৪
আমরা সেই জায়গা থেকে প্রসঙ্গ বদলেছি, যেখানে দক্ষিণাকামী গুরুর আদেশে অর্জুন পাঞ্চালদেশের রাজা দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে আনলেন। লক্ষ করে দেখবেন—দ্রোণাচার্যের আদেশের মধ্যে যথেষ্ট জোর ছিল, এবং কৌরব-পাণ্ডব ভাইরা সকলেই প্রবল উন্মাদনায় দ্রুপদের রাজ্য পর্যদস্ত করতে বেরিয়েছিলেন। জীবনের প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধে কৌরব-কুমারেরা এবং কর্ণ পালিয়ে বাঁচলেন বটে, কিন্তু অর্জুনের বিজয় লাভের পর আবার তাঁরা বিজয়ীর সম্মান আত্মসাৎ করে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে মনে করি। কারণ অর্জুন দ্রুপদের রথের সারথি এবং ঘোড়াগুলিকে বিদ্ধ করে যেই-না দ্রুপদকে ধরে ফেলেছেন তখনই আমরা সমস্ত কুমারদের আবার যুদ্ধক্ষেত্রে মিলিত হতে দেখছি। কারণ তাঁরা সবাই একসাথ হয়ে—কুমারাঃ সহিতা স্তদা-—অন্যকৃত যুদ্ধজয়ের আনন্দে দ্রপদের রাজধানী একেবারে উথাল-পাথাল করে তুললেন।
ব্যাপারটা অর্জুনের কাছে মোটেই ভাল লাগল না। এই যুদ্ধজয়ের মুহূর্তেও সমস্ত ঘটনা-পরম্পরার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আছে। অতএব ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর ভঙ্গিতে অর্জুন ভীমকে উদ্দেশ করে বললেন—আর্য ভীম! এখনকার দিনের শ্রেষ্ঠ রাজাদের মধ্যে মহারাজ দ্রুপদ অন্যতম। তা ছাড়া কৌরবকুলের সম্বন্ধে তিনি আমাদের আত্মীয়। অতএব শুধু শুধু দ্রুপদের সৈন্য ধ্বংস করবেন না। আপনারা গুরুদক্ষিণা দিন—গুরুদানং প্রদীয়তাম্।
এই যে গুরুগম্ভীর স্বরে, আদেশের মতো একটি মাত্র বাক্য নির্গত হল অর্জুনের মুখ দিয়ে—এর মধ্যেই তাঁর ব্যক্তিত্ব, এর মধ্যেই তাঁর যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ এবং এর মধ্যেই অনাসক্তভাবে কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করার অভ্যাসটি কিন্তু লক্ষ করার মতো। পাঞ্চাল-দ্রুপদের সঙ্গে কৌরবদের বংশগত সম্বন্ধ খুব দূরগত নয়। বস্তুত কয়েক পুরুষ আগে একই পিতৃপুরুষ থেকে কৌরব এবং পাঞ্চালদের জন্ম হয়েছে। বর্তমান লেখক এ সব আলোচনা ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ-গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে করেছে। কিন্তু কথাটা হল—এই যুদ্ধজয়ের উন্মাদনার মধ্যেও অর্জুনের সে-কথা স্মরণ আছে! ‘দ্রপদ কুরুবীরদের আত্মীয়—সম্বন্ধী কুরুবীরাণাম্’—এখানে কৌরবদের কথা উল্লেখ করে অর্জুন প্রকারান্তরে কৌরব-কুমারদের তিরস্কার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ঘটনার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ এতখানি যে, প্রায় একার কৃতিত্বে এই যুদ্ধ জয় করেও তিনি ভীমকে বলছেন—আপনারা গুরুদক্ষিণা দিন। অর্থাৎ ওই কাজটার সঙ্গেই দ্রুপদ-জয়ের সম্পর্ক, তার বেশি কিছু নয়। তাঁর ভাবটা হল—দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে আনার প্রয়োজন ছিল। সেই কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ এবং সৈন্যক্ষয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, অতএব ফিরে চলুন। ব্যাস লিখেছেন—অর্জুন বারণ করলে ভীম যুদ্ধে তৃপ্তি লাভ না করেই শান্ত হতে বাধ্য হলেন—অতৃপ্তঃ যুদ্ধধর্মেষু। এর মানে হল—ভীম যুদ্ধের উন্মাদনায়, জয়ের আনন্দে সংপৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেখানে অর্জুনের বাধায় তিনি অতৃপ্ত রয়ে গেলেন। এখানে শুধু ভীমের প্রতিতুলনায় দেখানো হল যে, অর্জুন কিন্তু গুরুদক্ষিণার মতো কর্তব্য কর্মের ব্যবস্থা হওয়া মাত্রেই তৃপ্ত। এই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আর কোনও কারণ নেই তাঁর। যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ-কালে ভারতযুদ্ধের নায়ক হবেন, যিনি ভবিষ্যৎকালে ভগবত্তার লক্ষণে ভূষিত কৃষ্ণ ভগবানের কাছ থেকে উপনিষৎসার গীতা শুনবেন, তিনি যে জীবনের প্রথম এবং প্রকাশ্য যুদ্ধেই তাঁর সুনিয়ন্ত্রিত আত্মশক্তি এবং নির্লিপ্ত কমাভ্যাসের পরিচয় দেবেন—তাতে সন্দেহ কী?
