অশরীরী ঝড় – ১১

এগারো

শ্মশানতলার আখড়া কে বারবার ভেঙে দিচ্ছে, শংকরা জানত না। সে প্রথমটা খুব চেঁচামেচি করে অকথ্য গাল দিয়েছিল। পিশাচ লেলিয়ে দেবে বলে শাসিয়ে বেড়াচ্ছিল। তারপর বেপাত্তা হয়েছিল কিছুদিন। হরসুন্দরের চায়ের দোকানে হেমাঙ্গ শুনেছে, সে নাকি উদ্ধারণপুরের শ্মশানে আছে। বলেছে, পিশাচ জাগাচ্ছি। মোহনপুরের মুণ্ডুসুদ্ধু কড়মড়িয়ে খাবে, দেখে নিয়ো। কিন্তু কদিন পরে তাকে মোহনপুর স্টেশনেই দেখা গেছে। ওয়েটিং রুমের দরজার পাশে চিত হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। ছকা পাণ্ডা গিয়েছিল রেলবাবুদের প্রসাদী ফুল দিতে। সে ডাকতেই শংকরা উঠে বসে এবং হাউমাউ করে কাঁদে। উদ্ধারণপুরের সাধুরা তাকে খুব মেরেছে। কাটোয়া থানায় গিয়ে নালিশ করেছিল। ভাগিয়ে দিয়েছে। শংকরা তার জটাজুট সরিয়ে হাসপাতালের একচিলতে ব্যান্ডেজ দেখায়। তখন ছকার মায়া হয়। নিয়ে এসে বাবুপাড়ায় সিংহবাহিনীর মন্দিরে আশ্রয় দিয়েছে। তাঁর জাঁক অনেক কমে গেছে। হেঁড়ে গলায় মায়ের নামে হিন্দি ভজন গায়। পয়সাকড়ি পায়। ছকার সঙ্গে ছিলিম টানে।

হেমাঙ্গ একদিন দেখতে গেল শংকরাকে। সত্যি বলতে কী, বাড়ির দক্ষিণে ওই শ্মশানতলায় শংকরা থাকায় হেমাঙ্গ যেন একটা উপভোগ্য পরিবেশ খুঁজে পেয়েছিল। মাঝে মাঝে গিয়ে ওর কাছে আবোলতাবোল শোনাটা মন্দ ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, শংকরার রহস্যময় আচরণ। সে নিশাচর। একটা গোপন হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। হয় তো হেমাঙ্গ ছাড়া আর কাকেও ওই সাংঘাতিক কথা সে বলেনি। বললে নিশ্চয় পুলিশ আসত। হইচই হত। হেমাঙ্গ তাকে আর নিছক বোকাহাবা ভাবতে পারত না। তার ঝোপড়ি বারবার সে ভেঙে দিয়ে এসেছে অনর্থক রাগে। পরে অনুতাপ হয়েছে।

শংকরা মন্দিরের উঠোনের আটচালার থামে হেলান দিয়ে বসে আছে। কেন যেন শরীরটা আরও রোগা হয়ে গেছে। পাঁজরের হাড় গোনা যাচ্ছে। কণ্ঠা বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু আগের মতো নোংরা হয়ে নেই সে। দাড়িতে সকড়ি নেই। গায়ে অত ময়লাও নেই। কোমরে নোংরা ন্যাতার বদলে একটুকরো গেরুয়া কাপড় বা গামছা জড়ানো। কপালে দগদগে লাল ফোঁটা।

শ্মশান—মশানের আদিম রহস্যময় জগৎ থেকে সরে আসার ফলেই যেন এই অবস্থা। হেমাঙ্গের তাই মনে হচ্ছিল। সে ডাকে, কী রে শংকরা! কেমন আছিস!

শংকরা কটমট করে তাকায়। কথা বলে না। হেমাঙ্গ ভাবে, তাহলে কি ওর ঝোপড়ি ভাঙার ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে সে? হেমাঙ্গ একটু তফাতে হাঁটু দুমড়ে বসে। জুতো প্রথামতো গেটের কাছে খুলে রেখে এসেছে। সে বলে, রাগ করেছিস মনে হচ্ছে। কেন রে?

শংকরা হঠাৎ কেমন হেসে মাথাটা একটু দোলায়।

হেমাঙ্গ বলে, কী রে? হাসছিস কেন?

শংকরা শুধু বলে, শালা খচ্চর।

বটতলায় যাবিনে আর? তোর জন্যে পিশাচ ভূতপ্রেতগুলো কান্নাকাটি করছে যে রে!

শালা মাগিবাজ! বলে শংকরা ঠ্যাং গুটিয়ে আসন করে বসে।

হেমাঙ্গ চাপা গলায় বলে, আমি এক রাতে অমির সঙ্গে ক্যানেলের ওদিকে গিয়েছিলাম, তুই পুলিশকে বলে দিয়েছিলি। তাই না?

ভাত—বে। পীরিতের ঘরে ধোঁয়া দে গে! আমি এখন ব্যস্ত।

বলেছিলি তুই?

যা যা! ঢ্যামনাগিরি করিস নে! এটা মায়ের জায়গা।

একটা টাকা দেব। বল না ব্যাটা!

আগে দে। বলে শংকরা হাত বাড়ায়।

হেমাঙ্গ একটা টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, তুই পুলিশকে বলে দিয়েছিলি তো?

