২
হই হই করে দ্রোণাচার্যের ইস্কুল আরম্ভ হয়ে গেল। চারদিকে বেশ রটেও গেল কথাটা—দ্রোণাচার্য ইস্কুল খুলেছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে লাগল। মহামতি কৃষ্ণ যে বংশের মানুষ, সেই বৃষ্ণি-অন্ধক কুলেরও অনেক ছেলে এসে জুটল অস্ত্রশিক্ষার আশায়। কিন্তু বহিরাগত ছাত্র না হলেও অস্ত্রশিক্ষার আসরে আরও একটি ছেলেকে দেখা গেল, শিক্ষার উদ্দেশ্য তার কতটা ছিল জানি না, কিন্তু সে এল শুধু অর্জুনের সঙ্গে টক্কর দিতে। এই ছেলেটি কর্ণ। ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রটির সঙ্গে সামান্য নম্বরের জন্য দ্বিতীয় স্থানাধিকারীর যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকে, সেই প্রতিযোগিতার মনোভাবে কিন্তু কর্ণ দ্রোণাচার্যের কাছে আসেননি। তিনি এসেছেন অর্জুনের প্রতি অদ্ভুত এক ঘৃণা নিয়ে। অথচ তাঁর দিক থেকে এই ঘৃণার কোনও কারণ নেই। দুই ছাত্রের প্রতিযোগিতায় অন্তরে অন্তরে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকে, সে শ্রদ্ধা তো তাঁর নেই-ই, আছে শুধুই রাগ। এই রাগ আর ঘৃণা তাঁর তৈরি হয়েছে দুর্যোধনের সঙ্গে পড়ে। কর্ণ দুর্যোধনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করার জন্য এবং দুর্যোধনও তাঁকে কাজে লাগাচ্ছেন নিজের প্রয়োজনে। ভবিষ্যতে এই দুই স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির মধ্যে বন্ধুত্ব যতই দৃঢ় হোক, দুর্যোধন প্রথম থেকেই কিন্তু কর্ণকে এটা সম্পূর্ণ বোঝাতে পেরেছিলেন যে, পাণ্ডবরা অতি ঘৃণ্য জীব এবং কিছুতেই তাদের বাড়তে দেওয়া যাবে না। মনে রাখবেন—এরই মধ্যে দুর্যোধনের দিক থেকে ভীমকে বিষ খাওয়ানোর অকাজটি হয়ে গেছে এবং ভীম বেঁচে ফিরেছেন। তারপর যখন ওই অস্ত্রশিক্ষার আসরে প্রথম দিনেই অর্জুন গুরুর আকাঙ্ক্ষিত কাজটি করে দেবেন বলে কথা দিলেন, আর আচার্য দ্রোণও তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন কর্ণের ঈর্ষা হল সবচেয়ে বেশি; কারণ তাঁর ধারণা ছিল—অবশ্য অন্যের তুলনায় অস্ত্রবিদ্যায় নিজের ‘ন্যাক’ বেশি দেখেই তাঁর এই ধারণা হয়েছিল যে, ধনুকবাণের আসারে তাঁর ওপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে না। কিন্তু আজকে যখন দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রগুরু অর্জুনের ওপর প্রথমেই প্রীত হয়ে পড়লেন, তখন থেকেই কর্ণ অর্জুনকেই তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে আরম্ভ করলেন। এর সঙ্গে জুড়ে গেল দুর্যোধনের পরম্পরায় আসা হিংসা। ফলে অস্ত্রশিক্ষার জন্য তিনিও বেছে নিলেন দ্রোণকেই। অর্জুন বুঝতেও পারলেন না যে, তাঁরই এক সতীর্থ তাঁকে বেছে নিল জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।
যাই হোক দ্রোণাচার্যের ইস্কুল আরম্ভ হয়ে গেল। সবাই শিখছে—কেউ ধনুকের কেরামতি শিখছে, কেউ গদা শিখছে, কেউ বা খঙ্গের কেরামতি শিখছে। কিন্তু একদিন দেখা গেল অর্জুনই সবার থেকে আলাদা। তার কারণ অবশ্য কিছু অলৌকিক নয়। মহাভারতকার অর্জুনের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন—যে কোনও ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ হতে গেলে আপন ক্ষমতার সঙ্গে যোগ করতে হয় অভ্যাসকে। অভ্যাসের সঙ্গে চাই উৎসাহ এবং বারংবার, দিনের পর দিন অভ্যাস করতে করতে যদি উৎসাহেও কখনও ভাটা পড়ে, তবে শেষ জিনিস যেটা দরকার, সেটা হল, বিষয়ের প্রতি অনুরাগ—যা একজনকে আবারও অভ্যাসে নিযুক্ত করে। অর্জুনের এই শিক্ষা এবং অনুরাগের ফলে দ্রোণশিষ্যেরা সবাই এক অস্ত্রবিদ্যা শিখেও অর্জুনের থেকে ছোট হয়ে রইলেন। দ্রোণও বুঝতে পারলেন—অর্জুনই সবার সেরা এবং উপযুক্ত শিক্ষক যেমন যোগ্য ছাত্রকে বিশেষ নজর দিয়ে পড়ান, দ্রোণও অর্জুনের ব্যাপারে সেই সব ব্যবস্থা নিলেন, যাতে অর্জুন আরও পোক্ত হয়ে ওঠেন।
লক্ষণীয় বিষয় হল—অর্জুন যেদিন থেকে দ্রোণাচার্যের কাছে নাড়া বাঁধালেন, সেদিন থেকেই শিষ্য হিসেবে অর্জুনের নজর ছিল—তাঁর থেকে কেউ বেশি এগিয়ে যাচ্ছে কিনা। একটা ঘটনা এখানে বলা দরকার! দ্রোণের নিজের ছেলে অশ্বত্থামাও দ্রোণের কাছেই অস্ত্রশিক্ষা করতেন। কিন্তু অর্জুনের নিরন্তর অভ্যাসের জ্বালায় তাঁকে আলাদা করে কিছু শেখানোর উপায় ছিল না। কিন্তু স্নেহ যেহেতু বিষম বস্তু, তাই অন্য শিষ্যদের মধ্যে আপন পুত্রের বিষমতা রাখার জন্যই দ্ৰোণ শেষ পর্যন্ত কায়দা বার করলেন। বস্তুত সেকালের শিষ্যদের সবাইকে অল্পবিস্তর গুরুসেবা করতে হত। দ্রোণ অর্জুন সহ সমস্ত শিষ্যদেরই বলতেন—যাও জল ভরে নিয়ে এসো। কিন্তু জল ভরে আনার জন্য তিনি প্রত্যেক শিষ্যকে বড় বড় কমণ্ডলু দিয়ে দিতেন, যেগুলির মুখ ছোট। কমণ্ডলুতে গুব গুব করে জল ভরতে অনেক সময় চলে যেত। কিন্তু দ্রোণ অশ্বত্থামাকে দিতেন একটি বিরাট ছড়ানো মুখের কলসি। জলাধারে গিয়ে অশ্বত্থামা ঘপাৎ করে কলসী ডুবিয়ে জল নিয়ে আসতেন এবং তখন অন্যদের কমণ্ডলুতে কিন্তু গুব গুব করে জল উঠছে। অশ্বত্থামা দ্রোণের কাছে তাড়াতাড়ি চলে আসতেন, এই সময়ে দ্রোণ তাঁকে অস্ত্রবিদ্যার বিশেষ কিছু কায়দা শিখিয়ে দিতেন।
