিক, এমনকি রেলকলোনিবাসী নানা জায়গায় নানা ভাষার লোকেরাও চোখ নাচিয়ে আগাম সঙ বা গানের খবরাখবর নেয়। অর্থাৎ এবার কার হাঁড়ি ভাঙা হচ্ছে?

এমন একটা জায়গায় সত্যিকার অর্থে আধুনিক প্রেম—ভালোবাসার ব্যাপারটা বিদঘুটে হতে বাধ্য। হেমাঙ্গ এবং বেচারি অমির বেলায় তাই হল। সামনে সংক্রান্তির গাজন আসছে। হেমাঙ্গ এই ভেবে শিউরে উঠেছিল। তারপর মনে হল, ডনের দিদির নামে প্রকাশ্য কেলেঙ্কারি করার সাধ্য কারও হবে না। সেই সুযোগে হেমাঙ্গও হয়তো রেহাই পাবে।

এই সব নানান ভাবনায় হেমাঙ্গ অস্থির হয়ে কাটায় সারা সকাল। তারপর ডাবুর সাড়া পায়—এই ব্যাটা হেমা! আছিস নাকি?

হেমাঙ্গ বেরিয়ে বলে, আয়, আয়। এসেছিস শুনলাম। ডনকে বলে পাঠালাম, ও বলেনি?

কোথায় ডন? নাদুস—নুদুস মোটা ও বেঁটে ডাবু হাঁসফাঁস করে বারান্দায় ওঠে। তো এসেই শালা পড়ে গেছি ভূতের পাল্লায়! কি তোদের দেশ মাইরি! অমিকে এইমাত্র বলে এলাম, চলো আমার সঙ্গে। ভূতের দেশে আর থেকো না। শুনে অমিও খুব হাসতে লাগল। বলল, যাঃ! কীসের ভূত?

বলল নাকি? হেমাঙ্গ আগ্রহে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ! এখন দিব্যি ভালো মেয়ের মতো ঠ্যাং নাচিয়ে চা খাচ্ছে। মাইরি, তোর দিব্যি!

ভেতরে আয় ডাবু। কেমন আছিস বল?

খুব মুটিয়ে গেছি রে! এই গরম আসছে, না মৃত্যু। জামসেদপুরের যা অবস্থা হবে। রুমাল বের করে ডাবু ঘাড় মোছে। তারপর সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বলে, ফ্যান রাখিসনি ঘরে?

হেমাঙ্গ বলে দরকার হয় না। এখানে জানালার ধারে বস। খুলে দিচ্ছি…

ওই ডাবু ডনদের কে যেন হয়। কৈশোর থেকে হেমাঙ্গ ওকে ডনদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতে দেখেছে। কোন আমলে ওরা নাকি মোহনপুরেরই বাসিন্দা ছিল। চাকরি—বাকরির সূত্রে জামসেদপুরে যাওয়া। ডনের দাদা লালুর জামসেদপুরে চাকরি পাওয়ার কারণও ডাবুরা। এবং এই সব দেখেশুনে হেমাঙ্গর মনে হত, সেও ওইভাবে চাকরি করতে যাবে। এখন ভাবলে হাসি পায়।

ডাবু বরাবর মিশুকে ছেলে। মোহনপুরে এলে ওকে নিয়ে ছেলেদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। মেয়েরাও টানাটানি কম করত না। বয়স্কা দিদি মাসি পিসি ঠাকুমারাও ডাবুকে দেখে খুশি হতেন। ডাবুর কী একটা গুণ ছিল সন্দেহ নেই। হেমাঙ্গর মনে পড়ে, বেঁটে হোঁৎকা মোটা ডাবু হাফপ্যান্ট পরে এই সেদিনও মোহনপুরে খেলার মাঠে ফুটবলের পিছনে দৌড়চ্ছে। রেলকলোনি বনাম তরুণ সংঘের ম্যাচ। সব বয়সের খেলোয়াড় নিয়ে খেলা। লোকোশেডের মাদ্রাজি ব্যাক বিশ্বনাথন, যাকে ছেলেরা বিশুদা বলে ডাকত, ডাবুর মতোই হোঁৎকা মোটা ছিল। তাই বিশ্বনাথন রেলের দলে ব্যাক হলে ডাবু তরুণ সংঘের ব্যাক হবেই। হাসাহাসি করত। কী যে সব দিন গেছে তখন! হেমাঙ্গ জীবনে ফুটবল ছোঁয়নি, আদপে কোনো খেলা খেলেনি। কিন্তু খেলাধুলোর ব্যাপারে নীরব সমর্থকের মতো ঘুরেছে। যেন ডাবুরই টানে। ডাবু মোহনপুরে এলে তার মন খুশিতে নেচে উঠত। তখন দিনরাত ডাবুর সঙ্গে থাকা চাই তার।

