বারো
আরও তিনটে দিন কেটে যায়। হেমাঙ্গ কান পেতেই থাকে, ডনের গ্রেপ্তারের খবর শুনবে। হরসুন্দরের চায়ের দোকান, গুলাইয়ের হোটেল—আরও কয়েকটা পুরনো আড্ডার জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। কিন্তু তেমন কোনো খবরই নেই। পুলিশের ওপর চটে যায় সে। আরও অস্বস্তিতে ভোগে। তাহলে কি ডনকে ধরতে চায় না পুলিশ? জ্ঞানবাবুর অথবা আকবরের হাত থাকাও সম্ভব। না—সম্ভব এখানে ভুল শব্দ। আকবর নিজের বাড়িতে তো তাকে লুকিয়ে রেখেছে!
হেমাঙ্গ বুঝতে চেষ্টা করে, কেন সে ডনকে এত ভয় পায় বরাবর? বুঝতে পারে না। শুধু মনে হয় ডন একজন জন্ম—আততায়ী। মোহনপুরের অন্ধকার জগতের সে এক শক্তিমান ক্ষুদে রাজা। অথচ হাতাহাতি লড়লে হেমাঙ্গের সঙ্গে সে গায়ের জোরে পারবে না হয়তো।
আর কলকাতায় জুয়েলারি দোকানের ডাকাতি কেসটা ধামাচাপা দিতে কতক্ষণ? নেহাত কাগজপত্রের পদ্ধতি বজায় রাখতেই আই.বি. তাকে জেরা করতে এসেছিল, সেটা বুঝতে পারছে হেমাঙ্গ।
কিন্তু আপাতত ডনকে মোহনপুর থেকে সরাতে পারলে টলুর সঙ্গে বোঝাপড়া করা যেত। টলু মেয়ে। প্রমথ বোস বেঁচে থাকতে বিধবা মেয়ের কেলেঙ্কারি রটতে দেবেন না, টলু যতই শাসাক।
হেমাঙ্গ বিকেলে বেরুবে বলে তৈরি হচ্ছে, হাবুর সাড়া পেল। ডাবু রাস্তা থেকে চেঁচাচ্ছে—হ্যামা। এই হ্যামা!
হেমাঙ্গ বেরোয় বারান্দায়। ডাবু ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে একলাফে উঁচু বারান্দায় ওঠে। হেমাঙ্গ বলে, এসে গেছিস!
ডাবু ওর জামার কলার খামচে ধরে বলে, তুই শালা যদি কিছু না করবি, মিছিমিছি আমাকে ভোগালি কেন?
হেমাঙ্গ কৈফিয়ত দেয়। মুশকিল কী জানিস? প্রমথ—জ্যাঠা আমাকে পাত্তাই দেন না। নিজে ইনিশিয়েটিভ নিয়েছেন। আমি ব্যাপার দেখে চুপ করে আছি।
ডাবু যুক্তিটা মেনে নেয়। সেটা খানিকটা আঁচ না করেছি, তা নয়। যাক গে, শোন। টেলিগ্রাম পেয়ে দৌড়ে এসেছি। কমিউনিটি সেন্টারের কাজটা পেয়ে গেছি।
পাবিই। তোর হবুশ্বশুরের কেরামতি!
ডাবু জিভ কেটে বলে, যাঃ! মিলুকে আমি বিয়ে করব ভেবেছিস? ও একরত্তি মেয়ে। আমার বডিটা দেখছিস না? সে হো—হো করে হাসে।
ভেতর থেকে মুনাপিসির সাড়া আসে। ডাবের গলা শুনছি নাকি রে হেমা?
ডাবু বলে, হ্যাঁ পিসিমা।
আয় রে, আয়। তোকে দেখি।
যাচ্ছি। হ্যামার সঙ্গে বোঝাপড়াটা সেরে নিই আগে।
হেমাঙ্গ বলে, আবার হ্যামা—হ্যামা করছ? ভেরি ইনসাল্টিং!
ডাবু চোখ নাচিয়ে বলে, তোর চেহারা এমন শুটকিমাছের মতো হয়ে গেছে কেন রে? একেবারে অমির মতো। হুবহু! ধন্যি বাবা প্রেম! তোমার খুরে নমস্কার।
হেমাঙ্গ বলে, ওদের বাড়ি আর আমি যাই নে রে।
কেন, কেন?
এমনি। হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থাকার পর ফের বলে তোকে বলব সব।
এক্ষুনি বল।
হেমাঙ্গ বাড়ির ভেতরদিকে ইশারা করে ঠোঁটে আঙুল রাখে। ডাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেট বের করে। হেমাঙ্গ বলে, আয় না—বটতলার দিকে ঘুরে আসি।
চল। ডাবু ভেতরে উঁকি মেরে মুনাপিসির উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে, পিসিমা, আসছি আমরা। এক্ষুনি আসছি তুমি রেডি হয়ে থাকো।
মুনাপিসি বলে, তোর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবি নাকি রে?
হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে নেমে আসে ডাবু। হেমাঙ্গ তখন রাস্তায়। দুজনে কিছুটা এগোলে সতর্ক মুনাপিসি ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।
শ্মশানতলার আগে গাবগাছটার কাছে দাঁড়িয়ে দুজনে সিগারেট ধরায়। ডাইনে পশ্চিমে কিছুটা দূরে বাঁজা চটানের দিকে তাকিয়ে ডাবু বলে, উরেব্বাস। ওখানে কারা ফুটবল গ্রাউন্ড করল রে হেমা?
