অশরীরী ঝড় – ১

এক

ডনের দিদি অমিকে ভূতে পেয়েছে শুনে হেমাঙ্গ হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। একটু গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করে, করছে কী ও?

হুলো অবশ্য হাসছিল। বলে, করছে কী মানে? সারারাত বাড়িসুদ্ধ জাগিয়ে রেখেছে। বারান্দা থেকে উঠোন জলে কাদা। দেখে এসো না হেমাদা।

হেমাঙ্গ বিরক্ত হয়।—জলে কাদা মানে?

নিজের মাথা দেখিয়ে হুলো বলে, ঘিলুর মধ্যে যে ভূতটা ঢুকেছে, তাকে বের করে দেবার জন্যে এক ইঁদারা জল খরচ হয়ে গেল।

মাথায় জল ঢেলেছে?

আবার কী করবে? ডনের জেঠিমা বলছিল নাকে লংকা পুড়িয়ে ধুঁয়ো দিতে। ডনের জ্যাঠা বাধা না দিলে তাই করত।

হুলোর সিগরেটটা নিভে গেছে। সেটার ছাই হাতের উল্টোপিঠে ঘষে পকেটে রেখে দেয়। হেমাঙ্গ খালের জলে ভেরেণ্ডার দাঁতনকাঠিটা ফেলে দিয়ে বলে, এখন গিয়েছিলি নাকি ওদের বাড়ি?

হুলোর হঠাৎ কী মনে পড়ে তাড়া লেগেছে। যেতে যেতে বলে যায়, হুঁ। অমিদি এখন শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে মনে হল।

খালের জলটা পরিষ্কার। হেমাঙ্গ পোলের পাশে ঘাটের মতো জায়গায় নেমে গিয়ে মুখ ধোয়। ওপারে সমান্তরাল রেলইয়ার্ডে একটা ইঞ্জিন সান্টিং করে বেড়াচ্ছে। নির্জন নিঝুম ভোরবেলাটা মাঝে মাঝে তীব্র শিস দিয়ে চিরে ফেলছে। তার ও দিকে দিগন্ত অব্দি মাঠ। এখানে—ওখানে দাগড়া—দাগড়া সবুজ ঝোপ। ঘোলাটে আকাশ ফাটিয়ে সূর্য উঠছে সবে। ডানদিকে একটু দূরে খালের পাড়ে শ্মশান। বিশাল বটগাছের ডগায় এক ফালি নীল কাপড় দেখা যাচ্ছে। হেমাঙ্গর মনে হল, ওটা শঙ্কর খেপার কাজ। শঙ্কর আজকাল ওই শ্মশানেই নাকি থাকে। একটা ঝোপড়ি মতো বানিয়ে নিয়েছে। হেমাঙ্গর মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে মনে পড়ে যায়, শঙ্কর স্কুলে তার সহপাঠী ছিল। ভগবান দেবদেবতা সাধু সন্ন্যাসীতে যেমন তার ভক্তি ছিল, তেমনি ভূতেও। ক্লাসে নির্দ্বিধায় ভূতের সঙ্গে তার দেখা—সাক্ষাতের বর্ণনা দিত। সবাই হাসছে কিনা গ্রাহ্যও করত না। তখনও হেমাঙ্গর মনে হত, শঙ্কর ছিটগ্রস্ত এবং মিথ্যুক, এখনও মনে হয়, পাগল এবং ভণ্ড।

অবশ্য হেমাঙ্গর সেই ছেলেবেলায় মোহনপুরের প্রায় সব লোকই ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করত। নানারকম ভূতের কথা বলাবলি করত লোকেরা, কার কী অভ্যেস, কার কোনটা যাতায়াতের রাস্তা, কার কোথায় আস্তানা, এই সব আলোচনা বেশ গম্ভীর চালেই হত। আজকাল সে সব আর নেই। বেশিরভাগ লোকই ভূত বিশ্বাস করে না। তখনকার মতো ভূতেও আর ধরে না মানুষকে। আজকাল ভূত একেবারেই নেই।

যেমন নেই শেয়াল কিংবা বনবেড়াল। আর শুধু জন্তু কেন, ছেলেবেলায় দেখা পাখিগুলোও তো দেখতে পাওয়া যায় না। এই খালের এদিকটায় গাছপালা ঝোপ জঙ্গলে বা আশেপাশে পোড়ো জমিতে ঘাসের ওপর কত রঙবেরঙের পাখি দেখতে পাওয়া যেত। খালের ওপারে রেলইয়ার্ড ঘেঁষে মুসহরদের বস্তিটা এখনও আছে। তারা জাতে ব্যাধ। পাখি ধরে পেটের ধান্দা মেটায়। আজকাল শুয়োর পোষে, কয়লা কুড়োয় এবং মেয়েরা যৌবনের কারবার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্টেশনের ওপাশে সেনা ব্যারাক হয়েছিল। সায়েব মিলিটারিরা মুসহর মেয়েদের বংশানুক্রমে বেশ্যা করে দিয়ে গেছে।

