উপন্যাস
গল্প

অরণ্য-বিভীষিকা – ৮

আট

এ জঙ্গলে ডাকাতদের তিনটে বড়ো দল আছে। নামকরা। একেবারে পুব মুখে তিলক সর্দারের দল। তিলক জাতে বিহারি। তার দলের লোক ইদানীং অনেক কমে গেছে। কোম্পানির আমল থেকেই পাইকের কাজে লেগে গেছে। আসলে তিলক ঠগি। আচমকা লোকের গলায় মোম-দেওয়া দড়ির ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে।

বর্ধমানের কাছাকাছি আছে ফটিকচরণের দল। সংখ্যায় অনেক। এদের দলেই কয়েকজন আছে, হাতে বেঁটে লাঠি, অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সেই লাঠি ঘুরিয়ে পথিকের পায়ের ওপর ছুড়ে দেয়। অব্যর্থ লক্ষ্য। পায়ের হাড় ভেঙে লোকটা সেই যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, নিজের শক্তিতে আর কোনওদিন উঠতে পারে না। চিরজীবনের মতন খঞ্জ হয়ে যায়।

দুটো দলেরই একটা বড়ো অসুবিধা, অনেক লোক একসঙ্গে এলে তখনই মুশকিলে পড়ে যায়। মোম-লাগানো দড়ির ফাঁস আর বেঁটে লাঠি, এত লোকের বেলা কার্যকরী হয় না। এ বিষয়ে তারার দলের সুবিধা অনেক বেশি।

তিনটে দল, কিন্তু একজনের সঙ্গে আর-একজনের কোনও যোগাযোগ নেই। নিজের নিজের এলাকায় সবাই স্বাধীন। কেউ কোনওদিন কারো সঙ্গে দেখা করে না।

তারা প্রথম যেন এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে চাইছে। সেইজন্যই চৈতন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল।

লোক গিয়ে কী বলবে?

একটা চিঠি দেব, সেটা দিয়ে আসবে। দুজনকে আমার সঙ্গে দেখা করার চিঠি।

দেখা করবে তোমার সঙ্গে?

দেখা করা-না-করা তাদের ইচ্ছা।

চৈতন ব্যাপারটা যেন ভালো চোখে দেখল না।

বলল, কী জানি, ওরা যদি ভাবে, আমরাই বা কেন যাব। তারাই আসুক আমাদের কাছে।

তারা মাথা নাড়ল, না, তা হয়তো ভাববে না, কারণ আমি মেয়েছেলে। আমার মনে হয় ওরা আসতে কোনও দ্বিধা করবে না। তুমি বুঝছ না, চৈতন, এই সময় আমাদের একজোট হতে হবে। কোম্পানির লোকেরা যেমন আমাদের উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর, তেমনই আমাদেরও বাঁচবার পথ খুঁজতে হবে।

কথাগুলো তারা খুব নরম সুরেই আরম্ভ করেছিল, কিন্তু উত্তেজিত হয়ে উঠতে গলার স্বরও চড়া হয়ে গেল।

আশপাশে দলের যে কজন ছিল, তারা এসে সামনে দাঁড়াল।

মেঘা বলল, কী হল তারা মায়ি?

তারা তার সিদ্ধান্তের কথা সবাইকে বলল।

মেঘা, চরণ, মনা, সিধু দলের অন্য চাঁইরা স্বীকার করল। যুক্তিটা মন্দ নয়। ওরা যেমন একজোট হচ্ছে, তেমনি আমাদেরও একজোট হতে হবে। তা ছাড়া, এসব ব্যাপারে বেশি লোকের পরামর্শ নেওয়াও মন্দ নয়।

তারা জনমেজয়কে দিয়ে দুটো চিঠি লেখাল। দু-লাইনের চিঠি। তলায় নাম নেই, শুধু দলের প্রতীকচিহ্ন।

দলের দুজন রনপা চড়ে দু-দিকে বেরিয়ে গেল।

চিঠিতে লেখা ছিল, সামনের শনিবার বাশুলির মন্দিরের চাতালে তিনজনের সভা বসবে। সভার উদ্দেশ্য নরিশ সাহেবের ইস্তাহারের বিষয় আলোচনা করা।