হেমাঙ্গ ঘুরে দেখে অবাক হয়। কে জানে। আজই প্রথম দেখলুম।
কারা ওরা?
মনে হচ্ছে রিফিউজি কলোনির ছেলেরা। হেমাঙ্গ ওদের দেখতে দেখতে বলে। ব্যস! আর কী! দেখল হয়ে গেল। নন্দীবাবুদের বোনমিল প্রজেক্ট খতম! তবে এটা ভালো হল জানিস? বাড়ির কাছে বোনমিল! গন্ধে টেঁকা দায় হত।
আয় না, দেখে আসি খেলা।
হেমাঙ্গ ওকে টেনে আটকায়। তোর পা সুড়সুড় করতে লেগেছে? ছাড় ওসব। কথা আছে অনেক। আয়, খালের ধারে বসি।
আগাছার মধ্যে দিয়ে দুজনে খালের ধারে যায়। ঘাসে বসে। ডাবু পাছার তলায় রুমাল রাখতে ভোলে না। হেমাঙ্গ চটানের দিকে ঘুরে বসেছে। হালকা পাটকিলের রঙ রোদ খেলছে। খেলোয়াড়দের সিল্যুট মূর্তিগুলো ছোটাছুটি করছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, হুলোও খেলছে ওদের সঙ্গে। পান্তলুন গুটিয়ে হাঁটুঅব্দি তুলে একজায়গায় দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে। কুঁজো হয়ে হাততালিও দিচ্ছে।
হেমাঙ্গ একটু চুপচাপ থাকার পর বলে, অনেক সিরিয়াস ব্যাপার ঘটেছে। তুই শোন। তারপর আমাকে বলবি, কী করা উচিত। তুই আমার চেয়ে অনেক ইনটেলিজেন্ট ডাবু—অন্তত সাংসারিক ব্যাপারে। তোকে যা বলব, ভেরি ইমপরট্যান্ট এবং কনফিডেনসিয়াল—মাইন্ড দ্যাট।
ডাবু হাঁটুতে তবলা বাজাতে বাজাতে বলে, হুঁ, বল। হেমাঙ্গ শুরু করে।
আগাগোড়া সবটাই বলে সে। শংকরার কাছে যা কিছু শুনেছে, এবং অমিরও সায় দেওয়ার আভাস পেয়েছিল এক সন্ধ্যায় ওই চটানের ওখানে, ডিটেলস শোনায়। ডনের রিভালবার প্রসঙ্গও। কিছু টলুর সঙ্গে তার ঝড়ের সন্ধ্যার ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। এড়িয়ে যায়, হুলোর কাছে শুনে ডনকে ধরিয়ে দিতে থানায় খবর দেওয়ার ব্যাপারটাও।
সব শুনে ডাবু দুলতে দুলতে মুচকি হেসে বলে, হ্যামা! তুই মাইরি একটা ছাগল।
কেন?
তুই টলুদি’কে ডনের পিস্তল দিতে গেলি কেন? অমি ছিল না—চলে এলেই পারতিস।
টলুদি—একটু ইতস্তত করে হেমাঙ্গ বলে, টলুদিকে তো তুই জানিস! আমার পকেট হাতড়াতে গিয়ে দেখে ফেলল। তখন—
ওয়েট, ওয়েট! তোর পকেট হাতড়াতে এল টলুদি? ডাবু খ্যাক খ্যাক করে হাসে। একটা অশ্লীল জিনিস উল্লেখ করে বলে, তা ভালো। খুব ভালো। হাতড়াতে এল টলুদি! তোর মতো হাঁদারামকে পেয়েছে একা। বাঘিনি ছাগল পেয়েছে নিজের খাঁচায়। ফাইন!
হেমাঙ্গ বিব্রত হয়ে বলে, না, না! তেমন কিছু নয়।
চা—ও—প, বে! মায়ের কাছে মাসির বাড়ির কথা শোনাচ্ছে! আমি জানিনে টলুদি কী জিনিস? আমি ঘরপোড়া গোরু।
বলিস কী? তুইও তাহলে পড়েছিলি ওর পাল্লায়?
ডাবু ঘাসেভরা ঢালু পাড়ে পা ঝুলিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে, গা ঘিনঘিন করে। বলিস নে। যাক গে, ছেড়ে দে। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে ডনের পিস্তল নিয়ে তুই ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিস। কেমন তো?
মানে, ডন এখনও ফেরারি! ও নিশ্চয় লুকিয়ে বাড়ি আসবে কোনো এক সময়ে। অমির কাছে ওটা চাইবে। অমি বলবে, আমাকে রাখতে দিয়েছিল।
ডাবু কথা কেড়ে বলে, অমিকে আমি ম্যানেজ করছি। ভাবিস নে।
অমির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে বললুম না? ও গোঁ ধরে আছে।
ভাব হতে কতক্ষণ? তোদের এ ব্যাপার তো ছেলেবেলা থেকে দেখছি।—বলে ডাবু ওর কাঁধে হাত রাখে। আমার সঙ্গে আয়। অমির সঙ্গে তোর আন্ডারস্ট্যান্ডিং করিয়ে দিচ্ছি।
সূর্য ডুবে গেছে ততক্ষণে। ধূসর কালো ধূসরতর হয়েছে। চটান থেকে ছেলেরা হুল্লোড় করে ফিরে আসছে। তারা হল্লা করতে করতে পিছনের রাস্তা দিয়ে চলে গেলে হেমাঙ্গ লক্ষ্য করে হুলো একটু দাঁড়িয়ে তাদের দেখল! যেন আসবে ভাবল। তারপর চলে গেল।
ডাবু বলে, ওঠ। তার এখানে বসা উচিত নয়। সাপ বেরুবে।
তারা রাস্তায় যায়। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে হেমাঙ্গ বলে, অমিকে তুই কোনোভাবে ডেকে আনতে পারিসনে ডাবু? ওদের বাড়ি যেতে আমার ইচ্ছে করে না।
টলুর ভয়ে তো?