নির্লিপ্ততার এই আরম্ভ এবং এই নির্লিপ্ততাই অর্জুনের সমস্ত কর্ম, ধর্ম, এমনকী বীরত্ব এবং প্রেমকেও নিয়ন্ত্রিত করেছে। আমরা একে একে সে-সব কথায় আসছি। এই মুহূর্তে যে মানুষটি দ্রুপদ রাজার সারথি, রথ—সব ধ্বংস করে দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে ফেললেন, সেই মানুষটির মুখেই শত্রুর সম্বন্ধে যে সম্ভ্রবাণী শোনা গেল—তা আমরা যতখানি খেয়াল করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি খেয়াল করেছিলেন স্বয়ং মহারাজ দ্রুপদ। সেই মুহূর্তে অর্জুনের বাহুবন্দি অবস্থায় দ্রুপদ বুঝেছিলেন—এ কোনও সাধারণ যোদ্ধার কাজ নয়। পরাজিত অবস্থাতেও তিনি বুঝলেন—অর্জুন তাঁর ব্যক্তিগত কোনও শত্রু নন, তিনি দ্রোণাচার্যের প্রতিহিংসার নিমিত্তমাত্র। নানা কারণে অর্জুন ছেলেটিকে তিনি মনে রেখে দিলেন।
দ্রুপদের পরাজয়ের পর, কয়েক বছরের মধ্যেই তিনটি বড় ঘটনা ঘটল। প্রথমত দ্রুপদ-শাসনের ঠিক এক বছরের মধ্যেই হস্তিনাপুরের অস্থায়ী রাজা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজপদে অভিষিক্ত করতে বাধ্য হলেন। এই অভিষেকের পর আমরা দেখছি—অর্জুন একটার পর একটা রাজ্য জয় করে বিপুল ধনসম্পত্তি নিয়ে এসেছেন হস্তিনাপুরে। বীরত্বের দিক দিয়েও এই জয়ের মূল্য কম নয়। কারণ হস্তিনাপুরের পূর্বতন রাজা পাণ্ড পর্যন্ত যাঁদের বশে আনতে পারেননি, তাঁদের অনায়াসে আয়ত্ত করে নিলেন অর্জুন। প্রধানত অর্জুনের ক্ষমতাতেই সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের শক্তি এত বিখ্যাত হয়ে পড়ল—ততো বম্ল অতিখ্যাতম্—যে, ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের ওপর অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন।
দ্বিতীয় ঘটনা—মহারাজ দ্রুপদ দ্রোণাচার্যের কাছে অপমানিত হয়ে উপযুক্ত পুত্রলাভের ইচ্ছায় যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। যজ্ঞবেদি থেকে উৎপন্ন হলেন কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন, যিনি ভবিষ্যতে দ্রোণবধের জন্য চিহ্নিত হলেন। কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নর জন্ম থেকেও যে ঘটনার মূল্য অনেক বেশি, তা হল—দ্রৌপদীর জন্ম। দ্রৌপদীর আবির্ভাবে যজ্ঞবেদির অলৌকিকতা থাকায় তিনি সম্পূর্ণ যৌবনবতী, অসামান্যা সুন্দরী হয়েই জন্মালেন। তাঁর জন্মলগ্নে দৈববাণী হল—তিনি কৌরবকুলের ভয়ের কারণ হবেন—অস্যা হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপৎস্যতে ভয়ম্। এই আকাশবাণী শুনে পাঞ্চালরা সিংহের মতো কোলাহল করল। বোঝা যায়—কৌরবদের হাতে দ্রুপদের অপমানের স্মৃতি পাঞ্চালদের হৃদয়ে সম্পূর্ণ জাগরূক আছে এবং দ্ৰোণ যেহেতু কৌরবদের আশ্রয় করেই রয়েছেন, তাই কৌরবকুল ধ্বংসের দৈববাণী পাঞ্চালদের আশ্বস্ত করল।
তৃতীয় ঘটনা—ধৃতরাষ্ট্রের ঈষায় এবং দুর্যোধনের আগ্রাসী রাজনীতিতে পাণ্ডবদের বারণাবতে যাওয়া। বারণাবতে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারবার জন্য বহুতর দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন-ঘর তৈরি হল। অবশ্য বিদুরের পরামর্শে এবং পাণ্ডবদের বুদ্ধিতে দুর্যোধনের চক্রান্ত ব্যর্থ হল। পাণ্ডবরা তখন ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের বেশে এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে একসময় পাঞ্চাল রাজ্যে যাওয়ার কথা ভাবলেন। প্রস্তাবটা অবশ্য এসেছিল কুন্তীর কাছ থেকে। যুধিষ্ঠির মায়ের কথা শুনে ভাইদের সাঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন পাঞ্চালদেশে। সেখানে নাকি ভাল ভিক্ষে মিলবে। জায়গাটাও নাকি সুন্দর।
