অর্জুন – ৭

সুভদ্রার পর অর্জুনকে আমরা আর কোনও রমণীর চিন্তায় মন দিতে দেখিনি। বস্তুত এই রাগ-অনুরাগ-অভিমান পর্বের পর অর্জুনের জীবনের কয়েকটি বড় ঘটনা আমাদের তীব্রবেগে উল্লেখ করতে হবে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সাময়িক জ্ঞাতিভেদ এড়ানোর জন্য যুধিষ্ঠিরকে যে জায়গাটা রাজ্য করার জন্য দিয়েছিলেন, সে জায়গাটা ছিল জঘন্য। চাষবাস হয় না, শষ্য মেলে না, শুষ্ক রুক্ষ মরুভূমির মতো সে দেশ। সদ্য বিবাহের পর অর্জুন বনবাসে গেলে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ঘরে বাইরে রাজ্য সামলে রাজধানী বা রাজপ্রাসাদের উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। অর্জুন ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাচক্রে অগ্নিদেবতার যে খাণ্ডব-বন পুড়িয়ে খেতে ইচ্ছে হল, সেটা আমাদের মতে নেহাতই সমানুপাতিক। যুধিষ্ঠিরের রাজ্য ছোট ছিল এবং বন কেটে বা পুড়িয়ে বসতি তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। দগ্ধ বনে অতঃপর শষ্যরোপণের ভাবনাটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাই হোক, অর্জুন বনবাস থেকে ফিরে আসার পর খাব-বন পোড়ানোটাই তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অবশ্য এই বন-দহনের সূত্র ধরেই অর্জুনের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কিছু শুভ লাভ হল। তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে অর্জুনের বড় পছন্দের ধনুক গাণ্ডীবের কথা। গণ্ডারের পিঠের চামড়া দিয়ে তৈরি এই ধনুক তাঁর কাছে এতই পছন্দ এবং শ্রদ্ধার ব্যাপার ছিল যে, দাদা যুধিষ্ঠিরও যদি কখনও এই ধনুকের সম্বন্ধে খারাপ কথা বলেন, তো তাঁকেও তিনি রেহাই দেননি। অর্জুনের কপিধ্বজ রথটিও এই খাণ্ডবদহনের প্রাপ্তি। এই দুটি জিনিসই অর্জুন পেয়েছেন খাণ্ডববন পোড়ানোর আগে স্বয়ং অগ্নিদেবের সহায়তায়। এই দুটি জিনিসের উল্লেখ না করে পারলাম না, কারণ গাণ্ডীব ধনুর সঙ্গে অর্জুন এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, গাণ্ডীব ছাড়া তাঁর অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। যদিও পূবোল্লিখিত চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে যদি তিনি ‘পাণ্ডব আমি অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা’ বলে নিজেকে ‘এলিভেট’ করে থাকেন, তবে যথার্থতার খাতিরে ওই মুহূর্তে সে-পরিচয় মিথ্যা হলেও, গাণ্ডীব ছাড়া যে অর্জুনকে কল্পনা করা যায় না—সেইটাই প্রতিষ্ঠিত হয়।

খাণ্ডবদহনের সূত্রে অর্জুনের পারিবারিক লাভ—ময়দানবের নির্মাণ—ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভা। এই সভার জন্য যুধিষ্ঠিরের ‘স্ট্যাটাস্‌ বেড়ে গেল, ফলে সম্রাট পদবী লাভের জন্য তাঁকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে হল। এই রাজসূয়ের আগে যদিও অর্জুনকে কৃষ্ণ এবং ভীমের সঙ্গে মগধরাজ জরাসন্ধের হত্যায় অংশ নিতে হয়েছিল, তবে সেখানে তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না। অবশ্য ভূমিকা না থাকলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, যুধিষ্ঠির দাদা হিসেবে ভীম এবং অর্জুন কাউকেই জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পাঠাতে চাননি। কারণ ভীম-অর্জুন—দুজনেই ছিলেন যুধিষ্ঠিরের নয়নের মণি—ভীমার্জুনাবুভৌ নেত্রে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই মানসিক অবস্থাতেও প্রধানত অর্জুনের উৎসাহেই জরাসন্ধ বধের পর্ব সূচিত হল। অর্জুনের কথায় তাঁর আপন সার্থকতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা—একই সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অর্জুন বলেছিলেন—ধনুঃশর, অস্ত্রশস্ত্র, শক্তি, বাসুদেব কৃষ্ণের মতো বন্ধুপক্ষ, থাকবার জায়গা এবং যশ সবই আমি পেয়ে গেছি। পাওয়া হয়নি শুধু—যা এখন চাইছি তাই। এই উৎসাহের পরে যুদ্ধযাত্রায় বিলম্ব হয়নি। রাজসূয় যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে অর্জুন যে ভারতবর্ষের উত্তর-দিকটা জয় করে বহু ধন-রত্ন ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে এলেন এই সব বীরোচিত ঘটনার উল্লেখ করে আমি সময় নষ্ট করব না। কারণ, অর্জুন যুদ্ধে যাচ্ছেন, যুদ্ধ জয় করেছেন, বীরত্ব প্রকাশ করেছেন—এইগুলি এতই জলভাতের মতো যে, অন্তত অর্জুনের চরিত্রে এগুলির কোনও নূতনত্ব নেই। আমাদের তাই অর্জুন চরিত্রের সেই দিকগুলির দিকে ফিরে তাকাতে হবে, যেখানে এই মহাবীর নিজেকে বীরোচিত মহিমায় সংযত রাখছেন, কারণ বীরত্ব থাকলে তার প্রকাশ যতখানি স্বাভাবিক, বীরত্ব সংযত রাখার ব্যাপারটা তার চেয়ে শতগুণ কঠিন এবং ঠিক সেখানেই অর্জুন—অর্জুন।