ডাবুটা আবার একটু—আধটু গানও গাইতে পারত। বউদি এবং সাধারণ মেয়ে মহলে এ একটা কোয়ালিফিকেশন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ডাবু গান গাইছে আর মেয়েরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, হেমাঙ্গর চোখে এই দৃশ্যটা স্পষ্ট ভাসে। সে ভাবত, কেন সে গান গাইতে পারে না?

জীবনে কিছু কিছু ছোটখাটো ব্যাপারে ব্যর্থতা তো থাকেই মানুষের। সেজন্য প্রচুর দুঃখও জোটে। এটা ডাবু টের পাইয়ে দিয়েছিল হেমাঙ্গকে। তাই বলে ডাবুকে সে ঈর্ষা করত না। করতে পারেনি কোনোদিনও। আজও না। এই যে এতক্ষণ ধরে ডাবু শোনাল নিজের নানা কৃতিত্বের কথা, হেমাঙ্গ খুব মন দিয়ে শুনল, এবং নিজের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে খুব ব্যর্থ মানুষ বলে গণ্যও করল, তবু কত ভালো লাগল শুনে।

কৃতিত্ব নিশ্চয়। ডাবু চাকরি ছেড়ে কিছুদিন এক বড় কন্ট্রাক্টার কোম্পানির অধীনে সাব—কন্ট্রাক্টারি করছে। (হেমাঙ্গ জানত, ডাবু বরাবর চাকরিই করছে)। ভালো কামিয়ে নিয়েছে। নানান জায়গার বড়লোক ফ্যামিলি ওকে মেয়ে অফার করতে সেধেছে। ডাবু ভেবে কিছু ঠিক করেনি। বাবা—মা খানিকটা চাপ দিচ্ছেন বইকি। বুড়োবুড়ি হয়ে গেছেন এবং ডাবুর একটি সুন্দরী বউ দেখে যেতে চান। ডাবু বলেছে শিগগির শেটল করে ফেলবে। আপাতত হঠাৎ মোহনপুর আসার কারণ স্বাধীনভাবে এখানে কন্ট্রাক্টারির সুযোগ কতটা, তা অ্যাসেস করা। হেমাঙ্গর কী মনে হয়? আছে তেমন স্কোপ?

হেমাঙ্গ জানে, এটা ডাবুর নিছক প্রশ্ন তাকে। ডাবুর মতো স্মার্ট চালাক চতুর ছেলে ভালোই বোঝে, বৈষয়িক ব্যাপারে হেমাঙ্গ ছাগলেরও অধম। হেমাঙ্গ বলল, আমায় জিগ্যেস করছিস! সেই শ্লোকটা জানিস তো, অজাযুদ্ধে ঋষিশ্রাদ্ধে…? আমি যথার্থ ছাগল। শিং তুলে…

ডাবু হেসে শুধরে দিল, খাসি বল? ছাগলের শিং থাকে না।

ওই হল। আমিও তো এ যাবৎ অসংখ্যবার পাঁয়তারা করে বেড়ালুম। আসলে ও ধরনের ব্রেনই আমার নেই। তোর আছে।

ডাবু স্বীকার করে নিল।—তা আছে কিছুটা। ভাবতে পারিস, তিন দিদির বিয়ে আমিই দিয়েছি? জাস্ট এক বছরের মধ্যে।

ডাবুর দিদিদের দেখেছে হেমাঙ্গ। তবে স্পষ্ট মনে পড়ে না। বলল, তোর তো ভাই—টাই নেই?

ডাবু খিক খিক করে হাসল। বুকে টোকা মেরে বলল, ওনলি ওয়ান। তুইও তো তাই!

হুঁ। তবে ভাগ্যিস আমার দিদি বোন—টোন নেই। থাকলে কী বিপদে না পড়তুম!