ক’দিনের মধ্যেই অর্জুন ব্যাপারটা ধরে ফেললেন। অর্জুন কিচ্ছুটি বললেন না, কিন্তু নিজের কমণ্ডলুটি অস্ত্রের সাহায্যে পূরণ করে অশ্বত্থামার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রোণের কাছে ফিরতে লাগলেন। ফলে অশ্বত্থামার ‘স্পেশাল লেসন’ অর্জুনকেও শেখাতে হল একই সঙ্গে—বলা বাহুল্য, অন্য শিষ্যেরা তখন সবাই মিলে কমণ্ডলুতে গুব গুবির খেলা খেলছে। আসলে ছাত্র-শিষ্য যদি শিক্ষার ব্যাপারে এতটাই উৎসাহী, এতটাই সতর্ক হয়, তাহলে গুরু তাঁর সর্বস্ব উজাড় করে দিতে বাধ্য। এমন ছাত্রের ওপর সর্বকালের গুরুদের মমতা পুত্ৰাধিক। অশ্বত্থামার পক্ষে তাই অন্য কিছুই জানা সম্ভব হল না, যা অর্জুনের অজ্ঞাত। শুধু তাই নয়, অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারে অর্জুনের যত্ন এবং উদ্যোগ সবাইকে এমনভাবে ছাপিয়ে গেল যে, দ্রোণ তাঁকে আরও ভালবাসতে বাধ্য হলেন। মহাভারতের কবি স্বয়ং মন্তব্য করে বলেছিলেন—অর্জুন এতটাই মেধাবী যে, আচার্য-পুত্র অশ্বত্থামার থেকে কোনও অংশে কম রইলেন না—ন ব্যহীয়ত মেধাবী পার্থোস্ত্রবিদুষাং বরঃ। কিন্তু এবার যে অর্জুন সবাইকে ছাড়িয়ে স্বীয় সাধনার চরম বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছচ্ছেন—সে-কথা আর মন্তব্য করে বললেন না, গল্প করে বললেন। অর্জুনকে নিরন্তর ধনুক-বাণের লক্ষাভ্যাস করতে দেখে—তং দৃষ্টা নিত্যমুদ্যুক্তমিস্বস্ত্রং প্রতি ফালুনম্—দ্রোণাচার্য একদিন নির্জনে রান্নার ঠাকুরটিকে ডেকে বললেন—দেখো বাপু! অর্জুনকে যেন কখনও অন্ধকারের মধ্যে খেতে দিয়ো না, আর আমি যে তোমাকে এই কথাটি বললাম—সেটাও অর্জুনকে বোলো না।
ব্যাপার হল—ধনুকবাণের সব কৌশল শেখার পর শেষ শিক্ষা হল—চোখে দেখে নয়, শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করা। অর্জুনের এখন সেটাই শুধু বাকি। যে বিদ্যায় ইক্ষাকু বংশের রাজা দশরথ, রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণ পারদর্শী ছিলেন, অর্জুনের এখন সেইটা শুধু শিখতে বাকি। এরই মধ্যে দ্ৰোণ পাচককে বললেন—অন্ধকারে অর্জুনকে খেতে দিয়ো না এবং এ-কথা যে আমি বলেছি—সেটাও তাঁকে বোলো না। টীকাকার নীলকণ্ঠ দ্রোণাচার্যের এই উপদেশটি বড় সরলভাবে নিয়েছেন এবং এই উপদেশের মর্মকথা যা প্রকাশ করেছেন, তাতে কিছুরই উপপত্তি হয় না। কিন্তু আমাদের হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মশায় ঠিক ধরেছেন। আসলে যে বস্তুতে মানুষ সিদ্ধিলাভ করতে চায়, তার সাধন সম্বন্ধে সে সব সময়ই চিন্তা ভাবনা করে। ধনুক-বাণ যেহেতু অর্জুনের ধ্যান-জ্ঞান, অতএব তিনি সবসময়েই চিন্তা করছেন—কী করে লক্ষ্য ভেদের কৌশলে আরও উৎকর্ষ আনা যায়। এখন কোনওক্রমে যদি রান্নার ঠাকুরটি অন্ধকারে অর্জুনকে খেতে দেয়, তাহলে অন্ধকারে খেতে খেতেই ধনুক-ধ্যানী অর্জুনের ধারণা হাব—আরে! এই অন্ধকারেও তো চিরন্তন অভ্যাসে মুখের গ্রাস ঠিক মুখেই গিয়ে পড়ছে, অন্য কোথাও তো হাত সরে যাচ্ছে না, তাহলে উপযুক্ত অভ্যাসে বাণও ছাড়া যাবে অন্ধকারে এবং শব্দমাত্রেই সে বাণ লক্ষ্যবিদ্ধ করতে পারবে। এখন এই সম্পূর্ণ ভাবনাটাই যাতে অর্জুনের মনে না আসে অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অকার’ না করে—সেজন্যই দ্রোণাচার্য পাচককে বলেছিলেন—অন্ধকারে অর্জুনকে খাবার না দিতে।
কিন্তু কেন এই গোপনীয়তা? সিদ্ধান্তবাগীশ জানিয়েছেন—গোপনীয়তা এই জন্য যে, ওই একটা জিনিসই বাকি ছিল—যেটা দ্রোণ ভেবেছিলেন নিজপুত্র অশ্বত্থামাকে শেখাবেন। কমণ্ডলু আর কলসির পরীক্ষা মাঠে মারা গেছে; এবং অর্জুনের ইনটুইশনের ওপর দ্রোণের আস্থা এত বেশি যে, তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন—একটা বিপর্যয় হলেই অর্জুন নিজেই না এর কৌশল উদ্ভাবন করে ফেলে। তাই তিনি পাচককে সাবধান করেছেন, যাতে ওই এক শব্দভেদী অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারে অন্তত নিজপুত্র অশ্বত্থামা অর্জুনকে ছাড়িয়ে যায়। এই গোপনীয়তার অর্থ আমরা বুঝলাম, কিন্তু দ্বিতীয় গোপনীয়তা! অর্থাৎ অর্জুন যদি কোনও ভাবে শব্দভেদের উপায় আবিষ্কার করেও ফেলেন আর অবোধ পাচক তখন যদি বলে—তাই তো বলি মহামান্যি দ্রোণাচাজ্জি আমাকে আগেই বলেছিলেন—অন্ধকারে আপনাকে খাবার না দিতে। তা হলে গুরু হিসাবে দ্রোণাচার্যের মানসম্মান আর কিছু থাকবে না। অতএব ওই দ্বিতীয় গোপনীয়তা—আমি যে বলেছি—সেটা বোলো না। বেশ বোঝা যায়—আপন পুত্রের কারণে দ্রোণের এই স্বার্থ সন্ধানের মধ্যেও তাঁর পাপবোধ কাজ করছিল, দ্রোণের দ্বিতীয় গোপনীয়তা সেই কারণেই।
কিন্তু বিপর্যয় যা ঘটার তা ঘটেই গেল; অবশ্য বিপর্যয়টা দ্রোণের কাছে, অর্জুনের কাছে এটা নিমিত্তমাত্র। নব নব উন্মেষশালিতার মধ্যেই প্রতিভার বীজ থাকে এবং সেই উন্মেষশালিতার জন্য সাধারণ নিমিত্তই যথেষ্ট। এবার সেই নিমিত্তটা জানাই। সারা দিনের অস্ত্রশিক্ষার পর সবাই তখন ‘ক্যাম্পে’ ফিরে এসেছে। সাঁঝের প্রদীপ দেওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ। এবার শ্রান্ত ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের খাবার দেওয়া হবে। ঠাকুর যখন সবাইকে খাবার দিল, তখন ঘরের প্রদীপখানি সুন্দর জ্বলছিল। কিন্তু সবাই যখন বেশ জাঁকিয়ে খেতে আরম্ভ করেছে, ঠিক তখুনি হঠাৎ হাওয়ায় প্রদীপ গেল নিভে। অবোধ পাচক ভাবল—আমি তো আর অন্ধকার দেখে অর্জুনকে খাবার দিইনি, কাজেই আমার দোষ নেই কিছু। অন্যেরা ভাবছে—আলোটা নিভেছে তো নিভেইছে, আবার জ্বালাও। অতএব ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি—ওরে, করভক! ওরে খর্বটক! কিন্তু এত শব্দ, হাঁকডাক, অন্ধকারের মধ্যে যিনি নির্বিকারে খাওয়া সেরে চলেছেন তিনি অর্জুন। তিনি ভাবছেন—ওঃ তৃতীয় তীরটা লক্ষ্যে পোঁছেছে বটে, কিন্তু ছিলাটা আরও এক পঁাচ জড়িয়ে নিলে আরও জোরে যেত তীরটা; আর দশম তীরটা ছোঁড়া উচিত ছিল আরও একটু বসে, নিচু হয়ে—অর্জুন কিন্তু খেয়ে চলেছেন—আর ত্রয়োদশ তীরটা লক্ষ্যের মধ্যেই গিয়ে পড়ল। আমি চাই, ওটা এক ইঞ্চি মাত্র সরে যাক, কারণ এখানে আমি লক্ষ্যভেদ করতে চাইছি না। লক্ষ্যের এক ইঞ্চি পাশ দিয়ে যেতে চাইছি এবং সেটাই আমার লক্ষ্য। সময়কালে গুরুস্থানীয়দের বাণমুখে প্রণাম জানাতে হলে লক্ষ্যের