পরের দিনই চর দুজন ফিরে এল। সংবাদ শুভ। তিলক আর ফটিক আসতে রাজি।

তারা ঠিক করল, সভায় সবাইয়ের থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। তারা ছাড়া দলের আর পাঁচজন চাঁই থাকবে। এ কথাও দলের দুজনকে বলে দিল, যেন জঙ্গলের পুব-পশ্চিম দু-দিকে অপেক্ষা করে। তিলক আর ফটিকচরণকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসবে।

অন্ধকার রাত। চাঁদ উঠবে একেবারে শেষের দিকে। মন্দিরের চাতালের দু-পাশে দুটো মশাল জ্বালাবার ব্যবস্থা হল। সভার শেষে আহারাদির ব্যবস্থা। ভাত আর পাঁঠার মাংস। শেষ পাতে চালতার অম্বল। তিলক বিহারি মিষ্টান্নের ভক্ত। তাই বোঁদেও রাখতে হল।

শিয়াল ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তিলক এসে হাজির। ঘোড়ার পিঠে। সঙ্গে দলের দুজন। বোধহয় পরামর্শদাতা।

অনেকক্ষণ কাটল, ফটিকের দেখা নেই। অভ্যর্থনার জন্য যাকে পাঠানো হয়েছিল, সে ফিরে এল।

তারা-মা, কই কেউ তো এল না। মশার কামড়ে দুটো পা ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। কতক্ষণ আর দাঁড়াব।

তারা চাতালের ওপর তিলকের পাশে বসে ছিল। তিলকের দিকে চেয়ে বলল, আসবে বলে তো কথা দিয়েছিল ফটিকচরণ। বিপদ-আপদ হল না তো?

বিপদ-আপদ শত্তুরের হোক।

অন্ধকারে ভারী কণ্ঠস্বরে তারা আর তিলক দুজনেই একটু চমকে উঠল।

ঝোপের পাশ থেকে লাঠি হাতে এক মূর্তি এগিয়ে এল। দু-পায়ে ন্যাকড়ার ফালি। তাতে রক্তের ছোপ। সারা মুখে কালো কালো দাগ।

লোকটা সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ে বলল, আমিই ফটিকচরণ। আসতে সামান্য দেরি হয়ে গেল।

তারা দাঁড়িয়ে উঠল, এ কী, এ অবস্থা কী করে হল?

মাথা নিচু করে পায়ের ন্যাকড়া খুলতে খুলতে ফটিক বলল, অবস্থাটা আমাকেই করতে হল। পুলিশের চর ঘুরছে। এখানে-ওখানে। কে তাদের খবর দিয়েছে মার্শাল সাহেবের দুটো পা নাকি আমিই জন্মের মতন খোঁড়া করে দিয়েছি। তাই এই রাজবেশ ধারণ করতে হল।

মুখের দাগগুলো মুছে নিয়ে ফটিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তারার দিকে চেয়ে বলল, আদেশ করো তারা মায়ি, আমাকে তলব করেছ কেন?

ফটিক উঠে তিলকের পাশে গিয়ে বসল।

তারা নরিশ সাহেবের ইস্তাহারের কথাটা দুজনকে শোনাল।

দুজনেই এর আগে শুনেছে।

ফটিক আরও গোপন কথা বলল।

এ আর কী। শুনলাম নতুন লাট হয়েছে বেন্টিঙ্ক সাহেব। কলকাতার লাট। তামা-তুলসী হাতে নিয়ে বুঝি প্রতিজ্ঞা করেছে দেশ থেকে ডাকাতদের উচ্ছেদ করবে। আমরা নাকি দেশে অশান্তির সৃষ্টি করছি। লাটের আবার এক চেলা জুটেছে শ্লিম্যান।

চেলা?

চেলা ছাড়া আর কী। নিজের তো অত সময় নেই, তাই চোর-ডাকাত খতম করার ভার দিয়েছে এই চেলাটির ওপর।

এতক্ষণে তিলক কথা বলল, তা শ্রীমান কী করে খতম করবে আমাদের?

ফটিক হাসল, শ্রীমান নয় গো শ্লিম্যান। পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে নাকি ঘেরাও করবে দুর্গাপুরের জঙ্গল। একটি প্রাণীকেও রেহাই দেবে না।

তারা বলল, একটা মতলব ঠিক করার জন্যই তোমাদের ডেকেছি। এত বড়ো জঙ্গল ঘেরাও করা তো আর মুখের কথা নয়। কোম্পানির তাঁবে এত লোক নেই। তবে আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। ফাঁদে ফেলার চেষ্টা নিশ্চয় করবে।

ফাঁদে ফেলবে কী করে? আমরা কি চিড়িয়া যে চট করে ধরা দেব?