খাণ্ডবদাহের আগুন থেকে বেঁচে ময়দানব তাঁর কৃতজ্ঞতার শিল্পমাধুর্যে যুধিষ্ঠিরের রাজসভা তৈরি করে দিলেন, সেই রাজসভার ঐশ্বর্য দেখেই দুর্যোধনের ঈর্ষা এবং সেই ঈষা থেকেই শকুনির পাশা-খেলা, দ্রৌপদীর অপমান এবং পাণ্ডবদের বনবাস। ঠিক এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্জুনকে আমাদের এক ঝলক দেখে নিতে হবে। যুধিষ্ঠির মহারাজের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে উত্তর-ভারতের রাজ্যগুলি জয় করা ছাড়া অর্জুনের আর কোনও ভূমিকা নেই। এমনকী রাজসূয়ের শেষ পর্বে শিশুপাল বধ পর্যন্ত অর্জুনের কোন কার্যকরী ভূমিকা আমরা দেখিনি। তবে হ্যাঁ, যজ্ঞান্তে, সবাই চলে গেলে, দুর্যোধন যখন শকুনির সঙ্গে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় ঐশ্বর্য দেখতে গিয়ে স্ফটিক-জলে পড়ে গেলেন, তখন ভীম-নকুলদের সঙ্গে অর্জুনও হেসেছিলেন। কাজটা ঠিক অর্জুনোচিত না হলেও অন্যভাইদের উচ্ছ্বাসের মুহূর্তে এই হাসাহাসিটা অস্বাভাবিকও নয়। যাই হোক, যুধিষ্ঠিরের রাজসভার ঐশ্বর্য, সমস্ত রাজাদের যুধিষ্ঠিরের কাছে আত্মনিবেদন এবং সর্বোপরি দুর্যোধনের হাস্যাস্পদ হয়ে যাওয়া—এই সব কিছু মিলে শকুনির পাশা-খেলা ত্বরান্বিত করল। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে, পাশার দানে পাণ্ডবদের রাজ্য-ঐশ্বর্য জিতে নেওয়াটাই সময়োচিত এবং যুক্তিযুক্ত হবে।

লক্ষণীয় বিষয় হল—ধৃতরাষ্ট্র যখন যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলতে ডেকে পাঠালেন, তখন যুধিষ্ঠির কিন্তু অর্জুনের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একবারও আলোচনা করলেন না। পাশাখেলার অভিজ্ঞতা অল্প থাকা সত্ত্বেও নিজের নেশা এবং রাজোচিত মর্যাদায় তিনি হস্তিনাপুরে পাশা খেলতে এলেন। সঙ্গে রইলেন ভাইয়েরা এবং দ্ৰৌপদীর মতো স্ত্রী অর্জুনকে আমরা এই পরিসরে একটাও কথা বলতে দেখিনি। এমনকী সেই যে ভয়ঙ্কর পাশা-খেলা আরম্ভ হল, যুধিষ্ঠির একের পর এক ধনরত্ন, রাজ্য-সম্পত্তি হেরেই চলেছেন কিন্তু অর্জুনকে আমরা রা কাড়তে দেখছি না। খেলার পণ হিসেবে যখন স্বয়ং অর্জুনকেই বাজি রাখা হল, তখন তো নয়ই। অবশ্য একই সঙ্গে এটা বলতেই হবে—অর্জুন কেন, কোনও ভাই-ই যুধিষ্ঠিরের খেলা বা হারার সময় কোনও কথা বলেননি। কিন্তু যখন দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরে গেলেন যুধিষ্ঠির এবং যখন সেই একবস্ত্র রজস্বলা রাজবধূকে সকলের সামনে টেনে এনে বস্ত্রহরণের পালা আরম্ভ করলেন দুঃশাসন, তখন মধ্যম-পাণ্ডব ভীম কিন্তু আর চুপ করে থাকতে পারেননি। বিবাহিতা পত্নীর এই অপমানে তিনি দুঃশাসনের ওপর যতখানি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের প্রতি। কারণ পাশা-খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি না রাখলে অপমানের এই চূড়ান্ত হত না। রাগে, অপমানে ভীম সহদেবকে বললেন—নিয়ে এসো আগুন, এই যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়িয়ে দেব আমি।