কান ঘেঁষে নতুন একটা লক্ষ্য চাই আমার। অর্জুন কিন্তু খেয়ে চলেছেন। হঠাৎ মনে হল—আরে! সবাই এত হাঁক-ডাক করছে, আমি তো এই অন্ধকারের মধ্যে দিব্যি খেয়ে নিলাম। কিন্তু খেলাম কী করে? পর-পর ঠিক তত খেয়েছি! অভ্যাসে এতটা হয়? ঘন অন্ধকারে যদি মুখের গ্রাস মুখেই পড়ে, তা হলে অন্ধকারে অভ্যস্ত মহাবীরের বাণই বা কেন লক্ষ্যমুখে পতিত হবে না! বাস, এই জিজ্ঞাসা এবং অন্তর্গত উচ্চাশার তাড়নায় সেই রাত্রেই অর্জুন উপস্থিত হলেন অস্ত্র অনুশীলনের নির্জন প্রান্তরে। একেবারে একা, সমস্ত রাজপুত্র যখন স্বপ্নের ঘুম ঘুমোচ্ছে, তখন অন্ধকারের মধ্যে এক অতন্দ্র বালক একাকী নিরলসভাবে বাণ ছুঁড়ে চলেছে শুধু শব্দ লক্ষ্য করে। প্রত্যেকটি বাণ এমনভাবে ছুঁড়ছেন অর্জুন, যেন অন্ধকারই তাঁর প্রথম শত্রু, আর দ্বিতীয় শত্রু লক্ষ্য। আধো ঘুমে আধো জাগরণে দ্রোণাচার্যের কানে সেই অন্ধকারের নৈঃশব্দ্যভেদী বাণের শব্দ ভেসে এল শন্···শন্···শন্—তস্য জ্যাতলনির্ঘোষং দ্রোণঃ শুশ্রাব ভারত।
নিজে ভাল ছাত্র এবং ভাল শিক্ষক হিসেবে দ্রোণ জানতেন—সব বিদ্যা, সব কৌশল ভাল ছাত্রকে শেখাতে হয় না। শিখতে শিখতে আপন প্রতিভায় সে আপনি শেখে। যখন জটিলতার জায়গাটা শিষ্য আপনিই ধরে ফেলে, তখন গুরুর আনন্দ হয় দুগুণ। প্রথম আনন্দ হয় স্বার্থে, নিজের ওপর আস্থায়; মনে হয়—এ ছেলে আমার কাছে এসেছিল বলেই আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। আর দ্বিতীয় আনন্দ হয় পরার্থে, শিষ্যের ওপর আস্থায়; মনে হয়—এ ছেলে ‘জিনিয়াস’, আমার শিক্ষা সে এতটাই নিয়েছে যে, এখন নিজেই নিজের পথ বার করে নিয়েছে। গুরুর কাছে এই আনন্দ এতটাই যে, তখন তাঁর পুত্র-পরিজন, আত্মীয়ের কথা মনে থাকে না, কোনও স্বার্থের কথা মনে থাকে না। শিষ্যের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পান, এবং আত্মলাভের আনন্দে গুরু তখন ঠিক দ্রোণাচার্যের মতো রাত্রের অন্ধকারে ছুটে যান অর্জুনের মতো শিষ্যের কাছে। তাঁকে আলিঙ্গন দেন বুক ভরে। আর পুত্রের স্বার্থ ভুলে গুরু তখন আপন অন্তরের সমস্ত স্বার্থপরতা এবং পাপবোধের ক্ষালন করেন কঠোর প্রতিজ্ঞায়—অর্জুন! আমি তোমার শিক্ষার জন্য এতটাই চেষ্টা করব, যাতে অন্য কোনও ধনুকধারী তোমার ধারে কাছে না আসতে পারে—যথা নান্যো ধনুর্ধরঃ। সত্যি বলছি—আমি এতটাই করব যাতে কেউ আর তোমার সমান হবে না।
বলা বাহুল্য, মহাভারতের কবি দ্রোণাচার্যের মুখে এমন অন্তিম-মুহূর্তে এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, যাতে বোঝা যায়—এর মধ্যে তাঁর উদারতার চেয়েও নাচার অবস্থাটা বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। দ্রোণ বুঝেছিলেন—অর্জুনের মতো শিষ্যের কাছে মন্ত্রগুপ্তি করে কোনও লাভ নেই—সে আপনিই যে কোনও সুত্রে নিজের প্রতিভায় সব অধিগত করবে, মাঝখান থেকে গুরু হিসেবে তাঁর গৌরবটাই ক্ষুন্ন হবে। অস্ত্রবিদ্যার নতুন কৌশল শেখানোর ক্রেডিটটাই তখন আর দ্রোণাচার্য পাবেন না, যেমন শব্দভেদ শিক্ষার ব্যাপারে হল। দ্রোণকে তখন তাই বলতেই হয়—সত্যি বলছি, তোমার মতো আর কাউকে এমন করে তৈরি করব না—সত্যমেতদ্, ব্রবীমি তে। মনের ভাবটা এই—সত্যি বলছি—আর হবে না, শব্দভেদিতার ক্ষেত্রে যেমনটি হল, তেমনটি আর হবে না। অন্তত এইবার দ্রোণ কথা রেখেছিলেন। অস্ত্রচালনায় নিষাদপুত্র একলব্যের ক্ষিপ্রতা এবং শব্দমাত্রে লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা অর্জুনের থেকেও বেশি ছিল এবং সে ক্ষমতা অর্জুনের কাছে ছিল ঈর্ষণীয়। স্বভাবতই অর্জুন এসে গুরুকে নিবেদন করেছিলেন—গুরুদেব! আপনিই সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—আমার শিষ্যদের মধ্যে আর কেউ তোমার থেকে শ্রেষ্ঠতর হবে না—ন মে শিষ্যঃ ত্বদ্বিশিষ্টো ভবিষ্যতি। অথচ এই তো দেখে এলাম নিষাদপুত্র একলব্যকে। সে আমার থেকেও নিপুণ। অন্য সমস্ত বীরের মধ্যেই সে শ্রেষ্ঠতম। এটা কেমন হল গুরুদেব?
আপনারা সকলে জানেন যে, এর উত্তরে দ্রোণাচার্য একলব্যের ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি গুরুদক্ষিণা হিসেবে চেয়েছিলেন এবং একলব্য তা কেটেও দেন। আঙুল কাটার পর যখন একলব্যের ছোঁড়া বাণগুলির ক্ষিপ্রতা কমে গেল অর্জুনের তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, তিনি ভারী খুশি হলেন—ততো’র্জুনঃ প্রীতমনা বড়ব বিগতজ্বরঃ। দ্রোণ কথা রাখলেন।
পাঁচজনে এ-কথা শুনলে বলবে—এ আবার কেমনধারা বীরত্ব? তুমি যখন অন্য একজনের থেকে বড় নও, তুমি তা হলে তার থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করো। তুমি তার আঙুল কেটে নিয়ে বড় হবে—এ কি বীরত্ব, না, কাপুরুষতা? এই আক্ষেপের উত্তরে আমরা আবার জানাই যে,-মহাভারতের কবি অর্জুনকে কোনও অলৌকিকতার মধ্যে দিয়ে বড় করেননি। প্রচণ্ড খাটুনি, অভ্যাস, প্রতিভা এবং সর্বোপরি ‘প্রোফেশনালিজম্’-এর মাধ্যমে যে মানুষটা ধাপে ধাপে চরম হয়ে উঠেছে সেটাই অর্জুন। বিশেষ করে শেষ যে কথাটা বললাম—‘প্রোফেশনালিজম্—এ-কথাটা অর্জুনের ক্ষেত্রে এত বেশি প্রযোজ্য যে, বড় হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একলব্যের মতো চরম বাধাটিকে সেই বৃত্তিতেই প্রতিহত করেছেন, যদিও এতে যে তাঁর বীরজনোচিত লজ্জা ছিল সেটা মহাভারতের কবি লুকোননি। লজ্জা ছিল বলেই অর্জুন দ্রোণাচার্যের কাছে একলব্যের সম্বন্ধে অনুযোগ করেছেন গোপনে এবং একটু বায়না করে—রহো দ্রোণং সমাসাদ্য প্রণয়াদিদম্ অব্রবীৎ। কিন্তু তাঁর ‘প্রোফেশনালিজম্’ বোঝা যায়—একলব্যকে দেখা ইস্তক তিনি তাঁর কথা ভেবে যাচ্ছেন—একলব্যমনুস্মরন্, এর জন্য গুরুর সঙ্গে দরবার করেছেন নির্জনে, সপ্রণয়ে, একাই গুরুর সঙ্গে একলব্যের কাছে পুনরায় গেছেন এবং দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যের বাণাকর্ষণের আঙুলটি কেটে দিতে বললে তাতে তিনি বাধা দেননি এবং শেষমেষ আঙুল কাটার পর তিনি খুশি হয়েছেন—যতটা না গুরু-গৌরবে তার থেকেও বেশি এই ভাবনায় যে—তাঁকে প্রতিহত করার মতো দ্বিতীয় কেউ রইল না—নান্যো’ভিভবিতা’র্জুনম্।