ডাবু গলা চেপে বাড়ির ভেতর দিকটায় চোখের ইশারা করে বলল, ঘরে যখের ধন বাঁধা ইয়ার। কিছু ভাবনা ছিল না। হ্যাঁ রে, মুনাপিসি আমার গলা শুনে এল না কেন বল তো! ঝগড়া করেছিস নাকি?

ভাগ! তুই এলি, মুনাপিসিও খিড়কির দরজায় বেরুল। মনে হচ্ছে কলোনি—পাড়ায় গেল রান্নার মাল জোগাড় করতে। কিংবা বাজারে।

কেন? তুই এত লাটসাহেব যে বৃদ্ধা মহিলাকে বাজার করতে হয়? হেমা, এবার একটু গা ঘামা তো বাবা। বয়স তো কম হল না। মানবজীবন আবাদ করে সোনা—টোনা কবে আর ফলাবি?

হেমাঙ্গ হো হো করে হেসে উঠল।—তুই পেরেছিস ফলাতে। আমার জমিটাই বাঁজা।

কপট গাম্ভীর্যে ডাবু চোখে একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, না—ভুল বলছি। ফলিয়েছ বটে। একটা চালকুমড়ো!

তার মানে?

মানে আবার কী? অমি।

যাঃ! হেমাঙ্গর কানের পাশটা লাল হয়ে গেল।

ডাবুর এই উক্তি অপ্রত্যাশিত। অমির প্রসঙ্গে এ ধরনের ব্যাপার নিয়ে—তা যত সামান্য হোক, ডাবু কোনোদিন তার সঙ্গে ঠিক এভাবে আলোচনা করেনি। অমির নায়িকা—অস্তিত্বই যেন ডাবুর কাছে ছিল না। হঠাৎ এভাবে অমির কথা কেন বলে বসল? হেমাঙ্গ অবাক হয়। ব্যস্ত হয়ে সিগারেট খুঁজতে থাকে।

ডাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিং সাইজের দামি সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলে, খা।

উঠে বোস। তুই যে দেখছি রাজা হয়ে গেছিস ডাবু!

না। এ মাল নিজের জন্যে নয়, পরার্থে। তবে তোমার মতো ক্ষুদে কাপ্তেনের জন্যে নিশ্চয় নয়। বিগ—বিগ ওমরালোকের জন্যে। বুঝলে? আমি সেই চারমিনারেই পড়ে আছি।

তাহলে দিচ্ছিস যে?

ডাবু ফিসফিস করে চোখে ঝিলিক তুলে বলে, একটা ব্যাপারে তুই আমাকে মেরে বেরিয়ে গেছিস, ভাই।

কীসে রে?

নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাবু জানালার বাইরে যেন আকাশ দেখতে দেখতে বলে, তুই লালুর বোনের সঙ্গে প্রেম করতে পেরেছিস। আমি পারিনি।

হেমাঙ্গ ধাঁধায় পড়ে যায়। অমির সঙ্গে প্রেম! ডাবু তো ওদের বাড়িরই আত্মীয় এবং কী সম্পর্কে অমিদের ভাইও যেন। তাছাড়া ডাবু অমির সঙ্গে প্রেম করতে চেষ্টা করেছিল, এ খবর হেমাঙ্গর কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য।

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, বলিস কি! অমি তোর কীরকম বোন হয় যেন?

তাতে কী? ডাবু কৌতুকের ভঙ্গিতে বলে।

ভাগ! বড্ড বেহায়া হয়ে গেছিস তুই! যত রাজ্যের খোট্টাদের সঙ্গে মিশে একেবারে গেছিস!