টাকাটা ঝটপট শংকরা কোমরে গুঁজে ফেলে। তারপর বলে, আমি কি বলতুম নাকি? তোর গা ছুঁয়ে বলছি। আমাকে মাইরি যখন তখন রাতদুপুরে দারোগাবাবুরা এসে জ্বালাত। হারামিবাচ্চা ডনের কথা জিগ্যেস করত। আমার কি চারটে চোখ আছে? বল না!!

শংকরা তেতো মুখে চুপ করে যায়। হেমাঙ্গ বলে, হুঁ। তারপর বলে দিলি যে….

বাধা দিয়ে শংকরা বলে, আমাকে একদিন থানায় নিয়ে গিয়েছিল।

বলিস কী!

সে জটা দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলে, এগুলো টেনে টেনে দেখলে মাইরি! দাড়ি টেনে দেখলে। তারপর খুব খাতির করে চা—বিস্কুট খাওয়ালে। তখন আমি ভেবে দেখলুম, এত খাতির যখন করলে তখন একটুকুন উপকার করা যাক।

তুই আমার আর অমির কথাটা বলে দিলি?

হুঁউ। তাতে কী! মিথ্যে বলেছি?

না, বলিসনি। কিন্তু তুই জগার কথা বলিসনি তো?

শংকরা গুম হয়ে থাকে। গাল ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বাতাস বের করতে থাকে।

বল না রে!

আরেক টাকা লাগবে, ভাই।

এখন আর নেই। পরে নিয়ে আসব। বল।

যখন দিবি, তখন বলব।

তার মানে বলেছিস।

ঊরুতে থাপ্পড় মেরে শংকরা চেঁচিয়ে ওঠে, বেশ করেছি। তোর বাবার কী?

হেমাঙ্গ বোঝে, ওকে চটালে কাজ হবে না। মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলে, ভালো করেছিস। আমিই তো বলব ভাবছিলুম পুলিশকে। পাছে তোকে সাক্ষী হয়ে কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাই চেপে গেছি।

একথায় শংকরা শান্ত হয়। বরং ভয়ের ছাপ মুখে ফুটে ওঠে। বলে মাইরি?

হ্যাঁ। তোকে সমন করে নিয়ে যেত আদালতে।

ওরে বাবা! হাকিম—টাকিম দেখলে মাইরি আমার ভয় করে। ওরাই তো ফাঁসি দেয়, না রে হেমা?

দেয়ই তো।

তাহলে ঠিক করেছি।… বলে শংকরা এপাশ—ওপাশ ঘুরে কী দেখে নেয়। তারপর ফিসফিস করে বলে, আরেকটা টাকা দিবি তো? মায়ের জায়গা। ওই দ্যাখ মা। দেখতে পাচ্ছিস?

হুঁউ, পাচ্ছি।

মায়ের সামনে বলছিস, আরেকটা টাকা দিবি?

দেব।

শংকরা আসন থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে এনে ফিসফিস করে বলে, জগা শালাও কম ছিল না মাইরি! একদিন সন্ধেবেলা খালের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। ওখানে একটা ওয়াগন উলটে পড়েছিল দেখেছিস?

হ্যাঁ, ছিল…. হেমাঙ্গের মনে পড়ে, ভাঙাচোরা ওয়াগনটা ছিল ডেডস্টপের পাশে। ঘাস আর আগাছা গজিয়ে ছিল তার চারপাশে।

শংকরা বলে, বুধনীর মেয়েটা রে। বুঝলি? সৈকা! সৈকা ছাগলের বাচ্চা বুকে নিয়ে আসছে। যেই ওখানটায় আসা জগা শালা কোত্থেকে এসে সামনে দাঁড়াল। তারপর মাইরি ছুঁড়িটাকে পটাতে শুরু করল। সব পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেড়ার ফাঁক দিয়ে। তারপর জগা শালা ছুঁড়িটাকে ধরল। আর ছাগলছানাটা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে দৌড়ুল। তারপর হেমা, জগা শালা দু’হাতে ছুঁড়িটাকে ধরে ওয়াগংয়ের মধ্যে ঢুকল। আমি তো থ।

দম আটকানো স্বরে হেমাঙ্গ বলে, তারপর?

শংকরা বলে, বসে পড়লুম, দেখি কী করে জগা। ওয়াগং থেকে বেরুল, তখন আঁধার হয়ে গেছে, বুঝলি? তবে চাঁদটা উঠেছে। ওকে আবছা দেখলুম একা চলে যাচ্ছে। অনেকটা চলে যাওয়ার পর খাল পেরিয়ে গিয়ে সৈকাকে খুঁজলুম। ওয়াগংয়ের ভেতরে আঁধার হয়ে আছে। হলে কী হবে? আমি আঁধারে তো দেখতে পাই!

বলে শংকরা খ্যাঁক করে হেসে হাতে তালি দেয় একবার। হেমাঙ্গ বলে, তারপর?

শংকরা ফিসফিস করে। চোখ কুতকুতে, নিষ্পলক।

…ভেতরে সৈকা পড়ে আছে। গা ঠান্ডা। গায়ে হাত বুলিয়ে দেখি, একেবারে ন্যাংটো। আমি কাঁপতে কাঁপতে পালিয়ে এলুম। তা’পরে বুঝলি হেমা? বটতলায় চক্কর দিচ্ছি তখন চোখে পড়ল, জগা আর কে যেন আসছে। শালা ডন আসছে। এসে ওয়াগং থেকে ছুঁড়িকে বের করে মাইরি লাইনে ফেলে দিয়ে এল! তোর গা ছুঁয়ে বলছি!

এই সময় ছকার গলা শোনা যায়। শংকরা অমনি চোখ নাচিয়ে বলে ওঠে, হেমা! পালা!