ব্যাস লিখেছেন—দ্রোণাচার্য সবাইকেই সমান শিক্ষা দিতেন, কিন্তু বুদ্ধি, লেগে থাকবার ক্ষমতা, শক্তি এবং উৎসাহ—বুদ্ধিযোগবলোৎসাহৈঃ—এগুলির দ্বারাই অর্জুন সবার থেকে বড় হয়ে উঠেছেন—বিশিষ্টো’ভবদৰ্জুনঃ। যে গুণগুলির দ্বারা অর্জুন বিশিষ্ট হয়ে উঠলেন, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি, সেটিকে ব্যাস আলাদা করে কোনও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু আমরা যেটিকে বিশেষ বলে মনে করি, সেটি—ওই ব্যাস যাকে বলেছেন ‘যোগ’। সাধারণভাবে আমরা এই শব্দের মানে বলেছি—লেগে থাকবার ক্ষমতা। কিন্তু এই শব্দটার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার সময় আমরা যোগ বলতে মনঃসংযোগই বুঝব। সবকিছুর মধ্যে বিশেষত সমস্ত আলোড়নের মধ্যেও এই মনোঃসংযোগের ব্যাপারটা অর্জুনের এতই বেশি ছিল যে, প্রথিতযশা গুরুদেব দ্রোণাচার্য পর্যন্ত কোনও বিশ্রাম পাননি। প্রকৃত ছাত্রের ক্ষমতাই হল মাস্টারমশাই তার জন্য খেটে পরিশ্রম করে আনন্দ পাবে। অর্জুন দ্রোণকে সেই আনন্দ দিয়েছেন।
অর্জুনের মনঃসংযোগ কতটা—সেটা প্রবাদে পরিণত হয়েছে সেই পাখির চোখ-বেঁধার পরীক্ষায়। বুদ্ধদেব বসু থেকে আরম্ভ করে অনেকেই এই পরীক্ষায় একা যুধিষ্ঠিরকে বোকা সাজিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছেন। কিন্তু দ্রোণের প্রশ্নের উত্তরে শুধু যুধিষ্ঠিরই বলেননি যে,—আমি এই গাছ, এই আপনি, ওই ভাইদের এবং ওই পাখি—সব কিছুই দেখছি; একই কথা অন্যেরাও বলেছিলেন—দুর্যোধন ভীম এবং দ্রোণের অন্যদেশী ছাত্ররাও একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন—সব দেখতে পাচ্ছি। যুধিষ্ঠির যেমন এ-কথায় দ্রোণের কাছে তিরস্কার লাভ করেছিলেন, অন্যেরাও ওই একই কথা বলে, একই ভাবে তিরস্কার লাভ করেছিলেন—তথা চ সর্বে তৎ সর্বং পশ্যাম ইতি কুৎসিতাঃ। কিন্তু অর্জুন তো আর সব দেখছি বলার লোক নয়। যে বীর পুরুষ দুদিন পরে পাঞ্চালের রাজসভায় সর্বসমক্ষে ঘূর্ণি-যন্ত্রের মাঝখানে রাখা মৎস্যচক্ষু ভেদ করবেন, তিনি যে ইস্কুলের শেষ পরীক্ষায় শুধু লক্ষ্যবস্তু, অর্থাৎ পাখিটাই দেখবেন তাতে আশ্চর্য কী?
দ্রোণ একইভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—তুমি পাখি, এবং আমি—সবাইকে ঠিক দেখছ তো? অর্জুন বললেন—না গুরুদেব! আমি শুধু পাখিটাই দেখছি—পশ্যাম্যেকং ভাসমিতি। দ্রোণ বললেন—যদি পাখিটাই দেখছ, তবে পাখির কোন অঙ্গ দেখছ? অর্জুন বললেন—শুধু পাখিটার মাথাই দেখছি, আর কিছুই আমার চোখে পড়ছে না।
দ্রোণ প্রথমে সাধারণভাবে সমস্ত শিষ্যদের বলেছিলেন—তোমরা সকলেই ওই পাখিটাকে তাক করে দাঁড়িয়ে থাকো, তারপর আমি এক একজন করে বলব এবং আমার বলামাত্র ওই পাখিটার মাথা কেটে ফেলতে হবে। এই সাধারণ উপদেশের পর যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাভূমিতে দ্রোণের প্রশ্ন, একেক-জনের একেকরকম উত্তর—এই বিচিত্রতা এবং সর্বোপরি শিষ্যদের ক্রমিক অকৃতকার্যতার মধ্যে দিয়ে যে ঘটনাগুলি ঘটছিল, তাতে সমবেত শিষ্যদের সবারই মনোযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই যে দ্রোণ বলেছিলেন—তোমরা সবাই ওই পাখিটার দিকে তীর তাক করে দাঁড়িয়ে থাকো—সেই আদেশমাত্র অর্জুন পাখি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। কে কী বলল, কার কী হল—সে-সবে অর্জুনের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ তখন পাখির দিকে। শেষে যেই চরম আদেশ নেমে এল—অর্জুন! পাখির কোন অঙ্গ দেখছ তুমি—সেটা মিলিটারি ভাষায় অর্জুনের কাছে ‘অ্যাটেনশান’ বলার মতো। এই মুহূর্ত থেকে তিনি আর পুরো পাখিটা দেখতে পাচ্ছেন না, শুধু পাখির মাথা দেখছেন—শিরঃ পশ্যামি ভাসস্য ন গাত্রমিতি সো’ব্রবীৎ।
এমন শিষ্য পেয়ে এবং সেই শিষ্যের চরম মনোযোগের খবর জেনে দ্রোণের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল—দ্রোণো হৃষ্টতনূরুহঃ। তাঁর মুখ দিয়ে শেষ আদেশ বেরিয়ে এল—শর ত্যাগ কর। মুহূর্তমধ্যে সেই পরীক্ষাভূমির প্রশস্ত ক্ষেত্রে অসংখ্য গাছ, শুকনো পাতা, আর উদ্বেলিত রাজপুত্রদের সমস্ত অনীপ্সা—অর্থাৎ আমরা পারিনি, অর্জুনও পারবে না—এই না-চাওয়ার মুহর্তটা কাটতে না কাটতেই পাখির মাথাটা শুধু মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেল। দ্রোণাচার্য অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। বলা যায় ‘থিওরেটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেল, এবার ‘প্র্যাকটিক্যাল’। এ যেমন বলে-কয়ে ছাত্রদের অবহিত করে একটা পরীক্ষা হল, তেমনি হঠাৎ বিপদ এলে ছাত্রদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং অস্ত্রত্যাগের ক্ষিপ্রতা কতখানি—এটাও সেকালের গুরুরা বুঝে নিতেন। দ্রোণ শিষ্যদের সঙ্গে গঙ্গায় স্নান করতে গিয়েছিলেন। বালক-বয়সের ছেলেরা তখনও গঙ্গায় নামেনি, নানারকম ক্রীড়াকৌতুকে মগ্ন ছিল সবাই। দ্রোণাচার্য একাই নেমেছিলেন গঙ্গায়। এমন সময় হাঙর-কুমির জাতীয় কোনও জলজন্তু তাঁর পা কামড়ে ধরল। দ্রোণাচার্য নিজেই সেটাকে মেরে মুক্ত হতে পারতেন, কিন্তু সে-চেষ্টা না করে যন্ত্রণা সহ্য করে গঙ্গার তীরে দাঁড়ানো রাজকুমারদের ডেকে বললেন—হাঙর-কুমির কিছু একটা কামড়ে ধরেছে আমার পা। তোমরা এটাকে মেরে আমায় বাঁচাও।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রত্যেকটি রাজকুমার আপন কর্তব্য ভুলে গেলেন। হতচকিত, বিমূঢ় কুমারদের মধ্যে যিনি নিমেষে জলের মধ্যে শরসন্ধান করে জল-জন্তুটিকে খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন, তিনি অর্জুন। দ্রোণ আর দেরি করেননি। উপযুক্ত ছাত্রের চরম কৃতকার্যতার পুরস্কার হিসেবে নিজের কাছে সযত্নে রাখা ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র অর্জুনকে দান করলেন। শিখিয়ে দিলেন এই ভয়ঙ্কর অস্ত্র কীভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং দরকার হলে কীভাবে এই অস্ত্র সম্বরণ করতে হবে।