ডাবু মিটিমিটি হাসে। ওর চোখ দুটো এ সময় ভারী সুন্দর দেখায়। বলে, যদি রিলেশনের কথাই তুলিস, অমিদের সঙ্গে আমাদের কোনোরকম ব্লাড কানেকশান নেই। মাসির পিসির পায়ের ঘায়ের ছেলের ডাক্তার না কি যেন বলে, সেই রকম। অমির ঠাকুরদা আর আমার ঠাকুরদা দুজনেই পাটনায় রেলের কোয়ার্টারে পাশাপাশি থাকতেন। রিটায়ার করার কিছু আগে অমির ঠাকুরদা মোহনপুরে বদলি হয়ে এসেছিলেন। রিটায়ার করার পর এখানেই জমিজায়গা কিনে বাড়ি করলেন। জায়গাটা পছন্দ হয়েছিল। আর আমার ঠাকুরদা বদলি হয়েছিলেন জামসেদপুরে। সেখানে বাবা রেলে না ঢুকে টাটা কোম্পানির টেলকোতে অ্যাপ্রেন্টিস হলেন। বুড়ো ছেলের এই ব্যাপার—স্যাপার দেখে বিগড়ে গেলেন। মোহনপুরের বুড়ো ততদিন তাঁকে এখানে এসে বাস করার জন্যে প্ররোচিত করে আসছেন। ব্যস! ঠাকুরদা সত্যি একদিন মোহনপুরে একটা পুরনো বাড়ি কিনে বসলেন।

হেমাঙ্গ বলে, ভেরি ইন্টারেস্টিং। জানতুম না তো! বল।

ডাবু সিগারেট ধরায় এবং হেমাঙ্গরটা জ্বেলে দিয়ে বলে, কিন্তু পিছনে কবে যম এসে ওয়েট করছে ঠাকুরদা টের পাননি। বাড়ি কেনার মাস তিনেকের মধ্যে অক্কা! বোঝ ব্যাপার।

তারপর? হেমাঙ্গ আগ্রহে প্রশ্ন করে।

বাবা শেষ পর্যন্ত ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মোহনপুরে। আমি তখন হাঁটি হাঁটি পা পা। যাই হোক, ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বছর চার পাঁচ থাকল বাড়িটা। আমরা, অর্থাৎ তিন দিদি—এক ভাই মায়ের সঙ্গে এখানে থাকি। বাবা ছুটি—ছাটায় আসেন। কিন্তু দু’জায়গায় আর কাঁহাতক টানাটানি করা যায়। শেষ পর্যন্ত বাবা আমাদের জামসেদপুরে তুললেন। ভালো কোয়ার্টার পেয়েছিলেন ততদিনে। তার পরেও বছর পাঁচ—সাত এখানকার বাড়িটা ছিল। লালুর জ্যাঠামশাই দেখাশোনা করতেন। ভাড়া দেওয়া হয়েছিল এক মারোয়াড়িকে। তারপর বাবা ওকেই বেচে দিলেন শেষ পর্যন্ত। অ্যান্ড দিস ইজ দা হিস্ট্রি।

…ডাবু সিগারেটে একটা জোর টান মারে। তারপর প্রচুর ধুঁয়ো ছাড়তে ছাড়তে এবং রিং তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করে ফের বলে, তাহলে বুঝতেই পারছ, অমির সঙ্গে প্রেম করতে মর্যাল কোনো বাধা ছিল না। অ্যান্ড আই ভেরি ম্যচ ট্রায়েড!

প্রেম হল না কেন? হেমাঙ্গ হাসে একটু।

তুই শালার জন্যে! বলে ডাবু আবার প্রচণ্ড জোরে হেসে ওঠে। তারপর একটু ঝুঁকে এসে ফের বলে, নো, নেভার। তার জন্যে তোর প্রতি এতটুকু ঈর্ষা বা রাগ—টাগ হচ্ছে না। কারণ আমি এতকাল টেরই পায়নি যে তোরা তলে তলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস। এবার এসেই সব জানতে পারলুম।

কী জানলি, শুনি? হেমাঙ্গ একটু ক্ষোভের ভঙ্গিতে বলে কথাটা।

ডাবু গ্রাহ্য করে না। নির্বিকার বলে, কিছুটা আবছা ওদের বাড়িতেও বটে, কিছুটা বাইরের নানা সূত্রেও বটে, জানলুম যে অমির সঙ্গে তোর একটা জব্বর অ্যাফেয়ার চলছিল। ওদের ফ্যামিলি থেকে নাকি তোকে ইনসিস্ট করা হয়েছিল বিয়ে করে ফেলতে। তুই অমনি কেটে পড়েছিস। তারপর নাকি অমির মন ভেঙে যায় এবং আলটিমেটলি এই ভূতের ব্যাপার। গভীর দুঃখ—টুঃখ পেলে নাকি মেয়েদের কোমল আত্মা দুর্বল হয়ে যায়। তখন প্রেতাত্মাদের পোয়াবারো মাইরি! জাস্ট এমনি একটা অ্যানালিসিস শুনলাম।

কোথায় শুনলি? কার কাছে?