হেমাঙ্গ ওঠে। পেছনে পায়ের শব্দ হতেই সে সেখানে দাঁড়িয়ে দেবীকে প্রণামের ভান করে। তারপর ঘুরে পা বাড়ায়। ছকা বলে, কী গো হেমাংবাবু? ভালো তো?

ভালো বলে হেমাঙ্গ বেরিয়ে যায়। রাস্তায় যেতে—যেতে সে পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। শংকরার খ্যাপামি অনেকটা কেটে গেছে মনে হল। হয়তো আবার মানুষের ভিড়ে এসে বাস করতে করতে নির্জন প্রকৃতির আদিম ব্যাপার—স্যাপার ওর মন থেকে খসে গেছে অনেকটা।

কিন্তু অমিও কি তাহলে সেকার মৃত্যুর রহস্যটা টের পেয়েছিল? শংকরা অমির কথা বলল না। অমি ওখানে থাকলে শংকরা তো তাকে দেখতে পেত।

নাকি শংকরা চলে আসার পর অমি অভিসারে বেরিয়েছিল? এমনও হতে পারে জগার সঙ্গে ওই ওয়াগনের মধ্যেই অমির প্রেম করার অভ্যাস ছিল। হয়তো শংকরার মতো সেও ধর্ষিতা সৈকার লাস আবিষ্কার করেছিল। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল অবচেতনায়। কিন্তু…

একটা কিন্তু আছেই। হেমাঙ্গ আনমনে হাঁটতে হাঁটতে গুলাইয়ের হোটেলের সামনে এসে পড়েছিল। গুলাই তাকে দেখতে পেয়ে ডাকে—হেমাংবাবু! ও হেমাংবাবু!

হেমাঙ্গ ‘শুকতারা’ হোটেলে ঢোকে অনেককাল বাদে। ঢুকতেই তাকে হুলো একগাল হেসে অভ্যর্থনা করে। হেমাদা গো! আমি এসে গেছি।

কোথায় ছিলি রে অ্যাদ্দিন? বলে হেমাঙ্গ তার চুল খামচে ধরে।

গুলাই বলে, হ্যাঁ—গাঁট্টা লাগাও গোটাকতক হেমাংবাবু। আমার হাতের গাঁট্টায় হারামির বেল ভাঙবে না। বাপ রে! মাথা নয়, পাথর।

গুলাইয়ের হোটেল বেশ পরিচ্ছন্ন। কারণ স্কুল—কলেজের ছেলেমেয়েরা এসে খেয়ে যায়। কাঠের পুরনো টেবিলের ওপর সানমাইকা লাগিয়েছে। স্টেনলেস স্টিলের জগ। দেয়ালগুলোয় অয়েলপেন্ট মাখানো এবং ছবিও এঁকে নিয়েছে।

দুটি গ্রাম্য শৌখিন লোক টেবিলে ট্রান্সজিস্টার রেখে মাংসভাত খাচ্ছে। তাছাড়া সব টেবিল ফাঁকা। হেমাঙ্গ গুলাইয়ের কাউন্টারের পাশের টেবিলে বসে হুলোকে বলে, কোথায় ছিলি বললিনে?

হুলো দাঁত বের করে শুধু হাসে। গুলাই বলে, চেহারার হাল দেখে বুঝতে পারছেন না কোথায় ছিল?… বলে গুলাই ফিসফিস করে। একগাদা টাকা গচ্চা দিতে হল হারামির জন্যে। নইলে তো অ্যারেস্ট করে নিয়ে পেঁদানি দিত। কাল রাত্রিবেলা এসে ওই জানলায় খুটখুট করছে। জানলা খুলে দেখি, আমার হিরো এসে গেছে। গুলাই হাসতে থাকে।

হেমাঙ্গ বলে, হুলো! একগেলাস জল খাওয়া রে! হুলো নিঃশব্দে হুকুম তামিল করে।

গুলাই বলে, সক্কালে উঠে বলেছি—থাকতে হলে খেটে খেতে হবে। খদ্দেরপাতি দেখতে হবে। কাউন্টারেও বসতে হবে। এ যদি মেনে চলো, তোমার উদ্ধার। নইলে বাবা, গেট আউট হও! তা হেমাংবাবু, অসময়ে এলে যে গো! কাবাব তো এখনও রেডি হয়নি। কষা মাংস আর পরোটা খাও!

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, কিচ্ছু খাব না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, তাই ভাবলুম দেখে যাই কেমন আছেন গুলাইদা!

হুলো জলের গেলাস রেখে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হেমাঙ্গ জল খেয়ে বলে, হুলো! তোর অমিদির ভূতের খবর জানিস? ভূতটা ক্ষেপে গেছেরে!

হুলো মাথা দোলায়। গুলাই বলে, ভালো কথা! প্রমথবাবুর ভাইঝির ব্যাপারটা কী গো হেমাংবাবু? শুনলুম নিশিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল নাকি! আজকাল এমন হয়?

