অশরীরী ঝড় – ১০

দশ

সুলোচনা অমিকে রিকশো করে নিয়ে গেছেন জটাবাবার থানে। সঙ্গে পল্টে গেছে সাইকেলে। এইতে প্রমথ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। রোয়াকে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ ওঠেন এবং ভেতরে গিয়ে টলুকে বলেন, জনকে জামা—প্যান্ট পরিয়ে দে। ওকে নিয়ে বেরুব।

ইলুও সঙ্গ ধরল। তাই দেখে মিলু বলে, বাবা, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

প্রমথ ধোয়া ধুতি পাঞ্জাবি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভুরুতে চিরুনি চালাচ্ছিলেন, বলেন ব্লক কোয়ার্টারে। শংকরী প্রায় বলে, যাওয়া হয় না রে। তুই যাবি!

ইলু খুনসুটি করে, নাও! আমার যাওয়া সইবে না। পঙ্গপাল সঙ্গ ধরবে। যায় তো ওরা যাক। আমি না।

মিলু বাঁকা ঠোঁটে বলে, আমি কারুর সঙ্গে যাব না। আমি যাব মহুয়াদের কোয়ার্টারে।

প্রমথ বলেন, মহুয়া কে রে?

আছে ওখানে। তুমি চিনবে না।

শেষঅব্দি প্রমথ দুই মেয়ের মধ্যে রফা করে দিলেন। জন মুখটা সাদা করে ফেলেছে পাউডারে। টলু আঁচল ঘষে মুছতে গেলে জন ছিটকে বেরিয়ে গেল। টলু বোনদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি একা থাকব বাড়িতে?

পাছে বড়দিও সঙ্গ ধরে, ইলু দ্রুত বলে, কেন? ঘণ্টার মা রইল না?

মিলু হাসে।… ও বড়দি। যদি তোকে সৈকা বাগে পেয়ে ধরে?

প্রমথ ঘড়ি দেখে কপট ধমক দেন, নাও! হল তোমাদের সাজগোজ? জন কোথায় গেলি রে! সাড়ে চারটে বেজে গেল। আয় ইলু। তারপর ছড়িটি আলমারির মাথা থেকে টেনে বের করেন।

মিলু বেরুল সবার শেষে। একা পেছনে যাবে। ইলুর সঙ্গে ঝগড়া চলছে সকাল থেকে। বইয়ের পাতা ছেঁড়াছেঁড়ি পর্যন্ত হয়েছে।

টলু রোয়াকে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছিল। দলটা আড়াল হয়ে গেলে সে বাড়ির দিকে ঘুরে ঘণ্টার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে, মাসি! আমি এখানে আছি।

কদিন থেকে গরম পড়েছে। বাতাসও বইছে না। গাছপালার ঝিমধরা অবস্থা। আকাশকে শক্ত দেখাচ্ছে। বিকেলে এই ছোট্ট বাগানে অনেকরকম শব্দ অনেক গন্ধ। কোনার আমগাছে এবার বেশি মুকুল আসেনি। ভোরের কুয়াশার উপদ্রবে গুটিও ধরেনি বিশেষ। গতবার খুব আম হয়েছিল। টলু কোমরে আঁচল জড়িয়ে আমতলায় ঘোরে কিছুক্ষণ। তারপর ফুলগাছগুলোর দিকে যায়। ওদিকটা খোলামেলা। সেই সময় লক্ষ্য করে পশ্চিমের আকাশ জুড়ে চাপ চাপ মেঘ ঘনিয়েছে কখন। মেঘের মাথায় মেটে সিঁদুরের ছোপ। পুরনো ট্যাংকের ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে সাদা বক পালিয়ে যাচ্ছে। তারপর সোনালি রূপোলি রঙ ছড়িয়ে পড়ার মতো বিদ্যুৎ ঝিলিক দিতে থাকে। দূরে চাপা গুমগুম শব্দ ওঠে। কোথাও শনশন শব্দ হয়। তারপর দ্রুত বিকেলের রোদ চাপা দিতে দিতে আবছায়া ঘন হয়ে ওঠে। ঘণ্টার মা ডাকছিল—টলু, ও টলু। ঝড় উঠছে যে গো। ওরা সব বেরুল অবেলায়। ও মা, কী হবে!

টলু রাগ দেখিয়ে বলে, কী হবে আবার? জানলা বন্ধ করোগে যাও!

বছরের প্রথম কালবৈশাখীর স্বাদ গায়ে নেয় টলু। চারপাশে হাজার হাজার হাতি শেকল ছিঁড়ে ফেলার জন্যে ছটফট করছে। হাতিগুলো মাটি কাঁপিয়ে হুলুস্থুলু করছে। কবে কোন প্রাগৈতিহাসিক সময়ে শেকলে ধরা পড়া আসঙ্গলিপ্সু কালো—কালো মত্ত হাতি। বিশাল শরীর। শুঁড় তুলে বৃংহতি নাদ তুলেছে। তাদের পায়ের শব্দ, কালো শরীরের পিচ্ছিল স্পর্শ মাথার মধ্যিখানে। শেকল খুলে দেওয়ার ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়েছে। পোড়ো রেশমকুঠির ওদিকে দেবদারু গাছের মাথা ভেঙে পড়ল। ঘণ্টার মা আবার রোয়াকের দিকে বেরিয়ে আর্তনাদ করে, ও টলু! শিল হবে, শিল। গতিক ভালো না গো! ফাঁকায় থেকো না বাপু!

বোনেরা মিলে শিল কুড়োনো অভ্যাস আছে। টলু ঝড়ের ধাক্কায় টালমাটাল। ওর কাপড় জড়িয়ে যাচ্ছে এবং খুলে যাচ্ছে। কুঁজো হয়ে পা ঢাকতে ঢাকতে আসে। চোখ খোলা কঠিন। ধুলো খড়কুটো ছেঁড়াপাতা ঘুরপাক খাচ্ছে। রোয়াকের কাছে এসে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, হেমাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। জ্বালাকরা চোখ কচলাতে কচলাতে টলু লাফ দিয়ে উঠে বলে, হেমা যে! আর আসবার সময় পাওনি? অসময়ে মরতে এলে? যাও, ভাগো! কেউ নেই বাড়িতে।

সেই সময় শিলপড়া শুরু হল। অলীক সন্ধ্যার আবছায়া জুড়ে কুয়াসার ধূসর পর্দা পড়ল। ঘণ্টার মা ভেতরে চলে গেছে। টলু হেমাঙ্গের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, মুখে বোবা ধরেছে, হেমা? কথা বলছ না যে?

হেমাঙ্গ হাসে। তুমি তো ভাগিয়ে দিচ্ছ টলুদি!

দেব না কেন? তুমি যার কাছে এসেছ, সে তো নেই। মা ওকে নিয়ে জটাবাবার থানে গেছে। বাবা, জন, মিলু, ইলু গেছে ব্লক অফিসের ওখানে। টলু রোয়াকে নেমে হাতের তালুতে শিল কুড়োতে থাকে। তুমি ঠিক সময়ে আসোনি। গেট আউট।

হেমাঙ্গ বলে, ঠিক আছে। চলি।

সে রোয়াকে নামতেই টলু ওর প্যান্ট খামচে ধরে ভিজে হাতে। আরে! তুমি পাগল না মাথা খারাপ? মরবে নাকি? শিল পড়ছে। বাজ ডাকছে! এসো, শিল কুড়োও আমার সঙ্গে।

অগত্যা হেমাঙ্গ মোটা কয়েকটা শিল কুড়িয়ে দুহাতে লোফালুফি করে। ইস। রক্ত জমে যাচ্ছে যে! তুমি ধরে আছো কীভাবে টলুদি?

টলু হাসে। আমার হাতে কোনো সেন্সেশান নেই।

যাঃ! ঠান্ডা লাগে না তোমার?