হাত তুলে ডাবু বলে, চ্যাঁচাসনে বাবা! সবকিছু এত সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন?

না। কে বলল ওসব কথা?

ডাবু হাসতে হাসতে বলে, আবার কে? আমার বিজ্ঞ জেঠিমা। তো আমি বললুম আচ্ছা জেঠিমা, তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সব থাকতে মুসহর বস্তির বহরী বুড়ির মেয়েটা কেন ওকে ধরল বলুন তো? জেঠিমা বলল, আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বেহায়া অমি চূড়ান্ত বেহায়াপনা করে গতকাল নাকি তোর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসেছিল।…

হেমাঙ্গ বাধা দিয়ে বলে, মিথ্যে। অমির সঙ্গে আমার একমাস দেখা হয়নি।

শোন না। তারপর তুই নাকি ওকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছিস। তখন অমি সুইসাইড করতে যায় ডিস্টান্ট সিগন্যালের কাছে। যেই যাওয়া, ব্যস। সৈকা না ফৈকার ভূত ওকে বাগে পেয়ে যায়। কেমন অ্যানালিসিস?

হেমাঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলে, সবটাই বানানো। তবে একটা ব্যাপার কিন্তু সত্যি। অমি গতকাল সন্ধ্যায় বা তার আগে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝেন্টু নামে মুসহর ছেলেটা আছে—সে ওদের বস্তিতে শুনে ডনকে বলেছে। ডন কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলল।

ডাবু ওর একটা হাত চেপে ধরে বলল, তাহলে বাকিটাও সত্যি!

অসম্ভব। আমি মোহনপুরে ছিলুমই না ক’দিন। কলকাতায় ছিলুম। গত রাতে ফিরেছি।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। তুই অমিকে জিগ্যেস করলিনে কেন?

করলুম তো। উড়িয়ে দিল। মানে আমলই দিল না।…বলে ডন উঠে কয়েক পা পায়চারি করার পর ফের বলে, কলকাতা কেন রে?

পি এস সি—র একটা পরীক্ষা ছিল। সেক্রেটারিয়েট ক্লার্কশিপ।

ডাবু চেঁচিয়ে ওঠে, তুই কেরানি হবি? তুই কি পাগল, না কি! তোর মতো জুয়েল ছেলে! হেমা, মারব বলছি। মাইরি মেরে দেব। আমার খুব রাগ হচ্ছে।

হেমাঙ্গ হাসবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুখটা শুকনো। বলে, তাছাড়া আর করবটা কী, বল? পরের ঘাড় ভেঙে আর কতকাল খাব? হিউমিলিয়েশন না? কী যে বিচ্ছিরি লাগে!

ডাবু এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বলে, শোন। আমি এখানে এসে কন্ট্রাক্টারি করব ভাবছি। আফটার অল আমি আউটসাইডার।…

হেমাঙ্গ বাধা দিয়ে বলে মোহনপুরে প্রায় সবাই আউটসাইডার।

না। যা বলছি শোন। তুই লোকাল ম্যান। তোর মোটামুটি সুনাম আছে। অমির ব্যাপারে স্ক্যান্ডাল যা একটু রটেছে বা রটতে পারে। আসলে ওটা কী জানিস, এক ধরনের ব্ল্যাকমেলিং ওদের। ডনের জ্যাঠামশাই ভেবেছে, বামুনের ছেলের কাঁধে ভাইঝিটাকে চাপিয়ে দেওয়া যাক। বিনি পয়সায় পার পাওয়া যাবে। তাছাড়া একটা কথা, ওরে ভাই, জাত—পাতের নানান কমপ্লেক্স শালা মানুষের হাড়ে হাড়ে আছে, বুঝলি তো? এ জিনিস যাবার নয়।