অর্জুনের এই পুরস্কার অর্থাৎ ব্রহ্মশির অস্ত্রলাভের প্রসঙ্গে দুটি কথা বলতে চাই। মনে রাখা দরকার, মহামতি কর্ণ, যিনি ভবিষ্যতে অর্জুনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, তিনি বেশ কিছুদিন দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন। বস্তুত এই অস্ত্রশিক্ষার শেষ-পর্বে যে ব্রহ্মশির অত্র অর্জুন পেলেন, এই অস্ত্রটির ওপর সবচেয়ে বেশি লোভ ছিল কর্ণের। প্রতিদিনের সুচিন্তিত অভ্যাস, লেগে থাকা, মনঃসংযোগ—এগুলি ছাড়াই কর্ণ চেয়েছিলেন ব্রহ্মাস্ত্র তাঁর হোক। কর্ণ বেশ বুঝতে পেরেছিলেন—যে উদ্যম এবং অনুশীলনে অর্জুন হওয়া যায়, সেই উদ্যম এবং অনুশীলন তাঁর নেই। অথচ রণক্ষেত্রে অর্জুনকে ঠেকাতে হলে এমন কিছু তাঁর চাই যার কাছে অর্জুনের অতীত অভ্যাস, মনঃসংযোগ—সব ব্যর্থ হবে। এর জন্য চাই সাংঘাতিক মারণাস্ত্র, যার কাছে বিদ্যা, বুদ্ধি কিংবা রণনীতির জারিজুরি খাটে না। দ্রোণাচার্যের পাঠশালাতেই কর্ণ বুঝে নিয়েছিলেন—অর্জুন তাঁর চেয়ে বেশি কৌশলী—সর্বত্থাধিকমালক্ষ্য ধনুর্বেদে ধনঞ্জয়ম্। কিন্তু অর্জুনকে যে হারাতেই হবে—শুধুমাত্র এই প্রতিস্পর্ধিতায়—যখন পাণ্ডব-কৌরবের একজন রাজকুমারও কাছে-ভিতে নেই, গুরুপুত্র অশ্বত্থামা নিজগৃহে অনুপস্থিত এবং দ্রোণাচার্য একা—ঠিক সেই সময় কর্ণ এসে বললেন—গুরুদেব! আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়বার উপায় শিখিয়ে দিন এবং সেই সঙ্গে শিখিয়ে দিন কী করে ওই অস্ত্র সম্বরণ করতে হয়। কর্ণ মনের মধ্যে কিছু না লুকিয়ে পরিষ্কার জানালেন—আমি এই ব্রহ্মাস্ত্রের অভিসন্ধি জানতে চাই শুধুমাত্র অর্জুনের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করবার জন্য—অর্জুনেন সমং চাহং যুধ্যেয়মিতি মে মতিঃ।
নিজের অভিজ্ঞতায় এবং অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের মমতার নিরিখে কর্ণ জানেন—অর্জুনের ব্যাপারে আচার্যের পক্ষপাত আছে। বস্তুত বুদ্ধিমান, উদ্যমী তথাচ বিনয়ী ছাত্রের প্রতি কোন গুরুর পক্ষপাত না থাকে? এই পক্ষপাত ধরে নিয়েই কর্ণ কৌশলে বললেন—গুরুদেব! সমস্ত শিষ্যের ক্ষেত্রেই আপনার সমদৃষ্টি। এমনকী আপনি আপনার নিজের ছেলের সঙ্গেও শিষ্যদের ভেদ করেন না—সমঃ শিষ্যেষু বঃ স্নেহঃ পুত্রে চৈব তথা ধ্রুবম্। অতএব আমিও ব্রহ্মাস্ত্র চাই।
কর্ণের এই বাচনভঙ্গীর মধ্যেই চাতুর্য ছিল। তিনি আগেভাগেই অর্জুনের ওপর আচার্যের নিশ্চিত। পক্ষপাত ভাষার কৌশলে নিবৃত্ত করতে চান। মহাভারতের কবি দেখিয়েছেন—যত বড় সমদর্শী। গুরুই হোন না কেন, সবার ওপরে তিনি মানুষ। অসাধারণ তথাপি শ্রদ্ধালু শিষ্যের প্রতি মনুষ্যধর্মে পক্ষপাত অনিবার্য। দ্রোণাচার্যও তাই অর্জুনের ব্যাপারে দুর্বল—সাপেক্ষঃ ফায়ূনং প্রতি। তার ওপর কর্ণ এমন একটি অস্ত্রের কৌশল শিখতে চায়, যার মারণ-ক্ষমতা পূর্বাহ্নেই নিশ্চিত এবং সর্বজনবিদিত, বিশেষত কর্ণ সেই অস্ত্র অর্জুনের ওপরেই প্রয়োগ করতে চায়। দ্রোণাচার্য জেনেশুনে কেমন করে এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ক্রোধী যুবকের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দেবেন?
অনেকে বলেন—কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র না দেওয়ার জন্য দ্রোণ যে ওজর আপত্তি তুলেছেন, তা ভারী অভব্য হয়েছে। সমাজ-সচেতন ঐতিহাসিকের কাছে এই ওজর আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এই কারণে যে, দ্রোণ বলেছিলেন—ব্রহ্মাস্ত্রের কৌশল জানতে পারেন ব্রাহ্মণ, জানতে পারেন চরিত্রবান, ব্রতচারী ক্ষত্রিয়, এমনকী সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসীও ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতে পারেন, কিন্তু আর কেউ নয়।
বলতে পারেন—এ আবার কেমন ধারা কথা? ব্রহ্মাস্ত্র লাভের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে দ্রোণ যাঁদের কথা উল্লেখ করলেন—তাদের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র থাকাও যা, না থাকাও তাই। ব্রাহ্মণ, ব্রতচারী, সন্ন্যাসী—এরা কি কেউ অস্ত্র হানার লোক? সত্যি কথা বলতে কি—দ্রোণের কথাটা যে কতটা জরুরি, সেটা অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র দেওয়ার সময়েই বোঝা যাবে। অর্থাৎ অর্জুনকে ব্রহ্মশির-অস্ত্র দান করার সময় দ্রোণ কী কথাগুলি বলেছিলেন, সেটাই আমাদের লক্ষ করতে হবে। প্রথম কথা—অর্জুন গুরুর কাছে ব্ৰহ্মাস্ত্র চাননি, গুরুই সেটা তাঁকে দিয়েছেন শিষ্যত্ব সিদ্ধির চরম পুরস্কার হিসেবে, দিয়েছেন স্বেচ্ছায়, সানন্দে। আর কর্ণ? কর্ণ নিজেই গুরুর কাছে ব্রহ্মাস্ত্র চেয়েছিলেন এবং সে চাওয়ার পিছনে প্রতিহিংসার আগুন ছিল। তা ছাড়া কর্ণ ব্রহ্মাস্ত্র চেয়েও ফেলেছিলেন বড় তাড়াতাড়ি এবং তিনি যে কী কূটবুদ্ধি নিয়ে দ্রোণের পেছন-পেছন ঘুর-ঘুর করছেন—সেটা দ্রোণ ধরে ফেলেছিলেন—দৌরাত্মঞ্চেব কর্ণস্য বিদিত্বা তমুবাচ হ। ব্রহ্মাস্ত্র লাভের বিষয়ে অর্জুন এবং কর্ণ—দুজনের ব্যবহারের তারতম্যটুকু লক্ষ করলেই দ্রোণাচার্য কর্ণকে যা বলেছিলেন এবং অর্জুনকে যা বলেছিলেন—সেই দুটি বক্তব্যই তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে। কর্ণকে দ্রোণ যা বলেছিলেন, তা সংক্ষেপে বলেছি। এবার অর্জুনকে কী বলেছিলেন সেটা শুনি।