হয়। বলে হেমাঙ্গ সিগারেট এগিয়ে দেয় গুলাইকে। গুলাইদা, হুলোর অবস্থা তো শোচনীয় দেখছি। এবার ভালো করে মাংসটাংস খাইয়ে তাজা করে তুলুন।

গুলাই বলে, সে আমাকে বলতে হবে না হেমাংবাবু। ও নিজেই সে ব্যাপারে এক্সপার্ট। ওর নাম হুলো কেন, বুঝতে পারছ না? বিপদ কেউ কেউ ডেকে কাঁধে নেয়। আমিও নিয়েছি, ঘরে হুলো ঢুকিয়েছি।

হুলোকে নিয়ে কিছুক্ষণ রসিকতা চলতে থাকে। তারপর হেমাঙ্গ ওঠে। হুলো, যাস একবার। পিসিমা প্রায় তোর কথা বলে। এসেছিস শুনে খুব খুশি হবে। দেখা করে আসিস।

কিন্তু সেদিন থেকেই হেমাঙ্গের সুখ শান্তি গেল।

কালবোশেখির ঝোঁক এসে গেছে এ বছর। প্রায় দিন বিকেলে আকাশ জুড়ে ক্ষ্যাপামি চলেছে। কোনোদিন শুধু ঝড়—ঝাপটা, কোনোদিন তার সঙ্গে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি। গাছপালার রঙ ঝলমল করে। খালের জল হলুদ হয়ে গেছে মোহনপুর ধোয়া গড়ানে জলে। শ্মশানতলার দিকে সবুজ ঘাসের জেল্লা ফুটেছে। বাঁজা ডাঙায় গয়লাদের গোরু—বাছুরের পাল দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজে। কখনও মেঘভাঙা রোদের মধ্যে বৃষ্টি ঝরে। রেল ইয়ার্ডে চেকনাই ভাব ফুটেছে। মুসহরবস্তির ঝোপড়িগুলোও ঘষামাজা তকতকে দেখায়। শুয়োরের পাল খালের ধারে হুলুস্থুল করে বেড়ায়। অনেক রাত অব্দি ঢোল বাজে ওদিকটায়। রেলইয়ার্ডে কোনো শৌখিন গ্যাংম্যান বাঁশের বাঁশিতে হিন্দি ফিল্মের গান বাজায়। হেমাঙ্গের এইসব রূপ শব্দ গন্ধ অনুভবের আর কোনো স্নায়ুই নেই যেন।

মুনাপিসি নার্সারি থেকে নানারকম বীজ আর চারা এনে দিতে সাধে হেমাঙ্গকে। হেমাঙ্গের উড়ু—উড়ু মন। আর অস্বস্তি। যত দিন যাচ্ছে, বাইরে বেরুতে তার গা ছমছম করে। শুধু ভাবে, বাড়ি ফেরা হবে তো।

প্রতিমুহূর্তে সে অপেক্ষা করছে আততায়ী ডনের। কখন এসে তাকে রিভলবার চাইবে! হেমাঙ্গ কী বলবে, জবাব তৈরি করে। দৈবাৎ বাইরে থাকলে সন্ধ্যার আগেই সে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। রাতে কান পেতে থাকে ডনের পায়ের শব্দ পাবে বলে। কোথায় একটু শব্দ হলেই চমকে ওঠে। জানলার কাছে গিয়ে কান পাতে। শংকরার কাছে সৈকার মৃত্যুরহস্য জেনে তার চোখে মোহনপুর দিনদুপুরেই ঘন অন্ধকারে ভরে গেছে। মারাত্মক অপশক্তিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। আর একেকটি রাত মানেই নরকবাস। দীর্ঘ দীর্ঘ নরকযন্ত্রণা।

কোনো—কোনো রাতে বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। সব জানালা সে বন্ধ করে রেখেছে। উৎকট গরমে সে দরদর করে ঘামে। তবু জানলা খুলতে সাহস পায় না। হাতপাখা ঘোরায়। ভাবে, মুনাপিসিকে পটিয়ে একটা টেবিলফ্যান কেনার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সকাল হলেই দুঃস্বপ্নের অনেকটা অবসান, এবং এই বিলাসিতার জন্যে মুনাপিসিকে বলতে তার দ্বিধা আসে।

হেমাঙ্গ অনেক হাস্যকর এবং অদ্ভুত ব্যাপার করল। সে খুঁজে পেতে একটা লোহার মরচেধরা রড এনে রাখে খাটের তলায়। ছোট্ট ছুরি খুঁজে বের করে পুরনো জিনিসপত্রের জঞ্জাল থেকে। আজকাল সে মুনাপিসিকে চোর—ডাকাতের কথা বলে ভয় দেখাতে চায়, যাতে মহিলাটি সতর্ক থাকে! পিসেমশাই এই শেষ দিকটায় কেন যে বাড়ি করলেন, তা নিয়ে অনুযোগ করে। কাছেই শ্মশান—ওদিকে মাঠ জঙ্গল খাঁ খাঁ জায়গা!

মুনাপিসি বলে, গোলমাল তো পছন্দ করতেন না উনি। তুইও তো তাই। নিরিবিলি এমন বাড়ি বলে চিরদিন তোর পিসেমশায়ের কত প্রশংসা করেছিস। এখন উলটো গাইছিস কেন রে হেমা?

হেমাঙ্গ বলে, আগে বুঝতুম না তাই। মোহনপুর যে কী মারাত্মক জায়গা হয়ে উঠেছে আজকাল, জানো না তো!

মুনাপিসি এ যুক্তিতে সায় দিয়ে বলে, তা অস্বীকার করছি নে। তবে আমরা তো আসলে গরিব মানুষই। চোর—ডাকাতেরা কী নেবে? কোন বাড়িতে হানা দিলে লাভ হবে, ওরা জানে।

আতঙ্কের প্রথম ধাক্কাটা কাটার পর হেমাঙ্গ একদিন বিকেলে নিজের সাহস বাজিয়ে দেখতেই গুলাইয়ের হোটেলে কাবাব খেতে গেল। একটু গোপন উদ্দেশ্যও ছিল। হুলোর কাছে ডনের খবর জানা।

হুলো ডনের খবর জানতেও পারে। ওকে গুলাই নিশ্চয়ই বেরুতে দিচ্ছে না, তাই ও হেমাঙ্গের বাড়িতে যায়নি। হেমাঙ্গকে দেখে গুলাই খুশি হয়ে অভ্যর্থনা করে। হেমাঙ্গ বলে—কাবাব খেতে এলুম গুলাইদা! হুলো কই?