বললুম তো। আমার গন্ডারের চামড়া। বলে টলু যেন নিজের চামড়ার শক্তি দেখাতেই কয়েক পা এগিয়ে যায়। ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতকে পরোয়া নেই, এমন ভঙ্গিতে থানের শাড়ি ভিজিয়ে এবং মুহুর্মুহু শিলীভূত বৃষ্টির প্রহারকে তুচ্ছ করে টলু তার দিকে ঘুরে হাসে, মুখ গড়িয়ে ফোঁটা ঝরে পড়ে গলার খাঁজে।

হেমাঙ্গ বলে, এই টলুদি! কী হচ্ছে? উঠে এসো, উঠে এসো।

সামনে কাছাকাছি কোথায় বাজ পড়ে এবং চোখের সামনে বিস্তৃত ঝলক—হেমাঙ্গ চোখ বুজে ফেলে এবং যখন খোলে, টলুকে কাছে দেখতে পায়। ভিজে জবুথবু অবস্থা। একটু—একটু কাঁপছে। কাপড় সেঁটে গেছে শরীরে। ফর্সা রঙ আবছায়ার মধ্যে ফুটে বেরিয়ে দাউ দাউ জ্বলছে। সে বলে, হেমা! হাঁ করো!

কেন?

শিল খাও। হাঁ করো।

ছ্যাঃ। ওই নোংরা জায়গায় পড়েছিল!

ইস! খুব ভালো জায়গার মানুষ তুমি। বলে হাসতে হাসতে শিলগুলো ফেলে দিয়ে টলু কাঁপতে কাঁপতে পা বাড়ায়। ভীষণ শীত করছে যে! হেমা, ভেতরে এসো। কাপড় বদলে নিই! বাবা রে বাবা! কত বিশ্রী গরম করছিল এতক্ষণ! এখন দেখি ডিসেম্বরের শীত!

হেমাঙ্গ ভেতরে যায়। ভেতরের বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে। কিচেনের দরজার কাছে ঝি—মেয়েটি চুপচাপ বসে আছে। টলু তার ঘরে ঢোকে। আলো জ্বালে। ডাকে, হেমা! এসো। ওখানে ভিজছ কেন?

হেমাঙ্গ বাধ্যছেলের মতো ওর ঘরে যায়। সেই বিশাল বিছানা। হারমোনিয়াম, তানপুরা, ডুগিতবলা। সে চুপচাপ বসে বিছানায় পা ঝুলিয়ে। টলু বাইরে কোথাও কাপড় বদলাচ্ছে।

একটু পরে তোয়ালেতে চুল ঘষতে ঘষতে সে ফিরে আসে। বলে, প্রথম কালবোশেখি আজ। তাই না রে হেমা?

হেমাঙ্গ বলে, হ্যাঁ। জাস্ট তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসেছি, আর…

অ্যাদ্দিন আসিসনি কেন রে?—টলু একটু হেসে ফের বলে, দেখছিস? তোকে আগের মতো তুই তোকারি করছি। তুই আমার চেয়ে এক—দেড় বছরের ছোট। তাই না? লালু আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট ছিল।

লালুর চেয়ে আমি দুমাসের বড়ো।

বলিস কী! টলু বিছানা ঘুরে এগিয়ে উত্তরের জানলা খুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট আসছে দেখে বন্ধ করে দেয়। বলে, তোর গরম লাগছে না তো? আমার শীত করছে।

করবেই তো। ভিজেছ। বলে হেমাঙ্গ সিগারেটের প্যাকেট বের করে।

টলু আঁতকে উঠে বলে, এই! খাসনে। ওরা এসে গন্ধ পাবে।

হেমাঙ্গ চকিতে অপ্রস্তুত হয়। প্যাকেট পকেটে ঢুকিয়ে আমতা হেসে বলে, তুমি একসময় লুকিয়ে সিগারেট খেতে আমাদের সঙ্গে। মনে পড়ছে?

টলু কেমন হাসে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে বলে, বোস। চা নিয়ে আসি।

হেমাঙ্গ প্যান্টের বাঁ পকেটে রুমালের তলায় হাত ঢুকিয়ে দেখে নেয়, জিনিসটা আছে কি না। ভাগ্যিস দুপুরে সুরকির পাঁজা থেকে বের করে রেখেছিল। নইলে ভিজে জং ধরে যেত। শেষঅব্দি অনেক ভেবে সে রিভলবারটা অমিকেই ফেরত দিতে এসেছে। নার্ভের চূড়ান্ত অবস্থা! রিস্ক নিয়েই এবাড়ি এসেছে। বারবার এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখেছে, কেউ তাকে ফলো করছে নাকি। ভাগ্যিস ঝড়টা এসে পড়ল!

কিন্তু অমিকে নিয়ে গেছে জটাবাবার থানে। লোকোশেডের ওদিকে একটা বড়ো পুকুরের পাড়ে জঙ্গুলে জায়গায় থান। এক মুসলমান সাধুর কবর আছে। ওখানে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ওরা কীভাবে আছে কে জানে! একজন সেবায়েত ফকির থাকে অবশ্য। একটা ভাঙাচোরা ঘর আছে ইটের। ঘরটা যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। হেমাঙ্গ উদ্বেগ বোধ করে।

তার চেয়েও সমস্যা তার নিজের। আবার রিভলবারটা নিয়ে যাওয়া!

হঠাৎ মনে হয় টলুকে বলবে সব? টলুর কাছে দিয়ে যাবে? টলু অমিকে দেবে। তারপর ভাবে, অমি ব্যাপারটা কীভাবে নেবে? সে ভুল বুঝতে পারে হেমাঙ্গকে। আনমনে হেমাঙ্গ তানপুরাটা টেনে নিয়ে পিড়িং পিড়িং করতে থাকে।

টলু দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে এল। এসে বলে, জানিস আমার চা খাওয়া বারণ? এই সব সুযোগ পেলে লুকিয়ে খাই। এমনকি কাটলেট পর্যন্ত।

হেমাঙ্গ চা নিয়ে বলে, কাটলেট কোথায় পাও?

কাটলেট কোথায় পাওয়া যায় রে?

সে তো বসন্ত কাফেতে।

তবে জিগ্যেস করছিস কেন?

আহা, এনে দেয় কে?

টলু চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার পাশে বসে। বলে, আমার লোক আছে। বলব না।

হেমাঙ্গ চুপচাপ চা খায়। এখন বেশ অন্ধকার ঘনিয়েছে বাইরে। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি সমানে পড়ছে। ঝড়টাও চলেছে। হেমাঙ্গ বলতে যাচ্ছে এখন লোডশেডিং হলে দারুণ জমে—বলার মুখেই সত্যি তাই হল। ঝড়ের দিন এ ব্যাপারটা প্রতিদিনই হয়। কোথায় মেন লাইন ছিঁড়ে যায়। থাম উপড়ে যায়।

ঘণ্টার মা চেঁচিয়ে উঠেছিল কিচেনের দিকে। টলু সাড়া দিয়ে বলে, তাকে মোম আছে। জ্বেলে নাও। এই হেমা! দেশলাই জ্বাল। হ্যারিকেন বের করি।

হেমাঙ্গ দুষ্টুমি করে বলে, থাক না। সৈকার ভূতটা এসে জমিয়ে তুলুক।

চাপা গলায় টলু বলে, যাঃ! ঘণ্টার মা আছে। কী ভাববে! জ্বালা না ভাই, দেরি করিস নে! বুড়ি ভীষণ লক্ষ্য রাখে সব।

হেমাঙ্গ এবার একটু কেঁপে ওঠে। তার হৃৎপিণ্ডে রক্ত শিসিয়ে উঠেছিল। খিল ধরা অবস্থা। দুই ঊরু ভার। কাঁপা কাঁপা হাতে সে চায়ের কাপটা অন্ধকারে পায়ের তলায় নামিয়ে রাখে। তারপর পকেট থেকে দেশলাই বের করে। কাঠি জ্বালে।

টলুও নীচে কাপপ্লেট ঠেলে দিচ্ছে। হেরিকেন খুঁজছে খাটের তলায়। কাঠিটা নিভে যায়। আবার জ্বালে হেমাঙ্গ। লক্ষ্য করে দুটো কাপেই আদ্ধেক চা রয়ে গেছে। সে জড়ানো গলায় বলে, পাচ্ছ না?