একটা পায়ের ওপর আর-একটা পা তুলে নাচাতে নাচাতে ফটিক বলল, আমাদের ফাঁদ হচ্ছে টাকার তোড়া। টাকার লোভ দেখিয়ে না-ধরার চেষ্টা করে।

তিলক বলল, তার মানে?

মানে, হয়তো বিধবা সেজে কোম্পানির লোক তীর্থযাত্রা ভান করে এই পথ দিয়ে হাঁটবে। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লেই থান কাপড়ের তলা থেকে বন্দুক বের করবে। ঝোপঝাড় থেকে দলে দলে সিপাই আমাদের ঘিরে ধরবে।

তাহলে উপায়? তিলক হাতের লাঠিটা ঠুকতে লাগল।

উপায় হচ্ছে, যখনই লোক জানিয়ে এ পথ দিয়ে কেউ যাবে, তখনই সাবধান। লোক জানিয়ে মানে, টাকা নিয়ে অসহায় লোক যাচ্ছে এমন একটা কথা লোকের মুখে যদি রাষ্ট্র করে দেয়, যাতে আমাদের কানে আসে, তাহলেই বুঝতে হবে ভিতরে গলদ আছে। তাদের আক্রমণ না-করাই বুদ্ধির কাজ হবে।

দলের একজন ভাঁড়ে শরবত নিয়ে এসে দাঁড়াল। তারা শরবত বিলাতে বিলাতে বলল, কাজের কথা শোনো। তোমরা দুজন দু-দিকে আছ, আমি মাঝখানে। যদি গোলমাল হয় তো তোমরাই আগে টের পাবে। এমন একটা ব্যবস্থা করো যাতে গোলমালের আভাস পেলেই আমাকে খবরটা দিতে পারো। একজন যদি বিপদে পড়ে, তাহলে দলবল নিয়ে আমরা দুজন এগিয়ে যাব তার সাহায্য করতে।

খুব ভালো কথা। আমরাও একজোট হব। তেমন কিছু হলে তারা-মা আমি তোমাকে খবর দেব, তুমি খবর দেবে ফটিককে। দেখি, কোম্পানির কী সাধ্যি আমাদের শেষ করে।

মাঝরাতের পর সভা শেষ হল। তিলক আর ফটিক দুজনে দু-দিকে চলে গেল। দুজনেরই রনপা ছিল। যেতে দেরি হল না।

তারা নিজের কুঁড়েঘরে ফিরে এল।

বিছানায় শুল, কিন্তু তারার চোখে ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল। বড়ো কম ভাবনার কথা নয়। সমস্ত দলের নিরাপত্তার ভার তার ওপর। মঙ্গল-অমঙ্গল সব চিন্তা তাকেই করতে হবে। কালু সর্দার দলকে তারই হাতে তুলে দিয়ে গেছে।

কোম্পানির কর্তারা কোনওদিনই তাদের ভালো চোখে দেখেনি। এভাবে টাকাপয়সা লুঠতরাজ করলে কে-ই বা দেখে। কিন্তু মা বাশুলি জানেন, টাকাপয়সা লুঠ করেছে বটে, কিন্তু নিজের দলের জন্য সে টাকাপয়সার আর কতটুকু খরচ করেছে; বেশির ভাগই আশপাশের গাঁয়ের লোকদের জন্য খরচ করেছে। তাদের ক্ষুধা মিটিয়েছে, পরনের কাপড়চোপড় দিয়েছে, শীতের সময় গরম জামাকাপড় বিলি করেছে।

জমিদাররা যা করেনি, ইংরেজ সরকার যা করেনি, তারা তা-ই করেছে।

ভাবতে ভাবতে একসময়ে তারা ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।

দিন পনেরো-কুড়ি একেবারে চুপচাপ। লোকজন পথ চলা বুঝি বন্ধই করে দিল। যে দু-একজন গেল, তারা মোটেই লোভনীয় শিকার নয়। একেবারে নিঃসম্বল পথিক। শহরের দিকে চলেছে চাকরির সন্ধানে।