ধর, তাই।
রামছাগল! ডাবু হো—হো করে হাসে। তারপর গম্ভীর হয়ে যায়।—হেমা! অমির যা অবস্থা দেখলুম, সত্যি বড্ড উইক। ওকে বাইরে নিয়ে আসা মানে কষ্ট দেওয়া। তুই চল না বাবা। বলছি, তোকে ইনসালটেড হতে হবে না। কে ইনসাল্ট করবে তোকে? আয়।
হেমাঙ্গ অনিচ্ছা নিয়ে পা বাড়ায়। তারপর বলে, পিসিমা রাগ করবেন যে! তুই দেখা করে আয়।
ডাবু জিভ কেটে বলে, উঁহু। এখন নয়। সন্ধ্যায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কাল সকালে আসব’খন। আয়!
হেমাঙ্গ সারা পথ চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক। ডাবু গুনগুন করে গান গায়। বোস বাড়ির গেটের দেখা হয় প্রমথের সঙ্গে। বেরুচ্ছেন, হাতে ছড়ি আর টর্চ। বলেন, ওটা কে? হেমা? কোথায় ছিলে হে? তোমার পাত্তাই নেই। পিসিমা অসুস্থ বলেছিলে। কেমন আছেন?
হেমাঙ্গ বলে, ভালো। আপনি বেরুচ্ছেন?
একবার ঘুরে আসি। তোমরা যাও। জেঠিমা আছেন।—প্রথম ডাবুর দিকে ঘুরে বলেন, আকবরের সঙ্গে দেখা করেছ ডাবু? খপর পাঠিয়েছিল। দেখি কী ব্যাপার?
ডাবু বলে, কোন গোলমাল করছে নাকি?
প্রমথ মাথা নাড়েন।—না, না। টেন্ডার তো অফিসিয়ালি অ্যাকসেপ্টেড। অন্য কোনো ব্যাপারই হবে। কতকটা আঁচও করেছি। শুনলুম আকবরদের গাঁয়ের বাড়িতে সার্চ করেছে পুলিশ। ডন নাকি ওখানে আছে বলে খবর পেয়েছিল পুলিশ। কোথায় ডন? খামোখা কেলেঙ্কারি!
প্রমথ চলে গেলে দু’জন লন পেরিয়ে যায় পাশাপাশি। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। জন আর ইলু পড়তে বসেছে মাস্টারমশায়ের কাছে। ডাবু হেমাঙ্গর হাত ধরে টেনে ভেতরের বারান্দায় যায়। বারান্দায় কেউ নেই। টলুর ঘরের দরজা বন্ধ। সিঁড়ির পাশের ঘরে সুলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে। টলু সেখানেই আছে হয়তো।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠে দু’জনে। বাঁ পাশে মিলুদের ঘরে আলো জ্বলছে। মাঝের ছোট্ট ঘরটা বন্ধ। ডাইনে ডনের ঘরেও আলো জ্বলছে। পর্দা টাঙানো। হেমাঙ্গের মনে হয়, অসুস্থ অমিকে এভাবে একা ফেলে রাখে এরা! বড় অদ্ভুত এ বাড়ির লোকগুলো।
ডাবু হেমাঙ্গের দিকে চোখ নাচিয়ে অমির উদ্দেশ্যে একটু গলা ঝেড়ে বলে, আসতে পারি ম্যাডাম?
কোনো সাড়া না পেয়ে ডাবু পর্দা তোলে।
হেমাঙ্গ দেখতে পায়, অমি কাত হয়ে শুয়ে আছে।
ডাবু ভেতরে ঢুকলে, সেও ঢোকে। ডাবু তার কাঁধে হাত রেখে ডাকে, অমি! ঘুমোচ্ছ? এই সন্ধ্যাবেলা!
কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার ডাকাডাকি করে। হেমাঙ্গ লক্ষ্য করে অমির পায়ের পাতা দুটো বেঁকে রয়েছে, সে বলে, ও কী রে! ওর পা’দুটো দ্যাখ!
ডাবু ফস করে নিশ্বাস ফেলে বলে, তাহলে ফিট হয়ে আছে।
অমির চুল পিঠ, কাঁধ আর বিছানা জুড়ে ছড়ানো।
এক হাতের মুঠোয় বালিশ খামচে ধরে আছে। মুখটা একপাশে কাত। হেমাঙ্গের বুকে কষ্ট ঠেলে ওঠে।
ডাবু অমিকে চিত করে শোয়ানার চেষ্টা করে। অমির শরীরও বেঁকে সিঁটিয়ে রয়েছে। ঘোরানো যায় না। পেটের কাপড় সরে গেছে। পেটটা ফাঁপছে। ফুলে ফুলে উঠেছে। ডাবু বলে, ওই দ্যাখ! টেবিল জল আছে গেলাসে। দে তো হেমা!
হেমাঙ্গ জলের গেলাস দিলে ডাবু অমির মুখে ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু অমির কোনো সাড়া নেই। তখন ডাবু বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে ডাকে, টলুদি! টলুদি!
টলু সাড়া দিতে উঠোনে নেমেছে। সেখান থেকে বলে, কী রে ডাব?