যাওয়ার পথে অর্জুনকে একটু বিক্রম-প্রকাশ করতে হল। সন্ধ্যার পর প্রথম রাত্রির আরম্ভে পাণ্ডবরা গঙ্গার পারে এসে পৌঁছলেন। একে রাত্রি, তাতে জায়গাটা নির্জন। অর্জুন একটা মশাল জ্বালিয়ে সবার আগে আগে গঙ্গার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে এক গন্ধর্ব গঙ্গার মনোরম নির্জনতার সুযোগ পেয়ে মেয়েদের নিয়ে জলবিহার করছিল। অর্জুনের মশাল আর পাণ্ডবদের কণ্ঠস্বর শুনে সে গন্ধর্ব ভারী রেগে গেল। গন্ধর্বরা পুরোপুরি দেবতা নয় বটে, তবে ক্ষমতায় আর শক্তিতে আধা-দেবতা। সে রেগেমেগে অর্জুনের ওপর দু-একটা কড়া কড়া বাণ ছুঁড়তেই অর্জুন তাকে সাবধান করে দিলেন। কিন্তু তাতে যখন কোনও কাজ হল না, তখন দ্রোণের কাছ থেকে পাওয়া এক আগুন-ছড়ানো বাণে গন্ধর্বকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেললেন। শেষে গন্ধর্বের বউ কুম্ভীনসী যুধিষ্ঠিরের হাতে-পায়ে ধরে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে থামতে বললেন এবং অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আদেশ মান্য করলেন। এর ফল হয়েছিল অসাধারণ। এই গন্ধর্বের সঙ্গে অর্জুনের চিরকালের বন্ধুত্ব হয়ে গেল, যে বন্ধুত্বের প্রতিদান অর্জুন এবং পাণ্ডবরা সমবেতভাবে ভোগ করবেন।
পাণ্ডবরা পাঞ্চালরাজ্যে এসে কুমোরপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন। ওদিকে ছদ্মবেশ ঠিক রাখার জন্য ব্রহ্মচারীর বেদপাঠ, ভিক্ষাবৃত্তি—সব ঠিকঠাক চলতে থাকল। পাঞ্চালে আসবার আগে এবং পরে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের ঘোষণা পাণ্ডবরা বহুবার শুনেছেন। কাজেই সেখানে যাবার লোভ তাঁদের ছিলই। তা ছাড়া অর্জুনকে লুকোনো যাচ্ছিল না। রাজসভায় যাবার আগে ব্রাহ্মণরা ব্রহ্মচারী-বেশ পাণ্ডবদের দেখে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—যা সুন্দর চেহারা আপনাদের। আপনাদের একজনকে দ্রৌপদী বর হিসেবেও পছন্দ করতে পারেন। তা ছাড়া, এই ভাইটি তো আপনার যেমন দেখতে, তেমনি শক্তপোক্ত এর হাত-জোড়া। আপনি একবার বললে ধনসম্পত্তি অনেক কিছুই জিতে আনতে পারে। যুধিষ্ঠির আর কী বলবেন? বললেন—চলুন আমরাও যাচ্ছি।
দ্রুপদ যেদিন নিজের সঙ্গে যুদ্ধে অর্জুনের ক্ষমতা দেখেছিলেন, সেদিন তাঁর মেয়ে ছিল না। কিন্তু আজ যখন মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, অভিরূপ পাত্রের হাতে কন্যা-সম্প্রদান করতে হবে, তখন সেই পরাক্রমশালী ছেলেটির কথা তাঁর মনে পড়ছে। সমস্ত কৌরব রাজপুত্রদের মধ্যে সেই একক বীর, অথচ একান্ত বিস্মৃতির যোগ্য মুহূর্তেও যাঁর সম্মানবোধ অব্যাহত আছে, আজ মেয়ের বিয়ের আগে তাঁর কথা বারবার মনে পড়ছে দ্রুপদের। বলা বাহুল্য—বারণাবতে পাণ্ডবদের মৃত্যু রটনা দ্রুপদ বিশ্বাস করেননি। বিশ্বাস করেননি—অর্জুনের শক্তির নিরিখেই। তাঁর দৃঢ় ধারণা—অর্জুনের মতো শক্তিধরকে পুড়িয়ে মারা সম্ভব নয়। অর্জুন এবং তাঁর মা-ভাইরা নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছেন এবং দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের খবর কানে গেলেই অর্জুন চলে আসবেন স্বয়ম্বর-সভায়।