আর বাজারের বর্তমান জমজমাট অবস্থার পিছনে যে ভিন্ন প্রদেশের ব্যবসায়ীদের অবদান, একই সময়ে তারা মুসহর পুরুষদের চৌর্য—বৃত্তিতে দীক্ষা দিয়েছিল। রেলইয়ার্ডের ধারে বাস। কয়লা, লোহা এবং মালগাড়ির নানা মাল হাতাতে হাতাতে পাকা চোর হয়ে যায় ওরা। স্বাধীনতার যুগে অনেক জুলুম স্বভাবত হয়েছে। কিন্তু ততদিনের মুসহরদের দলে যোগ দিয়েছে বাবু ভদ্রলোকের ছেলেপুলেরা। তাই রাজনীতির ঝান্ডা উড়িয়ে বস্তি উচ্ছেদ রোখা হয়েছিল।

কিন্তু মুসহর বস্তির উন্নতি হল কই? সেই নীচু ঘর, তালপাতার ছাউনি, হাড় বের হওয়া দারিদ্র্য, কয়েকটা ট্রানজিস্টারের মুহুর্মুহু চিৎকারেও ঢাকা পড়ে না। কয়লাকুড়ানি বুড়ি বুধনী বহরী যৌবনে সাতকাণ্ড করেও এখন মাঝে মাঝে ভিক্ষেয় বেরোয়। তার মেয়ের নাম ছিল সৈকা। বুধনী কানে কালা। তাই বহরী নামে পরিচিত। মেয়েটা তার ডাকে সাড়া দিতে মুখে রক্ত তুললেও সে সমানে ডেকে যেত, হেই গে সৈকিয়া—আ—আ! সৈকিয়া গে—এ—এ—এ!

সৈকার বয়স হয়েছিল চৌদ্দ—পনেরো বছর। হালকা ছিপছিপে শরীর। মুখে আশ্চর্য একটা লাবণ্য ছিল বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতো। গত বছর সন্ধ্যায় সবে মস্ত চাঁদ উঠেছে, সে তার আদরের ছাগল খুঁজে আনমনা আসতে আসতে ট্রেনের চাকায় পিষে মরেছিল।

সে ঘটনা ডিস্ট্যান্ট সিগনালের কাছে। ওই শ্মশানবটের সামনা—সামনি।

কিন্তু অপমৃত্যুর পরিণামে সৈকা যে ভূত হয়েছে, আজকাল কারুর বিশ্বাস করার কথা ছিল না। অথচ হুলো বলে গেল, অমিকে সৈকা ধরেছে। কারণ, সারারাত নাকি অমি মুসহরদের বুলিতে কথা বলেছে। এমনকি সৈকার আদরের ছাগলটার নাম ধরে কেঁদেছে ও।

হুলোর বলায় নিশ্চয় বাড়াবাড়ি আছে। হুলোকে দেখতে যেমন গবেট এবং কতকটা জড়ভরত গোছের হাবাগোবা ছেলে, বস্তুত সে তা নয়। ভেতরে ভেতরে নাকি ভীষণ ধূর্ত। মোহনপুরে সবাই জানে, হুলো ডনের গ্যাং—এর মারাত্মক চর। তার আপাতনিরীহ ড্যাবডেবে গোলাকার চোখের কোণায় চোরা একটা দৃষ্টি আছে, যা গোয়েন্দার।

হেমাঙ্গ মুখ ধুয়ে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে। তারপর খালের এপারে বাঁধ বরাবর হাঁটতে থাকে। গত রাতে কলকাতা থেকে ফিরে ঘুমটা ভারী গভীর হয়েছিল বলেই এত সকাল সকাল উঠতে পেরেছে। নয়তো অন্তত আটটা অব্দি শুয়ে থাকত। এবং ভালো ঘুমের দরুন অনেক দিন পরে তার মন মেজাজ ও শরীর বেশ হালকা ছিল। কিন্তু অমির ব্যাপারটা শুনে আনমনা ভাব তাকে পেয়ে বসেছে।

বড় পোলের কাছে গিয়ে সে বাঁদিকে বাড়ির রাস্তায় ঘোরে না। ডাইনে বড় পোল পেরিয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। মুনাপিসি চা করে নিয়ে বসে থাকবে। থাক। বাজারে গিয়েই চা খাবে সে। কেন কে জানে, অমির ব্যাপারটা তাকে ক্রমশ অস্বস্তিতে ভোগাতে শুরু করেছে। এড়িয়ে থাকার জন্যেই যেন এমন করে তফাতে সরে যাওয়া।

একপাশে রেলকলোনি, অন্য পাশে বাজার এলাকা। মাঝামাঝি জায়গায় চৌরাস্তা। মধ্যিখানে গোল ঘাসের পার্ক। তার কেন্দ্রে দেশনেতা নলিনাক্ষবাবুর আবক্ষ প্রতিমূর্তি আছে। ক’দিন আগে ওঁর জন্মদিন গেল। গলায় মালাটা শুকনো হয়ে ঝুলছে এখনও। থাম ঘেঁষে একটা পাগল বসে আছে হাত—পা ছড়িয়ে। ঘুমোবার ভান করছে। অন্যদিন হলে হেমাঙ্গ হয়তো একটু রসিকতা করত। আজ সোজা হরসুন্দরের চায়ের আখড়ায় ঢুকে পড়ে।