না রে! এখানেই তো ছিল। নিশ্চয় মায়ের কীর্তি! টলু গজগজ করে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। কিচেন থেকে মোম নিয়ে আসি দাঁড়া। তোর দেশলাইয়ের দরকার নেই। রাখ।

হেমাঙ্গ দেশলাই পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছে, উঠোনের দিকে তীব্র আলোর ঝলক এবং প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। কানে তালা ধরে গেল।

টলু ‘ও মা!’ বলে তার ওপর ছিটকে পড়েছে এবং তার ধাক্কায় হেমাঙ্গও বিছানায় চিত হয়ে গেছে। ঠেলে ওঠার চেষ্টা করছে, তখনও তাকে দু’হাতে ধরে আছে টলু।

মেয়েদের শরীরের স্পর্শ এবং কমনীয় ভার অমির কাছে পেয়েছে হেমাঙ্গ। এ শরীর অন্য শরীর। আর টলু কি ব্রেসিয়ার পরে না? সরাতে গিয়ে হেমাঙ্গ টের পায়, টলু তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। হেমাঙ্গ আস্তে সাবধানে বলে, আঃ। ছাড়ো!

টলু কি হাসছে নিঃশব্দে? নাকি সত্যি সত্যি ভয়ের কাঁপুনি? তারপর সে ফিসফিস করে বলে, এই বাঁদর! অমি হলে এখন কী করতিস রে?

প্লিজ, টলুদি! হেমাঙ্গ প্রায় ককিয়ে ওঠে।

বল না? ধর, অমি তোকে এভাবে শক্ত করে—এমনি ভীষণ জোরে, তোকে মনে কর জড়িয়ে ধরেছে। আর তুই—তুই কী করবি?

অগত্যা হেমাঙ্গ বলে, তুমি তো অমি নও।

মনে কর না বাবা, অমি আমি। অন্ধকারে আমাকে তো দেখতে পাচ্ছিস নে! আমি অমি।

হেমাঙ্গের বুকের ভেতর বাইরের মতো ঝড়জল। বুক কাঁপছে। সে বলে, বেশ তাই। কিন্তু আমার দম আটকে আসছে, সত্যি। তুমি ভীষণ ভারী যে!

চাপা হেসে টলু সোজা হয়। কিন্তু সরে না। হেমাঙ্গ উঠে বসে। তার ঊরুর ওপর চাপ লাগে টলুর। তার দুই কাঁধে যেন নখ বসিয়ে রেখেছে মেয়েটা। হেমাঙ্গ মনে মনে আফশোস করে। জেনেশুনে ডাইনি অথবা বাঘিনীর গুহায় ঢুকতে এসেছিল। অমি তাকে কতবার টলুর সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিল। কিচ্ছু মনে ছিল না হেমাঙ্গের।

টলু ফিসফিস করে বলে, অমিকে সত্যি বিয়ে করবি, না পথে ভাসাবি বল তো?

কেন?

বাইচান্স যদি ওর বাচ্চাটাচ্চা এসে যায় পেটে!

ভ্যাট! কী বলছ আজেবাজে কথা!

মারব থাপ্পড় বাঁদরকে। আমি জানি নে? আমার কাছে লুকিয়ে পার পাবি নে হেমা!

হেমাঙ্গ অস্বস্তিতে ঘামছে। বলে, এখন তোমাদের ঘণ্টার মা কিছু ভাবছে না?

বয়ে গেল! তুই আমার কথার জবাব দে।

কী জবাব দেব?

অমিকে বিয়ে করবি, না স্রেফ মজা লুটে কেটে পড়বি?

দেখ টলুদি, একজাক্টলি ডন আমাকে এই কথা বলেছিল বলে—

ওর মুখে থাবা পড়ে।—বেশ করেছিল ডন। ওর দিদির সর্বনাশ করবি, আর ও তোকে ছেড়ে দেবে? মনে রাখিস, ডন এখনও বেঁচে আছে। তুমি সাবধান। জগার মতো অবস্থা হবে!

তুমি কেন আমাকে শাসাচ্ছ বলো তো?

শুধু শাসাচ্ছি? তোকে পিষে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে!

বেশ, মারো! হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হেমাঙ্গ বলে।

টলু তাকে সত্যি সত্যি পিষে মেরে ফেলার মতো ফের দু’হাতে জড়িয়ে আচমকা ঝুঁকে তার নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। হেমাঙ্গ অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। ধস্তাধস্তি করে ওকে হঠানোর চেষ্টা করে। টলুর গায়ের জোর দেখে তার অবাক লাগে।

তারপর হঠাৎ টলু তার প্যান্টের পকেট টিপে ধরে বলে, কী রে এটা? ব্যথা করছে! এত শক্ত কী এটা? টর্চ?

হেমাঙ্গ হাঁসফাঁস করে বলে, টর্চ! আঃ, ছাড়ো না! কী হচ্ছে?

টর্চ? ন্যাকা শেখাচ্ছ? দেখি, দেখি।

হেমাঙ্গ মরিয়া হয়ে বিছানা থেকে ঠেলে ওঠে এবং ওকে ধাক্কা দেয়। টলু পাথরের মতো। নড়ানো যায় না। হেমাঙ্গ বলে, তোমাকেও ভূতে ধরেছে টলুদি! ছাড়ো এবার। আমি চলে যাব।

তোর পকেটে ওটা কী?

ও একটা জিনিস।

বল কী জিনিস?

বলা যাবে না।

হেমা! না বললে আমি চেঁচাব। তোর কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ঘণ্টার মা সাক্ষী।

হেমাঙ্গ আরও ভয় পেয়ে যায়। বলে, তোমার লজ্জা করবে না?

কীসের লজ্জা? তুই বাগে পেয়ে আমাকে ধরতে এসেছিলি—আমার কী দোষ হবে?

সত্যি! তোমাকে চিনতে পারিনি টলুদি, তুমি— তুমি—

বল, বল—কী আমি?

তুমি ডেঞ্জারাস মেয়ে!

নেকু! জানো না সেটা? গাল টিপলে দুধ বেরোয়?

ছাড়ো! প্লিজ টলুদি! আমি চলে যাব।

এই রে! তুই কেঁদে ফেললি ভ্যাঁ করে। আয়, তোকে আদর করি।—বলে সে হেমাঙ্গের পাশে বসে পড়ে। কিন্তু ওকে ছাড়ে না।

হেমাঙ্গ বুঝেছে, টলু তাকে ব্ল্যাকমেল করছে। ওর হাত থেকে তার আজ পরিত্রাণ নেই। সে শান্ত হবার চেষ্টা করে। এবার টলু রাক্ষুসীর মতো তাকে অন্ধকারে জিভ বের করে গিলতে আসছে মনে হয়। বাইরে বৃষ্টিটা কিছু ধরেছে। কিন্তু ঝোড়ো বাতাস আছে। মেঘও ডাকছে। কিচেন এখান থেকে দেখা যায় না। বুড়িটা নিশ্চয় কতকিছু ভাবছে। হেমাঙ্গ অসহায় হয়ে বসে থাকে। টলু তার পকেট থেকে মোড়কটা বের করার চেষ্টা করে আবার। তখন হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ওটা ডনের রিভলবার।

কোথায় পেলি রে?

হেমাঙ্গ মিথ্যে বলতে শুরু করে।—ডন রাখতে দিয়েছিল। আমি ওর দিদিকে ফেরত দিতে এসেছি। বুঝতে পারছ না? রিসকি ব্যাপার!

ঠিক আছে। আমার কাছে রেখে যা। দেব অমিকে।

হেমাঙ্গ মোড়কটা বের করে ওর হাতে গুঁজে দেয়। টলু ওটা অন্ধকারে একটু ঝুঁকে সম্ভবত বালিশের তলায় গুঁজে রাখে। হেমাঙ্গ বলে, তোমাদের বাড়ি হঠাৎ সার্চ হলে বিপদে পড়বে কিন্তু।

টলু ভারী নিশ্বাস ফেলে বলে, আর কতবার হবে? তিনবার হয়ে গেছে। আর হবে না।

এবার আমাকে যেতে দেবে তো?

হেমা! আমাকে তুই খুব ঘেন্না করিস। না রে?

না, না। কেন ঘেন্না করব?

আমাকে তোর ভালো লাগছে না?