এত কথা মাথায় রেখেই দ্রুপদ লক্ষ্যভেদের ধনুকটি বিশেষভাবে তৈরি করালেন, যাতে অর্জুনের মতো মহাবীর ছাড়া অন্য কেউ সে ধনুক নোয়াতেই না পারে। তৈরি করালেন—শুন্যমার্গে রাখা সেই মৎস্য-চক্ষুর যন্ত্র, যাতে অন্য কেউ নীচে জলের দিকে তাকিয়ে ওপরে সেই মৎস্যচক্ষুতে বাণ ছোঁয়াতেই না পারে। মহাভারতের কবি আগেভাগেই আমাদের জানিয়েছেন যে, দ্রুপদের ভারী ইচ্ছে ছিল যাতে কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে অর্জুনের হাতে তুলে দেওয়া যায়, অথচ এ-কথা তিনি কোথাও প্রকাশ করেননি। কারণ তাতে স্বয়ম্বরসভার রীতিনীতি লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু স্বয়ম্বরে আসবেন এমন রাজা এবং তদানীন্তন রাজপুত্রদের বলাবল মাথায় রেখে দ্রুপদ মেয়ের বিয়ের জন্য এমন কঠিন একটা শর্ত স্থির করলেন, যাতে অর্জুন ছাড়া আর কেউ তার ধারে কাছে না যেতে পারে। কারণ তাঁর একমাত্র অভিলাষ—পুরুষপ্রবীর অর্জুনের হাতে সুন্দরী কৃষ্ণাকে তুলে দেওয়া। দ্রোণাচার্যের হাতে অপমান এবং কৃষ্ণার মতো সুন্দরী মেয়ে পাবার পর থেকেই দ্রুপদ শুধু অর্জুনকে খুঁজে যাচ্ছেন—সো’ম্বেষমানঃ কৌন্তেয়ম্। সব সময় ভাবছেন—মেয়েটিকে তাঁর হাতে তুলে দেব—কৃষ্ণাং দদ্যামিতি সদা।
সব-সময় তিনি এই কথা ভাবছেন, অথচ মহাভারত বলছে দ্রুপদ তাঁর ভাবনা কোথাও প্রকাশ করেননি—এটা কতটা সম্ভব? হয়তো বাইরে এ-কথাটা কাউকে বলেননি দ্রুপদ, কারণ তাতে স্বয়ম্বরের নীতি-যুক্তি পালিত হত না। কিন্তু ভিতরবাড়িতে নিজের মেয়েটির কাছেও কি তিনি কখনও অর্জুনের কথা বলেননি। পিতৃহৃদয়ের অন্তরঙ্গ উচ্ছ্বাস কি এত সহজে চেপে রাখা যায়, বিশেষত তিনি নিজেই যেখানে অর্জুনের কথা ভেবেই স্বয়ম্বরের শর্ত ঠিক করেছেন। মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে কিছু না বললেও আমাদের বিশ্বাস—দ্রৌপদী পিতার ইচ্ছার কথা জানতেন এবং জানতেন বলেই কি সামান্য, অথবা সত্যিই অসামান্য অজুহাতে তিনি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করলেন। কর্ণ তো দেখতে খারাপ ছিলেন না, দ্রুপদের শর্ত-মতো তিনি তো প্রায় লক্ষ্যভেদ করেই ফেলেছিলেন। খোদ পাণ্ডবরাও কর্ণকে দেখে বুঝে গিয়েছিলেন যে, লক্ষ্যভেদ বুঝি হয়েই গেল, সুন্দরী কৃষ্ণাকে এ-জীবনে আরও পাওয়া হল না। কিন্তু এত বড় যোদ্ধাকেও যে কৌলীন্যের অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করলেন দ্রৌপদী, তাতে আমাদের ধারণা হয়—পিতার মনের কথা তিনি জানতেন।
অনেকেই বলেন যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বয়ম্বর-সভায় এসে দ্রৌপদীর কাছে সমস্ত রাজাদের পরিচয় দেবার পর ঘোষণা করেছিলেন—কল্যাণী! এই রাজারা তোমার জন্য লক্ষ্যভেদ করতে আরম্ভ করবেন, এঁদের মধ্যে যিনি এই লক্ষ্যভেদ করবেন, তুমি তাঁকে বরণ করবে—বরয়েথাঃ শুভে’দ্য তম্।