এইবার অর্জুনকে আমরা কথা বলতে দেখছি, নিতান্ত আশ্চর্যজনকভাবে কথা বলতে দেখছি। আর এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে, আপাতত অর্জুনের এই ব্যবহার স্ত্রী-স্বাধীনতা-কামী রমণীকুলের যথেষ্ট ক্রোধ উদ্দীপন করবে। দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ থেকে আরম্ভ করে তাঁর উত্তমাঙ্গের বসন নমিত করা পর্যন্ত—তাঁকে যে চূড়ান্ত অপমান কৌরবসভায় সহ্য করতে হল, তার মধ্যে একটি কথাও বলেননি অর্জুন। অথচ এই এখনই ভীম যখন যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়িয়ে দিতে চাইছেন—তখন তিনি কথা বলছেন। এই ব্যবহার শুধু সতর্ক রমণীকুলেরই ক্রোধের কারণ নয়, নিরপেক্ষ পুরুষকেও তা বিচলিত করে। তবু আগে আমরা অর্জুনের বক্তব্যটা শুনে নিই। অর্জুন বললেন—আর্য ভীম! তুমি তো কই আগে কখনও শ্রদ্ধাস্পদ যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে এমন রূঢ় কথা বলেনি। শত্রুরা কি তোমার ধর্মগৌরবও নষ্ট করে দিল? একটা কথা পরিষ্কার বলি—তুমি শত্রুদের আশা পূরণ কোরো না—এই মুহূর্তে এই অপমানের মধ্যে তুমি ছোটভাই হয়ে দাদাকে অপমান করো—শত্রুরা এটাই চায়। তাতেই তাদের সুবিধা। কিন্তু আমি বলব—তুমি ধর্ম এবং ধর্মের বিধি-নিষেধ মেনে চলো। ধার্মিক ধর্মরাজ বড়দাদাকে কি কেউ অতিক্রম করে—ভ্রাতরং ধার্মিকং জ্যেষ্ঠং কো’তিবৰ্ত্তিতুমহতি? ভীম অর্জুনের ব্যক্তিত্ব অতিক্রম করতে পারলেন না। তিনি নিজেকে সংযত করতে বাধ্য হলেন।

যে কথাগুলি অর্জুন বলেছেন, তার পেছনে তাঁর নিজের যুক্তি হল—মহারাজ যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের নিয়ম মেনে কৌরবদের সভায় পাশা খেলতে এসেছিলেন, তাঁকে পাশা খেলতে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি ক্ষত্রিয়ের নিয়মেই পাশা খেলেছেন এবং সেটাই আমাদের পক্ষে কীৰ্তিজনক—দীব্যতে পরকামেণ তন্নঃ কীর্তিকরং মহৎ। প্রসঙ্গত জানাই—সেকালের দিনে এক ক্ষত্রিয়-রাজা অপর ক্ষত্রিয়-রাজাকে পাশা খেলতে আহ্বান জানালে অন্য ক্ষত্রিয়-রাজার পক্ষে ‘না’ বলাটা ছিল অসভ্যতা। যুধিষ্ঠিরের পক্ষেও তাই ‘না’ বলাটা সম্ভব হয়নি। এবং সম্ভবত সেই কারণে ভীম-অর্জুনেরাও তাতে বাধা দেননি। বিশেষত ধৃতরাষ্ট্র যখন যুধিষ্ঠিরকে বিদুরের মাধ্যমে পাশা খেলবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তখন তিনি জানিয়েছিলেন—খেলাটা হবে বন্ধু রাজার সঙ্গে বন্ধু-রাজার মতো—সুহৃদন্তং বর্তামত্ৰ চেতি। যুধিষ্ঠিরও সেই ভেবে এসেছিলেন। কিন্তু সভায় ঢুকে তিনি অন্যরকম বুঝেছেন। শকুনি-দুর্যোধনের ভাব দেখে তাঁর সন্দেহই হয়েছে। খেলাতে অন্যায়-কপটতা যে হতে পারে—সে আশঙ্কা যুধিষ্ঠির পরিষ্কার ব্যক্ত করেছেন। শকুনিরা বলেছেন—এত যদি ভয় তা হলে আর খেল না, তুমি চলে যাও। যুধিষ্ঠির নিরুপায় হয়ে বলেছেন—আমাকে যখন ডাকা হয়েছে খেলতে, তখন আমি ফিরব না, কারণ সেটাই ক্ষত্রিয়ের ব্রত। বিধি বলবান, অতএব নিজের ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় খেলা আরম্ভ করে খেলার পণে হারতে হারতে এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির গৃহবধূ দ্রৌপদীকেও হারিয়ে বসে আছেন। ভীম তাঁর পাশা-খেলা হাত দুটি পুড়িয়ে দিতে চাইছেন—অর্জুন তাঁকে বলছেন—বড়দাদাকে এভাবে অতিক্রম কোরো না।