ঢুকেই একটু চমকে যায়। ডন কোণার দিকে বসে আছে।

ডন থাকলে তার ইয়াররাও থাকে। হেমাঙ্গ এক পলকে দেখে নেয় ইদ্রিস আর মুসহর বস্তির ঝেণ্টুও আছে। ঝেণ্টুর বাবা রেলে গ্যাংম্যানের চাকরি পেয়েছিল। কবে মরে হেজে গেছে। ঝেণ্টুয়াকে হাইস্কুলে কয়েক ক্লাস—তক পড়াতে পেরেছিল। সেই সুযোগে হেমাঙ্গর সহপাঠী হয়েছিল কিছুদিন। মুসহরের ছেলে বলে ক্লাসে অনেকে তাকে ছি—ঘেন্না করত। আর আজকাল? ঝেণ্টুই পালটা ছি—ঘেন্না করতে পারে। ডনের সঙ্গে জুটে মোহনপুরের এক মার্কামারা মস্তান হয়ে উঠেছে। চেহারা আর পোশাকে তাকে অবশ্য মুসহর বলে চেনাও যায় না। কথাবার্তাতেও না। বাঙালির মতো বাংলা বলে। কিন্তু থাকে সেই নীচু চাউনি দেওয়া খুপরি ঘরের কোণায়। হয়তো ভেতরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোও যায় না। কেন এখনও অমন ঘরে থাকে কে জানে!

আর ডন হেমাঙ্গর চেয়ে বছর তিনেকের ছোট তো বটেই। ডনের দাদা লালু ছিল সত্যিকার অর্থে হেমাঙ্গর বন্ধু। স্কুলে পড়ার সময় সে তার মামার কাছে জামসেদপুরে চলে গিয়েছিল। সে প্রায় একযুগ আগের কথা। সেখানে কারখানায় অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে ঢুকেছিল। উন্নতিও করেছিল নাকি। বছর তিনেক আগে কারখানায় কীভাবে ইলেকট্রিক শক খেয়ে মারা পড়েছে।

মোহনপুরে অমি আর ডন জ্যাঠার কাছে থেকে গেছে বরাবর। লালু মাসে মাসে টাকা পাঠাত। টাকা বন্ধ হবার অনেক আগে ডন লায়েক হয়ে উঠেছিল। দাদার টাকার পরোয়া করত না। জ্যাঠারও না। বরং জ্যাঠাই তাকে পরোয়া করে চলছিলেন। আর আজকাল তো ডনই ওঁর পরিবারের গার্জেন।

হেমাঙ্গদা যে! ইদ্রিস ডাকে, সেদিন কোথায় যেন যাচ্ছিলে গো?

হেমাঙ্গ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হরসুন্দরকে বলে, হরদা, চা দাও। তারপর ইদ্রিসের উদ্দেশে বলে, কলকাতা।

ঝেণ্টু আঙুলে রুমাল জড়িয়ে কিছু খেলছে। রুমালের কোণায় চাবির রিং। কীসের চাবি হেমাঙ্গ জানে না। ডন গম্ভীর মুখে সিগারেট টানছে। এক সময় হেমাঙ্গকে দেখলে সিগারেট লুকোত।

ইদ্রিস ডাকে, এসো হেমাঙ্গদা। ভেতরে এসো।

ডনের ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না বলেই হেমাঙ্গ যাবে না ভেতরে। সে মাথাটা একটু দুলিয়ে বলে, থাক।

স্টেশনবাজারে এত সকালে দোকানপাট বিশেষ খোলেনি। সন্দেশ আর চা—পান—সিগারেটের দোকান ছাড়া। তবে চৌরাস্তা বলেই রিকশো টেম্পো বাস আর ট্রেনযাত্রীদের মোটামুটি ভিড়টা আছে। উত্তরের যে রাস্তাটা মাঠের দিক থেকে এসেছে, সেটা হাইওয়ে। দূরের দিকে তাকালে তার দুধারে ঘন মেহগনি গাছের সার চোখে পড়ে। ওপাশে রেলের হাসপাতালের চত্বরে ঝাউ আর বিশাল আমগাছ, ফুলবাগিচা। ওখানে সঙ্কীর্ণ একটা রাস্তা মোহনপুর ঘুরে চলে গেছে লোকোশেডের দিকে। গত বছর ওই রাস্তায় ডন জখম হয়ে পড়েছিল। হেমাঙ্গ বিকেলে লোকোশেডে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। ড্রেনের ধারে দেয়ালে ভর করে আহত ডন ওঠার চেষ্টা করছে, একটু দূর থেকে নজরে পড়েছিল তার। কাছে আসতে আসতে ডন অজ্ঞান হয়ে যায়। হেমাঙ্গ রিকশো ডেকে তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।