গুলাই বিকৃত মুখে বলে, ওর কথা জিগ্যেস করছ হেমাংবাবু! ও কী মানুষের বাচ্চা!

সে কী! হেমাঙ্গ হতাশ হয়ে বলে। আবার পালিয়েছে বুঝি?

যাবে কোন চুলোয়? চুলো থাকলে কি আমার কাছে ফিরে আসত ভাবছেন?

তাহলে?

সেই আগের মতো লাইন ধরেছে। এখন আছে তো তখন নেই। একটু আগে বললুম, নসুকে দেখে আয় বাড়ি ফিরেছে নাকি। আমার বাবুর্চি বুড়োটা তো দেখেও এল। এসে খানিক এদিক—ওদিক ঘুর—ঘুর করে কোন ফাঁকে হাওয়া! কদিন থেকে এইরকম।

হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থেকে বলে, তাহলে ইদ্রিসদের সঙ্গে ঘুরছে আবার!

গুলাই রাগ দেখিয়ে বলে, তাই মনে হচ্ছে। কাল বিকেলে দেখলুম মুসহরদের ঝেণ্টু ওকে সাইকেলের রডে বসিয়ে গোলপার্কে চক্কর দিচ্ছে।

গুলাই বাজারের মধ্যিখানে নলিনাক্ষের আবক্ষ—মূর্তি সমন্বিত গোলে রেলিংঘেরা জায়গাটাকে গোলপার্ক বলে। আসলে ওর জীবনের একটা সময় কলকাতায় কেটেছে। ওর কথাবার্তায় সেই সব শহুরে গন্ধ ভুর—ভুর করে। হেমাঙ্গ জিগ্যেস করে, ঝেণ্টু নাকি গা ঢাকা দিয়েছিল শুনছিলুম।

গুলাই চাপা গলায় বলে, জ্ঞানবাবুর রিপ্রেজেন্টেটিভ আছে একজন। জানো না?

সে আবার কে?

আকবর। আকবর এখন জ্ঞানবাবুর লেজুড় ধরে উঠতি নেতা হচ্ছে যে! সে আজকাল ঝেণ্টুদের গার্জেন হয়েছে দেখছি। খুব লেফটহ্যান্ড রাইটহ্যান্ড ভাব। বলে গুলাই দুর্বোধ্য একটা দুই হাত ঘুরিয়ে। তারপর খিকখিক করে হাসে।

কাবাব খেয়ে হেমাঙ্গ ওঠে। শুকতারায় এখন বিকেলের ভিড়। অবাঙালি মুসলিমও আছে মোহনপুরে। বেশিরভাগই রেলের লোক। কেউ কেউ ছোটখাট ব্যবসা করে। তাদের ভিড় এখন থেকে রাতঅব্দি চলবে। হেমাঙ্গ বাজারের চৌমাথায় এসে হরসুন্দরের চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে। হুলো ওখানে নেই।

সে সতর্ক চোখে ভিড়ে যেন নিজের আততায়ীকে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটে। বলা যায় না, ডন তার কোন সঙ্গীকে এই দায়িত্বটা দিতে পারে। আচমকা সে ড্যাগার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে হেমাঙ্গের ওপর। হেমাঙ্গ প্রতিটি যুবককে সন্দেহের দৃষ্টে দেখতে দেখতে বড়পোল পেরিয়ে যায়।

বাঁদিকে হাউসিং কলোনির রাস্তা। এ পথে সে আসেনি, ফিরেও যাবে না। কারণ এ পথের ধারেই বোসবাড়ি। কিছুটা এগিয়ে রেশমকুঠির পেছন ঘুরে যাবে। কিন্তু সেখানে মোড়ের মাথায় বারোয়ারি বটতলায় টলু তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হেমাঙ্গ দাঁড়িয়ে গেল।

টলু মিটি—মিটি হেসে তার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গের মাথা থেকে পা অব্দি দেখে নিয়ে বলে, সত্যি সত্যি হেমা, নাকি অন্য কেউ?

হেমাঙ্গ গম্ভীর থাকতে চেষ্টা করে। কী ব্যাপার?

ব্যাপার তো তোর। কী হল সেদিন অমির সঙ্গে যে অমন করে পালিয়ে গেলি?

হেমাঙ্গ চারপাশে দ্রুত দেখে নিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কথা? আমার সঙ্গে? সব কথা তো তোর অমির সঙ্গে!

না। তোমার সঙ্গেই।

খুশি হলুম। বল!

এভাবে এখানে কথা হয় না। বলে হেমাঙ্গ উপযুক্ত জায়গা হাতড়ায় মনে মনে।

টলু চোখ নাচিয়ে বলে, তাহলে আমাদের বাড়িতে আয়। তবে আজ ওয়েদার ফাঁকা রে! আজ আর ঝড়—জলের চান্স নেই হেমা!