ভারী আশ্চর্য ব্যাপার! যে ব্যক্তি বয়োজ্যেষ্ঠ দাদার মর্যাদা-লঙ্ঘনের চিন্তায় উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, তিনি আপন কুলবধূর লাঞ্ছনার বিষয়ে একটি কথাও বলছেন না—এই অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা আমাদের পীড়িত করে। কী অসীম, আশ্চর্য এক দার্শনিক নির্বিণ্ণতায় অর্জুন তার সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয়গুলিকে ন্যূতক্রীড়ার অপমান-পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন। একে ‘অ্যাসেটিক্‌ উইদ্‌ড্রয়াল’ নাই বলি, কিন্তু অর্জুনের ব্যবহারে গীতার সেই কচ্ছপের উদাহরণটা মনে আসেই। কচ্ছপ যেমন প্রয়োজনে নিজের সমস্ত অঙ্গগুলিকে কঠিন খোলসটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে, অর্জুনও তেমনি আপাতত সমস্ত ঘটনা পরম্পরা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অর্জুন ভবিষ্যতে বিরাট পুরুষের মুখে গীতার উপদেশ শুনবেন। শুনবেন—পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণীবর্গ ঈশ্বরী মায়ায় যারূঢ় পুত্তলিকার মতো ভ্রমণ করে। এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির, দুঃশাসন, দ্রৌপদী—সবাই যেন অর্জুনের কাছে যারূঢ় পুত্তলিকার মতো; তাঁর যেন কিচ্ছুটি করার নেই। ভাল-মন্দ কিছুই না। জাগতিক সম্বন্ধে যুধিষ্ঠির রাজা বলে এবং দাদা বলে প্রথম থেকেই অর্জুন তাঁকে কিছু বলেননি এবং এখনও বলছেন না। ভবিষ্যতেও কোনওদিন বলেননি। কি রাজনৈতিক কি সামাজিক কোনও ব্যাপারেই না। এবং তা শুধু রাজা এবং দাদা বলেই যে বলেননি, তাও সব সময় আমার মনে হয় না। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের প্রতিমূর্তি বলে মনে করেন। এই বিপন্ন মুহূর্তেও তিনি ভীমকে বলছেন—ধার্মিক এবং বড়দাদাকে কে অতিক্রম করে—ভ্রাতরং ধার্মিকং জ্যেষ্ঠং কো’তিবৰ্ত্তিতুমর্হতি?

অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যে এতক্ষণ পাশা খেলেছেন, বাজি ধরেছেন এবং হেরেছেন—এই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যেই অর্জুন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম দেখতে পেয়েছেন। কারণ, যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মেনেই পাশা খেলেছেন এবং এখন সে খেলায় হেরে গেলেও যুধিষ্ঠির ধর্ম থেকে দ্রুত নন, এমনকী সেটা অকীর্তিরও কিছু নয়, অন্তত অর্জুন তাই মনে করেন। আপাতত অর্জুনের এই ব্যবহার আমাদের খুশি করে না, বরঞ্চ দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা দেখে ভীমের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা আমাদের মতো মানুষের কাছে অনেক বেশি ইচ্ছাপূরক। কিন্তু এ বিষয়ে বিবেচনার বিষয় একটাই। মহাভারতের কবির মনোজগৎ থেকে তিন, সাড়ে তিন হাজার বছর এগিয়ে এসে আমাদের আধুনিক এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারায় যে বিশ্লেষণগুলি আমরা মনোমতো মনে করি, সেই বিশ্লেষণগুলি যদি মহাভারতের চরিত্রগুলির ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলি—যুধিষ্ঠির একটি উঁাড়স-মাকা লোক, আর অর্জুন লোকটা নারীর মর্যাদা জানে না—তা হলে আমি বলব ভুল করছেন, খুব ভুল করছেন। কারণ ব্যক্তিগত একটি চরিত্রকে সেই ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই বিচার করতে হবে। কিন্তু আমাদের পরিশীলিত সামাজিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তিন হাজার বছরের পূর্বতন চরিত্রের ওপর আরোপ করে আপনি ব্যক্তিচরিত্রের হনন করতে পারেন না। আজকাল রামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, অর্জুন—এই চরিত্রগুলির এইরকম বিশ্লেষণ হচ্ছে এবং তা করছেন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরাই। আমার তাতে সবিশেষ আপত্তি আছে এবং আমি সে-কথা সবিনয়ে বলতেও চাই।