পরে পুলিশের পাল্লায় পড়ে হেমাঙ্গ নাজেহাল হয়েছিল। ডনকে হাসপাতালেই গ্রেফতার করা হয়। ছাড়াও পেয়েছিল। জেল—টেল কিচ্ছু হয়নি।

ডনদের বাড়ি হেমাঙ্গর সেই থেকে ঘনিষ্ঠভাবে যাওয়া—আসা।

এবং অমির সঙ্গে ভাব। অর্থাৎ প্রেম।

হরসুন্দর চায়ের কাপ—প্লেট দিয়েছে খাতিরে। হেমাঙ্গকে অনেক ভালো ছেলে বলে খাতির করে। দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে আবার আনমনা হয়ে যায়। অমির কী হয়েছে? ভূতে পাওয়া ব্যাপারটাই বা কী? নাকি হুলো বেমক্কা রসিকতা করে গেল?

ডনের সঙ্গে কিছুদিন থেকে তার কথা বন্ধ। তার অবশ্য কথা বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু বয়সে ছোট এই ডন, সে আগে কথা না বললে হেমাঙ্গ আগ বাড়িয়ে কথা বলার পাত্র নয়। বয়সে সে ছোট এবং লালুর ভাই বলেই হেমাঙ্গর এই অভিমান। রাগ নয় ঠিক, অভিমানই।

স্টেশনের ওভারব্রিজে হেমাঙ্গ একদিন রাতে দাঁড়িয়ে আছে, ডন হঠাৎ কোত্থেকে এসে বলেছিল, আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট কথা আছে হেমাদা।

বল। মুখে নির্লিপ্ত এবং হাসির ভাবটা ফুটিয়ে তুললেও হেমাঙ্গর বুক কেঁপে উঠেছিল, তাতে কোনো ভুল নেই। ওভারব্রিজ তখন নির্জন। নীচের প্ল্যাটফর্মগুলোও প্রায় খাঁ খাঁ।

ডন বলেছিল, আপনি দিদিকে বিয়ে করছেন কবে?

হেমাঙ্গ চমকে উঠেছিল।—তার মানে?

মানে! এত সোজা কথার মানে জানেন না?

না।

ডন অশ্লীল ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, না? তাহলে ফোকটে ফুর্তি ওড়াবেন?

অন্য কেউ হলে হেমাঙ্গ চড় মারত। কিন্তু ডনের গায়ে হাত তোলার সাহস তার নেই। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ছিঃ ডন! তুমি এ কী বলছ!

লিমিট ছাড়িয়েছে বলেই বলছি। আমার সোজা কথা। হয় বিয়েটা শীগগিরি করে ফেলুন, নয়তো এখনই কাট আপ করে দিন। নইলে…

নইলে কী?

মোহনপুরে থাকা যাবে না। বলে ডন হনহন করে এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর সিঁড়ির মুখে হঠাৎ থেমে গলা চড়িয়ে বলেছিল, আমার দিদি বলেই কথাটা বললাম না। আর কোনো মেয়ে হলেও বলতাম।…

হেমাঙ্গ জানে, ডনের মতো বদমাসেরও কিছু ব্যাপারে যেন নীতিবোধ থাকে। মানুষের চরিত্রের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। অন্তত ডনের যতটা খবর সে রাখে, সব রকম বদমায়েশি এ বয়সেই সে করতে পারে, শুধু মেয়েছেলে বাদে। এই একটা ব্যাপারে ডনের কোনো বদনাম নেই। এক সময় যখন সে তত কিছু কুখ্যাতি কুড়োয়নি, তখন হেমাঙ্গ দেখেছে, অনেক বড় ঘরের মেয়েরা ডনকে প্রচণ্ড পাত্তা দেয়। দেশনেতা নলিনাক্ষবাবুর বাড়ির মেয়েদের ডনের সঙ্গে রেলকলোনির জব্বর ফাংশনে পাঠানো হত। কলকাতার নামী দামী আর্টিস্টদের নিয়ে ফাংশন শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। ডন মেয়েগুলোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। ঘরেও গতিবিধি অবাধ ছিল।

অবশ্য নলিনাক্ষর পরিবারে ডনের খাতিরের কারণ ছিল রাজনীতি। ডন ও তার সঙ্গীদের দরকার হত ওদের। একালের রাজনীতিতে মস্তান গুন্ডা চাই—ই। ওদিকে স্থানীয় প্রশাসন মুখে যতই শাসন—তর্জনের ভঙ্গি করুক, ডনকে তাদেরও দরকার হয় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্যে। কিছুদিন আগেই তো রেলইয়ার্ডে বাইরের ওয়াগান ব্রেকার গ্যাংটা ডনেরই সাহায্যে ধরা পড়ল। একালের সমাজে ডনের প্রয়োজন আছে বলেই ওর উদ্ভব ঘটেছে হেমাঙ্গের ধারণা।