লাগছে। না লাগার কী আছে?

টলু ওর মুখের কাছে ঝুঁকে এসে শ্বাস—প্রশ্বাস মিশিয়ে বলে, হেমা! আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারিস কোথাও? আমার বড্ড কষ্ট রে! সময় কাটতে চায় না। বিশ্বাস কর, আমি সারারাত জেগে থাকি। ছটফট করি। কী সাংঘাতিক মনোটনাস লাইফ, হেমা! আর বাঁচতে এতটুকু ইচ্ছে করে না।

কেন টলুদি?

তুই বুঝিস নে হেমা? কেন ন্যাকামি করছিস? এবার তোকে চড় মারব আমি।

হেমাঙ্গ একটু হাসে। মারো না! অভ্যাস আছে।

হ্যাঁ, অমি তোকে চড় মেরেছিল।

অমির ওপর তোমার খুব হিংসে তাই না টলুদি?

কথাটা বলে হেমাঙ্গ নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনল। টলু তার জামা খামচে মড় মড় করে টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং হিংস্রভাবে তাকে আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। হেমাঙ্গ বুঝতে পারে জটাবাবার সাহায্যে সৈকা অমিকে ছেড়ে চোখের পলকে এখানে চলে এসেছে এবং টলুকে ধরে ফেলেছে।

হেমাঙ্গ প্রেতিনীকে সামলানোর চেষ্টা করে। তার পালানোর আর কোনো উপায়ই নেই।

মোহনপুরের মাটি হাউসিং কলোনি এলাকায় গাঙ্গেয় পলিতে তৈরি। যত বৃষ্টি হোক, জল শুষে নেয়। কাদা হয় না বিশেষ। উত্তরে লিচুতলার ওদিকটা আবার অন্যরকম। এঁটেল আর দোয়াঁশ মাটি ওদিকে ঢেউ খেলানো। একছিটে বৃষ্টিতেই প্যাচপেচে কাদা। ব্লক কোয়ার্টারে প্রমথ চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন তখনও। শঙ্করীপ্রসাদ তাঁর আমলের হেড—ক্লার্ক। রথ দেখা কলা বেচা দুই—ই হচ্ছে। অর্থাৎ কমিউনিটি সেন্টারের টেন্ডারের খবরাখবর নিতেই গেছেন। মিলু পাশের কোয়ার্টারে ওর বন্ধু মহুয়ার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। ওদিকটায় আলো যায়নি। কিন্তু বাকি মোহনপুর অন্ধকার। স্টেশনে অবশ্য আলো আছে। রেলের নিজস্ব ব্যবস্থা আছে বরাবর। তখন বৃষ্টি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। টিপ টিপ পড়ছে। আকাশ কিন্তু মেঘে ঢাকা। বাতাস অল্পস্বল্প আছে। গা শিরশির করা ঠান্ডা খেলছে আবহাওয়ায়। পোকামাকড় গলা খুলে গান জুড়েছে। ক্যানেলে ভীষণ চ্যাঁচামেচি করে ব্যাঙ—ব্যাঙনিরা ডাকাডাকি করছে। এখনও জোনাকদের মরশুম আসেনি। দু’চারটে বেরিয়ে পড়েছে বৃষ্টির স্বাদ ও ভিজে মাটির গন্ধে আবিষ্ট হয়ে। মাটির ওপর ঘোরাঘুরি করে উড়ে গিয়ে ঝোপের ডগা আর গাছের গা ঘেঁষে ঘুরছে। এই সব সন্ধ্যার একটা আলাদা স্বাদ। এতদিন চুপ করে থাকার পর দীর্ঘ নিঝুমতা ভেঙে অদৃশ্য আত্মাদের মতো পোকামাকড়েরা জেগে ওঠে। দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। পথে ছেঁড়া পাতা আর ভাঙা ডালপালা পড়ে আছে। অন্ধকারে হেমাঙ্গ ক্লান্তভাবে হাঁটে এবং বারবার সেগুলো পায়ে জড়িয়ে যায়। খোয়াঢাকা এবড়োখেবড়ো রাস্তায় টোক্কর লাগে। স্লিপারের ফিতে ছিঁড়ে যায়। টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরে। শীত বেড়ে যায় এদিকটায় পৌঁছে। অন্ধকারে সাপের ভয় তাকে চমকে দেয় বারবার। পায়ে নরম ঠান্ডা কিছু ঠেকলেই সে লাফিয়ে ওঠে। পা ছোড়ে। শরীরে এতটুকু জোর নেই। ছিবড়ে হয়ে গেছে। ক্লান্তির স্বাভাবিক আনন্দটুকুও নেই। গা ঘিনঘিন করে। জামা বুকের কাছে ছেঁড়া। কীভাবে মুনাপিসির সামনে দাঁড়াবে সেই অস্বস্তি।

এদিকে ঘরবাড়ি দূরে—দূরে ছড়ানো। তাদের বাড়িটাই শেষ বাড়ি। বাঁদিকে একটু দূরে খালের ওপারে রেল ইয়ার্ডের আলো দেখা যায় এতক্ষণে।

বাড়ির সামনাসামনি এসে এমনি একবার রেল ইয়ার্ডের দিকে তাকায়। এখানে ওখানে ওয়াগন দাঁড়িয়ে রয়েছে। লাল সবুজ বাতি জ্বলছে। সিগন্যাল পোস্টের কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়। হয়তো মুসহর বস্তির কেউ। ওদের ল্যাট্রিনের বালাই নেই। রেল লাইনের ধার বরাবর নোংরা করে রেখেছে।

তারপর হেমাঙ্গ বুঝতে পারে, যে দাঁড়িয়ে আছে, সে স্ত্রীলোক।

তারপরই তার গা শিউরে ওঠে। সৈকা ওখানেই মারা পড়েছিল। ভূতের ভয় তাকে পেয়ে বসে। লোকেরা বলে, সৈকা নাকি ওখানে মাঝে মাঝে রাতবিরতে দাঁড়িয়ে থাকে। রেলের সিকিউরিটির লোকেরাও বলাবলি করে একথা। হেমাঙ্গ ভূত যুক্তি দিয়ে মানে না, কিন্তু ভূতের ভয় অন্য ব্যাপার।

ভয়ের চোখে সেদিকে ফের তাকিয়েই সে বারান্দায় উঠে পড়ে। এসময় ভয়টা তাকে এমন বাগে পেয়েছে যে মনে হয় পিঠের কাছে সৈকা এসে গেছে। তার গলা কেঁপে যায় ডাকাডাকি করতে। ভেতরে মুনাপিসির সাড়া পেয়ে তার সাহস হয়।

সে বুদ্ধিমানের মতো জামাটা খুলে ফেলে। হেরিকেন নিয়ে দরজা খোলে মুনাপিসি। কোথায় ছিলি রে? প্রলয় ঘটে গেল এতক্ষণ। আমি খালি ঠকঠক করে কাঁপছি—আর ভাবছি!

হেমাঙ্গ ভেতরে ঢুকে ঝটপট আলনা থেকে লুঙ্গি নিয়ে প্যান্ট ছাড়তে থাকে। বলে, আটকে গেলুম জ্ঞানবাবুর বাড়িতে। জ্ঞানবাবু তো সকালের ট্রেনে চলে গেছেন। দেখা হল না।

হল তো? তোকে এত করে বললুম, গতকালই যাবার কথা ছিল!

আকবর বলল, আবার শিগগির আসছেন।

বিষ্টিটা আরেকটু ছাড়লে না হয় আসতিস বাবা! ভিজে এতটা পথ এলি। বললুম, সাইকেলে যা। তাও গেলিনে! এবার ঠান্ডা লেগে জ্বর—জ্বারি হোক।

হেমাঙ্গ টিউবওয়েলের কাছে যাচ্ছিল। মুনাপিসি বলল, এখনও টিপটিপ করে ঝরছে। ভিজিস নে আর। জল নে!