প্রথমেই মনে রাখা দরকার—মহাভারতের মতো বিশাল মহাকাব্যে একটি ব্যক্তিজীবনের ঘটনা খামচা খামচা করে তুলে এনে একটি ব্যক্তি-নারীর মর্যাদা নির্ণয় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মহাভারতের কবি এক সার্বিক বিশালতায় তাঁর মহাকাব্য রচনা করেছেন। এখানে প্রত্যেকটি চরিত্র ব্যক্তিজীবনের কুটিল সংকীর্ণতার মধ্যে যতখানি আবদ্ধ, তার থেকে অনেক বেশি সামাজিক বিশালতার সঙ্গে সম্বদ্ধ। সে বিশালতাও আবার এমন যে, ব্যক্তি চরিত্রগুলি অনেক ক্ষেত্রেই সেই বিশালতার দ্বারাই নিজেকে চিহ্নিত করতে ভালবাসে। ধর্মের মতো বিশাল এক ধারণা, জাতির মতো বিরাট এক শক্তি অথবা যশ কিংবা কীর্তির মতো বিরাট এক লক্ষ্য—এইগুলির সঙ্গে মহাকাব্যিক চরিত্রগুলি এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, একটি ব্যক্তি-নারীর মর্যাদার জন্য কাউকে নিন্দাও করা যায় না, আবার কাউকে বহুমাননও করা যায় না। রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় এমনই এক সামগ্রিকতা আছে যে তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত। কাজেই এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় ভীমের যে প্রতিক্রিয়া হল—আধুনিক প্রগতিশীলতার নিরিখে তাঁর জন্য সাধুবাদ জমা থাকুক, কিন্তু মহাকাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই প্রতিক্রিয়ার বড় বেশি বিশেষত্ব নেই। বিশেষত্ব শুধু এইটুকু যে, ভীমের এই ব্যবহার তাঁর চরিত্রের একান্ত একটা দিক নির্দেশ করে। যে ঘটনা ঘটছে তার আপাতিক প্রভাব ভীমের ওপর এতই বেশি, যে, তিনি মুহূর্তের মধ্যে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাই বলে কি অর্জুন কিংবা যুধিষ্ঠির স্বয়ং এই ঘটনায় বিচলিত ছিলেন না? আমি আবারও বলছি এই মুহূর্তে অর্জুনের নীরবতায় আমি তেমন কিছু ক্ষুব্ধ নই, কেন না এই নীরবতার এমন কিছু বৈশিষ্ট্যও নেই। বৈশিষ্ট্য শুধু এইটুকুই যে, প্রতিবাদে মুখর না হলেও এই নীরবতা অর্জুনেরও চরিত্র নির্দেশ করে। প্রথমত কোনও ব্যাপারেই তিনি এত আকুল হন না যে, সঙ্গে সঙ্গে হই-চই শুরু করে দিয়ে এক বিষম কাণ্ড বাধিয়ে দেবেন। বরঞ্চ দুর্ঘটনা অথবা লাঞ্ছনা যখন ঘটে, তখন তাঁর নিশ্চল, স্বস্থ মূর্তি দেখে ভগবদ্‌গীতার বাঞ্ছিত সেই আদর্শ পুরুষটির কথা মনে আসে, সেই পুরুষটি—নির্মমো নিরহংকারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী। মহাবীর, অথচ তাঁর নিশ্চল সত্ত্বরূপ যেন খ্রিস্টীয় নিশ্চলতার প্রতিরূপে ধরা দেয়—Ye resist not evil।

