নয়
কিন্তু চুপচাপ তারা বসে থাকতে পারল না। লোকে তাকে বসে থাকতে দিল না।
দিন কুড়ি পরেই তারা বাশুলির মন্দির থেকে পূজা সেরে বাইরে এসেই চমকে গেল।
মন্দিরের সিঁড়ির সামনে জন ত্রিশেক লোক। অস্থিচর্মসার চেহারা, কোটরাগত চোখ, পথশ্রমে যেন ধুঁকছে।
তারাকে দেখেই সবাই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ে বলল, মা, আমাদের বাঁচাও!
তারা একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কে তোমরা?
আমরা রাইপুরের চাষি মা। পাঁচ কোশ পথ হেঁটে তোমার কাছে এসেছি।
আমার কাছে কেন?
তোমারই নাম শুনেছি। তুমি গরিবের মা। জমিদার আমাদের খেতের ফসল সব নিজের গোলায় আটকে রেখেছে। চালের মন দু-টাকা। কী করে আমরা বাঁচব মা বলো?
জমিদারের কাছে গিয়ে বলো তোমরা।
বলেছি মা। অনেক বলেছি। উত্তরও পেয়েছি, এই দেখো।
সামনের কয়েকজন চাষি পিছন ফিরে দাঁড়াল।
তাদের পিঠে চাবুকের রক্তাক্ত দাগ।
ইস, এইরকমভাবে মেরেছে?
এ আর কী মা। কত লোককে দিনের পর দিন ঠান্ডা গারদে পুরে রেখেছে। পরে দেহগুলো খালের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। জমিদার নয় মা, পিশাচ।
ঠিক আছে, তোমরা মাঠে বিশ্রাম করো। আমি দেখি কী করতে পারি।
চাষিরা গাছের ছায়ায় বসল। তারা চরণকে ডেকে তাদের মুড়ি আর গুড় দিতে বলল।
দুপুরের দিকে সভা বসল।
তারা বলল, এমন তো নয়, এরা কারসাজি করে আমাদের বিপদে ফেলতে চায়? কোম্পানির লোকের সঙ্গে এদের যোগসাজশ আছে।
মেঘা জিভ কাটল, না তারা-মা, সে ভয় নেই। এরা সব আমাদের জানা লোক। মধু, পচা, ফকরে, নিতাই এরা কতবার উৎসবে এসেছে নেমন্তন্ন খেতে। কালু সর্দারের আমলে অনেক খবরাখবরও এনেছে।
তাহলে তো আমাদের সামনে শুধু একটা পথ খোলা আছে।
কী? কী পথ?
রাইপুরের জমিদারের বাড়ি আক্রমণ করা।
তারপর?
তারপর গোলার চাবি নিয়ে গোলার দরজা খুলে দেব। গাঁয়ের চাষিরা ধান লুঠ করে নেবে। এতে একটা সুবিধা হবে, চাষিরাও আমাদের দলের হয়ে যাবে। কোনওরকম বাধা দেবে না।
মাটিতে লাঠি ঠুকে মেঘা বলল, খুব ভালো কথা তারা-মা। চুপচাপ বসে থেকে থেকে গা-গতরে বাত ধরে গেল। তাহলে একটা দিন ঠিক করা হোক।
চৈতন বলল, ও আর দিন দেখাদেখি কী। তারা-মায়ের কাজ সর্বদাই শুভকাজ। আর দিন দশেক পরেই অমাবস্যা। সেরাতেই বেরিয়ে পড়া যাবে।
কিন্তু একটা কথা আছে। তারা বলল।
সবাই তারার দিকে মুখ ফেরাল।
কী কথা?
কালু সর্দারের দল কখনো বিনা চিঠিতে ডাকাতি করতে যায় না। আমরা যে যাব, সেটা রাইপুরের জমিদারকে চিঠি লিখে আগে জানিয়ে দেব।
দলের সকলেই যেন একটু বিব্রত বোধ করল।
মনা বলল, আগে থেকে জানান দেওয়াটা কি ঠিক হবে? দিনকাল খারাপ, আগের দিনের কথা ছেড়ে দাও। এখন যদি জমিদার কোম্পানির সিপাইয়ের সাহায্য নেয়? বন্দুক নিয়ে সবাই ওত পেতে বসে থাকে?
তারা ভ্রূ কোঁচকাল।
যা-ই হোক, কালু সর্দারের নিয়ম ভাঙতে পারব না। বিনা চিঠিতে আমাদের দল কোথাও যাবে না। বন্দুক আমাদেরও আছে। ভয়টা কীসের?