বারোয়ারি তলায় কিছু লোক সব সময় থাকে। পাশে বড় রাস্তা—যেটা স্টেশন রোড বলা হয়, সোজা পশ্চিমে এগিয়ে হাইওয়েতে মিশেছে। স্টেশন রোডে গাড়ির ভিড় আছে। হেমাঙ্গ বলে, তোমাদের বাড়িতে নয়। হাইওয়ের দিকে যেতে আপত্তি আছে?

টলু আঁতকে উঠে বলে, তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তোর সঙ্গে ওদিকে যাব, আর চেনা কারুর চোখে পড়ুক! অসম্ভব। আয় না তুই আমাদের বাড়িতে। কোনো অসুবিধে নেই।

হেমাঙ্গ টের পায়, বটতলার বুড়োরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চেনা লোকেরাও তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে তাদের দিকে। সে বলে, চলো তো। বাড়ির পথে যেতে যেতেই বরং বলি।

টলু পা বাড়ায়। তার পাশে হাঁটে। যতীন কবরেজের বাড়ি গিয়েছিলুম রে! মায়ের কোমরে এক্সরে করে কিচ্ছু পায়নি। অথচ ব্যথা আছে। এখনও পা ফেলতে পারছে না ঠিকভাবে।

এই খোয়া ঢাকা রাস্তাটার দুধারে অজস্র গাছ, মধ্যে মধ্যে একটা করে সুন্দর বাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির চারপাশে শাকসবজির খেত, ফুলফলের বাগান। বেশ নির্জন এলাকা। ঘন ছায়ায় ঢাকা। হেমাঙ্গ বলে, তুমি রিভলবারের কথাটা তোমার বাবা—মাকে বলেছিলে। কিন্তু অমিকে তাহলে বলতে গিয়েছিলে কেন?

টলু পুরুষালি ভঙ্গিতে হাসে। ওর ভরাট থুতনি আর পুরু ঠোঁট কাঁপতে থাকে সেই অদ্ভুত হাসিতে। ইস! অমির সঙ্গে রিলেশানে চোট খেয়েছে তো? বাঃ! কী ফাইন!

এ হাসির কথা নয় টলুদি!

দিদি বলতে লজ্জা করে না তোর?

হেমাঙ্গ চটে গিয়ে বলে, তবে কী বলব? কী শুনতে চাও আমার কাছে?

টলু এদিক—ওদিক তাকিয়ে নিয়ে ওর চিবুক খামচে দিয়ে বলে, নেকু! খুকুছোনা! ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না?

ওসব ফাজলেমি ছাড়ো! তুমি আমাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছ জানো! হেমাঙ্গ তেতো মুখে বলে। হঠাৎ কখন ডন এসে অমির কাছে চাইবে। অমি বলবে আমাকে দিয়েছিল। তখন ডন আমার ওপর জুলুম করবে।

তুই ভাবিস নে হেমা! ডনকে আমি ম্যানেজ করব। টলু আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে। কিন্তু এখন এ নিয়ে ভাবছিস কেন তুই? ডন এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত!

হেমাঙ্গ চুপ করে থাকে। টলু খুব আস্তে হাঁটছে। একটু পরে হেমাঙ্গ বলে, ডন একবারও বাড়ি আসেনি?

টলু মাথা নাড়ে। তারপর ফিক করে হেসে বলে, জানিস? তোদের বাড়ি যাবার জন্যে খুব মন টানছিল। আদ্ধেক গিয়ে ফিরে এসেছি। বাপস! তোর পিসিবুড়ির যা চোখ! তোদের বাড়ির একটা বাড়ি পরে অনুরা থাকে জানিস? হেডমাস্টার মশায়ের মেয়ে অনু। ওকে তোর কথা জিগ্যেস করলুম সেদিন। বলল, নেই বোধহয়। বাইরে—টাইরে গেছে।

হেমাঙ্গ কোনো মন্তব্য করে না।

টলু হঠাৎ ফিসফিসিয়ে ওঠে, আমাকে তুই পাগল করে দিয়েছিস হেমা! ইচ্ছে করছে, তোকে এক্ষুনি স্ট্যাব করে মেরে ফেলি। সত্যি বলছি—বিশ্বাস কর। বেশ তো ছিলুম। কেন যে ছাই হঠাৎ…

টলুর কথা আটকে গেল। রাস্তার মধ্যে চোখে জলটল নিয়ে এক কাণ্ড করে ফেলবে মেয়েটা। হেমাঙ্গ বিব্রত হয়ে বলে, আমাকে তুমি বরাবর নেকু বলো তুমি নিজে কম নেকী নও! আচ্ছা—চলি।

টলু নির্লজ্জ হাতে ওর পিঠের জামা খামচে ধরে আটকায়। বলে, আমার সর্বনাশ করে খুব গা বাঁচিয়ে বেড়াচ্ছ, তাই না?

হেমাঙ্গ আঁতকে উঠেছে। আবার সেদিনকার মতো ব্ল্যাকমেল শুরু করেছে রাস্তার মাঝখানে। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ছিঃ! তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞানই নেই। ওইসব বাড়ির লোকেরা চোখ বুজে বসে নেই খেয়াল আছে?

টলু বলে, হেমা! তুমি সেদিন একা পেয়ে আমার সর্বনাশ করেছ। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তার রেসপনসিবিলিটি তোমার। তোমাকে আমি ছেড়ে দেব না। আমি কেমন মেয়ে, তা তো জানোই।

হেমাঙ্গ হাসবার চেষ্টা করে বলে, বাঃ! দিব্যি ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছ। করো! আমি নির্বোধ!