কিন্তু তবু তো অৰ্জুন মানুষ। মানুষের ক্ষোভ, তৃষ্ণা, দুর্বলতা এবং ক্রোধ তাঁর অন্তরের সত্ত্বকে অতিক্রম করে বাইরে প্রকাশিত হয় না বটে, তবু সেই সব বিক্ষুব্ধ বৃত্তিগুলি তাঁর অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, তাঁকে নিজের কর্তব্যে, প্রতিজ্ঞায় আরও কঠিন আরও দৃঢ় করে তোলে। হ্যাঁ, আপাতত দ্রৌপদীর অপমানে তিনি মুখ খোলেননি বটে, কিন্তু দাদার অপমানে মুখ খুললেন। মনে হতেই পারে—এ সেই পুরুষশাসিত সমাজের মাত্রাহীন পক্ষপাত, কিন্তু এ-পক্ষপাত যতখানি যুধিষ্ঠিরের জন্য, তার থেকে অনেক বেশি ধর্মের জন্য। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের বাচন, মনন এবং আচারে ধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখে সকলে তাঁকেই একমাত্র ধর্মস্বরূপ বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁরা কেউ অর্জুনের কথা ভাবেন না। ভাবেন না কী সব বিষম পরিস্থিতিতে অর্জুন ধর্মের কথা স্মরণ করেছেন। মনে পড়ে—সেই যেদিন নম্রনেত্রপাতিনী নববধূ দ্রৌপদীকে নিয়ে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে অর্জুন মায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন, সেদিনও কুন্তীর ভুলে অর্জুন ভেঙে পড়েননি। যুধিষ্ঠির তবুও বলেছিলেন—অর্জুনই দ্রৌপদীকে জিতেছে, দ্রৌপদী তারই। তুমি বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু অর্জুন বলেছিলেন—আমাকে এমনি করে অধর্মের ভাগী করবেন না। আপনি আমার প্রতি স্নেহবশত যা বললেন ধর্মের দৃষ্টিতে তা ঠিক নয়—মা মাং নরেন্দ্র ত্বমধর্মভাজং/কৃথা ন ধর্মো’য়মশিষ্টদৃষ্টঃ। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে মায়ের আদেশের নিরিখে যেটা সত্যই ধর্ম বলে মনে হয় আপনি তাই করুন, যেটা যশস্কর—আপনি তাই করুন—এবং গতে যৎ করণীয়মত্র ধর্মং যশস্যং কুরু তদ্‌ বিচিন্ত্য।

ঠিক একইভাবে যেদিন নারদের উপদেশে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গ পেলেন আর ওদিকে ব্রাহ্মণের গরু-খোঁজার জন্য অস্ত্রাগারে ঢুকতে হল অর্জুনকে, যুধিষ্ঠির ঘটনা লঘু করে বলেছিলেন—তুমি বনবাসে যেয়ো না অর্জুন, এতে কোনও দোষ নেই। অর্জুন একই ধীরতায় উত্তর দিয়েছিলেন—আপনার কাছেই না শুনেছি দাদা, চালাকির দ্বারা কোনও মহৎ ধর্ম সিদ্ধ হয় না—ন ব্যাজেন চরেদ্‌ ধর্মম্‌ ইতি মে ভবতঃ শ্রুতম্‌। অর্জুন আরও বলেছিলেন—আমি সত্য থেকে বিচলিত হব না, কারণ সত্যই আমার অস্ত্র। আজ দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার মুহূর্তেও আমরা অর্জুনকে স্থির দেখছি এবং সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের অপমানের মুহূর্তেই তাঁকে আমরা প্রতিক্রিয় হতে দেখছি। যুধিষ্ঠির পাশা-খেলার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ; ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, রাজার ধর্ম মেনে তাঁকে পাশা খেলতে বসতে হয়েছে। তাঁর ‘না’ বলার উপায় ছিল না। এইরকম একটা অবস্থায় পাশার দানে হেরে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাও তাঁকে দেখতে হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরের এই নাচার অবস্থাটা অর্জুন বুঝেছেন। আর বুঝেছেন বলেই স্ত্রীর অপমানের থেকেও আরও বিশাল এক ইতিবাচক-বোধ অর্জুনকে এই সময় আত্মস্থ করে তুলছে—না, আমরা হারাইনি। নিজের অপমান, স্ত্রীর অপমানের চেয়েও আরও বড় যে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম—সেটা আমরা হারাইনি।