তা-ই ঠিক হল, অমাবস্যার দু-দিন আগে চিঠি যাবে। অমাবস্যার রাত্রে দল গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে জমিদারবাড়িতে। তার আগে চৈতন আর পরান চাষিদের খবর দিয়ে দেবে, তারা যেন তৈরি থাকে।
চিঠি লেখবার সময় তারা বলল, কালিতে লিখলে চলবে না। এই দিয়ে লেখো।
পাশ থেকে বর্শার ফলা তুলে নিয়ে আস্তে আঙুলে বসিয়ে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত বইতে শুরু করল।
আঙুলটা এগিয়ে দিয়ে তারা বলল, লাল অক্ষরে লেখো চিঠি। জমিদারের পড়তে সুবিধা হবে।
ঠিক অমাবস্যার দু-দিন আগে চিঠি নিয়ে পরান ছুটল। রনপায়ে ভর দিয়ে।
তিরের ফলায় চিঠিটা আটকে ছুড়ে দেবে জমিদারের বাড়িতে।
সব ঠিক হল। কাজ শেষ করে পরান ফিরে এল।
.
রাইপুরের জমিদার পতাকী ঘোষাল। যেমন উচ্ছৃঙ্খল স্বভাব, তেমনই দুর্দান্ত প্রকৃতির। প্রজারা দু-বেলা তার মরণকামনা করে। তিন কূলে কেউ নেই। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে স্ত্রী মারা গিয়েছিল। লোকে বলে পতাকী ঘোষালই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল বউকে। তার কী একটা অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেছিল বলে।
খুব ভোরে উঠে পতাকী ঘোষাল ঘোড়ার পিঠে বেড়াতে বের হয়। অর্ধেক জমিদারিটা একবার চক্কর দিয়ে ফেরে। পথের ওপর প্রজার দেখা পেলে সপাসপ তার পিঠে চাবুক চালায়। একেবারে বিনা কারণে।
সেদিনও বেড়িয়ে বাড়িতে ফেরার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘোড়াসুদ্ধ। দেউড়ির ফটকের ওপর একটা তির গাঁথা। তিরের মুখে চিঠি।
ঘোড়া থেকে নেমে পতাকী ঘোষাল একটানে তিরটা উঠিয়ে ফেলল। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার দুটি চোখ আরক্ত হয়ে উঠল।
একজন পাইকের হাতে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে ওপরে নিজের ঘরে এসে ঢুকল।
কয়েক লাইনের চিঠি। লাল অক্ষরে লেখা। চিঠির কোণে রক্তাক্ত খাঁড়ার চিহ্ন।
যথাবিহিত সম্মানপুরঃসর নিবেদনমেতৎ,
আপনার বিশাল ধনসম্পত্তি ও দুর্দান্ত চরিত্রের কথা আমরা অরণ্যবাসী হইয়াও অবগত আছি। দুইই কিঞ্চিৎ খর্ব করার মানসে আগামী অমাবস্যা রাত্রের দ্বিতীয় যামে সানুচর আপনার গৃহে পদার্পণ করিবার বাসনা রাখি। আপনি প্রস্তুত থাকিবেন।
আমাদের ভক্তিসহ প্রণাম গ্রহণ করিবেন।
ইতি
বাশুলি-মায়ের দাসী
তারা।
.
স্পর্ধা! দাঁতে দাঁত চেপে পতাকী একটা কড়মড় শব্দ করল। মুখে-চোখে হিংস্র ভাব ফুটে উঠল।
ঠিক আছে, তুমি কত বড়ো বাশুলি-মায়ের দাসী আমিও দেখে নিচ্ছি। মেয়েছেলের এত বাড় ভালো নয়।
অমাবস্যার দ্বিতীয় যাম। অমাবস্যা হচ্ছে কাল। হাতে সময়ও কম।
দুপুরের মধ্যে পতাকী ঘোষাল জমিদারির পর পাইক-বরকন্দাজদের ডেকে পাঠাল। তারা আসতে বলল, এ জমিদারির ইমান রাখার ভার তোমাদের ওপর। ডাকাত চিঠি দিয়ে শাসিয়েছে আমার ধনসম্পত্তি লুঠ করবে। বেইজ্জত করবে। কী তোমাদের মত বলো?