দ্রোণ বলেছিলেন—প্রয়োগ এবং সম্বরণের কৌশল-সহ এই ব্রহ্মশির অস্ত্র তুমিই নাও অর্জুন। এই অস্ত্র কখনও যেন মানুষের ওপর প্রয়োগ কোরো না, কারণ সাধারণ অল্পপ্রাণ মানুষের ওপর প্রয়োগ করলে এই অস্ত্র সমস্ত জগৎ ধ্বংস করে দিতে পারে—জগদ্ বিনির্দহেদেতদ্ অল্পতেজসি পাতিতম। দ্রোণ অর্জুনকে সাবধান করে আবারও বললেন—এই অস্ত্র কোনও সাধারণ অস্ত্র নয়। অতএব যথেষ্ট সংযত হয়ে এই অস্ত্র ধারণ করবে।
দ্রোণ যে কথাগুলি বললেন, আধুনিক উন্নতমানের যে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র সম্বন্ধেই সে-কথা খাটে। বস্তুত ব্রহ্মাস্ত্রও সেকালের দিনের অত্যাধুনিক কোনও অস্ত্র যা চরম মারণাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ শব্দটাও বাংলাভাষায় চরম এবং পরম উপায় হিসাবে রূঢ় হয়ে গেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের অপব্যবহারে আধুনিককালে যে আশঙ্কাগুলি করা হয়, ব্রহ্মাস্ত্রের ক্ষেপণেও সেই চিন্তা বরাবর ছিল। ফলে এই অস্ত্রের অধিকারীর সংযম ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। কর্ণের এই সংযম ছিল না। কারণ প্রথমত, তিনি এই অস্ত্র অর্জুনের ওপর প্রয়োগ করার জন্যই চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, অস্ত্রের ব্যবহারে তাঁর যে স্থান, কাল, পাত্রের বোধ কম ছিল—তা ভবিষ্যতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচের ওপর একাগ্নী বাণের ব্যবহারেই বোঝা যায়। অন্যদিকে অর্জুনের সংযম এবং স্বার্থহীনতা এতটাই, যে সারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহারথ যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করার সময়েও ব্রহ্মাস্ত্রের কথা ভাবেননি। অপিচ ব্রহ্মশির অস্ত্রের মতো সাংঘাতিক অস্ত্রও তিনি ব্যবহার করেছিলেন অশ্বত্থামার ব্রহ্মশির প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু সে অস্ত্রও তিনি সময় মতো সম্বরণ করেছিলেন সাধারণ নাগরিকের প্রতি অনুকম্পায়, পাণ্ডব-বংশের সন্তানবীজ পরীক্ষিতের প্রাণের মূল্যে। বস্তুত অর্জুনের এই যে স্বার্থত্যাগ, এই যে নিষ্কাম উদাসীনতা, এই যে আপন মূল্যে পরের অস্তিত্ব চিন্তা—এগুলি সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী বা ব্রতচারী ক্ষত্রিয়কে মানায় বলেই ব্রহ্মাস্ত্রের অধিকারী হিসেবে দ্রোণ এদেরই নাম করেছেন। অপিচ অর্জুনের মধ্যে এত সব গুণ ছিল বলেই একমাত্র তাঁকেই দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্রের উপযুক্ত অ ধকারী মনে করেছেন। এর মধ্যে তাই পক্ষপাতের প্রশ্ন তো ওঠেই না, বরঞ্চ দ্রোণের দিক থেকে পাত্র নিবাচনের ক্ষমতা প্রকাশ পায়।
অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র দেবার সময় দ্রোণ আরও বলেছিলেন—আমি মহাত্মা অগ্নিবেশের শিষ্য এবং আমার অস্ত্রগুরু অগ্নিবেশ ছিলেন অগস্ত্যের শিষ্য। এই ব্রহ্মশির অস্ত্র অগস্ত্য অগ্নিবেশকে দিয়েছিলেন এবং অগ্নিবেশ দিয়েছিলেন আমাকে। তবে আমি কিন্তু রীতিমতো তপস্যা করে এই অস্ত্র পেয়েছিলাম—তপসা যন্ময়া প্রাপ্তম্। এই যে অস্ত্রের জন্য তপস্যা, এই তপস্যার মধ্যে অভ্যাস, উৎসাহ, অনুরাগের থেকেও সবার ওপরে সত্ত্বগুণের মাত্রাটা বেশি। অর্থাৎ অস্ত্র ব্যবহারের সময় ব্যক্তিগত হিংসার থেকেও সামগ্রিক পরিস্থিতি যেন বড় হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, এই মাত্রা-বোধ কর্ণের থেকে অর্জুনের অনেক বেশি ছিল। বড় বড় বনেদি বাড়িতে এক একটি গয়না—সে হার, অঙ্গদ, কেয়ুর—যাই হোক, শাশুড়ি বউমার হাতে তুলে দেন। আবার বউমা যেদিন পক্ককেশী শাশুড়িটি হন, সেদিন তিনি সেটি তুলে দেন পুত্রবধূর হাতে। এইভাবে পরম্পরাক্রমে সে-গয়না নামে কত অধস্তন পুরুষে। সে-গয়নার মধ্যে সোনা ছাড়া আরও যেটা থাকে, সেটা পূর্বতন পুরুষ এবং ঐতিহ্যের প্রতি মর্যাদা। কিন্তু অনুপযুক্ত বধূটির হাতে পড়লে সে-গয়না যেমন মর্যাদা হারিয়ে সোনার মূল্যে ধরা দেয়, পরম্পরাক্রমে পাওয়া অস্ত্রের ব্যাপারটাও সেইরকম! দ্রোণ বলেছিলেন—এক পরম গুরু থেকে আরেক গুরুতে সঞ্চারিত করার জন্যই আমি এই অস্ত্র তোমাকে দিয়েছি অর্জুন—তীর্থাৎ তীর্থং গময়িতুম্ অহমেতৎ সমুদ্যতঃ। খেয়াল করা দরকার, দ্রোণ এখানে অর্জুনকে অস্ত্রবিদ্যার পরবর্তী তীর্থস্বরূপ বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের তিনিই গুরু। আবারও বলছি কর্ণের কাছে গুরুতর অস্ত্রের কোনও আলাদা মূল্য নেই। অনুপযুক্ত বধূর কাছে, বংশ-পরম্পরায় নেমে আসা গয়না যেমন ঐতিহ্য অতিক্রম করে শুধুমাত্র সোনার মূল্যে ধরা দেয়, কর্ণের কাছেও তেমন সাধনার ধন পরম এবং চরম অস্ত্রটিও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার মুল্যে ধরা দেয়। দ্রোণাচার্যের ব্রহ্মাস্ত্র, পরশুরামের অমোঘ অস্ত্র—সবই তিনি চেয়েছিলেন অর্জুনের ওপর প্রতিহিংসায়। অনুপযুক্তের হাতে মারণাস্ত্র পড়লে সে যেমন পাত্ৰাপাত্র বিচার না করে স্বল্প প্রয়োজনেই তার অপব্যবহার করে, কর্ণ ঘটোৎকচের ওপর একাগ্নী প্রয়োগ করে সেই অনুপযুক্ততাই প্রমাণ করেছেন। এই অনুপযুক্ততার আরম্ভ সেই দিন থেকে, যেদিন এক কিশোর-শিষ্য দ্রোণাচার্যের কাছে অর্জুন-হত্যার মোক্ষম অস্ত্রটি চেয়েছিল। অল্পবয়স থেকেই প্রতিহিংসা-মুখর সেই কর্ণের ওপর গুরু হিসেবে দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত কী করে থাকবে?