কোনোরকমে হাত পা আর মুখ গলা কাঁধ রগড়ে ধুল হেমাঙ্গ। স্নান না করলে এই ঘৃণার হাত থেকে রেহাই নেই।

চা খাবি নাকি? বরং দুধ খা গরম—গরম।

থাক।

থাকবে না। মুনাপিসি ধমক দেয়। গরম দুধ খা। উনুনে বসিয়ে রেখেছি।

হেমাঙ্গ তার ঘরে আসে। টেবিল থেকে দেশলাই নিয়ে ড্রয়ার খোলে। মোমবাতি বের করে জ্বালে। দেশলাইটা গুঁড়ো হয়ে গেছে। সিগারেটের প্যাকেটও গেছে চেপ্টে! মোম টেবিলে বসিয়ে রেখে তার ইচ্ছে করে, সিগন্যালের কাছে মেয়েটা এখনও আছে নাকি দেখবে। না থাকলে ভূত বলে মেনে নেওয়া মন্দ হবে না। এমন রাতে ঘরে বসে ভূতের কথা ভাবতে ভালোই লাগবে।

সে বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় যায়। তারপর সিগন্যালের দিকটায় তাকায়। আরে! এখনও ওখানে তেমনিভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে! নাকি ওটা আদতে মানুষই নয়, কোনো কাঠের পোস্ট? চোখের ভুল হচ্ছে না তো?

ভুল নিশ্চয় হচ্ছে না। আলো আছে ওখানে। সামান্য তফাতে অনেক উঁচুতে তীব্র মারকারি বালব জ্বলছে—থালার মতো চওড়া সসার ল্যাম্প।

মুনাপিসি ডাকল ঘরে ঢুকে। কই রে? বাইরে কী করছিস?

পিসিমা, দেখে যাও তো!

মুনাপিসি বেরিয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে। কী রে?

দেখ তো, ওটা কোনো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে না?

মুনাপিসি দেখে নিয়েই ওর হাত ধরে টানে। চাপা গলায় বলে, চলে আয়। কোথায় কে দাঁড়িয়ে আছে, তাই নিয়ে মাথাব্যথা কীসের তোর?

হেমাঙ্গ গোঁ ধরে দাঁড়ায়। বলে, কেউ সুইসাইড করার জন্যে ওভাবে দাঁড়িয়ে নেই তো?

মুনাপিসি রাগ দেখিয়ে বলে, তোর খালি অলক্ষুণে ভাবনা। মুসহর বস্তির কেউ জল সরতে বেরিয়েছে।

হেমাঙ্গ বলে, ভ্যাট! কতক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার মুনাপিসি চাপাগলায় বলে, হেমা! অমি নয়তো রে?

সেই তো সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু আমি তো… হেমাঙ্গ চেপে যায়। অমিকে নিয়ে তার জেঠিমা ঝড়জলের আগে জটাবাবার থানে গেছে। হেমাঙ্গ যতক্ষণ বোসবাড়িতে ছিল, ওরা ফিরে আসেনি। তারপর এইটুকু সময়ের মধ্যে অমি কীভাবে ওখানে আসতে পারে? সে বলে, পিসিমা! আমি দেখে আসি।

মুনাপিসি আপত্তি করার সুযোগ পায় না। হেমাঙ্গ জানে তার টর্চের ব্যাটারি সেই কবে ক্যানেলের মাঠ থেকে ফেরার পর বোসবাড়ির গেটের কাছে শেষ স্ফুলিঙ্গ দিয়ে গেছে। আর নতুন ব্যাটারি আজকাল করে ভরা হয়নি। সে বারান্দা থেকে লাফিয়ে হনহন করে ছোট পোলের দিকে এগিয়ে যায়। এই পোলটা কাঠের। বাঁদিকে ঘুরে গিয়ে পৌঁছয় সে। ওখানেই একদিন মুখ ধুতে গিয়ে হুলোর কাছে অমিকে ভূতে ধরার খবর শুনেছিল।

হেমাঙ্গ মুসহর বস্তির কুকুরগুলোকে সচকিত করে চলতে থাকে। ওরা তাকে কিছুদূর অনুসরণ করে। তবু চ্যাঁচাতে ছাড়ে না। সিগন্যাল পোস্টের কাছাকাছি গিয়ে একবার দাঁড়ায় হেমাঙ্গ। ভালো করে দেখে নিতে চায় অমি না অন্য কেউ। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরঅব্দি ছড়ানো চুল।

চুল দেখেই হেমাঙ্গ লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে যায়। যত কাছাকাছি হয়, তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে অমি। কোমর ও পাছায় শায়া বেরিয়ে রয়েছে এবং শাড়ি প্রায় খুলে পায়ের কাছে পড়েছে। আঁচলের দিকটা কোনোমতে কাঁধে ঝুলছে। অমি বলে চেঁচিয়ে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ও একটু ঘোরে। হেমাঙ্গের বুক কেঁপে ওঠে। অমির মুখটা মরা—মানুষের মুখের মতো রক্তশূন্য, চোখের দৃষ্টি ভাসা—ভাসা—অথচ আলোর ছটায় কেমন যেন নীলচে বন্য, নিষ্ঠুর। কিন্তু ঠোঁটের কোণায় পাগলাটে হাসি।

হেমাঙ্গ ওর কাছে যাওয়ামাত্র সে দৌড়ুতে শুরু করে। লাইনের নীচে সরু পায়ে চলা পথ। তার ডাইনে আগাছাগজানো কাঁটাতারের বেড়া। ওই পথে দৌড়ে যেতে যেতে অমি আচমকা বেড়ার দিকে ঘোরে। ঠেলে বেরুতে গিয়ে আটকে যায়। হেমাঙ্গ লাফ দিয়ে তাকে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, অমি! অমি! অমি!

অমি মুসহরবুলিতে গেঙিয়ে কীসব বলে এবং হেমাঙ্গকে আঁচড়াতে কামড়াতে শুরু করে। এবার হেমাঙ্গ তার গালে চড় মারে। অমি নেতিয়ে পড়ে।

হেমাঙ্গ হাঁটু গেড়ে বসে তাকে তুলে ধরে ডাকে, অমি, অমি! আর কোনো সাড়া পায় না। ওকে শুইয়ে রেখে ওর শাড়িটা কাঁটা থেকে ব্যস্তভাবে ছাড়িয়ে নেয় হেমাঙ্গ। শাড়িটা ভিজে ছপছপ করছে। অমির ব্লাউস আর সায়াও ভিজে। গা ঠান্ডা। চুলও ভীষণ ভিজে। হেমাঙ্গ বুঝতে পারে, হয়তো পুরো ঝড়জলটা অমির ওপর দিয়ে গেছে।

শাড়িটা কোনোমতে জড়িয়ে সে একহাত ওর পিঠের এবং অন্যহাত ঊরুর তলায় রেখে বয়ে নিয়ে চলে মুসহরবস্তির দিকে।

ঘোড়া নিমের গাছটার তলায় আসতেই ওৎপেতে থাকা কুকুরগুলো আবার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। মুসহরদের কয়েকটা লোককে হেমাঙ্গ চেনে। সে ডাকতে থাকে, লালু! লালু!

তার ডাকাডাকিতে একজন দুজন করে বেরিয়ে আসে। ভিড় জমে যায় দেখতে—দেখতে। হেমাঙ্গ বলে, তোমরা কেউ শিগগির বোসবাড়িতে খবর দিয়ে এসো।

সকালে হেমাঙ্গ সিগন্যাল পোস্টের ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার গোয়েন্দার মতো খুঁজতে গেছে, কেন অমি ওখানে আসে। কেনই বা অমন করে দাঁড়িয়ে থাকে? এই একবার নয় এবং অসচেতন কোনো নেশার ঘোরে নয়, সজ্ঞানেই সে এসেছে কতবার। বুধনী বহরী বলেছিল। ডন বলেছিল। সেই প্রথম ভূতে পাওয়ার দিনও সন্ধ্যায় এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল অমি।

বুধনী বহরীর বৃত্তান্তে এবং শংকরার সত্য মিথ্যায় মেশানো গল্পে সে একটা অস্পষ্ট সূত্র আঁচ করেছিল। অমির সঙ্গে জগদীশের গোপন সম্পর্ক আর ডনের হাতে জগদীশ খুন হওয়ার মধ্যে সেই সূত্রটা রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল হেমাঙ্গের। অমি কি নিজের চোখে জগদীশকে খুন হতে দেখেছিল? মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল সম্ভবত।