এই প্রতিজ্ঞাত বচনের অন্যথা ঘটেছিল কর্ণের প্রত্যাখ্যানে, সে কালেই বৈবাহিক প্রথা এবং স্বয়ম্বর-সভার রীতিনীতিতে যে প্রত্যাখ্যান অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও আমরা যদি স্বীকার করি যে, দ্রৌপদী অর্জুনের কথা, পিতার মনের কথা জানতেন, তা হলে ওই প্রত্যাখ্যান অপ্রত্যাশিত হলেও সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। মহাভারতের কবি অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানাননি যে, দ্রৌপদী পিতার হৃদয়লীন মর্মকথা জানতেন অথবা তিনি অপেক্ষা করেছিলেন, অর্জুন লক্ষ্যভেদ করতে আসবেন বলে। না, কবি এসব কথা পরিষ্কার করে বলেননি। কিন্তু দ্রৌপদী বিদগ্ধা রমণী বটে, তাঁর ব্যক্তিত্বও অত্যন্ত গভীর। সেই নিরিখে প্রথম দর্শনেই লক্ষ্যভেত্তা অপরিচিত পুরুষটির প্রতি তাঁর যে আপ্যায়ন প্রকাশ, মানসিকভাবে তাঁর যেমন তদ্গত সম্মোহন ঘটেছে, তাতে অনুমান করি—দ্রৌপদী বুঝেছিলেন—তিনি অর্জুন। যাঁর জন্য তিনি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যাঁর জন্য তিনি এতক্ষণ স্বয়ম্বরের মালা হাতে অপেক্ষার অন্তভূমিতে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন—সে আসিবে আমার মন বলে। পিতার মুখে যদি তিনি অর্জুনের কীর্তিকথা একটুও না শুনতেন, অর্জুন সম্বন্ধে এবং পিতার ইচ্ছে সম্বন্ধে তাঁর যদি পূর্বাহ্নেই কোনও ধারণা না থাকত, তা হলে একদিকে যেমন কর্ণপ্রত্যাখ্যান সযৌক্তিক হয় না, অন্যদিকে লক্ষ্যভেদের পর লক্ষ্যভেত্তা পুরুষের প্রতি বিদগ্ধা তথা ব্যক্তিত্বময়ী দ্রৌপদীর আপাত বিগলন তেমনই মানায় না।
আকাশযন্ত্রে মাছের চোখে যেই অর্জুনের বাণের ছোঁয়া লাগল, অমনই হাজারটা লোক আবার দ্রৌপদীর দিকে তাকাল। তাঁর চোখে সীমাহীন বিস্ময়; মনে হল এ যেন সাক্ষাৎ ইন্দ্র, রাজার রাজা। লোকেরা দেখল—লক্ষ্যভেত্তা পুরুষের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দ্রৌপদী যেন না হেসেও হাসছেন, এ যেন নিত্য নবায়মান অন্য কোনও দ্রৌপদী-নবেব নিত্যং/বিনাপি হাসং হসতীব কন্যা। স্বয়ম্বর-সভার এই অন্তিম পর্বে দ্রৌপদীর মুখে যখন কুমারীজীবনের শেষ হাসিটি ফুরিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তে মহাভারতের অনেকগুলি সংস্করণ দ্রৌপদীর হাতে-রাখা বরমাল্যখানি অর্জুনের বিশাল বক্ষে দুলিয়ে দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সভাস্থলে এতক্ষণ যিনি লক্ষ্যভেদ না হওয়ার সমস্ত আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, সেই রমণী—তিনি যত বিদগ্ধাই হন না কেন—তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাতঙ্ক হৃৎকম্পগুলি লক্ষ্যভেদের মুহূর্তে নিশ্চয়ই নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। সেই কুমারী-হৃদয় নিশ্চয়ই উদ্বেল হয়ে উঠেছিল অন্য কোনও মধুর গভীর অনুভূতিতে। মহাভারতের আরও কিছু সংস্করণ দ্রৌপদীর এই সানন্দ আপ্লুতির জন্য গোটা তিনেক শ্লোক বেশি খরচ করেছে এবং তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় দ্রৌপদী অর্জুনকে পিতার মুখে চিহ্নিত অৰ্জুন বলেই চিনেছিলেন। নইলে যতই লক্ষ্যভেদ হোক অপরিচিত পুরুষের প্রতি দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীর এই ভাব সাজে না। দ্রৌপদী কথা বলছিলেন না, কিন্তু চোখের চাহনিতেই কী যেন বলতে চাইছিলেন। বিলাসিনী রাজকুমারীর পক্ষে স্বাভাবিক হলেও তিনি মদ্য পানীয় কিছুই গ্রহণ করেননি, অথচ হাবে-ভাবে আপ্লুতিতে তিনি যেন মদস্খলিতা রমণীর মতো নুয়ে নুয়ে পড়ছিলেন—মদাদৃতেপি স্বলতীব ভাবৈঃ। তারপর আর কী? সাদা বরমাল্যখানি হাতে নিয়ে প্রাপ্তির গৌরবে নিঃসঙ্কোচে সমস্ত রাজমণ্ডলীর মধ্যপথ দিয়ে হেঁটে গেলেন দ্রৌপদী। আর প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো মধুর হাসিটি উপহার দিয়ে অর্জুনের গলায় দুলিয়ে দিলেন স্বয়ম্বরা বধূর সারা জীবনের ইচ্ছে দিয়ে গাঁথা মালাখানি।