সর্দার পাইকরা হাতের লাঠি তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমাদের জ্ঞান থাকতে তা হতে দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন হুজুর।
কাল মাঝরাতে ওরা হানা দেবে। সম্ভবত জমিদারবাড়িই আক্রমণ করবে। তোমরা সবাই দা, সড়কি, বর্শা নিয়ে জমিদারবাড়ি ঘিরে থাকবে। ওপরের বারান্দায় আমি নিজে থাকব বন্দুক নিয়ে। কিন্তু বরকন্দাজ রাখব একেবারে জমিদারিতে ঢোকবার মুখে। প্রথমে তারা বাধা দেবে। অবশ্য ডাকাতরা খুব চালাক। হঠাৎ কোন দিক দিয়ে আসে কিছু বলা যায় না। আমাদের সব দিকে সর্বদা হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
আবার সর্দাররা লাঠি তুলে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিল।
সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেল। পতাকী ঘোষাল একরকম নিশ্চিন্ত হল। ডাকাতদের সাধ্য নেই তার জমিদারিতে ঢোকে। তিন পুরুষে তাদের এলাকায় কোনওদিন ডাকাতি হয়নি। কেউ সাহস করেনি মাথা গলাতে।
এবার দেখা যাক বাশুলির দাসীর কতটা বিক্রম।
পরের দিন ঠিক তিনটে নাগাদ পাইক-বরকন্দাজরা চমকে দেখল অনেক দূরে ধুলো উড়িয়ে এক ঘোড়সওয়ার তিরবেগে আসছে।
পতাকী ঘোষাল লোহার আলমারি খুলে দামি অলংকারগুলো একবার মিলিয়ে নিচ্ছিল, পাইকদের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
ততক্ষণে ঘোড়সওয়ার অনেকটা কাছে এগিয়ে এসেছে। মাথার টুপি খুলে হাত নেড়ে কী বলছে। প্রখর রৌদ্রে ঘোড়সওয়ারের সুগৌর রং দেখে বোঝা গেল লোকটা ইংরেজ।
পাইক-বরকন্দাজরা তাদের হাতের অস্ত্র উদ্যত করে রেখেছিল, পতাকীর আদেশে সবাই সরে দাঁড়াল।
ঘোড়সওয়ার ফটক পার হয়ে উঠানে এসে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল।
পতাকী ঘোষালও সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে।
ঘোড়সওয়ার টুপিটা বুকের কাছে রেখে অভিবাদন করে বলল, আপনি কি রাইপুরের জমিনদার?
পতাকী ঘোষাল বলল, হ্যাঁ সাহেব।
আমি কলভিন। মহামান্য ইংরেজ বাহাদুরের সৈন্যবিভাগের লোক। আপনার কাছে কিছু সাহায্য প্রার্থনার জন্য আসিয়াছি।
বলুন।
দুর্গাপুর জঙ্গল ডাকাতের আস্তানা তা নিশ্চয় আপনি জানেন। এ ডাকাতরা মাঝে মাঝে আশপাশের লোকদের শান্তি নষ্ট করে। পথচারীর প্রাণনাশ করে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে।
পতাকী ঘোষাল ঘাড় নাড়ল।
আজ আমরা ডাকাতের একটি দলকে গ্রেপ্তার করিতে চাই। খোঁজ পাইয়াছি তাহারা আপনার জমিদারির দিকেই আসিতেছে।
এবার পতাকী ঘোষাল আরও কয়েক পা এগিয়ে এল। সাহেবের কাছ বরাবর। বলল, আমি আগেই খবর পেয়েছি ডাকাতরা আমার এখানেই হামলা করতে আসবে, মানে চিঠি দিয়ে তা-ই জানিয়েছে। আপনারা কি তাদের গ্রেপ্তার করেছেন?
প্রায়। তবে তাহারা দলে ভীষণ ভারী। আমাদের সৈন্য সংখ্যায় কিছু অল্প। লড়াই হইলে কী হইবে বলা যায় না। তাই আমাদের দলপতি আপনার কাছে পাঠাইলেন, আপনি আপনার লোক দিয়া সাহায্য করুন।
পতাকী ঘোষাল ব্যস্ত হয়ে উঠল।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, এ আবার একটা কথা। এতে তো আমারই লাভ। দলটাকে জব্দ করার জন্য আমিও লোক তৈরি রেখেছিলাম।
কথার শেষে পতাকী দু-হাতে তালি বাজাল। সঙ্গে সঙ্গে বল্লমধারী একজন পাইক এসে দু-হাত জোড় করে নমস্কার করল।
হুকুম করুন হুজুর।
জন দশেক পাইক এখানে রেখে বাকি সবাইকে নিয়ে সাহেবের সঙ্গে চলে যাও। যে ডাকাতের দলের আজ রাতে এখানে আসার কথা, তাদের ইংরেজের লোক আগেই আটকাতে চাইছে। তোমরা তাদের সাহায্য করবে।
পাইক আবার নমস্কার করে দলের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। সাহেব ঘোড়ার পিঠে উঠতেই তার পিছন পিছন সবাই দল বেঁধে অনুসরণ করল।
তারা পথের বাঁকে না মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পতাকী ঘোষাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে নিজের মনে খুব হেসে নিয়ে বলল, যা শত্রু পরে পরে। ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারুক, মাঝখান থেকে আমি বেঁচে যাব।
পতাকী ঘোষাল নিশ্চিন্ত মনে নিজের ঘরে ঢুকল।
.