‘ক্ষত্রিয়ের ধর্ম’ কথাটা এমনই যা আজকের এই পরিবর্তিত পরিশীলিত সমাজে প্রায় অর্থহীন। কিন্তু সেদিনের সেই মহাভারতীয় সমাজে এই ধর্মের ব্যাপ্তি ছিল এতটাই যে, অন্য সব কিছু, এমনকী এই ধর্ম ছাড়া ক্ষত্রিয়-পুরুষ নিজেও ছিলেন মূল্যহীন। অর্জুনের এই গভীর ধর্মবোধ—যা প্রায়শই যুধিষ্ঠিরের মতো প্রকটভাবে প্রকাশিত হত না—এই ধর্মবোধের কথা দ্রৌপদী যথেষ্ট জানতেন। আর জানতেন বলেই বনবাসের সময় কৌরবদের জামাই জয়দ্রথ যখন দ্রৌপদীকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন দ্রৌপদী অর্জুনকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে—এই সেই মহাবীর, যিনি ধনুর্ধারীদের অগ্রগণ্য। ধৈর্য, যশ এবং জিতেন্দ্রিয়তা তাঁর চরিত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আর ইনি শুধু যুধিষ্ঠিরের ভাই-ই নন, শিষ্যও বটে—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। এই একটি মাত্র কথা—শুধু ভাই নন, শিষ্য—এই কথাতেই বোঝা যায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাকালে তিনি কেন ততটা বিচলিত হননি এবং কেন যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীমের অপমানের ভাষায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

আমি জানি আধুনিক প্রগতিবাদীরা আমার যুক্তিতে খুশি হবেন না। তাঁরা বলবেন—তুমি যে যুক্তিই দাও, স্ত্রীকে এইভাবে পণ্য করাটা একেবারেই বর্বরতা! আমরা বলব—এ-কথা কে অস্বীকার করে? তবে এ কথাটা আপনারা বলার তিন হাজার বছর আগে ভীমই বলে দিয়েছেন। আমরা লড়ছি—অর্জুন কেন কিছু বললেন না তাই নিয়ে। বিরাট মহাকাব্যের পরিমণ্ডলে, বিশাল ক্ষাত্র-শক্তির ব্যাপ্তির মধ্যে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা একটা ঘটনামাত্র—যে লাঞ্ছনার মোকাবিলার জন্য ক্ষত্রিয়বধূ হিসাবে দ্রৌপদী নিজেই ছিলেন যথেষ্ট। আপনারা সবাই জানেন—দৌপদী তাঁর যুক্তি-তর্কে কুরুসভার সভ্যদের আকুল করে দিয়েছিলেন এবং এক সময় সেই নারীশক্তির কাছে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকেও হার মানতে হয়েছিল। আপন লাঞ্ছনাকালে দ্রৌপদী নিজেও হয়তো জানতেন যে, অর্জুন কিছু বলবেন না, কারণ সেটা তাঁর স্বভাব নয়। দ্রৌপদী তাঁর প্রিয়তম স্বামীকে চিনতেন। জয়দ্রথের কাছে অতি-সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেবার সময় তিনি বলেছেন—এই অর্জুন কখনও ধর্ম ত্যাগ করেন না। কামনা-বাসনার ঘোরে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন না, ভয় কিংবা রাগ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের ধর্ম বিসর্জন দেন না—যো বৈ ন কামান্ন ভয়ান্ন কোপাৎ ত্যজেদ্ধর্মং ন নৃশস্যঞ্চ কুযাৎ—অর্জুনের আরেক বৈশিষ্ট্য—তিনি নৃশংসতা পছন্দ করেন না। অর্জুনের স্বভাব সম্বন্ধে দ্রৌপদীর এত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বলতে পারি—কুরুসভায় নৃশংসতার নামান্তরে তাঁর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, তাতে সেই মুহূর্তে ধর্মের থেকেও ক্রোধটা বড় বেশি জরুরি ছিল। কিন্তু এও ঠিক—ধর্ম এবং দার্শনিকতা আমাদের দেশে এমন এক বৃহৎ তত্ত্ববোধ, যাতে সাময়িক ঘটনার পরম্পরা থেকে নিজেকে যুক্তিযুক্তভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়। অর্জুনও তাই করেছেন। যদি ভারতবর্ষের ধর্ম-দর্শন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান না থাকে, তা হলে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাকালে সেই ‘বীতরাগভয়ক্রোধ ব্যক্তিটির ওই বিপ্রতীপ আচরণ বুঝে ওঠা খুব কঠিন। রাগ কিংবা নৃশংসতার কারণ ঘটেছে বলেই অর্জুন ঘটনার অনুরূপ ব্যবহার করবেন—এত অল্পস্বত্ব তিনি নন, তাই আমাদের একান্ত মানবিক প্রতিক্রিয়াগুলি দিয়ে তাঁর এই গভীর ব্যবহার সযৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করাও খুব কঠিন।