অর্জুনের ব্যাপারে—অথবা দ্রৌপদী যদি তাঁকে চিনেই থাকেন, তা হলে স্বয়ম্বর-সভায় শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর পুরুষটির ব্যাপারে, দ্রৌপদীর ভাব না হয় খানিকটা বোঝা গেল, কিন্তু অর্জুনকে আমরা কতটুকু চিনলাম? দ্রৌপদী প্রথম যখন স্বয়ম্বর-সভায় এসেছিলেন তখন তাঁর অলোকসামান্য রূপের ছটায় পাঁচ পাণ্ডব ভাইকেই আমরা বিমোহিত দেখেছি। আলাদাভাবে অর্জুনের কোনও বিক্রিয়া আমরা ব্যাসের জবানীতে পাইনি। অথবা সাধারণভাবে সব পাণ্ডবদের কথা বলতে হচ্ছিল বলেই অর্জুনকে সমস্ত ভাইদের গড্ডালিকায় ফেলে দিয়ে কবি যেন অর্জুনকে পাঁচজনের সমান করে রেখেছিলেন। তারপর যখন সব রাজপুত্রেরা একবার দ্রৌপদীর মুখ, আরেকবার মৎস্য যন্ত্রের দিকে তাকাতে তাকাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন, ঠিক তখনই অর্জুনকে আমরা পৃথক এক বৈশিষ্ট্যে দেখতে পাচ্ছি।
বস্তুত দ্রৌপদীর মুখ দেখে পাঁচভাই পাণ্ডবরা কামপীড়িত হলেন—ব্যাসের এই কথার মধ্যে দ্রৌপদীর রূপ-বৈদগ্ধ্য প্রকাশ করা যতটা ঈপ্সিত ছিল, অর্জুনের মাহাত্ম প্রকাশ করা ততটা নয়। ঠিক এই কারণেই এই মুহূর্তে অর্জুনকে ভাইদের সমতা লাভ করতে হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি অস্ত্রশিক্ষার সময় পাখির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি, সেই ব্যক্তি প্রথম দর্শনে দ্রৌপদীর মুখ দেখে যতটা মোহিত হয়েছেন, তার থেকেও মৎস্যচক্ষুর লক্ষ্যভেদ যে তাঁর কাছে অনেক বেশি রোমাঞ্চ নিয়ে ধরা দিয়েছিল—তাতে সন্দেহ কী। এ ছাড়া ব্যাস-বাল্মীকির উত্তরাধিকার পাওয়া এক কবি ভারী সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন—যাঁর জয়ের আশা এখনও একটুও মেটেনি, সেই মহাবীরের পক্ষে কি স্ত্রী-চিন্তা করা সম্ভব? প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখো—প্রবল-প্রতাপ সূর্য পর্যন্ত সমস্ত জগৎ আক্রমণ শেষ না করে অনুরাগবতী সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকান না। প্রকৃতির এই নিয়মে চললে অর্জুনকে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের শেষে বিবাহ করতে হত। কিন্তু এও ঠিক এবং অর্জুন বলেই এ-কথা ঠিক যে, তাঁর মতো মহাবীরের সামনে যখন কষ্টসাধ্য একটি লক্ষ্যভেদের প্রশ্ন ছিল, অপিচ অধম মধ্যম সমস্ত রাজারাও যেখানে নিজেদের প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানে অর্জুন শুধুমাত্র ক্ষত্রিয়ের বেশে উপস্থিত নেই বলে লক্ষ্যভেদ করতে পারছেন না—এই দুর্দমনীয় পরিস্থিতি তাঁকে দ্রৌপদীর মুখ ভুলিয়ে দিয়ে শেষ ক্ষত্রিয় পুরুষটির শেষ অক্ষম অস্ত্রপাত দেখার ধৈর্য জুগিয়েছিল। তাঁর মাথায় শুধু ছিল যন্ত্রনির্মিত মৎস্যচক্ষু—আর কিছু নয়।