অমি ফিট হয়ে পড়ে আছে যে!
থাক না। ওকে তুই ঘাঁটাতে গেলি কেন?
বা রে! এমনি হয়ে পড়ে থাকবে?
টলু চটে গিয়ে বলে, যা বুঝিসনে, কেন করিস বাবা? ডাক্তার বলেছে ওকে নিয়ে হইচই করলে ফিট বেড়ে যাবে। পড়ে থাকতে দে। নিজে থেকেই ছেড়ে যাবে। রোজ দেখছিনে আমরা?
ডাবু তবু বলে, স্মেলিং সল্ট নেই?
এবার টলু উঠে আসে হন্তদন্ত হয়ে। তার ধুপধুপ শব্দে বাড়ি যেন কাঁপতে থাকে। হেমাঙ্গ গম্ভীর মুখে বসে থাকে। টলু ডাবুর সঙ্গে ঘরে ঢুকে হেমাঙ্গকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। বাঁকা হেসে বলে, তাই বলো! স্বয়ং বড় ডাক্তার হাজির।
ডাবু অমিকে দেখতে দেখতে বলে, এমনি করে হাত—পা বেঁকিয়ে পড়ে থাকবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। থাকবে।—বলে টলু হেমাঙ্গের দিকে ঘোরে। তবে আজ বড় ডাক্তার এসে গেছে। ভাবনা নেই অমির। টলু হাসতে থাকে।
হেমাঙ্গ কথা বলে। ডাবু খাটের পাশে সোফায় বসে সিগারেট বের করে হেমাঙ্গকে এগিয়ে দেয়। তারপর বলে, খুব ভুল হচ্ছে তোমাদের টলুদি। আরার মনে হয়, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখালে ভালো হত।
খরচ কে দেবে? তুই?—টলু ভুরু কুঁচকে বলে।
হুঁউ। দেব। দেওয়া উচিত।
টলু চোখ নাচিয়ে হেমাঙ্গকে দেখিয়ে বলে, বদান্যতা দেখিয়ো না ডাবচন্দর। হেমা ইনসালটেড ফিল করবে। নারে হেমা?
হেমাঙ্গ চটেছে। কী বলতে যাচ্ছিল, নীচে পল্টের গলা শোনা গেল। ঘণ্টার মাকে কী বলছে জোর গলায়। টলু বলে, আবার বুড়ির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে হতচ্ছাড়া। দেখাচ্ছি মজা!
সে বেরিয়ে যায়। ডাবু আর হেমাঙ্গ অমির দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানে চুপচাপ। ডাবু হাত বাড়িয়ে দেয়ালের তাক থেকে ডনের সুদৃশ্য অ্যাসট্রেটা টেনে নেয়। সামনে রাখে।
একটু পরে টলুর পায়ের শব্দ শোনা যায় সিঁড়িতে। দুমদাম করে দৌড়ে উঠছে। হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে বলে, এই! জানিস? হুলোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
হেমাঙ্গ তাকায়।—কী হয়েছে?
মালগাড়িতে চাপা পড়েছে! পল্টে দেখে এল?
হেমাঙ্গ লাফিয়ে ওঠে।—কোথায় টলুদি?
মুসহর বস্তির ওখানটায়। সৈকা যেখানে চাপা পড়ে ছিল! টলু ডাবুকে বলে হুলোরে! সেই ছেলেটা—গুলাইয়ের হোটেলে থাকত! প্রায়ই ডনের সঙ্গে আসত আমাদের বাড়িতে!
ডাবু বলে হেমা! কোথায় যাচ্ছিস?
আসছি।
যাসনে বাবা। লাশ—টাস দেখে ভয় পেয়ে যাবি অমির মতো। আয়, বোস।
না রে!—বলে হেমাঙ্গ টলতে টলতে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু রাস্তায় নেমে সে গতি কমায় হঠাৎ। তার চোখ ফেটে ঝরঝর করে জল এসে যায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে সংযত থাকার চেষ্টা করে সে।
মধ্যরাতে মোহনপুরের আকাশে মেঘের ডাক শোনা গেল। একটু পরে গাছপালা শনশন করে উঠল। ঝড় আসছে। হেমাঙ্গ বাড়ির ভেতরদিকের জানালা দুটো খোলা রাখেনি আজ রাতে। শুয়ে সিগারেট খেতে খেতে ঝড়ের শব্দ শুনতে থাকল সে।
একটু পরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রথমে বড় বড় ফোঁটায় চড়বড় ভারী শব্দ। তারপর ঝিরঝির এলোমেলো বৃষ্টি। হাওয়ার দাপট কমেনি। এখনও কি হুলোর মড়া রেলইয়ার্ডে পড়ে আছে? নিশ্চয়ই নেই। তুলে নিয়ে গেছে।
অথচ খালি মনে হচ্ছে, ছেলেটা শুয়ে আছে লাইনের ওপর। নতুন প্যান্ট জামা জুতো পরে উপুড় হয়ে আছে। মাথাটা গুঁড়ো। চবচব করছে রক্ত। রক্ত ধুয়ে রেল গড়িয়ে ঘাসের পাতায় নেমে যাচ্ছে। একটা অনাথ ছেলে—মা বাবার পরিচয় জানে না, পৃথিবীসুদ্ধ তার আপনজন। বোকা সরল নিষ্পাপ কিশোর।
হেমাঙ্গ উত্তেজনায় উঠে বসে। পা ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ বসে হুলোর কথা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। পারে না। লোকে নিশ্চয় সৈকার মতো গলা টিপে মেরে চলন্ত মালগাড়ির চাকার তলায় গুঁজে দিয়েছে ডনের চেলারা।