তবে অনেক সময় হেমাঙ্গর মনে হয়েছে, কুৎসিত ব্যাপারকেও স্বীকার করে নেবার অসহায় অভ্যাস যেন মানুষের রক্তে আছে। একটা ব্যাখ্যা দাঁড় না করিয়ে পারে না মানুষ। এবং বিনা কারণে কিছু ঘটে না, এই নিয়তিবাদের খপ্পরে পড়েই সে যেন সান্ত্বনা চায়। কলেজে ইতিহাসের লেকচারার বিধুবাবু বলতেন, ওই যে হিটলারের আবির্ভাব ঘটেছিল, তারও প্রয়োজন ছিল। ইতিহাস বিশ্লেষণ কর, সব টের পেয়ে যাবে। সু—এ কু—এ ঘাত সংঘাত লেগে না থাকলে সমাজ এগোবে কেমন করে? রাবণ না থাকলে, রামের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায় না। ভগবানের বল, মহাকালের বল, এটাই লীলা। ঐতিহাসিক নিয়মও বলতে পারো, আমি আপত্তি করব না। …বলে জব্বর একটিপ নস্যি নিয়ে মুখটা শুয়োরের মতো আকাশে তুলতেন হাঁচির প্রত্যাশায়।

ঝেণ্টু বেরিয়ে এল।

হেমাঙ্গর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেন যেন হাসে সে। হেমাঙ্গ সাড়া দিয়ে ঘাড় নাড়ে। ঝেণ্টু কবে সাইকেল কিনেছে লক্ষ্য করেনি সে। ঝকমকে নতুন সাইকেলটা একপাশে দাঁড় করানো ছিল। সেটা টেনে দোকানের সামনে আনে সে। ডনকে বলে, চলি রে! তারপর সাইকেল চেপে বেরিয়ে যায়।

ডনের মুখ অন্যপাশে ফেরানো। এতক্ষণে ডাকে, হেমাদা, ভেতরে আসবেন না?

হেমাঙ্গর চা খাওয়া শেষ। কাপ—প্লেট নীচে রেখে ভেতরে ঢোকে। যেন কেউ তাকে টেনে ঢোকায়। হয়তো ডনের এই ক্ষমতা আছে। তাকে অস্বীকার করা যায় না। তাকে ঘৃণা করেও ঘৃণা দানা বাঁধে না মনে। হেমাঙ্গর মনে হয়, ডনকে আসলে সে বড্ড ভয় পায়। অথচ হাতাহাতি লড়লে ডন তাকে কাবু করতে পারবে না সম্ভবত। হেমাঙ্গ তার চেয়ে ঢ্যাঙা। শরীরের হাড় মোটা। ডন তো তুলনায় পাঁকাটি।

কিন্তু হেমাঙ্গর এ মুহূর্তে ভালো লেগেছে ডনের এই ডাক। তাছাড়া অমির সত্যি সত্যি কী হয়েছে, জানবার ইচ্ছেও প্রবল। সে ভেতরে ঢুকে আগে একটা সিগারেট ধরায় এবং ইদ্রিসকে বলে, নাও।

ইদ্রিস প্যাকেটটা নিয়ে ডনকে বলে, খা রে গুরু! হেমাদার মাল!

সে খিকখিক করে হাসে। ডন কিন্তু নিঃসঙ্কোচে সিগারেট বের করে নেয়। তারপর বলে, কলকাতা গিয়েছিলেন হেমাদা?

হ্যাঁ, রাতে ফিরেছি।

জামসেদপুর থেকে ডাবুদা এসেছে পরশু। আপনার কথা জিগ্যেস করছিল।

ডাবু! তাই বুঝি?

আপনাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিল। পিসিমা বলেনি?

কৈ, না তো!

ইদ্রিস বলে, পিসিমা মাইরি বুধনী বহরীর মতো…বলেই সে জিভ কাটে। হাসতে থাকে। ডন হাসে না। হেমাঙ্গ হাসে একটু।

ডন বলে, ডাবুদা থাকবে দিন কতক।

পাঠিয়ে দিয়ো। আমি আছি।…বলে হেমাঙ্গ ডনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দিদির ব্যাপারটা বলছে না কেন ডন? নাকি হুলোর নিছক রসিকতা? তবে হুলো তার সঙ্গে কোনোদিন রসিকতা করেনি। হঠাৎ কেন করতে যাবে? এই অজ্ঞাতকুলশীল পড়ে পাওয়া ছেলেটি যতই দাগী খচ্চর হোক, তাকে মোহনপুরের লোকেরা বরাবর স্নেহ করে। ষোলো—সতেরো বছর আগে বাস স্ট্যান্ডে দু—আড়াই বছরের একটা বাচ্চাকে ফেলে তার ভিখারিণী মা পালিয়ে গিয়েছিল। হুলোকে দয়া করে মানুষ করেছিলেন বাস—আপিসের রহমান সায়েব। রহমান সায়েব মারা গেলে আবার অনাথ হয়ে যায়। তখন স্টেশন বাজারের সবাই ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। তারপর দেখতে দেখতে ছেলেটা এত বড় হয়ে গেল। বাস—আপিসেই থাকত ড্রাইভারদের সঙ্গে। ইদানীং থাকে গুলাইয়ের হোটেলে। সত্যি বলতে কী, হুলোকে গুলাই থাকতে দিয়েছে সেও ডনের ভয়ে। হুলো কোনো কাজে আসে না। খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। সব সময় নানান ফন্দিফিকির তার মাথায়। হুলোকে ডনদের চর বলে জানে সবাই। তাই গায়ে হাত তোলার সাহস নেই কারও। তাছাড়া সেই পুরনো স্নেহের তাগিদ।