বসে বসে দলের লোকদের শরীরে প্রায় মরচে ধরার জোগাড়।

হঠাৎ এক খবর এল। খবর আনল কানা গোবিন্দ। গোবিন্দ দু-চোখেই দেখতে পায়। বরং একটু বেশিই দেখে। কী একটা গাছের আঠা মাখিয়ে মাঝে মাঝে চোখের পাতা দুটো বেমালুম জুড়ে দেয়। খুব কাছের লোকও টের পায় না। ভাবে বেচারি দৃষ্টিহীন।

গোবিন্দ খবর আনল খাস ইংরেজের তাঁবু থেকে।

এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে রানিসায়র। লোকে বলে রানির বিল। এই বিলের ধারে ধারে শীতকালে হরেক রকমের পাখি আসে। কোথা থেকে আসে কে জানে। এখানকার লোকেরা সব পাখির নামও জানি না। পাখি শিকারের লোভে শহর থেকে ছোকরা সাহেবরা আসে। বিলের পাশে তাঁবু ফেলে। পাঁচ-সাত দিক কাটিয়ে যায়। পাখি মারে। নিজেরাই পালক ছাড়িয়ে আগুনে ঝলসে খেয়ে ফেলে।

গোবিন্দ বলল, এবার প্রায় জন পাঁচেক সাহেব এসেছে। সঙ্গে ছ-টা বন্দুক। কোনওরকমে বন্দুকগুলো হাত করতে পারলেই কাজ হয়। তারার দলে বন্দুকের প্রয়োজন, সে খবর গোবিন্দ রাখত।

একটা উপায় বাতলে দাও তারা-মা। বন্দুক ক-টা তোমাদের এনে দিই।

এ কথা গোবিন্দ বলল বটে, তবে সে মনে মনে ভালো করেই জানত এ প্রায় অসম্ভব। বরং বাঘিনির কোল থেকে তার বাচ্চা টেনে আনা যেতে পারে, কিন্তু ইংরেজদের কাছ থেকে বন্দুক ফুসলে আনা কিছুতেই যাবে না।

দিনের বেলা বন্দুকগুলো তারা তো কাছে কাছে রাখেই, রাত্রিবেলা শোবার সময় মাথার কাছে তাঁবুর হুকে বন্দুকগুলো আটকে রাখে। ইংরেজদের খানসামার সঙ্গে কথা বলে গোবিন্দ এ খবর সংগ্রহ করেছে।

তারা চিন্তায় পড়ল। এতগুলো বন্দুক এত কাছে রয়েছে, অথচ পাবার কোনও পথ নেই।

দলসুদ্ধ ইংরেজদের তাঁবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, কিন্তু অতগুলো বন্দুকের মুখে কী হয় বলা যায় না। এ দেশি সিপাই হলে ভয়ের কিছু ছিল না, কিন্তু ইংরেজের বাচ্চারা শেষ পর্যন্ত লড়বে।

তারা বলল, আচ্ছা গোবিন্দ, তুমি দুপুরের দিকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করো। আমি একটু চিন্তা করে দেখি।

দুপুরের দিকে গোবিন্দ আবার এসে দাঁড়াল। তারার পাশে মেঘা, চৈতন আর মনাও ছিল। গোবিন্দকে কাছে ডেকে তারা ফিসফিস করে কিছুক্ষণ ধরে পরামর্শ করল।

গোবিন্দর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

হাসতে হাসতেই বলল, ঠিক আছে তারা-মা, আমি কাল ভোরেই সাহেবদের তাঁবুতে একবার যাব। যদি কাজ হাসিল করতে পারি, তাহলে মেঘা, চৈতন আর মনাকে বলে যাব। ওরা যেন তৈরি থাকে।

পরের দিন ভোরে গোবিন্দ যখন তাঁবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল তখন তার অঙ্গে কানা ভিখারির সাজ। হাতে খঞ্জনি।

সাহেবরা গোল হয়ে তাঁবুর সামনে মাঠের ওপরে বসে বন্দুক পরিষ্কার করছিল, গোবিন্দকে দেখে একজন বলল, এই সাঢু, একঠো গান শুনাও। ভালো গান। রাঢা-কিষ্ট গান।

সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জনিতে ঘা দিয়ে গোবিন্দ কীর্তন শুরু করে দিল।

গোবিন্দর গলা চমৎকার। যেমন মিষ্ট, তেমনই সুরেলা। সাহেবরা না বুঝলেও তালে তালে মাথা নাড়তে লাগল।

গানের শেষে গোবিন্দ কাঁধের থলি বাড়িয়ে দিল। খানসামা তাতে আলু, বেগুন, চাল ঢেলে দিল।

গোবিন্দর কিন্তু যাবার নাম নেই। সে চেপে সাহেবদের সামনে বসল।

হ্যাঁ সাহেব, তোমরা জল আনো কোথা থেকে? কোথাকার জল খাও?