তবু এইরকম একটি মানুষকেই মহাভারতের কবি অর্জুনের প্রথম প্রতিযোগী করে তুললেন, অস্ত্র প্রদর্শনীর আসরে। বিরাট মঞ্চ সাজানো হয়েছে। এই মুহূর্তে পাণ্ডব এবং কৌরব কিশোররা সকলেই নিজের নিজের অস্ত্রশিক্ষার ওপর যতখানি আস্থাশীল, ঠিক ততখানিই সংশয়ান্বিত। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে প্রথম ফাংশনে গান গাইবার সময় কিশোর-কিশোরীর যে দ্বিধা থাকে, কিশোর-বীরদের হয়তো সেই দ্বিধাই ছিল। বিরাট মঞ্চের একদিকে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী—সবাই বসে আছেন। ভীষ্ম প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্য আসর পরিচালনা করছেন। মহামতি বিদুর ধারাভাষ্য দিচ্ছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। আর বীরের বীর অর্জুন তাঁর অস্ত্রশিক্ষার কেরামতিও প্রায় সবটাই দেখিয়ে ফেলেছেন। মাথার ওপর কোথাও লোহার শুয়োর ঘুরছিল, অর্জুন তার মুখে পাঁচখানি বাণ একের পর এক গেঁথে রেখেছেন, কোথাও দড়িতে গরুর শিং দুলছিল অর্জুন তার ভিতর একুশটি বাণ ঢুকিয়ে রেখেছেন। এতসব কেরামতি আর চমক দেখে জ্যাঠামশাই ধৃতরাষ্ট্র যখন প্রায় স্থির করে ফেলেছেন যে, এমন বীর বোধহয় হয়নি, আর হবেও না, জননী কুন্তী যখন পুত্রগর্বে পাণ্ডব-রাজ্যের স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখুনি মঞ্চের দুয়োর থেকে তাচ্ছিল্যের হাততালি শোনা গেল। কর্ণ প্রবেশ করলেন। আমি বলব-মহাভারতের কবি কর্ণকে প্রবেশ করালেন। এই মুহূর্তে সমবেত জনগণ, দুর্যোধন এবং জননী কুন্তীর কী প্রতিক্রিয়া হল—আমি তার মধ্যে যাচ্ছি না। আমি শুধু অর্জুনের অবস্থাটা বলতে চাই। প্রবল প্রতিপক্ষের সামনে চরম অস্ত্ৰনৈপুণ্য দেখানোর পর অর্জুন যখন নিজের নৈপুণ্যে নিজেই প্রায় বিস্মিত ঠিক সেই সময়ে মহাভারতের কবি কর্ণকে এনে উপস্থিত করলেন অর্জুনের সামনে। এমন কর্ণ, যিনি গুরুশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্যের শিষ্য নন, এমন কর্ণ যিনি একা নিজের ভার নিজেই বহন করতে পারেন।
কর্ণ এসে কোনওমতে দ্রোণাচার্য আর কৃপাচার্যকে একটা সেলাম ঠুকে (কারণ দ্রোণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন) অর্জুনকে বললেন—অর্জুন তুমি যা যা কারসাজি দেখিয়েছ, তাতে অন্য লোক চমকালেও চমকাতে পারে, কিন্তু তুমি নিজে যেন চমকে যেয়ো না—মাত্মনা বিস্ময়ং গমঃ। সত্যি কথা বলতে কি—অস্ত্রের নিপুণতা তুমি যা দেখিয়েছে, আমি তার থেকে বেশি করে দেখাব। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠল—তারা মজা দেখতে চায়। অস্ত্রশিক্ষার চরম নিপুণতা দেখার পরও আরও কিছু! লজ্জা এবং ক্রোধ একসঙ্গে অর্জুনের সমস্ত সত্তা জর্জরিত করে তুলল—হ্রীশ্চ ক্রোধশ্চ বীভৎসুং ক্ষণেনাম্বাবিবেশ হ।
এতক্ষণ ধরে অর্জুনের ধৈর্য, সহ্য আর অস্ত্রনৈপুণ্যের পারম্য ঘোষণা করার পর এই যে মহাভারতের কবি অর্জুনকে লজ্জায় ফেলে দিলেন—এটা হল বাস্তবের সম্মুখীন করা। মহা-মহা বীরকে ভবিষ্যতে যে বাস্তবের সম্মুখীন হতে হবে, সেই বাস্তবকে মহাভারতের কবি অর্জুনের সামনে প্রথমেই এনে দিয়েছেন এমন একটা মুহূর্তে, যখন অর্জুন আত্মতৃপ্তির পারে এসে পৌঁছেছেন। কর্ণের মুখে নিজের কথা বসিয়ে কবি বলেছেন—তুমি নিজের কেরামতিতে নিজে বিস্মিত হয়ো না—মাত্মনা বিস্ময়ং গমঃ। কবির এও এক ধরনের মমতা, আপন-সৃষ্ট নায়কের প্রতি মমতা। যাঁরা মহাভারতের এই জায়গায় কর্ণের দাপট দেখে অভিভূত হন, তাঁরা ব্যাসের কবিহৃদয়টুকু বোঝার চেষ্টা করবেন। হ্যাঁ, এইখানে কর্ণের তেজ দেখে আপ্লুত হবার কারণ আছে। কর্ণ বলেছিলেন—অর্জুন তুমি যা যা করে দেখিয়েছ, তা সবই, এমনকী তার চেয়ে বেশি আমি করে দেখাব পার্থ যত্তে কৃতং কর্ম বিশেষবদহং ততঃ। করিষ্যে…। কর্ণ সব করেও দেখালেন। দ্রোণাচার্যও কর্ণকে তাঁর অস্ত্রকৌশল দেখানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন, কারণ সার্থক গুরু হিসেবে তিনি জানেন যে, অর্জুনকে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতেই হবে। এইখানে মহাকাব্যের কবির ক্ষমতা। তিনি বুঝিয়ে দিলেন—এতদিন ধরে অস্ত্রগুরুর আসন থেকে দ্রোণাচার্য যাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান দিয়ে আসছেন, অস্ত্রপরীক্ষায় যাঁকে তিনি প্রথম বলে ঘোষণা করেছেন, একনিষ্ঠ একলব্যের বুড়ো আঙুল কেটে যে-গুরু অর্জুনকে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন করে তুলেছেন, আজ পিতামহ ভীষ্ম, জ্যাঠামশাই ধৃতরাষ্ট্র এবং জননী কুন্তীর সামনে সেই অর্জুন কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। অর্থাৎ জগতে দ্রোণাচার্য ছাড়াও আরও গুরু আছে, একলব্য ছাড়াও আরও প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, দ্রোণের শিক্ষাশ্রম ছাড়াও আরও বড় একটি জায়গা আছে—যেখানে অর্জুনকে একাকী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মহাভারতের কবি। আজ এই বাহ্য-জগৎ থেকে অর্জুনকে শিক্ষা নিতে হবে। এখানে কর্ণের ক্ষমতা দেখানোতে কবির উদ্দেশ্য যতটুকু, তার থেকে অনেক বড় উদ্দেশ্য অর্জুনকে লজ্জায় ফেলে বাহ্য-জগতের সম্মুখীন করা।
কর্ণ বলেছিলেন—আমি অর্জুনের সঙ্গে সরাসরি লড়তে চাই। আর এই কথার উত্তরে অর্জুন বাচ্চা ছেলের মতো অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করে বললেন—সেধো কোথাকার! এই আসরে তোমাকে ডাকা হয়নি, তোমাকে কথা বলতে কেউ বলেনি, তবু কথা বলছ। কবি গুরুগম্ভীর করে যা অর্জুনের মুখে বলেছেন, তার মানে এই হয়। অর্থাৎ চিরকাল প্রথম হওয়া মহাবীর বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে সমকক্ষ প্রতিভার সামনে কতটা অপ্রতিভ হয়ে যেতে পারেন সেটা অর্জুনের কথা দিয়ে সপ্রমাণ করলন কবি। অর্জুনের কথার উত্তরে কর্ণ যা বললেন তার আধুনিক রূপান্তর করলে দাঁড়ায়—আরে! এতক্ষণ যে বাণের খেলা দেখাচ্ছিলি, সেই বাণের মুখে কথা বল ব্যাটা—শরৈঃ কথয় ভারত। কেন, এই আসর কি তোর বাপের সম্পত্তি, এখানে সবার অধিকার সমান—রঙ্গো’য়ং সর্বসামান্যঃ কিমত্র তব ফায়ূন। কর্ণ আরও বললেন—তোর গুরুর সামনেই আজকে তোর মাথা কাটব।