ডন হঠাৎ একটু হাসে।—ডাবুদাকে চিনতে পারবেন না। খুব মোটা হয়েছে।

এবার হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ইয়ে, হুলো বলল, অমির কি নাকি অসুখবিসুখ হয়েছে? বলেই সে অস্বস্তিতে পড়ে। ডন কীভাবে নেবে বলা যায় না। বড্ড খামখেয়ালি ছেলে সে। আর এখানে এত কাছে ইদ্রিস বসে আছে। হেমাঙ্গ সাহস পায় না ডনের দিকে তাকাতে। ইদ্রিসের দিকে তাকায়। ইদ্রিস কেন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে।

ডন একটু পরে আস্তে বলে, হুলো কী বলেছে আপনাকে?

হেমাঙ্গ মরিয়া। হাসে।—কীসব ভূত—টুত বলছিল।

ডন মাথা দোলায়। তারপর তেমনি আস্তে বলে, ভারী অদ্ভুত ব্যাপার হেমাদা। আমি তো একেবারে স্টান্ট। শালা, রাতে আর ঘুমই হল না!

কেন? কী ব্যাপার?

ঝেণ্টুদের ভাষায় কথা বলছে। হুবহু ওইরকম টাং! ডনের মধ্যে থেকে এখন সেই ছেলেবেলার সরল বালকের মূর্তিটি বেরিয়ে এসেছে। মুখে সেই বিস্ময়।

হেমাঙ্গ শুধু বলে, বলো কি! সত্যি!

আবার একটু চুপ করে থাকার পর ডন বলে, কাল সন্ধ্যায় নাকি ঝেণ্টুদের বস্তির কারা দেখেছে, সিগন্যালের ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল একা। এইমাত্র ঝেণ্টু বলে গেল। তা, কাল আমার শরীরটা ভালো ছিল না। শুয়ে পড়েছিলুম সকাল—সকাল। রাত এগারোটা নাগাদ জেঠিমা ওঠাল। দিদি নাকি ফিট হয়ে বারান্দায় পড়ে আছে।

নীচের, না ওপরের?

নীচের। ডন চাপা গলায় বলতে থাকে, জেঠিমারা নাক টিপে ধরে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। আমাকে ডেকেছে। ডাক্তার ডেকে আনলুম…

বাধা দিয়ে হেমাঙ্গ বলে, নীচে গিয়ে তুমি অমিকে কী অবস্থায় দেখলে?

ফিট হয়ে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে খিঁচুনির মতো হাত—পা ছুড়ছে। আমি ভাবলুম, যা শালা! মরেই যাবে তাহলে। যাই হোক, ডাক্তারকে ওঠালুম। নিয়ে এলুম। স্মেলিং সল্ট না কী শোঁকাল। জ্ঞান হল। কিন্তু ভুল বকতে শুরু করল ঝেণ্টুদের ভাষায়। ডাক্তার বলল, জল ঢালো আরও। কিস্যু হল না। বরং বেড়ে গেল। হাত—পা ছোড়াছুড়ি করছিল দেখে যেই ধরতে গেছি, এমন চড় মারল!…

ডন গালে হাত রাখে। হেমাঙ্গ বলে, তারপর?

ডাক্তার বলল, হিস্টিরিয়া। যত ব্যস্ততা দেখাবে, তত পেয়ে বসবে। ছেড়ে সরে যাও সবাই।

ওষুধ বা ইঞ্জেকশান দিল না?

হ্যাঁ। ব্রোমেড না কী বলল। ওষুধটা খেয়ে ঘুমোল, তখন রাত তিনটে প্রায়। হেমাঙ্গ একটা ভারী নিশ্বাস আস্তে আস্তে বের করে দেয়। তারপর বলে, এর আগে কখনও ফিট—টিট হত নাকি?

ডন মাথা নাড়ে এবং হেমাঙ্গর চোখে চোখ রেখে বলে, আমি আপনাকে জিগ্যেস করব ভাবছিলুম…

কী? হেমাঙ্গ নড়ে ওঠে।

ইদ্রিসের দিকে অপলক তাকিয়ে ডন সংযত হয়। আর ততক্ষণে হরসুন্দরের চা খেতে আরও খদ্দের এসে গেছে। ডন উঠে দাঁড়ায়।

ইদ্রিস বলে, উঠলি?

হ্যাঁ। তুই বাড়ি যাবি তো?