কিন্তু হেমাঙ্গ জানে বা সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে, অমির মনটা খুব শক্ত। ছেলেবেলায় বাবা—মা মারা গেলে এবং অন্যের দয়ায় মানুষ হলে মানুষের জীবনে এক ধরনের সাহস আর শক্তি জেগে ওঠা হয়তো সম্ভব। অবশ্য হেমাঙ্গের বেলায় তো তেমন কিছু ঘটেনি।

তার ঘটেনি, এজন্যে মুনাপিসি বা মোক্তার—পিসের মতো মানুষ দায়ী। এই নিঃসন্তান দম্পতির কাছে হেমাঙ্গ ছিল আত্মজের প্রতীক। ডন ও অমির বেলায় উলটো ঘটেছিল। ডন বয়স পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে এবং অমির স্বাধীনতাবোধ অমিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। শুধু অবাক লাগে, ডনের মতো নীতিবাগীশ ছেলে দিদিকে সামলাতেই পারেনি।

নাকি সামলানোর চেষ্টাটা বাড়াবাড়ি রকমেরই হয়ে যায় জগদশীকে খুন করার ঘটনায়? জগদীশ তো একসময় ডনেরই গুরু ছিল। বস্তুত জগদীশই ডনকে নিষিদ্ধ সবরকম ব্যাপারে এবং আইন ভাঙতে শিখিয়েছিল। আইন—ভাঙার একটা সুখ আছে। রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধিতার আনন্দ মানুষের রক্তে থাকা স্বাভাবিক। কোথাও সেটা ব্যক্তিগত, কোথাও গোষ্ঠীগত। কেউ হয়ে ওঠে তথাকথিত অ্যান্টিসোস্যাল, কেউ হয় বিপ্লবী।

হেমাঙ্গ আনমনে রেলইয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাল সন্ধ্যার বৃষ্টিতে লাইনের ফাঁকে ঘাসগুলো রাতারাতি সবুজ হয়ে উঠেছে। কিছুটা দূরে সান্টিং করে বেড়াচ্ছে একটা ইঞ্জিন। লাইন ডিঙিয়ে মুসহরবস্তির কয়লাকুড়ুনিরা ছুটেছে ওপরের বিশাল ছাইগাদার দিকে। ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে একটা নেড়ি কুকুর। ঠ্যাং তুলে লাইনে পেচ্ছাপ করে কুকুরটা ধুকুর ধুকুর চলতে থাকে। এসব কুকুর নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে অন্য প্রাণীর থ্যাঁতলানো লাস তারিয়ে তারিয়ে খেতে জানে। হেমাঙ্গ উদ্বিগ্নভাবে লক্ষ্য করে একটা ছাগল আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। লাইনের ওপর পেট রেখে দুপা সামনে ঝুলিয়ে কুটকুট করে চিবুচ্ছে। গাড়ি এলে পিঠের ওপর দিয়ে চাকা চলে যাবে। সৈকা তার ছাগলকে বাঁচাতে গিয়েই নাকি মারা পড়েছিল।

সৈকার কথায় সৈকার ভূতের কথা এসে যায়। হেমাঙ্গ টের পায় অমির সব রহস্যের সূত্র যেন এখানেই লুকোনো আছে। অমির অবচেতনায় সৈকা ঢুকে পড়েছে। কেন? কাল রাতে যখন ওকে পল্টে আর হেমাঙ্গ ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে কাঠের সাঁকো পার করে রিকশোয় তুলল, অমি ক্ষীণ স্বরে মুসহর বুলিতে গুনগুন সুরে কী বলছিল বা গাইছিল। মুসহররা হতবাক হয়ে শুনেছে। ওদের মুখে—চোখে আতঙ্ক ঠিকরে পড়ছিল। অনেকটা রাত অব্দি বুধনী বহরীর চেরা গলায় কান্না শোনা গেছে।

লালুর মেয়ে মালতী তো অমির মুখের ওপর ঝুঁকে নিজেদের বুলিতে সৈকার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিল। মরদেরা ওকে ধমক না দিলে রিকশোর পেছন পেছন বোসবাড়ি গিয়ে হাজির হত মালতী।

কালকের ঝড়ে মুসহরদের অনেক ঝোপড়ি ভেঙেচুরে গেছে। এখন সেগুলো মেরামত করছে ওরা। তারই মধ্যে ঢোলের শব্দ ভেসে আসছে। কয়লার পাঁজায় কে আগুন দিয়েছে। সকালের ঝকঝকে রোদে নীল ধোঁয়া সোজা হয়ে গেছে অলীক স্তম্ভের মতো। বাতাস বন্ধ এখন থেকেই। হয় তো আজ বিকেলেও কালবোশেখি আবার আসবে।

দাদাবাবু! ওঁগো দাদাবাবু!

হেমাঙ্গ ঘোরে। তার পিছনে খালের ওপারে দাঁড়িয়ে পাল্টে ডাকছে। হেমাঙ্গর বুক ধক করে ওঠে। অমির কিছু ঘটল না তো? সে সাড়া দিয়ে বলে, কী রে পল্টে?

আপনাকে গিন্নিমা ডেকেছে। একবার আসুন।

হেমাঙ্গ আড়ষ্ট বোধ করে। বোসবাড়ি যাওয়ার কথা ভাবলেই টলুকে সে সামনে দেখতে পায়। পুরুষালি গড়নের একটি মেয়ে—তার সারা শরীরে অতৃপ্ত কামনা নিয়ে বেঁচে আছে, এতদিন এতটুকু আঁচ করতে পারেনি। এত বেশি আলোয় তার মুখোমুখি হতে কেমন বিশ্রী লাগবে। ওর কথা ভাবতেই তার গা ঘিনঘিন করছে।

হেমাঙ্গ বলে, অমি কেমন আছে রে?

ভালো। রাতেই জ্ঞান ফিরেছিল। এখন শুয়ে আছে। আপনি আসুন দাদাবাবু।

কেন ডেকেছেন জেঠিমা, জানিস?

পল্টে মাথা নাড়ে।

যাচ্ছি বলে হেমাঙ্গ মুসহরবস্তি ঘুরে গিয়ে কাঠের সাঁকো পার হয়। মিনির মা আর বাবা বাড়ির গেটে ঝড়ে বিধ্বস্ত বুগানভিলিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত। মিনির বাবা তপনবাবুর স্টেশনারি দোকান আছে বাজারে। খুব শৌখিন লোক। এভাবে তাঁকে কাদা আর জঞ্জাল মেখে বুগানভিলিয়া নিয়ে ব্যস্ত দেখে অবাক লাগে। সৌন্দর্যের খাতিরেই তো এই খাটুনি আর নোংরাঘাঁটা।

দোকানে যাননি তপনদা?

এক্ষুনি যাব। দেখ না, ঝড়ে কী লণ্ডভণ্ড করেছে সব।

মিনির মা ঝাড়ের একটা দিক ধরে আছে। গলা চেপে বলে, হেমাং, কাল রাতে অমির কী হয়েছিল?

তপনবাবু বলেন, হবে আবার কী! অবসেসনের অসুখ। ঘুমের ঘোরে বেরিয়ে যায় না অনেকে? আমাদের ভোলাকে তুমি দেখনি! কাটোয়ার বাড়িতে থাকত। প্রতি রাতে ও বিছানা থেকে উঠে গিয়ে যেখানে সেখানে ঘুমোত। কখনও কারুর বারান্দায়, কখনও ড্রেনের ধারেই। সাইকলজিকাল ব্যাপার!

মিনি বুঝি পড়তে বসেছে?

মিনির মা বলে, তোমার ওপর খুব চটেছে হেমাং। বলে, কাকু আর আসে না। মুনা বুড়ি আর নিয়ে যায় না। ওদের সঙ্গে আড়ি।

হেমাঙ্গ হাসে। তাই বুঝি? যা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি। ওকে বলবেন, শিগগির আসব।

হেমাঙ্গ পা বাড়ালে তপনবাবু বলেন, কীসের এত ছুটোছুটি হে?