সামনে ডানদিকে বোসবাড়ি দেখা যাচ্ছে গাছপালার ফাঁকে। রোয়াকে প্রমথ যথারীতি বসে আছেন। সামনে আর কেউ বসে আছে। হয়তো কোনো আত্মীয় কিংবা অন্য কেউ। টলু বলে, হেমা! যা বললুম, রাগ করিস নে লক্ষ্মীটি! সত্যি, ঝোঁকের বশে সেদিন কীসব হয়ে গেল—বড্ড ভয় করছে। শুধু কী ভাবছি জানিস? যদি সর্বনাশ ভাগ্যে থাকেই, তার শেষটুকু দেখতে ক্ষতি কী?

হেমাঙ্গ সে কথায় কান করে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে আরেক আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। এবার মোহনপুর ছেড়ে তাকে পালাতে হবে। সে বলে, আসি টলুদি।

টলু খপ করে তার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে সে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয়। সরে আসে নিরাপদ দূরত্বে। টলু চেঁচিয়ে বলে, বাবা! ও বাবা! হেমা আমাদের বাড়ি আসছে না!

প্রমথ দেখতে পেয়ে হাত তুলে ডাকেন। হেমাঙ্গ অগত্যা গেটের সামনে গিয়ে বলে, কাল সকালে আসব জ্যাঠামশাই। ভীষণ জরুরি কাজ আছে। পিসিমা খুব অসুস্থ।

প্রমথ বলেন, তাই নাকি? তাহলে তো একবার দেখে আসতে হয়। অনেক দিন…

বাধা দিয়ে হেমাঙ্গ বলে, না। বেশি কিছু নয়। সেরে যাবে। আসি জ্যাঠামশাই!

হেমাঙ্গ আর পিছু ফিরে তাকায় না। হনহন করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিছু দূর যাওয়ার পর সে গতি কমায়। তারপর টলুর শাসানির বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করে। অমনি তার হৃৎপিণ্ডে সেই বারবার আসা আতঙ্কের পরিচিত খেঁচুনি দেখা দেয়। ঊরু ভারী হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে, যেভাবেই হোক পাকেচক্রে এক ভয়ঙ্কর অপশক্তির ছায়ায় সে জড়িয়ে পড়েছে। শূন্যদৃষ্টে তাকায় হেমাঙ্গ। এখান থেকে চলে যাওয়া ছাড়া আর হয়তো কোনো উপায়ই তার নেই।…

পরদিন সকালে অভ্যাসমতো খালে কাঠের ব্রিজে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ ভেরেণ্ডা ডাল ভেঙে দাঁতন করছে, ওপারে মুসহর বস্তির দিক থেকে সিগারেট টানতে টানতে হুলো এল।

হেমাঙ্গ তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে একটু যেন ভড়কে যায় ছেলেটা। কাঁচুমাচু হাসে। একটা বেঢপ ঢোলা নতুন ফুলপ্যান্ট আর নতুন জামা পরে আছে। চুলের কেতা দেখার মতো। মুখে পাউডারের ছোপ। হেমাঙ্গ বলে, এই যে গুলাইবাবুর হিরো। এসো, তোমাকে দেখাচ্ছি মজা।

হুলো ফিক করে হাসে। হেমাদা, এই নোংরা জলে তুমি মুখ ধোবে গো?

তুই যে ভীষণ সেজেছিস রে! কাছে আয় তো দেখি।

হুলো ব্রিজে ইচ্ছে করেই আওয়াজ দিয়ে হেঁটে এল। তখন হেমাঙ্গ দেখতে পায়, একটা উঁচু হিলওলা নতুন জুতোও পরেছে। কাছে এসে সে বলে, হেমাদা! তুমি বেরাশ দিয়ে দাঁত মাজলেই পারো।

হেমাঙ্গ বলে, তোর মতো আমার গুলাই—টুলাই নেই। এদিকে কোত্থেকে আসছিস রে?

হুলো আঙুল তুলে মুসহর বস্তির দিকটা দেখিয়ে বলে, ঝেণ্টুদার কাছে ছিলুম। ঝেণ্টুদা বিয়ে করেছে জানো না? কী বউ মাইরি হেমাদা! একেবারে মধুবালার মতো দেখতে!

তাই নাকি? জানি না তো! হঠাৎ কবে বিয়ে করল ঝেণ্টু?

এই তো পরশু।

ইয়ার্কি করছিস! ঝেণ্টু চুপচাপ বিয়ে করল? কই, ঢোলফোল বাজতে শুনলাম না—কিছু না। হেমাঙ্গ থাপ্পড় তোলে। বাঁদর সক্কালবেলায় গুল দিতে বেরিয়েছ!

হুলো একটু পিছিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষার ভঙ্গি করে তারপর বলে, মাকালীর দিব্যি। জটাবাবার দিব্যি। তোমার দিব্যি হেমাদা। সে গলা চেপে ফের বলে, ভাগিয়ে এনেছে কার বউ! ইদ্রিসদা বলছিল।

হেমাঙ্গ অবাক হল। মুসহর বস্তিতে মাত্র কয়েকটি ঘর আছে মাটির দেয়াল এবং টালির চাল। ছোট্ট ঘর। তার একটা ঝেণ্টুর। বাদবাকি সব ঝোপড়ি! তেরপল ক্যানেস্তারা চাপানো গুহা বললেই চলে। ওই ঘরে কোনও সুন্দরী মেয়েকে এনে তুলেছে ঝেণ্টু? নিশ্চয় আজেবাজে চরিত্রের মেয়ে। অবশ্য ঝেণ্টুর চেহারা সুন্দর। সে স্বাস্থ্যবানও বটে! হেমাঙ্গ জিগ্যেস করে, তোকে কাল শুকতারায় খুঁজতে গিয়েছিলুম জানিস?