ইদ্রিস হাই তুলে আড়ামোড়া দিয়ে বলে, যাই। বাপটা আজ খচে হয়তো লাল হয়ে আছে। জবাই করবে। রাতভোর বেপাত্তা ছিলুম।

ওদের সঙ্গে হেমাঙ্গও বেরোয়। হরসুন্দরকে চায়ের দাম দিয়ে পা বাড়ায় ডনের পিছনে। ডনের মুখটা গম্ভীর। ইদ্রিস ফের হাসতে হাসতে বলে, আজ মাইরি গুলাইচাচার হোটেল ভরসা।

ডন কোনো কথা বলে না। পিছন থেকে হেমাঙ্গ বলে, ডন বাড়ি যাচ্ছ তো?

একটু পরে যাব। আপনি?

যাব। তুমি কোথায় যাচ্ছ?

ঠিক নেই। চলুন, আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাই।

ইদ্রিস চলে যায়। ডন ও হেমাঙ্গ খালপোলের কাছে এসে দাঁড়ায়। কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় আশেপাশের গাঁয়ের লোকেরা শাকসবজি বেচতে এনেছে। ভিড় আছে। হেমাঙ্গ একবার ভাবে, বাজারটা করে নিয়ে গেলে মুনাপিসি খুশি হত। অগত্যা কিছু টাটকা মাছও। রুমাল তো আছেই।

হঠাৎ হেমাঙ্গ লক্ষ্য করে ডন তার দিকে তাকিয়ে আছে। হেমাঙ্গ একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বলে, হ্যাঁ, তখন কী যেন জিজ্ঞেস করবে বলছিলে?

ইদানীং দিদির সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে নাকি?

না। বলে হেমাঙ্গ হাসবার চেষ্টা করে। এই ভিড়ের মধ্যে ডনের সঙ্গে অমির ব্যাপারে কথা বলা শুধু নয়, ডনের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লোকের এমন কিছু ধারণা হওয়াও হেমাঙ্গের কাছে সঙ্গত মনে হচ্ছে না। সে ফের বলে, এখানে দাঁড়ালে কেন? চলো, এগোই।

চলুন। বলে চিন্তিত ডন পা বাড়ায়।

খালপোল পেরিয়ে গিয়ে হেমাঙ্গ বলে, প্রথম কথা, ইদানীং আমি চাকরির ব্যাপারে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি। দ্বিতীয় কথা, তুমি অমন করে চার্জ করে বসলে গত মাসে। তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো ডন।

হাত তুলে ডন বলে, ও কথা থাক। আমার হঠাৎ রাগ হয়েছিল ওভারব্রিজে আপনাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। থাক সে কথা।

হেমাঙ্গ অন্তরঙ্গতার আশায় সাহস করে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে পা বাড়ায়। ডন আপত্তি করে না। হেমাঙ্গ হাঁটতে হাঁটতে বলে, তোমাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়েছি সেই কবে? মাস চারেক তো বটেই। তোমার জ্যাঠামশাই তো খুব ইনসালটিং টোনে কথা বলেছিলেন।

বাঁদিকে সরু একফালি রাস্তা। এবড়ো খেবড়ো। দু’ধারে রাঙচিতা বেড়া। ঘন গাছপালা, কলাবাগান, শাকসবজির খেতের মধ্যে ঘরবাড়ি। এটা উদ্বাস্তু এলাকা। ডন এই মোড়ে দাঁড়ায়। বলে, আমি কলোনিতে যাব।

হেমাঙ্গ বুঝতে পারছে না এখনও অমির ব্যাপারটা নিয়ে ডন এত মুষড়ে পড়েছে কেন। কেন যেন হেমাঙ্গকে জড়িয়ে ফেলেছে অমির ভূতে পাওয়ার সঙ্গে। ডনের খামখেয়ালি হাবভাব তার জানা। কিন্তু এটা রীতিমতো অস্বস্তিকর। ডন কি তার দিদির ভূতটার জন্যে হেমাঙ্গকেই দায়ী করতে চায়? হেমাঙ্গ বলে, ডাবুকে পাঠিয়ে দিচ্ছ কখন?

আপনি যান না! ডাবু এখনও ঘুমোচ্ছে। কাল রাতে দিদির জ্বালায় কারুর তো ঘুম হয়নি।

বলেই ডন হনহন করে চলতে থাকে কলোনির রাস্তায়। একটু পরে হেমাঙ্গর আবছা কানে আসে ডন শিস দিয়ে কী সুর ভাঁজতে ভাঁজতে যাচ্ছে। হেমাঙ্গ সোজা এগিয়ে গিয়ে পোড়ো আগাছা ঢাকা একটা জমির পাশ ঘুরে আবার খালের ধারে পৌঁছয়। শর্টকাট রাস্তায় বাড়ি ফেরে।

মুনাপিসি বাইরের চেয়ারে বসে কাঁসার গেলাসে চা খাচ্ছে। চিরদিনের অভ্যেস। নিকেল ফ্রেমের সেকেলে চশমা নাকের ডগায় নেমেছে। পাশের মিত্তিরবাড়ির ছোট বউমার সঙ্গে রসিকতা করছে। ভদ্রমহিলা মেয়েকে রেলকলোনির কিন্ডারগার্টেনে দিতে যাচ্ছেন। হেমাঙ্গকে দেখে একটু হেসে বলেন, মর্নিং ওয়াক হল ঠাকুরপোর?