শোনেননি? ডাবুর সঙ্গে কন্ট্রাক্টরি করার তালে আছি। জামসেদপুরের ডাবু—ওই যে বোসবাড়ির!

বলেই হেমাঙ্গ চলে যায়। পল্টে দাঁড়িয়ে আছে।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। পল্টে বলে, কাল সেই বিকেলে বেরিয়েছিলুম গিন্নিমার সঙ্গে, এখন প্রায় আটটা বাজে—ছুটি পাইনি। ঘুমোতে পাইনি। আমার যা অবস্থা!

কাল কীভাবে অমি পালিয়ে এল রে? ডিটেলস বল তো। রাতে ভালো করে শোনা হয়নি।

পল্টে জড়িয়ে—মড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যা শোনাল তা ভারী অদ্ভুত। পীরের থানে কাসেম ফকিরের ঘরে ওরা বসে আছে। ফকির চামরটা অমির গায়ে বুলোচ্ছে আর বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। অমিকে পেছন থেকে ধরে থাকতে বলেছিল ফকির। সুলোচনা তাই ধরে আছেন। অমি বিরক্ত, তা বুঝতে পারছিল পল্টে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল। যত ঝড়, তত শিলাবৃষ্টি। চিক্কুর মেরে বাজ পড়ছে আর মেঘ ডাকছে মুহুর্মুহু! কাসেম ফকির চোখ খুলে বলল, বুঝতে পারছেন মা? গতিক ভালো না। এ বেটি কালা দেওয়ের (কালো দৈত্য) পাল্লায় পড়েছে। লড়ে তো যাই। একখানা শাল বখশিস দেবেন, শীতের সময় কষ্টে থাকি। ব্যস, আর কিচ্ছু চাইনে।

সুলোচনা বললেন, কেন দেব না? তুমি আমার মেয়েকে সারিয়ে দাও বাবা।

ফকির বলল, একদিনে হবে না মা। সাত দিন আনতে হবে।

তাই আনব।

ফকির চোখ বুজে আবার চামর এদিক—ওদিক দোলায় আর অমির গায়ে বোলায়। অমি চুপচাপ।

তারপর যেই না কাছাকাছি প্রচণ্ড আওয়াজে বাজ পড়েছে, চোখ জলসে গেছে সবার, অমনি আচমকা অমি একধাক্কায় সুলোচনাকে সরিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে। ফকির চেঁচাচ্ছিল, ধরো! ওকে ধরো!

পল্টে ছিল দোরগোড়ায়। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাকে লাথি মেরে অমি নীচে গিয়ে পড়ে। তারপর দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঝোপজঙ্গলে ভরা জায়গায়। ততক্ষণে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। শিলা পড়া বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ঝড় আর বৃষ্টি তুমুল চলছে। বাজ পড়ছে বারবার।

সুলোচনা হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। পল্টেকে বলেন, ধর, ধরে আন ওকে।

পল্টের প্রাণের ভয় আছে। কিন্তু সে প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে ঝড়জলের মধ্যে নামে। খুব চেঁচামেচি করে ডাকতে থাকে। থানের জায়গাটা পুকুরের পাড়ে অনেক উঁচুতে। অজস্র মাদারগাছ আর মস্তো কাঠমল্লিকা আছে। এখন তাদের ফুলের সময়। মউ—মউ করে গন্ধে। কিন্তু তখন তো প্রলয় চলেছে। মড়মড় করে ডাল ভেঙে পড়ছে। একবার যেন দূরে নীচের দিকে রাস্তার একঝলক বিদ্যুতের ছটায় অমিকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু নেমে গিয়ে সেখানে তার পাত্তা পেল না পল্টে। তখন ফিরে আসছে, দেখে সুলোচনা টলতে টলতে থান থেকে নেমে আসছেন। আছাড় খেয়ে গড়িয়েও পড়লেন একবার। কাপড় কাদায় মাখামাখি। কোমরে লেগেছে সুলোচনার।

সবচেয়ে বিপদ হল, রিকশোটা নীচের রাস্তায় অপেক্ষা করার কথা—সেটা নেই। ওখানে থাকা তখন সম্ভবও নয়। লোকোশেডের ওখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে পল্টে আর সুলোচনা রিকশোওলাকে পেলেন, তাই বাঁচোয়া। ওখানে কয়েকটা দোকান আছে। ছোট্ট দোকান সব। পান—সিগারেট চা এবং সন্দেশের দোকান। একটা দোকানে কোনোরকমে মাথা বাঁচাবার জায়গা জুটল। তখন রিকশো নিয়ে বেরুনো অসম্ভব।

ঝড়বৃষ্টি কমলে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল ওরা। তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। প্রমথবাবুরা তখনও ফেরেননি। ফিরতে পারেননি আসলে। টলু আর ঘণ্টার মা ছিল বাড়িতে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশেষ ভাব নেই বোসবাড়ির। পল্টে ছাতি আর টর্চ নিয়ে বেরুল। ডনের বন্ধুদের সাহায্য নিতেই।

কিন্তু এখন আর কে কার বন্ধু! পল্টে বলে, কারুর পাত্তা পেলুম না গো দাদাবাবু! সব ব্যাটা গাঢাকা দিয়েছে, নাকি ইচ্ছে করেই বেরুল না। বাড়ির লোকেরা বলল, নেই। তারপর তো ফিরে আসছি। বাড়ির সামনে এসে দেখি লালু মুসহররা হেরিকেন হাতে ব্যস্তভাবে ডাকাডাকি করছে।

হেমাঙ্গকে পেছনে ফেলে পল্টে দৌড়ে বাড়ি ঢোকে।

হেমাঙ্গ আড়ষ্টভাবে হাঁটে। রোয়াকের সামনে ইলু মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে। হেমাঙ্গ বলে, কী ইলু! কাল তোরা খুব নাকানিচোবানি খেয়েছিস শুনলুম!

ইলু গম্ভীর মুখে বলে, হেমাদা কাল রাতে এলে না যে?

আসিনি। হেমাঙ্গ বারান্দায় ওঠে। ফের বলে, তোর বাবা নেই?

বাবা এক্ষুনি বেরুল। বাজারে গেল।

হেমাঙ্গ বসার ঘরের ভিতর দিয়ে ঢোকে। ভেতরের বারান্দায় গিয়ে টলুর ঘরের দিকে তাকাতে পারে না। আবছা চোখের কোণা দিয়ে টলুকে আঁচ করে। যেন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

পল্টে বলে, আসুন দাদাবাবু! এ ঘরে।

বাঁদিকে কিচেনের পাশে ঘরে ঢুকে হেমাঙ্গ দেখে, সুলোচনা একগাদা বালিশ হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। ইশারায় তাকে পাশেই বসতে বলেন। হেমাঙ্গ বসে। সুলোচনার কোমরের কাপড় ঢিলে হয়ে আছে। সম্ভবত একটু আগে তেল মালিশ করা হয়েছে।

হেমাঙ্গ বলে, অমি কেমন আছে জেঠিমা?

সুলোচনা বলে, ভালো। জটাবাবার থানে গিয়ে মনে হচ্ছে কাজ হয়েছে। প্রথমে অতটা বুঝতে পারিনি, পরে সব বুঝলুম। কাল ঝড়জলের মধ্যে অমি যে দৌড়ে পালাল, ওটা কী জানো? ওটাই দস্তুর।

কীসের?