ঝেণ্টুই একাজ করেছে। হেমাঙ্গের এই দৃঢ়বিশ্বাস। ইদানীং ডনের বদলে ঝেণ্টুর সঙ্গেই সে ঘুরে বেড়াত। আকবরের বাড়িতে ডনের থাকার কথা হুলো জানত। হুলোর পেটে কথা থাকে না, কে না জানে মোহনপুরে? একদিন হেমাঙ্গই তো তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। হুলো জেরার চোটে নিশ্চয় কবুল করে গেছে।
হেমাঙ্গ বুঝতে পেরেছে, এবার আরও বেশি করে নিজেকে নিজেই বিপন্ন করে ফেলেছে সে। এবার তার পালা। আততায়ী আসার চরম মুহূর্তের জন্য তাকে এখন তৈরি থাকতে হচ্ছে। কখন তার ছায়া ভেসে উঠবে সামনে—পেছনে, ডাইনে আর বাঁয়ে। সিল্যুট মূর্তিগুলো ক্রমশ তাকে বেড় দিয়ে ঘিরবে। ক্রমশ কাছে আসবে। তারপর—
তারপর আরও একটা দুর্ঘযনা ঘটবে রেল—ইয়ার্ডে।
হেমাঙ্গ হিংস্রভাবে উঠে দাঁড়ায়। অস্থির পায়চারি করে অন্ধকার ঘরে। হুলোকে ঝেণ্টুই মেরেছে। ডন অন্য কোথাও গা—ঢাকা দিয়েছে। সে রেল—ইয়ার্ডে আসেনি ওই সন্ধ্যাবেলায়। হুলো ফুটবল খেলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই মারা পড়েছে। কাজেই এ ঝেণ্টুরই কাজ। হুলো মাঠ থেকে সোজা ওর বাড়িতে গিয়েছিল। হয়তো।
হয়তো কেন? ঠিক তাই। হেমাঙ্গ টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে খাটের তলা থেকে লোহার মরচে ধরা রডটা টেনে বের করে। তারপরই কী এক শক্তি তাকে ভর করে। সে বাইরে দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় যায়। ঝাঁপিয়ে নীচে নামে। বৃষ্টি আর উত্তাল বাতাসের মধ্যে সে টলতে টলতে কাঠের ব্রিজে যায়। মুসহর বস্তির ও—পাশ ঘুরে রেল—ইয়ার্ডের ধারে পৌঁছায়। গেঞ্জি পাজামা ভিজে গায়ে সেঁটে গেছে। বৃষ্টিতে সব ঝাপসা দেখছে।
ঝেণ্টুর ঘরের দরজায় গিয়ে সে ডাকবে। ঝেণ্টু বেরিয়ে এলেই—
ঘোড়ানিমগাছটার তলা এসে বাঁদিকে ঝেণ্টুর ঘরের দিকে ঘোরার আগে অকারণে কিংবা অবচেতন তাগিদে সে ডাইনে একবার ঘোরে। সিগন্যাল পোস্টের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পায় সে—রাতের মতো। অমনি হেমাঙ্গ টলতে টলতে দৌড়য় সেদিকে। রেল—ইয়ার্ডের উজ্জ্বল আকাশ—বাতির আলো যদিও বৃষ্টিতে ঝাপসা, তবু অমি ছাড়া আর কে হতে পারে?
হেমাঙ্গ চিৎকার করে ওঠে, অমি।
অমি তার দিকে ঘুরে দৌড়তে শুরু করে—সে রাতের মতো। হেমাঙ্গ রড তুলে পাগলের মতো গর্জন করে ওঠে, অমি! দাঁড়াও—নইলে খুন করে ফেলব।
প্রচণ্ড শব্দে মেঘ ডাকে। বিদ্যুতের ছটা খেয়ে যায় আবার। হেমাঙ্গ সেই ছটায় দেখতে পায়, অমি ভাঙা ওয়াগনটার মধ্যে ঢুকে পড়ল।
হেমাঙ্গ ঢুকেই আছাড় খায়। ভেতরে ইঁদুরের মাটি আর জঙ্গল গজিয়ে থাকতে দেখেছে। সাপের কথা এ মুহূর্তে মনে নেই। সে অমিকে খোঁজে। রডটা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে কোথায় অমি আছে টের পেতে চায়। একটু পরে অমির ফোঁপানি শুনতে পায় সে। তখন সেদিকে পা বাড়ায়। পা ঢুকে যায় তলার ফাটলে। কেটেছড়ে যায় হয়তো। গ্রাহ্য করে না। অমিকে আঁকড়ে ধরে টানতে থাকে সে! রড ফেলে দেয়। তারপর দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে তুলে ফেলে বুকের কাছে। অমি ছটফট করে। তার নখের আঁচড়ে ফালা—ফালা হয়ে যায় তার বুক, গলা, ঘাড়, গাল।
হেমাঙ্গকে অমানুষিক শক্তি ভর করে আছে। সে লাইনের ধারে—ধারে ওকে তুলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়তে থাকে।
কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে যাবার পর অমি অবশ হয়ে পড়েছে। তখন আস্তে আস্তে হাঁটে হেমাঙ্গ।
অনেক কষ্টে বারান্দায় উঠে হেমাঙ্গ হাঁফাতে হাঁপাতে ডাকে, পিসিমা! পিসিমা!
কাদা আর ওয়াগানের জংমাখা অমিকে সে তার বিছানায় শুইয়ে দেয়। মুনাপিসি উঠে এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। হেমা! ও হেমা! কী হল?