অতএব যে মুহূর্তে মহাভারতের কবি ঘোষণা করলেন—যদা নিবৃত্তা রাজানঃ—অর্থাৎ রাজারা যেই থামলেন, অমনই অর্জুন সমবেত ব্রাহ্মণমণ্ডলীর কারও বা ধিক্কার-গঞ্জনা, কারও বা উৎসাহ প্রেরণা শুনতে না শুনতেই নিমেষের মধ্যে লক্ষ্যভেদ করে মাটিতে ফেললেন। এইটুকুই। এরপর দ্রৌপদীর ভাব-বিগলিত বরমাল্যখানি প্রথমা প্রিয়ার বাহুর মতো তাঁর গলা জড়িয়ে ধরলেও, তাঁকে শুধু দেখেছি ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে রঙ্গস্থল থেকে বেরিয়ে যেতে, আর দ্রৌপদীকে দেখছি অনুগতা বধূটির মতো তাঁর পেছনে পেছনে চলতে। লক্ষণীয় বিষয় হল—সমস্ত রাজমণ্ডলীর অক্ষমতার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদেরই একান্ত ঈপ্সিতা, সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠা রমণীটিকে এককভাবে জিতে নেবার পর যে আপ্লতি, যে উদ্বেলতা একজন বিজয়ীর পক্ষে স্বাভাবিক হত, সেই বাঁধভাঙা-ভাব অর্জুনের মধ্যে আমরা দেখলাম না। যৌবনের কল্পকুঞ্জে প্রথম অতিথির সমাগমে অর্জুনের হৃদয় মথিত হয়েছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতির সমস্ত ভাবনা তাঁকে অন্যতর এক ব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত করল।
ব্রাহ্মণকল্প অর্জুনের হাতে মেয়ে দেওয়ায় সমবেত রাজমণ্ডলীর সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল কন্যার পিতা দ্রুপদের ওপর। সেই অবস্থায় সবাইকে যুদ্ধে প্রতিহত করে অর্জুন এবং ভীম যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে মায়ের কাছে উপস্থিত হলেন, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। ছেলেরা ফিরছে না, ঝুলি ভরে ভিক্ষার জিনিস আনল না, খাওয়া-দাওয়া হল না—এতসব চিন্তায় যখন কুন্তী আকুল হয়ে আছেন, সেই মুহূর্তে ভীম-অর্জুন দুজনে খুব আনন্দের সঙ্গে একসঙ্গে বলে উঠলেন—মা গো! ভিক্ষা এনেছি। নবপরিণীতা বধূর সঙ্গে প্রথম ঠাট্টা। সম্পর্কটা সহজ করে নেওয়া। জননীর মন কি আর যুবক ছেলের রসিকতা বোঝে? ছেলেদের খাওয়া-দাওয়া হয়নি—এই তো কুন্তীর প্রথম চিন্তা। অতএব তিনিও বললেন—যা এনেছো, সবাই একসঙ্গে ভোগ করো।
আপনারা জানেন—কুন্তীর এই কথার পর পাণ্ডবদের সামনে সেই বিরাট সমস্যা উপস্থিত হল। মুখ ফসকে বেরোলেই কি, জননী কুন্তী বলেছেন। তাঁর কথার মর্যাদা আছে। ব্যাকুল হয়ে কুন্তী ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের শরণ নিলেন—বাবা বাঁচাও, এ আমি কী বলে ফেললাম। একটু ভাবনা করতেই যুধিষ্ঠির পথটা পেয়ে গেলেন। পথটা এমনই যাতে অর্জুনের প্রাধান্য সম্পূর্ণ বজায় থাকে অথচ ‘বল’টা চলে যায় তাঁর ‘কোর্টে’। যুধিষ্ঠির বললেন—অর্জুন। দ্রৌপদীকে তুমিই জিতেছো, অতএব সে তোমারই—ত্বয়া জিতা ফাল্গন যাজ্ঞসেনী। অতএব তুমিই তাঁর পাণিগ্রহণ করো। কথাটার মধ্যে কি একটু অক্ষমের অভিমান ছিল? অর্থাৎ আমাদের তো আর লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা ছিল না, তুমি পেরেছো, তুমিই নাও।
এতে করে সমস্যা সমাধানের কল্পটুকু অর্জুনের দিকেই শুধু ঘুরিয়ে দেওয়া হল না, ওই একটা কথাই অর্জুনের সমস্ত সৌজন্যবোধ মথিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কারণ, এর পরেই অর্জুন বলবেন—দাদা! তুমি আমাকে অধর্মের ভাগী কোরো না। আমি যদি প্রথম বিয়ে করি দ্রৌপদীকে, সেটা কি শিষ্টাচারসম্মত হবে—ন ধর্মো’য়মশিষ্টদৃষ্টঃ? নিয়ম অনুসারে আপনি সবার প্রথমে বিবাহ করবেন, তারপর ভীম এবং তারপর আমি। আমরা সকলেই আপনার অনুগত। আপনি সব-দিক বিচার করে সেই কর্তব্য ঠিক করুন, যাতে ধর্ম, যশ এবং দ্রুপদরাজার হিত হয়।