কেন?

চারদিকে মহামারি শুরু হয়েছে। মায়ের দয়া, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

সাহেবরা কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। পাশে দাঁড়ানো খানসামাকে মানে জিজ্ঞাসা করল।

খানসামা বুঝিয়ে দিল মায়ের দয়া মানে বসন্ত।

এই রোগটাকে সাহেবরা যমের চেয়েও ভয় করে। প্রাণে বাঁচাই এ রোগে দুষ্কর, বাঁচলেও মুখের এমন অবস্থা হয়, রীতিমতো ভীতিপ্রদ।

এই বিল ঠেকে জল আনি। আগুনে গরম করিয়া পান করি।

এই বিল থেকে? গোবিন্দ যেন আঁতকে উঠল।

কী হইল?

আর কী হইল! বছর তিনেক আগে এখানকার জল খেয়ে জমিদারের পুরো বরকন্দাজের দল একেবারে খতম।

সাহেবরা চমকে উঠল।

জল ফুটিয়ে খেলে হবে না সাহেব, অন্য জায়গা থেকে জল আনার ব্যবস্থা করো।

সাহেবরা মুশকিলে পড়ল। কাছাকাছি কোনও বড়ো জলাশয় নেই। দু-একটা যা পুকুর আছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। শীতকালে শুকনো খটখট করছে।

উপায়!

এক কাজ করতে পারি সাহেব, তবে বেশি দিন পারব না।

কী কাজ?

আমি যে গাঁয়ে থাকি, সেখানে প্রকাণ্ড এক ইঁদারা আছে, তার জল গরম করে এনে দিতে পারি। তবে তার জন্য পয়সা চাই আমার। আর দিন তিনেকের বেশি পারব না।

ঠিক আছে। পাবে পয়সা। দিন তিনেকই তুমি নিয়ে এসো, তার চেয়ে বেশি দিন আমরা থাকবও না। শিকার মাথায় থাক।

তা-ই ব্যবস্থা হল। বাঁকের দু-ধারে কলসি বসিয়ে কলসির মুখে কলাপাতা ঢাকা দিয়ে গোবিন্দ সাহেবদের জন্য পানীয় জল এনে দিয়ে পরিশ্রমের মূল্য নিল।

তার পরের ব্যাপারটা খুবই সহজ।

রাতের অন্ধকারে মুখে কালি মেখে মেঘা, চৈতন আর মনা তাঁবুতে ঢুকল। খানসামা বাইরে ঘুমাচ্ছিল, তারই কাপড় দিয়ে গোবিন্দ তার মুখ-হাত-পা বেঁধে ফেলল।

জল পান করে সাহেবরা বেহুঁশ। ষণ্ডামার্কা তিনটে লোক তাঁবুতে ঢুকতে একবার চোখ মেলেও দেখল না।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারার অনুচরেরা সব ক-টা বন্দুক বগলদাবা করে বেরিয়ে এল। শুধু বন্দুক নয়, টেবিলের ওপর কার্তুজের বাক্স ছিল। সেগুলো আনতেও ভুল হল না।

তারা খুব খুশি। বিনা রক্তপাতে তার মতলব হাসিল হয়েছে বলে নয়, দলের শক্তি অনেক বেড়ে যাবে ছ-টা বন্দুক পেয়ে।

এতদিন তারার ভয় ছিল, খুব ভারী একটা দল প্রচুর বন্দুক নিয়ে এ পথে এলে তাদের মোকাবিলা করতে একটু অসুবিধাই হয়। ফলে সম্ভব হত না বলেই কৌশলের আশ্রয় নিতে হত।

এবার আর সে ভয় নেই, তখন তারা একটা খারাপ খবর পেল।

ইংরেজ সিপাইদের হাতে তিলক সর্দার ধরা পড়েছে। সংবাদ দিল তারই দলের একজন।

তিলক সর্দারের আস্তানার মাইল দুয়েকের মধ্যে ইংরেজ কালেক্টরের তাঁবু পড়েছিল। সঙ্গে সিপাই-বরকন্দাজ অনেক ছিল, তিলক টের পায়নি। সবাই চাষার ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করছিল।