এই যে এক মুহূর্তে উপযুক্ত গুরুর সমস্ত সুশিক্ষা উড়িয়ে দিয়ে মহাবীরের সমস্ত অভিমান তাচ্ছিল্য করে কর্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন, এর মধ্যে কর্ণকে উজ্জ্বল করার থেকেও মহাকাব্যের কবি অন্তরে-অন্তরে অর্জুনকে আরও গভীর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করেছেন। কবি শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ হতে দেননি। যুদ্ধের আহ্বানে অর্জুনকে এগিয়ে যেতে অনুমতি দিয়েছেন গুরু দ্রোণাচার্য। যুদ্ধও প্রায় লেগেই যাচ্ছিল, কিন্তু কার্গের কুলশীলের তুচ্ছ বাহানায় এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত থেমে গেছে। কবি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন যুদ্ধের জন্য, কারণ তাতে কর্ণের চরিত্র উজ্জ্বল হয়; আর যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন কর্ণকে কুলেশীলে লজ্জায় ফেলে, এবং এইখানে অর্জুনের প্রতি তাঁর মমতা। তিনি তাঁকে যথেষ্ট অপ্রস্তুত করে কঠিন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করেছেন। ভাবটা এই—কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে কী হত বলতে পারি না, অর্জুন! তবে শুধু দ্রোণগুরুর অস্ত্রবিদ্যা নিয়ে অথবা শুধু গুরুর মুখে আপন শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুনে কোনও সুশিষ্য যদি আত্মতৃপ্ত হয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে, তবে সে মূখের স্বর্গে বাস করছে। জগতে অন্য আরও উপযুক্ত গুরুর সুশিষ্যরাও আছেন, তাঁদের কথা ভেবে নিজেকে তৈরি করা দরকার। অস্ত্রশিক্ষা-প্রদর্শনের চরম মুহুর্তে অর্জুনের সামনে কর্ণের অবতারণা এই কারণেই।
অর্জুনের প্রতি মহাভারতের কবির আপাত-কঠিন এই পরোক্ষ মমতাটুকু না থাকলে ঠিক পরের অধ্যায়ে মহারথী দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধকালে আমরা কর্ণকেই বিজয়ী হিসেবে দেখতাম, অর্জুনকে নয়। দ্রোণাচার্য সমস্ত কৌরব-ভাইদের এবং পাণ্ডবদের বলেছিলেন—তোমরা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জ্যান্ত বেঁধে আনবে। এই তোমাদের গুরুদক্ষিণা। লক্ষ করে দেখবেন—এই যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত থেকেই অর্জুনের মুন্সিয়ানা আরম্ভ হল। দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা দেওয়ার কথা প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গে কৌরবরা দুর্যোধনের নেতৃত্বে হই হই করে বেরিয়ে পড়লেন দ্রুপদকে শিক্ষা দিতে। এঁদের সঙ্গে মহাবার কর্ণও ছিলেন। দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণেরা—আরে আমি আগে যাচ্ছি—আরে তুমি বোসো, আমিই যথেষ্ট—এইরকম তাচ্ছিল্যে দ্রুপদের রাজ্যে ছুটলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে অজুন কী করলেন? একটুও উত্তেজনা প্রকাশ না করে, নায়কোচিত দৃঢ়তায় দ্রোণাচার্যকে বললেন—এঁদের পরাক্রম প্রকাশ করা শেষ হোক, তারপর আমরা যাব—এষাং পরাক্রমস্যান্তে বয়ং কুর্যাম সাহসম্।
এও এক ধরনের ‘হিরোয়িক আইসোলেশন’—ব্যাস কর্ণকে দুর্যোধন, দুঃশাসন জলসন্ধ অথবা যুযুৎসুর গড্ডালিকায় ভিড়িয়ে দিয়েছেন; আর অর্জুনকে রেখেছেন একা—যিনি এই মুহূর্তে বরং বলা উচিত কর্ণের সঙ্গে তাঁর প্রথম সংঘাতের পরমুহূর্ত থেকেই অন্য এক মানুষ, যিনি হঠাৎ কিছু করে বসবেন না। অর্জুনের চিন্তার কারণ তিনটি। এক, দ্রুপদের সঙ্গে কৌরব-ভাইদের আগেই একটা যুদ্ধ হয়ে গেলে দ্রুপদের ক্ষমতা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। দুই, কর্ণের দম্ভ এবং কার্যকালে তার কার্যকারিতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে সবার সামনে। তিন, একই দলে থেকে কর্ণের সঙ্গে একযোগে দ্রুপদকে আক্রমণ করার পর দ্রুপদ যদি শেষমেশ ধরাও পড়েন, তা হলে ‘ক্রেডিট’ ভাগাভাগি হয়ে যাবে। এত সব ভেবেই—পূর্বমেব তু সংমন্ত্র্য—অর্জুন এঁদের সঙ্গে গেলেন না। তিনি বুঝেছিলেন—যে উন্মাদনা নিয়ে দুর্যোধন-কৰ্ণরা লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুপদকে ধরতে গেল, অত লাফালাফি করে দ্রুপদের মতো বিরাট যোদ্ধাকে ধরা যায় না। কারণ, তিনি দ্রোণাচার্যের সতীর্থ—অস্ত্র-বিদ্যা শিখেছিলেন একই গুরুর কাছে।
অর্জুন যা ভেবেছিলেন, তাই হল। দুর্যোধন-কৰ্ণরা দ্রুপদের বাণের মুখে ভেসে গেলেন। যে ব্যক্তি কিছু কাল আগে অর্জুনকে বাণের মুখে কথা বলতে বলেছিলেন, সেই মহাবীর কর্ণ দুর্যোধন, দুঃশাসনের সঙ্গে দ্রুপদের বাণ খেয়ে পালিয়ে গেছেন। মহাভারতের কবি তাঁর জন্য পৃথক কোনও শ্লোক ব্যবহার করেননি। গুরুগৃহ, পরীক্ষা এবং প্রদর্শনীর পর কৌরব, কর্ণ এবং পাণ্ডবদের এই ছিল প্রথম এবং প্রকাশ্য যুদ্ধ, যেখানে সমস্ত কৌরব ভাইরা এবং কর্ণ অকৃতকার্য হলেন। শুধু নায়কোচিত একাকিত্বের পরিসরে যে মানুষটি নিজের মহিমায় জ্বলজ্বল করতে লাগলেন—তিনি অর্জুন। কর্ণ যা পারলেন না, অর্জুন তাই পারলেন। ভাবে বুঝি—একটু আগে যে কবি প্রতিনায়কের মহিমা প্রকাশ করে আপন সৃষ্ট নায়ককে লজ্জায় ফেলে তাঁকে দিয়ে আবোল-তাবোল বকাচ্ছিলেন, এখন ক্ষত্রিয়ের উপযুক্ত রণক্ষেত্রের মধ্যে তাঁকে সমস্ত নিন্দাপঙ্ক থেকে উদ্ধার করে আনলেন সবার সামনে। জীবনের প্রথম সত্যিকারের যুদ্ধ অর্জুন জিতে ফিরলেন, কর্ণ পারলেন না।
এই যে অর্জুন শুধুমাত্র ভীমকে সহায় করে দ্রুপদকে জ্যান্ত ধরে আনলেন দ্রোণের সামনে—এই ঘটনার আরও কতগুলি গভীর তাৎপর্য আছে। মনে রাখা দরকার—দ্রুপদের সঙ্গে যুদ্ধের পরেই দ্রোণ বুঝেছিলেন—কর্ণ অর্জুনের সমকক্ষ নন এবং কর্ণ কেন, কেউই তাঁর সমান নন—বীভৎসুসদৃশো লোকে ন্যান্যঃ কশ্চন বিদ্যতে। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার পরেই দ্রোণ তাঁকে গুরু-পরম্পরায় নেমে আসা ব্রহ্মশির অস্ত্রের গুরুত্ব সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার উপদেশ দেন। কারণ, অর্জুন-এর মধ্যে যুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধমাত্রেই তিনি ব্রহ্মশিরের কথা স্মরণে আনেননি। শুধু অস্ত্র হানা নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষত্রিয়ের পক্ষে অস্ত্রহানার সংযমও একান্ত প্রয়োজনীয়। এই সংযম দ্রোণাচার্য অর্জুনের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। তৃতীয়ত, অস্ত্র প্রদর্শনীর সময় কর্ণের আস্ফালনের পর জনসমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা একদল কর্ণকে এবং অন্যদল অর্জুনকে শ্রেষ্ঠতার আসন দিয়েছিল। কিন্তু দ্রুপদের পরাজয়ের পর সারা ভারতবর্ষে স্বাভাবিকভাবেই ধনুর্বেদে অর্জুনের অদ্বিতীয়তা চাউর হয়ে গিয়েছিল—স্বভাবাদ্ অগমচ্ছব্দে মহীং সাগরমেখলাম্। চতুর্থত, দ্রুপদ শাসনের এক বছরের মধ্যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজপদে অভিষেক করেছেন। আমি অবশ্য ‘অভিষেক করেছেন’ বলব না, বলব অর্জুনের ক্ষমতা দেখে পাণ্ডবভাইদের জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন! পঞ্চমত, যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন যে ভাবে একা একাই বিভিন্ন রাজ্য জয় করে, রাজোর সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তুললেন, তাতে হঠাৎই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মন পাণ্ডবদের ওপারেই বিষিয়ে গেল—দুষিতো সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুযু। ধৃতরাষ্ট্র বয়সে এবং ক্ষমতায় বড় হয়েও পাণ্ডবদের ঈর্ষা করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু এই সমস্ত ঘটনার মূল কারণ বস্তুত একটাই! অলৌকিকভাবে নয়, দেবতার বরে নয়, মণি-মন্ত্র-মহৌষধে নয়—সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায়, পরিশ্রম, অভ্যাস আর অভিজ্ঞতায় অর্জুন সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।