হুলো মাথা দোলায়। সিগারেটটা ঝুঁকে খালের জলে ফেলে দেয়। জলে সবে স্রোত বওয়ার মরশুম এসেছে।

হেমাঙ্গ বলে, তুই এতদিন কোথায় ছিলি রে হুলো?

হুলো শার্টের বুকপকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, কত জায়গায়। কাটোয়া, বহরমপুর, বেলডাঙা, কেষ্টনগর। ঘুরে—ঘুরে বেড়াতুম।

খেতিস কোথায়? কে খেতে দিত তোকে?

জুটে যেত। দিনকতক এক বাবুর বাড়ি ছিলুম জানো? হুলো ফিক করে হাসে। বাবুর বউ খুব ফক্কড় মেয়ে মাইরি। কী করত জানো? রোজ দুপুরবেলা আমাকে বলত, বাহরে—টাইরে ঘুরে আয়। এই নে পয়সা। আমি এখন ঘুমোব। বিরক্ত করতে আসবি নে। তারপর কী করত উরেব্বাস! একদিন খুব রাগ হল। বাবুকে বলে দিয়ে পালিয়ে এলুম। কী হল কে জানে—আমি আর সেখানে থাকলে তো?

হেমাঙ্গ বলে, কী করত রে বাবুর বউ?

হুলো রাঙামুখে বলল, যাঃ! বলে না ওসব। তা হ্যাঁ গো হেমাদা, অমিদির ভূত সেরেছে?

গিয়ে দেখে আয় না।

বুড়ো তেড়ে মারতে আসে। এসেই তো গিয়েছিলুম। যেই গেটের কাছে গেছি, বুড়ো বলল—কে রে? আমি বললুম—দাদু, আমি হুলো। অমনি তিড়িং বিড়িং করে তেড়ে এল। আমি লংজাম দিয়ে হাওয়া!

হেমাঙ্গ আস্তে বলে, হ্যাঁ রে! ডন কোথায় আছে জানিস?

হুলো একটু দ্বিধায় পড়ে যায় যেন। খালের জলে থুতু ফেলে। আকাশ দেখতে থাকে।

হেমাঙ্গ ফের বলে, আমাকে বলতে ভয় কী? তুই তো কত কথা আমাকে বরাবর বলেছিস। কারুর কানে তুলেছি?

হুলো পায়ের দিকে চোখ রেখে যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেই বলে, আকবরদাদের গাঁয়ের বাড়িতে আছে। এই হেমাদা! জানলে আমাকে আবার পালাতে হবে। ঝেণ্টুদারা বারণ করেছিল।

তুই আর কাকেও বলিসনি তো?

হুলো মাথা দোলায়।

হুলো, নতুন জামা—প্যান্ট কে দিল রে?

গুলাইশালা খুব পটাচ্ছে।

তুই ওকে শালা বলছিস? খুব নেমকহারাম তো তুই! হেমাঙ্গ দাঁতনটা খালের জলে ফেলে দেয়। তারপর জলের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে। হুলো ঠিকই বলেছে। জলটা এখন নোংরা। চৈত্রের শেষে খুব পরিষ্কার থাকে। মোহনপুরের নর্দমাগুলোর সঙ্গে খালটার যোগ নেই। সব নর্দমার জল উত্তরের দিকে গড়িয়ে মাঠে পড়ে। ওই মাঠটাই নাকি ভাগীরথীর কবেকার খাত ছিল। ঘুরে জটাবাবার থানের পাশ কাটিয়ে রেল—লাইনের তলা দিয়ে পুবের মাঠের দিকে গেছে। অবশ্য শুয়োরের পাল এই খালের জলে হুলুস্থুল করে বেড়ায়। হেমাঙ্গের সেটা অনেক সময় মনে থাকে না। হয়তো তার কিছু অন্যমনস্ক বদভ্যাস আছে, নিজেও আঁচ করে। কোথাও অবচেতনায় একটু পারভার্সান আছে।

আয় হুলো, পিসিমা তোকে দেখলে খুশি হবে। বলে হেমাঙ্গ পা বাড়ায়।

হুলো ঘুরে মুসহর বস্তির দিকটা দেখে নিয়ে বলে, এখন যাব না হেমাদা। ঝেণ্টুদা বকবে। তোমাকে দেখতে পেয়ে চলে এসেছি। আমি যাই গো হেমাদা।

সে আবার মুসহর বস্তির দিকে চলে যায়। হেমাঙ্গ বাড়ি ঢুকে টিউবওয়েলের ধারে বসে মুখ ধোয়। মুনাপিসি কাঁসার গেলাস আঁচলচাপা করে চা খাচ্ছে বারান্দায়। যতক্ষণ চা খাবে মুখ খুলবে না সে।

একটু পরে হেমাঙ্গ সাইকেল বের করে। বলে, পোস্টাপিস থকে ঘুরে আসি। ডাবু চটে আর চিঠিপত্র দিচ্ছে না। একটা চিঠি লিখে দিইগে আজ।

মুনাপিসি বলে, হেমা, বাজারটা করে আনিস বাবা! রোজ আর একে—ওকে সাধতে পারিনে।

কই, দাও।

থলে আর টাকা নিয়ে হেমাঙ্গ বেরিয়ে যায়। কোনো বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় সেদিকে তাকায় না। খুব জোরে বেরিয়ে যায়।