হেমাঙ্গ দরজা খুলে দেয়। তারপর সুইচ টিপে ওপরের বাতি জ্বালে। মুনাপিসি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, একী রে! ওকে কোথায় পেলি?
হেমাঙ্গ ভাঙা গলায় শ্বাস—প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, একটা কাপড়টাপড় আনো শিগগির। বদলে দাও। আর—চেষ্টা করে দেখ তো ফিট ভাঙতে পারো নাকি।
মুনাপিসি দ্রুত বেরিয়ে যায়। একটু পরে একটা শাড়ি নিয়ে আসে। কোমরে কাপড় জড়িয়ে মুনিপিসি অমির শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়। হেমাঙ্গ জানে, এ মোহনপুরে মুনাপিসির মতো বড় হৃদয় কারুর নেই।
হেমার দিকে তাকিয়ে মুনাপিসি বলে তুই এখনও ভূত সেজে রইলি কেন বাবা? ধুয়ে ফেল গে। কাপড় বদলে নে। নিমুনি হবে যে?
শেষ রাতে অমির ফিট ভাঙল। পিসি—ভাইপো পাশে বসে রাত জাগছে। অমি চোখ খুলে কিছুক্ষণ বড় বড় নিশ্বাস ফেলে। তারপর অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকায়।
তারপর উঠে বসতে চেষ্টা করে। রুগ্নস্বরে বলে, আমি এখানে কেন? কে আনল আমাকে?
মুনাপিসি ধরে শুইয়ে দেয়। বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো মা। আমি আছি। ভয় কী? আহা, মা বেঁচে থাকলে কি—
কথা থামিয়ে মুনাপিসি চোখ মোছে। অমি একটু হাসে। একটা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দেয় মুনাপসির দিকে। সব ময়লা গরম জলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে সাফ করে দিয়েছে মানদাসুন্দরী। অমির হাতটা নিয়ে গালে রেখে বুড়ি বলে, এবার ঘুমোবার চেষ্টা করো। বোনেরা এখনও টের পায়নি। পাবে’খন। হেমা বলে আসবে, আমার কাছে আছে। থাকলেই বা! আমার পেটেই যদি আসত এমনি একটা মেয়ে! ফেলে দিতুম?
তুমি আমার পাশে শোও না পিসিমা!
কই, সরো। হেমা, তুই ওঘরে শোগে যা বাবা।
হেমাঙ্গ শুতে যায় না। বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় যায়। ভোরের ধূসর ভিজে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে। তারপর ঝেণ্টু কিংবা ডনের উদ্দেশ্যে ঠোঁট বাঁকা করে। একটা সিগারেট ধরায়।
বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে। খাল, মুসহর বস্তি, রেল—ইয়ার্ড, শ্মশানতলা জুড়ে চারিদিকে মোহনপুরের মাটি ও আকাশে এক ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে আছে। একটা স্নিগ্ধ গন্ধ ভেসে আসে। হেমাঙ্গ সেই গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সিগন্যাল পোস্টের কাছে ফেলে আসা লোহার রডটা খুঁজতে যায়।
খালপোল পেরিয়ে পায়েচলা সরু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হেমাঙ্গ টের পায়, এভাবে সত্যিসত্যি সে একটা মরচেধরা লোহার রড ফিরে পেতে হয়তো যাচ্ছে না। সেটা কি সত্যি একটা জরুরি জিনিস তার কাছে? এ আসলে একটা প্রতীক। আত্মরক্ষা করে বেঁচে থাকার জন্য অসহায় একটা অবলম্বন।
কিন্তু ঝেণ্টু বা ডনদের শক্তির কাছে কত তুচ্ছ ওটা! সময়ের কোনো গোপন গুহার দরজা খুলে পালেপালে যেন বেরিয়ে পড়েছে হিংস্র অশুভ নেকড়েগুলো। সব বিশুদ্ধতা নখের আর দাঁতের আঁচড়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। পাপে অন্ধকার ঢেকে ফেলছে পুণ্যের রক্তাক্ত শরীর। সব কালো হয়ে যাচ্ছে। এখন এ পৃথিবীতে যারা বেঁচে আছে, তাদের শরীরে সেই কালো অন্ধকারের ছোপ। সিল্যুট মূর্তির মতো মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, ভালোবাসছে এবং ছেলেপুলের জন্ম দিচ্ছে।
হেমাঙ্গ তাদের একজন বলে তারও অস্তিত্বে সেই কালো ছোপ। একই কলঙ্কক্ষত। গোপন উপদংশের মতো। হেমাঙ্গ শিউরে ওঠে। থমকে দাঁড়ায়। তার চোয়াল আঁটো হয়ে যায়।
অথচ মধ্য রাতের সেই ঝড়ের পর পৃথিবী এখন ধূপের ধোঁয়ার মতো কুয়াশাময় ভোরবেলায় গভীর কী এক মাদক গন্ধে ছড়িয়ে দিচ্ছে বেঁচে থাকার আনন্দকে মুঠোয়—মুঠোয়। ভিজে ঘাস, খড়কুটো, পাখির পালক, ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে থাকা গাছপালা জুড়ে ধ্বংসের পর শান্তির আচ্ছন্নতা যেন। বেঁচে থাকতে ও ভালোবাসতে বড় ইচ্ছে করে। ভাবতে ইচ্ছে করে, যুগ যুগ ধরে মানুষ ও তার পৃথিবীর এইরকমই তো ইতিহাস! আলো ও অন্ধকারে, পাপ ও পুণ্যে, মৃতে ও অমৃতে একাকার। দুই—ই হয়তো সত্য। এই সত্য নিয়েই অস্তিত্ব।…
রেল—ইয়ার্ডে একটা ইঞ্জিন হঠাৎ তীক্ষ্ন হুইসল দিল। একটু দূরে মালগাড়ির শান্টিং শুরু হয়েছে। কুয়াশার শীর্ষে লালচে আলো ফুটে উঠেছে। দিগন্তে। ইঞ্জিনের ধোঁয়া সেই আলোকে কালো করে দিচ্ছে বারবার। সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে হেমাঙ্গ।
তারপর কেউ তাকে ডাকে। হেমাদা!