আমরা জানি এবং আমাদের মতো যুধিষ্ঠিরও জানতেন যে, অর্জুন এই কথা বলবেন। তা ছাড়া এই ব্যবহারই তো অর্জুনের স্বাভাবিক। তা না হলে স্বয়ম্বর-সভায় প্রত্যেক রাজপুত্রের প্রার্থিতা দ্রৌপদীকে লাভ করার পরও তিনি আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেননি, আবার আজকে আপন কষ্টার্জিত সরসা রমণীটিকে বড় দাদার হাতে তুলে দিতেও অর্জুন দুঃসহ কষ্ট পাননি, অন্তত বাইরে তাঁর দুঃসহ দেখাননি। এই লাভালাভের দ্বন্দ্বহীন মানসিকতা প্রথম যৌবনেই অর্জুনকে এমন এক মাহাত্ম্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যাতে যুধিষ্ঠিরও ম্লান হয়ে যাবেন। অর্জুন বলেছিলেন—ভীম, আমি, আমার ছোটভাই নকুল-সহদেব এবং এই কন্যা দ্রৌপদী—এঁরা প্রত্যেকেই আপনার আজ্ঞাবহ, সকলের ওপরেই আপনার অধিকার আছে—প্রশাধি সর্বে স্ম বশে স্থিতাস্তে। অর্জুন নিজের বীরত্ব এবং গরিমা জানতেন বলেই তাঁর মুখে নিজেকে দমিয়ে রাখার এই সবিনয় অঙ্গীকার বারবার শুনেছি—আমরা সবাই আপনার বশে আছি, আপনি আজ্ঞা করুন। অর্জুনের মতো বিরাট মানুষের এমন প্রত্মীভূত আচরণে—যিনি নিজেকে দমিয়ে রাখা জানতেন না, সেই ভীমকেও কিন্তু দমিত হতে হয়েছে। জ্যেষ্ঠভ্রাতার কাছে অর্জুনের আত্মনিবেদনের এটি দ্বিতীয় ফল এবং সে-কারণেও এই আচরণ অর্জুনের ইচ্ছাকৃত কিনা, তা সুধীদের বিচার্য।
যাই হোক, দ্রৌপদীর ব্যাপারে অর্জুন যে কথাগুলি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। যুধিষ্ঠিরও তাঁকে দ্বিতীয়বার কোনও অনুরোধ করেননি অর্থাৎ আর সুযোগ দেননি। অর্জুনের কথা শোনার পর দ্রৌপদীও সচকিত হয়ে উঠেছেন। যে মহাবীরকে স্বয়ম্বর-সভায় বরমাল্যের সঙ্গে আপন হৃদয়টিও দান করেছিলেন, সেই অর্জুন যে এমন হঠাৎ করে স্বয়ম্বরা রমণীর সমস্ত অন্তর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন—এটা তিনি ভাবেননি। যুধিষ্ঠিরের কাছে অর্জুনের আত্মনিবেদনের মুহূর্তেই বিদগ্ধা দ্রৌপদী বুঝতে পারলেন তাঁর স্বয়ং পতি-নিবাচন ব্যর্থ হয়েছে। লহমার মধ্যে তিনি অন্য পাণ্ডব ভাইদের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছেন; বুঝি বা পরিমাপ করে নিচ্ছিলেন—ব্যক্তি পাণ্ডবদের শৌর্য, বীর্য, অবয়বসংস্থান। যুধিষ্ঠিরও দ্রৌপদীর মতোই দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন ভাইদের দিকে। দেখলেন—প্রত্যেকেই দ্রৌপদীকে পাবার জন্যে মনে মনে আকুলিত। যুধিষ্ঠির আর দেরি করেননি। শেষে এক রমণীর কারণে ভাইদের মধ্যে বিরোধ হয়—এই ভেবে যুধিষ্ঠির রায় দিলেন—এই কল্যাণী দ্রৌপদী আমাদের সবারই স্ত্রী হবেন—সর্বেষাং দ্রৌপদী ভায্যা ভবিষ্যতি হি নঃ শুভা। অর্জুন একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না, প্রকাশ করলেন না গভীর হৃদয়ের অন্তরতম অনুভূতি। নির্বিগ্ন মহাপুরুষটির মতো, ভগবদ্গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ মহাত্মার মতো অৰ্জুন স্ববীর্যলব্ধ আপন স্ত্রীর এক-পঞ্চমাংশ লাভ করেও যথালব্ধ অধিকারেই সন্তুষ্ট হয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবের সঙ্গে অর্জুনও দ্রৌপদীর অন্যতম স্বামীমাত্র, আর কিছু নয়।