তুই বিহারে থাকিস কি না? জাত—ফাতের ব্যাপারটা তাই তোর মাথায় ঢুকে গেছে।

শাট আপ! যা বলছি শোন। লক্ষ্মী ছেলের মতো শুনে যা।

বেশ, বল।

ওরে বাবা, আমিও তো কায়েত বাচ্চা। আমার বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখ। এবার আমি ক’দিন থাকছি। জাস্ট প্রিলিমিনারি সার্ভে এবং নানান জায়গায় কনট্যাক্টগুলো করে ফিরে যাব। তারপর আসছি সামনের মাসে, দ্যাট ইজ, ধর বাই দা থার্ড উইক অফ এপ্রিল। কেমন? ইতিমধ্যে তোকে কিছু কনট্যাক্টের দায়িত্ব দিয়ে যাব, অন মাই বিহাফ। তুই রেগুলার যোগাযোগ করবি চিঠিতে, কিংবা জরুরি বুঝলে বাই টেলিগ্রাম। এমনকি ট্রাঙ্ক—কলও করতে পারিস। এখানে তো দেখলুম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু হয়ে গেছে।

হয়েছে।

ডাবু খাটে বসে বলে, কাগজ বের কর। নোট করে নে।

হেমাঙ্গ এখনও ভাবছে, এটা নিছক একটা খেলা। সেই ভঙ্গিতেই সে কাগজ হাতড়ায়।

মুনাপিসির গলা শোনা গেল বাইরে।—ডাবু এসেছে শুনলুম! কই সে ছোঁড়া? পরশু এসে যে বলে গেল, পিসিমা তোমার সঙ্গে ছানার ডালনা দিয়ে ভাত খাব…

ভেতরের উঠোন থেকে মুনাপিসি কথা বলতে বলতে হাতের মুঠো পাকিয়ে ঘরে ঢুকল।—কই সে বাঁদর? মারব? মারব মাথায় এক গাঁট্টা?

বলে ডাবুর রাশিকৃত চুলে হাতের মুঠোটা ঘষেও দিল। ডাবু মাথায় হাত দিয়ে বলল, উহুহু! খুব লেগেছে, খুব লেগেছে! তারপর জিভ কেটে হাত জোড় করে ঘোরে।

মুনাপিসির হাতে একটা থলে। থলেটা তুলে মারার ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে, আমার অতটা ছানা নষ্ট করেছ। তোমাকে খুন করে ফেলব। প্রমথবাবুরা না হয় বড়লোক। আমরা গরিব। তাই বলে এত হেনস্তা!

ডাবু খপ করে থলেটা ধরে ফেলে। বলে, কী আনলে দেখি না পিসিমা!

দেখাব। বল, এ বেলা খাবি নাকি?

তা আর বলতে? ডাবু হেমাঙ্গর বুকে আঙুলের খোঁচা মেরে বলে, এই হেমার মতো আমার একটা মুনাপিসি থাকলে উঃ! আজ আমি কী যে হতুম!

খুব হয়েছে। বলে মুনাপিসি ভেতরে যায়। যেতে যেতে বলে, হেমা, জিতেন গয়লা এখনও দুধটা দিয়ে গেল না রে! আজও আবার নষ্ট বলবে নাকি। আর পারা যায় না বাবা। মোহনপুরে দুধের অমিল হবে কে ভাবতে পেরেছিল।

ডাবু বলে, সে কি! দুধ পাওয়া যাচ্ছে না?

ভেতরের বারান্দা থেকে মুনাপিসি বলে, যাবে কেমন করে? সব দুধ তো ড্রাম ভর্তি করে চালান দিচ্ছে। অল্প স্বল্প যেটুকু রাখে, জল মিশিয়ে ডবল দরে এখানে বেচে। সবাই কলকাতা চিনে ফেলেছে যে!

ডাবু হেমাঙ্গকে বলে, অ্যাদ্দিন তুই একটা ডেয়ারি করলে পারতিস। কিংবা ধর, ওদের মতো দুধ কিনে কলকাতা চালান দিতিস। কত পুঁজি লাগে?

হেমাঙ্গ বলে, বাপস! ঘোষ কোম্পানি থাকতে?

সে আবার কে?

তুই চিনবি। সেই যে রাইট ব্যাকে খেলত গয়লাদের ছেলেটা। মনে পড়ে?

পোদো?