হেমাঙ্গ চমকে উঠে মুখ ফেরায়। ডানদিকে খালের ধারে ঝোপঝাড় ঠেলে কে বেরিয়ে আসছে। হেমাঙ্গের হৃৎপিণ্ডে মুহূর্তে রক্ত ঝিলিক দেয়। ডন!
তাহলে এতক্ষণে আততায়ী এল? হেমাঙ্গ আবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকে ডনের দিকে। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে ডন। ঠোঁটের কোণায় কেমন একটা হাসি। নাকি হেমাঙ্গর চোখের ভুল!
ডন সামনে এসে দাঁড়ায়। ফের ডাকে, হেমাদা!
হেমাঙ্গ গলার ভেতর থেকে বলে, কী?
ডনের হাতে ড্যাগার নেই। গলার স্বরে কেমন চাপা উৎকণ্ঠা। সে আস্তে বলে, দিদি কোথায় জানো হেমাদা?
হেমাঙ্গ বলে, জানি। কেন?
ডন একটু হাসে। তুমি কি ভয় পাচ্ছ আমাকে দেখে হেমাদা?
হেমাঙ্গ মাথা দোলায় শুধু।
বাড়ি গিয়েছিলুম। শুনলুম, দিদির পাত্তা নেই। ডন উদ্বিগ্নমুখে বলতে থাকে। হঠাৎ ফিটের ঘোরে নাকি বেরিয়ে গেছে কখন, ওরা কেউ টের পায়নি। খোঁজও করেনি। এত অকৃতজ্ঞ ওরা হেমাদা!
হেমাঙ্গ বলে, অমি মুনাপিসির কাছে আছে। ওখানেই থাকবে।
ডন,—নিষ্ঠুর ঘাতক ডনের চোখে কী জল? হেমাঙ্গ বিশ্বাস করতে পারে না। ডন হঠাৎ এগিয়ে তার দুটো হাত ধরে ধরাগলায় বলে, জানতুম হেমাদা। যেন জানতুম। তাই তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলুম। হঠাৎ দেখলুম, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো। তাই… স্বাভাবিক স্বরে হেমাঙ্গ বলে, তুমি কি এখনও লুকিয়ে বেড়াচ্ছ নাকি?
ডন শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জবাব দেয়, হ্যাঁ। তবে শিগগির সেটল হয়ে যাবে। তারপর হাসবার চেষ্টা করে বলে, ইলেকশান আসছে না? আমাকে ওদের কত দরকার, তা তো জানোই হেমাদা!
হেমাঙ্গ নিশ্বাস ফেলে বলে, তোমার রিভলবারটা আমি…
বাধা দিয়ে ডন বলে, টলুদির কাছে সব শুনেছি। ওকথা থাক হেমাদা। রিভলবারের অভাব হয় না আজকাল। যাকগে, শোনো। দিদিকে দেখা করতে আর যাচ্ছি না। তোমাদের কাছে যখন আছে, আর আমার ভাবনা নেই। শুধু একটা অনুরোধ, হেমাদা!
কী?
যদি দিদিকে তুমি সত্যি ভালোবাস, তাহলে প্লিজ, বিয়ে করে ফেলো!
হেমাঙ্গের হাসতে ইচ্ছে করে। এই সেই বিচিত্র নীতিবাগীশ ছেলে ডন! দিদিকে সে কত ভালোবাসে, তা তো বরাবর দেখেছে হেমাঙ্গ। সে বলে, দেখি। ও এখন অসুস্থ। তাছাড়া…
ডন ফের তার হাত দুটো ধরে বাচ্চা ছেলের মতো বলে ওঠে, হেমাদা! দিদির জন্যে আমার পিছুটান যাচ্ছে না। এতটুকু নিশ্চিন্ত থাকা যায় না, বিশ্বাস করো। ও যদি তোমার কাছে থাকে, তাহলে আমার মুক্তি!
কীসের মুক্তি ডন?
ডন একটু চুপ করে থাকে। মাটির দিকে চোখ। তার মানুষ খুনকরা হাত দুটো এখনও হেমাঙ্গের হাতে। এ যেন কী অসহায় এক অনাথ বালকের হাত! হেমাঙ্গ ফের বলে, কীসের মুক্তি?
ডন বলে, কে জানে! ওইরকম মনে হয় খালি। আচ্ছা, চলি হেমাদা!
ডন, হুলোকে তোমরা খুন করলে কেন?
ডন চমকে ওঠে যেন। মুহূর্তে তার চেহারায় সেই পরিচিত ত্রূরতা ফিরে আসে। ঠোঁটের কোণা কামড়ে ধরে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলে, ইদানীং শুয়োরের বাচ্চাটা পুলিশের ন্যাওটা হয় উঠেছিল। ছেড়ে দাও ওকথা। তুমি ভদ্রলোক হেমাদা, এসব লাইনের খবর রেখে কী করবে? তুমি তোমার লাইনে থাকো। আচ্ছা, চলি!