হল। হেমাঙ্গ হাসে।—মিনি স্কুল যাচ্ছে বুঝি? হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন অদ্দূর?

রিকশোওলা এল না এখনও। তো কী করব? ওদের যা রোয়াব হয়েছে! অসুখবিসুখ হয়েছে হয়তো।…বলে হেমাঙ্গ বারান্দায় ওঠে।

মিত্তিরদের ছোট বউমা মেয়েকে নিয়ে চলে যান। মুনাপিসি বলে, বাজারে চা খেতে গিয়েছিলি তো? তা বেশ করেছিস। কিন্তু সেই সঙ্গে বাজারটাও করে আনলে কেমন হত।

হেমাঙ্গ বলে, তোমার কলোনির সেই বুড়ো তো আসবে। ভাবছ কেন?

মাছ ছাড়া যে তোর ভাত উঠবে না বাবা!

হেমাঙ্গ হাসে।—আজ নিরিমিষ হোক না বাবা!

মুনাপিসি হাসতে গিয়ে চা পড়ে যায় কাপড়ে। হেমাঙ্গ বাইরের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতে যাচ্ছে, মুনাপিসি সেই সময় চাপা গলায় বলে ওঠে, হ্যাঁ রে হেমা! বোসদার ভাইঝি, মানে অমির কি হয়েছে শুনেছিস? কেলেঙ্কারি নাকি?

শুনেছি। কিন্তু কেলেঙ্কারি কেন?

বুধনী বহরীর মেয়ে নাকি ওকে ধরেছে? মুনাপিসি হাসে না। গম্ভীর মুখেই বলতে থাকে। ও মাসে কায়েতপাড়ার সুবীর বউমাকেও নাকি ধরেছিল। কদমতলার থানে গিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিল। কাকেও জানতে দ্যায়নি।

সৈকা ধরেছিল বলছ?

না বাবা, না! লোকে বলছে।

পিসিমা, তুমি কখনও ভূত—টুত দেখেছ?

এবার হাসতে হাসতে মুনাপিসি উঠে আসে। দু’জনে ঘরে ঢোকে। হেমাঙ্গর শোয়ারও ঘর, আবার গেস্টরুমও বটে। সতীশ পিসেমশাইয়ের মোক্তারির টাকায় তৈরি। একতলা এই ছোট্ট বাড়িটার গায়ে সতীশ মোক্তারের স্নেহের ছাপ লেগে আছে।

মুনাপিসি কাঁসার গেলাসটা উঠোনের দিকের বারান্দায় রেখে এসে বলে, ভূত—প্রেতের কথা বললি তো? আমি বাবা কখনও ওনাদের দেখিনি। এ জন্মে যেন দেখতে টেখতে না হয়। তবে তোদের মোহনপুরে কিন্তু বরাবর ভূত—প্রেতের আখড়া। সেই কবে বউ হয়ে এখানে এলুম। কত দেখলুম, শুনলুম। এখানে তখন গলিতে ভূত, গাছে—গাছে ভূত। আর এ বেলা ও বেলা বউ—ঝিদের দুমদাম করে ভূতে ধরছে।

হেমাঙ্গ আগ্রহী হয়ে বলে, ভূতে ধরলে কী করে পিসিমা?

ফিট হয়। দাঁত কিড়মিড় করে। লাল চোখ পাকিয়ে তাকায়। হিহি করে হাসে। আর আবোল—তাবোল বকে।…কথা ভালোভাবে বলার জন্যে মুনাপিসি মেঝেয় বসে।—তোর পিসেমশাই এসব মানতেন না। বলতেন হিস্টিরিয়া। আমি বলতুম হিস্টিরিয়া কি মড়কের মতো। হল তো হল একেবারে দলে দলে? আর সব্বাই কম বয়সের মেয়ে?

কম বয়সের মানে, কত?

ওই অমির বয়সি, নয়তো মিনির মায়ের মতো। কারুর বিয়ে হয়েছে, কারুর হয়নি, এমন মেয়ে। আর জানিস হেমা? কে ধরেছে, তাও বলত।

তুমি বিশ্বাস কর না এসব?

কে জানে বাবা! আমি কিছু বুঝতে পারিনে। তবে একবার স্টেশনের ছোটবাবুর বউকে ধরেছিল। মেয়েটা ইংরেজি বলছিল। অথচ মেয়েটা ইংরেজি তেমন জানতই না। বাড়িতেই সামান্য লেখাপড়া।

হেমাঙ্গ গম্ভীর হয়ে থাকে। তারপর বলে, আমি আবার চা খাব পিসিমা।

খাবি! বেশ তো। কথাটা সস্নেহে বলে মুনাপিসি রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।