বেশ, বুঝলাম—অর্জুন কার্যকালে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সমস্ত বাহ্যস্পর্শে তিনি অনাসক্ত অথবা নিতান্ত অনাসক্তভাবেই সমস্ত বিষয় তিনি গ্রহণ করতে পারেন, তাই বলে কি কুরুসভায় পাণ্ডব-কুলবধূর লাঞ্ছনা তাঁর মনে কোনওই প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি? আমরা বলব—মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলে নারীর সেই লাঞ্ছনাও তার সমস্ত ব্যাপ্তি নিয়ে ক্ষত্রিয়ের ধর্মের সঙ্গে মিশে গেছে। ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞার ধর্ম যেমন একদিকে অর্জুনকে সেই উন্মুক্ত সভাস্থলে নিশ্চ থাকতে বাধ্য করেছে অন্যদিকে সেই ধর্মই তাঁকে ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞায় আরও দৃঢ় করেছে। অথচ তিনি কথা বলেন খুবই কম। এরই মধ্যে ভীমসেন, দুঃশাসনের রক্তপান, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ এবং সমস্ত কৌরব-ভাইদের পিষে মারবার প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছেন। প্রথমবার পাশার জাল থেকে মুক্তি পেয়ে পাণ্ডবরা বেরিয়ে যাবার সময় কর্ণ যখন গালি দিলেন, ভীমও তখন কর্ণকে উল্টো গালাগালি দিলেন। কিন্তু এই অবস্থাতেও অর্জুন মহাবীরের দূরত্ব নিয়ে ভীমকে বললেন—ফালতু লোকের সঙ্গে কথা বলতে নেই, দাদা।

অর্জুন কথা বলেন না, শুধু মনে মনে দৃঢ় হন। দ্বিতীয়বার পাশা-খেলায় হেরে পাণ্ডবরা যখন বনে চললেন, তখনও অবধারিতভাবে দুর্যোধন-কর্ণেরা পাণ্ডবদের এই অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করতে লাগলেন। ভীম আবারও ক্ষেপে উঠে গোটা তিনেক প্রতিজ্ঞার পুনরুক্তি করলেন। আর নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপ শিখার মতো উদ্ধত মহাবীর অর্জুন শুধু বললেন—ভদ্রলোকেরা এত কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করে না দাদা! আজ থেকে বনবাসের চোদ্দো বছরের মাথায় যা ঘটবে—সবাই তা দেখতে পাবেন—ইতঃ চতুর্দশে বর্ষে দ্রষ্টারো যদ ভবিষ্যতি। তবু এইখানে একবার তাঁকে মুখ খুলে প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করতে হয়েছে। তার কারণ অবশ্য ভীমই। ভীম নিজে তো কৌরববংশ ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা নিলেনই, উপরন্তু যুদ্ধ লাগলে পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে কে কাকে হত্যা করবেন, তার একটা ‘লিস্ট’ বানিয়ে—আমি দুর্যোধনকে মারব, কর্ণকে মারবে অর্জুন, শকুনিকে মারবে সহদেব—এইরকম আস্ফালন করে যাচ্ছিলেন। অর্জুন তাঁকে ধীর স্বরে শান্ত করলেন বটে, কিন্তু ভোলেভালা সরল ভীমদাদার জন্য তাঁর মায়া লাগল। তিনি দেখলেন—ভীমকে অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেলেছেন, এখন তাঁর নিতান্ত সযৌক্তিক কথাগুলিকে, তাঁর যুক্তিযুক্ত প্রতিবাদগুলিকে একটু সমর্থন করা দরকার। অতএব তিনিও কর্ণবধের ভীষণ প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করলেন আপাতত শুধু ভীমের ভাল লাগবে বলে—অর্জুনঃ প্রতিজানীতে ভীমস্য প্রীতিকাম্যয়া।

আসলে অর্জুন যে সেই অস্ত্র পরীক্ষার আসরের দিন থেকে কর্ণকে দুচোখে দেখতে পারেন না, সে-কথা তো ভীমের অজানা ছিল না। কিন্তু আপাতত কুরুসভায় ওই অপমানদিগ্ধ ব্যক্তিটির মানসিক শান্তির জন্য অর্জুন যেন তাঁর ভাললাগা, তাঁর ইচ্ছাটাই বড় করে দেখলেন। বললেন ভীম ইচ্ছা করেছেন, অতএব আমি প্রতিজ্ঞা করছি—যদি হিমালয় পাহাড়ও নড়ে চড়ে বসে, সূর্য যদি হারায় তার আলো, তবু আমার এই প্রতিজ্ঞার ব্যত্যয় হবে না। এই কথা বলে অর্জুন দাদা যুধিষ্ঠির আর ভীমের পেছন পেছন বনের পথে চলতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মুষ্টিতে ধরা ছিল বালুকা, যে বালুকা ঝুরঝুর করে রাস্তায় ছড়িয়ে যেতে যেতে তিনি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন—আজ থেকে চোদ্দো বছর পরে এমনি ঝুরঝুর করে বাণ বর্ষণ করব শত্রু-সৈন্যের ওপর।