ডন এগিয়ে যায় মুসহর বস্তির দিকে। হেমাঙ্গ পিছু ডেকে বলে, ডন! দিদির সঙ্গে একবার দেখা করে যাও। ওর অসুখ বেড়ে গেছে। কালরাতে ঝড়বৃষ্টির সময় ওকে ভাঙা মালগাড়ির ভেতর থেকে কী কষ্টে যে তুলে এনেছি, কহতব্য নয়।
ডন ঘোরে। ভুরু কুঁচকে বলে, ভাঙা মালগাড়ির ভেতর?
হ্যাঁ। তুমি যেখানে জগাকে খুন করেছিলে।
তুমি কীভাবে…
আমি জানি, ডন।
ডন আবার ফিরে আসে কাছে। আস্তে বলে, দিদি ভুল করেছিল। জগাদা হারামিবাচ্চা। টের পেতে দেরি হয়েছিল দিদির। হেমাদা, আমি দিদিকে যতটা চিনি, তুমি ততটা চেনো না।
হেমাঙ্গ হাসবার চেষ্টা করে বলে, কিন্তু তোমার দিদি ফিটের ঘোরে বারবার ওখানে যায়, জানো কি?
যায় নাকি? ডন একটু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, দিদি বাইরে যত কড়া হোক, ভেতরে ভীষণ নরম। ভীষণ ভীতু। খুনোখুনি রক্ত এসব সইতে পারে না। আমি ওর ভাই। আমাকে মায়ের মতো মানুষ করেছে। অথচ আমাকে ওর এত ভয়, ভাবতে পারবে না।
হেমাঙ্গ সায় দিয়ে বলে, তা ঠিক।
ডন হঠাৎ ভুরু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। একটু পরে বলে, কিন্তু ভাঙা মালগাড়ির ভেতর দিদি কেন যায়, জিগ্যেস করোনি হেমাদা?
করব’খন।
ডন একটু ভেবে নিয়ে মুখ নীচু করে বলে, বলতে নেই। কিন্তু বলা উচিত তোমার কাছে। সব ক্লিয়ার থাকা ভালো। জগাদা দিদির ওপর হামলা করেছিল। ভালোবাসার ছলে ডেকে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করতে চেয়েছিল দিদিকে। আমি আঁচ করেছিলাম কী ঘটবে। তাই তক্কেতক্কে ছিলুম। হেমাদা, দিদি এত বোকা মেয়ে।
ডন চুপ করলে হেমাঙ্গ বলে, তারপর?
সৈকাকেও ঠিক একইভাবে রেপ করে মেরে ফেলেছিল জগাদা।
জানি।
তাহলে আর জিগ্যেস করছ কেন?
জিগ্যেস করছি, তার কারণ….হেমাঙ্গ আনমনে বলে, ঘটনাটা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। এও শুনেছি, তুমি সৈকাকে ভালোবাসতে।
ডন হাসবার চেষ্টা করে। কে জানে! তবে মেয়েটাকে ভালো লাগত।
সত্যি কথা বলো তো ডন, তুমি জগদীশকে সৈকার জন্যে খুন করেছিলে, না তোমার দিদিকে বাঁচাতে খুন করেছিলে?
ডন দ্রুত বলে, দুটো কারণেই। দিদি জগাদার কথামতো ওখানে গিয়ে পড়েছিল। তখনও সৈকার বডি মালগাড়ির ভেতর পড়ে আছে। দিদি ভয় পেয়ে পালিয়ে আসছে, সেইসময় জগা শালা দিদিকেও রেপ করার চেষ্টা করছিল। তখন আমি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। আচ্ছা, চলি।
ডন হনহন করে চলে গেল। হেমাঙ্গ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর খালপোলের দিকে পা বাড়ায়।
অমির হিস্টিরিয়ার একটা অস্পষ্ট কারণ তার মাথায় ভেসে উঠেছে এতক্ষণে। অমি সত্যি আসলে বড্ড ভীতু। গেছো মেয়ে হলে কী হবে? সেদিন পরপর দুটো খুনোখুনি—সৈকার লাশ এবং জগাকে খুন করার তীব্র ঘটনা তার অবচেতনায় হুলুস্থুল বাধিয়েছিল। সেই বিশাল ভয়ঙ্কর আতঙ্ককে হজম করার শক্তি অমির ছিল না। হেমাঙ্গ মনস্তত্ত্ব পড়েছে। সে জানে, এটা ‘অবসেসনে’র অসুখ। অমি বারবার ওই ভাঙা মালগাড়ির দিকে ছুটে যায় ফিটের ঘোরে—এই অসুখের ডাক্তারি নামও আছে একটা। কী যেন…
হেমাঙ্গের ভাবনার ঘোর কেটে যায়। ডাবু খালের ওপারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডাকছে। অ্যাই হ্যামা!
হেমাঙ্গ মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ডাবুকে এ মুহূর্তে জীবনের উলটোপিঠের একটা বড় প্রেরণা মনে হয়। জীবনের ওইদিকটায় সবকিছু তুচ্ছ করে বেঁচে থাকার, আনন্দ পাওয়ার এবং নির্বিকারভাবে টাকা রোজগারের প্রচুর শক্তি পড়া রোদে ঝলমল করছে। অন্তত অমির জন্যে সে ডাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। তার হাতে হাত মিলিয়ে হাঁটবে। বেঁচে থাকতে হলে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই হেমাঙ্গের।
সে হাত তুলে সাড়া দেয়, যাচ্ছি।…