কালেক্টর সাহেব চাঁদিনি রাতে ঘোড়ার ওপর চড়ে এদিক-ওদিক বেড়াচ্ছিল, তিলকও ওত পেতে ছিল।

সে ভেবেছিল লোকটাকে ঘায়েল করতে পারলে টাকাপয়সা বেশ কিছু পাওয়া যাবে। সাহেবরা কোথায় টাকা রাখে, তিলকের জানা। কোমরবন্ধের মধ্যে পকেট থাকে, সেখানেই সবকিছু। এমনকী রাত্রে শোবার সময়ও সাহেবরা কোমরবন্ধ খোলে না।

কালেক্টর সাহেব একটা বাঁশের বাঁশি বের করে ফুঁ দিচ্ছিল। আকাশে-বাতাসে মিষ্ট একটা সুর।

ঝোপের আড়ালে বসে তিলক দড়ির ফাঁস ঠিক করে নিয়েছিল, সাহেব কাছ বরাবর আসতেই দড়িটা মাথার ওপর ঘুরিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল।

তিলকের বরাত। এ পর্যন্ত কোনওদিন সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সবাই বলে তিলকের ফাঁসে মাছি পর্যন্ত আটকে যায়।

কিন্তু সাহেব যেন দড়ির গন্ধ পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার ঘাড় জড়িয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়েছিল। দড়িটা চাবুকের মতন সপাৎ করে পিঠের ওপর এসে পড়েছিল।

পলকের মধ্যে দড়িটা টেনে নিয়ে তিলক দ্বিতীয়বার ছোড়বার জন্য তৈরি হবার আগেই বিপদ ঘটেছিল।

ঘোড়ার পিঠে শুয়ে শুয়েই সাহেব অপূর্ব সুরে বাঁশি বাজাতে শুরু করেছিল, আর দড়ি হাতে করে তিলক সর্দার পাথরের মতন দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

আশপাশের গাছপালার পিছন থেকে ছুটে এসেছিল অন্তত পঞ্চাশজন সিপাই। সকলের হাতে উদ্যত বন্দুক। তিলকের দম নেবার পর্যন্ত সময় দেয়নি। পিঠে-বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে হাঁটিয়ে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে ঢুকিয়েছিল।

দলের আর সবাই কোথায় ছিল? তারা উদবিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করল।

অনেকেই শিকারের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। আমরা কয়েকজন কাছাকাছি ছিলাম, কিন্তু অতগুলো বন্দুকের সামনে কী করব?

তারপর?

তারপর সর্দারকে ছই-ঢাকা গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে শহরের দিকে নিয়ে চলে গেল। দলের সব লোক এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ল। আমরা জন দশেক এখনও আছি। কিন্তু মুণ্ড ছাড়া ধড় আর কী করবে বলো? চুপচাপ বসে রয়েছি। আমাদের তোমার দলে নিয়ে নাও তারা-মা।

তারা খুব চিন্তিত ছিল। কোনও উত্তর দিল না।

লোকটা বলল, একটা খবর পেয়েছি।

কী?

সাহেবটা কালেক্টর নয়, অন্য কী একটা নাম।

মেঘা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, বুঝেছি, বুঝেছি, ওই হচ্ছে ছিরিমান।

তারা মুচকি হাসল, ছিরিমান নয়, শ্লিম্যান।

সে আবার কে?

লাটসাহেবের লোক আমাদের খতম করার প্রতিজ্ঞা করেছে। তিলক সর্দার গেল। বাকি রইলাম আমি আর ফটিকচরণ।

চৈতন বলল, এবার থেকে আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে তারা-মা। কিছুদিন না হয় চুপচাপ বসে থাকব। শিকারের লোভ করে দরকার নেই। কোথায় কোম্পানি কী ফাঁদ পেতে রাখবে বলা যায়।

তারা সায় দিল। বলল, সত্যি এখন কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকাই ভালো। দলের যারা নিজেদের গাঁয়ে ফিরে যেতে চায় যাক। দরকার হলে ডেকে নেব।

এখন আমাদের কিছুদিন চুপচাপ থেকে সাহেবদের হালচাল লক্ষ করে যাওয়া উচিত। একজনকে যখন ধরেছে, তখন মনে হয়, ওরা এদিকেও জাল বিছোবার চেষ্টা করবে।

.