এখন পোদো নয়, প্রদ্যোৎ কুমার ঘোষ। ঘোষ কোম্পানির মালিক। জিপ কিনেছে।

চিন্তান্বিত গম্ভীর ডাবু বলে, মোহনপুরের প্রচুর উন্নতি হয়েছে রে। নানান ব্যাপারে প্রসপেক্ট আছে।

হেমাঙ্গ বুঝতে পারে, ডাবু একটা কিছু করতেই এসেছে এবার। এবং পারবেও। ডাবু একটু বেশি কথা বলে, তা ঠিক। কিন্তু ওর মধ্যে একটা শক্তি আছে, মানুষকে প্রভাবিত করার শক্তি। অবস্থা বোঝার এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছবার শক্তি। এ সব হেমাঙ্গর নেই।

মুনাপিসি ভেতর থেকে বলে, ডাব! ভেতরে আমার কাছে আয়। গল্প করি। হেমা একবার দেখে আসুক জিতেনকে। হেমা, যাচ্ছিস তো?

যাচ্ছি। বলে হেমাঙ্গ ওঠে।—ডাবু, তাহলে পিসিমার কাছে যা। আমি এখুনি আসছি।…

হেমাঙ্গ সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল। পথেই জিতেনের সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে জানায়, একটু দেরি হয়ে গেল বাবু। ভোরবেলা গিয়েছিলুম সেই চাঁদপাড়া—হাঁড়িভাঙা মেয়েকে দেখতে। অসুখ হয়েছে। ফিরতে ফিরতে লোকাল পাস করে গেল। তারপর দুধ দুইয়ে দৌড়ে আসছি।

হেমাঙ্গ সিগারেট কিনতে লিচুতলা বাজারে ঢুকল। এটাই সাবেকি বাজার। বড় পোলের এপারে টাউনশিপের মাঝখানটিতে। হাটও বসে এখানে। তবে স্টেশন বাজারের মতো ঠাসা ভিড় নেই।

সিগারেট কিনে একটা ধরিয়ে নিয়ে, ইচ্ছে করেই সে অমিদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে ঠিক করল।

প্রচুর গাছপালার মধ্যে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকা বাড়ি এখানটায়। বেশ নির্জন ও শান্ত। এই বাড়িগুলোর বেশিরভাগই প্রাক্তন রেল অফিসারদের কিংবা যাঁদের বলা হয় রেলকর্মী, তাঁদেরও। রিটায়ার করার পর ওঁরা এখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন। মোহনপুরের কী একটা টানের ব্যাপার আছে। যে আসে, তারই ভালো লেগে যায়। আর নড়ার নাম করে না।

আস্তে আস্তে প্যাডেল ঠেলছিল হেমাঙ্গ। আকাশ কখন হালকা মেঘে ঢেকে ফেলেছে। বৃষ্টিমেঘ নয়। চৈত্রের ভীতু নিরীহ কোমল সেই মেঘ, মেষপালের মতো। চৈত্রের এই মেঘলা আকাশ ভালোই লাগে। বড় নিরুপদ্রব এবং রোদ থাকে না বলে। হাওয়া দিচ্ছে জোরালো। বাঁদিকে মোড় নিলে খাল বা সেই ক্যানেল। ওখানে ঘন নিমবন আছে। হেমাঙ্গর মনে পড়তেই নাক তুলে শোঁকে। নিমফুলের গন্ধ কী মিষ্টি। ছেলেবেলায় এমন মেঘলা দিনে ফুল ও নিমডাল ভেঙে পুজোপুজো খেলত ছেলেমেয়েরা। মুখে ঢাক বাজাত এবং ডালটা ঢাকের কেশর ভেবে দোলাত। হেমাঙ্গ তখন ঠিক বাচ্চা নয়, পুরোদস্তুর কিশোর। পায়ে নতুন বুট। বাবা দিয়ে গেছেন। অমি বলত, এই! তুমি জুতো পরে খেলছ কেন ভাই? খোল।…বলে ফ্রক পরা অমি নিঃসঙ্কোচে সামনে বসে তার জুতো খুলে দিত। ফিতে বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে বলত, এসো, এবার খেলি! অমির সাদা ধবধবে সরু আঙুলগুলো চোখে ভাসছে।

হেমাঙ্গ অন্যমনস্ক হয়েছে। কখন অমিদের বাড়ি পেরিয়েছে, খেয়াল নেই। যখন টের পায়, সাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘোরায়। এবং দেখতে পায়, অমি দোতলার জানালা থেকে সরে গেল এইমাত্র।

একটু আগে কেন হেমাঙ্গ তাকায়নি? সাহসের অভাব! নিজের ওপর ক্ষোভে দুঃখে অস্থির হয় সে।…