অশরীরী আত্মা যখন রোগীকে ছেড়ে দিতে চায়, তখন ঠিক যেখানটিতে প্রথমে তাকে ধরেছিল, সেখানটিতে নিয়ে যায়। এমন ঘটলেই বুঝতে হবে, ছেড়ে গেল। সুলোচনা চাপা উত্তেজনায় বলেন আবার এ তো অল্পের মধ্যে গেল। রুগিকে তখন দাঁতে জলভরা কলসি কামড়ে নিয়ে যেতে বললে তাও যায়। আমি স্বচক্ষে দেখেছি। মোহনপুর দেখেছি, এমনকি একটা মেয়ে কুয়ো ডিঙিয়ে গিয়েছিল ভাবতে পারো? স্বাভাবিক অবস্থায় সে একহাত লাফাতে পারে না। আমার ধারণা, অমি সেরে গেছে।

হেমাঙ্গ বলে, আপনি কাল পড়ে গেছেন শুনলুম।

হ্যাঁ বাবা। একে তো কোমরে বরাবর বাতের ব্যথা। জোর আছাড় খেয়েছি। রাতে অবিনাশ এসে ট্যাবলেট দিয়ে গেল। তাই বাঁচোয়া! একটু পরে হসপিটালে যেতে হবে। এক্সরে করাতে বলল। বলে সুলোচনা একটু ঝুঁকে এলেন তার দিকে।

তারপর দরজায় পল্টেকে দেখে বলেন, তুই হাঁ করে কী শুনছিস? হেমার জন্যে চা—টা করতে বলগে টলুকে। পল্টে অমনি সরে গেল।

সুলোচনা ফিসফিস করে বলেন, ডনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল।

হেমাঙ্গ চমকে ওঠে। তাহলে টলু সব বলেছে। কতটুকু বলেছে? সে মাথা দোলায়।

কোথায় দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে?

আমাদের বাড়িতে। রাতে এসেছিল চুপি—চুপি। হেমাঙ্গ সহজেই মিথ্যা কথা বলে।

কেমন আছে? হাঁটাচলা করতে পারছে? ঘা সেরে গেছে?

হ্যাঁ।

তুমি বললে না বাড়ি যাও, তোমার জ্যাঠা—জেঠি কেঁদেকেটে সারা হচ্ছেন?

বললুম। ডন বলল, সুযোগ পেলে যাব’খন। হেমাঙ্গ ঠান্ডা স্বরে বলে যায়।

তোমাকে পিস্তল রাখতে দিল?

হ্যাঁ।

সুলোচনা একটু চুপ করে থেকে বলেন, কাল ওই বিপদ। তারপর অনেক রাতে শুয়েছি, টলু আমাকে বলল, হেমা এসেছিল। ডন তাকে একটা পিস্তল রাখতে দিয়ে গেছে। হেমা সাহস পাচ্ছে না। তাই অমিকে দিতে এসেছিল। শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলুম। তোমার জ্যাঠামশাইকে ডেকে সব বললুম। উনি পিস্তলটা টলুর কাছ থেকে নিয়ে তক্ষুনি পুকুরে না কোথায় ফেলে দিয়ে এলেন।

হেমাঙ্গ তাকাল। কিন্তু কথা বলল না।

সুলোচনা বলেন, অমিকে বলেছিলে এ ব্যাপারটা?

হেমাঙ্গ মুখ নীচু করে জবাব দেয়, অমি জানে।

দেখছ হতচ্ছাড়ী মেয়ের কাণ্ড? একটুও বলেনি!… সুলোচনা একটু সরে ভঙ্গি বদলে বসেন। ফের বলেন, টলুর একশোটা কথার নিরানব্বুইটা আমি বাদ দিয়ে শুনি তাই তোমাকে ডেকেছিলুম হেমা।

হেমাঙ্গ বলে, বুঝতে পেরেছি।

সুলোচনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, যাও না! অমিকে দেখে এসো। ওপরে ডনের ঘরে আছে। ওর মনটা ভালো হবে। কালকের কথা তুলো—টুলো না যেন। যাও দেখে এসো।

হেমাঙ্গ অগত্যা বেরিয়ে যায়। সুলোচনা টলুকে ডাকছেন। সিঁড়ির মুখে হেমাঙ্গ, তখন টলু আসছে। চোখে চোখ পড়লে টলু হাসে। চোখে ঝিলিক। হেমাঙ্গ তিনটে ধাপ উঠেছে, টলু ডাকে—এই হেমা!

হেমাঙ্গ ঘুরলে সে ইশারায় ওপর ঘর দেখিয়ে হাত মুঠো করে কিল দেখায়। তারপর হাসতে হাসতে চলে যায়। তার মানে অমির সঙ্গে প্রেম করলে টলু তাকে পিটুনি দেবে। হেমাঙ্গের হাসি পায় এতক্ষণে।

ডনের ঘরটা খুব সাজানো। খাটো ফোমের গদি আছে। সুন্দর হালকা একেলে ধাঁচের নানান আসবাব আর কুটিরশিল্প। ওর রুচির প্রশংসা করতে হয়। এই ঘরে ঢুকলে ডনকে দুর্বোধ্য লাগে। দেয়ালে একটা মোটে ক্যালেন্ডার। ফুলের ছবি। ডন হাতের রক্ত ধুয়ে এঘরে ঢুকে ঘুমোত। মাথার কাছে মোকালির বাঁধানো ছবি। এ কি নেহাত অভ্যাস, না তার ভক্তিভাবের প্রতীক? অমি দক্ষিণের জানলার কাছে খাটের মাথায় পা ঝুলিয়ে বসে একটা পত্রিকা পড়ছিল। ঘুরে হেমাঙ্গকে দেখে স্থির চোখে তাকায়। হেমাঙ্গ বলে, কেমন আছো?

অমির গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। চোখের তলায় অনেকটা জায়গায় কালো ছোপ পড়েছে। কোটরগত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। নাসারন্ধ্র স্ফীত। সে হিসহিস করে ওঠে, ন্যাকামি করতে এসেছ কেন?

হেমাঙ্গ ভড়কে যায়। হাসবার চেষ্টা করে বলে, কাল রাতের এই বখশিস দিচ্ছ বুঝি?

তুমি বড়দিকে রিভলবার দিলে কেন? অমি ঘুরে বসে। ফের চার্জ করে, কেন দিলে ওকে?

হেমাঙ্গ চটে যায়। তোমাকেই ফেরত দিতে এসেছিলুম। পাইনি বলে ওকে দিয়ে গেছি।

ওসব বুঝিনে। আমার জিনিস আমি ফেরত চাই।

তোমার জ্যাঠামশাই নাকি কোন পুকুরে ফেলে দিয়ে এসেছেন কাল রাতে।

কী? বলেই অমি পত্রিকাটা ছুড়ে মারে ওর দিকে। হেমাঙ্গের বুকে এসে লাগে।

হেমাঙ্গ ওকে বোঝাবার চেষ্টায় এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। বলে ব্যাপারটা আমাকে এক্সপ্লেন করতে দাও। খামোকা এক্সাইটেড হচ্ছ কেন? তোমার শরীরের এই অবস্থা!

অমি মুখ নীচু করে জোরে মাথা দুলিয়ে বলে, নো এক্সপ্লেনেশান! আমার জিনিস আমাকে ফেরত দাও। সোজা কথা। যেভাবে পারো, এনে দাও!

আহা, শোনো ব্যাপারটা।

না, না। আমি শুনব না। তুমি আমার জিনিস আমাকে এনে দাও! ব্যাস!

তুমি ইনসিস্ট করলে চেষ্টা করব। কিন্তু…

কিন্তু—টিন্তু আমি বুঝিনে। তুমি রাখতে না পারলে আমার জিনিস আমাকে দিতে পারতে!

তুমি তো ছিলে না!

ছিলুম না বলে তুমি যাকে—তাকে দেবে?

যাকে—তাকে তো দিইনি। টলুদিকে দিয়ে গেছি।

কোনো কথা শুনব না। আমি ওটা ফেরত চাই।

ঠিক আছে। চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমার সঙ্গে আর আমার সম্পর্ক থাকবে না অমি!

ওসব বুঝিনে। তুমি আমার জিনিস আমাকে ফেরত দাও। নইলে…

হেমাঙ্গ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, নইলে কী করবে?

অমি আর কোনো কথা বলে না। জানলার দিকে মুখ ঘোরায়!

নইলে জগার অবস্থা করাবে ভাইকে দিয়ে—এই তো? ঠিক আছে। তাহলে আর ওটা খুঁজে বের করার চেষ্টা আমি করছি না জেনে রাখো। যা খুশি করতে পারো তুমি।… বলে হেমাঙ্গ বেরিয়ে যায়।

নীচে গিয়ে ইচ্ছে হল, টলুকে চার্জ করে—কেন সে অমিকে রিভলবারের কথা বলেছে। কিন্তু সুযোগ পেল না। টলু মায়ের ঘরে।…